#হামিংবার্ড
#পর্ব_৪৫
#তাসমিয়া_তাসনিন_প্রিয়া
দরজায় ঠকঠক আওয়াজেও কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই তামান্নার। সে যেন আজ পণ করেছে– কিছুতেই ঘর থেকে বেরোবে না আজ।
“ তামু? এই তামু! দরজা খোলো। কতবার কল দিলাম, ছাদে যাবে না?”
ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করলো তালহা। তামান্না এখনো বিছানায় শুয়ে আছে। রাগে শরীর জ্বলছে তার। সে উঠলো না৷ ওভাবেই শুয়ে রইলো। তালহা বেশ কয়েকবার ডাকাডাকি করলো।
“ ঘুমিয়ে গিয়েছ, তামু? “
“ হ্যাঁ, আপনিও গিয়ে ঘুমান। “
তালহা ফিক করে হেসে উঠল। মেয়েটার কণ্ঠে রাগ আর অভিমান স্পষ্ট।
“লক্ষ্মীটি আমার, প্লিজ এসো, আই মিস ইউ।”
শোয়া থেকে উঠে বসলো তামান্না। মেয়েদের একটাই সমস্যা—ভালোবাসার পুরুষ একটু মিষ্টি করে বললেই সব কিছু ভুলে যায়।
তামান্নাও মন কম্পমান করে আস্তে আস্তে দরজা খুলে দিলো।
“ কী হয়েছে? “
কিছুটা রেগেই জিজ্ঞেস করলো তামান্না। তালহা তামান্নার হাতদুটো নিজের হাতের মাঝে ধরে বলল,
“ রাগ করেছ কেন, সোনা বউ?”
“ বউ! এতো ঢং করতে হবে না। কিছু হয়নি আমার। “
“ বুঝতে পেরেছি। রেবেকাকে বাসায় পৌছানোর জন্য, তাই তো?”
“ বুঝলে আবার ঢং করেন কেন, তালহা ভাই? “
তামান্না ভাই বলে ডাকাতে চোখমুখ ফ্যাকাসে হয়ে গেলো তালহার।
“ তারজন্য ভাই ডাকতে হবে? কী করবো বলো? ভাইয়ার আদেশ তার ওপর একটা মেয়ের নিরাপত্তার বিষয়। “
“ হুম জানি তো।”
আচমকাই তালহা তামান্নাকে জোরে বুকে জড়িয়ে ধরল। তামান্না হঠাৎ স্তব্ধ হয়ে গেলো, চোখ বড় করে চমকে উঠল। তার হৃদস্পন্দন বেড়ে গেলো, শ্বাস-প্রশ্বাস দ্রুত হতে লাগলো। মুহূর্তেই বুকে বাঁধা রাগ আর অভিমান যেন ভুলে গিয়ে তার শরীর ভরে গেলো তালহার উষ্ণতায়। তালহার স্পর্শে তার মন এক অন্য জাগরণে পৌঁছলো, যা আগে কখনো অনুভব হয়নি। ছোট্ট এই আলিঙ্গনে, দুজনের মাঝের দূরত্ব মুহূর্তেই মিশে গেলো।
“ লক্ষ্মীটি অভিমান করে থেকো না। “
তামান্না থরথর করে কাঁপছে। লজ্জায় আর ভালোবাসার মিশ্রণে ঠোঁট দিয়ে কথা বের হচ্ছে না।
“আমি… আমি ঘুমাবো। ছাড়ুন…”
তার কাঁপা কাঁপা গলায় কথা শুনে তালহা একটু হাসল, তারপর আলতো করে তাকে মুক্ত করে দিলো। সে-ও লজ্জায় লাল হয়ে উঠেছে, চোখ সরিয়ে নিচ্ছিলো। দুইজনের মধ্যেই সেই অদ্ভুত, মিষ্টি নীরবতা বাস করছিলো– যেখানে কথা কম, অনুভূতি বেশি।
“ শুভ রাত্রি। “
“ শুভ রাত্রি। “
তালহা হাত দিয়ে মাথা চুলকাতে চুলকাতে নিজের ঘরের দিকে ধীরে ধীরে এগোতে লাগল।
অন্যদিকে, তামান্না দরজা আঁটকে দেয়ার পর দ্রুত ধুরুধুরু করেও বুকে হাতে হাত রেখে বিছানায় শুয়ে পড়লো। তার মন এখনো থমথমে, শরীরটা লজ্জা আর অদ্ভুত উষ্ণতায় ভরপুর।
দিন যতই এগোচ্ছে সাবিহার প্রতি মেহরাবের ভালোবাসাও ততই বৃদ্ধি পাচ্ছে। আজকাল প্রায় কথা হচ্ছে দু’জনের। কখনো অল্পস্বল্প আবার কখনো বেশি। সাবিহাও নতুন দেশে নিজেকে মানিয়ে নেওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা করছে।
বাহিরে টিপটিপ বৃষ্টি নেমেছে, মেঘের ঘন আঁধার ছড়িয়ে পড়েছে চারদিকে। মাঝেমধ্যে গর্জন করে মেঘেরা তার গম্ভীর গান শোনাচ্ছে। শুক্রবার, অফিসের ছুটির দিন। তালহা, আরিশ দুই ভাই আজকের এই স্নিগ্ধ দিনে বাড়িতেই আছে । আরিশের হাতের ব্যথা এখন অনেকটাই সেরে গেছে।
বৃষ্টিমুখর এই দিনে খাবারও বিশেষ কিছু হওয়া লাগবে। তাই খিচুড়ির সঙ্গে মসলাদার গরুর মাংস ভুনা রান্না করা হয়েছে। আর এই বাড়ির ছেলেরা তো বিরিয়ানি ছাড়া আর কিছুতেই সন্তুষ্ট হয় না, তাই অন্য খাবারের বূলে একটু বদলে অন্যরকম খাবার তৈরি করা হয়েছে। তামান্না আর অরা মিলে যত্ন করে দুপুরের রান্নাবান্না শেষ করলো, ঘরটা যেন এখন ঘ্রাণে ভরে উঠেছে, মশলার টঙটঙানি আর রান্নার হাসি-আনন্দে।
গতকাল থেকে আরিশের আচরণ অরার কাছে অদ্ভুত লাগছে। যেন সে নিজেকে অরা থেকে একটু একটু করে দূরে সরিয়ে নিচ্ছে। কথা বলতেও যেন মন করছে না, শুধু জরুরি কিছু বলেই উঠে যাচ্ছে। এই হঠাৎ পরিবর্তন অরাকে শুধু অবাক করেনি, বরং তার মনকে আরও বেশি ব্যথিত করছে – এক ধরনের অকথিত কষ্ট, যা বুঝতে পারছে না কেন এমন হলো। অরার হৃদয় ঝড়ের মত বিক্ষুব্ধ, আর পাশে থাকা মানুষটা যেন তার থেকে হিমশীতল দূরত্ব বজায় রাখছে।
কাজকর্ম শেষে নিজের রুমে প্রবেশ করলো অরা। বিছানায় বসে আছে আরিশ। অরাকে খেয়াল পর্যন্ত করছে না। তপ্ত নিঃশ্বাস ছাড়ল সে। এগিয়ে গেলো আরিশের দিকে।
“ আপনার কী হয়েছে আরিশ?”
“ আমার কী হবে, হামিংবার্ড?”
“ জানি না, আমি। “
আরিশ কিছু বলল না। অরা কিছুক্ষণ তার পাশে চুপচাপ বসে রইল, তবুও আরিশ তাকে একবারও কাছে টানল না—একটু অবাক করা ব্যাপার। অবশেষে অরা নির্বিকার ভঙ্গিতে ওয়াশরুমের দিকে এগিয়ে গেলো।
অরা চলে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আরিশ দীর্ঘশ্বাস ফেলল। বউয়ের কাছ থেকে দূরে সরে থাকার চেয়ে বড় কষ্ট তার আর কিছু নেই—এই ভাবনা ঘোরাতে ঘোরাতে সে মেহরাবকে টেক্সট করল।
“ভাই, মনে হচ্ছে আমার নিঃশ্বাস আটকে আছে। এভাবে থাকা কি সম্ভব?”
