হামিংবার্ড পর্ব-৫৭+৫৮+৫৯

0
24

#হামিংবার্ড
#পর্ব_৫৭
#তাসমিয়া_তাসনিন_প্রিয়া

অরার অসুস্থতার জন্য অনেক কিছুই মিস করতে হয়েছে তাকে। যেমন, তালহা আর তামান্নার বিয়ের যাবতীয় কেনাকাটার সময় অরা সঙ্গে থাকতে পারেনি। তবে আরিশ পুরো সময়টা তাকে ভিডিও কলে যুক্ত রেখেছিল। কিন্তু ভিডিও কলে শপিং দেখে কি আর সত্যিকার আনন্দ পাওয়া যায়? না… অরার মন তাতে ভরেনি।

তবু কী আর করার ছিল! জোর করেও কোনো লাভ হতো না। কারণ, এসব বিষয়ে আরিশ কখনোই তার কথা শুনে না– অন্তত এমন বিষয়গুলোতে তো নয়ই।

সন্ধ্যাবেলা।

খান বাড়িতে চলছে বিয়ের শেষ মুহূর্তের প্রস্তুতি।

সারা বাড়িটা চমৎকার করে সাজানো হয়েছে। লাইটিং ও ডেকোরেশনের লোকজন প্রতিটি খুঁটিনাটি ভালো করে পরীক্ষা করে নিচ্ছে।

নয়না বসার ঘরে একা বসে আছে। বিয়ে না হওয়া পর্যন্ত এ বাড়িতেই থাকবে সে। তালহা একটু বেরিয়েছে – কিছু বন্ধুদের দাওয়াত দেওয়া বাকি ছিল, সেই কাজটাই সেরে আসছে। সাবিহা আর তামান্না ঘরে বসে জিনিসপত্র দেখছে। কোন ড্রেসটা কেমন হলো, কোন গয়না বেশি সুন্দর – এসব নিয়েই তাদের আলাপ।

অরা নিজের ঘরেই বসে আছে চুপচাপ।

আরিশ তাকে বাইরে যেতে মানা করেছে। বাড়িতে অতিথি আসছে, লোকজন অনেক।

আর অরার কাছে এসব নিয়ে কিছুটা বিরক্তিই লাগে এখনও। আরিশের কিছু কিছু কাজ এখনো সহ্য হয় না তার।

বসে বসে বেশ বোরিং লাগছিল অরার।

ঠিক তখনই আরিশের ফোনে একটা কল এল।

ভদ্রলোক ফোনটা ঘরেই রেখে বাইরে গেছেন।

অরা চোখ বুলিয়ে দেখল—ডা. শেলিনা আক্তার কল করেছেন।

স্বাভাবিকভাবেই কৌতূহলী হয়ে উঠল সে।

কলটা রিসিভ করে কথা বলতে বলতে বারান্দা পেরিয়ে এগোতে লাগল।

“হ্যালো, মি. খান বলছেন?”

“আমি অরা বলছি।”

“ও আচ্ছা, কেমন আছো তুমি অরা?”

“জি, আগের থেকে অনেকটাই ভালো আছি।”

“ভালো কথা, আলহামদুলিল্লাহ। আচ্ছা শোনো, তোমার জন্য আরেকটা খবর আছে।”

“কী খবর?”

অরা সিঁড়ির মুখে এসে দাঁড়ায়। ডেকোরেশনের কাজ চলছে। দুটো ছেলে কাজ করছে জোরেশোরে।

ডাক্তার বললেন,

“আমার মনে হয়, এই কথাটা তোমাকে বলার চেয়ে তোমার হাসবেন্ডকে বললে তিনি বেশি আনন্দিত হবেন। তবে আমি এখনই শতভাগ নিশ্চিত নই। এজন্য একটা টেস্ট করাতে হবে।”

ঠিক তখনই আরিশ অরাকে দেখতে পেয়ে এগিয়ে এল। সে ইশারায় জিজ্ঞেস করল, কার সঙ্গে কথা বলছে।

“ডাক্তার আপু কল দিয়েছেন। আপনার সঙ্গে কথা বলতে চাচ্ছেন।”

অরা ফোনটা বাড়িয়ে দিল আরিশের দিকে।

আরিশ ফোনটা হাতে নিলেও কথা না বলে চুপ করে রইল। হঠাৎ, তার চোখ আটকে গেল, দাঁড়িয়ে থাকা ছেলেগুলোর দিকে। দুজনের একজন ছেলেটা একদৃষ্টিতে অরার দিকে তাকিয়ে আছে তাকানোর ভঙ্গি যেন চেনা। আরিশের মেজাজ মুহূর্তেই বিগড়ে গেল। ফোনটা কেটে পকেটে ঢুকিয়ে রেখে সোজা এগিয়ে গেল ছেলেটার দিকে।

এক সেকেন্ডের ব্যবধানে ছেলেটার কলার চেপে ধরল সে। হিসহিস করে বলল,

“কী দেখছিলি ওভাবে? টাকা দিচ্ছি কাজ করার জন্য, না আমার বউয়ের দিকে কু-দৃষ্টিতে তাকানোর জন্য?”

আরিশের গলার শব্দ আশেপাশে সবকে থামিয়ে দিল। চিৎকার-চেঁচামেচি শুনে খান বাড়ির লোকজন যেন ভূত দেখেছে এমন ভঙ্গিতে সিঁড়ির দিকে ছুটে এল।

অরা তড়িঘড়ি করে আরিশকে থামাতে চেষ্টা করল।

“আরিশ প্লিজ… ছেড়ে দিন!”

কিন্তু আরিশ তখন যেন রাগে পাগল হয়ে গেছে।

ছেলেটার মুখে ঘুষি মারতে মারতে বলছে,

“তুই সাহস কী করে করিস রে… সাহস কী করে হয় তোর!”

সাবিহা, তামান্না, নয়না, তাসলিমা খাতুন সবাই স্তব্ধ। নয়নার চোখ বিস্ময়ে আরও বড় হয়ে গেছে– এই আরিশকে সে কোনোদিন দেখেনি।

এ রকম উন্মত্ত, বেপরোয়া, সীমাহীন হিংস্র একজন পুরুষকে সত্যি দেখেনি নয়না।

“ আরিশ! প্লিজ, ছেড়ে দিন। উফ! “

অরা আরিশের হাত ধরে, কিন্তু আরিশ তার হাত সরিয়ে দেয়। ছেলেটা অবস্থা বেগতিক বুঝে দৌড়ে পালাতে চাইলে অরার গায়ের সাথে ধাক্কা লাগে। ফলশ্রুতিতে মুহুর্তেই সিঁড়ি থেকে ছিটকে নিচে গড়িয়ে পড়তে শুরু করে। ঘটনার আকস্মিকতায় হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে আছে সবাই। ডেকোরেশন লোকজন জড়োসড়ো হয়ে দাঁড়িয়ে আছে, শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে তাদের মুখ। আর সেই ছেলেটা বাড়ি থেকে দৌড়ে বেরিয়ে গেছে।

আরিশ যতক্ষণে অরাকে ধরার জন্য পা বাড়াল, ততক্ষণে দেরি হয়ে গেছে। অরা সিঁড়ি থেকে গড়িয়ে পড়ার পর নিথর হয়ে পড়ে আছে। তার মাথার পাশে রক্তের লাল রেখা, কপালে কেটে গেছে।

নয়না আপু বলে চেঁচিয়ে উঠে দৌড়ে অরার কাছে আসে।

“আপু! আপু কথা বলো…..”

