হামিংবার্ড পর্ব-২৯+৩০

0
2

#হামিংবার্ড
#পর্ব_২৯
#তাসমিয়া_তাসনিন_প্রিয়া

গতকাল খান বাড়িতে মেহরাবের আসার কথা থাকলেও গুরুত্বপূর্ণ কাজ থাকার কারণে আসতে পারেনি সে। তাই আজ মেহরাবকে পার্টিতে ইনভাইট করতে, মেহরাবের অফিসে চলে এসেছে আরিশ। আরিশের বিয়েটা তেমন লোক জানিয়ে হয়নি বলে অরাকে কেউ চেনে না তেমন। সেজন্য আত্মীয়স্বজন ও অফিসের লোকজনকে নিয়ে বড়সড় একটা পার্টির আয়োজন করেছে আরিশ। আজ সন্ধ্যায় খান বাড়িতে পার্টি রয়েছে।

“ গরীবের ঘরে পা পড়লো তবে?”

মেহরাবের রসিকতায় মুচকি হাসল আরিশ। চেয়ার টেনে বসতে বসতে বলল সে,

“ এমনভাবে বলছিস যেন আমি বিল গেটস। “

“ তা না হলেও কোটিপতি তো বটে! “

“ তোর মনে হয় কিছু কম আছে শ্লা। “

“ শ্লা হবো কীভাবে? আমার না আছে বোন আর না আছিস তুই সিঙ্গেল। তোর বউ আছে। তারচে আমি তোকে শ্লা বলি, তোর বংশের কোনো মেয়েকে গছিয়ে দে আমাকে। “

“ তুই আর ভালো হলি না, মেহরাব। “

“ এহহ! আসছে আমার সাধুপুরুষ। “

টেবিলের ওপর রাখা কফির কাপের দিকে ইশারা করল মেহরাব। মুচকি হেসে কফির কাপ হাতে নিলো আরিশ। দু’জনে কফি খেতে খেতে গল্প চালিয়ে গেল—কথাগুলো কখনও হালকা, কখনও গাঢ়, কফির মতোই কড়া আর উষ্ণ।

দুপুর গড়িয়ে বিকেল হতে চলেছে। খান বাড়ির গেট পেরিয়ে বাইরে বেরিয়ে এলো কালো রঙের লেক্সাস এলএক্স৫৭০। আরিশ ও অরা সাইক্রিয়াটিস্টের কাছে যাচ্ছে। গতকাল থেকেই অরা আরিশকে ডাক্তারের কাছে যাওয়ার জন্য অনুরোধ করছিল। বউয়ের মনের শান্তির জন্য অবশেষে আজ ডাক্তারের কাছে যেতে রাজি হয়েছে আরিশ।

সন্ধ্যায় তাদের বাড়িতে একটি গুরুত্বপূর্ণ পার্টি রয়েছে, অথচ এখন তাকে যেতে হচ্ছে মনোরোগ বিশেষজ্ঞের কাছে! তবে বাড়ির সবকিছু দেখাশোনার জন্য তালহা আছে, সাথে নবনীতা আর শেখরও। বাড়িঘর সাজানোর জন্য ইভেন্ট ম্যানেজারের সাথে যোগাযোগ রাখার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে তাদের ওপরই।

“ আচ্ছা ডাক্তার কী বলবে, বলো তো?”

গাড়ি চলছে ধীরে ধীরে, মাঝে মাঝে জ্যামের জন্য থেমেও থাকতে হচ্ছে। আরিশের এমন এক প্রশ্ন করল, যা শুনে অরা নিজেকে আর আটকে রাখতে পারল না, না হেসে পারল না সে।

“ কী হলো? হাসছ কেনো, হামিংবার্ড?”

অধৈর্য হয়ে আবারও জিজ্ঞেস করলো আরিশ। অরা বলল,

“ ডাক্তার কী বলবেন সেটা যদি আমি আগে থেকে জানতাম, তবে কি আপনাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতাম?”

কিছুক্ষণ চুপ করে রইলো ভদ্রলোক। তারপর বলল,

“ আজকাল কীসব বলছি, নিজেও জানি না । “

আরিশের এমন বোকা বোকা কাজকর্ম অরাকে ভীষণ আনন্দ দিচ্ছে। এই শান্ত মানুষটাকেই ভালো লাগে অরার। আরিশ একহাত দিয়ে গাড়ি চালাচ্ছে, অন্য হাত অরার হাতের ওপর রেখেছে। ভয়ে গলা শুকিয়ে আসছে মেয়েটার।

“ কী করছেন! যদি এক্সিডেন্ট হয়ে যায়? “

“ কিচ্ছু হবে না, পাখি। “

আরিশ টুক করে অরার ঠোঁটে কিস করলো একটা। অরা লজ্জায় অন্য দিকে ফিরে তাকাল। জানালা দিয়ে ব্যস্ত শহর দেখতে লাগলো সে।

ঘরটা শান্ত। জানালার ফাঁক গলে নরম রোদের রেখা পড়েছে আরিশের চোখেমুখে। অরা পাশে বসে আছে, হাত দুটো আঁটসাঁট করে ধরে রেখেছে নিজের কোলে। ডাক্তার মহসিন মল্লিক টেবিলের ওপারে বসে থাকা সত্ত্বেও, যেন আরিশকে ভেতর থেকে দেখতে পারছেন। চশমার পেছন থেকে তাঁর চোখদুটো স্থির, পর্যবেক্ষণশীল।

“আপনার নাম আরিশ, তাই তো?”

