#হামিংবার্ড
#পর্ব_৫১
#তাসমিয়া_তাসনিন_প্রিয়া
অরা আর আরিশ ধীরে ধীরে পাহাড়ি রাস্তায় হাঁটছে। বালডিচিয়ার ছোট্ট শহরটা যেন কোনো রূপকথার বই থেকে উঠে এসেছে। টালি ছাওয়া লাল ছাদের বাড়িগুলো সারি ধরে দাঁড়িয়ে আছে, দেয়াল জুড়ে আঁকা প্যাস্টেল রঙের ফুল আর পুরনো সময়ের ছোঁয়া মাখা জানালার গ্লাসগুলো রোদের আলোয় ঝিকমিক করছে।
রাস্তার পাশে একটা ছোট্ট কাফে – সাদা রঙের কাঠের চেয়ার আর টেবিল পেতে রেখেছে বাইরে, যার উপর রোদ্দুর আর পাতার ছায়া একসাথে খেলা করছে। সেখানে বসতেই গেল তারা। এক মাঝবয়সী ভদ্রমহিলা, চোখে রিমলেস চশমা আর গায়ে কোট, হাসিমুখে এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করলেন,
“Buongiorno! What would you like to have?”
আরিশ মেন্যুর দিকে তাকিয়ে বলল,
“Two cappuccinos, two croissants with chocolate filling. That’s it for now.”
“Grazie! I’ll be right back.”
ভদ্রমহিলা চলে যেতেই অরা আস্তে করে বলল,
“ বুনাগিরিটিরি, না জানি কী বললেন উনি! ওটার অর্থ কী?”
অরার কথায় জোরে হেসে উঠল আরিশ। ভ্রু কুঁচকে ফেলল অরা। জানে না বলেই জিজ্ঞেস করলো, তাতে হাসার কী হয়েছে?
“ স্থানীয় ভাষায় ‘শুভ সকাল’ বলেছেন। “
“ ওহ আচ্ছা। আপনি ইতালিয়ান ভাষায় কথা বলতে পারেন? “
“ একটু-আধটু। তবে পুরোপুরি না। কাজকর্মের সূত্রে ইতালিতে আসতে হয়, সেখান থেকেই একটু-আধটু শিখেছি। কাজ চালিয়ে নেওয়ার মতো। “
“ উমমম… বুঝলাম। “
আরিশ অরার কানের পাশে মুখ এনে ফিসফিস করে বলল,
“ উমমম… এমন করছো কেন? এরকম তো কিস করলে করে। তুমি কি কিস করতে চাচ্ছো, হামিংবার্ড? “
ভড়কাল অরা। বিষম খেলো। আরিশ পানির বোতল থেকে পানি পান করতে দিলো অরাকে। ধীরেসুস্থে পানি পান করে ধাতস্থ হয়ে বসলো সে।
“ কী এমন বললাম যে, বিষম খেলে? “
“ আপনি বড্ড দুষ্ট। “
“ কিছু করার নেই। আমি এমনই ডার্লিং। “
আরিশের কথায় অরার মুখটা একটু লাল হয়ে উঠল। সে জানালা দিয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে থাকল কিছুক্ষণ, হালকা হাওয়ায় তার খোলা চুল উড়ছে।
ক্যাফের গুনগুন সুর, দূরের গির্জার ঘণ্টাধ্বনি আর পাহাড় থেকে নামা শীতল হাওয়া—সব মিলিয়ে এক অদ্ভুত শান্তির অনুভূতি তৈরি হচ্ছিল তাদের মাঝে। এরমধ্যে ভদ্রমহিলা খাবারগুলো দিয়ে গিয়েছেন। আরিশ কাপচিনোর কাপটা হাতে তুলে বলল,
“ ইচ্ছে করছে এখানেই থেকে যাই। শুধু তুমি আর আমি, সাথে পাহাড়ি নীরব প্রাকৃতিক সৌন্দর্য। “
“ তাহলে আমাকে ইচ্ছে মতো জ্বালাতন করতে পারতেন আরকি!”
অরা মৃদু হেসে কিছুটা নিচুস্তরে বলল কথাগুলো।
আরিশ হেসে তাকাল তার দিকে। কিন্তু সেই হাসি স্থায়ী হলোনা বেশিক্ষণ। আচমকাই অরার উরুতে শক্ত করে হাত রাখল আরিশ। কিছুটা ঘাবড়ে গেলো অরা।
“ আমি না জ্বালালে আর কে জ্বালাবে তোমায়?”
“ আবার! আপানকে ডাক্তার দেখিয়ে কী লাভ হয়েছে, শুনি? “
বিস্মিত হলো আরিশ। সত্যি তো! এমন আচরণ তো করার কথা নয় তার। হাত সরিয়ে ফেলল আরিশ ।
“ ডাক্তারের যা করার ছিলো করেছে। তোমার যদি মনে হয় আমি আর পাঁচটা ছেলের মতো শান্ত, ভদ্র টাইপ হয়ে গেছি তাহলে বলব– তুমি ভুল। ডাক্তার আমার মানসিক অস্থিরতা দূর করেছেন, আমার স্বভাব বদলাতে পারেননি। “
দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল অরা। আরিশ সঠিক বলেছে।
“ হ্যাঁ ঠিক বলেছেন। খাওয়াদাওয়া শেষ করুন জলদি। নয়তো খেতে খেতেই সময় গড়িয়ে যাবে, ঘুরবো কখন?”
“ তুমিও খাও। “
“ খাচ্ছি তো। “
খাবার খেতে খেতে পাশের টেবিলে বসা এক বৃদ্ধ দম্পতির হাসির শব্দ তাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করল।
বৃদ্ধা হাতে এক কাপ কফি নিয়ে হাসতে হাসতে কিছু বলছিলেন, আর বৃদ্ধ তার হাত ধরে ছিলেন, তাদের চোখে ছিল বহু বছরের ভালোবাসা।
অরা চুপচাপ সে দৃশ্য দেখছিল। আরিশ জিজ্ঞেস করল,
“কী ভাবছো?”
“ভাবছি… উনাদের মতো বয়স হলে কেমন হবে? পঁচিশ বছর পরেও আমরা এমন করে একে অন্যকে ভালোবাসতে পারবো তো!.”