কিছুক্ষণের মধ্যেই মেহরাবের রিপ্লাই আসলো,
“বউয়ের ভালোবাসা পেতে হলে, বউকে সারপ্রাইজ দিতে গেলো, এমন করতেই হবে বস।”
“রাখ, তোর কেরামতি! বউ আমার কাছে আসছে অথচ আমি হাবলা পুরুষদের মতো চুপচাপ বসে আছি! আরিশ খানের পক্ষে এটা কি সম্ভব বল?”
“তাহলে… কিছু বললাম না। দাঁত বের করা ইমোজি দুইটা।”
মেহরাবের টেক্সট দেখে মুচকি হাসল আরিশ। তারপর ফোন ধরলো, কোথাও কল করে খোঁজ নিলো সবকিছু ঠিকঠাক চলছে কি-না। অপরপ্রান্ত থেকে সান্ত্বনামূলক কথা শুনে কল কেটে দিলো সে।
“ নয়না! এই নয়না!”
মায়ের ডাকে হকচকিয়ে গেলো। পড়া বাদ দিয়ে পলাশকে নিয়ে ভাবনায় বিভোর ছিলো সে।
“ হ্যাঁ, মা। বলো।”
“ তুই বল তো, কী হয়েছে তোর? ইদানীং এতো অন্যমনস্ক থাকিস কেন?”
থতমত খেলো নয়না। থেমে থেমে বলল,
“ কই! কী হয়েছে বলো তো।”
“ তোর বাবা তোর জন্য কীসব জামাকাপড় নিয়ে এসেছে। ড্রইংরুমে গিয়ে দেখে আয়। “
“ নতুন ড্রেস!”উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে বলল সে।
“ আচ্ছা মা,যাচ্ছি। “
নয়না এক মুহুর্ত কালক্ষেপণ না করে ড্রইং রুমের দিকে এগোল। রোকসানা মল্লিকের খটকা লাগছে। নয়নার আচরণ মোটেও ঠিকঠাক লাগছে না উনার।
“ আজকে ঘুমাতে হবে না। “
আচমকা আরিশের এমন কথায় শোয়া থেকে উঠে বসলো অরা। আরিশ খাটের পাশে দাঁড়িয়ে আছে, হাতে একটা ব্যাগ।
“ কিন্তু কেন?”
“ আমার ইচ্ছে। উঠে এই শাড়িটা পরে নাও, পাখি। “
আরিশ অরার দিকে ব্যাগটা এগিয়ে দিলো। অরা ব্যাগটা হাতে নিলো। ধীরে ধীরে ব্যাগের ভেতর থেকে অপূর্ব, চোখ ধাঁধানো একটা শাড়ি বের করলো। খাঁটি সোনার জরির সুতোয় হাতে বোনা জামদানি। শাড়ির জমিনে সূক্ষ্ম মসলিন, আর পাড়জুড়ে জ্যামিতিক নকশা। যার মূল্য কয়েক লক্ষ টাকা! প্রতিটি সুতোয় যেন ইতিহাস, সংস্কৃতি আর ভালোবাসার ঘ্রাণ লেগে আছে।
অরা নিঃশ্বাস বন্ধ করে তাকিয়ে রইল।
“এটা… এটা তো কোনো সাধারণ শাড়ি না! মনে হচ্ছে অনেক দামি!
আরিশক হেসে বলল,
“না, এটা ‘তোমার’ শাড়ি। তোমার শাড়ি তো সাধারণ হতে পারে না, হামিংবার্ড।
নারায়ণগঞ্জের একজন বুড়ো তাঁতিকে দিয়ে হাতে বুনিয়েছি চার মাস ধরে।”
অরার দু-চোখ ঝাপসা হয়ে আসছে। টাকাপয়সার হিসাব করছে না সে কিন্তু এতগুলো মাস ধরে একটা শাড়ি তৈরি করানো মানে কতটা ভালোবাসা লুকিয়ে ছিলো তাতে!
“ আপনি… এতগুলো মাস ধরে এটা তৈরি করিয়েছেন!”
আরিশ অরাকে জড়িয়ে নিলো এবার। কপালে কপাল ঠেকাল। কোমরে শক্ত করে হাত রেখে বলল,
“ তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে নাও। আরো কিছু দেওয়ার বাকি আছে। “
অরা যেন দেহে প্রাণ ফিরে পেলো। এইতো তার চেনা মানুষটা। মুচকি হাসল সে।
“ আমি রেডি হয়ে আসছি। “
“ এখানেই চেঞ্জ করো। “
“ কিন্তু আপনি….. “
আরিশ কিছু বলল না। হুট করে রুমের অন্য দিকে চলে গেলো। তপ্ত নিঃশ্বাস ছাড়ল অরা। রুমে বসেই চেঞ্জ করার সিন্ধান্ত নিলো। আরিশ যে অন্য দিকে গিয়ে দাঁড়িয়েছে এটাই অনেক।
“ এখন চেঞ্জ করো, হামিংবার্ড।”
আচমকা আরিশের আগমনে চমকাল মেয়েটা। চেয়ার নিয়ে এসে, আঁটসাঁট হয়ে বসেছে সে।
“ আপনি! “
“ হ্যাঁ আমি, তোমার একমাত্র স্বামী। শুরু করো। “
অরা কী বলবে সেটাও যেন ভুলে গেলো। এর সাথে কথা বাড়িয়ে লাভ নেই। ঝটপট চেঞ্জ করে নিলো অরা। চুলগুলো আঁচড়ে, কানে ডায়মন্ডের দুল ও গলায় নেকলেস পরে নিলো। তবে সব গয়নাই সিম্পল। আরিশ মুগ্ধ নয়নে অরার দিকে তাকিয়ে আছে।
“ ঠিক আছে? “
গলা নিচু করে শুধালো অরা। আরিশ বসা থেকে উঠে অরার দিকে এগোল।
“ ইচ্ছে করছে আদর করি কিন্তু এখন তোমাকে ধরলে সব সাজগোছ নষ্ট হয়ে যাবে। ‘“
অরা ফিক করে হাসলো। বেচারা আরিশ! দেয়ালঘড়ির দিকে তাকিয়ে আছে সে। আর মাত্র দু’মিনিট বাকি!
রাত ঠিক বারোটা।
ঘরের বাতি নিভে গেল আচমকাই। অরা কিছু বুঝে ওঠার আগেই চারপাশ আলোয় ভরে উঠল– হালকা গোলাপি, সোনালি আর মোমবাতির নরম আলো। ব্যাকগ্রাউন্ডে ধীর লয়ের পিয়ানো মিউজিক বাজছে ।
নরম সাদা পর্দার আড়াল থেকে এগিয়ে এলো আরিশ। হাতে এক কালো ভেলভেট বক্স, ঠোঁটে মৃদু হাসি।
“শুভ জন্মদিন, মাই প্রিন্সেস।”
চমকাল অরা। আজ ওর জন্মদিন! ভুলেই গিয়েছিল সে। চোখ ছলছল করে উঠলো তার।
“ আজ আমার জন্মদিন, সেটাও আপনি জানেন!“
“ আমার বউয়ের কোন তারিখ কী, সবকিছুই জানি আমি, ডার্লিং। “
আরিশের ঠোঁটের কোণে দুষ্ট হাসি। লোকটা আর ভালো হলোনা। পেছন থেকে আরিশ জড়িয়ে ধরলো তাকে। তারপর সামনে এসে ধীরে ধীরে হাতে তুলে ধরল কালো রঙের ভেলভেট বক্সটা।
অরা কাঁপা কণ্ঠে বলল,
“এইটার দরকার ছিল না…”
আরিশ হাসল,
“তোমার জন্মদিনে আমি শুধু একটা জিনিস দিতে চেয়েছি– তোমার মতো রাজকীয় কিছু।”
বক্স খুলতেই আলোর ঝলক, যেন তারার চেয়ে বেশি উজ্জ্বল কিছু! হোয়াইট গোল্ডে গড়া, হীরা, ওনিখস আর সবুজ এমারেল্ড চোখে পরা এক রাজসিক চিতা। নেকলেস নয়, যেন অরার গলার জন্য তৈরি এক রাজমুকুট।
“ তোমাকে এই জগতে একমাত্র আমার বলে জানাতে এর চেয়ে দামি কিছু আমি পাইনি। আমার সর্বোচ্চ দেওয়ার চেষ্টা করেছি হামিংবার্ড।”
আরিশ বলল মৃদু কণ্ঠে। অরা এখনও গয়নাটার দিকে তাকিয়ে আছে। চোখ ফেরাতে পারছে না।
“ এজন্যই গতকাল থেকে ওরকম অদ্ভুত আচরণ করছিলেন? “
“ অদ্ভুত? “
“ হুম। রাগ করছিলেন না, জোর করছিলেন না,আর আদ…..”
