#হামিংবার্ড
#পর্ব_৪০
#তাসমিয়া_তাসনিন_প্রিয়া
পাশাপাশি হাঁটছে তেজরিন খান আরিশ ও অরা মেহরিন খান। সামনেই অরার বন্ধুরা দাঁড়িয়ে আছে। অরার নজর সেদিকেই। বন্ধুদের সামনে কীভাবে যাবে সে? তাছাড়া আরিশ কি অনুমতি দেবে? কিন্তু এতগুলো মাস পর বন্ধুদের সাথে দেখা হলো, কথা না বলে কীভাবে পারবে সে? নিজেকে ধাতস্থ করে নিয়ে কিছুটা নিচু স্বরে বলল অরা,
“ একটা কথা বলবো?”
“ একটা কেন, পাখি? হাজারটা বলো, লক্ষবার বলো… কী হয়েছে? “
ফ্যালফ্যাল দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো অরা। আরিশকে ভীষণ কিউট লাগছে ওর কাছে। ওই যে রিলসে দেখা যায় না? পুকি হাসবেন্ড না জানি কী? ওরকম পুকি আরিশ। মনে মনে এসব ভেবে ফিক করে হাসল অরা। চমকাল আরিশ। বলল,
“ কী হলো, হামিংবার্ড!”
“ না… মানে কিছু না। ওই যে সামনে আমরা বন্ধুরা, একটু কথা বলে আসি?”
কথাটা বলেই মাথা নিচু করে ফেলল অরা। আরিশ সামনে তাকাল, ভালো করে সবাইকে পর্যবেক্ষণ করে নিলো একবার। আকাশকে দেখেই মেজাজ বিগড়ে গেলো তার। কিন্তু আকাশের সাথে সে যেটা করেছে সেটাও ভুল। চোখ বন্ধ করে লম্বা নিঃশ্বাস ছাড়ল আরিশ। অরা ভয়ে এখনও চুপ করে মাটিতে দৃষ্টি নিবদ্ধ করে হাঁটছে।
“ একা যাবে না। আমিও যাবো সাথে। “
মাথা তুলে তাকাল অরা। দিনদিন আরিশের আচরণে বিস্মিত হচ্ছে সে। হয়তো চিকিৎসা কাজে দিচ্ছে।
“ ঠিক আছে, চলুন। “
উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে বলল অরা। আরিশ মাথা নেড়ে সম্মতি দিলো কেবল। হাসি হাসি মুখে বন্ধুদের দিকে এগোতে লাগলো।
আরিশ ও অরাকে এগিয়ে আসতে দেখে সবাই সতর্ক হয়ে উঠলো। ভদ্রলোক সাথে আছে, অরার সাথে মনখুলে কথাও বলতে পারবে না বলে মন খারাপ লাগছে সবার। তবে এটাও স্বস্তির বিষয়, লেখাপড়া চলবে অরার। ইউনিভার্সিটিতে আসবে যখন এমনিতেই সবার সাথে কথাবার্তা লেগে থাকবে।
“ কেমন আছিস তোরা?”
সহাস্য মুখে শুধালো অরা। ঠোঁটের কোণে হাসির রেখা। আরিশ সেটাই দেখছে। বন্ধুদের সাথে কথা বলতে এসে অরা কতটা আনন্দিত হয়েছে, কিন্তু আরিশের সাথে কথা বলতে গেলে তো কখনো এমন খুশি হয় না সে।
“ আমরা সবাই ভালো আছি। “
লিজা জবাব দিলো। আরিশকে ইশারায় দেখাতে লাগলো রনি। অরা বুঝতে পারলো, তাকে কী করতে হবে। মুচকি হেসে আরিশের দিকে তাকাল সে। আরিশ অরার হাসি মুখখানা দেখে অবাক হলো বটে। কারণ আরিশের দিকে তাকিয়ে হেসেছে সে!
“ আচ্ছা আলাপ করবি চল, উনি তোদের দুলাভাই। অর্থাৎ আমার হাসবেন্ড – তেজরিন খান আরিশ। “
“ হেলো জিজু। “
আগবাড়িয়ে জিজ্ঞেস করলো লিজা৷ আরিশ আসলে খুশিতে চুপ করে আছে। অরা তাকে এভাবে পরিচয় করালো? নিজ থেকে, কোনো জোরাজোরি ছাড়াই।
“ হাই এভরি ওয়ান। “
“ হাই দুলাভাই। আপনাদের বিয়েতে দাওয়াত পর্যন্ত করলেন না, হুহ্। আমাদের বিয়েতেও দাওয়াত করবো না, আপনাদের। “
অথৈর কথায় সবাই হেসে উঠল। আরিশও মুচকি হাসল। আকাশ একটু চুপচাপ আছে অবশ্য।
“ সমস্যা নেই। বউয়ের সাথে আরো একবার বিয়ে করে নেবো। তারপর তোমাদের সবাইকে ইনভাইট করবো, ওকে?”
সবাই অবাকই হলো, আরিশের আচরণে। কারণ তার সম্পর্কে যেসব কথা শুনেছিল – আরিশ মোটেও তেমন নয়। যথেষ্ট ভালো মানুষ সে। কত সুন্দর করে কথা বলছে।
“ ঠিক আছে, ভাইয়া৷ আমি রনি….”
“ একদিন রাতে কল করেছিলে অরাকে?”
“ জি। “
“ রাতে আমার বউকে কখনো কল করবে না। বিকজ তখন আমরা ব্যস্ত থাকি। বুঝেছ?”
কিছুটা মজা করেই বলল আরিশ। সবাই হাসল। অরা ভালো করেই বুঝতে পারছে, মজার ছলে সিরিয়াস কথা বলছে লোকটা।
“ ওকে, ভাইয়া। কী রে অরা তুই এতো চুপচাপ কেন?”.
জিজ্ঞেস করলো রনি। অরা বারবার আরিশের দিকে তাকাচ্ছে। ছেলেদের সাথে কথা বলবে কি-না বুঝতে পারছে না। আরিশ অরার হাতটা শব্দ করে ধরে আছে, যেন একটু আলগা হলেও যেন ছুটে যেতে না পারে ।
“ এমনি। “
আরিশ আকাশের দিকে তাকাল হঠাৎ।
“ আকাশ?”
আঁতকে উঠল ছেলেটা। আর কেউ না জানলেও আকাশ খুব ভালো করেই আরিশকে জেনে গেছে। অরাও কিছুটা বিচলিত হলো। আরিশের হাতে চাপ দিয়ে ফিসফিস করে বলল,
“ প্লিজ ওকে কিছু বলবেন না। মাথা ঠান্ডা রাখুন প্লিজ!”
“ কানের পাশে এসে এভাবে ফিসফিস করে কথা বলছ কেন, হামিংবার্ড? তুমি কি চাও আমি এখানেই কন্ট্রোললেস হয়ে যাই?”
অরাকে কপি করে আরিশও ফিসফিস করে বলল কথাগুলো। শুকনো ঢোক গিলল অরা। আরকিছুই বলল না সে। বজ্জাত স্বভাবের লোক একটা!
“ জি। “
মৃদুস্বরে জবাব দিলো আকাশ। সবাই ভয়ে ভয়ে তাকিয়ে আছে আরিশের দিকে। আকাশের দিকে আরেকটু এগোল সে। তবে অরার হাত ছাড়লো না।
“ আম সরি ব্রো। ওইদিন ওভাবে স্যুট করা উচিত হয়নি আমার। অরার ব্যাপারে একটু বেশি বেপরোয়া আমি। “
পরিস্থিতি কেমন থমথমে হয়ে গেছে। কেউ কিছু বলছে না। আকাশ ম্লান হাসল।
“ ইট’স ওকে। আমি ভুলে গেছি ওসব। আপনিও ভুলে যান। “
বাঁকা হাসল আরিশ।
“ আমি কখনোই ভুলতে পারবোনা, আমার স্ত্রী বাড়ি থেকে পালিয়ে তার বন্ধুর কাছে চলে গিয়েছিল। ”
আরিশের কথাটা সকলকে বিব্রত করে তুলল যেন। অরা মাথা নিচু করে ফেলল। সবাইকে এভাবে চুপ করে থাকতে দেখে ফিক করে হেসে উঠল আরিশ।
“ ইট’স ওকে গাইস। কথা শেষ হলে চলো, বের হতে হবে। আমাকে অফিসে যেতেও হবে। “
শেষের কথাগুলো অরাকে উদ্দেশ্য করে বলল আরিশ।
“ চলুন। “
অরা সবাইকে হাত দিয়ে ইশারায় বায় বলে এগোতে লাগলো। পেছনে পড়ে রইলো অরার বন্ধুরা।
_________________
“ মা! ও মা!”
সন্ধ্যা বেলা। মেয়ের হাঁকডাক শুনে রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে ড্রইং রুমে এসে উপস্থিত হলেন রোকসানা মল্লিক।
“ কী হয়েছে তোর? এমন ষাঁড়ের মতো চেল্লাচিল্লি করছিস কেন?”