আরিশ মুচকি হেসে বলল,
“ তেজরিন খান আরিশের নিঃশ্বাস যতক্ষণ চলবে ততক্ষণ এই ভালোবাসা চলতে থাকবে। তাই পঁচিশ কিংবা পঞ্চাশ এটা বলা যাচ্ছে না। বুঝলে? ”
অরা কোনো কথা বলল না। শুধু হাত বাড়িয়ে আরিশের হাতে হাত রাখল। ঠোঁটের কোণে তার মুচকি হাসির রেখা।
সকালের নাস্তা শেষে তারা দু’জন বেরিয়ে পড়লো টাসকানির বিভিন্ন জায়গা দেখতে। গাড়ি চালক মারিও ছিলো সাথে। প্রথমেই তারা গেলো Castello Vecchio বা পুরনো দূর্গে। সেখানকার পাথরের আঁকাবাঁকা গলি, ভাঙা প্রাচীর, আর ঘন নীরবতায় মোড়া শহরটা যেন নিঃশব্দে বলছিল শতাব্দী পেরোনো গল্প।
দেয়ালের ফাটলে গজিয়ে ওঠা লতাগুল্ম, কাঠের জানালায় মরচে ধরা বন্ধ শাটার, আর দূরে চোখে পড়া রঙিন ছাদের সারি সবকিছুই ছিল ছবির মতো নিখুঁত, অথচ ধুলোমাখা।
দূর্গের ওপর উঠে তারা কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিল – নিচের উপত্যকার দিকে তাকিয়ে। নিচে সূর্যরঙা মাঠ, দূরে পাহাড়ের রেখা, আর মাথার ওপর থেমে থাকা আকাশ।
পুরনো দুর্গ শহর থেকে বেরিয়ে তারা চলে গেলো বাগনো ভিগনোনির ছোট্ট গ্রামে। সেখানে প্রাচীন গরম ঝর্ণার চারপাশে জল জমে ছোট ছোট পুকুর তৈরি, যেগুলোকে ঘিরে বেড়িয়েছে পাথরের বেঞ্চ আর কাঠের সেতু।
তারা ধীরে ধীরে পুকুরের ধারে হাঁটছিল , গরম জল থেকে উঠে আসা ধোঁয়ার মধ্যে মিশে থাকা সেই নরম আর্দ্রতা অনুভব করছিলো। কিছুক্ষণ বসে ছিল ঝর্ণার পাশের পাথরে, তারপর ফিরে আসলো, মনে রেখে এক নরম স্মৃতি
সূর্য তখন টালমাটাল করে পশ্চিমে হেলে পড়েছে। হালকা সোনালি আলো বালডিচিয়ার গমক্ষেতে ছড়িয়ে পড়ে সোনার চাদরের মতো ঢেকে রেখেছে গোটা উপত্যকা। সাইপ্রাস গাছগুলো নিঃশব্দ পাহারাদারের মতো দাঁড়িয়ে আছে। গাড়ির জানালায় হাওয়ার ঝাপটা এসে অরার চুলগুলো এলোমেলো করে দিল।
“ আজকের দিনটা কখনো ভুলবো না, রাগী ভূত। আমার জীবনের অন্যতম একটা দিন ছিলো। “
আরিশ মুচকি হাসল। অরা তার হাসির কারণটা ঠিক বুঝতে পারলোনা। হাসিতে দুষ্টমি লুকিয়ে ছিলো। আরিশ খুব আস্তে করে অরার শাড়ি ভেদ করে উন্মুক্ত কোমরে হাত রেখে, তাকে কোলের ওপর বসাল। অরা কিছু বলতেও পারছে না এখন। মারিও গাড়ি চালাচ্ছে। লজ্জায় গাড়ি থেকে লাফ দিতে পারলে শান্তি লাগতো অরার। আরিশ অরার কোমরে দু-হাত রেখে নাকের সাথে নাক ছুঁইয়ে ফিসফিস করে বলল,
“ তোমার মুখে রাগী ভূত নামটা শুনলেই আমি সিডিউস হয়ে যাই, পাখি। কেমন আদুরে একটা ডাক! “
চোখ বড়ো করে ফেলল অরা। কী একটা অবস্থা, রাগী ভূত বলে ডাকলেও সমস্যা?
“ কীসব বলছেন! এমন নামেও কারো…..”
“ ডু ইউ লাভ মি?”
“ ইয়েস, আই লাভ ইউ। কোনো সন্দেহ আছে?”
“ নো। “
আরিশ অরার ঘাড়ে শক্ত করে হাত রাখল। একহাতে কোমড় আঁকড়ে ধরে অন্য হাতে ঘাড় চেপে ধরে ঠোঁটে ঠোঁট ছুঁইয়ে দিলো সে। প্রথমে অস্বস্তি লাগলেও পরে নিজেকে ধাতস্থ করে নিলো অরা। মারিও এরমধ্যেই একটা রোমান্টিক গান বাজাতে শুরু করেছে। যদিও অরা ইতালিয়ান গানের আগামাথা বোঝেনা, তবে আরিশ তো বুঝতে পারছে। কিছুক্ষণ বাদে অরার ঘাড় ছেড়ে দিলো আরিশ। অরা নিচুস্তরে বলল,
“ মনে হচ্ছিল আরেকটু হলে ঘাড় মটকে দিবেন। “
শব্দ করে হেসে উঠল আরিশ। মারিও মুচকি মুচকি হাসছে।
“ মটকে দিলে, ব্যথা পেতে। “
“ এতো কেয়ার?”
“ কেন, আমি কি তোমার কেয়ার করি না?”
অরার ইচ্ছে করলো বলতে– হ্যাঁ মারাত্মক কেয়ারিং হাসবেন্ড আপনি। এতটাই কেয়ারিং যে শরীরে অজস্র দাগে ভরপুর হয়ে আছে, এতটাই কেয়ারিং যে ঠাস করে থাপ্পড় মারতেও সময় লাগে না।
কিন্তু অরা এসব কিছু বলল না। মুচকি হাসল কেবল।
“ কী হলো, বলো? ‘
“ হ্যাঁ অনেক কেয়ার করেন। “
খুশিতে গদগদ হয়ে বউয়ের কপালে ঠোঁট ছুঁইয়ে দিলো সে। কোল থেকে নামিয়ে সিটে বসিয়ে নিজের, বুকে মাথা ঠেকিয়ে রাখল অরার।
“ বাসায় গিয়ে এ বিষয় বিস্তারিত আলোচনা করবো। “
“ কোন বিষয়? “
“ আরো কেয়ার করার বিষয়, যাতে ভবিষ্যতে তুমি গর্ব করে বলতে পারো– তোমার হাসবেন্ড বেস্ট, কেয়ারি হাসবেন্ড। “
“ আচ্ছা। “
ঠোঁটের কোণের হাসি আরো প্রসস্থ হলো আরিশের। অরা চুপ করে রইলো। ক্লান্ত লাগছে শরীর। সারাদিন অনেক দৌড়ঝাঁপ গেছে। এখন এই পাগলের তালে তাল না মেলালে সমস্যা হতে পারে ভেবেই অরার এই নীরবতা।
“ চাচি! আপনি আসলেন কেন? আমাকে ডাক দিতেন, কিছু দরকার হলে দিয়ে আসতাম রুমে। “
দুপুরের রান্নাবান্না শেষ করে সবে হাতমুখ ধুয়ে দাঁড়াল তামান্না। এরমধ্যেই রান্নাঘরে তাসলিমা খাতুন এলেন। সাবিহার সাথে কথা বলেছিলেন তিনি৷ সবকিছু শুনে তালহার সাথে তামান্নার বিয়েটা মানার জন্য খুব করে বলল সে। সাবিহার জোড়াজুড়ি আর তালহার খুশির কথা ভেবে হলেও তাসলিমার মন গলেছে অবশেষে।
“ কিছু লাগবে না। এদিকে এসো, মেয়ে। “
তামান্না ধীরপায়ে তাসলিমার সামনে গিয়ে দাঁড়াল। এরমধ্যে কলিংবেলের শব্দ ভেসে এলো। তালহা ফিরেছে। দুপুরবেলা সে ছাড়া আর কেউ আসার কথা নয়। তামান্না তাসলিমার দিকে তাকিয়ে আছে, আগে দরজা খুলে দিয়ে আসবে কি-না সেজন্য।
“ যাও দরজা খুলে দিয়ে আসো। তারপর কথা শুনে যেও৷ “
“ ঠিক আছে, চাচি। “