থেমে গেলো অরা। লজ্জা লাগছে তার। আরিশ মিটিমিটি হাসছে। আচমকাই অরার হাত দুটো পেছনে চেপে ধরে ঘাড়ে মুখ গুঁজে দিলো সে। চোখ বন্ধ করে ফেলল অরা।
“ আই লাভ ইউ, অরা। ডু ইউ লাভ মি?”
অরার সমস্ত শরীর থরথর করে কাঁপছে। ঠোঁট কাঁপছে কিছু বলতে, কিন্তু শব্দ বেরোচ্ছে না। চোখে মুখে দ্বিধা, সংকোচ আর গভীর আবেগের মিশ্র ছায়া। আরিশ অপেক্ষায়– তার ধৈর্যের সীমা যেন শেষপ্রান্তে এসে দাঁড়িয়েছে। অরার এই দীর্ঘ নীরবতা অসহ্য ঠেকছে তার কাছে।
অরা নিজেকে সামলে নিচ্ছে, ভেতরে ভেতরে সাহস সঞ্চয় করছে। সেও আজ বলতে চায়… ভালোবাসার সেই জমে থাকা কথা। ঠোঁট খোলার চেষ্টা করতেই হঠাৎ- ঘাড়ে তীব্র এক ব্যথা অনুভব করলো সে।
চমকে উঠল অরা। মুহূর্তেই বুঝে গেল, অধৈর্য আরিশ তার ঘাড়ে কামড়ে দিয়েছে। ভালোবাসার উন্মাদনায়, একরোখা আবেগে এমন পাগলামিটুকু করাতে নিজেকে থামাতে পারলো না আরিশ।
“ লাগছে, আমার।”
আরিশ মুচকি হাসল। অরার কথা অগ্রাহ্য করে পরপর অনেকগুলো কামড় বসাল ঘাড়ে।
“ অপেক্ষা করালে কেন, হামিংবার্ড? আমি অপেক্ষা করতে পারি না। আমার উত্তর চাই। “
“ আমি…. আমি…. “
“ থাক। আজকের দিনটা তোমার। তাই আজ কোনো জোর করবোনা। কাল থেকে প্রতিদিন, প্রতিরাত শুধু আমার। বুঝেছ, পাখি? অধৈর্য আমি আর ধৈর্য ধরতে পারছি না। “
অরা মাথা নাড়লো কেবল। আরিশ তাকে কোলে তুলে নিয়ে দরজার দিকে এগোল। অরা কৌতূহলী হয়ে জিজ্ঞেস করলো,
“ কোথায় যাচ্ছেন? “
“ ওয়েট এন্ড সি। “
অরা চুপ করে গেলো। ঘর থেকে বেরিয়ে বারান্দা দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে আরিশ। তার প্রতিটি পদক্ষেপের সাথে বারান্দায় রঙবেরঙে আলো জ্বলে উঠছে। অরা অবাক হয়ে দেখছে সবকিছু। আরিশ একপা এক পা করে এগিয়ে চলছে সাথে রঙিন বাতি জ্বলে উঠছে এবং লাল গোলাপের পাপড়ি ঝড়ে পড়ছে। সবকিছু স্বপ্নের মতো সুন্দর লাগছে অরার কাছে ।
এক পা এক পা করে তারা যখন সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামছিল, তখন মনে হচ্ছিল তারা কোনো স্বপ্নের দৃশ্যের মাঝে হাঁটছে।
ড্রইংরুমে পৌঁছাতেই থমকে দাঁড়াল অরা। এক মুহূর্তের জন্য যেন নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে এল তার। চারপাশে সব পরিচিত মুখ, তাদের চোখে ভালোবাসা আর উচ্ছ্বাস। কেউ হাসছে, কেউ চোখ মুছছে। সবাই নতুন জামাকাপড় পরে দাঁড়িয়ে আছে, এমনকি অরার বাবার বাড়ির মানুষজনও! পুরো ঘর জুড়ে বাতাসে ভাসছে কনফেটি আর গোলাপের ঘ্রাণ।
তাকে কোলে রেখেই নিচে নামিয়ে দিলো আরিশ। এরপর ধীরে ধীরে তার হাত ধরে সামনে নিয়ে এলো। চারপাশ থেকে গেয়ে উঠলো সবাই—
❝ হ্যাপি বার্থডে টু ইউ! হ্যাপি বার্থডে টু ইউ….
হ্যাপি বার্থডে ডিয়ার অরা… হ্যাপি বার্থডে টু ইউ…. ❞
্
রোকসানা মল্লিক মেয়েকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলেন, মমতার স্নেহে ভরা একটুখানি চুমু রাখলেন মেয়ের গালে। নয়না আদরে আপ্লুত হয়ে বোনকে আলতো করে জড়িয়ে ধরেছে, চোখে তার আনন্দের দীপ্তি। চারপাশে ছড়িয়ে পড়েছে এক উষ্ণ, ভালোবাসায় ভরা আবহ। সবাই খুব খুশি, হাসির ঝিলিকে ভরে উঠেছে পুরো ঘরটা।
অরার সুখ, আনন্দ সব একাকার হয়ে গেছে এই মুহূর্তে। তার চোখের কোণে জমে থাকা জলের বিন্দুগুলো গড়িয়ে পড়ল গাল বেয়ে। সে কখনো কল্পনাও করেনি যে তার জন্মদিন এমন বিস্ময় আর ভালোবাসায় ভরা হবে। আরিশ চুপচাপ পাশে দাঁড়িয়ে অরার প্রতিক্রিয়া দেখছে। সে চোখে চোখ রেখে মৃদু হাসল।
অরা চারপাশে তাকিয়ে দেখে, দেয়ালের ওপরে বড় করে লেখা,
“আমাদের আলো অরা, শুভ জন্মদিন।”
রঙিন বেলুন, ঝলমলে লাইটিং, পাপড়ির ছড়াছড়ি– সব মিলিয়ে পুরো বাড়িটা যেন স্বপ্নপুরী হয়ে উঠেছে। ড্রইং রুমের এক পাশে রাখা বিশাল কেকটার দিকে তাকিয়ে থাকে কিছুক্ষণ, তারপর হাসিমুখে বলে,
“এতকিছু… আমার জন্য? তোমরা আমাকে এতো ভালোবাসো!”
রোকসানা মল্লিক বললেন,
“তুই আমাদের পৃথিবী রে মা, তোকে ভালো না বাসলে কাকে বাসবো?”
নয়না হেসে বলে,
“তোর জন্য আজকের পুরো দিনটায় শুধু চমক আর চমক আপু! সবকিছুই দুলাভাইয়ের কাজ। ”
আরিশ সামনে এসে অরার কানে ফিসফিসিয়ে বলে,
“চলো, কেক কাটো। এরপরে আরও কিছু চমক বাকি আছে!”
অরা বিস্ময়ের চোখে তাকায় ওর দিকে।
“আরও?”