“ আমি ষাঁড়? “
“ কীসের জন্য ডেকেছিস সেটা বল, মা। রাতের রান্নাবান্না সব বাকি তো। “
“ আমার গনিত সাজেশন বইটা খুঁজে পাচ্ছি না, মা। “
“ তোর বই, তুই রেখেছিস– আমি তো রাখিনি। একটু খুঁজে দেখ, ঘরেই পাবি৷ “
মায়ের কথামতো হনহনিয়ে ঘরের দিকে এগোল নয়না। বইপত্র খুঁজে না পেলে মাথা গরম হয়ে যায় তার। আর রোকসানা মল্লিক ভালো করেই জানেন তার মেয়ে জিনিসপত্র সামনে থাকলেও সহজে খুঁজে পায় না। সেজন্য এসব বিষয় তেমন একটা গুরুত্ব দেননা তিনি। মায়ের কথামতো ঘরে এসে আরেক দফা বই খুঁজতে লাগলো নয়না। বালিশের নিচে পেয়েও গেলো বই। কিন্তু কথা হলো ওখানে রাখলো কে? বই নিয়ে আবারও মায়ের কাছে যেতে লাগলো সে। সোজা রান্নাঘরে এসে বলল,
“ বই পেয়েছি কিন্তু বইটা বালিশের নিচে গেলো কীভাবে? “
রোকসানা তরকারি কষাচ্ছেন। খুন্তি নাড়াতে নাড়াতে বললেন,
“ যেমন বাবা তার তেমন মেয়ে। নিজেই এখানে-সেখানে জিনিসপত্র রাখবে, খুঁজে পাবে না। আর পেলেও বলবে ওখানে গেলো কীভাবে? আমি আছি তো ঘরে – তোমাদের জিনিসপত্র সব আমিই এখানে-সেখানে রাখি। “
একনিশ্বাসে কথাগুলো বলে থামলেন রোকসানা। নয়না কিছু বললো না। মায়ের সাথে কথা বলা যাবে না এখন। আবহাওয়া গরম এখন। নিঃশব্দে রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে গেলো সে।
ড্রেসিং টেবিলের সামনে চেয়ারে বসে আছে অরা। চুলগুলো বেশ এলোমেলো লাগছে, সেজন্য আঁচড়ে নিচ্ছে। এখনও বাসায় ফেরেনি আরিশ। দুপুরে অরাকে বাসায় পৌঁছে দেওয়ার পরপরই অফিসে চলে গিয়েছিল সে। দুপুরের খাবার পর্যন্ত খায়নি। আজকে আরিশ শান্ত থাকলেও তার আচরণ ছিলো অদ্ভুত, রহস্যময়। বিশেষ করে আকাশকে বলা কথাগুলো। অরা ভয় পাচ্ছে। আরিশকে নয়, নিজের আবেগকে। অদ্ভুতভাবে আরিশের প্রতি আকর্ষিত হচ্ছে সে। এমন জটিলতা তো চায়নি অরা। বিষাক্ততা, অধিকারবোধ, হিংস্রতা, মায়া, সবকিছু নিয়েই তেজরিন খান আরিশের ভালোবাসা। অরা কীভাবে এই ভালোবাসা সহ্য করবে? দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছাড়ল অরা। খুব সম্ভবত মানুষ তখনই সবচেয়ে বেশি অসহায়বোধ করে যখন নিজের সাথে নিজের যুদ্ধ হয়। অরাও ভীষণ অসহায়বোধ করছে।
দরজা খোলার শব্দে নড়েচড়ে উঠল অরা। এমনিতে ভেজানো ছিলো দরজা। আরিশ ফিরেছে। আয়নায় দেখতে পাচ্ছে অরা। কালো রঙের শার্ট পরিহিত এক সুদর্শন পুরুষ তার দিকেই তাকিয়ে আছে। চোখে তার অজানা ভাষা, কেমন ঘোরলাগা দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সে– অরাকেই দেখছে। আরিশ এগিয়ে গেলো অরার দিকে। পেছনে গিয়ে দাঁড়াল। নিঃশ্বাস আঁটকে আসছে যেন অরার। আরিশ তার পেছনে দাঁড়িয়ে আছে, একেবারে কাছাকাছি। অরা আয়নার দিকে তাকিয়ে আছে, আরিশ অরার দিকে। একটু পর কিছুটা ঝুঁকে অরার কাঁধে থুতনি রাখল আরিশ।
“ আয়না দেখার দরকার নেই। “
“ কেন?”
আরিশ কী বলবে বুঝতে পারছে না। অরাকে কীভাবে বলবে আয়নাতে তার বউয়ের সৌন্দর্য দেখলেও হিংসা লাগে তার।
“ কিছু না। শোনো। “
“ জি বলুন। “
“ তোমার ভার্সিটিতে গিয়ে ক্লাস করার দরকার নেই। “
হুট করে এমন কথা আশা করেনি অরা। তবে কিছু যে বলবে না আরিশ, এটাও আশা করেনি। তাই সরাসরি জিজ্ঞেস করলো অরা,
“ কী হয়েছে? ক্লাস না করলে পরীক্ষায় লিখবো কী?”
“ অনলাইনে ক্লাস করবে। “
“ কিন্তু কেন?”
“ তুমি ক্লাস করতে গেলে সবাই তোমাকে দেখবে। মানে যারা তোমাকে পছন্দ করে তারা দেখবে, ছেলেরা তোমাকে নিয়ে কল্পনা করবে। সেসব আমার সহ্য হবে না। “
আজকে প্রথম আরিশের পাগলামিতে হাসি পেলো অরার। একেবারে বাচ্চাদের মতো মুখের হাবভাব তার। দেখলেই হাসি পায় এমন।
“ আপনি এতো হিংসুটে কেন?”
কপাল কুঁচকে ফেলল আরিশ। অরা আয়নায় তার চেহারা দেখছে আর মুচকি মুচকি হাসছে।
“ আমি যেমনই হই, আমি ছাড়া তোমার গতি নেই হামিংবার্ড। “
“ তাহলে লেখাপড়ার দরকার নেই। পড়বো না আর। এমনিতেই তো পড়তাম না৷ সমস্যা নেই। “
স্বাভাবিকভাবেই বলল অরা। আরিশ ক্ষেপে গেলো তাতে। দিলো কাঁধে এক কামড় বসিয়ে। মাঝে মধ্যে আরিশকে অরা মনে মনে অনেককিছু বলে গালি দেয়। আর দিবে না কেন? কামড়ের ফলে রক্ত বের করে দেওয়া কি কোনো মানুষের কাজ?
“ তাহলে প্রতিদিন আমি তোমাকে ইউনিভার্সিটিতে পৌঁছে দিয়ে আসবো। “
“ আপনার লেট হবে না?”
“ সবার আগে তুমি, তারপর সব। “
আরিশের এমন সরাসরি কথায় কিছুটা লজ্জা পেলো অরা। মাথা নেড়ে সম্মতি দিলো কেবল।
“ আচ্ছা। “
আরিশ সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে পোশাক খুলতে লাগলো। অরা আয়নায় আঁড়চোখে তাকিয়ে দেখছে।
“ আয়নার দিকে না তাকিয়ে সরাসরি আমার দিকে তাকাচ্ছো না কেন, হামিংবার্ড? “
থতমত খেলো অরা। চুরি করতে গিয়ে ধরা পড়ে যাওয়ার মতো করে আমতা আমতা করে বলল,
“ আমি… আমি তো আয়না দেখছিলাম। “
আরিশের মেজাজ বিগড়ে গেলো এবার। মিথ্যা কেন বলল হামিংবার্ড? খালি গায়ে এগিয়ে গেলো অরার দিকে। হুট করেই অরার দুই হাত পেছনে নিয়ে এসে চেপে ধরে জিজ্ঞেস করলো,
“ আমাকে কেন দেখছো না?”
“ আপনাকে দেখিনি সেটাও তো বলিনি আমি। আয়নার মধ্যেই তো আপনি ছিলেন। “
“ ওহ! তাই তো। “
“ জি। যান ফ্রেশ হয়ে আসুন। আমি বিছানা গোছগাছ করছি। “
আরিশ অরাকে ছাড়লো না। ঘাড়ে নাক ডুবিয়ে নিঃশ্বাস নিতে লাগলো।
“ আজকে আদর করি, পাখি? “
নেশা ভরা কণ্ঠে শুধালো আরিশ। অরার সমস্ত শরীরে যেন বিদ্যুৎ বয়ে গেলো। তবে সে এখনও দ্বিধায় আছে।
“ অনুমতি চাইছেন? “
“ হ্যাঁ। “
“ আমি এসবের জন্য প্রস্তুত নই এখন। আমার মতামত এটা, বাকিটা আপনার ইচ্ছে। “
চোখ বন্ধ করে লম্বা নিঃশ্বাস ছাড়ল আরিশ। তারপর সোজা ওয়াশরুমের দিকে এগোল। মন ও শরীর দুই উত্তপ্ত এখন। লম্বা শাওয়ার দরকার তার। অরা চুপচাপ বসে রইলো। কী হচ্ছে, কী করা উচিত সে বুঝতে পারছে না।
টরেন্টো, কানাডা
১৫-০৫-২৫ | দুপুর ২টা
টরেন্টোর আকাশটা আজ একটু বেশি নীল লাগছে সাবিহার চোখে, যদিও তার ভিতরটা ঠিক ততটাই ধূসর। জানালার পাশে দাঁড়িয়ে সে দৃষ্টির আড়ালে হারিয়ে যাচ্ছে যেন। চারদিকে এত কিছু নতুন– নতুন শহর, নতুন ভাষা, নতুন নিয়ম। অথচ তার ভিতরটা আটকে আছে কোথাও, খুব চেনা কোনো জায়গায়।
এখানে আসাটা তার স্বপ্ন ছিল না। বাংলাদেশে গ্র্যাজুয়েশন শেষ করে সে তো ভেবেছিল, হয়তো একটা চাকরি করবে, আরিশের সাথে সংসার করবে । কিন্তু আরিশ একপ্রকার জোর করেই পাঠিয়ে দিলো কানাডা। নিজের ইচ্ছের বিরুদ্ধে ঠেলে দেওয়া এই জীবনকে সে সহজে আপন করতে পারছে না। নতুন শুরু ঠিকই, কিন্তু সব শুরু আনন্দের হয় না। কিছু কিছু শুরু হয় নিঃশব্দ অভিমানে, কিছুটা অভিমান নিজেকেও নিয়ে।
আজ ক্যাম্পাসে যাওয়ার প্রথম দিন। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে সাবিহা নিজের চোখের দিকে তাকায়। গ্রামে বেড়ে ওঠা মেয়েটি আজ দেশ ছেড়ে এতটা দূরে চলে এসেছে! আরিশকে ভালোবাসার শাস্তি পেয়েছে, না কি পুরস্কার – এখনো ঠিক বুঝে উঠতে পারে না সে।
হঠাৎ হোয়াটসঅ্যাপে কলের শব্দে চমকে ওঠে সাবিহা। ফোনের স্ক্রিনে তাকিয়ে দেখে, অপরিচিত একটি নম্বর। কে হতে পারে? – মনে মনে ভাবতে ভাবতেই কলটি কেটে যায়।
এক মুহূর্তের দ্বিধা শেষে, নিজেই কলব্যাক করে সাবিহা।
“ হাই বিউটি কুইন! “
চমকাল সাবিহা, মেহরাব কল করেছে! কিন্তু কেন?