তামান্না রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে একদৌড়ে ড্রইং রুমে উপস্থিত হলো। তাড়াতাড়ি দরজা খুলে ফেলল। দরজা খুলতেই তালহার হাতে কতগুলো বেলি ফুলের মালা দেখতে পেলো সে।
“ এই যে মিস তামান্না ভাটিয়া, এতো হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এলেন কেন? “
তালহা হাসিহাসি মুখে বাসার ভেতরে প্রবেশ করলো। তামান্না দরজা আঁটকে দিয়ে কণ্ঠ নিচু করে বলল,
“ চাচি এসেছেন রান্নাঘরে, আমার সাথে কথা বলতে। আপনি ঘরে যান এখন৷ এসব পরে দিবেন। “
“ মা এসেছেন, কথা বলতে! “
“ হ্যাঁ। “
“ ওকে, যাও৷ দেখো কী বলে। দেখো, আবার হবু শ্বাশুড়ির সাথে ঝগড়া বাঁধিয়ে বসো না৷ “
কিছুটা মজা করেই বলল তালহা। তামান্না ভেংচি কেটে রান্নাঘরের দিকে এগোল।
তাসলিমা খাতুন আগের জায়গায় দাঁড়িয়ে আছেন। তামান্নাকে দেখে সামনে এগিয়ে এলেন কিছুটা।
“ জি, বলুন। “
“ আরিশ দেশে ফিরলে তোমাদের বিয়ের বিষয় কথা বলবো। তোমার কোনো আপত্তি নেই তো? মানে এতো জলদি বিয়েতে কোনো সমস্যা? “
তামান্না যেন নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারলো না। অস্ফুটে স্বরে শুধালো,
“ কী? “
“ যা শুনেছ সেটাই বলেছি। “
লজ্জায় কিছুটা মাথা নিচু করে ফেলল সে। বলল,
“ আপনারা যা বলবেন তাই হবে। আমার কোনো আপত্তি নেই, চাচি।”
“ বেশ। তাহলে লজ্জা পাওয়া বাদ দাও। গোসল সেরে আসছি, এখন থেকেই শ্বাশুড়িকে যত্ন করা শুরু করো। “
তাসলিমা খাতুন কথাগুলো বলেই রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন। তামান্না হাসবে না-কি কাঁদবে বুঝতে পারছে না। এমন শ্বাশুড়ি পাওয়া সৌভাগ্যের না-কি দূর্ভাগের বলা মুশকিল ।
তাসলিমা খাতুন চলে যেতেই তালহা এসে ঢুকল রান্নাঘরে। তামান্না তখনও ভাবনার জগতে বিভোর ছিলো বলে তালহার আগমন টের পায়নি।
“ এই তামু, মা কী বললেন? “
“ বিয়ের কথা বললেন। ভাইয়া ফিরলে আপনার আর আমার বিয়ের কথা বলবেন, চাচি। “
“ কী?”
“ হ্যাঁ, যা শুনেছেন সেটাই। ‘
তালহা খুশিতে তামান্নাকে কোলে তুলে নিয়ে ঘুরতে লাগলো। তামান্নার মাথা ঘুরছে।
“ মারহাবা! মা এভাবে রাজি হয়ে গেছে, ভাবতেই আনন্দ লাগছে। “
“ উঁহু আমার মাথা ঘুরছে। নামান, বলছি। “
“ আরে কিছু হবে না। “
“ তালহা ভাই! “
থেমে গেলো তালহা। তামান্নাকে কোল থেকে নামিয়ে দিলো। ঠোঁট টিপে হাসছে তামান্না। তালহা গাল ফুলিয়ে বলল,
“ ভাই বললে কেন?”
“ থামানোর নিনজা টেকনিক!”
“ তবে রে এএ…..”
তালহা তামান্নাকে ধরতে চাইলো, কিন্তু তামান্না দৌড়ে রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে গেলো । দু’জনেই মহাখুশি আজ। অবশেষে তাদের ভালোবাসা পূর্ণতা পেতে চলেছে।
নয়নার মন এখন একটা নীরব সীমানার ভেতরে বন্দী। প্রতিদিন সকালে ইউনিফর্ম পরে আয়নায় নিজেকে দেখে, কিন্তু সেই চেনা মুখের ভেতরেও যেন কিছু হারিয়ে গেছে। স্কুলে যেতে যেতে প্রতিটি মোড়, প্রতিটি দেয়াল, প্রতিটি ক্লাসরুম – সবখানে পলাশের উপস্থিতি খুঁজে বেড়ায় সে।
ক্লাসে বসে জানালার বাইরে তাকিয়ে থাকে। মনে পড়ে, ঠিক এই বেঞ্চেই একদিন পলাশ পাশের ক্লাস থেকে এসে বসেছিল একটু সময়ের জন্য। বারান্দায় দাঁড়ালেই মনে পড়ে, সেখানে দাঁড়িয়ে পলাশ একবার মুচকি হেসে বলেছিল,
“আজ খুব সুন্দর লাগছো।”
নয়না কিছু বলেনি সেদিন, শুধু হেসেছিল নরম করে।
এখন সেই শব্দহীন ভালোবাসা প্রতিদিন তাকে ভেতর থেকে একটু একটু করে খেয়ে ফেলছে। পলাশ চলে যাওয়ার পর, স্কুলের প্রতিটা দিন যেন শুধুই সময় গুনে যাওয়া। বন্ধুদের হাসির মধ্যে, পড়ার চাপে, টিফিনের ভিড়েও, নয়না একা হয়ে গেছে । ক্লাসরুমের জানালায় বসে আকাশ দেখে সে, ভাবে–
এই আকাশের নিচেই তো পলাশ আছে, কোথাও না কোথাও। আর দুই বছর পর সেই আকাশের তলায় আবার দেখা হবে।
কিন্তু ততদিন… প্রতিটি দিন যেন দীর্ঘশ্বাসে লেখা চিঠি হয়ে জমা হয় নয়নার মনের ডায়েরিতে। কথার অপ্রকাশিত অনুভূতিগুলো তাকে নীরব করে দেয়, আর সেই নীরবতাই এখন তার সবচেয়ে বড় সঙ্গী।
“ কী রে নয়না? আজকাল এতো অন্যমনস্ক হয়ে থাকিস কেন?”
হাসিবের প্রশ্নে নড়েচড়ে বসে নয়না। সাথে যোগ দেয় উর্মি।
“ হ্যাঁ, রে! ইদানীং নয়না কেমন চুপচাপ হয়ে গেছিস। কী হয়েছে রে তোর?”
“ কই! আমার তো কিছু হয়নি। “
“ ইশ! বললেও হলো। “
উর্মি বলল। ইলমা পাশ থেকে বলে,
“ নয়না মনে হয় পলাশ ভাইকে মিস করে। “
চমকাল নয়না। যদিও পলাশ যে নয়নাকে পছন্দ করে এটা গোটা ক্লাসের সবাই জানে। কিন্তু ওদের মধ্যে কোনো সম্পর্ক গড়ে ওঠেনি, তবুও এমন মজা কেন করবে ইলমা?
“ এসব কী বলছিস ইলমা? আমি কেন উনাকে মিস করবো? “
কিছুটা গম্ভীর কণ্ঠে বলল নয়না। সবাই চুপ করে গেলো। বিশেষ করে ইলমা। নয়নার মন মানসিকতা খারাপ না থাকলে সে কখনোই বন্ধুদের সাথে এমন আচরণ করে না।
“ আচ্ছা সরি, মজা করেছি। চল চল টিফিনের টাইম হয়ে গেছে। আজ সবাই একসাথে ঝালমুড়ি খাবো। “
ইলমা বসা থেকে উঠে দাঁড়াল বাকিরাও উঠে দাঁড়িয়েছে, নয়না এখনো বসে। উর্মি নয়নার হাত ধরে টেনে দাঁড় করিয়ে বলল,
“ চল না, নয়না। একসাথে খাবো…..”