অরার চোখ আধখোলা, ঠোঁট নীলচে, নিঃশ্বাস ভারী। গলায় একটুকরো শব্দ বের হয়,

“আরিশ…”

নয়না মুহূর্তেই কান্না জুড়ে বসে।

“তুমি চোখ বন্ধ করবে না, শুনছো! চোখ খোলা রাখো!”

আরিশ যেন বরফের মতো জমে গেছে। তার জন্যই তো—তার জন্যই এমন ভয়ংকর দুর্ঘটনা ঘটলো। পায়ের তলায় জমাট কুয়াশা, বুকের ভেতর গলগল করে বয়ে যাচ্ছে ভয়।

হঠাৎ জোরে গলা ফাটিয়ে উঠে আরিশ অরাকে কোলে তুলে নেয়, অরার মাথা ঝুলে পড়ছে তার কাঁধে।

“জলিল! জলিল! গাড়ি বের কর…..”

তার কণ্ঠে উন্মাদনা, কান্না, অপরাধবোধ সবকিছুর ঝাঁপটা।

অরার নিঃশ্বাস যেন একেকবার আসছে, থেমে যাচ্ছে। মাঝে মাঝে শরীর কেঁপে উঠছে অদ্ভুতভাবে। তার পেটের ওপর হাত রেখে গুঁড়িয়ে আসা স্বর ফিসফিস করে বলে,

“ব্যথা করছে… ভীষণ… পেটটা…”

__________

হাসপাতালের করিডোরের হলুদ আলোয় থমথমে পরিবেশ। সোলাইমান মল্লিক, আরিশ আর তালহা—তিনজন তিন কোণে পায়চারি করছে যেন কেউ ভিতর থেকে খবর নিয়ে বেরিয়ে আসলেই হুট করে দৌড়ে যাবে তার দিকে। করিডোরের একপাশে মাথা নিচু করে বসে আছে রোকসানা, নয়নার হাত আঁকড়ে ধরে কাঁদছে ফুঁপিয়ে। নয়নার মুখও ভেজা, কিন্তু সে নিজেকে শক্ত করে রেখেছে।

আরিশের শার্টে বড় বড় রক্তের ছোপ। বুক বরাবর ছড়িয়ে পড়েছে লালচে ছোপগুলো। সেই রক্ত কার– অরার। আর এই ব্যাপারটা যেন সবাইকে ঠান্ডায় জমে যেতে বাধ্য করেছে।

সিঁড়ি থেকে পড়ে যাওয়ার পর থেকেই, রাস্তায়, গাড়ির ভেতর, অরা একবারও চোখ পুরো খুলেনি। বারবার শরীর ঝাঁকিয়ে উঠেছে, আর পেট চেপে ধরে শ্বাস নিতে চেয়েছে। ব্লিডিং হয়েছে থেমে থেমে।

তামান্না, যতটা পারে, রোকসানাকে শান্ত রাখার চেষ্টা করছে,

“আন্টি… চিন্তা করবেন না। অরা ভাবি ঠিক হয়ে যাবে। ভিতরে ডাক্তাররা আছে…”

কিন্তু রোকসানা কোনো কথা শুনছে না, শুধু বলছে,

“ আমার মন কু’ডাকছে তামান্না। আমার মেয়েটার কিছু একটা হয়েছে। “

নয়না মা’কে জড়িয়ে ধরে বুকে।

কোথায় রাত পোহালেই সবার বিয়ে বাড়ির আনন্দে মেতে ওঠার কথা ছিল, তার বদলে এখন করিডোর জুড়ে কান্নার শব্দ, উন্মাদ আরিশের আর্তনাদ আর প্রত্যেকের বুকে চেপে বসা এক ভয়ানক নীরবতা।

আরিশ যেন বদ্ধ উন্মাদ হয়ে গেছে। কিছুক্ষণ পরপর হাউমাউ করে কেঁদে উঠছে সে। তালহা কোনোমতে আরিশকে বুঝিয়ে শুনিয়ে শান্ত করছে।

“ আমাকে ভেতরে ঢুকতে দিলো না কেন? ডাক্তার এতক্ষণ কী করছেন ভেতরে? “

“ ভাইয়া! শান্ত হও। ভাবীকে আগে দেখুক, তারপর তো জানাবেন। “

সোলাইমান আরিশের অবস্থা দেখে পাশে এসে দাঁড়ালেন। কাঁধে হাত রেখে বললেন,

“ ডাক্তারকে দেখতে দাও। অপেক্ষা করা ছাড়া কিছু করার নেই আমাদের। “

আরিশ শান্ত হতে পারে না। তার হামিংবার্ড চোখ বন্ধ করে আছে, কথা বলছে না – সে কীভাবে শান্ত হতে পারে?

এরমধ্যেই কেবিনের দরজা খুলে গেল। সাদা অ্যাপ্রোন পরা ডাক্তারের মুখটা ক্লান্ত, চোখে চাপা গম্ভীরতা। ডা. শেলিনা আক্তার কেবিন থেকে বেরিয়ে এলেন। আর কোনো কথা না শুনেই আরিশ দৌড়ে গেলেন তার দিকে, প্রায় ছুটে গিয়ে সামনে দাঁড়িয়ে পড়লেন।

“ডাক্তার… অরা? অরা ঠিক আছে?”
তার গলা কাঁপছে, চোখ দুটো ছলছল করছে। বুকে হাত চেপে দাঁড়িয়ে আছে।

ডা. শেলিনা এক মুহূর্ত চুপ করে তাকিয়ে থাকেন তার দিকে। তারপর ধীরে বলেন,

“ মাথায় ছোট একটা আঘাত লেগেছে, কিন্তু সেটা বিপজ্জনক না। আমরা স্ক্যান করেছি, ব্রেইনে আঘাত নেই। হাতের একটা হাড় হালকা চিড় ধরেছে… তবে…”

তিনি থামলেন।

আরিশের বুক কেঁপে উঠলো।

“তবে…?”

তার কণ্ঠ আরেকটু নরম হয়ে এলো। ডাক্তার শেলিনা এবার সরাসরি তাকিয়ে বললেন,
“মিস্টার খান… উনি গর্ভবতী ছিলেন। প্রায় ছয় সপ্তাহের মতো। অরা নিজেও জানতোনা, হয়তো। আমি সন্ধ্যায় এটা বলতেই কল করেছিলাম। সন্দেহ করেছিলাম অরা প্রেগন্যান্ট কি-না, সেজন্য একবার টেস্ট করাতে বলতে চেয়েছিলাম। সম্ভবত আপনিও জানতেন না । কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে, পড়ে যাওয়ার কারণে অরা মিসক্যারেজ করেছে। আ’ম সরি! ”

কথাটা যেন মুহূর্তে দেয়ালের মতো ধাক্কা দিলো আরিশকে। পেছন থেকে রোকসানার মুখ থেকে বেরিয়ে আসে অস্ফুট চিৎকার,
“অরা প্রেগন্যান্ট ছিলো…?”

