#হামিংবার্ড
#পর্ব_২৩
#তাসমিয়া_তাসনিন_প্রিয়া
অরার সহজসরল স্বীকারোক্তি। হঠাৎ করে আরিশ অরার গাল টেনে দিলো। হকচকিয়ে গেলো অরা।
” ভালো করেছ। ”
” আপনি কী করলেন, এই মাত্র? ”
অরার চোখমুখ দেখে ভীষণ হাসি পাচ্ছে আরিশের।
” কী করলাম? ”
” আমার গাল টেনে দিলেন! ”
” হ্যাঁ দিলাম। ”
” আমি কি বাচ্চা? ”
” অবশ্যই। আমার জন্য বাচ্চাই তুমি, বাচ্চা বউ একটা। ”
” আচ্ছা আপনি আমাকে হামিংবার্ড বলে ডাকেন কেনো? আপনার তুলনায় দেখতে ছোটো বলে?”
অরা পিটপিট করে তাকিয়ে আছে আরিশের দিকে। আরিশ বসা থেকে উঠে ওয়ারড্রবের দিকে অগ্রসর হলো। অরাও চুপচাপ নিজের জায়গায় বসে আছে। আরিশ জামাকাপড় পরতে পরতে বলে,
” বুদ্ধিমতী মেয়ে। ”
মুচকি হাসল অরা। বলল,
” তালহা ভাই বলছিলেন, কাজকর্ম শেষ করে ফিরবেন বলে লেট হয়েছে। আসলেই কি তাই? অফিসে ছিলেন?”
অরার প্রশ্নটা শুনেই হঠাৎ করেই আরিশের চোখেমুখের ভঙ্গি বদলে গেল । তার দৃষ্টি হিংস্র হয়ে উঠল, ঠোঁটটাও কেঁপে উঠল রাগে। এক পলকেই কাছে এসে অরার গাল চেপে ধরল সে। অরার চোখে পানি চলে এলো যন্ত্রণায়। কী এমন জিজ্ঞেস করেছিল সে, যার জন্য এমন প্রতিক্রিয়া দরকার ছিল?
” তালহার থেকে দূরে থাকতে বলেছি, না? কেনো কথা বলেছ? আমার আসতে দেরি হওয়ার কারণ জানার থাকলে আমাকে কল করে নিতে। তালহার কাছে কেনো? এটা অপ্রয়োজনীয় বাক্যালাপ ছিলো হামিংবার্ড। ”
অরা গালে, মুখে ব্যথা পাচ্ছে। আর আরিশের আচরণে অবাকও হচ্ছে। এইতো কতো সুন্দর করে কথা বলছিল লোকটা, চোখের পলকে এভাবে বদলে গেলো কীভাবে?
” আমার ব্যথা লাগছে। প্লিজ ছাড়ুন! আমি জিজ্ঞেস করিনি, ভাইয়া নিজে থেকে বলেছিলেন। ”
আরিশ শান্ত হতে পারছে না। রাগে শরীর কাঁপছে, কান দিয়ে যেন গরম ধোঁয়া বেরুচ্ছে। অরা আরিশের এই রূপটাকে ভয় পায়, পাওয়ারই কথা। এমন অস্বাভাবিক রাগ কেউই সহ্য করতে পারে না৷ আরিশ অরাকে ওভাবেই বিছানায় শুইয়ে দিল। অরার মনে হচ্ছে ওর মুখের হাড্ডি-গুড্ডি ভেঙেই যাবে আজ। ওর শরীরের ওপর কিছুটা ঝুঁকল আরিশ।
” অহেতুক কখনো তালহার সাথে কথা বলবে না৷ ”
” বলব না। ”
অরার চোখ থেকে কয়েক ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়লো। হুঁশ ফিরলো আরিশের। হাত সরিয়ে নিলো ওর গাল থেকে। ঘনঘন নিঃশ্বাস ফেলে নিজেকে স্বাভাবিক করার চেষ্টা করছে অরা। মেয়েটার এমন অবস্থা দেখে অপরাধবোধ অনুভব হচ্ছে আরিশের। সে অরার গালে আলতো করে চুমু খেলো কয়েকটা, হাত দিয়ে আস্তে আস্তে আদর করে দিতে লাগলো । অরা চুপচাপ আরিশের চোখের দিকে তাকিয়ে শুয়ে আছে। একবার মনে হচ্ছে এই মানুষকে নিয়ে সংসার করা যায় না , আবার মনে হচ্ছে মানুষটা যতই হিংস্র হোক– তার ভেতর একটা নরম মনের মানুষ বিরাজ করে। পরিস্থিতি, সময়, কিছু মানুষের অবহেলা তাকে এরকম তৈরি করেছে।
” আম সরি, লিটল বার্ড। সরি!”