মুচকি হাসল নয়না। সাথে সাথে সবার ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটল। চারজন একসাথে ক্লাসরুম থেকে বেরিয়ে মাঠের দিকে এগোল। মাঠের উত্তর দিকের কৃষ্ণচূড়া গাছের নিচে ঝালমুড়ি মামা বসেন প্রতিদিন।
“ ইউ আর লুকিং সো হট, হামিংবার্ড।”
আরিশের এমন মন্তব্যে নিজের দিকে একবার দেখে নিলো অরা। হট লাগার মতো কিছু দেখতে পেলো না সে। তার পরনে ছিল হালকা অফ-হোয়াইট লিনেন ম্যাক্সি ড্রেস, কোমরের কাছে একচেটিয়া বেল্ট দিয়ে বাঁধা। ভেতরে ধুসর রঙা ট্যাংক টপ আর হালকা গলার অলঙ্কার। চুলগুলো একপাশে নামিয়ে রেখেছে, একটু ভেজা এখনো। গোসল করে মাত্রই বের হয়েছে সে।
আয়নার সামনে থেকে উঠে গিয়ে বিছানায় গিয়ে বসলো অরা।
“ আপনার নজর ঠিক করুন। “
আরিশ সোজা হয়ে বসে আছে, দৃষ্টি তার অরার দিকে । তার পরনে কালো টিশার্ট, যার গলা একটু খোলা, আর হালকা বাদামি কর্ড প্যান্ট।
“ আমার নজর যথেষ্ট ঠিক আছে বলেই এখনও বলিনি, ট্যাংক টপ-এর নিচে যা দেখা যাচ্ছে, ওটা জানিয়ে দিচ্ছে তুমি কতটা ভয়ংকর সুন্দর।”
চমকাল অরা। লোকটা এতো পাজি কেন? কিছুটা লজ্জা পেলো অরা।
“ বলতে আর বাকি রেখেছেন কী?”
“ ওপস! সরি, হামিংবার্ড। কী করবো, বলো? চোখ থাকলে দেখা যাবে, স্বাভাবিক। “
আরিশ অরাকে জড়িয়ে ধরে, থুতনিতে চুমু খেলো। অরা আরিশের কোলে মাথা রাখলো।
“ এসব রাখুন, দেশে ফিরবো কবে? “
“ কবে যেতে চাও?”
“ আগামীকাল? “
“ শিওর?”
“ হুম। সবাইকে মিস করছি। “
আরিশ অরার ঠোঁটে মৃদু কামড় বসাল। বিস্ময়ে বড়ো বড়ো চোখ করে তাকিয়ে রইলো অরা। এই লোক কি ভ্যাম্পায়ারের বংশধর? এভাবে হুটহাট কামড় বসায় কেন সে?
“ ওকে। আগামীকাল সকালে ফ্লাইট। হ্যাপি?”
অরার ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটল। জড়িয়ে ধরল আরিশকে।
“ হ্যাঁ। “
চলবে….
#হামিংবার্ড
#পর্ব_৫২
#তাসমিয়া_তাসনিন_প্রিয়া
রাতের খাবার খেয়ে কেবলই বিছানায় শরীর এলিয়ে দিয়েছে মেহরাব। আজ অফিসে অনেক কাজের চাপ ছিলো। এজন্য কিছুটা ক্লান্ত সে। ফোন হাতে নিয়ে সাবিহাকে কল করতেই যাচ্ছিল মেহরাব, এরমধ্যে সালমা আক্তার দরজার বাইরে এসে দাঁড়ালেন। সম্পর্কে তিনি মেহরাবের মা। বয়স ষাট ছুঁইছুঁই, পরনে ছাই রঙা শাড়ি, চুলগুলো খোঁপা করা, চোখে মোটা ফ্রেমের চশমা।
“ মেহরাব! “
মায়ের কণ্ঠস্বর শুনে শোয়া থেকে উঠে বসলো সে।
“ মা! কিছু বলবে? ভেতরে না এসে ওখানে দাঁড়িয়ে আছো কেন?”
দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন সালমা। ধীরপায়ে ছেলের ঘরে ঢুকলেন।
পাশের ফ্ল্যাটের রহিমার ছেলে সাকিব বিয়ে করেছে মাসখানেক হলো। বিয়ের পর নিজের মা’কে রুমে ঢোকার আগে অনুমতি নিতে বলেছে সে । আর সেসব কথা রহিমা এসে সালমার সাথে বেশ কেঁদে কেঁদে বলেছিল। ফলশ্রুতিতে সালমার মন কিছুটা খারাপ হয়ে আছে। মেহরাবকেও তো বিয়ে করাতে হবে। তখন যদি মেহরাবও তেমন কিছু বলে? সেজন্য আগে থেকেই রুমে ঢোকার আগে অনুমতি নেওয়ার অভ্যাস করছেন সালমা।
“ বলো, এবার। “
“ বয়স তো কম হলোনা তোর, এবার তো বিয়ে-শাদি করতে হবে। “
“ আর কয়েক বছর যাক, তারপর…… “
“ আমি ম রার পর?”
আঁতকে উঠল মেহরাব। মায়ের হাত ধরে বলল সে,
“ এমন কথা বলছো কেন মা? প্লিজ তুমি এরকম কথা আর বলবে না। “
“ তাহলে বিয়েতে রাজি হয়ে যা। “
“ আমি একজনকে পছন্দ করি, মা। তবে সে লেখাপড়ার জন্য কানাডায় থাকে এখন। “
ভ্রু উঁচিয়ে শুধালো সালমা,
“ মেয়ে বিদেশে লেখাপড়া করে? “
“ হ্যাঁ। তবে গ্রাজুয়েশন কমপ্লিট করেছে দেশে থেকেই। গ্রামের মেয়ে। শহুরে মেয়েদের মতো চালচলন না তার। তোমার অপছন্দ হওয়ার কথা না, মা।”
মেয়ে বিদেশে লেখাপড়া করে শুনে কিছুটা বিরক্ত হলেন সালমা। মূলত সালমা আক্তার শহুরে মেয়েদের আধুনিক চালচলন দেখতে পারেন না। মেহরাব সেই কারণে সাবিহার বিষয় সবকিছু স্পষ্ট করে বলল।
“ বেশ। আমাকে ছবি দেখাস। আর মেয়ের সাথে আগে থেকেই কথাবার্তা বলে রাখিস। আর পারলে বিদেশ থেকে দিশে ফিরতে বলিস। কী হবে এতো লেখাপড়া করে? সেই তো শ্বশুর বাড়িতে এসে সংসার করতে হবে। “
মেহরাব চুপ করে রইলো। তার মা’কে বলে লাভ নেই কিছু। তিনি নিজে যা বোঝেন, ভাবেন সেটাই বলেন। উনার চিন্তাভাবনা এমনই। মেয়েদের কেবল একটাই কাজ – বিয়ে করে সংসার করা এবং বাচ্চা লালন-পালন করা।
“ আচ্ছা। “
“ ঘুমা তাহলে, গেলাম আমি। “
“ ঠিক আছে। “
সালমা আক্তার ঘর থেকে বেরিয়ে যাওয়ার সাথে সাথে সাবিহার কল এলো। মেহরাবের ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটল তাতে। সব ভাবনা বাদ দিয়ে কল রিসিভ করলো সে।
“ হ্যালো! “
“ ইয়েস, সুন্দরী। কেমন আছো?”