“ আপনি! আপনি আমার নম্বর পেলেন কোথায়? “
“ সুন্দরীদের নম্বর জোগাড় করে, নিতেই হয়। “
“ ওহ আচ্ছা। “
“ তারপর? তোমার সবকিছু কেমন চলছে? “
“ ভালোই। আপনি এখন কল দিলেন? মানে বাংলাদেশে তো রাত বারোটা বেজেছে মেবি। “
“ হ্যাঁ। ঘুম আসছে না। তো ভাবলাম একবার কথা বলি। “
“ বুঝলাম। আমাকে একটু বেরোতে হবে, অন্য কোনো সময় কথা হবে। “
“ ওকে। বায়। “
“ বায়।”
চলবে,
#হামিংবার্ড
#পর্ব_৪১
#তাসমিয়া_তাসনিন_প্রিয়া
দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে ফোনটা বালিশের পাশে রেখে দিল মেহরাব। মানুষ কখন কার প্রেমে পড়ে, তা কেউ আগে থেকে জানে না। মেহরাবও জানত না। কখন যে সাবিহার প্রেমে পড়ে গেছে, বুঝতেও পারেনি। এমন এক মেয়েকে তার ভালো লেগে গেছে– এই ভাবনাতেই বিরক্ত হতো সে। নিজেকে কতবার কড়া করে শাসন করেছে! কিন্তু মন তো কারো শাসন মানে না। মেহরাবের মনও মানেনি। শেষমেশ সে সাবিহার প্রেমে পড়েই গেল।
রাত গভীর। চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছে মেহরাব, কিন্তু মাথায় ঘুরছে শুধুই সাবিহার কথা। তার পরিবার বলতে মা, বাবা আর এক বোন– যদিও বোনের বিয়ে হয়ে গেছে, এখন থাকে শ্বশুরবাড়িতে। বহু চেষ্টা করেও ছেলের বিয়ে দিতে পারেননি মা-বাবা। একসময় হালই ছেড়ে দিয়েছেন তারা। মেহরাবের মা ছেলে অন্ত প্রাণ। মেহরাব ছাড়া তার একদিনও চলে না। শুধু মায়ের জন্যই বিদেশে ভালো চাকরির সুযোগ পেয়েও বহুবার হাতছাড়া করেছে সে। মেহরাব ভাবছিল – যদি কানাডা চলে যেত, কেমন হতো জীবনটা? কিন্তু মা? মা’কে কি আদৌ বোঝানো যাবে?
ভাবনার অতলে ডুবে ডুবে একসময় ঘুমিয়ে পড়লো মেহরাব।
ভার্সিটির প্রথম দিন আজ। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চোখে কাজল দিচ্ছে অরা। ঘরে নিঃশব্দ একটা উত্তেজনা। চেয়ারে বসে আরিশ একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে তার দিকে, চুপচাপ, মনোযোগী। বরাবরের মতোই ভদ্রলোক কালো রঙের পোশাকে সুসজ্জিত, যেন এক নিখুঁত অভ্যস্ততা।
“তোমার সাজগোজ নষ্ট হয়ে যাবে এখন।”
নরম কণ্ঠে বলে উঠল আরিশ।
চেয়ার থেকে উঠে ধীরে ধীরে এগিয়ে এল অরার দিকে।
অরা কিছুটা অবাক হয়ে পেছন ফিরে তাকাল। তার পরনে হালকা মিষ্টি রঙের থ্রিপিস, ঠোঁটে মেরুন লিপস্টিক, কানে কুন্দনের ছোট দুল, চোখে গাঢ় কাজল– সব মিলিয়ে সে যেন সকালবেলার এক স্নিগ্ধ অনুভূতির মতো। খোলা চুলগুলো এলোমেলো হয়ে আছে কিছুটা। তবে অরা চুলগুলোও আঁচড়ে নিতে লাগলো এবার।
আরিশ থেমে দাঁড়াল অরার কাছাকাছি, চোখে একরাশ প্রশ্রয়।
“ কেন?”
“কারণ, আজ তোমাকে অসহ্য রকম হট লাগছে।”
অরার কোমর ধরে তাকে এক ঝটকায় কাছে টেনে নিলো আরিশ।
“প্লিজ, এখন না। সাজগোছ নষ্ট হয়ে গেলে বের হবো কীভাবে?”
“হোক না। এমন সেজেগুজে যাচ্ছো কেন? আমি ছাড়া আর কেউ তোমার এই রূপ দেখবে না।”
আরিশের কণ্ঠে ছিল একধরনের দাবি।
“কই সাজলাম? কেবল লিপস্টিক আর কাজল দিয়েছি।”
“কাজলের দরকার নেই। মুছে ফেলো। রাতে দিও – আমি দেখবো।”
অরা বিরক্ত হয়ে মুখ ফিরিয়ে নিল। সবসময় এমন হুকুম, এমন দখলদারি–ভালো লাগে না তার। কিন্তু কীই বা করবে? আরিশের কথা না শুনলে পরে বাড়বে ঝামেলা। একটা তপ্ত নিঃশ্বাস ফেলল অরা, ঠোঁটের কোণে জমে থাকা অভিমান চেপে রাখার চেষ্টা করল।
“ঠিক আছে।”
নরম কণ্ঠে বলল অরা, চোখের কাজল মুছে ফেলতে শুরু করল। সময়ও লাগল কিছুটা। এ ফাঁকে আরিশ যেন একেকটা দৃশ্য গিলছে চোখে– অরাকে ভালো করে দেখে নিচ্ছে সে, একটানা।
“আজ রাতে আর তোমার নিস্তার নেই, পাখি।”
চোখ আধবোজা করে ফিসফিসিয়ে বলল আরিশ।
“আমি আর নিজেকে সামলাতে পারছি না।”
লাজুক মুখে মাথা নিচু করে রইল অরা। ন’টা বাজছে– দেয়ালঘড়ির কাঁটা যেন তাগাদা দিচ্ছে, ভার্সিটিতে যেতে হবে।
“সেটা রাতে দেখা যাবে। এখন চলুন।”
অরা চোখ তুলে বলল, ঠোঁটে অল্প হাসি। আরিশ একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলল।
“তুমি বুঝবে না।”
“কী বুঝবো না?”
“চোখের সামনে এমন সুন্দরী বউ থাকার পরও আদর করতে না পারার যন্ত্রণাটা।”
“কেন বুঝবো না?”
“কারণ, তুমি পুরুষ নও।”
অরা হেসে উঠল – প্রাণখোলা, ঝরঝরে সেই হাসিতে যেন সকাল নামে ঘরে। আরিশ এক দৃষ্টে তাকিয়ে থাকল, মুগ্ধ হয়ে।
“বুঝলাম। এখন চলুন, দেরি হয়ে যাচ্ছে।”
যাওয়ার আগে হঠাৎ করেই আরিশ অরার ঠোঁটে একটা আলতো চুমু এঁকে দিল, তারপর ভালোবাসায় মেশানো এক মৃদু কামড় বসাল। অরা একটু চমকে উঠল, কিন্তু কিছু বলল না।
যেন বাই ওয়ান গেট ওয়ান ফ্রি অফার চলছে।
“ চলো। “
হাতে হাত ধরে ঘর থেকে বেরোল দু’জন। ড্রইং রুমে যেতেই তাসলিমা খাতুনের মুখোমুখি হলো তারা।
“ তোমার সাথে কথা ছিলো আরিশ। গুরুত্বপূর্ণ। “
তাসলিমা খাতুন বেশ থমথমে গলায় বললেন কথাগুলো।
“ সন্ধ্যায় কথা হবে। এখন লেট হচ্ছে চাচি। “
“ ঠিক আছে। “
আরিশ আর না দাঁড়িয়ে অরাকে নিয়ে বাসা বেরিয়ে গেলো। তাসলিমা খাতুন একা একা দাঁড়িয়ে রাগে ফুঁসছেন । কথা বলার সময় নেই কিন্তু বউকে ইউনিভার্সিটিতে পৌঁছে দেওয়ার মতো ঠিকই সময় আছে!
গাড়ি চলছে। অরা চুপচাপ জানালার কাচে চোখ রাখল– বাইরের দৃশ্যগুলো একটার পর একটা সরে যাচ্ছে, ঠিক যেন তার ভেতরের অনুভূতির মতোই নিরব, অনিঃশেষ। যেতে যেতে কোনো কথা হলোনা দুজনের মধ্যে। শুধু নিস্তব্ধতা, মাঝে মাঝে গাড়ির টায়ারের শব্দ। ভার্সিটির গেটের সামনে থামলো গাড়ি। অরার ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটল। আরিশ এক নজর তাকাল সেদিকে তারপর লম্বা নিঃশ্বাস ছাড়ল কয়েকবার। অরা অন্য কোনো বিষয় খুশি হয়ে হাসলেও হিংসা হয় আরিশের। মনে হয় অরা একমাত্র তার জন্য হাসবে, অন্য কিছুর জন্য নয়। অদ্ভুত ভাবনা!