ডাক্তার জিজ্ঞেস করলেন, স্বরটা কোমল কিন্তু দৃঢ়।

আরিশ কেবল মাথা ঝাঁকালো। গলার কাছে একটা অদৃশ্য গিঁট বেঁধে ছিল হয়তো, কথা বেরোলো না। বাবা হারানোর পর কখনো আরিশের মনে কিছু হারানোর ভয় ছিল না। কিন্তু আজ তার অবচেতন মন ভীষণ ভয় পাচ্ছে। অরাকে হারানোর ভয়। ডাক্তার কী বলবেন সেসব শুনে অরা কীরকম প্রতিক্রিয়া দেখাবে সেই ভেবে চুপচাপ হয়ে গেছে আরিশ। অরা মাঝে মধ্যে আঁড়চোখে আরিশকে দেখছে। মানুষটাকে কখনো এমনভাবে চুপ করে বসে থাকতে দেখেনি সে।

অরা হালকা শ্বাস ফেলল, তারপর নিজেই শুরু করল,

“সবকিছু খুলে বলেছি, ডাক্তার। এখন আপনি বলুন। আমার এতটুকুই বলার ছিলো। ”

ডাক্তার চুপ করে শুনছিলেন। মাঝে মাঝে খাতায় কিছু টুকে নিচ্ছিলেন।

“আরিশ।”

ডাক্তার মহসিন মল্লিক এবার সরাসরি তার চোখে চোখ রাখলেন।

“তোমার মনের ভেতরটা যদি একটা ঘর হতো, এখন সেটা কেমন দেখাচ্ছে?”

আরিশ অনেকক্ষণ চুপ থেকে বলল,

“অন্ধকার। জানালা নেই। দরজা বন্ধ। বাইরে কেউ দাঁড়িয়ে আছে, আমি জানি… কিন্তু আমি খুলে দিতে পারছি না।”

ডাক্তারের ঠোঁটের কোণে হালকা নরম হাসি খেলল।

“বেশ, তাহলে আমরা আজ সেই দরজাটার দিকে একটু এগিয়ে যাই।”

বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে আবারও বলতে লাগলেন তিনি–

“মিস্টার আরিশ, আপনার ভেতরে অনেক রাগ। কিন্তু এই রাগটা হঠাৎ করে আসেনি। এটা অনেক পুরনো। ছোটবেলার ভাঙা স্মৃতি, অবহেলা, ভয়, আর ভালোবাসা না পাওয়ার ব্যথা- সব মিলে আপনার ভেতরে একটা অদৃশ্য আগুন জ্বলছে, যেটা আপনি কন্ট্রোল করতে পারেন না।”

মহসিন মল্লিক আরিশের দিকে তাকিয়ে আছেন,চোখে গভীর দৃষ্টি।

“আপনি হয়তো কখনো ভালোবাসা দেখেননি, কেমন হয় আদর – তা শিখতে পারেননি। আপনার মা আপনাকে মেরেছেন, আর বাবাকে অপমান করতে দেখেছেন। তাই আজ আপনি ভেবেছেন, শক্ত না হলে ভালোবাসা চলে যাবে। আপনি নিজের স্ত্রীকে ধরে রাখতে চাচ্ছেন, কিন্তু আপনি তাকে দমন করছেন। এটাকে ভালোবাসা বলে না, মিস্টার আরিশ। এটা হলো Trauma Response।”

ডাক্তার ধীরে ধীরে বলতে থাকলেন,

“আপনার মধ্যে Complex PTSD আর Attachment Disorder এর লক্ষণ রয়েছে। আপনি ভয় পান– হারিয়ে যাওয়ার, দুর্বল হয়ে পড়ার। আর সেই ভয় আপনাকে Toxic Control এ ঠেলে দিচ্ছে। আপনি পজেসিভ, কারণ আপনার ভেতরের শিশুটা এখনো ভয় পায়।”

ডাক্তার মহসিন একটু থামলেন। আরিশ ও অরা দু’জনেই উনার দিকে তাকিয়ে আছে। তিনি আবারও বলতে লাগলেন,

“আপনি অসুস্থ নন, আরিশ। আপনি আহত। কিন্তু সেই আঘাত না সারালে আপনি আরও অনেককে আঘাত করবেন। আপনি কি চাইবেন- আপনার সন্তানও একদিন আপনার মতো হয়ে উঠুক?”

ঘরটা হঠাৎ নিঃশব্দ হয়ে গেল। আরিশ নড়ল না, কিন্তু ওর চোখের কোণে চিকচিক করে উঠল জল। ও তা লুকাতে চাইল না। অনেকদিন পরে হয়তো নিজেকে লুকানোর প্রয়োজন বোধ করল না। ওর শক্ত হয়ে থাকা চোয়াল আস্তে আস্তে ঢিলে হয়ে এলো, ঠোঁট কাঁপতে শুরু করল।

অরা চুপ করে তাকিয়ে ছিল। কখন যেন ওর হাতটা আরিশের হাতের ওপর রাখল, আরিশ অরার দিকে তাকাল একবার। অরা চোখের পলক ফেলে ভরসা দেওয়ার চেষ্টা করলো। দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বলল আরিশ,

“আমি… আমি এরকম হতে চাইনি। আমি আসলে জানিই না, কিভাবে এমন হলাম।”

ডাক্তার মহসিন একটু এগিয়ে এলেন, কণ্ঠটা নরম,

“আপনি জানতেন না, ঠিক। কিন্তু এখন জানছেন। এইটা শুরু, নিজেকে চেনার, ভাঙাগুলো জোড়া লাগানোর শুরু। আপনি প্রস্তুত থাকলে – আমরা একসাথে সেটা করতে পারি।”

আরিশ এবার একবার চোখ মুছল, তারপর মাথা নিচু করে ফিসফিস করল, “আমাকে বদলাতে হবে… অরার জন্য, আমার ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য।”

ডাক্তার হালকা হাসলেন।

“তবেই আমরা আজ সত্যিকার চিকিৎসা শুরু করলাম। ”

” উনি ঠিক হয়ে যাবেন, তো?”