তিনি কাঁদতে কাঁদতে এক হাতে মুখ চেপে বসে পড়ে হঠাৎই। তামান্না রোকসানার হাত ধরে । তালহা হতবাক, কিছুই বলতে পারছে না। তাসলিমা খাতুনও চুপ করে আছেন। সোলাইমান ধপ করে ফ্লোরে বসে পড়েছেন। নয়না উনাকে সামলাচ্ছে।

আরিশ এক পা পিছিয়ে গেল। ঠোঁট কাঁপছে, চোখ জলে ঝাপসা—
“সে… জানত না… আমিও না…”

ডাক্তার বললেন,
“এটা খুব কমন। অনেকেই প্রথম কয়েক সপ্তাহ টের পান না। কিন্তু পড়ে যাওয়ার ধাক্কা, অভ্যন্তরীণ শকে এমব্রিও আর টিকে থাকতে পারেনি। এখন জরায়ু পরিষ্কারের জন্য একটা ছোট প্রসিডিউর করবো—D&C। চিন্তার কিছু নেই, আমরা সব ব্যবস্থা নিচ্ছি। ”

আরিশ কিছু বলতে পারছিল না। তার চারপাশটা যেন ঘূর্ণি হয়ে ঘুরতে লাগলো। শুধু একটা কথাই মাথায় ঘুরছিল–
“আমাদের অজান্তেই একটা প্রাণ চলে গেলো… অরা জানতেই পারলো না…”

ডা. শেলিনা ধীরে ধীরে হেঁটে চলে গেলেন, পেছনে ফেলে গেলেন এক চাপা, ভারী নিঃশ্বাসে মোড়ানো গুমোট নীরবতা।

দেড় ঘণ্টা পর।

অপারেশন থিয়েটারের দরজা খুলে গেল।

দুজন নার্স স্ট্রেচারে করে অরাকে কেবিনে নিয়ে এলো। চোখ বন্ধ, মুখে অক্সিজেন মাস্ক, হাতে স্যালাইন, এবং শরীর নিস্তেজ।

আরিশ উঠে দাঁড়িয়েই থমকে যায়। অরাকে এ অবস্থায় দেখে নিশ্বব্দে চোখের জল ফেলতে থাকে সে। হাতে কাগজ, রিপোর্ট, আর চোখে ক্লান্তির ছাপ নিয়ে ডাক্তার শেলিনা পাশে এসে দাঁড়ান।

“সব ঠিকভাবে হয়েছে। আমরা জরায়ু পুরো পরিষ্কার করেছি। এখন বিশ্রাম দরকার। শারীরিকভাবে ঠিক হয়ে যাবে কিছুদিনের মধ্যে। তবে মানসিকভাবে… আপনাদের সবাইকে পাশে থাকতে হবে।”

অরাকে কেবিনে শুইয়ে দেওয়া হয়েছে। রোকসানা তার মাথার পাশে বসে কপালে হাত বুলাতে থাকে। নয়না ধীরে ধীরে তার হাত চেপে ধরে। আরিশ একটু দূরে দাঁড়িয়ে, কথা বলতে পারছে না—শুধু তাকিয়ে আছে।

ঘণ্টাখানেক পর। অরার চোখ দুটো ধীরে ধীরে খুলে যায়। আলো ধাঁধিয়ে যায় তার চোখে। আরিশ সর্তক হয়ে ওঠে।

“ মা… আমি কোথায়?”

গলা কাঁপা কাঁপা।

রোকসানা ফোঁপাতে ফোঁপাতে বলে,

“তুই হাসপাতালে। পড়ে গিয়েছিলি। এখন তুই নিরাপদ… মা, আমরা তোকে নিয়ে হসপিটালে আছি।”

অরা চোখ ঘোরায়। নয়নাকে দেখে। তারপর ধীরে ধীরে মুখ ফিরিয়ে তাকায় আরিশের দিকে।

“আরিশ…”

আরিশ এগিয়ে আসে। নিচু গলায় বলে,

“আমি এখানে আছি… আমি তোমাকে একটুও ছেড়ে যাইনি।”

অরা চোখ বুজে ফেলে একবার। তারপর হঠাৎ যেন কী যেন মনে পড়ে যায়। পেটের ওপর ধীরে হাত রাখে সে।

“আমার পেট… ব্যথা করছে… কেমন যেন লাগছে… অস্বস্তি লাগছে। কিছু হয়েছে? ডাক্তার… ডাক্তার কি বলেছে কিছু?”

রোকসানা আর নয়না মুখ নিচু করে রাখে। কেউ কিছু বলে না।

আরিশই এগিয়ে আসে ধীরে। তার কণ্ঠ কাঁপছে, কিন্তু ঠোঁট শক্ত করে ধরেছে সে। ভেতর ভেতর অদ্ভুত এক অপরাধবোধ কাজ করছে তার। সেজন্য অরার পাশেও যেন বসেনি এতক্ষণ। কিন্তু এখন আর দূরে থাকার সময় নেই। সে অরার পাশে বসে। সকলের সামনেই অরার কপালে একটা চুমু দিয়ে বলে,

“তুমি প্রেগন্যান্ট ছিলে… আমরা কেউ জানতাম না… এমনকি তুমিও না… কিন্তু…”

একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস নেয় আরিশ।

“ কিন্তু পড়ে যাওয়ার ধাক্কায়… আমাদের বাচ্চাটা আর নেই…”

অরা প্রথমে বুঝে না। চোখে একটা শূন্যতা। এক সেকেন্ড… দুই সেকেন্ড… তারপর মুখে ধীরে ধীরে নেমে আসে হতবিহ্বলতা। চোখ বড় হয়ে যায়। ঠোঁট ফাঁকা হয়ে পড়ে।

“ আমি মা হতে যাচ্ছিলাম?”

থেমে যায় সে। শুকনো ঢোক গিলে ফের বলে,

“কিন্তু আমি তো… আমি জানতাম না… আমি তো… একটিবারও অনুভব করতে পারিনি… আমি…”

অরা হাউমাউ করে কাঁদে না। শুধু চোখ দিয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ে, নিঃশব্দে। এক হাত পেটের ওপর, অন্য হাত চেপে ধরে আরিশের কাঁধ।

“আরিশ… আমাদের বাচ্চাটা… চলে গেলো?”

তার গলা ভেঙে যায়। আরিশ তার কপালে মুখ গুঁজে কান্না চেপে রাখে।

হাসপাতালের এককোণে, এক দম্পতি চুপচাপ বিদায় জানায় একটি অনাগত প্রাণকে–

যে এসেছিলো নিঃশব্দে, আর চলে গেলো আরও নিঃশব্দে…একটিবার “মা” বা “বাবা” ডাকার সুযোগ না দিয়েই।

রোকসানা মেয়ের এমন ভেঙে পড়া সহ্য করতে না পেরে নয়নার হাত ধরে কেবিন থেকে বেরিয়ে যান। নয়নাও চোখ মুছতে মুছতে পিছনে তাকায়,অরার সেই ফাঁকা চাহনির দিকে।

অরার চোখে এক অদ্ভুত শূন্যতা। তার ঠাণ্ডা চোখে শুধু প্রশ্ন – কী হারাল, কেন হারাল। আরিশ তার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। অরাকে আজ কীভাবে শান্ত করবে জানে না আরিশ । সে নিঃশব্দে অরাকে বুকে জড়িয়ে ধরে।

“পাখি…”

“আমার পেটে বাচ্চা ছিলো? আমি… আমি মা হতাম?”