“ হুম ভালো, আপনার কী অবস্থা? ভুলে গেলেন না-কি? “
“ আরে না, না। কাজকর্ম নিয়ে একটু ব্যস্ত ছিলাম দু’দিন। সেজন্য নক করা হয়নি। কল করতাম আমি। “
লম্বা নিঃশ্বাস ছাড়ল সাবিহা। জানালার পাশে দাঁড়িয়ে আকাশের দিকে দৃষ্টি ছড়িয়ে দিলো। রৌদ্রময় দিন, আকাশটা দেখতে দারুণ লাগছে।
“ বেশ, বুঝলাম। “
“ শুনলাম তালহা আর তামান্নার বিয়ের কথা হচ্ছে। আরিশ কল করেছিল, গতকাল রাতে দেশে ফিরেছে ওঁরা। “
“ হ্যাঁ। সবকিছু তো ঠিকই ছিলো, শুধু মা বেঁকে বসেছিলেন। উনাকে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে রাজি করালাম। আমার ভাই তার ভালোবাসার মানুষকে নিজের করে পাক – এটুকুই চাওয়া। “
“ উমম….. মিস সাবিহা দেখছি বেশ বদলে গেছে। “
মুচকি হাসল সাবিহা। মেহরাবের ঠোঁটের কোণেও হাসি খেলা করছে।
“ তা বলা যায়। “
“ তা নিজে কবে বিয়ে করবে শুনি?”
“ ঠিকঠাক ছেলে পেলে এখুনি করতে পারি। “
“ শিওর? “
“ অফকোর্স! “
“ তা ঠিকঠাক বলতে কেমন ছেলে দরকার তোমার? “
“ বেশিকিছু না, কেবল আমার প্রতি সৎ থাকতে হবে। আর একটু ভালোবাসতে হবে, ব্যাস!”
“ একটু ভালোবাসলেই হবে? “
“ হুম। বাকিটা একসাথে থাকতে থাকতে হয়ে যাবে। “
মেহরাব বিছানায় শরীর এলিয়ে দিলো আবার। ক্লান্তিতে রাজ্যের ঘুম এসে ভর করেছে তার চোখে। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখল মেহরাব , রাত বারোটা ছুঁইছুঁই এখন। তারমানে কানাডায় এখন দুপুরবেলা।
“ বুঝলাম। লাঞ্চ করেছ?”
“ এখনো না, একটু পর খাবো। আপনি ডিনার করেছেন”
“ হ্যাঁ কিছুক্ষণ আগে খেলাম। এখন শুয়ে আছি। নিদ্রার অপেক্ষায়! “
“ নিদ্রা? ওহ ঘুম…. ‘
“ জি, হ্যাঁ ম্যাডাম। নিন্দ্রা মানে ঘুম – কোনো নারী নহে। “
থতমত খেলো সাবিহা। কোনো নারী হলেও বা তার কী? মেহরাবটা বড্ড সেয়ানা। কথার মানে বুঝতে সময় লাগে না তার।
“ হু,হু। আচ্ছা পরে কথা হবে আবার। রাখছি এখন। “
“ ওকে। বায়। “
“ হুম, বায়। “
কল কেটে ফোন বালিশের পাশে রাখল মেহরাব। আগামীকাল একবার আরিশের অফিসে যাবে সে। বন্ধুকে মনের কথাটা এবার বলার সময় এসেছে। আগামীকাল আরিশের সাথে কীভাবে সবকিছু বলবে সেসব ভাবতে ভাবতে নিজের অজান্তেই ঘুমের দেশে পাড়ি জমাল মেহরাব।
বিছানায় বসে নোটপ্যাডে কীসব লিখতে ব্যস্ত অরা। আরিশ তার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। অরার প্রতিটি নড়াচড়া খুব গভীরভাবে খেয়াল করাই যেন তার কাজ।
দুপুরে তামান্না ও তালহার বিয়ের বিষয় কথাবার্তা হয়েছিল। যেহেতু এখন তাসলিমা খাতুনও রাজি সেজন্য বিয়েতে দেরি করতে চাচ্ছে না আরিশ। শুধু সাবিহার ছুটি পাওয়া নিয়ে সমস্যা। একমাত্র ভাইয়ের বিয়েতে তার বোন থাকবে না, এটা তো হয় না। সাবিহার সাথে আরিশ কথা বলবে আগামীকাল। আজকে বিভিন্ন কাজকর্মের ঝামেলায় কথা বলবে বলবে করেও বলা হয়নি।
“ হ্যাঁ, হয়ে গেছে। “
লম্বা নিঃশ্বাস ফেলে বলল অরা। চোখেমুখে তার খুশির ঝিলিক।
“ কী হয়ে গেছে, শুনি?”
অরার হাত ধরে কোলে তুলে নিলো আরিশ। গলা জড়িয়ে ধরে বলল অরা,
“ তামান্না আপু আর তালহা ভাইয়ের বিয়েতে কী কী কিনবো সেসব লিস্ট করলাম। “
“ লিস্ট? কই দেখি তোমার লিস্ট! “
আরিশ হাত বাড়িয়ে নোটপ্যাডটা হাতে নিয়ে দেখতে লাগলো সেটা– দু’টো শাড়ি, একটা লেহেঙ্গা, একটা থ্রিপিস লেখা আছে – সাথে কিছু গয়নাগাটি। আরিশের মতিগতি বোঝার চেষ্টা করছে অরা। লিস্ট কি বেশি লম্বা হয়ে গেলো?
“ এই তোমার লিস্ট? “
“ হু হু। কেন কী হয়েছে?”
“ লিস্ট করেছো, ভাবলাম অনেক কিছু লিখবে কিন্তু যা লিখেছ সেসব তো এমনি মনে রাখা যায়। তোমার আসল শপিং তো আমি করবো। আমার লিস্টের দরকার পড়বে না, পাখি। “
অরা কিছু বলার আগেই আরিশ তার ঠোঁটে কিস করলো একটা। অরা বলতে শুরু করলো,
“ লিস্ট করে নতুন পোশাক কেনার মধ্যে অন্য রকম একটা আনন্দ আছে, রাগী ভূত। ছোটোবেলায়, ঈদ আসলেই লিস্ট করতে বসতাম। তারপর সেই লিস্ট অনুযায়ী কসমেটিকস কিনতাম। “
শৈশবের কথা ভাবতেই মনটা কেমন বিষিয়ে উঠলো আরিশের। তার ছোটবেলায় এমন কোন মধুর স্মৃতি নেই যা সে বলতে পারবে। এতক্ষণ কথার ফাঁকে ফাঁকে কিস করে যাচ্ছিল আরিশ, আচমকা থেমে যাওয়াতে তার দিকে মনোযোগ দিলো অরা। ভদ্রলোকের চেহারার হাবভাব বদলে গেছে। কেমন বিষণ্ণতা ভর করেছে চোখেমুখে।
“ কী হলো? “
“ ইম… কই? কিছু হয়নি তো, হামিংবার্ড। “
“ কেমন অন্যমনস্ক লাগছিল আপনাকে। “
“ ঠিকই আছি আমি। কিন্তু তুমি ঠিক থাকবে না এখন। “
“ কেন!”