অরার কণ্ঠে সংশয়। ডাক্তার মহসিন মুচকি হাসলেন।

” যতটুকু সমস্যা আছে সেটা চলে যাবে। ঠিকমতো কাউন্সিলিং দরকার শুধু। কিন্তু… ”

” কিন্তু কী ডাক্তার? ”

” আপনার হাসবেন্ড এমনিতেই ওভার পজেসিভ, রাগী। এবং সেই সাথে আপনাকে ভীষণ ভালোবাসেন৷”

ডাক্তারের মুখে এমন কথা শুনে লজ্জা পেলো অরা। আরিশের ঠোঁটের কোণে হাসির রেখা ফুটে উঠেছে।

” আজ তাহলে আসছি, স্যার। বাড়িতে অনুষ্ঠান আছে। ফোনে যোগাযোগ করে, কাউন্সিলিং এর জন্য আসবো পরে। ”

” ওকে, মিস্টার আরিশ। ”

” থ্যাংক ইউ। ”

” ওয়েলকাম, ডিয়ার। ”

অরাকে নিয়ে ডাক্তারের চেম্বার থেকে বেরুলো আরিশ।

সন্ধ্যার নরম আলোয় খান বাড়ি যেন আলোয় স্নান করছে। গেট থেকে শুরু হয় চোখ ধাঁধানো রাজকীয়তা – ব্ল্যাক অ্যান্ড গোল্ড প্যালেটের ডিজাইনে তৈরি ইলেকট্রিক গেটের দু’পাশে লাগানো দামী আর্ট ইন্সটলেশন। পুরো গেটজুড়ে ফেইরি লাইট ও স্লো-মোশন LED লাইটিং, যা এক বিশেষ থিম অনুযায়ী রঙ বদলাচ্ছে।

বাড়ির মূল চত্বরে পা রাখতেই দুপাশে সারি সারি ছোট বাগানবেষ্টিত লাইট পিলার, যেগুলো স্বচ্ছ কাচের ভেতরে রাখা, আর তার মধ্যখানে জ্বলছে গন্ধযুক্ত সুগন্ধি মোমবাতি। বিশাল মার্বেলের চত্বর, মাঝখানে ওয়াটার ফাউন্টেন থেকে উঠে আসছে পানির ফোয়ারা।

” রেডি হচ্ছ না কেন?”

আরিশ পোশাক পরতে পরতে জিজ্ঞেস করলো অরাকে। বেচারি লজ্জায় অন্যদিকে তাকিয়ে আছে। কী আর করার? বর যদি এমন নির্লজ্জ হয়, তখন বউয়ের অন্য দিকে তাকিয়ে থাকা ছাড়া উপায় থাকে না।

” আপনি যান, তারপর আমি রেডি হয়ে আসছি। ”

” গুড গার্ল। সাজগোজের জন্য পার্লার থেকে লোকজন আনাতে চাইলাম, না করলে৷ এখন একা একা সামলাতে পারবে? ”

” তামান্না আপু আছে তো। ”

” তামান্নার দরকার নেই। তুমি চেঞ্জ করো। আমি সাজিয়ে দেবো। ”

অরা হকচকিয়ে গেলো। হুট করেই আরিশের দিকে তাকাল। আর তাতেই দৃষ্টি আটকে গেলো তার। আরিশের উন্মুক্ত বুকের দিকে তাকিয়ে গলা শুকিয়ে আসছে অরার। আরিশ তার দৃষ্টি পর্যবেক্ষণ করছে।

” কেমন লাগছে? নিশ্চয়ই হট?”

আরিশের কথায় বিষম খেলো অরা।

” এই কী হলো তোমার! দাঁড়াও, পানি দিচ্ছি। ”

আরিশ টি-টেবিলের ওপর থেকে পানির গ্লাস নিয়ে অরার হাতে দিলো। বেচারি কিছুক্ষণ পর শান্ত হলো।

” আপনি আসলে…..”

” বাহ! তুমি ড্যাবড্যাব করে তাকাতে পারো আর আমি বললেই দোষ? যত দোষ, আরিশ ঘোষ। ”

আরিশের এমন বাচ্চামিতে অরার খুব ভালো লাগছে।

” আপনি ঘোষ নন, খান। ”

” কথার কথা ছিলো। ”

আরিশ আচমকা অরাকে নিজের সাথে জড়িয়ে ধরল। মেয়েটা নিজেকে সামলাতে আরিশের কাঁধে হাত রেখেছে। পুরুষ মানুষের এতো সুন্দর হওয়া লাগবে কেন? দেখলেই হার্টবিট বাড়ার মতো সুন্দর না হলেও তো পারতো এই লোক! লম্বা নিঃশ্বাস ফেলল অরা।

” আপনার দেরি হয়ে যাচ্ছে, আরিশ। নিচে সবাই আপনার জন্য অপেক্ষা করছে। ”

” সেইম টু ইউ, হামিংবার্ড। আমি যাচ্ছি, তুমি দ্রুত চলে এসো। ”

কথা শেষে আরিশ অরার ঠোঁটে মৃদু কামড় বসাল । কিছু বলল না অরা। আরিশ মুচকি হেসে শার্ট পরতে লাগলো। অরা আরিশকে রুমে রেখে ওয়াশরুমের দিকে এগোল।

পার্টিতে সবাই নিজেদের মতো কথাবার্তা বলছে। তালহা অফিসের লোকজনের সাথে হেসে হেসে কথা বলছে। পরনে তার নেভি ব্লু ট্রাউজার আর ত সাথে টার্টলনেক ইননার ও ওপরে হালকা ব্লেজার।

সাবিহা এককোনায় নিজের মতো দাঁড়িয়ে আছে। পরনে তার একটা মেটালিক রঙের ফ্লোর-লেংথ গাউন, কানে স্মার্ট হুপ কানের দুল, হাতে মিনিমাল জুয়েলারি, চুল হালকা কার্ল করে এক পাশে টানা। এ শহরে তার পরিচিত কেউ নেই। লোকজনের যাওয়া-আসা দেখা ছাড়া পার্টিতে কোনো কাজ নেই। হঠাৎ সিঁড়ির দিকে নজর পড়তেই চমকাল সাবিহা। সিঁড়ি বেয়ে ধীরে ধীরে নামছে তেজরিন খান আরিশ ।