অরার গলার স্বর জড়িয়ে যাচ্ছে। কথা বলতে গিয়ে যেন গিলে ফেলছে কান্না।

আরিশ তার মাথার তালুতে এলোমেলোভাবে চুমু খায়। ঠুকরে ঠুকরে কেঁদে ওঠে। অরাও আর ধরে রাখতে পারে না। চোখ বন্ধ করে, বুক চেপে ধরে হঠাৎ ফুঁপিয়ে ওঠে — অবশেষে শব্দ করে কান্না জুড়ে বসে।

“শান্ত হও, অরা… যে চলে গেছে, তাকে আর ফেরানো যাবে না। আমরা তো কেউ জানতাম না… আমরা আবার বাবা-মা হতে পারবো, ইনশাআল্লাহ। তুমি সুস্থ—এটাই এখন বড় জিনিস।”

আরিশের কথা শুনে মুহূর্তেই যেন অরার মুখশ্রী বদলে যায়। চোখে বিষণ্ন দৃষ্টি, ঠোঁট শক্ত করে বলে,

“আপনার কাছে আমাদের বাচ্চাটা গুরুত্বপূর্ণ ছিল না? আপনি… এত সহজে কীভাবে বললেন ‘আবার বাবা-মা হতে পারবো’?”

আরিশ স্তব্ধ। কিছু বলার আগেই অরা নিজেকে সরিয়ে নেয় তার বুক থেকে।

“আপনার কথায় মনে হয় এই সন্তানটা শুধু আমার ছিল। আপনি তো বাবা ছিলেন! তাহলে কষ্ট আপনার হবে না? আপনি কি বুঝতে পারছেন আমি কী হারিয়েছি?”

আরিশ তার দুই গালে হাত রাখে। কোমল গলায় বলে,

“বাচ্চাটা তো তোমার একার ছিল না, অরা। আমারও ছিল। আমিও কষ্টে আছি… অনেক বেশি।”

“তাহলে আপনি… তখন কেন শান্ত থাকতে পারেননি? ওই ছেলেটাকে মারতে গেলেন কেন? আপনি থামলে… থামলে হয়তো এসব কিছু হতো না।”

অরার গলা ভাঙা ভাঙা। চোখে কান্না, ঠোঁটে দুঃখ, গলায় অভিযোগ।

আরিশ কিছু বলতে গিয়েও থেমে যায়। সে জানে, তার সেই আগুনে রাগ… অন্য কাউকে অরার দিকে চোখ তুলে তাকানো দেখলে নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলা – এসবই অরার জীবনে বিষ হয়ে দাঁড়িয়েছে। সে তো চেষ্টা করলেও নিজের স্বভাব বদলাতে পারেনি।

“অরা… আমি…”

“না! প্লিজ, আপনি কিছু বলবেন না। আপনার পাগলামি, আপনার সহ্যহীনতা আমাকে আজ এই জায়গায় নিয়ে এসেছে। আপনার আচরণের কারণেই আজ আমার বুক খালি। আমি তাকে কখনো অনুভব করতে পারিনি… আর এখন—সে নেই!”

অরা যেন পাগলের মতো কাঁদতে শুরু করে।

এদিক-ওদিক তাকিয়ে বিছানায় উঠে বসার চেষ্টা করে, আরিশ জড়িয়ে ধরতে গেলে বারবার ঠেলে দূরে সরিয়ে দেয়।

“ছুঁবেন না আমাকে! আপনার জন্যই… সবকিছু শেষ!”

অতিরিক্ত উত্তেজনায়, দুর্বল শরীর আর ক্ষয়ে যাওয়া শক্তিতে হঠাৎ জ্ঞান হারিয়ে ফেলে অরা।

আরিশ আঁতকে উঠে তাকে আঁকড়ে ধরে।

“অরা! অরা প্লিজ চোখ খোলো! ডাক্তার! কেউ আছেন? প্লিজ… ওর কিছু যেন না হয়!”

আরিশ চিৎকার করে ওঠে। কেবিনের দরজায় ধাক্কা দিয়ে নার্স ছুটে আসে, পেছনে ডাক্তার শেলিনা আক্তার ।

“BP একদম নিচে। Pulse ইরেগুলার। স্যালাইন আরও দাও, ওকে নিচু করে শুইয়ে দাও। Oxygen মাস্ক…”

ডা. শেলিনা দ্রুত অরার চোখের পাতা তুলে,চেক করেন। আরিশ চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে বিছানার পাশে। তার হাতে অরার হাত, ঠাণ্ডা হয়ে গেছে। ডাক্তার, নার্সের উপস্থিতিতেই সে একবার অরার কপালে চুমু খেয়ে শুধু ফিসফিস করে বলে,

“তুমি চোখ খুলছো না কেন, পাখি? আমার ওপর যত রাগ, সব ঝাড়ো… কিন্তু চোখ খোলো প্লিজ…”

ঘড়ির কাঁটা যেন আর এগোয় না। রোকসানা চেয়ারে বসে ঠাণ্ডা হয়ে যাওয়া হাতদুটো জড়িয়ে ধরে। নয়না জানালার পাশে চুপচাপ দাঁড়িয়ে, একবারও চোখের জল মুছছে না। তালহা শুধু পাশে দাঁড়িয়ে, আরিশের পিঠে একবার হাত রাখে। কিন্তু আরিশ কাঁপা কাঁপা গলায় বলে,

“আমার জন্যই সবকিছু হয়েছে, তাই না তালহা?”

“ না ভাইয়া। তকদিরে যা লেখা থাকে তাই হয়। তুমি নিজেকে অপরাধী না ভেবে এখন শক্ত হও। ভাবীকে সামলাতে হবে। “

আরিশ মাথা নাড়ে কেবল। চোখে তার জল।

ডাক্তার শেলিনা ধীরে কেবিন থেকে বেরিয়ে বলেন,

“ অরা শকে চলে গিয়েছিল। ওভার স্ট্রেস। ভয় নেই, ও ধীরে ধীরে জ্ঞান ফিরে পাবে।”

সবাই একটু হলেও স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে। কিন্তু আরিশের মন শান্ত হয় না। অরার বলা কথাগুলো তাকে ভেতর ভেতর শেষ করে দিচ্ছে। সত্যি কি সবকিছুর জন্য সে দায়িত্ব?

চলবে……

#হামিংবার্ড
#পর্ব_৫৮
#তাসমিয়া_তাসনিন_প্রিয়া

সবাই একটু হলেও স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে। কিন্তু আরিশের মন শান্ত হয় না। অরার বলা কথাগুলো তাকে ভেতর ভেতর শেষ করে দিচ্ছে। সত্যি কি সবকিছুর জন্য সে দায়িত্ব?