দু’হাতে গাল ধরে, কপালে কপাল ঠেকাল আরিশ। অরা ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল। আরিশের বুকটা কেমন মুচড়ে উঠল তাতে।
” আমি বুঝতে পারিনি, তুমি ভয় পাবে। এভাবে ব্যথা পাবে। ”
অরা চুপ করে আছে। আরিশ তাকে নিজের শরীরের ওপর উঠিয়ে শুইয়ে, দু’হাতে বুকে জড়িয়ে ধরল।
” পাখি? ও পাখি? কথা বলবে না?”
” না। ”
অরার কন্ঠে তীব্র অভিমান, যন্ত্রণার ছাপ স্পষ্ট। আরিশ অরার কপালে ঠোঁট ছুঁইয়ে দিলো কয়েকবার, পিঠে আলতো করে হাত বুলিয়ে দিতে লাগল।
” বললাম তো, সরি! ”
” হুটহাট কী হয় আপনার? এরকম করলে তো ভয় লাগে। ”
” আমি রাগ কন্ট্রোল করতে পারিনি। আম সরি, হামিংবার্ড। ”
” হুম। ”
” কী হুম?”
” কিচ্ছু না। ”
আরিশ অরাকে বিছানায় শুইয়ে দিল এবার, নিজের হাতের ওপর মাথা রাখল তার।
” অফিসেই ছিলাম। কাজ ছিলো। ”
” আচ্ছা। ”
চুপ করে গেলো অরা। আরিশও কিছুক্ষণ চুপচাপ রইলো। চোখাচোখি হলো দুজনের, ঠোঁটে ঠোঁট ছুঁইয়ে দিলো আরিশ। কয়েক মিনিট পর ছাড়া পেলো মেয়েটা, ঠোঁট জ্বলছে, নিঃশ্বাস ঘনঘন ফেলছে। আরিশের স্পর্শ মানেই জ্বলেপুড়ে খাক করে দেওয়া অনুভূতি।
” তোমার বর বদমেজাজী হতে পারে, চরিত্রহীন নয় হামিংবার্ড। ভালোবাসা থাকুক বা না থাকুক, তেজরিন খান আরিশ কেবল অরা মেহরীনে আসক্ত থাকবে। সুতরাং কাজেই ছিলাম, অন্য কোথাও নয়৷ ”
মুচকি হাসল অরা। আগামীকাল সাবিহাকে কিছু কথা শোনাবে বলে মনে মনে ঠিক করে নিলো সে।
” বাহ! ভালো মানুষ তো আপনি। এক নারীতে আসক্ত। ”
” মোটেও না। আমি খারাপ, জগতের সকল অন্ধকার আছে আমার মধ্যে। ”
” তাই? তো সেজন্যই কি, সব সময় এই কাইল্লা রঙ পরে থাকেন?”