“ চলো, ক্লাসে পৌঁছে দিয়ে আসবো। “
“ দরকার নেই। আপনার লেট হচ্ছে না? আপনি যান, আমি চলে যাবো। কারো সাথে অপ্রয়োজনীয় কথা বলবো না। “
ভ্রু নাচিয়ে বলল আরিশ,
“ শিওর? “
“ হ্যাঁ। শুধু বন্ধুদের সাথে কথা বলবো তবে সীমিত। “
“ গুড গার্ল। তাহলে ঠিক আছে। আমারও লেট হচ্ছে, মিটিং আছে জরুরী। “
হাতঘড়ির দিকে এক নজর তাকিয়ে ব্যস্তসমস্ত ভঙ্গিতে বলল আরিশ। তারপর গাড়ির দরজা খুলে দিলো। অরা গাড়ি থেকে নামতেই যাবে এমন সময় হাত টেনে ধরলো আরিশ।
“ কী?”
অরার প্রশ্নের জবাব না দিয়ে তার কপালে চুমু খেলো আরিশ।
“ এখন যাও৷ সোজা ক্লাসে যাবে। আর হ্যাঁ ক্লাস শেষে কল করবে। “
“ আচ্ছা। সাবধানে যাবেন। “
“ ওকে। “
গাড়ির দরজা বন্ধ করে দিলো আরিশ। অরা এখনও রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে আছে। এক অদৃশ্য টানে আরিশের গাড়ি দৃষ্টির আড়াল হওয়ার আগ পর্যন্ত ওভাবেই দাঁড়িয়ে রইলো সে। তারপর স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়ল। ভার্সিটির গেটের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসল। এরমধ্যেই আকাশের সাথে দেখা হলো তার। এদিকেই আসছে সে। অরা দ্বিধায় পড়ে গেলো, আকাশের সাথে কথা বলবে কি-না ভেবে। বলা তো উচিত! আরিশ যা করেছে তাতে অরারও ক্ষমা চাওয়া দরকার।
“ এসেছ তুমি! “
আকাশ নিজে থেকেই কথা বলল।
“ হ্যাঁ। কেমন আছো?”
“ এইতো, ভালোই। তুমি? “
“ হ্যাঁ, ভালো আছি। চলো ক্লাসে যাই। “
“ আরে দাঁড়াও! তোমার বর তো নেই এখানে, চলো না দোকানে বসে চা খেতে খেতে আড্ডা দেই একটু? ক্লাস শুরু হতে তো এখনও দেরি আছে। “
আকাশের প্রস্তাবটা মন্দ না। তবে অরা তো আরিশকে কথা দিয়েছে, সোজা ক্লাসে যাবে। কিন্তু আকাশকেও কীভাবে না বলবে? অরাকে অন্যমনস্ক হয়ে থাকতে দেখে আকাশ আবারও বলল,
“আরে এত ভাবছো কেন? চলো তো!”
আকাশ হেসে হাত ধরল তার। অরা খানিকটা অন্যমনস্ক ছিল, সুতরাং আপত্তি করল না।
তবে কিছুদূর গিয়ে নিজে থেকেই হাতটা ছাড়িয়ে নিলো, তারপর পাশাপাশি হাঁটতে লাগল দু’জন।
রাস্তার ওপাশে একটা ছোট চায়ের দোকানের দিকে এগোল তারা। আকাশ অরাকে সেখানে বসতে বলল। অরা বেঞ্চিতে বসে চারপাশে তাকাল।
এদিকে আকাশ একটু দূরে গিয়ে ফোনটা বের করল পকেট থেকে। কোনো একটা নাম খুঁজে নিয়ে একবার চারপাশে নজর বুলিয়ে
চুপিচুপি কল করল কাউকে।
“ এখন আসুন। চায়ের দোকানে আছে অরা। “
ওপাশ থেকে কিছু একটা বলে কল কাটা হলো। আকাশের ঠোঁটের কোণে রহস্যময়ী হাসি!
মিনিট পাঁচেক হলো আকাশ গেলো কিন্তু এখনও ফিরছে না। দোকানদার অরাকে চা দিয়েছে। একা একাই চা খাচ্ছে সে। আকাশের চায়ের কাপটা পাশেই রাখা আছে। এরমধ্যে আকাশ চলে এলো।
“ কোথায় গিয়েছিলে আকাশ?”
“ আরে ইমার্জেন্সি! বুঝতে পেরেছ?”
হাতের ইশারায় কিছু একটা বোঝাল আকাশ। অরা ইতস্ততভাবে মাথা নাড়ল।
“ না-ও চা খাও, আমার প্রায় শেষ হয়ে এসেছে। “
“ আমাকে রেখে একাই খেলে! ইট’স বেরি ব্যাড অরা। “
আকাশ মজার ছলে বলল।
“ মামা অরাকে আরেককাপ চা দিন তো, বেশি করে লিগার দিবেন৷ “
শেষের কথাগুলো দোকানদারকে উদ্দেশ্য করে বলল আকাশ।
অরা বিপাকে পড়েছে। চা পছন্দের হলেও এই মুহুর্তে আর খেতে ইচ্ছে করছে না। কিন্তু না-ও বলতে পারছে না। কেনো যে আগে আগে একা খেতে গেলো সেই ভেবেই বিরক্ত লাগছে এখন। কিছুক্ষণের মধ্যেই দোকানদার চা দিলো।
“ লেট হচ্ছে আকাশ। চা শেষ হলেই, চলে যাবো। ওকে?”
“ হ্যাঁ হ্যাঁ, পাক্কা। “
আকাশ হেসে চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে কথা বলছে। অরাও খুব এনজয় করছে সবকিছু। কতগুলো দিন পর এভাবে প্রানখুলে বাঁচতে পারছে!
“ অরা ম্যাম!”
আচমকা কারো ডাকে পেছন ফিরি তাকাল অরা। আকাশও তাদের দিকে তাকিয়ে আছে। দু’জন ভদ্রলোক, ফর্মাল পোশাক পরে আছে তারা। অরা বসা থেকে উঠে দাঁড়াল। কৌতূহলী হয়ে শুধালো অরা,
“ আপনারা কারা? “
“ আরিশ স্যার এক্সিডেন্ট করেছে ম্যাম। আমরা উনার পরিচিত। অজ্ঞান অবস্থায় উনি শুধু বারবার আপনার নাম নিচ্ছেন, প্লিজ আমাদের সাথে চলুন। “
বুকটা কেমন ধক করে উঠলো অরার। আরিশের এক্সিডেন্ট হয়েছে! অরা কিছু বিচারবিবেচনা না করেই বলল,
“ আমি যাবো। উনার কাছে নিয়ে যান আমাকে। “
আকাশ বলল,
“ আমিও যাচ্ছি সাথে, চলো। “
দুই ভদ্রলোক আকাশ ও অরাকে গাড়িতে তুলে নিলো। গাড়ি চলতে লাগলো তার আপন গতিতে। অরা সমানে কেঁদে যাচ্ছে। মাথা কাজ করছে না তার। আরিশের যদি কিছু হয় তাহলে!
“ আর কতদূর? কোথায় আছে আরিশ?”
আকাশ ও দুই ভদ্রলোক একে অপরের দিকে মুখ চাওয়াচাওয়ি করলো একবার। তারপর আচমকাই একজন অরার মুখে একটা রুমাল চেপে ধরল। মুহুর্তেই চোখের সামনে সবকিছু অন্ধকার হয়ে আসতে লাগলো তার। জ্ঞান হারালো অরা।
সকাল গড়িয়ে দুপুর হয়ে গেছে। ফরেনারের সঙ্গে মিটিং শেষ করে মাত্রই কেবিনে প্রবেশ করলো আরিশ। চেয়ারে বসে অস্থিরতায় নড়ে উঠে ফোন হাতে নিলো। না, অরা এখনও কল করেনি।অদ্ভুত লাগল আরিশের, প্রথম দিন তো এতটা দীর্ঘ সময় ক্লাস হওয়ার কথা নয়। তৎক্ষণাৎ অরার নম্বর ডায়াল করল সে। বেজে বেজে কল কেটে গেলো, কিন্তু অন্যপাশ থেকে রিসিভ হল না।মেজাজটা খারাপ হয়ে গেলো আরিশের। আবারও কল দিলো। এবার ফোন বন্ধ বলছে।হঠাৎ মাথায় যেন আগুন জ্বলে উঠল। বসা থেকে উঠে দাঁড়াল।
সব কিছু রেখে ইউনিভার্সিটির দিকে ছুটে গেলো সে।
দুপুরের তীব্র রোদ মাথার ওপর পোহালেও অরা চেয়ারে বসে রয়েছে, হাত-পা বাঁধা, অচেতন নয়, একটু ঝিমিয়ে আছে। ধীরে ধীরে চোখ মেলে চারপাশে তাকাতে লাগল।
পুরনো, ঝকঝকে ছাদের ছায়াযুক্ত একটি বাড়ির উঠোনে সে রয়েছে– চারপাশে ঘিরে বাড়ি, আর মাঝখানে উঠোন, শহরের মধ্যে এমন জায়গা থাকা মুশকিল, অর্থাৎ শহর থেকে অনেক দূরে কোনো এক নিস্তব্ধ স্থানে বন্দি রয়েছে সে।হঠাৎ মনে এলো আরিশের কথা – তার দুর্ঘটনার খবরে অরার বুক টেনে উঠল, চেঁচিয়ে উঠল সে।
“ কেউ আছেন? কে আছেন! আমাকে এভাবে আঁটকে রেখেছেন কেন! আরিশ কোথায়?”