আরিশ মুচকি হেসে চোখ টিপে দেয়। অরা বুঝে যায়, আজকের রাতটা শুধু তার, আর শুধু আরিশের ভালোবাসায় মোড়ানো এক স্বপ্নের রাত হতে চলেছে।
কেক কাটার পর বাড়ি ভরে ওঠে হাততালি, ক্যামেরার ফ্ল্যাশ আর হাসির রোলেও। অরা এক এক করে সবার মুখে কেক তুলে দিচ্ছে। সবার প্রথমে অবশ্য আরিশকেই খাইয়ে দিয়েছে। কেক খাওয়া শেষে, আরিশ দূরে দাঁড়িয়ে কিছু একটা নিয়ে ব্যস্ত। অরা খেয়াল করলেও কিছু বুঝতে পারছে না। হঠাৎ ঘরের আলো নিভে গেলো। চারদিকে অন্ধকার। সকলে চুপ হয়ে গেছে ।
ঘর জুড়ে নেমে এসেছে গভীর অন্ধকার।
তারপরই চারদিক থেকে একসাথে নীলচে, বেগুনি, রূপালি আলো ছড়িয়ে পড়ল । দেয়াল, ছাদ, মেঝে – সবকিছু হারিয়ে গেলো কোনো এক বিশাল গ্যালাক্সির ভিতর।
তারার ঝিলিমিলি, ঘুরছে গ্রহ, উড়ছে উল্কা, দূরে সরে যাচ্ছে নীহারিকা।
ঘর নয়, মনে হয় অরা দাঁড়িয়ে আছে অনন্ত মহাকাশের মাঝে। চোখের সামনে দিয়ে বয়ে যাচ্ছে একটার পর একটা অসাধারণ দৃশ্য – একবার ধূসর চাঁদ, আবার কোনো লাল গ্রহ। একেক কোণ থেকে ভেসে আসছে নরম স্পেস সিম্ফোনি, যেন মহাবিশ্ব নিজেই তার কানে গাইছে।
আর এই সবকিছুর মাঝে, সামনে দাঁড়িয়ে আছে আরিশ। আলো এসে পড়ছে তার মুখে। হাতে ধরা একটা ছোট রিমোট।
আরিশ হেসে বলল,
“তোমার জন্য গোটা মহাবিশ্ব এনে দিলাম, হামিংবার্ড। নাও টেল মি… উইল ইউ বি দ্য কুইন অব মাই ইউনিভার্স?”
অরার চোখ বিস্ময়ে ছলছল করে ওঠে। সে কিছু বলতে পারে না, শুধু এক ধাপ এগিয়ে এসে আলতো করে জড়িয়ে ধরে আরিশকে। চমকাল আরিশ। অরা সবার সামনে এভাবে তাকে আলিঙ্গন করলো!
অরা কাঁপা কাঁপা গলায় বলল,
“ ইয়েস… আই ওয়ান্ট নাথিং মোর দ্যান টু বি দ্য কুইন অব ইয়োর ইউনিভার্স। “
চলবে….
#হামিংবার্ড
#পর্ব_৪৬
#তাসমিয়া_তাসনিন_প্রিয়া
[ কঠোরভাবে প্রাপ্তমনস্কদের জন্য উন্মুক্ত। ]
অরা কাঁপা কাঁপা গলায় বলল,
“ ইয়েস… আই ওয়ান্ট নাথিং মোর দ্যান টু বি দ্য কুইন অব ইয়োর ইউনিভার্স। “
স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়ল আরিশ। এতগুলো মাস পর অরা আজ নিজে থেকে তার জগতের রাণী হতে চেয়েছে। অবশেষে একটা সুস্থ, স্বাভাবিক জীবন পেতে চলছে সে।
“ ওকে, হামিংবার্ড। এখন ছাড়ো, সবাই তাকিয়ে আছে। এসবের জন্য সারা রাত পড়ে আছে। বিশ্বাস করো, আজকে তোমাকে এক সেকেন্ডও ঘুমাতে দেবোনা। “
শেষের কথাগুলো ফিসফিস করেই বলল আরিশ। অরা লজ্জায় তৎক্ষণাৎ তাকে ছেড়ে কিছুটা দূরে সরে দাঁড়াল।
তালহা, তামান্না আর নয়না এগিয়ে এলো অরার দিকে। পাশেই দাঁড়িয়ে আছে আরিশ, ঠোঁটে মুচকি হাসি। অরার চোখে সে স্পষ্ট ভালোবাসার ঝিলিক দেখেছে—এই ভালোবাসা পাওয়া মানে আরিশের জন্য যেন গোটা পৃথিবীটাই জিতে নেওয়া।
“আপু, ভাইয়াকে বলো না, আমাদের ব্ল্যাকহোলটা দেখাক!”
নয়না উচ্ছ্বসিত গলায় বলল।
আরিশ হাতের রিমোটটা তুলে কয়েকটা বোতামে চাপ দিল। মুহূর্তেই দৃশ্যটা বদলে গেল।
ঘরের মাঝখানে এক স্বচ্ছ কাঁচের উপর ভাসছে একটি হলোগ্রাফিক সৌরজগৎ। নক্ষত্রগুলো ধীরে ঘুরছে, মাঝে মাঝে উল্কা ভেঙে পড়ছে প্ল্যানেটে। হঠাৎই একটি ব্ল্যাকহোল তৈরি হয়ে গ্রাস করে নিচ্ছে একটি নীল গ্রহকে। নয়না,তালহা, অরা, তামান্না সবাই চোখ মেলে তাকিয়ে থাকে, বিস্ময়ের অতলে ডুবে যেতে যেতে। সবকিছু একেবারে বাস্তব মনে হচ্ছে। নয়না তো হা করে তাকিয়ে দেখছে সবকিছু।
“ওয়াও! ইট’স অ্যামেইজিং!”
নয়নার চোখে-মুখে বিস্ময়ের ছাপ।
“আরও কিছু দেখাবো, নয়না?”
আরিশ একটু রহস্যময় হাসি হেসে জিজ্ঞেস করলো।
নয়না সঙ্গে সঙ্গে মাথা নেড়ে সায় দিল।
অরাসহ সবার চোখেমুখেই বিস্ময়ের ঝিলিক। অসীম আর অজানার প্রতি তাদের কৌতূহল যেন আরও বেড়ে উঠলো।
আরিশ কিছু না বলে অরার হাত ধরে তাকে নিয়ে গিয়ে একটা নরম সোফায় বসলো। বাকিরাও ওদের দেখাদেখি পাশে এসে বসে পড়লো, যেন সামনে কী আসছে তা জানার আগ্রহে একসাথে অপেক্ষা করছে সবাই।
ঘরটা ঘুটঘুটে অন্ধকার, অথচ কোথাও একটুও ভয় নেই। বরং যেন মাথার ওপর ছড়িয়ে আছে কোটি কোটি তারা, রঙিন গ্যাস ক্লাউড, ছায়াপথের ঘূর্ণি। নয়না ও অরা দুজনেই নরম সাদা বসে আছে, চোখ উপরের দিকে স্থির।
একটা গভীর নীল নেবুলা আস্তে আস্তে ঘুরতে ঘুরতে ছড়িয়ে পড়ছে পুরো ছাদজুড়ে। দূরে একটা ব্ল্যাকহোল জন্ম নিচ্ছে—সব আলোকে গিলে নিচ্ছে।
হঠাৎ, নরম অথচ অচেনা এক কণ্ঠ ভেসে এল চারপাশ থেকে। কণ্ঠটা যেন বাতাসেই মিশে আছে।
“আজ আপনি কোন গ্যালাক্সিতে ভ্রমণ করতে চান?”
অরা চমকে তাকাল আরিশের দিকে। আরিশ হেসে বলল,
“এটা AI কনসিয়ার্জ। ঘরেরই অংশ।”
AI আবার বলল,
“আপনার হৃদস্পন্দন কিছুটা ধীর… আপনি কি শান্ত কোনও ভ্রমণ পছন্দ করবেন? নাকি আজ একটু ঝড়ের মধ্যে হারিয়ে যেতে চান?”