তার পরনে হাই-এন্ড ডিজাইনার ব্ল্যাক স্যুট- স্লিম ফিটেড। ভেতরেও ব্লাক শার্ট, সাথে সেইম কালারের টাই। হাতে রোলেক্স ঘড়ি। মুখজুড়ে হালকা স্টাবল দাড়ি, চুল ব্যাকসেট করা। সাবিহা নিজের চোখ ফেরাতে পারছে না। আনন্দে নাচছে তার মন। আরিশের দিকে এগোতেই যাবে এমন সময় আরিশের পেছন থেকে অরা বেরিয়ে এলো।

অরার পরনে মউভ পিংক রঙের সফট গাউন, যার কাপড় এতটাই হালকা যে বাতাসে তার পাশ ফুঁড়ে পাপড়ির মতো দুলে উঠছে। গাউনের বুকের অংশে সূক্ষ্ম লেইস আর হাতা ছিল ট্রান্সপারেন্ট ফুল স্লিভ,যার মাঝে মাঝে নরম মুক্তোর কাজ। কোমরটা একটু টাইট কাটে ফিট করা, নিচ থেকে ফ্লেয়ারড। চুল খোলা, কিন্তু পুরোটা নয়। সামনের দুটো লক একটুখানি ঘুরিয়ে তুলে পেছনে আটকানো, মাঝখানে ছোট্ট একটা পার্ল ক্লিপ। কানে ঝুলছে ছোট্ট হোয়াইট স্টোনের দুল, আর গলায় একফোঁটা ডায়মন্ডের পেনডেন্ট।

আরিশ অরার হাত ধরে রাজকীয় ভঙ্গিতে নিচে নেমে আসছে। পার্টিতে এখন সবাই শুধু মিস্টার এন্ড মিসেস খানকে দেখতে ব্যস্ত। সাবিহা রাগে ফুঁসছে। এই জমকালো আয়োজনের মধ্যমনি হিসেবে অরাকে সহ্য করতে পারছে না সে।

হাতে হাতে কাজ করে চলেছে তামান্না। আজকে তাকে-ও বেশ দারুণ লাগছে। আরিশ তামান্নার জন্যও নতুন পোশাক আনিয়েছে। তবে তামান্না বলেকয়ে সাদামাটা পোশাক আনিয়েছে। একটা সিম্পল কিন্তু স্মার্ট কুর্তি-প্যালাজ্জো সেট, ল্যাভেন্ডার কালারের। তালহা আঁড়চোখে মাঝে মধ্যে দেখছে তাকে। তবে সেটা তামান্না টের পাচ্ছে না।

অতিথিদের সাথে কথা বলছে আরিশ, পাশেই অরা দাঁড়িয়ে আছে। আরিশ সবার সাথে আলাপ করিয়ে দিচ্ছে তাকে। এরমধ্যে মেহরাব এলো। তাকে দেখেই আরিশ দরজার দিকে এগোল।

“ এত দেরি হলো কেন?”

আরিশ মেহরাবকে জড়িয়ে ধরে শুধালো। জবাবে মিষ্টি করে হাসল মেহরাব। কথা বলতে বলতে সামনের দিকে এগোল দু’জন।

“ ঢাকার জ্যাম যে কেমন, সেটা তো অজানা নয় তোর। “

“ তা ঠিক বলেছিস। “

“ ভাবি কোথায়?”

“ ওই যে, দাঁড়িয়ে আছে। চল আলাপ করবি। “

দু’জনে হাসিমুখে অরার দিকে এগোল। অরা অতিথিদের সাথে হাসিমুখে কুশল বিনিময় করে যাচ্ছে। এরমধ্যে মেহরাবকে পরিচয় করিয়ে দিলো আরিশ। দু’জনে স্বাভাবিক কথাবার্তা বলল কিছুক্ষণ। এই কিছুক্ষণের মধ্যে আরিশ বেশ কষ্ট করে নিজেকে সামলে রেখেছে। অরা অন্য কোনো পুরুষের সাথে হেসে কথা বললেও বুকে যন্ত্রণা হয় তার।

“ ভাইয়া, শোনো!”

তালহাকে ডাক দিলো সাবিহা, হাত তার জুসের গ্লাস। তালহা দ্রুত পায়ে ওর দিকে এগিয়ে গেলো।

“ হ্যাঁ,বল। “

“ অনেক কাজ করেছ। এবার একটু জুস খেয়ে নাও তো। “

বেশ মিষ্টি করে কথা বলল সাবিহা। বোনের এতো কেয়ারে তালহা বেশ খুশিই হলো। সাবিহার হাত থেকে জুসের গ্লাসটা নিয়ে ঢকঢক করে সবটুকু জুস শেষ করে ফেলল।

“ থ্যাংক ইউ বইনা৷ “

“ ওয়েলকাম, ভাইয়া। “

তালহা চলে যাওয়ার জন্য পা বাড়াতেই সাবিহা আবারও বলে উঠল,

“ ভাইয়া!”

“ কী? “

“ এই জুসের গ্লাসটা অরা ভাবিকে দিয়ে এসো না, প্লিজ? ভাবির গলা শুকিয়ে গেছে বলল। আমার একটু কাজ আছে। “

তালহা সরল মনে সাবিহার থেকে জুসের গ্লাসটা হাতে নিলো।

“ হ্যাঁ, ঠিক আছে। “

সাবিহা মুচকি হেসে অন্য দিকে হাঁটতে লাগলো।

হলরুম জুড়ে অনেক লোকজন। কেউ কেউ নিজেদের মধ্যে কথাবার্তা বলছে, কেউ আবার খাওয়াদাওয়া করছে। এমন সময় অরার চিৎকারে কিছুটা চমকাল সকলে।

“ রাগী ভূত! ও রাগী ভূত! কোথায় আপনি? আরে দেখুন না, আমার জামা আকাশে উড়ছে। “

একজন বিজনেস পার্টনারের সাথে কথা বলছিল আরিশ। আচমকা অরার এমন আচরণে থতমত খেয়ে তাকাল সে। সকলের দৃষ্টি এখন অরা অর্থাৎ আরিশ খানের স্ত্রী’র দিকে।

“ ওখানে দাঁড়িয়ে আছেন, কেনো? একটু এদিকে আসুন না, রাগী ভূত। আমার না কেমন আনন্দ আনন্দ লাগছে…..