বেশ কয়েকবার চেঁচাল অরা। তারপর সেই লোক দু’জন একটা ঘর থেকে বেরিয়ে এলো।
“ এখানে চেঁচামিচি করে কোনো লাভ নেই মামুনি। তোমার আরিশ তো ঢাকায় আছে, সুস্থ আছে। কিন্তু তুমি সুস্থ থাকবেনা আর। “
কথাটা বলেই দু’জনে বিশ্রীভাবে হেসে উঠল। এদের নাম কালু ও কালাম। চৌধুরীদের পোষা গুন্ডা। রহমান চৌধুরী ও ফারুক চৌধুরীর আদেশেই অরাকে এখানে নিয়ে আসা হয়েছে। আকাশের সাহায্যেই কাজটা সহজ হয়েছিল। বিনিময়ে ফারুক চৌধুরী আকাশকে অনেক টাকাপয়সা দিয়েছে। যদিও এসবকিছুই জানে না অরা। কালু ও কালামের কথায় অরার কাছে এটা স্পষ্ট যে, তারা খারাপ মানুষ। তার রাগ হচ্ছে ভীষণ। কেন যে বোকার মতো এদের সাথে এলো!
“ আকাশ! আকাশ কোথায়? কী করেছিস ওর সাথে তোরা?”
হাসতে লাগলো ওরা দু’জন। অরা নড়েচড়ে নিজেকে চেয়ার থেকে ছাড়াতে চাইলো কিছুক্ষণ। কিন্তু কোনো লাভ হলোনা।
“ আমরা কিছু করিনি তার সাথে। উল্টো সেই আকাশই তোকে এখান পর্যন্ত নিয়ে আসতে সাহায্য করেছে, বোকা মেয়ে। বন্ধু নির্বাচনে সচেতন হতে হয়৷ “
অবাক হলো অরা। আকাশ এমনকিছু করতে পারে বিশ্বাস হচ্ছে না ওর। কিন্তু বাস্তবতা তো এটাই যে, আকাশের জন্যই ক্লাসে না গিয়ে চায়ের দোকানে গিয়েছিল সে। অরা কাঁদছে। আরিশের কথা শুনলে আজ তাকে এমন বিপদে পড়তে হতোনা।
“ আমাকে আটকে রেখে কার কী লাভ হবে? প্লিজ আমাকে যেতে দাও!”
কালু এগিয়ে এলো অরার দিকে। অরার খোলা চুলে নাক ডুবিয়ে নিঃশ্বাস ছাড়ল সে। ঘৃনায় শরীর ঘিনঘিন করে উঠলো অরার।
“ আমাদের লাভ হলো টাকা। তোকে ঠিকানা লাগাতে হবে আমাদের, মানে কবরে পাঠাবো। তবে ওপর থেকে অর্ডার আসার পর। কিন্তু….. “
দাঁড়ি চুলকে হাসতে লাগলো কালাম। কালু অরার চুলগুলো নেড়েচেড়ে দিতে দিতে বলল,
“ কিন্তু মরার আগে অনেক আদর পাবি তুই। মাত্র যৌবনে পা রাখলি, একটু এনজয় করেই মরবি না হয়। আমরা দু’জন তোকে অনেক সুখ দেবো। কী বলিস কালাম?”
তারা দু’জন একসাথে হেসে উঠল। অরার চোখের সামনে সবকিছু ঝাপসা হয়ে আসছে। মাথা ঘুরছে। মনে হচ্ছে জ্ঞান হারাবে সে। চোখ বন্ধ হয়ে আসার আগ পর্যন্ত আরিশের মুখটা মনে পড়তে লাগলো তার।
ইউনিভার্সিটির গেটের বাইরে দাঁড়িয়ে আছে গাড়ি। একটু আগেই ভার্সিটির মূল ফটকে প্রবেশ করলো আরিশ। কিন্তু সেখানে গিয়ে যা শুনলো তাতে মাথায় রক্ত চড়ে গেছে তার। অরা আজকে ভার্সিটিতে আসেনি। ভয়, রাগে পাগল পাগল লাগছে তার। হঠাৎ শরীর ঠান্ডা হয়ে আসছে তার, হাত-পা কাঁপতে শুরু করেছে । মাথার ভেতর হাজারো প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে, কিন্তু কোনো উত্তর পাচ্ছে না সে।
অবিশ্বাস আর উৎকণ্ঠায় দ্রুত ভার্সিটির বাইরে বেরিয়ে এলো আরিশ। হাঁটু চাটাচ্ছে, হৃদয় ব্যথায় ভারাক্রান্ত। ফোন তুলে অরার বাবার বাড়ি ডায়াল করলো। নয়না ফোন রিসিভ করলো। আরিশের কণ্ঠে আঁটসাঁট কাঁপন।
“ হ্যালো! কে?”
“ অরা গেছে তোমাদের কাছে? “
“ আপু! কই না তো! ওর না আজ ভার্সিটিতে যাওয়ার কথা ছিলো, ভাইয়া? গতকাল রাতে এজন্য খুশিতে কল করেছিল। মায়ের সাথে কথাও বলল। “
আরিশ আরকিছুই শুনতে পারলোনা। অরা ও বাড়িতেও যায়নি মানে কিছু ঠিক নেই। নিশ্চয়ই কোনো বিপদ হয়েছে মেয়েটার। মনের ভিতর একটা অজানা আতঙ্ক ছড়িয়ে গেলো। চিৎকার করে উঠলো আরিশ। আশপাশের সবাই অবাক হয়ে আরিশকে দেখতে লাগলো। ভাবলো, ভদ্রলোক উন্মাদ হয়ে গেছে। পরপর তিনবার কোথায় কোথায় যেন কল করলো আরিশ। কথা হলো তাদের সাথে। তারপর আশপাশের সবগুলো দোকানে অরার ছবি দেখাতে লাগলো। চায়ের দোকানে অরার ছবি দেখাতেই চিনতে পারল দোকানদার। আরিশ উত্তেজিত হয়ে ভদ্রলোকের কলার চেপে ধরে রাগে চিবিয়ে চিবিয়ে বলতে লাগলো,
“ কখন এসেছিল, অরা? আর কার সাথে? একা?”
“ একটা ছেলের সাথে এসেছিল, সকালে। আকাশ না আয়ুশ তার নাম। দু’জনে চা খেলো তারপর একটা বড়ো গাড়িতে চড়ে বসলো। এরচেয়ে বেশি কিছু আমি জানিনা। “
দোকানদার ভয়ে ভয়ে বলল কথাগুলো। আরিশের চোখে যেনো কোনো মৃত্যুপুরীর ছায়া নেমে এসেছে, যেকেউ দেখলে ভয় পাবে। এরমধ্যে তালহা এসে উপস্থিত হলো সেখানে। আরিশকে দোকান থেকে বের করে আনলো। ঘনঘন নিঃশ্বাস ফেলে নিজেকে সামলাতে চেষ্টা করছে আরিশ।
“ ভাইয়া প্লিজ শান্ত হও। ভাবিকে ঠিক পেয়ে যাবো। হয়তো বন্ধুর সাথে কোথাও গিয়েছে। “
“ নাহ তালহা। অরা কখনো এমন কাজ করবে না। আকাশের মধ্যে ঘাপলা আছে, ওকে আগেরবারই জানে মেরে ফেলা দরকার ছিল। ভুল হয়ে গেছে আমার। আগে আমার অরাকে পাই তারপর ওকে এতো ভাগ করে কাটবো যে ওর লাশ পর্যন্ত খুঁজে পাবে না কেউ। “
আরিশ কথা শেষ হতেই গাড়িতে উঠে বসল। তালহা কী বলবে বুঝতে পারছে না। আরিশকে এরকম ভয়ংকর রূপে কখনো দেখেনি সে। কথা বলতেও ভয় লাগছে ওর। আজকে নিশ্চিত খুনোখুনি লেগে যাবে। কিন্তু অরা ভাবি কোথায়? চিন্তায় মাথা ধরে গেছে তালহার। আরিশ গাড়ি চালাচ্ছে। চোখ থেকে নিঃশব্দে জল গড়িয়ে পড়ছে তার। রক্তবর্ণ চোখে জল যেন আগ্নেয়গিরির লাভা!
“ ভাইয়া আমরা কোথায় যাচ্ছি? “
“ আকাশের বাড়ি। ও সবকিছু জানে। “
তালহা চুপ করে রইলো। কিছুক্ষণের মধ্যেই একটা কল এলো আরিশের ফোনে। অবস্থা বেগতিক দেখে তালহা ড্রাইভ করতে লাগলো। কল রিসিভ করলো আরিশ।
“ স্যার চৌধুরীরা করেছে সব। তারাই ম্যাডামকে কিডন্যাপ করিয়েছে। “
কান দিয়ে গরম ধোঁয়া বেরুচ্ছে আরিশের।
“ খবর লাগা কোথায় রেখেছে অরাকে। আমার খবর চাই! নইলে সব শেষ করে ফেলবো আমি। “
ওপাশ থেকে কল কেটে দিলো। আরিশের পাগল পাগল লাগছে, ভীষণ অসহায় মনে হচ্ছে নিজেকে। কেনো যে সকালবেলা অরাকে ক্লাসে পৌঁছে দিয়ে এলোনা সেই আফসোসে কলিজা পুড়ে যাচ্ছে তার। চৌধুরী ইন্ডাস্ট্রির কথা মনে পড়তেই চোয়াল শক্ত হয়ে এলো আরিশের, হাত মুষ্টিবদ্ধ হলো। ফারুক চৌধুরী ও রহমান চৌধুরী ব্যবসায় না পেরে এরকম কিছু করবে দুঃস্বপ্নেও ভাবেনি আরিশ। এবার আরিশও তাই করবে, যা চৌধুরীরা করলো। সম্মানের বিনিময়ে সম্মান!
চলবে,
#হামিংবার্ড
#পর্ব_৪২
#তাসমিয়া_তাসনিন_প্রিয়া
[ এই পর্বে কিছু ভীতিকর দৃশ্য আছে। নিজ দায়িত্বে পড়বেন। গল্পের সাথে বাস্তবতা মেলাতে যাবেন না। ]
“ খালা! খালা!”