তিন দিন হয়ে গেছে। অরার চোখে এখনো স্বাভাবিক ঘুম আসেনি। তবে চোখ বন্ধ করলেই একটা দৃশ্য – একটা গড়িয়ে পড়া শরীর, একটা চাপা চিৎকার, আর পেটের ভেতরে এক অদৃশ্য ফাঁক– সবকিছু যেন মাথার ভেতরে ঘুরপাক খায়।

ওর নিজের শরীরটা এখন আগের মতো নেই।

হালকা হাঁটলে মাথা ঘোরে। বুক ধড়ফড় করে।

কিন্তু এর থেকেও যেটা তাকে বেশি কষ্ট দিচ্ছে, সেটা হলো – আরিশের উপস্থিতি। আরিশ এখন পাশের কেবিনে ঘুরঘুর করে। ডাক্তারের মতো মাথা নিচু করে রাউন্ড দেয়, একেকবার চোখে কান্না লুকিয়ে হাসার চেষ্টা করে। অরা এসব দেখতে চায় না। চোখে পড়লেই বুকের ভেতরটা গরম হয়ে ওঠে। অভিযোগে নয়, অসহ্য যন্ত্রণায়।

“কেন তুমি এমন? কেন তুমি আমাকে ভালোবেসে এইভাবে ধ্বংস করে ফেললে?”

অরা এসব বলে ফেলে আরিশকে। আরিশ চুপচাপ সব শোনে কেবল। রোজ রাতে অরাকে যখন নার্স এসে ঘুমের ওষুধ দেয়, তখন তার চোখের পাতার কোণে পিলোতে সাদা-ফর্সা ছোট একটা দাগ পড়ে। শুকনো কান্নার চিহ্ন।

আরিশ গতকাল থেকে আর ভেতরে ঢোকেনি।

শুধু দরজায় দাঁড়িয়ে আছে। কখনো কড়া নড়ে না। শুধু ভেতরে আলো দেখলেই নড়েচড়ে উঠে।

তালহা বলেছিল,

“ভাবী একটু ভালো আছেন এখন। আপনি কথা বলে দেখুন।”

আরিশ কোনো প্রতিক্রিয়া দেখায়নি। শুধু একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলেছে।

“আমার একটাও কথা যদি ওর কান্না থামাতে না পারে, তাহলে সে কথার মানে কী? আমার উপস্থিতি যদি ওর অস্থিরতার কারণ হয় তবে সেই উপস্থিতির কী দরকার? ”

আরিশের কথায় তালহা আরকিছুই বলতে পারেনি। আরিশের উপস্থিতি সত্যিই অরাকে অস্থির, অসুস্থ করে তোলে এখন। তালহা সব বোঝে। তামান্নার দীর্ঘশ্বাসটুকুও বোঝে। ভাগ্য সহায় থাকলে এতদিনে তাদের বিয়েটা হয়ে যেতো, সবাই কতো আনন্দ করতো! কিছু হয়নি তা….

আজ সকালে নয়না এসেছিল। চুপচাপ বোনের পাশে বসে ছিল কিছুক্ষণ। তারপর একটা ছোট্ট প্যাকেট অরার হাতে দিয়ে বলেছিল,

“এটা তোমার জন্য আপাই। আর শোনো, যে হারায়, সে ফিরেও আসে কোনো না কোনোভাবে। নিজেকে সামলাতে হবে ।”

অরা প্যাকেট খুলেনি। ভেতরে কী আছে দেখার ইচ্ছে নেই। শুধু তাকিয়ে ছিলো নয়নার দিকে । তারপর জানালা দিয়ে আকাশের দিকে। নির্বাক। বোনের জন্য যতটা না কষ্ট হচ্ছে আরিশের জন্য তারচে দিগুণ বেশি খারাপ লাগছে নয়নার। এই তিনটে দিন আরিশের কীভাবে কেটেছে সে তো অরা জানে না। প্রত্যেকটা মানুষ দেখছে, পাগলাটে আরিশ কতটা পাগলামি করতে পারে। অরার কেবিনের সামনে বসেই এই ক’দিন রাত কাটিয়েছে সে। আর সারাদিন জানালার পাশে দাঁড়িয়ে। এই ক’দিনে পানি ছাড়া আরকিছুই কেউ খেতে দেখেনি তাকে। তবে তালহা জোরাজোরি করে গতকাল রাতে ভাত খাইয়েছিল অল্প। হসপিটালের বাইরে খাওয়ার জায়গা আছে। সেখানেই নিয়ে গিয়েছিল।

নিস্তব্ধ রাত। জানালার ফাঁক দিয়ে আলো ঢুকছে।

অরা ধীরে ধীরে উঠে জানালার পাশে গিয়ে দাঁড়ায়। বাইরে ফুলের গাছগুলোর ওপর যেন শিশির পড়ে আছে। তবে সেখানে শিশির নেই। সবটাই অরার মনের ভুল। হঠাৎ নিচের দিক থেকে হালকা গলার আওয়াজ আসে। আরিশ!

চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে বারান্দায়, জানালার পাশে । আলোআঁধারিতে ঠায়। কেবিনের দিকে তাকিয়ে, ডাকছেও না। শুধু… দাঁড়িয়ে আছে।

অরা চোখ নামিয়ে তাকায়। কিছু বলে না। কিছু ভাবেও না। আরিশ করুন স্বরে বাইরে থেকে বলে,

“ পাখি! আমাকে একবার তোমাকে সামনে বসে দেখতে দেবে? একটু আসবো ভেতরে? “

অরা জানালার পাশে একভাবেই দাঁড়িয়ে থাকে। আরিশের কথায় তার মন গলে না। শরীরের প্রতিটি যন্ত্রণা তাকে তার অংশ হারানোর কথা মনে করিয়ে দেয়।

“ অরা….. এভাবে শাস্তি দিও না। কলিজা পুড়ে যায় রে জান। আমি আর কখনো রাগারাগি করবোনা, বিশ্বাস করো…. বিশ্বাস করো…. আমি আর কখনো ওভার রিয়াক্ট করবোনা। আমিও তো সন্তান হারিয়েছি! আমি কি পাষাণ? আমার কি কষ্ট হয় না? “

ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে অরা। বুকটা কেমন শূন্য শূন্য লাগছে তার। আরিশকে দরকার তার, এই মুহুর্তে দরকার। ওই লোকটার বুকে মাথা রেখেই কাঁদতে হবে তার। কিন্তু! মানুষটা কি আদৌও বদলাতে পারবে? অরার মন মানে না। বারবার মনে হয় সেদিন আরিশ যদি একটু শান্ত হতো তবে আজ ছোট্ট প্রাণটা অরার শরীরের ভেতর থাকতো। হাউমাউ করে কাঁদে সে। আরিশ আর নিজেকে সামলাতে পারে না। দরজা খুলে ভেতরে ঢুকে যায়। অরা কাঁপা কাঁপা শরীরে তখন জানালার গ্রিল ধরে কোনোমতে দাঁড়িয়ে ছিলো। আরিশ এসে বুকে জড়িয়ে নিলো তাকে। ছোট্ট পাখিটার কপালে, চুলে, মাথার তালুতে এলোপাতাড়ি চুমু খেতে থাকে আরিশ। অরাও তাকে শক্তভাবে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে থাকে।

“তুমি পাগল ছিলে… এখনও আছো।

কিন্তু আমি সেই পাগলকে ভালোবেসেছিলাম, আর আজ… আমি সেই পাগলের জন্যই সন্তান হারালাম।”

“ ও আমারও সন্তান ছিলো। আমিও হারিয়েছি…. তবুও আমি অপরাধী। শাস্তি দাও, মাথা পেতে নেবো। কিন্তু আমাকে দূরে সরিয়ে দিস না রে পাখি। আমি তোকে ছাড়া অচল…. আমি… আমি তোমাকে ছাড়া অসহায় অরা। প্লিজ!”