আহা কী আনন্দ… আকাশে, বাতাসে… “

অরার অবস্থা দেখে কারোরই বুঝতে অসুবিধা হচ্ছে না, সে অতিরিক্ত ড্রিংকস করেছে। আরিশ অরার দিকে এগোচ্ছে। এককোনায় দাঁড়িয়ে মুচকি মুচকি হাসছে সাবিহা। তালহা কিছুটা দোটানায় পড়ে গেছে। তার দেওয়া জুস খেয়েই কি অরার এই হাল? না-কি এমনি ড্রিংক করেছিল?

“ পাখি, কী হয়েছে? এমন করছ কেনো? তুমি ড্রিংকস করতে গেলে কেনো?”

আরিশ অরাকে জড়িয়ে ধরে দাঁড়িয়েছে। কেউ কেউ সেদিকে না তাকিয়ে নিজেদের মধ্যে কথা বলাবলি করছে। অরা আরিশের চুলগুলো টেনে দিয়ে বলল,

“ বেশ করেছি। রাগী ভূত একটা, সব সময় রাগ করে। আমাকে ব্যথা দেয়। সব জায়গায় ব্যথা….”

আরিশ অরার মুখ চেপে ধরে। মেকি হেসে ইশারায় তালহা এবং মেহরাবকে এদিকটা সামলে নিতে বলল। তালহা ও মেহরাবও ইশারায় সম্মতি দিলো। ফলে আরিশ অরাকে কোলে তুলে নিয়ে বেডরুমের দিকে যেতে লাগলো। অরা এখনও নিজের মতো বকে যাচ্ছে। আরিশ দ্রুত ওকে নিয়ে বেডরুমে ঢুকে, বিছানায় শুইয়ে দিলো। অরার কপালে, গালে, গলায় হাত দিয়ে চেক করলো শরীর ঠিক আছে কি-না। তারপর আরিশ দূরে সরতে গেলে অরা তার হাত ধরে ফেলল। পিটপিট করে তাকিয়ে বলল,

“ আমাকে ছেড়ে যাবেন না। আমার সাথে থাকুন, রাগী ভূত। “

আরিশ ফিক করে হেসে উঠল। রাগী ভূত! কী অদ্ভুত একটা নাম! মনে মনে তাহলে এসব বলে ডাকে অরা? আরিশ বেশ মজা পেলো তাতে। কিন্তু কথা হলো, এত হাই ডোজের এলকোহল কেনো পান করলো অরা?

“ থাকুন, না?”

“ আমি আছি, হামিংবার্ড। তোমার নেশা ছাড়ানোর ব্যবস্থা করতে হবে। দুই মিনিট শুয়ে থাকো। আমি নিচে সবার উদ্দেশ্য কিছু বলে আসছি। “

“ দুই মিনিট, কিন্তু? “

“ হ্যাঁ, দুই মিনিট।”

“ পাক্কা? “

“ হ্যাঁ, শিওর। যাই?”

“ যান।”

অরার হাতে কিস করে রুম থেকে বেরিয়ে গেলো আরিশ।

চলবে,

#হামিংবার্ড
#পর্ব_৩০
#তাসমিয়া_তাসনিন_প্রিয়া

[পর্বটি রোমান্টিক। ভালো না লাগলে স্কিপ করুন।]

কখন থেকে তামান্নার পিছুপিছু ঘুরছে তালহা। কিন্তু বেচারা কথার সুযোগটা পাচ্ছে কই? তামান্না আজ তালহাকে পাত্তাই দিচ্ছে না।

“ এই তামু…. কী হয়েছে? আরে শোনো না!”

“ আমার হাতে অনেক কাজ এখন। পরে কথা শুনবো। “

তালহা অধৈর্য হয়ে গেছে। হুট করে তামান্নার সামনে গিয়ে দাঁড়াল সে। চমকাল তামান্না। তালহা একপা সামনে এগিয়ে শুধালো,

“ কী হয়েছে, বলো?”

“ আপনি একটা বোকা, মাথামোটা। “

এবার সত্যিই বোকা বনে গেলো তালহা। গলা খাঁকারি দিয়ে শুধালো,

“ শোনো তামান্না ভাটিয়া, তুমি এভাবে বলতে পারো না আমাকে। কী করেছি আমি, হ্যাঁ? “

“ কী করেননি তাই বলুন। আপনার পেত্নী মার্কা বোন জুস দিলো আর আপনি সেটা ভাবিকে দিলেন কেন? আপনি বুঝতে পারেন না, সাবিহা আপা, অরা ভাবিকে সহ্য করতে পারে না? আপনার বোন আরিশ ভাইকে পছন্দ করে। এজন্যই সব সময় ভাবিকে বিপদে ফেলতে চায়। বোকারাম কোথাকার। “

তামান্নার কথাগুলো হজম করতে কিছুটা সময় লাগলো তালহার। তবে বুঝতে অসুবিধা হলোনা। বিষয়টা নিয়ে তালহা নিজেও ভেবেছিল একবার, জুস খেয়েই অরার ওরকম হয়েছে। কিন্তু সাবিহা যে এতটা নিচ কাজ করতে পারবে সেটা ভাবনায় আনতে পারেনি তালহা।

“ আমি আসলেই বুঝতে পারিনি তামু। আমি সাবিহার সাথে কথা বলব। এভাবে অন্যের সংসারে সমস্যা সৃষ্টি করলে ওর কপালেও শনি আছে। হয় ঠিকমতো লেখাপড়া করবে নয়তো বিয়ে দিয়ে দেবো। “

তালহার কথায় তামান্না বেশ খুশি হয়েছে। মুচকি হাসল সে।

“ এবারে ঠিক আছে। “

তালহা কেশে উঠল একবার, তারপর মুচকি হাসল।

“ এখন বলো, আমি বোকারাম? “

“ মোটেও না। হ্যাঁ বুদ্ধি একটু কম কিন্তু পুরোপুরি না। “

তামান্না এ কথা বলে দ্রুত অন্যদিকে চলে গেলো। বেচারা তালহা একা একাই দাঁড়িয়ে রইলো সেখানে।