কিছুক্ষণ আগেই বাসায় ফিরেছে আকাশ। শরীর ক্লান্ত। রহমান চৌধুরীর থেকে মোটা অংকের টাকা নিয়ে এসেছে সে। টাকাগুলো নিজের রুমে রেখে এসে কেবল ড্রইং রুমে বসেছে সে।
“ আকাশ বাবা, তুমি আইছো! কিছু লাগবে তোমার? “
লতা খালা গ্রামের মানুষ। কাজের জন্য শহরে আসা তার। বিগত তিন বছরের বেশি সময় ধরে এ বাড়িতেই কাজ করছেন তিনি।
“ এক গ্লাস ঠান্ডা লেবুর জুস দাও তো। “
“ ঠিক আছে। তুমি বহো, আমি নিয়া আইতাছি বাবা। “
আকাশ মাথা নেড়ে, প্যান্টের পকেট থেকে ফোন করল। তিনটা পেরিয়ে গেছে। এতক্ষণে নিশ্চয়ই অরাকে শেষ করে ফেলেছে চৌধুরীরা! একটু খারাপ লাগছে আকাশের। কিন্তু আরিশের সেই আচরণ মনে পড়লেই আকাশের মাথা খারাপ হয়ে যায়। বউয়ের জন্য এতো দরদ! সেই বউ যদি পৃথিবীতে না থাকে তখন আরিশের কীরকম অবস্থা হয় সেটাই দেখতে চায় আকাশ। তাছাড়া অরাকে যদি সে না পায় তবে অন্য কাউকেও পেতে দেবে না। এসব ভাবতে ভাবতে ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটল তার। হঠাৎ কলিংবেলের শব্দে নড়েচড়ে উঠল। লতা রান্নাঘরে আছে, আকাশই গেলো দরজা খুলতে।
“ আপনি! “
আরিশকে দেখেই চমকাল আকাশ। লোকটা তার কাছে কেন এসেছে? আরিশ মুচকি হাসল। আকাশকে বলল,
“ দাওয়াত করার জন্য এসেছি, আকাশ। “
“ কীসের? “
“ তোমার চল্লিশার। “
আকাশ কিছু বলার আগেই আরিশ তার মাথায় পিস্তল দিয়ে একটা বাড়ি মারলো। আকস্মিক আক্রমণে টাল সামলাতে না পেরে জ্ঞান হারিয়ে ফেলল আকাশ। তালহা আকাশকে ধরে বলল,
“ ভাইয়া কী করতে চাচ্ছো তুমি? “
“ গাড়িতে নিয়ে চল। “
তালহা তাই করতে লাগলো। দুই ভাই আকাশকে নিয়ে গাড়িতে বসাল। একেবারে চুপচাপ, নিঃশব্দে। লতাও কিছু টের পেলো না।
তালহা গাড়ি চালাচ্ছে। আরিশ আকাশের চোখেমুখে পানি ছিটাচ্ছে। ইচ্ছে করছে, ঘুমন্ত অবস্থাতেই ওকে শে*ষ করে দেয়। কিন্তু ওকে এখনই মে* রে ফেললে অরার খোঁজ আর জানা যাবে না। আরিশ একের পর এক পানি ছিটাতে ছিটাতে আকাশের পুরো মুখ ভিজিয়ে ফেলল।
আস্তে আস্তে আকাশের জ্ঞান ফিরছে।
“ভাইয়া, আমরা কোথায় যাচ্ছি?”
“আপাতত যেদিকে মন চায়, সেদিকেই চল। আগে এই শুয়ো*রের বাচ্চার কাছ থেকে অরার খোঁজ নিতে হবে।”
তালহা ওর কথামতোই গাড়ি চালাতে লাগল।
এতক্ষণে আকাশ চোখ মেলে তাকিয়েছে। জ্ঞান হারানোর কারণ মনে করতে না পেরে, নিজেকে আরিশের পাশে গাড়ির ভেতর আবিষ্কার করেই আঁতকে উঠল।
“আমাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন আপনারা?”
আরিশ ওর দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,
“আমার অরা কোথায়?”
আকাশ শুকনো গলায় ঢোক গিলল। আরিশের চোখে মুখে এমন কিছু ছিল, যা ওর কলিজা কাঁপিয়ে দিচ্ছিল। মিনমিনে গলায় বলল,
“আমি জানি না…”
আরিশ ওর ডান হাতে ঠেকিয়ে দিল পিস্ত* ল। কণ্ঠে স্পষ্ট রাগ,
“আমার অরা কোথায়, বল!”
“আমি কিছুই জানি না, আরিশ! বিশ্বাস করুন…”
আরিশ আকাশের হাতে গু* লি চালিয়ে দিল।
আকাশের চিৎকারে তালহা তটস্থ হয়ে গেল। হাত বেয়ে র* ক্ত গড়িয়ে পড়ছে অনবরত, আসন ভিজে যাচ্ছে।
“ভাইয়া, আশপাশের লোকজন যদি বুঝে ফেলে গাড়ির ভেতর কী হচ্ছে, তাহলে বড় বিপদ হবে।”
আর দেরি না করে আরিশ আকাশের মুখ চেপে বেঁ*ধে ফেলল। এখন শুধু গোঙানির মতো অস্পষ্ট শব্দ বেরোচ্ছে তার মুখ থেকে।
“ঠিক বলেছিস। এবার ঠিক আছে।”
আকাশ উম-উম করে কাঁপতে কাঁপতে ব্যথায় ছটফট করছে। আরিশ এবার পি*স্ত* ল ঠেকাল ওর উরুতে। গলা কাঁপিয়ে বলল,
“বল! না বললে আরেকটা গু* লি খেতে হবে তোকে।”
আকাশ দ্রুত মাথা নাড়তে লাগল।
তালহা বলল,
“ভাইয়া, মনে হচ্ছে ও কিছু বলতে চাইছে। মুখটা খুলে দাও একবার।”
আরিশ মুখের বাঁধন খুলে দিতেই আকাশ হাপাতে হাপাতে নিঃশ্বাস নিতে লাগল। মিনিটখানেক পরে কাঁপা গলায় বলল,
“ আমি… আমি অরার কাছে নিয়ে যাচ্ছি আপনাদের… দয়া করে আর গু* লি করবেন না।”
আরিশ গর্জে উঠল,
“তাড়াতাড়ি বল, তাড়াতাড়ি!”
আকাশ তখন কাঁপা গলায় আরিশ আর তালহাকে অরার অবস্থান বলতে লাগল।
সূর্য হেলে পড়ছে। দুপুর গড়িয়ে বিকেলের দিকে যাচ্ছে সময়। কালাম, কালু – দুজনেই কিছুক্ষণ আগে কথা বলেছে রহমান চৌধুরীর সঙ্গে।
অরাকে নিয়ে তারা কোনো ধরনের ঝুঁকি নিতে রাজি না। তাই সিদ্ধান্ত হয়েছে –যত দ্রুত সম্ভব, তাকে খু ন করে ফেলতে হবে। ফারুক চৌধুরীর নিজস্ব এক পুকুর আছে, মাগুর মাছের পুকুর। শহর থেকে খানিকটা দূরে। মাছগুলো ভয়ানক রকমের মাংসাশী। মানুষের মাংসও ছাড় দেয় না।
চৌধুরীদের নির্দেশ– অরাকে কুচি*কুচি করে কে* টে বস্তায় ভরে ফেলে আসতে হবে সেই পুকুরে।
অরার জ্ঞান ফিরেছে। চোখের দৃষ্টি এখনও ঝাপসা। সমনে তাকাতেই শরীর কেঁপে উঠল তার– কালাম একটা ধারালো ছু* রিতে শান দিচ্ছে নিঃশব্দে। কালু পাশে বসে, এক হাতে ফোন ধরে অশ্লী* ল ভিডিও দেখছে। ভিডিওর কুৎসিত শব্দে অরার চোখ-মুখ ঘৃণায় কুঁচকে গেল।
“ আরে! মামুনির জ্ঞান ফিরেছে, কালাম। “
কালু অরার দিকে তাকিয়ে বিশ্রীভাবে হেসে, কালামকে উদ্দেশ্য করে বলল কথাটা । কালামও ছুরি* তে শান দেওয়া বাদ দিয়ে অরার দিকে তাকাল। দু’জনের চোখেই লোলুপ দৃষ্টি। অরা আচমকাই চেঁচিয়ে উঠলো।
“ কেউ আছেন! প্লিজ কেউ থাকলে সাড়া দিন। আমাকে বাঁচান। “
কালাম ও কালু উচ্চস্বরে হাসছে। অরার কাকুতিমিনতি দেখে নিছকই মজা পাচ্ছে দু’জন। অরা চেঁচাতে থাকলো…
“ রাগী ভুত! আপনি কোথায়? প্লিজ আমার কাছে আসুন। আমি আর কখনো আপনার কথার বাইরে চলবো না। প্লিজ, প্লিজ আমাকে বাঁচান। “
“ বোকা মেয়ে! সারাদিন চিল্লাতে থাকলেও কেউ আসবে না এখানে। তোর রাগী ভুতও না। “
ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল অরা। মৃ* ত্যু তাকে এতটা ভয় দেখায় না– কিন্তু সতীত্ব হারানো? না, সেটা তার পক্ষে কখনোই সম্ভব নয়। কিছু একটা করতে হবে… কিন্তু কী? হাত-পা সব বাঁধা। শরীরটা যেন পাথরের মতো ভারী হয়ে আছে। আরিশকে ভীষণ মিস করছে অরা। মানুষটাও নিশ্চয়ই ওর খোঁজে পাগলের মতো হয়ে গেছে।
চোখের সামনে এক এক করে ভেসে উঠছে পরিচিত মুখগুলো– মা, বাবা, ছোট বোন, আরিশ…হয়তো আর কখনো তাদের কাউকেই দেখতে পারবে না। এই ভাবনা মাথায় আসতেই কান্নার বেগ আরও বেড়ে গেল অরার।
ভেতরটা ফেটে যাচ্ছে যেন। নিঃশব্দে ভাঙছে তার মন, আশা, অস্তিত্ব।
রোকসানা মল্লিক বিছানায় শুয়ে আছেন। মেয়ের চিন্তায় জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছেন তিনি৷ পাশেই নয়না ও সোলাইমান মল্লিক বসে আছেন। সোলাইমান মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন, নয়না হাত-পা গরম করার চেষ্টা করেছেন।
“ বাবা মায়ের জ্ঞান ফিরছে না কেন? আমার খুব টেনশন হচ্ছে। আপুর কিছু হবে না তো?”