আরিশ হাসল। কাইল্লা রঙ! অরা উঠে বসলো। আরিশ কনুইতে ভর দিয়ে অর্ধ শোয়া অবস্থায় বলে,
” কালো আমার পছন্দের রঙ। সব সময় রঙটা ভীষণ টানে আমাকে, সেজন্যই পরি। বিশেষ কোনো কারণ নেই। ”
” বুঝতে পেরেছি। ঘুমাতে হবে। অনেক রাত হয়েছে। ”
আরিশ অরার নাকে নাক ছুঁইয়ে ফিসফিস করে শুধালো,
” আ’ম ওয়েটিং, মাই হামিংবার্ড। অধৈর্য আমিও তোমাকে কাছে পাওয়ার জন্য ধৈর্য ধরে আছি। বুঝতে পারছ? বেশিদিন অপেক্ষা করিও না। আপাতত শুভ রাত্রি! ”
কিঞ্চিৎ লজ্জা পেলো অরা। আরিশ আর কথা না বাড়িয়ে দূরে সরে গেলো। নিজের জায়গায় শুয়ে ফোনের দিকে মনোযোগ দিলো সে। অরা কিছুক্ষণ ওভাবেই শুয়ে রইলো। আনমনে অনেক কিছু ভাবল, তারপর নিজের জায়গায় গিয়ে বসল, আরিশের দিকে তাকাল। লোকটা বড্ড নির্লজ্জ, ঠোঁটকাটা, পাগল আর সাইকো…..
” কলিংবেলটা এতোবার বাজানো লাগে? এতো সকালে কে এলো আবার!”
কলিংবেলের শব্দে সাবিহা বেজায় বিরক্ত হচ্ছে। এমনিতেই রাতে ঠিকমতো ঘুম হয়নি তার, শরীর খারাপ ছিলো একটু। তারমধ্য সকালেও ঘুমাতে পারেনি। তালহা দুষ্টমি করে ঘুম থেকে উঠিয়েছে। বড়ো ভাই হলেও তালহা প্রায়শই সাবিহার সাথে ঝামেলা করে, দুষ্টমি করে।
” আমি দেখছি গিয়ে। ”
তামান্না রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে দরজা খুলতে গেলো। নয়নাকে দেখেই হাসল সে।
” কেমন আছেন আপু?”
” আলহামদুলিল্লাহ। ভেতরে এসো তুমি। ভাবি রুমে আছে এখনও। তুমি বসো, আসো, আসো। ”
নয়নাকে নিয়ে বেশ ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়েছে তামান্না। সাবিহা আড়ালে মুখ ঝামটি দিলো। নয়না আশেপাশে নজর বুলিয়ে, সোফায় বসল। সাবিহা নিজের মতো বসে আছে। কোনো কথা নেই মুখে। নয়না বুঝতে পারছে না, সামনে থাকা আপুর সাথে কথা বলা উচিত হবে কিনা । আর নয়না জানেও না উনি কে! বাড়ির সদস্য তো নিশ্চয়ই! কুশলাদি জানতে না চাইলে কেমন একটা দেখায় না? নয়না লম্বা নিঃশ্বাস ফেলে, ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটিয়ে শুধালো,
” কেমন আছেন আপু?”
আড়চোখে তাকাল সাবিহা। নয়নার পরনে মেরুন রঙের সুতির থ্রিপিস, চুলগুলো ছাড়া, চোখেমুখে কেমন অস্থিরতা।
” ভালো। ”
সৌজন্যের খাতিরে নয়না কেমন আছে সেটাও জিজ্ঞেস করলো না সাবিহা। তবুও মুচকি হাসল নয়না। মনে মনে সাবিহাকে নিয়ে অনেক প্রশ্ন ঘুরছে ওর মনে। কথা বলতে চাইলোও কিছু না বলেই চুপচাপ রইল। সাবিহা যে নয়নার আসাতো বিশেষ খুশি হয়নি এটুকু বুঝে গেছে নয়না। অন্যদিকে, তামান্না আবার রান্নাঘরে ফিরে গিয়েছে। কিছুক্ষণ পর সিড়ি বেয়ে নামতে দেখা গেল অরাকে। বোনকে দেখা মাত্র নয়নার ঠোঁটের কোণে ঝিলিক দিল একটুখানি হাসি। অরাও বোনকে দেখে বেশ খুশি হল। নয়না উঠে দাঁড়িয়ে এগিয়ে গেল বোনের দিকে।
” কেমন আছিস নয়না? মা-বাবা কেমন আছেন?”