অরা চুপচাপ বসে রইলো। নয়না হালকা গলায় বলল,
“আমরা কিছু নতুন কিছু চাই। খুব পুরনো কোনো গ্যালাক্সি—যেটা হয়তো এখন আর অস্তিত্বেই নেই।”
ঘরের আলো বদলে যেতে লাগল। আগের শান্ত নীল এখন রূপ নিচ্ছে আগুনে লাল আর গাঢ় সবুজে। কোথা থেকে যেন বাজ পড়ার শব্দ এল, যেন হাজার বছর আগের কোনো নক্ষত্রের বিস্ফোরণ।
AI কণ্ঠ আবার ভেসে এলো,
“স্বাগতম—GN-Z11-তে। এই গ্যালাক্সি জন্ম নিয়েছিল বিগ ব্যাংয়ের মাত্র ৪০০ মিলিয়ন বছর পরে। এটি আজ আর নেই… কিন্তু আজ রাত আপনারা সেখানে ফিরে যাচ্ছেন।”
অরা ধীরে ধীরে আরিশের হাত ধরল। চোখে জল চলে এসেছে তার। আরিশ অরার গালে হাত রাখল, শান্তভাবে।
“এটা এখন শুধু ঘর না, অরা… এটা এখন একটা টাইম মেশিন ভাবতে পারো। নয়না আর তুমি এসব পছন্দ করো। সেজন্য ভাবলাম, তোমার স্পেশাল রাতটা আরেকটু স্পেশাল করা যাক।”
“ এসব কীভাবে করলেন? আমাদের দেশে এসব প্রযুক্তি আছে? “
“ ই-মার-সিভ থ্রি সিক্সটি ডিগ্রি প্রোজেকশান ম্যাপিং সিসটেম এর মাধ্যমে করেছি। আছে তবে , এগুলো আমেরিকা থেকে আনিয়েছি। “
নয়না মুচকি হেসে বলল,
“ আপুরে ভাইয়া তো পারলে তোর জন্য চাঁদটাও নিয়ে আসতো!”
অরা লম্বা নিঃশ্বাস ছাড়ল। সত্যি আজ নিজেকে ভীষণ ভাগ্যবতী মনে হচ্ছে। আরিশের হাতে হাত রেখে বসে রইলো অরা। এক এক করে মহাবিশ্বের অনেককিছু দেখা হলো তাদের।
রাত একটার দিকে সবাই সবার জন্য বরাদ্দকৃত ঘরে ঘুমোতে গেলো। আগামীকাল সন্ধ্যায় অরার জন্মদিন উপলক্ষে খান বাড়িতে পার্টি আছে। তাই মল্লিক পরিবারের সবাইকে এই দু’দিন এ বাড়িতেই থাকতে হবে।
নিজেদের ঘরে ফিরল আরিচ আর অরা। ঘরটা হালকা আবছা আলোয় ভরে আছে। জানালার পর্দা নরম হাওয়ায় একটু একটু দুলছে। বাইরে হয়তো চাঁদ উঠেছে, কিন্তু আরিশের চোখে এখন একটাই আলো– অরা।
অরা ড্রেসিং টেবিলের সামনে বসে গয়নাগুলো একে একে খুলে রাখছিল। সব গুছিয়ে নিয়ে এবার চুলে ব্রাশ চালাচ্ছে ধীরে ধীরে।
হঠাৎ আয়নায় চোখ পড়ে গেল—পেছনে দাঁড়িয়ে আছে আরিশ।
একটু চমকে উঠলেও ভেতরের আবেগ চাপা দিয়ে নিচু গলায় বলল,
“এভাবে দাঁড়িয়ে কী দেখছেন?”
অরার প্রশ্নে আরিশ মুচকি হাসল। তার পরনে শুধু একটা শর্টস।
“আমার পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর দৃশ্য দেখছি।,”
চোখ না সরিয়েই বলল সে।
ধক করে কেঁপে উঠলো অরার বুক। আরিশ যখন এভাবে বলে, তখন সত্যিই যেন ডুবে যেতে ইচ্ছে করে মেয়েটার।
অরা চুপচাপ, মাথা নিচু করে বসে আছে। পরনে কালো রঙের একটা নরম, কোমল নাইটি—যেটা আরিশই তাকে উপহার দিয়েছে।
আরিশ ধীর পায়ে এসে দাঁড়াল ওর পেছনে। অরার বুক ধুকপুক করতে লাগলো—মনে হলো, এখনই ছুঁয়ে দেবে সে। ঠিক তাই হলো। আরিশ তার কাঁধে থুতনি রাখল। তারপর হাতে আলতো করে অরার থুতনি তুলে আয়নার দিকে তাকাতে ইশারা করল।নঅরা তাকাল। আয়নায় স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে তাদের দু’জনকে একসাথে, এক ফ্রেমে। মুচকি হাসল অরা। আয়নাটাও যেন সেই মুহূর্তে ভালোবাসায় ভরে উঠল।
“কেমন লাগছে, আমাদের?”
আরিশের কণ্ঠে মিশে আছে গভীর আবেগ।
“সুন্দর।”
অরা আস্তে বলল, চোখ নামিয়ে।
“কতটা সুন্দর?”
আরিশ একটু ঝুঁকে প্রশ্নটা করতেই থমকে গেল অরা।
ঘাবড়ে গেল সে। কী বলবে, বুঝে উঠতে পারছে না। বুকের ভিতর হালকা ধকধক শুরু হয়ে গেছে। আরিশ যতই সুস্থ হোক, তার ভেতরের পাগলামি যে একটুও কমেনি।
“সুন্দরের আবার পরিমাণ হয়?”
অরা চোখ না তুলে জিজ্ঞেস করল।
“আলবাত হয়।”
আরিশ মুচকি হাসল।
“আমি জানি না…”
অরার গলা নরম হয়ে এলো, যেন নিজের অনুভবটুকু সে নিজেও পুরো বুঝে উঠতে পারছে না।
আরিশ হঠাৎই অরাকে কোলে তুলে নিলো। অরা চমকে উঠলেও প্রতিবাদ করল না। সত্যি বলতে, আজ সে নিজেও অপেক্ষায় ছিল – আরিশের স্পর্শ, তার উষ্ণতা, তার ভালোবাসার কাছে নিজেকে সঁপে দেওয়ার। এই দূরত্বের সময়টুকু অরার বুকের ভেতর অনেক শূন্যতা তৈরি করেছে।
“তাহলে তুমি কী জানো, হামিংবার্ড?”
আরিশের কণ্ঠে আবেশ।
বিছানার কিনারে এসে তাকে শুইয়ে দিতে চাইল, কিন্তু অরা হঠাৎই আরিশের গলা জড়িয়ে ধরল।ফলে আরিশ কিছুটা ঝুঁকে ওর ওপর ভর করে দাঁড়িয়ে রইল। চোখে চোখ পড়তেই সময়টা যেন থেমে গেল। অরা আরিশের কানের পাশে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বলল,
“কংগ্রাচুলেশনস, মি. তেজরিন খান আরিশ – আই লাভ ইউ।”
এক মুহূর্তে সব শব্দ যেন থেমে গেলো।
আরিশ চুপ করে রইলো, তার চোখে-মুখে নীরব বিস্ময়। শব্দহীন ভালোবাসার ভারে যেন চারপাশ নিঃশব্দ হয়ে এলো। সবকিছু তার কাছে এক মুহূর্তে বরফের মতো স্থির হয়ে গেছে – গলে যাওয়ার আগ মুহূর্তের মতো নিঃশব্দ।
অরা তার গালের পাশে নরম করে একটা চুমু দিল। তবেই যেন চেতনায় ফিরলো আরিশ। নড়েচড়ে উঠল সে। অরাকে নিজের সামনে বসিয়ে, চোখে চোখ রেখে ধীরে বসে পড়ল।
“সে, এগেইন, জান প্লিজ!”
আরিশ মুচকি হাসল, কাঁধ একটু ঝাঁকিয়ে বলে উঠল।
“আই লাভ ইউ।”
অরা লজ্জায় মুখ চেপে ধরে গলাও ভেসে আসছিল।
“আরেকবার বলো, প্লিজ!”