কাঁদোকাঁদো গলায় জিজ্ঞেস করলো নয়না। সোলাইমান মেয়েকে একহাতে বুকে জড়িয়ে ধরলেন। লম্বা নিঃশ্বাস ফেলে বললেন,
“ কিছু হবে না, নয়না। ওপরওয়ালা আছেন, তিনি সবকিছুই সহজ করে দিবেন। তোর মায়ের জ্ঞান ফিরলে উনার সামনে আমাদের স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করতে হবে। বুঝতে পেরেছিস? “
নয়না মাথা নাড়ে, “ আচ্ছা বাবা। “ এতটুকু বলে মায়ের দিকে মনোযোগ দেয়।
নির্দিষ্ট স্থানে এসে গাড়ি থামিয়েছে তালহা। কিন্তু এতবড় জায়গায় অরা কোথায় আছে সেটা সরাসরি জানে না আকাশ। চৌধুরীদের মুখে শুরু এতটুকুই শুনেছিল, মোহনপুরের পোড়োবাড়িতে অরাকে রাখা হবে। আরিশ এরমধ্যেই আশেপাশের অনেকটা জায়গায় খুঁজে ফেলেছে। কিন্তু এখানে দূরদূরান্ত পর্যন্ত কেবল জঙ্গলে ঘেরা। না আছে কোনো মানুষজন আর না আছে কোনো ঘরবাড়ি। তালহা আকাশকে হাত-পা বেঁধে গাড়িতেই লক করে এসেছে। দুই ভাই মিলে এখন অরাকে খুঁজছে।
“ অরা! অরা! কোথায় তুমি? কোথায় খুঁজবো তোমায়! “
চিৎকার করতে করতে দৌড়াচ্ছে আরিশ। তালহার চোখ ছলছল করছে। ভাইয়ের এমন অবস্থা তার পক্ষে সহ্য করা সম্ভব হচ্ছে না। আরিশ উদভ্রান্তের মতো কাঁদতে কাঁদতে ছুটছে কেবল। প্রতিটি গাছের আড়ালে, লতাপাতার ঝোপের আড়ালে পর্যন্ত খুঁজছে তাকে। কিন্তু কোথাও পাচ্ছে না।
“ আমার অরার কিছু হলে আমি সবকিছু জ্বালিয়ে, পুড়িয়ে ছাই করে ফেলবো। “
তালহা দৌড়ে গিয়ে আরিশকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরল।
“ ভাইয়া প্লিজ শান্ত হও। এভাবে খুঁজলে ভাবিকে পাওয়া যাবে না। “
“ কীভাবে খুঁজলে পাবো, বল, বল, বলছিস না কেন?”
তালহা আরিশের পিঠে হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল,
“ তুমি শান্ত হও আগে। তারপর জঙ্গলের ওইদিকে চলো। ওদিকে ঘন জঙ্গল মনে হচ্ছে। “
কিছুটা শান্ত হলো আরিশ। আশেপাশে সতর্ক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করলো কিছু একটা। তারপরই একটা বুদ্ধি এলো মাথায়। গাড়ির দিকে এগোতে লাগলো সে। আকাশের অবস্থা শোচনীয়, সিটে পড়ে আছে সে। তবে জ্ঞান হারায়নি। আরিশ গাড়ির দরজা খুলে আকাশের চুলগুলো শক্ত করে ধরে দুই গালে থাপ্প* ড় দিতে লাগল। ব্য*থায় চেঁচিয়ে উঠলো সে।
“ কল দে চৌধুরীদের। জিজ্ঞেস কর, অরাকে কোথায় রেখেছে। আর বলবি, তুই অরার সাথে একবার দেখা করতে চাস, পুরনো হিসাব বাকি আছে। “
“ আমা… কে কেন বলবে…”
আকাশ কথা শেষ করার আগেই আরে দু’চারটা থা*প্পড় পড়লো তার গালে। কেঁদে উঠে বলল সে,
“ হ্যাঁ করছি কল। “
আরিশের ঠোঁটের কোণে ক্রুর হাসি ফুটল। আকাশের হাত খুলে ফেলল তালহা। অরাকে পেতে যতক্ষণ সময়, তারপর আকাশের জন্য কী অপেক্ষা করছে সেটা সে নিজেও জানে না।
মাথা নিচু করে বসে আছে অরা। কালাম তার দিকেই এগিয়ে আসছে। মুখে তার বিশ্রী হাসি! অরার সমানে চেঁচাচ্ছে। কিন্তু তাতে কালু ও কালামের কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই। কালু বলল,
“ ওর মুখটা বেঁধে ফেল তো। এতো ক্যাচক্যাচ শুনতে ভাল্লাগছে না। “
“ কী যে বলিস তুই! যত চেঁচাবে তত মজা। তুই দেখ, আমি আগে মধু খাই। “
কালামের কথায় খুব আনন্দ পেলো কালু। সে ভালোমতো বসল, যাতে সবকিছু ভালো করে দেখতে পারে।
“ কুত্তা* রবাচ্চা আমার দিকে এগোবি না। আমার স্বামী জানলে তোদের চুল পর্যন্ত খুঁজে পাওয়া যাবে না। “
“ ওহ তাই নাকি, মামুনি?”
কালু এ কথা বলেই হাসে। কালাম অরার হাত-পায়ের বাঁধন খুলতেই অরা পালাতে চেষ্টা করে। কিন্তু কালাম পরপর কয়েকটা থাপ্প* ড় মারায় মাটিতে লুটিয়ে পড়ে অরা।
“তুমি? তুমি এখানে কেন এসেছ?”
কালুর কণ্ঠে বিস্ম*য়। তার কথায় কালামও তাকাল। আকাশ দাঁড়িয়ে আছে সামনে, হাতে র* ক্ত। কালাম এক পা এক পা করে অরার দিক থেকে সরে এসে আকাশের দিকে এগিয়ে গেল। কালুও উঠে দাঁড়িয়েছে। আকাশকে দেখে ঘৃণায় মাটিতে থুথু ছুঁড়ে দিল অরা।
ঠিক তখনই, পরপর দুইটা গু* লির শব্দ কাঁপিয়ে দিল চারদিক। আতঙ্কে চিৎকার করে উঠল অরা।
মুহূর্তের মধ্যে মাটিতে লুটিয়ে পড়ল কালু ও কালাম। পায়ের মাঝ বরাবর গু* লি করেছে আরিশ। তালহা তখন আকাশের পাশে দাঁড়িয়ে।
আরিশ দৌড়ে এসে এক ঝাঁকুনিতে অরাকে জড়িয়ে ধরল।
গলা ছেড়ে কাঁদছে অরা, কাঁপছে সমস্ত শরীর।
আরিশের চোখমুখে ভয়ানক এক রূপ—রাগ, উদ্বেগ আর ভালোবাসার বিস্ফোরণ। সে শক্ত করে জড়িয়ে ধরেছে অরাকে, বুকের সঙ্গে আগলে রেখেছে ভালোবাসা আর প্রতিশ্রুতির মতো করে।
“ পাখি তুই কাঁদছিস কেন? কিচ্ছু হয়নি, কিচ্ছু না। শান্ত হ সোনা। জান আমার, আমি এসেছি। “
অরা আরিশকে জড়িয়ে ধরে আছে, এতটা জোরে যেন আরিশ এক চুলও নড়তে না পারে৷ আরিশ অরার কপালে, চুলে, মাথার তালুতে এলোপাতাড়ি চুমু খেলো কতগুলো।
“ ভাইয়া এদেরকে কী করবে? পুলিশ পৌঁছে যাবে কিছুক্ষণের মধ্যেই। “
আরিশ সবার দিকে একনজর দেখে নিলো। অরার চোখমুখ মুছে গালে হাত রেখে নরম কণ্ঠে শুধালো,
“ তোমার গালে কে মেরে* ছে? কে ছুঁয়েছে তোমাকে? “
অরা ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কালামের দিকে ইশারা করল। ওদের অবস্থা শোচনীয়।
কেউ স্বপ্নেও ভাবেনি, এই জায়গায় হঠাৎ করে আরিশ এসে হাজির হবে। সেজন্য সঙ্গে ছুরি ছাড়া কোনো অ* স্ত্রও ছিল না।
অরাকে টুক*রো করে ফেলতেই এনেছিল কয়েক রকমের ছুরি। কিন্তু এখন ওরাই যেন ছিন্নভি*ন্ন হয়ে পড়ে আছে মাটিতে।
আরিশ অরাকে শক্ত করে ধরে দাঁড় করাল।
চোখ বুলিয়ে নিল চারপাশে,চারদিকে নির্জনতা, সুনসান স্তব্ধতা। তারপর অরার কপালে একটি নরম চুমু খেল।
“দশ মিনিটের জন্য একটা ঘরে বসবে, চলো।
আমি আছি, এখানেই। তুমি একদম ভয় পাবে না, হামিংবার্ড।”
“আচ্ছা। ,”
মৃদু স্বরে বলল অরা।
আরিশ তাকে একটি নিরাপদ ঘরে বসিয়ে এল।
অরার মুখে এখনও ভয় আর ক্লান্তির ছাপ।
ওদিকে কালু আর কালাম ব্যথায় কাতরাচ্ছে, ছটফট করছে মাটিতে পড়ে। আকাশের অবস্থা সবচেয়ে করুণ,হাতে গুলি*র ক্ষত থেকে অনবরত র*ক্ত ঝরছে।
“ তালহা তুইও যা এখান থেকে। “
“ কিন্তু ভাইয়া!”