” সবাই আছেন,আলহামদুলিল্লাহ। তুমি কেমন আছো? ”
” ভালো আছি। চল খাবার খেতে খেতে কথা বলব। খিদে পেয়েছে খুব। ”
অরা হেসে বলল। মেয়েটা খিদে সহ্য করতে পারে না তেমন৷ নয়নাও মুচকি হাসল, বলল,
” আচ্ছা। ”
বিদ্যুৎ নেই প্রায় দশ মিনিট হয়ে গেল। এমনিতেই তীব্র গরম, তার উপর বিদ্যুৎ না থাকায় হাঁসফাঁস করছে সবাই। নয়না আর অরা ড্রইংরুমে বসে নিজেদের মধ্যে কথা বলছে, মাঝে মাঝে বিরক্তিতে কপাল ভাঁজ করে।
আরিশ নিজের রুমেই আছে। তার তেমন গরম লাগে না। ফোনের স্ক্রিনে তাকিয়ে সময় দেখে নিলো একবার সে। রাত এগারোটা পেরিয়ে গেছে। অরা এখনো রুমে আসেনি। এই কয়দিনেই অরা আরিশের অভ্যাস হয়ে গেছে। তাকে ছাড়া ঘুম আসছে না ভদ্রলোকের। অগত্যা বউকে ডাকতে ঘর ছেড়ে ড্রইং রুমের দিকে অগ্রসর হলো সে।
চাঁদনি রাতের নরম আলো ছড়িয়ে আছে চারপাশে। ছাদের এক কোণে দাঁড়িয়ে তালহা, হাতে গিটার ধরে রাখলেও আঙুলগুলো থেমে আছে কোন নিঃশব্দ সুরের অপেক্ষায়। কোন গান গাইবে বুঝতে পারছে না। গরমের জন্য তামান্নাও ধীরে ধীরে ছাদে উঠে এলো । চাঁদের আলো তার মুখে পড়ে তাকে আরও কোমল, আরও স্নিগ্ধ করে তুলেছে। কারো পায়ের শব্দে পেছনে ফিরে তাকাল তালহা। তার চোখ মুহূর্তেই আটকে গেলো তামান্নার দিকে।
” গরমে শেষ! ভাই কি গান গাইবেন? ”
তামান্না জিজ্ঞেস করলো। তালহা হুঁশে ফিরলো যেন৷ ইদানীং তামান্নাকে বেশ ভালো লাগে তার৷ কিন্তু কেনো? তামান্না তালহার দিকে তাকিয়ে আছে এখনও। তালহা কথা না বলে মুচকি হেসে গান ধরলো–
Yeh aasma tere pairon mein hai
Themeri jaan meri khairon mein hai
Tera rang hai laal dhalte suraj ka jaise
Itna khoobsurat koi lagta hai kaise
Aaja mein batao tujhe kya rakha
Maine tera naam nasha rakha
Jab jab bole mujhe lagta hai yun
Koi ragni….
Hum tujhko sanam o sanam itna chahenge
Jaise chand ko chand ko chahe chandni
চলবে,
#হামিংবার্ড
#পর্ব_২৪
#তাসমিয়া_তাসনিন_প্রিয়া
প্রাপ্তমনস্কদের জন্য উন্মুক্ত।
ড্রইং রুমে বসে আছে অরা ও নয়না। বিদ্যুৎ নেই, তাই রিচার্জেবল একটি এলইডি লাইট জ্বলছে ঘরে। এই ধরনের বাতি বিদ্যুৎ থাকলে চার্জ হয়, আর বিদ্যুৎ চলে গেলে স্বয়ংক্রিয়ভাবে জ্বলে ওঠে। সাধারণত, এমন বাতিগুলো দুই থেকে তিন ঘণ্টা পর্যন্ত আলো দিতে পারে।
” ভাইয়া এত বড়লোক, কিন্তু কারেন্ট গেলে তোমাদের এভাবে অন্ধকারে থাকতে হয় কেন আপু? ”