“ মেহরাব! “

আরিশের ডাক শুনে মেহরাব পিছনে ফিরে তাকাল। দেখল, আরিশ তার দিকেই এগিয়ে আসছে।

“ হ্যাঁ, বল। ভাবির কী অবস্থা এখন? “

“ আরে কোনোমতে শুইয়ে দিয়ে এলাম। তুই আর তালহা মিলে সবটা হ্যান্ডেল করে নে ভাই। “

“ ওকে, তুই রুমে যা। “

আরিশ স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। মুচকি হেসে রুমের দিকে এগোল।

একটি অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা নয়নার জীবনকে বদলে দিয়েছে চিরতরে। প্রতিদিন পাড়ার মানুষের কটাক্ষ, স্কুলের সহপাঠীদের বিদ্রুপ—সব মিলিয়ে হাঁপিয়ে ওঠে নয়না। সমাজটা যেন বরাবরই অন্যায়কারীর পাশে দাঁড়ায়, কিন্তু যে অন্যায়ের শিকার– তার জীবনটাই হয়ে পড়ে বিচারের কাঠগড়ায়। ধর্ষককে নিয়ে কেউ মুখ খোলে না, অথচ ভিক্টিমকে শুনতে হয় আজীবনের অপমান।

পড়ার টেবিলের সামনে বসে আছে নয়না, কিন্তু মনটা তার কোথাও হারিয়ে গেছে। কিছুক্ষণ আগে রোকসানা মল্লিক নয়নার ঘরের দরজায় উঁকি দিয়ে গিয়েছেন। সামনে বার্ষিক পরীক্ষা—নিয়েই বেশ উদ্বিগ্ন তিনি। মেয়ের পড়াশোনার দিকে তার নজর সবসময়ই তীক্ষ্ণ। নয়নার বাবার সঙ্গে কথা বলে একজন হোম টিউটর রাখার পরিকল্পনা করছেন রোকসানা।

“ লা লা… লা.. আআআ.. লা লা লা….”

ঘরে ঢুকেই অরার কণ্ঠে ভেসে আসা গানের সুরে থমকে গেল আরিশ। কিন্তু পরমুহূর্তেই তার দৃষ্টি স্থির হয়ে গেল এক অসম্ভব দৃশ্যের ওপর। নিজের টিশার্ট আর হাফপ্যান্ট পরে অরা দাঁড়িয়ে আছে বিছানার ওপর – চুলগুলো এলোমেলো খোলা, চোখে একধরনের নিষ্পাপ দুষ্টুমি। টলমলে পায়ে হাঁটছে, হঠাৎ বসে পড়ছে আবার হেসে উঠছে। দৃশ্যটা যেন স্বপ্ন আর বাস্তবের সীমারেখা ঘোলা করে দিচ্ছে। আরিশ গিলে ফেলল এক ঢোক নিঃশ্বাস – অরাকে এতটা মোহময়, এতটা কামনাময় আগে কখনো দেখেনি।

“ ওলে… ওলে… আমার রাগী ভূতটা এসেছে রে… “

আরিশকে দেখেই খিলখিল করে হেসে উঠল অরা। মুহূর্তেই বাস্তবে ফিরল আরিশ। দরজাটা ধীরে ধীরে টেনে বন্ধ করে দিল সে, চোখে একরকম অস্পষ্ট তাড়া। তারপর নিঃশব্দে অরার দিকে এগিয়ে গেল– বিছানার ওপরে বসে থাকা, এলোমেলো চুলের সেই উচ্ছ্বল মেয়েটার দিকে।

“ তুমি না বললে, তোমার আসতে দুই মিনিট লাগবে? এই বুঝি দুই মিনিট? আমি কি অশিক্ষিত? সংখ্যা বুঝি না? শোনো, এক.. দুই… তিন তারপর হবে নয়। তুমি নয় মিনিট লেট করেছ রাগী ভূত। “

আরিশ অরাকে ধরে আস্তে করে বিছানায় বসিয়ে দিয়ে বলল,

“ এমন ভয়ংকর পড়াশোনা কে শেখাল তোমাকে , হামিংবার্ড?”

অরার দুষ্টু হেসে এসে আরিশের কোলে চেপে বসল। দুহাতে গলা জড়িয়ে ধরে কয়েকবার ঘনঘন চোখের পলক ফেলল। আরিশ ঠিকমতো হাসতেও পারছে না, যদি তার বউ রাগ করে!

“ তুমি শিখিয়েছ, রাগী ভূত। তোমার দোষ সব। “

আরিশ ধীরে ধীরে অরাকে কোলে তুলে নিল। অরার হাত দুটো তার গলায়, আর পা দুটো শক্ত করে জড়িয়ে আছে আরিশের পিঠের চারপাশে। মেয়েটা যেন পুরোটা ভরসা করে নিজের ওজনটা তুলে দিয়েছে তার প্রিয় মানুষের ওপর। হালকা হাসিমুখে, মাঝে মাঝে কিছু ফিসফিস কথা চালাচালি, আরিশ এগিয়ে চলেছে ওয়াশরুমের দিকে।

“ ইয়েস, ম্যাডাম। সব দোষ আমার। তুমি এখন লক্ষ্মী মেয়ের মতো গোসল সেরে নাও। “

ওয়াশরুমে ঢুকে দরজা টেনে বন্ধ করে দিল আরিশ। তারপর ধীরে ধীরে অরাকে কোল থেকে নামিয়ে দাঁড় করাল। চারপাশে একবার চোখ বুলিয়ে নিল। যেন এই ঘরে প্রথমবার ঢুকেছে অরা।

অরার ভেজা চুল, এলোমেলো মুখের হাসি, আর চোখে নেশার ঝাপসা দৃষ্টি – সব মিলিয়ে মেয়েটা অসম্ভব রকমের মোহময় লাগছে। আরিশ ভেতর ভেতর টাল খাচ্ছে, ইচ্ছেগুলো যেন দম বন্ধ করে জাগতে চাইছে। কিন্তু অরা এখন পুরোপুরি হুঁশে নেই – এই ভাবনাটাই যেন তাকে থামিয়ে রাখল। নিজেকে কঠোরভাবে সামলে নিল সে।

নিজেকে বলল,

‘এখন না, আরিশ… একটুও না।’

“ তুমিও গোসল করবে?”