অরা আরিশের বুকে মুখ গুঁজে রইলো। কিছুক্ষণ নীরবতা। তারপর বলল সে,

“ শুধু তোমার রাগটা কমাও! এই রাগ-ই আমার জীবনের কাল। “

“ আমি আর রাগারাগি করবোনা। “

দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল অরা। আরিশ রাগ করবে না – কথাটা ঠিক বিশ্বাস হয়নি অরার। কিন্তু কী করবে সে? আরিশের এমন আকুতি ফেরাতে পারেনি সে। তবে মনে মনে অরা আরিশকে ক্ষমা করতে পারেনি এখনও। শুধুমাত্র পাগলের মতো উদভ্রান্ত মুখাবয়বটা দেখে মায়া হচ্ছিল বলেই কাছে টেনে নিয়েছে অরা।

রাত পোহাল। ভোরের আলো ধীরে ধীরে ছুঁয়ে গেল খানবাড়ির ছাদ, দেয়াল, উঠোন।

পাঁচদিন হলো এই বাড়িতে ভালোভাবে রান্না হয়নি। কেউ কিছু খেতেও চায়নি। সকালের বাতাসে আজ একটু গন্ধ- মসলার, চাল-ডালের, রান্না হতে থাকা সুজির ঘ্রাণ। আজ রান্না হচ্ছে। সকাল সকাল। আরিশ ফোন করে জানিয়েছে–অরা একটু সুস্থ আছে। তাই ওর জন্য হালকা করে কিছু রান্না করে পাঠাতে বলেছেন। সেই খবর শোনার পর থেকেই তামান্না রান্নাঘরে নেমে পড়েছে। সঙ্গে সাবিহা আপু। তাসলিমা খালাম্মাও পাশ থেকে সাহায্য করছেন।

তালহা ভোরেই হসপিটাল চলে গেছে।

আরিশ গতকাল রাতেও বাড়ি ফেরেনি-হাসপাতালের কেবিনেই ছিলো, অরার পাশে।

রান্না যতটা হচ্ছে অরার শরীরের জন্য, তার চেয়ে বেশি হচ্ছে একেকজনের মনের শান্তির জন্য। এই যেন খানিক আশ্বাস – ঘরের মেয়েটা বেঁচে আছে, ধীরে হলেও সুস্থ হচ্ছে। সবাই চুপচাপ, তবু যার যার কাজে ব্যস্ত। যেন এক নীরব প্রার্থনায় মগ্ন হয়ে আছে পুরো বাড়ি। শুধু একটা কথাই ঘুরে ফিরছে সবার মনে––

“আল্লাহ, অরা যেন ঠিক হয়ে ওঠে… আবার আগের মতো হেসে ওঠে…”

রান্নাবান্না শেষ হলে সাবিহা ও তামান্না একসাথে হসপিটালের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হবে। সবাই অরার সুস্থতার জন্য প্রার্থনা করছে শুধু।

সকাল আটটা। তালহা আগে থেকেই হাসপাতালে, আরিশ আর অরার পাশে। রান্না শেষ হতে না হতেই সাবিহা আর তামান্না বেরিয়ে পড়ল গাড়ি নিয়ে। তামান্নার হাতে রাখা ব্যাগে কিছু রান্না করা খাবার, দুধ, কয়েকটা ফল। এতকিছু যদিও অরা খায় না তবুও!

গাড়তিে বসে দু’জনেই চুপচাপ। তামান্না নিচু গলায় বলল,

“ভাবি এখন কেমন আছে জানো সাবিহা আপু?”

“ভেতরটা অনেক ভাঙা হয়ে গেছে হয়তো। শরীর তো ধীরে সুস্থ হবে… কিন্তু মন?”

সাবিহার চোখে একরাশ বিষণ্নতা।

হাসপাতালে পৌঁছেই কেবিনের দিকে হেঁটে গেল তারা। করিডোরটা আজ একটু শান্ত, তবে সেই চেনা চাপা ভার এখনও টিকে আছে বাতাসে।

চলবে,

#হামিংবার্ড
#পর্ব_৫৯
#তাসমিয়া_তাসনিন_প্রিয়া

বেডের পাশে হাতে খোঁপা আর চিরুনি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে তালহা। অরা বসে আছে, আরিশ তার পেছনে বসে বউয়ের চুল, বিনুনি করার চেষ্টায় আছে। তবে বারবার বিনুনি করতে চেষ্টা করেও ব্যর্থ হচ্ছে ভদ্রলোক । ছোটো থেকে মা’কে চুল বাঁধতে দেখার সুযোগ হয়ে ওঠেনি আরিশের আর না তো কোনো অন্য মেয়েকে। তার জীবনে নারীসঙ্গ ছিলো না বললেই চলে। তাই এসব চুল বাঁধার বিষয় একেবারেই অপটু সে। তবুও বউয়ের মন ভালো রাখার জন্য একঘন্টা ধরে বিনুনি বাঁধার চেষ্টায় অব্যাহত আছে সে। তালহা পড়েছে মহাবিপদে। দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে তার পা ব্যথা করছে এবার।

“ হলো, আপনার ?”

অরার প্রশ্নে গলা খাঁকারি দিয়ে উঠলো আরিশ। তালহাও নড়েচড়ে উঠে, ভাইয়ের দিকে তাকাল। আরিশ আমতা আমতা করে বলল,
“ এইতো! আর অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই হয়ে যাবে। “
“ এক কথা তো, একঘন্টা ধরে শুনছি। “

জিহ্বা দিয়ে নিজের ঠোঁট ভিজিয়ে নেয় আরিশ। তালহা মিটিমিটি হাসছে।

“ এক… এক ঘন্টা লেগেছে এটাই বলতে চাচ্ছো? কী এমন হয়েছে তাতে, হামিংবার্ড? তুমি একবার শুধু বলো, কী কী ডিজাইনে চুল বাঁধতে চাও তুমি। “

অরা বিষম খেলো আরিশের কথায়। যে মানু্ষটা একঘন্টা ধরে বিনুনি করতেই পারলোনা সে কি-না ডিজাইনের কথা জিজ্ঞেস করছে!