আরিশের চোখে ছিল খুনসুটি আর মায়া মিশ্রিত আবেদন।
“আই… লাভ ইউ, আরিশ।”
আরিশ কিছু বলতে পারল না। অরার মুখে পরপর তিনবার “আই লাভ ইউ” শুনে আরিশের চোখ হঠাৎ বিস্তৃত হয়ে গেলো, মনে হলো যেন জগৎ থমকে গেলো এক মুহূর্তের জন্য।
শরীরটা নিস্তব্ধ হয়ে পড়লো, মনের ভিতরে এক অজানা ধাক্কা অনুভব করলো,পুরো পৃথিবী যেন থেমে গেছে। তার মাথায় আবেগ আর পাগলামির এক অদ্ভুত মিশেল বইতে শুরু করলো। হঠাৎ করে আরিশ অরার কোলে পড়ে গেলো, পুরো দেহ কাঁপছে। অরা আতঙ্কিত হয়ে টি-টেবিলের ওপর রাখা পানির গ্লাস থেকে কিছুটা পানি হাতে ঢেলে আরিশের চোখেমুখে ছিটাতে লাগলো।
“ জ্ঞান হারাইনি, হামিংবার্ড। ঠিক আছি আমি। “
মিনিট পাঁচেক পর স্বাভাবিক হলো আরিশ। অরা তো ভয়ে ভয়ে বসেছিল এতক্ষণ। আরিশ এবার শোয়া থেকে উঠে বসলো। অরাকে শক্ত করে জাপ্টে ধরে কপালে, গালে, চোখের পাপড়িতে, নাকের ডগায় অজস্র চুমু খেলো সে।
“ আমি জানি না, বউয়ের মুখে ভালোবাসি কথা শোনার পর আর কোনো পুরুষের এমন অবস্থা হয়েছিল কি-না । “
“ সে তো ঠিক আছে। কিন্তু আপনি আমার কথার জবাব দিলেন না।”
মুখ গোমড়া করে বলল অরা। আরিশ জোরে হেসে উঠল।
“ আই লাভ ইউ টু, হামিংবার্ড। “
অরার ঠোঁটের কোণে এক ধীরে ধীরে, সুন্দর একটা হাসি ফুটল। আরিশ তাকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে নিলো, নিজের শরীরের প্রতিটা স্পন্দন দিয়ে ধরে রাখলো। তার হাত যখন অরার কোমর ঘিরে গেলো, মনে হলো যেন ওকে ছেড়ে দেওয়ার কোনো ইচ্ছাই নেই আর। অজস্র গভীর, দাবালো চুমু খেলো আরিশ অরার গালে, কপালে, নাকের ডগায় – একেবারে নিজের হওয়ার দাবিতে।
অরা চোখ বন্ধ করে দিলো, লম্বা লম্বা নিঃশ্বাস নিচ্ছে, যেন এক মুহূর্তে পুরো শরীরই আগুনে ঝলসে উঠছে। হঠাৎ করেই আরিশ অরাকে কোলে তুলে নিলো, শক্তপোক্ত বাহুতে জোরে জোরে জড়িয়ে ধরে। অরার দুই পা আরিশের পিঠে বাচ্চাদের মতো ছুঁয়ে ধরেছে, যেন সে সম্পূর্ণরূপে তার উপর নির্ভরশীল। আরিশের বুকের স্পন্দন তীব্র, শরীর জুড়ে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ছে।
“এভাবে কোলে নিলেন কেন?”
অরা থেমে গিয়েছিলো, গলার স্বর কাঁপছে হালকা।
আরিশ ঠোঁটের কোণে অদ্ভুত এক হাসি নিয়ে ওকে সোজা কোলে রেখেই গিয়ে ঠেকাল দেয়ালে। চমকে উঠলো অরা। বুক ধুকপুক করছে, চোখে স্পষ্ট কৌতূহল আর ভয়মিশ্রিত উত্তেজনা।
আরিশ ওর কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করল,
“এখন দেখো… কেনো নিলাম।”
দেয়ালে ঠেকা অরার পিঠে আরিশের হাত, আর তাদের দুজনের মাঝে নিঃশ্বাসের তাপ… মুহূর্তটায় তীব্র উত্তাপ ছড়িয়ে পড়ল।
আরিশ অরাকে আর এক মুহূর্তও কথা বলার সুযোগ দিলো না। চুপিসারে ঠোঁটের ওপর ঠোঁট রাখল, যেন কোনো শব্দ নয়, শুধু অনুভবের ভাষা বলার সময় এখন। আবেশে চোখ বন্ধ করে ফেলল অরা। মুহূর্তেই সমস্ত চিন্তা, সমস্ত সংশয় বিলীন হয়ে গেল। এক হাতে ও আরিশের গলা জড়িয়ে ধরেছে, আর অন্য হাতে ওর চুল খামচে ধরেছে, তীব্র ভালোবাসা আর অভিমান একসাথে ছুঁয়ে দিচ্ছে চুমুর গভীরে।
তারপর যখন সময়টা একটুও আর নিয়ন্ত্রণে থাকে না, আরিশ ধীরে ধীরে ওকে চুমু থেকে আলগা করল, এবং আচমকাই কোমরে হাত দিয়ে নরমভাবে অরাকে দাঁড় করিয়ে দিলো। তাদের নিঃশ্বাস ভারী, চোখে চোখ লেগে আছে, যেন পরের মুহূর্তে ঝড় উঠবে।
“ কী হলো?”
অরার অস্থির লাগছে। অনুভূতি সামলাতে হিমসিম খাচ্ছে সে। আরিশের ঠোঁটের কোণে রহস্যময়ী হাসি। অরার গাল টেনে দিয়ে বলল সে,
“ আজকে নয়, পাখি। এটা তোমার ইচ্ছেতে, ফার্স্ট টাইম। সুতরাং স্পেশাল ফিল করাবো তোমায়। এজন্য অপেক্ষা করতে হবে, চলো আজ ঘুমিয়ে যাই। ‘
অরা মুখ ফুটে বলতে পারছে না কিছু। ভদ্রলোকের ওপর ভীষণ রাগ হচ্ছে তার। এমন তো নয়, এটা প্রথমবার! নিজে জোর করে কতবার কী করেছে এখন আবার স্পেশাল দরকার তার! তপ্ত নিঃশ্বাস ছাড়ল অরা। আরিশ তাকে নিয়ে বিছানায় গেলো।
“ কী হয়েছে? খারাপ লাগছে? “
“ না তো! খুব উৎফুল্লবোধ করছি, একেবারে আনন্দে ভেসে যাচ্ছি। “
অরা রাগে চিবিয়ে চিবিয়ে বলল কথাগুলো। আরিশ অরার মুখের এক্সপ্রেশন দেখে শব্দ করে হেসে উঠল তাতে।
“ এতো এক্সাইটেড? দেখবো, কতক্ষণ সহ্য করতে পারো আমাকে। “
অরা পাশ ফিরে শুয়ে রইলো। আরিশ হাতে ফোন নিয়েছে কেবল। নিউজফিড স্ক্রোল করতে করতে আচমকা একটা পোস্টে চোখ আঁটকে গেলো তার। মুহুর্তেই মেজাজ বিগড়ে গেলো। অরা অন্য দিকে ফিরে শুয়ে থাকায় কিছু টের পেলো না। আরিশ নড়েচড়ে শোয়াতে, অরা তার দিকে ফিরলো। তখনই আরিশের রাগান্বিত চোখমুখ দেখে কিছুটা ঘাবড়ে গেলো মেয়েটা।
“ কী হয়েছে আপনার? “
“ পাশের বাসার আন্টি!”
“ কী?”