বাথটাবের দিকে এক পা এগিয়ে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করল অরা, একেবারে সরলভাবে। আরিশের চোখ দুটো যেন চেপে ধরেছে অরার শরীরের প্রতিটি রেখা। এলোমেলো চুল, হাঁটু অবধি পরা প্যান্ট, আর টি-শার্ট যা পেটের ওপর উঠে গেছে – এই ভঙ্গিমায় অরা যেন এক অদ্ভুত মোহ ছড়িয়ে পড়ছে। অবাক হয়ে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল আরিশ, কিন্তু কিছু বলার আগেই অরা আচমকা পানিভর্তি বাথটাবে বসে পড়লো। আরিশ কিছুটা চমকে ওঠে, শরীরে এক অদ্ভুত টান অনুভব করে।

“আরিশ বাবু? ও আরিশ বাবু? এদিকে এসো না?”

অরার গলা শুনে আরিশ ঠোঁট কামড়ে কিছুক্ষণ হেসে নিল। মাথায় একটা খুনসুটি ঘুরপাক খাচ্ছে – আগামীকাল যখন অরা আবার সব কিছু মনে করবে, তখন তার মুখটা কীভাবে বদলে যাবে, সেই ভাবনাটাই যেন তাকে আনন্দিত করছে।

“আমি বাবু?”

“ওলে… ওলে… তুমি তো বাবু না, তুমি হচ্ছ রাগী ভূত!”

অরার কথা শুনে আরিশ হেসে ফেলল – যেন অরার এই হাস্যকর ডাকেই এক রকম শিহরণ অনুভব হচ্ছে।

“ ওহ হামিংবার্ড! আর আবোলতাবোল বকতে হবে না। এসো মাথা ধুইয়ে দিচ্ছি, গোসল সেরে নিবে। ভালো লাগবে। “

আরিশ অরার মাথা ও চুল ধুয়ে দিতে এগিয়ে গেলে, অরা হঠাৎ করেই তাকে বাথটাবের ভেতর ফেলে দিল। তার চোখে-মুখে খুশির ঝিলিক, যেন অরা খুব মজা পেয়েছে। আরিশের শরীরে তীব্র উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়লো। অরার ভেজা শরীর, চুলের লকগুলো আর পানির ছোঁয়া একে অপরকে ঘিরে। অরার উন্মুক্ত পেট, স্পষ্ট বক্ষ বিভাজনের খাঁজ, আর পানির গায়ে ছিটানো স্নিগ্ধতা– সব কিছুই যেন আরিশকে এক ঝলকে অন্য জগতে নিয়ে যাচ্ছে। ফর্সা উরুর ওপর পানির ছোঁয়া তার মনোযোগ পুরোপুরি অরার দিকে টেনে নিচ্ছে । নিজেকে সামলাতে, নিজের সাথে যুদ্ধ করে যাচ্ছে আরিশ। যার ফলস্বরূপ অস্থিরতা গ্রাস করে নিচ্ছে তাকে।

“ তুমি সব সময় আমাকে ব্যথা দিয়ে আদর করো কেনো?”

অরার কথাগুলো বড্ড করুণ শোনালো। আরিশ তার দিকে মনোযোগ দিলো এবার। অরাকে কোলের ওপর বসিয়ে, জড়িয়ে ধরল সে।

“ ডাজ ইট হার্ট মোর?”

“ খুব, খুব। “

“ আমি তোমাকে আঘাত দিতে চাই না পাখি। কিন্তু আমার স্পর্শই এমন, যেখানে ছুঁই দাগ হয়ে যায়। “

“ তাহলে ছুঁতে হবে না, যাও। তুমি পঁচা। “

“ তোমার কাছাকাছি না এসে তো আমি থাকতে পারবো না, পাখি। এই যে এখন দূরে আছি, কেবল তোমার সম্মতির অপেক্ষায়। “

“ কীসের সম্মতি? “

আরিশের কপালে আঙুল ছুঁইয়ে শুধালো অরা।

“ তোমাকে নিজের করে নেওয়ার জন্য সম্মতি। “

“ না, করেছে কে?”

মুচকি হাসল আরিশ। অরার হাতটা ধরে কপাল থেকে নিচে নামিয়ে আনলো।

“ মাতাল অবস্থায় কেউই এসবে ‘না’ করে না, হামিংবার্ড। “

অরা কিছু বলল না। এক মুহূর্তের জন্য, আরিশ স্থির হয়ে রইল, কিন্তু তারপর অরার আচমকা কাছাকাছি চলে আসা তার মনোযোগ পুরোপুরি টেনে নিল। অবাক করে দিয়ে, অরা ধীরে ধীরে আরিশের ঠোঁটের দিকে এগোতে শুরু করল। শুকনো ঢোক গিলল আরিশ, যেন তার গলা আটকে এসেছে। তার হৃৎস্পন্দন দ্রুত হয়ে উঠল, যেন হৃদয় তার বুকের ভেতরটা ভেঙে বের হয়ে আসতে চাচ্ছিল। অরা এখন একদম তার ঠোঁটের কাছে, দুজনের মধ্যে একটা অবর্ণনীয় উত্তেজনা সৃষ্টি হয়েছে।

“ ডোন্ট ডু দিস, হামিংবার্ড। আই ওয়ন্ট বি অ্যাবল টু কন্ট্রোল মাইসেলফ। পরে তুুমি কষ্ট পাবে, তোমার খারাপ লাগবে। প্লিজ ডোন্ট ডু দিস। “