“ তালহা, পানি দে। কুইক!”
আরিশ তালহাকে বলা মাত্রই তালহা দ্রুত পানির গ্লাসটা তার দিকে এগিয়ে দিলো।
“ এই নাও। “

তালহার থেকে পানির গ্লাস নিয়ে তাড়াতাড়ি অরাকে দিলো। বেচারি এক নিঃশ্বাসে সবটুকু জল সাবাড় করে কিছুটা স্থির হয়ে বসলো।

“ ঠিক আছো, পাখি?”
“ এখনও পর্যন্ত ঠিক আছি। তবে আপনি দ্বিতীয় বার আর চুলের বিষয় কিছু বলবেন না প্লিজ। “

আরিশের ঠোঁটের কোণে ক্রুর হাসির রেখা ফুটল। তালহা বেচারা ঠোঁট টিপে হাসছে।
“ ঠিক আছে। তোমার যা ইচ্ছে ! বিনুনি অন্তত শেষ করি? “
“ নাহ…. আর বসে থাকতে পারবো না। আমার চুল, আমিই বেঁধে নিচ্ছি। “

অরা আরিশের হাত থেকে নিজের চুলগুলো সরিয়ে নিলো। চোখের পলকের মধ্যে ঝটপট বিনুনি করতে দেখে আরিশের চোখ তো ছানাবড়া।

এরমধ্যে কেবিনের দরজাটা একটু নড়েচড়ে ওঠে, খুলে যায়। সাবিহা ও তামান্না এসেছে। তাদেরকে দেখে অরার ঠোঁটে হাসি ফুটেছে। আরিশ সেই হাসিটুকু আড়চোখে তাকিয়ে দেখে স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়ল।
“ কেমন আছো, ভাবি?”
সাবিহা এসে অরার পাশের চেয়ারে বসে জিজ্ঞেস করলো। তামান্না, তালহার পাশে দাঁড়িয়েছে– হাতে খাবারের ব্যাগ।
“ আলহামদুলিল্লাহ আপু। আপনি কেমন আছেন? “
“ তুমি হসপিটালে আছো, আমরা কি ভালো থাকতে পারি? তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরে চলো। সবাই তোমাকে মিস করছে। “

সাবিহার আচরণে অরা মুগ্ধ হচ্ছে। মানুষ কতটা বদলাতে পারে সেটা সাবিহাকে না দেখলে বুঝতে পারতো না সে। আরিশের ফোনে কল আসাতে ওদের কথাবার্তার মধ্যেই কেবিন থেকে বেরিয়ে গেছে সে। তালহা, তামান্না ইশারায় নিজেদের মধ্যে কথা বলতে ব্যস্ত। সাবিহার সাথে বেশ কিছুক্ষণ সময় কথা চলতে থাকলো অরার। আগামীকাল হসপিটাল থেকে ডিসচার্জ করে দেবে তাকে।

রাত গভীর। চারদিকে শুনশান নীরবতা। বিছানায় বসে আছেন রোকসানা মল্লিক। চোখ দুটো লাল, পানশে। পাশের চেয়ারে বসে আছেন সুলাইমান মল্লিক, পাঞ্জাবির হাতা গুটিয়ে রাখা, মাথা নিচু।

একটা দীর্ঘ নীরবতা যেন দুজনের মাঝখানে শ্বাস নিচ্ছে।

রোকসানা হঠাৎ নিচু গলায় বলে উঠলেন,

“আমার মেয়ে… মা হতে যাচ্ছিলো… অথচ আমরা কিছুই জানতাম না, কিছুই না… সবকিছু জানার আগেই সে হারিয়ে গেছে। ”

সুলাইমান মাথা তোলে। চোখে কষ্ট জমাট, কিন্তু চোয়ালে শক্ত ভর।

“তকদীরে যা লেখা থাকে তাই হয়। …”

রোকসানার চোখ ছলছল করে উঠে।
“ মেয়েটাকে ছোটবেলা থেকেই জানি। দুঃখ লুকোতে পারে না সে। অথচ এখন দেখো, হাসছে, কথা বলছে, যেন সব ঠিক। কিন্তু আমি জানি, বুকের ভেতরটা ফাঁকা হয়ে গেছে ওর…”

সুলাইমান দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেললেন।
“ওর দুচোখের শূন্যতা আমি দেখেছি, রোকসানা। আমার মেয়ে বড় হয়ে গেছে। কিন্তু একটা কষ্ট আছে যা বাবা-মা হলেও ভাগ করে নিতে পারি না…”

রোকসানা চুপ করে কাঁদতে শুরু করলেন।
“ আমার বুকের মধ্যে শুধু একটা প্রশ্ন – আমরা কী কিছু করতে পারতাম না?”

সুলাইমান উঠে এসে রোকসানার পাশে বসলেন। ধীরে ধীরে তাঁর কাঁধে হাত রাখলেন।

“জীবনে কিছু কষ্ট আসে যেগুলোর কোনো ব্যাখ্যা থাকে না। কিন্তু একটা জিনিস আমরা পারি– ওর পাশে থাকতে, ওকে জড়িয়ে রাখতে। ও যেন জানে, তার ব্যথা কেবল তার না… আমরাও সেই ব্যথা বহন করছি।”

রোকসানা মুখ তুলে স্বামীর চোখের দিকে তাকালেন।

“আমাদের মেয়েটা ভেঙে পড়ুক, সেটা আমি চাই না। সে আবার দাঁড়াবে। আমরা তাকে সেই শক্তিটুকু দেবো।”

একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস দুজনেই একসাথে ছাড়লেন। রোকসানা ধীরে বললেন,
“কাল যখন ওকে বাড়ি নিয়ে যাব, তুমি থাকবে তো?”

সুলাইমান মল্লিক দৃঢ় গলায় বললেন,
“আমি তার বাবা, রোকসানা। যতটুকু ভেঙে পড়েছি, তার চেয়ে দ্বিগুণ শক্তি নিয়ে ওর হাত ধরে ফিরব আমরা।”
রোকসানা কান্নাভেজা চোখে দোয়া করেছ
জানালার বাইরে ভোরের আলো ফুটে উঠছে – হালকা, ম্লান।

হাসপাতালের করিডোর জুড়ে সকালের আলো। জানালা দিয়ে ফুটে আসা নরম রোদের আভায় চারপাশে একটা শান্ত, নীরব পরিবেশ।

অরা ধীরে ধীরে হাঁটছে। তার পাশে আরিশ। ডান হাতে ছোট একটা ব্যাগ, বাম হাত দিয়ে অরাকে আগলে রেখেছে সে। একটু পেছনে রোকসানা আর সুলাইমান। সুলাইমানের হাতে ছাতা, রোকসানার চোখে চশমা। আরেকপাশে নয়না, হাতে ওষুধের ব্যাগ। কেউ খুব বেশি কথা বলছে না।

ডিসচার্জের প্রক্রিয়া আগেই শেষ হয়েছে। কেবিন থেকে বেরিয়ে সোজা লিফটের দিকে হাঁটছে ওরা।

আরিশ একবার নিচু গলায় জিজ্ঞেস করে,
“কষ্ট হচ্ছে হাঁটতে?”