“ পাশের বাসার আন্টি নামে একটা পেইজ তোমার নাম নিয়ে বাজে কথা বলেছে। “
অরা ফোনের স্ক্রিনে তাকাল। পেইজের নাম খেয়াল করলো, তারপর পোস্ট।
“ ওটা পাশের বাসার আন্টিদের কাজই এগুলো। সে হোক অনলাইন কিংবা অফলাইন! “
“ অরাকে বড়া বলেছে সে। হাউ ডেয়ার হিম! কোথায়, কোন দেশে থাকে ওই পেজের মালিক, আগামীকাল দেখবো বিষয়টা। “
অরা শুকনো ঢোক গিলল। আরিশ বেশ রেগে গেছে। আধ পাগল জামাই নিয়ে এই এক সমস্যা! হুটহাট পাগলামি শুরু করে।
“ শুনুন, সব বিষয় মাথা ঘামাতে নেই। কে কী বলল এতকিছু খেয়াল করার কী দরকার? আপনি কিছু করতে গেলে বা বলতে গেলে লোকজন আরো পাত্তা পেয়ে বসবে। মজা হিসেবে নিন, প্লিজ। “
আরিশের রাগ কমলো না। অরা আলতো করে মাথায় হাত বুলিয়ে দিলো।
“ তোমার নামে আজেবাজে কিছু বললে তাকে….”
“ অরা নামটা আমার একার নয়, সবার জন্য উন্মুক্ত। “
অরার কথায় যুক্তি আছে। চুপ করে গেলো আরিশ।
“ চলুন ঘুমাই। আগামীকাল আবার অনেক কাজ আছে তো।”
আরিশ অরাকে নিজের হাতের ওপর শোয়াল। নিজের সাথে মিশিয়ে ফেলে লম্বা নিঃশ্বাস ছাড়ল কয়েকবার।
“ হুম। গুড নাইট, হামিংবার্ড।”
“ গুড নাইট। “
স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়ল অরা। ভদ্রলোক ঘুমালেই শান্তি।
চলবে,
#হামিংবার্ড
#পর্ব_৪৭
#তাসমিয়া_তাসনিন_প্রিয়া
স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়ল অরা। ভদ্রলোক ঘুমালেই শান্তি। ছটফট করতে করতে একসময় অরার চোখে ঘুম নেমে এলো। কিন্তু আরিশ এখনো জেগে আছে। তবে সেটা অরাকে বুঝতে দেয়নি। অরা ঘুমিয়ে গেছে এটা বুঝতে পেরে, ধীরে ধীরে উঠে বসলো আরিশ। মনমেজাজ খারাপ তার। বিছানা ত্যাগ করে ওয়াশরুমের দিকে এগোল সে। আপাতত ঠান্ডা পানিতে গোসল করতে হবে। তবেই যদি মন ও শরীর শান্ত হয়!
“ গুড মর্নিং তামান্না ভাটিয়া। “
সকাল সকাল রান্নাঘরে এসে উপস্থিত হলো তালহা। তামান্না নাস্তা তৈরি করতে ব্যস্ত। আজকে বাড়িতে অনেক কাজ৷ সন্ধ্যায় অরার জন্মদিন উপলক্ষে পার্টি আছে।
“ শুভ সকাল। আপনার অফিস নেই আজ?”
তালহা ইতিমধ্যেই ফলের ঝুড়ি থেকে একটি লাল আপেল তুলে নিয়ে খেতে শুরু করেছে। তার পরনে ছিল অ্যাশ রঙের একটি শার্ট ও নীল জিন্সের প্যান্ট।
“ না। ভাবির জন্মদিন উপলক্ষে গোটা অফিস বন্ধের ঘোষণা দিয়েছে ভাইয়া। “
“ মাঝে মধ্যে অবাক হই। “
“ কেন?”
“ প্রথম প্রথম ভাবির সাথে কতো খারাপ ব্যবহার করতেন ভাইয়া! ভাবিও কয়েকবার পালিয়ে গিয়েছিলেন, থাকবে না বলে। অথচ এখন দেখুন, দু’জনের মধ্যে কতো ভালোবাসা! “
“এটাই তো পবিত্র সম্পর্কের আসল শক্তি, তামু। বিয়ে একটা পবিত্র বন্ধন – স্বামী আর স্ত্রীর মধ্যে একটা স্বাভাবিক টান নিজে থেকেই গড়ে ওঠে।”
“ হুহ্। “
তামান্না নিজের কাজেই ব্যস্ত। তালহার দিকে না তাকিয়েই কথা বলে যাচ্ছে। ফলে আচমকাই তালহা পেছন থেকে জড়িয়ে ধরল তাকে। চমকাল তামান্না।
“ এই! কেউ দেখে ফেলবে তো! ছাড়ুন। “
“ তাহলে তুমি আমার দিকে দেখো একবার।“
তামান্নাকে নিজের দিকে ফেরালো তালহা। ভয়ে গলা শুকিয়ে আসছে মেয়েটার৷ যদি কেউ দেখে ফেলে মহা মুশকিল হয়ে যাবে। তামান্নার এক বান্ধবী – সে-ও অন্যের বাসায় কাজ করে। সেই মেয়েটিও বাড়ির মালিকের ছেলের সাথে সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েছিল। তারপর একদিন সেটা বাড়িতে জানাজানি হয়ে যায় এবং মেয়েটিকে কাজ থেকে তাড়িয়ে দেওয়া হয়। মালিকের ছেলেটি কেবলই মেয়েটির সাথে সময় কাটিয়েছিল। এই ঘটনায় মেয়েটি অনেক কষ্ট পেয়েছিল। গতকালই তামান্না তার বান্ধবীর থেকে এসব জানতে পারে। ফলশ্রুতিতে ভেতর ভেতর তামান্নার ভীষণ চিন্তা হচ্ছে। যদি তালহাও ওই ছেলের মতো তার সাথে শুধু সময় কাটানোর জন্য সম্পর্কে জড়িয়ে থাকে– তখন কী হবে? তামান্না তো সত্যি তালহাকে মন দিয়ে ফেলেছে! তার ওপর বিষয়টা জানাজানি হলে যদি আরিশ তাকে বাড়ি থেকে বের করে দেয় তখন তামান্না কোথায় গিয়ে উঠবে?
“ তামান্না! কী হয়েছে তোমার? এতো অন্যমনস্ক হয়ে কী ভাবছো?”
আচমকা তালহার স্পর্শে নড়েচড়ে উঠল সে। গালে হাত রেখে, তামান্নার দিকে তাকিয়ে আছে তালহা।
“ আপনি এখন যান এখান থেকে। আমার দেরি হয়ে যাচ্ছে । “
তালহা ছাড়লো না তাকে। উপরন্তু কী হয়েছে সেসব জিজ্ঞেস করতে ব্যস্ত হয়ে উঠলো।
দু’দিন ধরে সাবিহার সাথে কথা হচ্ছে না তাসলিমা খাতুনের। সেই নিয়ে ভীষণ চিন্তিত তিনি। এককাপ চা খেলে যদি একটু ফ্রেশ লাগে সেই উদ্দেশ্যে রান্নাঘরের দিকে এগোচ্ছেন তাসলিমা।
“ তোমাকে এতো চিন্তিত দেখতে ভালো লাগে না আমার। “
তালহা তামান্নার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল। তামান্না মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। কীভাবে বলবে সে, তার মনে সন্দেহ বাসা বেঁধেছে? কীভাবে বলবে তালহাকে সে বিশ্বাস করতে পারছে না। মনের মধ্যে ভয় সৃষ্টি হয়েছে তার।
“ তালহা!”
আচমকা মায়ের কণ্ঠস্বর পেয়ে চমকাল তালহা। তামান্নাও তালহার থেকে দূরে সরে দাঁড়াল। যে ভয় পাচ্ছিল ঠিক সেটাই হলো আজ। তাসলিমা খাতুনের চোখে-মুখে রাগের ঝলকানি। তালহা পরিস্থিতি সামলে নিতে মায়ের কাছে এগিয়ে গেলো।
“ মা, চলো আমরা বসে কথা বলছি। “
তাসলিমা খাতুন কোনো কথা না বলে হনহনিয়ে ড্রইং রুমের দিকে এগোলেন। তামান্না তালহার দিকে অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো কেবল। তালহা কিছু না বলে মায়ের পেছনে ছুটলো। পেছনে পড়ে রইলো তামান্না।
“ আরিশ! আরিশ!”