নয়নার প্রশ্নে থতমত খেলো অরা। ঠিকই তো বলেছে নয়না।
” এ বাড়িতে আসার পর কখনো লোডশেডিং হতে দেখিনি। তাই বিদ্যুৎ না থাকলে বিকল্প কোনো ব্যবস্থা আছে কি-না সেটাও জানি না রে। ”
বিদ্যুৎ না থাকায় চারপাশটা কেমন ভুতুড়ে ভুতুড়ে লাগছে। রিচার্জেবল বাতির আলোয় পুরো ড্রইং রুমটা ঠিকভাবে আলোকিত হচ্ছে না। তার ওপর বাইরে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে, সঙ্গে ঠান্ডা বাতাস বইছে। মনে হচ্ছে, ঝড় উঠতে যাচ্ছে বলেই বিদ্যুৎ নেই। আকাশে মেঘ করলেই যেন বিদ্যুতের সঙ্গে একটা অদ্ভুত সম্পর্ক তৈরি হয়। ঝড়ের সময় বিদ্যুৎ থাকেই না প্রায়।
সিড়ি বেয়ে নিচে নামতে নামতে দুই বোনের কথোপকথন শুনে মুচকি হাসল আরিশ। তার হাতে ফোন, পরনে হাফপ্যান্ট আর কালো রঙের টি-শার্ট।
” তালহা? এই তালহা? কোথায় তুই? ”
আচমকা আরিশের গলা শুনে নড়েচড়ে বসল দুই বোন। বসার ঘরে দাঁড়িয়ে তালহাকে ডাকছে আরিশ, কিন্তু কোথাও তালহার সাড়া নেই। অরা চুপচাপ তাকিয়ে আছে আরিশের দিকে। হাফপ্যান্টে বেশ মানিয়ে গেছে ভদ্রলোককে – মুচকি হাসল অরা।
“এই ছেলেটা গেল কোথায়! কারেন্ট নেই, অথচ ওর কোনো হেলদোল নেই!”
কোমরে হাত রেখে চারপাশে সজাগ দৃষ্টি বুলিয়ে বলল আরিশ।
নয়নাও বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে বলল,
” ভাইয়া আমি উনাকে গিটার হাতে দোতলায় যেতে দেখেছিলাম। ”
ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে আছে আরিশ। তালহা গিটার নিয়ে কোথায় যেতে পারে সেটাই ভাবছে হয়তো।
” ফোনে একবার কল করে দেখুন। নিশ্চয়ই ফোন সাথে আছে। ”
অরা বলল। আরিশ হাসল। মেয়েটার বুদ্ধি আছে।
” গুড আইডিয়া। ”
আরিশ তালহাকে কল করে ড্রইং রুমে আসতে বলল। মিনিট দশেক পর তালহা আসল, সাথে তামান্নাও ছিল। আরিশ তালহাকে নিয়ে কোথাও চলে গেল। অরা আর নয়নার সাথে এখন তামান্নাও যুক্ত হয়েছে। তিনজন একসাথে বসে আছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই সারা বাড়ি আলোকিত হয়ে গেল—জেনারেটর চালু করা হয়েছে। হাঁপ ছেড়ে বাঁচল নয়না। বোনকে বিদায় জানিয়ে ঘুমানোর উদ্দেশ্যে গেস্ট রুমের দিকে অগ্রসর হলো সে। আরিশ ফেরার পর নয়নাও ড্রইং রুম থেকে নিজের রুমের দিকে এগোল। বসে রইলো কেবল অরা।
” কোলে তুলে নিয়ে যেতে হবে? ”
আরিশের প্রশ্নে হকচকিয়ে গেলো অরা। থেমে থেমে বলল,
” কী? কোথায় নিয়ে যাবেন ? ”
” রুমে! কোলে তুলে নিয়ে যাবো?”