কিছুটা অবাক হয়ে বলল অরা। আরিশ তাকে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে নিজের করে নিতে নিতে বলল,
“ কথা কম, কাজ বেশি করতে হয়। “
অরা মুচকি হাসল। আবেশে চোখ বন্ধ করে ফেলল। আরিশ তার প্রতিটি শিরা-উপশিরায় নেশা ছড়াতে ব্যস্ত হয়ে উঠেছে। অরা এবার আরিশের কাঁধে কামড় বসিয়ে নিজেকে সামলাতে চেষ্টা করছে । আরিশের স্পর্শ মানেই এক জ্বালাময়ী অনুভূতি – যেখানে ঘোরলাগা নেশার সাথে যন্ত্রণা লুকিয়ে থাকে।
রাতের আঁধার ঘনিয়ে ভোরের আলো ফুটেছে চারদিকে। শহরের ব্যস্ততা এখনও পুরোপুরি শুরু হয়নি। যানবাহনের কর্কশ শব্দও কিছুটা কম শোনা যাচ্ছে। আজ একটু তাড়াতাড়ি ঘুম ভাঙল নয়নার। গতকাল রাতেও ভালো ঘুম হয়নি তার। ইদানীং ঘুম কমে গেছে। ঘুম ভাঙলেও কিছুক্ষণ বিছানায় গড়াগড়ি খেতে লাগলো সে। তারপর আড়মোড়া ভেঙে উঠে বসলো। দেয়ালঘড়ির দিকে তাকিয়ে সময় দেখে নিলো একবার, সকাল ছয়টা বেজেছে কেবল। আজকাল পলাশের কথা খুব মনে পড়ে নয়নার। যতই তার কথা ভুলতে চায় ততই যেনো সবকিছু বেশি মনে পড়ে। পলাশ যখন আশেপাশে ছিলো তখন এতটা অনুভব করতোনা তাকে, অথচ দূরত্ব বাড়তেই সেই অনুভূতি প্রখর হচ্ছে।
বিছানা ছেড়ে উঠলো নয়না। ধীরপায়ে এগিয়ে গেলো পড়ার টেবিলের দিকে। ড্রয়ার খুলে একটা ছোটো কাগজ বের করলো। পলাশের ফোন নম্বর লেখা কাগজটায়। কিছুক্ষণ কাগজটা হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে রইলো সে। পলাশের বলা শেষ কথাগুলো ভাবতে লাগলো। পলাশ বলেছিল তার অনুপস্থিতিতে নয়নাও বুঝবে, তার গুরুত্ব। দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল নয়না । বাড়ির কারো ফোন দিয়ে একবার কল করবে কি-না সেটাই ভাবতে লাগলো এবার । কিন্তু ভাবনা যেন শেষই হচ্ছে না। দ্বিধা কাটছে না তার।
“ নয়না! এতো সকালে পড়তে বসেছিস যে আজ? “
আচমকা মায়ের কণ্ঠস্বর শুনে আঁতকে উঠল সে। হাত থেকে কাগজটা ড্রয়ারে রাখতে গিয়ে ফ্লোরে পড়ে গেলো। কিন্তু নয়না সেটা খেয়াল না করে টেবিলের পাশ থেকে সরে এসে বিছানায় বসলো।
“ পড়তে বসিনি, মা। ঘুম ভাঙল তাই ভাবছিলাম, পড়তে বসবো কি-না! “
ঘর ঝাড়ু দিতে এসেছেন রোকসানা। মেয়ের সাথে কথা বলতে বলতেই কাজ করছেন তিনি।
“ তাহলে ফ্রেশ হয়ে নে। চা-বিস্কুট খেয়ে তারপর না হয় পড়তে বসবি। “
“ ঠিক আছে, মা। “
নয়না মায়ের কথামতো ফ্রেশ হতে চলে গেলো। রোকসানা ঝাড়ু দিতে থাকলেন। অসাবধানতার ফলে পলাশের নম্বরটা যে ময়লার ঝুড়িতে পৌঁছে গেলো, সেটা নয়না টের অবধি পেলো না।
চলবে,
#হামিংবার্ড
#পর্ব_৫৩
#তাসমিয়া_তাসনিন_প্রিয়া
সারাদিন স্কুল আর ক্লাসের ব্যস্ততা শেষে ক্লান্ত শরীরে বাড়ি ফিরতেই নয়নার চোখে পড়লো তালহা। বসার ঘরের সোফায় চুপচাপ বসে আছে তালহা। তার পরনে গাঢ় নীল শার্ট আর কালো জিন্স, চুলগুলো হালকা এলোমেলো, চোখেমুখে ক্লান্তির ছাপ স্পষ্ট। সময়টা তখন সন্ধ্যা নামার ঠিক আগমুহূর্ত।
রোকসানা তালহার আপ্যায়নে ব্যস্ত। ঘরে থাকা যা কিছু খাবারদাবার আছে, তা দিয়েই আপাতত অতিথি সেবার চেষ্টা করছেন।
নয়না স্কুল থেকে ফিরে ভদ্রতার সাথে তালহার কুশলাদি সেরে, নিজের ঘরে ঢুকে ফ্রেশ হতে গেল। সকালের তাড়াহুড়োয় পলাশের নম্বর লেখা কাগজটা কোথায় রেখেছে, কিছুতেই মনে করতে পারছিল না সে। পুরো পথজুড়ে সেই কাগজটার কথাই বারবার মনে পড়ছিল।
“ তারপর বলো, বেয়াইন কেমন আছেন? “
রোকসানা সোফায় বসতে বসতে জিজ্ঞেস করলেন। তালহা চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে বলল,
“ আলহামদুলিল্লাহ, ভালো আছেন। ভাবি হয়তো আপনাকে কলে সবকিছু বলেছেন। আমি আসলে নয়নাকে নিতে এসেছিলাম। “
মুচকি হাসলেন রোকসানা।
কিছুক্ষণ আগেই অরা ফোন করেছিল। তখনই তালহার বিয়ের কথা জানিয়েছে তাকে। যদিও এখনও দিন-তারিখ চূড়ান্ত হয়নি, তবে কাল থেকেই কেনাকাটার প্রস্তুতি শুরু হবে – এমনটাই সিদ্ধান্ত হয়েছে।
এই কারণেই নয়নাকে খান বাড়িতে নিয়ে যাওয়ার জন্যই তালহাকে পাঠানো হয়েছে। আরিশের সময় নেই। অফিসের চাপ দিনদিন বেড়েই চলেছে। আর তাছাড়া, আরিশের যা স্বভাব, তাতে শ্বশুরবাড়ি এসে শালিকাকে নিজে হাতে আনার মতো ধৈর্য বা ইচ্ছা তার নেই বললেই চলে।
“হ্যাঁ, অরা বলেছে তুমি নয়নাকে নিতে এসেছো।”
রোকসানা হেসে বললেন।
“ও তো এখনই স্কুল থেকে ফিরেছে। একটু ফ্রেশ হয়ে আসুক, তারপর কথা বলি তোমার সঙ্গে।”
“ ঠিক আছে, আন্টি। “
“ তুমি বরং নাস্তা শেষ করো ততক্ষণে।“
তালহা মাথা নেড়ে মুচকি হাসল কেবল। রোকসানা বসা থেকে উঠে নয়নার ঘরের দিকে এগোলেন।
কোনোমতে স্কুলের ব্যাগ কাঁধ থেকে নামিয়েই কাগজটা খুঁজতে শুরু করেছে নয়না। কিন্তু দুঃখজনক ব্যাপার হলো টেবিলের ওপর থেকে শুরু করে ড্রয়ারে, ফ্লোরে কোথাও কাগজটা পাচ্ছে না সে।
“ কী রে! এখনও স্কুল ড্রেস চেঞ্জ করিসনি কেন? তালহা এসে বসে আছে , তোকে নিতে পাঠিয়েছে অরা। “
মায়ের আগমনে কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে গেছে নয়না। সোজা হয়ে দাঁড়াল, জিহ্বা দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে বলল সে,
“ এইতো ফ্রেশ হয়ে নিচ্ছি। আপু হঠাৎ নিতে পাঠালো? কোনো অনুষ্ঠান আছে? “
“ তালহার বিয়ে, শুনলাম। সেজন্য কেনাকাটা করবে বলল। ব্যাগপত্র নিয়ে যাবি, দু’দিন থাকার কথাও বলেছে অরা। “
নয়না শুধু সব কথায় হু হা করে যাচ্ছে। তার মন পড়ে আছে কাগজটা খোঁজার দিকে। পলাশের নম্বরটা হারিয়ে নয়নার মনে হচ্ছে যেন আস্ত মানুষটাকেই হারিয়ে ফেলেছে সে। বুকটা কেমন খালি খালি লাগছে।
“ কী রে? কী হয়েছে তোর?”