ড্রইং রুমে এসেই চিৎকার-চেঁচামেচি জুড়ে দিলেন তাসলিমা খাতুন। অরা কেবলই সিড়ি বেয়ে নিচতলায় আসছিল, চাচি শ্বাশুড়িকে এভাবে চেঁচাতে শুনে দ্রুত ড্রইং রুমে পৌঁছল সে। তালহা এরমধ্যে মায়ের কাছে এসে দাঁড়াল।
“ মা এসব কী করছো? ভাইয়াকে কেন ডাকছো? যা করেছি, আমি করেছি। আমার সাথে কথা বলো প্লিজ। “
“ আমি তোর সাথে পড়ে কথা বলবো। আগে পই কাজের মেয়েকে বাড়ি থেকে বের করার ব্যবস্থা করতে হবে। “
“ মা! “
“ চুপ কর তুই। ওসব মেয়েরা সব পারে। নিশ্চয়ই তোর মাথাটা খেয়েছে। “
মায়ের মুখের ওপর আরকিছুই বলতে পারলোনা তালহা। ঘটনা অনেক দূরে যাবে এখন, এ বিষয় ভালো করেই বুঝতে পারছে সে। অরা তাসলিমা খাতুনের সামনে এসে দাঁড়াতেই বললেন তিনি,
“ তোমার স্বামীকে ডেকে নিয়ে এসো, অরা। “
“ কিন্তু কী হয়েছে চাচি? সকাল সকাল এভাবে রাগারাগি করছেন কেন?”
“ কী হয়েছে সেটা ওই কাজের মেয়েকে গিয়ে জিজ্ঞেস করো। তোমার সাথে তো তার খাতির আছে। “
অরা কিছু বুঝতে পারছে না। তামান্না কী এমন করলো যার জন্য তাসলিমা খাতুন এতো রাগারাগি করছেন! অরা তামান্নার সাথে কথা বলার জন্য সোজা রান্নাঘরের দিকে এগোল এবার।
ঘুম ঘুম চোখে বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়াল আরিশ। চাচির চেঁচামিচিতে ঘুমানো মুশকিল। কিন্তু কথা হলো ভদ্রমহিলা এতো ক্ষেপলেন কেন? অরাও রুমে নেই! ভ্রু কুঁচকে ফেলল আরিশ। কোনোমতে ফ্রেশ হয়ে রুম থেকে বেরিয়ে গেলো সে।
অরা তামান্নার সাথে কথা বলে যা বোঝার বুঝে গেছে। ড্রইং রুমে একপাশে তাকে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে অরা। তালহা মা’কে শান্ত করতে অনেক চেষ্টা করছে। কিন্তু কিছুতেই তাসলিমাকে থামানো যাচ্ছে না। মা’কে ভীষণ ভালোবাসে ছেলেটা। তার ওপর বোনটাও দেশে নেই এখন। সবমিলিয়ে মা’কে কোনো কড়া কথাও বলতে পারছে না তালহা।
“ কী হয়েছে? সকাল সকাল এতো চিৎকার-চেঁচামেচি করছেন কেন?”
আরিশকে দেখে চুপ করে গেলেন তাসলিমা। তামান্না ও অরাসহ তালহাও আরিশের দিকে তাকিয়ে আছে। চাচির মুখোমুখি এসে দাঁড়াল আরিশ। তাসলিমা খাতুন কান্নায় ভেঙে পড়লেন। বললেন,
“ তোমার চাচা দুনিয়া ছাড়ার পর এই ছেলেটাই আমার একমাত্র ভরসা। আজ সেই ছেলেটার জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলছে, ওই কাজের মেয়েটা। “
তাসলিমা তামান্নার দিকে ইশারা করলেন। পরক্ষণেই ফের বলে উঠলেন,
“ তুমি এক্ষুণি ওকে বাড়ি থেকে বের করে দাও, বাবা। নইলে আমি চলে যাচ্ছি…. “
“ শান্ত হোন। আমি দেখছি। “
আরিশ অরার দিকে তাকাল একবার, তারপর তামান্নার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
“ কী হয়েছে, তামান্না? তুই কী করেছিস তালহার সাথে? “
তামান্না তালহার দিকে তাকাল, তালহা চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। তাসলিমা খাতুন ছেলের দিকে চোখ পাকিয়ে তাকিয়ে আছেন। অরা তামান্নার হাতটা শক্ত করে ধরলো। তাতে কিছুটা ভরসা পেলো মেয়েটা।
“ আমি কিছু করিনি ভাইয়া। “
“ কিছু না হলে চাচি এসব কী বললেন? “
“ ভাইয়া আমি বলছি। “
আচমকা তালহা এমন কথা বলায় কিছুটা বিরক্তি প্রকাশ করলেন তাসলিমা খাতুন। ছেলের দিকে দ্বিগুণ রাগান্বিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন তিনি।
“ হ্যাঁ, বল। “
“ আমি তামান্নাকে পছন্দ করি, ভালোবাসি ওকে। আমরা রান্নাঘরে দাঁড়িয়ে কথা বলছিলাম , মা সেটাই দেখে ফেলেছে। “
“ তালহা! একটা কাজের মেয়েকে কখনোই মানতে পারবোনা আমি। “
রাগে থরথর করে কাঁপছেন তাসলিমা। তামান্নার ঠোঁটের কোণে ম্লান হাসির রেখা। তালহা তো তার পাশে আছে, এটাই অনেক।
“ চাচি শান্ত হোন। কাজের মেয়ে কারো জন্মগত পরিচয় নয়। তামান্না আমার বোনের মতো। এ বাড়িতে আছে অনেকগুলো বছর। শুধু কাজ নয়, বোনের মতো খেয়াল রেখেছে আমার। “
“ তারমানে কী বলতে চাইছো তুমি? ওই মেয়েকে তালহার বউ করে নেবো?”
“ সমস্যা কোথায় চাচি? ওরা দু’জন দু’জনকে পছন্দ করে, ভালোবাসে। “
“ সমস্যা নেই? ওই মেয়ের কোনো পরিবার আছে? “
“ আমার বোন সে। তামান্না এদিকে আয়।”
অরা তামান্নাকে ইশারায় আরিশের কাছে যেতে বলল। তামান্না ধীরপায়ে এগিয়ে গেলো আরিশের কাছে।
“ আজ থেকে তামান্না আমার বোন। আর তেজরিন খান আরিশের বোন মানে বংশমর্যাদা, সম্পত্তি সবকিছুই থাকবে তার। আশা করি এখন আপনার কোনো সমস্যা হবে না, চাচি। “
তাসলিমা খাতুন অবাক হচ্ছেন। একটা কাজের মেয়েকে নিজের বোনের মর্যাদা দিয়ে দিচ্ছে আরিশ! এতটা উদার কবে থেকে হলো সে? সবকিছু ওই অরার জন্য হয়েছে।
তালহা মায়ের সামনে গিয়ে দাঁড়াল। শান্তস্বরে বলল,
“ মা পারিবারিক মর্যাদা, জায়গাজমি দিয়ে কী করবে? তোমার ছেলের সুখের থেকেও কি এসব বড়ো? আমি তো কোনো আরিশের বোনকে ভালোবাসিনি। আমি ভালোবেসেছি একটা সাধারণ মেয়েকে। হাসিখুশি, সবার কথা ভাবে, আমাকে ভালোবাসে সে– এতটুকুই আমার জন্য যথেষ্ট। “
“ যা ইচ্ছে তাই করো তুমি। আমি তোমার কোনো বিষয় থাকবো না আর। “
তাসলিমা খাতুন হনহনিয়ে ড্রইং রুম থেকে চলে গেলেন। তামান্না ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল। আরিশ তার মাথায় হাত রাখল।
“ কাঁদছিস কেন? বোকা মেয়ে। আস্তে আস্তে ঠিক হয়ে যাবে সব। সন্ধ্যায় পার্টি আছে। সবাই যার যার কাজ কর গিয়ে। তালহা? “
“ জি ভাইয়া। “
“ ডেকোরেশনে যেনো কোনো %A