অরা মাথা নাড়ে। চোখে ক্লান্তি, কিন্তু মুখে একটা শান্ত অভিব্যক্তি।

“না।”

আরিশ কিছু বলল না আর। শুধু অরার হাতটা শক্ত করে ধরলো আরো।

লিফটের দরজা খুললে প্রথমেই সুলাইমান মল্লিক এগিয়ে এসে দাঁড়ান। ভেতরে ঢুকে অরার কাঁধে আলতোভাবে হাত রাখেন তিনি।
“চল মা। এবার তোর নিজের ঘরে ফিরবি।”

অরা তাকায় বাবার দিকে। বাবার চোখে জল নেই, কিন্তু সেই চিরচেনা নির্ভরতার ছাপ।

লিফট নিচে নামে। বাইরে এসে গাড়িতে ওঠে সবাই। খান পরিবারের কালো রঙের প্রাইভেট কার দাঁড়িয়ে আছে গেটের সামনে। ড্রাইভিং সিটে জলিল বসে, ইতোমধ্যে গিয়ার গুছিয়ে নিয়েছে।

আরিশ আর তালহা অরাকে মাঝখানে বসতে সাহায্য করে। ডানপাশে মা রোকসানা, বাঁপাশে আরিশ নিজে। নয়না সামনের সিটে, আর সুলাইমান বসেন ড্রাইভারের পেছনে।

গাড়ি চলতে শুরু করেছে। হাসপাতাল পেছনে পড়ে যায় ধীরে ধীরে। অরার চোখে হালকা পানি জমেছে, দৃষ্টি তার জানালার বাইরে। শুধু বাইরের দৃশ্য না, সে তাকিয়ে আছে জীবনের ভেতরের এক বিশাল ফাঁকা জায়গার দিকে – যেখানে কেউ এসেছিলো, থেকে যায়নি।

আরিশ খুব ধীরে অরার হাত ধরলো।

“পাখি…”

অরা মুখ ফেরায় না। চুপচাপ বলে,

“আমার বুকের এক কোণ আজীবনের জন্য খালি হয়ে গেলো।”

আরিশের বুক চিঁড়ে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে। তার নিজের সন্তান পৃথিবীতে আসার আগেই হারিয়ে গেছে। তা-ও তারই রাগের কারণে। এসব ভাবনা মাথায় আসে, রাতে ঠিকমতো ঘুম হয় না তার। চোখ বন্ধ করলেই একটা বাচ্চার অস্পষ্ট মুখ ভাসে।

“তুমি আবার পূর্ণ হবে। আমি আছি। আমরা একসাথেই এগোবো, হামিংবার্ড।”

অরা এবার চুপচাপ চোখ বন্ধ করে ফেলে। নিঃশব্দে অশ্রু ঝরে পড়ে। তার গালে পড়ে থাকা চুলের একপ্রান্ত, বাতাসে দুলে উঠছে। আরিশ অরাকে আগলে বসে আছে, বুকে মাথ ঠেকিয়ে।

গাড়ি খান বাড়ির দিকে এগিয়ে চলছে। রাস্তায় অনেক জ্যাম। থেমে থেমে চলছে গাড়ি। কিছুদূর যেতেই সিগনাল পড়লো, থেমে গেলো সব গাড়িগুলো। অরা চুপচাপ জানালার বাইরে তাকিয়ে আছে। আরিশ একমুহূর্তের জন্য অন্যমনস্ক হয়ে গিয়ে জানালা দিয়ে বাইরে তাকাল। মুহুর্তের মধ্যে মাথায় রক্ত চড়ে বসল তার। এরমধ্যে অরাও জানালার দিক থেকে দৃষ্টি সরিয়ে নিয়ে। একটা ছেলে মোটরসাইকেলে বসে অরার দিকে তাকিয়ে ঠোঁট দিয়ে সিটি বাজাচ্ছে। আরিশ যে ওই ছেলের দিকে অগ্নি দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে এটা নয়না দেখতেই আঁতকে উঠল। আসন্ন ঘটনা কী হতে পারে ভালো করেই আন্দাজ করতে পারছে সবাই।

আরিশ বিদ্যুৎ এর বেগে গাড়ি থেকে নেমেই ছেলেটার কলার চেপে ধরল। রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে বলল,
“তোর সাহস তো কম না, রে! আমার বউয়ের দিকে সিটি বাজাস! কিপ ইয়োর ফাকিং আইজ টু ইয়োরসেলফ! নইলে আজ তোর বাইকসহ রাস্তায় পুঁতে ফেলবো আমি!”
আরিশের চোখ লাল হয়ে উঠেছে, নিঃশ্বাস বেড়ে গেছে। ছেলেটা প্রথমে কিছু বুঝতে পারেনি, তারপর চিৎকারে লোকজন জড়ো হতে শুরু করল। চারপাশে ভিড় বাড়ছে। গাড়ির ভেতর অরা অস্থির হয়ে উঠল।

“ নয়না! বাবা, দেখো কী করছেন উনি! তালহা ভাই! “
অরার কথায় সবাই যেনো হুঁশে এলো। রোকসানা আর সুলাইমান একসাথে বলল,
“আরিশ! প্লিজ, ফিরে আসো!”
তালহা দ্রুত ড্রাইভারের পাশের দরজা খুলে নেমে গেল। গিয়ে আরিশের হাত ধরে টান দিল,
“ভাইয়া! রাগ করে সবসময় এইরকম করে বসো কেন! ভাবি ভালো নেই, এই অবস্থায় এসব ঠিক না!”
ছেলেটা এবার কাঁপতে কাঁপতে বলল,
“ভাই, আমি জানতাম না উনি আপনার বউ… আমি তো মজা করছিলাম… ভাই প্লিজ!”
আরিশ গর্জে উঠল,
“মজা করছিলি? আমার স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে মজা করছিস? আজ তোর ওই ঠোঁট চেপে ধরি, না তারচে ভয়ংকর কিছু করি!”
তালহা তখন অনেক কষ্টে আরিশকে ধরে গাড়ির দিকে ঠেলে নেয়। কিন্তু বেশিক্ষণ আঁটকে রাখা ওর পক্ষে সম্ভব না। অবস্থা খারাপ বুঝে নয়না গিয়ে বাইকের ছেলেটাকে চোখ রাঙিয়ে বলে,

“চলে যান এখান থেকে, আর কোনো মেয়ের দিকে সিটি বাজাতে সাহস করবেন না!”
ছেলেটা বাইকে উঠে দৌড়ে পালিয়ে যায়। চারপাশের লোকজন তখনও ফিসফাস করছে।
ছেলেটা চলে যাওয়ার কয়েক মিনিট পর কিছুটা শান্ত হয় আরিশ, গাড়িতে উঠে চুপচাপ বসে। অরার দিকে একবারও তাকায় না। তার চোখে তখনো আগুন। অরা ধীরে বলে,
“তুমি ঠিক করনি।”
আরিশ কাঁপা গলায় বলে,
“সে তোমাকে অপমান করেছে, টিজ করেছে পাখি… আমি কীভাবে সহ্য করতাম?”

“কিন্তু আমি হাসপাতালে ভর্তি ছিলাম, হাঁটতেও পারিনি ঠিক করে। এখন একটু সুস্থ হয়ে বাড়ি যাচ্ছি… এভাবে আবার আপনি কারো গায়ে হাত তুললে, আমি কীভাবে স্বাভাবিক থাকবো বলুন?”

আরিশ এবার তার দিকে তাকায়। চোখে হতাশা, অনুশোচনা, কিন্তু রাগ নয়।

“আমি ঠিক করবো নিজেকে। শুধু তুমি পাশে থেকো…”

অরা চোখ সরিয়ে নেয়। দীর্ঘশ্বাস ফেলে। জ্যাম কেটে গেলে গাড়ি আবার ধীরে ধীরে চলতে থাকে।

চুপচাপ… নিঃশব্দে… একটা সম্পর্ক তার ভারসাম্য খুঁজছে –ভালোবাসা আর সহনশীলতার মাঝপথে।

চলবে,