” না, না, না। আমি যাচ্ছি। ”
অরার এমন হাবভাব খুব ভালো লাগে আরিশের। ভীষণ ইনোসেন্ট মেয়েটা। অরা বসা থেকে উঠে দ্রুত সিঁড়ির দিকে অগ্রসর হতে চাইলে আরিশ তার সামনে গিয়ে দাঁড়াল। অরা ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে তার দিকে। দৃষ্টিতে প্রশ্ন, কী হয়েছে? আরিশ হুট করে অরাকে কোলে তুলে নিলো। অরা টাল সামলাতে দুহাত দিয়ে আরিশের গলা জড়িয়ে ধরেছে।
” লেটস গো, হামিংবার্ড। ”
অরা কিছু বলল না। আরিশ ধীরপায়ে তাকে নিয়ে সিঁড়ি বেয়ে দোতলার দিকে এগিয়ে যেতে থাকলো।
ধীরে ধীরে আবহাওয়া আরো খারাপ হচ্ছে। এতক্ষণ ঠান্ডা বাতাস বইছিল, কিন্তু এখন হঠাৎ করে বৃষ্টি পড়তে শুরু করেছে। ঝিরিঝিরি বৃষ্টির ছোট ছোট বৃষ্টির ফোঁটাগুলো বাতাসের সাথে মিশে চারপাশে এক অদ্ভুত স্নিগ্ধতা তৈরি করছে। বৃষ্টির সাথে সাথে আকাশে গর্জন শোনা যাচ্ছে, যেন প্রকৃতি তার উত্তেজনা প্রকাশ করছে। বিদ্যুৎ চমকানোর সাথে গর্জন আরও শক্তিশালী হচ্ছে, আর মনে হচ্ছে এই গর্জন কোনো কালবৈশাখী ঝড়ের আগমনের সংকেত। বাতাসের প্রবাহ আরও তীব্র হয়ে উঠছে, আর বৃষ্টির তীব্রতা বাড়তে শুরু করেছে, যেন কোনো বড় ঝড় আসছে।
অরাকে কোলে নিয়ে বেডরুমে প্রবেশ করলো আরিশ। ধীরে ধীরে অরাকে নিয়ে বিছানার দিকে যাচ্ছে সে। অরা শুধু আরিশের দিকে তাকিয়ে আছে। কেমন একটা নেশায় ডুবে যাচ্ছে অরা। রুমজুড়ে ডিম লাইটের মৃদু আলো যেন সেই নেশালো ভাবটাকে আরো তীব্র করে তুলছে।
আরিশ অরাকে বিছানায় শুইয়ে দিল। হালকা গোলাপি রঙের থ্রিপিস পরে আছে সে, চুলগুলো মেসি বান করা। আরিশ গভীর মনোযোগ দিয়ে দেখছে অরাকে। অরার কপাল, ভ্রু, চোখজোড়া, নাক, ঠোঁট, আকর্ষণীয় শরীর সবকিছুই! কোনোকিছু যেন আরিশের দৃষ্টি থেকে বাদ যাচ্ছে না আজ। অরা শুকনো ঢোক গিলল একবার। আরিশের চোখগুলো কেমন ঘোলাটে লাগছে। মনে হচ্ছে ওই চোখে অরার সর্বনাশ লুকিয়ে আছে আজ। আরিশ ঘরের দরজার দিকে এগোল, দরজা আটকানোর জন্য। অরা সেই ফাঁকে চোখ বন্ধ করে লম্বা নিঃশ্বাস ফেলল কয়েকবার। কী হচ্ছে, কিছু বুঝতে পারছে না সে। আরিশ দরজা আঁটকে দিয়ে, অরার মাথার কাছে বসল। কয়েক সেকেন্ড চুপচাপ তাকিয়ে রইলো অরার মুখপানে। বাঁধা চুলগুলো খুলে দিলো। ডানহাতের আঙুলটা অরার কপালে ছুঁলো। শিউরে উঠলো অরা। আরিশের স্পর্শ বরাবরই তীব্র, কিন্তু আজ সেটা ছিল একটু ভিন্ন—কোমল, অথচ অনুভূতি প্রবল!
” আর ইউ ওকে, হামিংবার্ড?”