রোকসানা বেশ গলা উঁচিয়ে জিজ্ঞেস করলেন।
“ ফ্রেশ হয়ে আসছি, আমি। বেশি সময় লাগবে না। “
নয়না তড়িঘড়ি করে ওয়ারড্রব থেকে জামাকাপড় হাতে নিয়ে ওয়াশরুমের দিকে এগোল।
রোকসানা মল্লিক মেয়ের হাবভাব কিছুতেই বুঝে উঠতে পারছেন না।
নয়না আজকাল যেন কেমন অচেনা হয়ে গেছে। আগের সেই প্রাণচঞ্চল মেয়েটা কোথায় যেন হারিয়ে গেছে। এই পরিবর্তনের কারণটা তিনি ধরতে পারছেন না ঠিকভাবে, আর সেটাই তাকে ক্রমেই চিন্তিত করে তুলছে।
সন্ধ্যা নেমেছে। শহরের ওপরে গাঢ় নীল রঙা আবরণ টেনে নিচ্ছে আকাশ, বাড়ির চারপাশে বাতিগুলো একে একে জ্বলে উঠছে। একটা শান্ত, নরম আলোয় ভরে যাচ্ছে চারদিক।
ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে আছে অরা। নিজেকে আজ বেশ পরিপাটি করে গুছিয়ে নিয়েছে।
নীল রঙের শাড়ির সঙ্গে মিলিয়ে পরেছে ম্যাচিং ব্লাউজ, গলায় হালকা ডিজাইনের ডায়মন্ড সেট, খোলা চুলে জড়ানো আছে আর্টিফিশিয়াল বেলিফুলের গাজরা। হাতে নীল কাঁচের চুড়ি, ঠোঁটে টুকটুকে লাল লিপস্টিক।
সবকিছু মিলিয়ে তাকে যেন এক অপ্সরা মনে হচ্ছে – আলোকছায়ার এই সন্ধ্যায়, যেন রূপকথা থেকে নেমে আসা কোনো চরিত্র।
“ আয়নায় কী দেখছো, হামিংবার্ড?”
আরিশের কণ্ঠ ভেসে এলো পিছন দিক থেকে।
কণ্ঠটা শুনেই উচ্ছ্বসিত হয়ে পেছনে ফিরে তাকালো অরা। আর সেই মুহূর্তেই যেন আরিশের হৃদয়ে একচিলতে ঝড় বয়ে গেল। এক মুহূর্তের জন্য থমকে গেলো সব – নিশ্বাস, স্পন্দন, সময়।
একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো সে অরার দিকে; চোখে বিস্ময়, মুগ্ধতা আর গভীর ভালোবাসার ছায়া।
আরিশের এমন অভিব্যক্তি দেখে মুচকি হেসে ওঠে অরা। ধীরে ধীরে এগিয়ে গিয়ে গলা জড়িয়ে ধরে সে, কানে কানে বলল ,
“আপনার হামিংবার্ডকেই দেখছিলাম আয়নায়।”
আরিশ তার কোমরে হাত রেখে অরাকে একটু উঁচু করে তোলে, তারপর গভীর মমতায় কপালে এক আলতো চুমু রাখে।
“আজকের পর এই রুমে আর আয়নাই থাকবে না।”
“কী!” — চমকে উঠল অরা।
“যা শুনেছ, ঠিক তাই বলেছি।”
“কিন্তু কেন?”
আরিশ চোখ সরিয়ে রাখল, যেন অভিমান লুকাতে চাইছে।
“তোমার এই সৌন্দর্য আমার আগে আয়না দেখে ফেলে—এটাই সহ্য হয় না।”
অরা হেসে উঠল জোরে। সেই হাসিতে যেন রুমটা মুহূর্তেই আলোয় ভরে গেল।
আরিশের কপাল কুঁচকে গেল, থুতনিতে হাত রেখে গম্ভীর গলায় বলল,
“হাসবে না একদম!”
“ঠিক আছে। হাসব না। যান, ফ্রেশ হয়ে আসুন।”
“দরকার নেই। চল, বেরোবো এখনই।”
অরা বিস্ময়ে চোখ বড় বড় করে বলল,
“এখন? রাতে কোথায় যাবেন?”
আরিশ একটু হাসল, চোখে মায়া মেশানো উচ্ছ্বাস,
“তোমার সঙ্গে এখনও রাতের শহর দেখা হয়নি, পাখি। লেটস গো! ”
আনন্দে উচ্ছ্বসিত হয়ে অরা এগিয়ে এসে আরিশের ঠোঁটে এক চুমু দিল। আরিশও পাল্টা চুমু দিল ঠিকই, কিন্তু তাতে অরার ঠোঁটটা কেটে গেল।
“ভালো করে চুমু খেতে পারেন না?”
কিছুটা অভিমান নিয়ে বলল অরা।
আরিশ অবাক হয়ে অরার ঠোঁটের দিকে তাকায়, কাটা দাগটা খেয়াল করে বলল,
“আমি তো আস্তেই দেই… এটা আবার কেমন করে হলো?”