“ যেতে বলেছি। “
আরিশের কথার বাইরে যাওয়ার সাহস এখন কারো নেই। আহত সিংহের মতো হিংস্র হয়ে উঠেছে সে। তালহা আকাশকে ছেড়ে কিছুটা দূরে, নিরাপদে সরে গেল। মাটিতে ধপ করে লুটিয়ে পড়ল আকাশ।
আরিশ ধীরে ধীরে এগিয়ে গেল তার দিকে।
হাতে কালুর শান দেওয়া ছু*রি! পরনের শার্ট ছিঁড়ে আকাশের মুখ চেপে বেঁ*ধে দিল, আর তারপরই ঘটল এক ভয়াবহ দৃশ্য! আরিশ একে একে আকাশের আঙুলগুলো কুপি**য়ে কেটে ফেলতে শুরু করল। আকাশের আর্তনাদ মুখে বাধা পড়ায় কেবল উমউম শব্দে গুঁটিয়ে রইল। চারপাশ র*ক্তে সিক্ত, আকাশের দু’হাতের কাটা আঙু*লগুলো মাটিতে ছড়িয়ে আছে এলোমেলোভাবে। আরিশের চোখে তীব্র প্রতিশোধের আগুন,
হাতভর্তি র*ক্ত, ঠোঁটে এক তৃপ্ত, বিকৃত হাসি।
“ এই হাত দিয়ে আমার অরাকে এদের কাছে পৌঁছে দিয়েছিলি না? কাড়াকাড়ি টাকা নিয়েছিস, হাত দিয়েই তো? চিন্তা করিস না। যতটা কষ্ট আমার জানবাচ্ছাকে দিয়েছিস তার তিনগুণ কষ্ট দিয়ে মা*রবো তোকে। “
আকাশ কিছু বলতে পারছে না৷ কালু আর কালাম কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে বসে আছে। এতদিন শুধু নিজেরা খু ন করে এসেছে, আজ চোখের সামনে এভাবে খু ন হতে দেখে তারা অবাক হয়ে গেছে। আরিশ হাসতে হাসতে আকাশের চোখে ছু* রির ফলা ঢুকিয়ে দিলো এবার। যন্ত্রণায় মাটিতে লুটিয়ে পড়ে গলা কা*টা মুরগির মতে ছটফট করছে আকাশ। লঘু পাপে গুরু দন্ডের মতো অরাকে চৌধুরীদের হাতে তুলে দেওয়ার জন্য প্রান যাচ্ছে আকাশের। আরিশ সময় নিলো না। এবার একেবারে গলায় ছু*রি ধরে আকাশের ভবলীলা সাঙ্গ করে দিলো। কালাম আর কালু নিজেদের পরিণতি কী হবে সেই ভেবেই কাঁপছে।
“ স্যার আমাকে ছেড়ে দিন। আমি ম্যাডামের সাথে কিছু করিনি। গায়ে পর্যন্ত হাত দেইনি। কালাম… কালাম ম্যাডামকে মেরেছে, অসভ্যতা করতে চেয়েছিল। “
কালুর কথা শেষ হতেই কালাম চেঁচিয়ে বলল,
“ আমি কিছু করিনি। সব চৌধুরীদের আদেশে হয়েছে। আমাদের ছেড়ে দিন, স্যার। প্রানভিক্ষা দেন। “
আরিশ মুচকি হাসল। এগিয়ে গেলো কালামের দিকে।
“ আকাশকে টুক*রো টুক*রো কর। তারপর বস্তাবন্দি কর। “
চমকাল তারা। আরিশের মনোভাব বুঝতে পারলোনা কেউ। তবে আরিশের কথার বাইরে গেলো না কেউ। কিছু সময়ের ব্যবধানে আকাশের লা*শ টুক*রো টুক*রো করে বস্তায় ভরে রাখল কালু ও কালাম। যদিও এসব করতে বেশ কষ্ট হয়েছে তাদের। পায়ের যন্ত্রণায় ছটফট করছে দু’জনেই। আরিশের ঠোঁটের কোণে রহস্যময় হাসি। হঠাৎ
নিজের হাতের পিস্ত*লটা এগিয়ে দিলো কালামের দিকে।
“ এটা নে আর আমার হাতে গু* লি কর। “
কালু ও কালাম দু’জন দু’জনার দিকে তাকাল একবার। তারপর বলল,
“ কী বলছেন, স্যার! “
“ যা বললাম তাই কর। “
কালাম বাধ্য ছেলের মতো তাই করলো। আরিশের বাম হাতে একটা গু*লি করলো। গুলি**র শব্দে অরা এবং তালহা দু’জনেই চমকাল। তালহা আড়াল থেকে বেরিয়ে এলো। আরিশকে আহত অবস্থায় দেখে ছুটে এলো সে।
“ ভাইয়া! “
“ কল দিয়ে দেখ পুলিশ কতদূর। বলবি তুই লুকিয়ে কল করেছিস, এঁরা আমাকে গু*লি করেছে। “
“ কিন্তু তোমার পায়ে…. “
“ যা বললাম তাই কর, কুইক। “
অনিচ্ছা সত্ত্বেও তালহা দূরে চলে গেলো আবার। কালামের মনে ভয়। অরার সাথে যা করেছে সে, তাতে কি আরিশ ছাড়বে তাকে? আচমকাই আরিশ কালামের কপাল বরাবর গু*লি ছুড়লো। মুহুর্তেই কালামের নিথর শরীরটা মাটিতে লুটিয়ে পড়লো। ভয়ে জোরে কেঁদে উঠল কালু। আরিশের পা জড়িয়ে ধরল সে।
“ আমাকে মারবেন না, স্যার। আপনি যা বলবেন, সব করবো। শুধু জান ভিক্ষা দেন। “
আরিশের চোখের কোণে জল চিকচিক করছে। হাতের ব্যথা তাকে কাবু করছে। কালুর দিকে ঝুঁকে বসলো আরিশ। এরমধ্যে পুলিশের গাড়ির শব্দ শুনতে পেলো তারা।
“ তাড়াতাড়ি এই ছু*রি দিয়ে আমার পায়ে আঘাত কর।”
“ স্যার! “
“ প্রাণ বাঁচাতে চাইলে যা বললাম, তাই কর। “
কালু আরিশের পায়ে ছু*রি দিয়ে আঘাত করলো এবার। মাটিতে বসে পড়লো আরিশ। ফিসফিস করে বলল,
“ এখানে যা হয়েছে সবকিছুর দোষ নিজের কাঁধে নিবি তুই। বলবি, আকাশকে তোরা দু’জন খু*ন করে এমন করেছিস আর আমার ওপর হামলাও করেছিস। আমি সময়মত তোর জামিন করিয়ে নেবো। “
“ আমি সবকিছু বলবো। আপনি শুধু আমাকে মারবেন না। “
“ গুড। মনে রাখিস, উল্টাপাল্টা কিছু করলে তোর পরিবারের লোকজন বিপদে পড়বে। “
শুকনো ঢোক গিলল কালু। বাড়িতে তার বুড়ো মা আর একমাত্র ছেলে আছে। বউ মারা গেছে আরো তিন বছর আগে।
“ ঠিক আছে, স্যার। “
কিছুক্ষণের মধ্যেই পুলিশ এসে হাজির হলো।
পূর্বপরিকল্পনা মতো সবকিছুই নিখুঁতভাবে সম্পন্ন হলো। পুলিশ এসে কালুকে গ্রেফতার করল।
তারা জানে, আরিশ কেবল আত্মরক্ষার জন্য কামালের পায়ে গুলি করেছিল। আর কালু?
কালামকে সে নিজেই গু*লি করেছে—তাদের নিজেদের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বে।
আরিশকে চিকিৎসার জন্য নিয়ে যাওয়া হলো হাসপাতালে। গাড়িতে বসে অরা একটানা কাঁদতে লাগল। তার বুকের ভেতর এক অজানা শূন্যতা।
আরিশ যেভাবে আঘাত পেয়েছে, সেটাই ভেবে চোখে জল ধরে রাখতে পারল না সে।
তালহা মনে মনে আরিশের বুদ্ধির তারিফ না করে পারেনি।
হসপিটালের বেডে শুয়ে আছে আরিশ। পাশেই অরা বসে আছে । অপারেশন করে হাত থেকে গু*লি বের করা হয়েছে।
“ কাঁদছ কেন, হামিংবার্ড?”
অরার গালে হাত রেখে শুধালো আরিশ। অরা আরিশের হাতে চুমু খেলো একটা। পরক্ষণেই আরিশ কষিয়ে একটা থাপ্পড় বসাল অরার গালে।
বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে আছে অরা। কী হলো হঠাৎ বুঝতে পারলোনা।
“ তোমাকে সকালে বলেছিলাম না, রাতে আদর করবো? কেন পাকনামি করে আকাশের সাথে গেলে? তুমি অবাধ্য না হলে তো এসব হতোনা। এখন এই হাত দিয়ে ঠিকমতো আদর করতে পারবোনা তোমাকে। “
ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল অরা। আরিশের হাতটা ধরে আবারও চুমু খেলো সে।
“ সরি, রাগী ভুত। আর কখনো আপনার কথার অবাধ্য হবোনা। “
“ হলে আর আস্ত থাকবে না। “
শুকনো ঢোক গিলল অরা। আরিশের ঠোঁটের কোণে হাসি।
চলবে,