” হুম। ”
” শিওর? ”
” ইয়েস।”
মুচকি হাসল আরিশ। কপালে স্পর্শ করা আঙুলটা কপাল থেকে নাকে, নাক থেকে ঠোঁটের ওপর এনে থামাল আরিশ। অরা কাঁপছে, তার ভিতরটা কেমন অদ্ভুত লাগছে। আরিশের প্রতিটি স্পর্শ, পরবর্তী স্পর্শ পাওয়ার জন্য ব্যাকুল করে তুলছে অরাকে। তারপর আরিশ আলতো করে অরার কপালে ঠোঁট ছুঁইয়ে দিলো। আবেশে চোখ বন্ধ করে ফেলল অরা। চোখ বন্ধ করতেই কিছু অনাকাঙ্ক্ষিত দৃশ্য ভেসে উঠল। আরিশের সেই হিংস্র আচরণ, প্রথম রাতের যন্ত্রণা, আকাশকে গুলি করা, সব… সবকিছু! অরার মন বদলে গেলো। চোখ মেলে তাকিয়ে কিছুটা দূরে সরে গেলো সে। আরিশ বিষয়টা বুঝতে পেরে বলল,
” কী হয়েছে? ”
” কিছু না। বাইরে ঝড় হচ্ছে, আমি এসব খুব ভয় পাই। ”
” আমি থাকতে ভয় কীসের? আমি আছি তোমার জন্য, পাখি৷ ভয় পেওনা। ”
অরার বুকটা কেমন মুচড়ে উঠলো। বাইরের ঝড়ে তার কিছু যায় আসে না, ভয়ও পায় না সে। কিন্তু সব ভয় তো আর কেবল আরিশকেই নিয়ে! যাকে নিয়ে ভয়, সংশয়—সে নিজেই বলছে, সে সবকিছু থেকে আগলে রাখবে। দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল অরা।
” আচ্ছা। ঘুমাই? ”
ভ্রু উঁচিয়ে, ঠোঁট বাঁকিয়ে হাসল আরিশ।
” ঘুমাতে ইচ্ছে করছে? ”
” হুহ্। ”
” ঠিক আছে। ”
আরিশ বিছানায় শুয়ে, দু’হাতে অরাকে আঁকড়ে ধরল। অরার দু-চোখ ছলছল করছে। ইচ্ছায় হোক কিংবা অনিচ্ছায়, বিয়ের পর থেকে এই লোকটার বুকের মধ্যে শুয়েই প্রতিটা রাত কাটে তার। অরা তো চায় এভাবেই আজীবন কাটুক, তবে স্বাভাবিকভাবে। কিন্তু আরিশের আচরণে হতাশ হয় সে। মাঝে মধ্যে যেনো আরিশ নিজের মধ্যে থাকে না। বদলে যায় হুটহাট।
সারারাত বিধ্বংসী ঝড়ের পর নতুন সকালের রোদ আকাশে একা একা উঠে আসছে, আর তা আস্তে আস্তে জানালার ফাঁক দিয়ে রুমে ঢুকে পড়ছে। রোদের আলো মিষ্টি করে ছুঁয়ে যাচ্ছে নয়নার চোখেমুখে, যেন সে নতুন করে পৃথিবীকে অনুভব করছে। বাইরের বাতাসে ঠান্ডা, ঝড়ের পর এক অদ্ভুত শীতলতা যেন নেমে এসেছে। প্রাচীরের গাছগুলো ছেঁড়া পাতায় মোড়া, কিন্তু তাদের মধ্যে নতুন পাতা গজানোর সম্ভাবনা এক স্নিগ্ধ আশায় ভরপুর। সূর্যের প্রথম আলো সেই গাছগুলোর ওপর পড়লে যেন তারা নতুন করে জীবন পায়। চারপাশে কিছু দূরে জমাট বাঁধা কুয়াশা, যে কুয়াশা ধীরে ধীরে মধুর রোদে বিলীন হচ্ছে, প্রকৃতি যেন তার ঘুম ভেঙে উঠে এসেছে।
রোদের আলো চোখেমুখে পড়তেই ঘুম ভাঙতে শুরু করল নয়নার। ঘুম ভেঙে মনে হলো, গতকাল রাতে তো জানালা বন্ধ করেই শুয়েছিল সে। তাহলে রোদ কীভাবে এলো? এসব ভাবতে ভাবতে চোখ মেলে তাকাল নয়না। অরা জানালার পাশে দাঁড়িয়ে, পর্দাগুলো সরিয়ে দিচ্ছিল। অরাকে দেখে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল নয়না। কালো থ্রিপিসে দারুণ লাগছে অরাকে।
” ঘুম ভেঙেছে?”