“থাক, হয়েছে। চলুন এবার।” _ বলে মুখ ফিরিয়ে নিল অরা।
আরিশ ফিক করে হেসে উঠে ওর হাত ধরল।
দু’জনের হাসিমুখে, হাতে হাত রেখে তারা রুম থেকে বেরিয়ে গেল। রাতের শহরটা আজ যেন এক নতুন গল্পের সূচনা।
সন্ধ্যার ঢাকা শহর। বাতাসে হালকা গরম, আলো-ছায়ায় জ্বলজ্বল করছে রাস্তাঘাট।
অরার ইচ্ছায় আজ রিকশা চড়ে ঘুরবে তারা। তাই একটা রিকশা ঠিক করে ফেলেছে আরিশ।
তবে সমস্যাটা হলো – আরিশের জীবনে এই প্রথম রিকশায় ওঠা! ফলে খানিকটা অস্বস্তি তো থাকছেই। মাঝেমধ্যে রিকশা একটু নড়েচড়ে উঠলেই আরিশ ভয় পেয়ে যায়, দু’হাত দিয়ে শক্ত করে রিকশার হুক ধরে বসে থাকে। এই দৃশ্য দেখে অরা তো খিলখিল করে হেসেই ওঠে – তার হাসিতে যেন রিকশার চারপাশটা আরও হালকা হয়ে যায়।
রিকশা এসে থামলো সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের সামনে। চারদিকে যেন মানুষের ঢল। শুক্রবার বলে ভিড়টা স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক বেশি, দম ফেলার জায়গা নেই যেন। আরিশ রিকশা থেকে নেমে হাত বাড়িয়ে অরাকে নামতে সাহায্য করলো।
রিকশাওয়ালা মামা নিশ্চিন্তে বসে রইলেন নিজের আসনে। কারণ, আরিশ আগেই তাকে খুশি করে দিয়েছেন – সোজা হাজার দশেক টাকা দিয়ে।
মামার মুখে প্রশান্তির হাসি, আজকের দিনটায় তার আর কোনো চিন্তা নেই।
“ এখানে অনেক লোকজন, হামিংবার্ড। “
পাশাপাশি হাঁটছে ওরা। স্বাভাবিকভাবেই লোকজন অরার দিকে তাকাচ্ছে। এমন সুন্দরীর পরনে নীল শাড়ি – ঠিক যেন নীলপরি। লোকজন দেখবে এটাই স্বাভাবিক।
“ তাহলে কোথায় যাবেন? সবজায়গায় তো লোকজন। “
অরার কথার দিকে বিশেষ একটা খেয়াল নেই আরিশের। একটা ছেলেকে দেখছে সে। অরার দিকে কখন থেকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ছেলেটা। আরিশ আচমকাই ছেলেটার কাছে গিয়ে কলার চেপে ধরল। চমকাল অরা। আশেপাশের লোকজন জড়ো হয়ে গেলো।
“ হেই, ওয়াট দ্য ফাক ডু ইউ থিঙ্ক ইউ’র ডুয়িং স্টিয়ারিং অ্যাট মাই ওয়াইফ? গেট লস্ট, অ্যাসহোল!”
অরার ইচ্ছা থাকলেও আরিশকে থামানো তার পক্ষে সম্ভব হচ্ছিল না। ওই জায়গায় জমে থাকা লোকজনের কেউই আর সাহস পাচ্ছিল না তার দিকে ঝাঁপ দেওয়ার। আরিশের চোখ-মুখ থেকে যেন আগুনের শিখা বেরোচ্ছে, তার ক্রোধ একেবারে স্পষ্ট। বেচারা ছেলেটা আরিশের হাত থেকে ছুটে সরে গেল, তারপর অন্যদিকে দৌড়ে পালিয়ে গেল। ধীরে ধীরে লোকজনও সেখান থেকে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করল। একেকজন একেক রকম মিশ্র প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করছে – কেউ অবাক, কেউ কৌতূহলী, আবার কেউ ভাবছে এটা কতটা ঠিক বা ভুল।
অরা শুধু অসহায় চোখে আরিশের দিকে তাকিয়ে থাকে, নিজেকে সামলাতে পারছে না।
তার মনে হচ্ছে, এই ক্রোধ আর এই দৃশ্য আর কতকাল ধরে চলবে? আরিশ তার দিকে এগিয়ে বলল,
“ বাসায় যাবো। “
অরা কিছু বলল না। আরিশ অরাকে নিয়ে আবারও রিকশায় উঠে বসলো। মাঝখান দিয়ে অরার মনটা খারাপ হয়ে গেলো। মাঝে মধ্যে আরিশের এসব স্বভাব বিরক্তিকর লাগে তার।
নয়নাকে দেখে তামান্নার মুখে আনন্দের ঝিলিক ফুটে উঠল। কিছুক্ষণ আগে নয়নাকে নিয়ে খান বাড়িতে পৌঁছল তালহা। নয়না আর তামান্নাকে রেখে নিজের ঘরের দিকে এগোল সে।
“আপু, কোথায় গেছ?”
নয়না কৌতূহলী হয়ে জিজ্ঞেস করল।
“ভাবি ভাইয়ার সঙ্গে ঘুরতে বের হয়েছে, একটু পরেই ফিরে আসবে। তুমি আগে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে আয়, নয়না। তোমার জন্য রুমটা গুছিয়ে রেখেছি। আমি ততক্ষণে খাবার নিয়ে আসি।”
তামান্না বলল।
“আমি তো খেয়েই এসেছি, আপু। এখন রুমে গিয়ে ফ্রেশ হচ্ছি। আপু ফিরলে আমাকে জানিও।”
নয়না বলল।
“ঠিক আছে, যাও।”
নয়না গেস্ট রুমের দিকে এগোল আর তামান্না রান্নাঘরের কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ল।
বাড়ি ফিরেই অরাকে নিয়ে হনহনিয়ে রুমে ঢুকে দরজা আঁটকে দিলো আরিশ। তার স্বামী কেনো এমন করছে বুঝেও যেন বুঝতে পারছে না অরা। রাগের মাথায় অরার শরীর থেকে শাড়িটাই খুলে ফেলে দিলো আরিশ। অরা ওড়না গায়ে পেঁচিয়ে দাঁড়াল।
“ কী হয়েছে আপনার? শাড়ি খুললেন কেন?”
অরা হতবাক হয়ে প্রশ্ন করল। আরিশ রাগে কাঁপতে কাঁপতে বলল,
“ পাগল হয়ে গেছি আমি। এই শাড়ি যত নষ্টের মূল। আর পরবে না এই শাড়ি। “
গভীর নিঃশ্বাস ছাড়ল আরিশ। নিজের রাগ নিয়ন্ত্রণ করতে হিমসিম খাচ্ছে সে।
“ শান্ত হোন একটু। এতো রাগ করলে চলে?”
আরিশ অরার কথায় কান না দিয়ে আচমকাই অরার দু’টো হাতই পেছনে চেপে ধরে, দেয়ালের সাথে ঠেসে ধরলো তাকে৷ দেয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়ায় অস্বস্তি লাগছে অরার। আরিশ এবার অরার হাত দুটো উঁচু করে দেয়ালের সাথে চেপে ধরে হিসহিসিয়ে বলল,
“ আমি কি অহেতুক রাগ করেছি, হামিংবার্ড? তুমি দেখোনি, ওই অসভ্য ছেলেটা তোমার দিকে কীভাবে তাকিয়েছিলো। ওর চোখ দু’টো তুলে মার্বেল খেলতে পারলে কলিজা ঠান্ডা হতো আমার। “
আঁতকে উঠল অরা। কী ভয়ংকর কথাবার্তা! শুকনো ঢোক গিলে আরিশের কপালে কপাল ঠেকাল। নিচুস্বরে বলল,
“ শান্ত হোন আরিশ, প্লিজ শান্ত হোন। আমার দিকে দেখুন। আমার চোখের দিকে তাকান…….”
অরার মিষ্টি কথা আরিশের মনকে বেঁধে ফেলল। দু’জনে চোখে চোখ রেখে কিছুক্ষণ নিঃশ্বাস ফেলল, যেন শব্দহীন কিছু বোঝানোর চেষ্টা করছিল। তারপর হঠাৎ আরিশ বেগবান হয়ে অরাকে বুকে জড়িয়ে ধরল।
চলবে,