“ আমি এটাই করবো, রাগী ভূত। “

অরা জানে না সে আগুনে ঘি ঢালতে চলেছে। সেই আগুন যার তাপ সহ্য করার ক্ষমতা অরার নেই। আরিশ অরাকে থামাতেও পারবেনা। তার ভেতরের কামনাবাসনা তাকে অরাকে থামাতে দিচ্ছে না৷ মনে মনে চাইছে অরা তাঁকে গভীরভাবে ছুঁয়ে দিক। তারপর! অরা আরিশের ঠোঁটে নিজের ঠোঁট ছুঁইয়ে দিল। এরপর সে তার চুলগুলো শক্ত করে আঁকড়ে ধরে ঠোঁটের সমস্ত মধু পান করতে শুরু করল। আরিশ দু’বার লম্বা নিঃশ্বাস ফেলল, তারপর অরার কোমরে শক্ত করে হাত রাখল। সে নিজেকে পুরোপুরি অনুভূতিতে মগ্ন করে দিল, যেন মুহূর্তটি তার জন্য এক নতুন অনুভবের জায়গা হয়ে উঠেছে। ধীরে ধীরে ব্যথায় বিষিয়ে উঠল অরার কোমল ঠোঁট। মেয়েটা এখন সরে যেতে চাইছে কিন্তু উন্মাদ আরিশের আগ্রাসী থাবা তাকে সরতে দিচ্ছে না।

কিছুক্ষণ পর, আরিশ বুঝতে পারল, অরা এখন নড়াচড়া করছে না। বুকটা ধক করে উঠল, যেন এক মুহূর্তের জন্য সময় থেমে

গেছে। অরা জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছে। আরিশের শরীর থেমে গেল, নিঃশ্বাসের গভীরতা আরও বেড়ে গেল। তার মন দুর্বিষহ অনুভূতির মধ্যে আটকে গেল। নিজেকে সামলানো কঠিন হয়ে পড়ছে। কয়েক মিনিট এমনই বসে রইল সে, মনে মনে নিজেকে বোঝাতে চেষ্টা করছিল- এই উত্তেজনা, এই আবেগ, এসব সঠিক কিনা। মনে মনে নিজেকে অনেক কিছু বোঝাতে লাগল।

“ অরা এখন নিজের মধ্যে নেই, বেহুঁশ সে৷ এই মুহুর্তে কিছু করা সম্ভব না। এটা অন্যায়। অরা জানলে ভীষণ কষ্ট পাবে। নাহ, আরিশ! তুই যথেষ্ট বুঝদার। এমন করতে পারিস না তুই। মেয়েটা হুঁশে নেই, তাকে দেখভাল করতে হবে। “

নিজেকে নিজেই মোটিভেট করতে লাগলো আরিশ।

পার্টি শেষে সবাই যার যার বাসায় চলে গিয়েছে। বাসার লোকজনও যার যার রুমে চলে গিয়েছে, কেবল সাবিহা ড্রইংরুমে বসে আছে। মেহরাব বাসায় ফেরেনি। আরিশের সাথে দেখা করে তারপর বাসায় ফিরবে। সাবিহার দিকে তাকাতেই কিছুটা ভাবুক হয়ে গেলো মেহরাব। তারপর মনে পড়লো, কিছুক্ষণ আগে এই মেয়েটাই তালহাকে একটা জুসের গ্লাস দিয়েছিল। আর তারপর কী হয়েছে সেটা সবাই জানে। ক্রুর হাসল মেহরাব। ধীরপায়ে সাবিহার দিকে এগোতে লাগলো।

“ হেই বিউটি কুইন, একা একা বসে আছো কেনো?”

আচমকা পুরুষালি কণ্ঠ শুনে মাথা উঁচিয়ে সামনে তাকাল সাবিহা। সাদা রঙের পোশাকে শ্যামবর্ণ মেহরাবকে দারুণ লাগছে।

“ সেটা আপনাকে কেনো, বলব? হু আর ইউ?”

“ নাইস কুয়েশ্চন। না বললে, বলতে হবে না। তুমি জাস্ট আমাকে এটা বলো, অরার ড্রিংকসে তুমি এলকোহল মিশিয়েছিলে কেনো?”

চমকাল সাবিহা৷ এই ভদ্রলোক কীভাবে জানলেন সেসব? ইতস্ততভাবে বলল সাবিহা,

“ কীসব বলছেন? “

“ ভুল কিছু তো বলিনি, বিউটি কুইন। “

“ তামান্না? তামান্না? “

আরিশের আগমনে নড়েচড়ে বসল সাবিহা। মেহরাব বসা থেকে উঠে দাঁড়াল।

“ তোর জন্য অপেক্ষা করছিলাম। ভাবি কেমন আছে এখন?”

সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে এলো আরিশ। এখনও ভেজা জামাকাপড় পরে আছে সে। সমস্ত শরীর থেকে পানি পড়ছে।

“ আগের মতোই। “

“ ঠিক হয়ে যাবে। তোর এই হাল কেনো?”

“ আর বলিস না! যাগগে, সাবধানে যাস। “

“ ওকে দোস্ত। পরে দেখা হবে। “

আরিশ হাসিমুখে বিদায় দিলো মেহরাবকে। এরমধ্যে তামান্নাও ড্রইং রুমে এসে উপস্থিত হয়েছে।

“ ভাইয়া ডেকেছেন?”

“ হ্যাঁ। রুমে যা। তোর ভাবির জামাকাপড় রাখা আছে, চেঞ্জ করিয়ে দে। “

তামান্না মাথা নেড়ে দোতলার দিকে এগোল। সাবিহার ঠোঁটের কোণে মুচকি হাসি ফুটেছে। নিজের বউয়ের পোশাক চেঞ্জ করার জন্য অন্য কাউকে বলার মানে হলো নিশ্চয়ই ওদের মধ্যে স্বামীস্ত্রীর সম্পর্ক নেই। আনন্দে নাচতে ইচ্ছে করছে সাবিহার। আরিশ ধীর পায়ে দোতলায় যাচ্ছে। অরাকে অন্যভাবে দেখলে কোনোভাবেই নিজেকে সামলাতে পারতো না আরিশ৷ সেই কারণেই তামান্নাকে জামাকাপড় চেঞ্জ করতে পাঠাল।

চলবে,