” উঁহু, ঘুমিয়ে আছি। ”
খিলখিল করে হেসে উঠলো দু’জন। নয়না শোয়া থেকে উঠে বসে, চুলগুলো ক্লিপ দিয়ে বেঁধে নিলো। অরা ততক্ষণে নয়নার কাছাকাছি এসে দাঁড়িয়েছে।
” ফ্রেশ হয়ে আয় আগে। তারপর ব্রেকফাস্ট করবি। ”
” তা ঠিক আছে। কিন্তু আমি কিন্তু নাস্তা করেই বাড়ি চলে যাবো। ”
অরা হেসে বলল,
” কেন? আজকেও থেকে যা। ”
” না আপু। আমি তো কালকেই চলে যেতাম। নেহাৎ ভাইয়া থাকতে বলল, না থাকলে যদি তোমাকে কিছু বলত, সেজন্য থেকে গেলাম।”
” ভালো করেছিস। আজ না হয় আমার কথায় থেকে গেলি? ”
নয়না ঠোঁট কামড়ে মুচকি হাসল। অরা নয়নার বিছানা গুছিয়ে দিচ্ছে।
” ঠিক আছে। জানো আপু, ভাইয়া যে এতটা ভালো আগে বুঝিনি। ”
” যেমন?”
” এই যে তোমাকে কত ভালোবাসে, সবকিছু খেয়াল রাখে। তবে হ্যাঁ উনার রাগটা একটু বেশি। তোমাকে বিয়ে করার জন্য যেসব করলো! ”
অরার মুখটা মলিন হয়ে গেলো। সেইদিনগুলোর কথা মনে পড়লে অশান্তি লাগে ভীষণ। তবে নয়না কী বলল? ভালোবাসে? আরিশ তো ভালোবাসায় বিশ্বাস করে না। আর না তো অরাকে ভালোবাসে…
” অনেক বলেছিস। পাকাবুড়ি একটা। চল, চল ফ্রেশ হয়ে নে। আমি গেলাম। কাজ আছে আমার। ”
অরা এসব বলতে বলতে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো। নয়না স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল, ঠোঁটের কোণে প্রসস্থ হাসির রেখা। বোন সুখে আছে – এই ভেবেই মনটা ফুরফুরে হয়ে আছে তার।
” এত আদিখ্যেতা ভাল্লাগছে না, মা। একে তো ওই মেয়েটাকে নিয়ে বাড়াবাড়ি, আর এখন এসে জুটেছে ছোটো বোন! ”
রাগে হিসহিসিয়ে বলল সাবিহা। নিজের ঘরে মায়ের সাথে বসে কথা বলছে সে। শুধুমাত্র আরিশের জন্য অরাকে কিছু করতে চেয়েও করতে পারে না সাবিহা। অরাকে একটুও সহ্য করতে পারে না সাবিহা। কবে যে মেয়েটাকে বাড়িছাড়া করবে সেই অপেক্ষায় আছে। তাসলিমা খাতুন মেয়ের কাঁধে হাত রেখে বলেন,
” শান্ত হ সাবিহা। সবুরে মেওয়া ফলে। এতো তাড়াহুড়ো করলে চলবে না৷ আর রাগ সামলে নিতে হবে। রেগে গেলে তোরই লস। ”
মায়ের কথায় যুক্তি আছে। সাবিহা দীর্ঘশ্বাস ফেলে নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করছে।
” ঠিক বলেছ, মা। ”
” হ্যাঁ। শোন, ক্ষতি করতে গেলে কাছাকাছি থাকতে হয়। দূর থেকে কারো ক্ষতি করা যায় না। সেজন্য তোকে অরার কাছাকাছি যেতে হবে, ওর সাথে ভাব জমাতে হবে। বিশ্বাস অর্জন করলেই তো আঘাত করা যায়। ”
ক্রুর হাসল সাবিহা। মায়ের কথাগুলো বেশ মনে ধরেছে তার।
” ঠিক আছে, মা। আজ থেকে সাবিহার অন্য রূপ দেখবে সবাই। বিশেষ করে অরা। ওহ সরি! অরা ভাবি!”
সাবিহার কথা শেষ হতেই তাসলিমা খাতুন ও সাবিহা একসাথে হেসে উঠলো।
চলবে,