#হামিংবার্ড
#পর্ব_৬০
#তাসমিয়া_তাসনিন_প্রিয়া
আজ পাঁচ দিন পর খান বাড়িতে পা পড়লো অরার। অনাগত অতিথিকে হারিয়ে সবার মন ভারাক্রান্ত থাকলেও অরাকে আবারও ফিরে পেয়ে সবাই খুব খুশি। তামান্না বলতে গেলে অরার পছন্দ অনুযায়ী সব খাবার রান্না করেছে। এতো এতো পদের রান্না দেখে চমকে গিয়েছিল সে। সবাই আদরযত্ন করে অরাকে দ্রুত সুস্থ করে তুলতে চায়। তবে অরার মনে অশান্তির বীজ যেন তড়তড় করে বাড়ছে। আরিশের অতিরিক্ত রাগ, জেদ সবকিছু আজকাল অরাকে খুব ভাবাচ্ছে।
দুপুরের খাওয়াদাওয়া করে রুমে এসে শুয়েছে অরা। আরিশ ল্যাপটপে মুখ গুঁজে, কাজে ব্যস্ত। এতদিন বিজনেসের দিকে ভালো করে খেয়াল দিতে পারেনি বলে নানান সমস্যা দেখা দিয়েছে। অরা আনমনে আরিশের কথাই ভাবছে। বাবা-মা, বোন সবাই তাকে স্বান্তনার বাণী শুনিয়ে গিয়েছিল – আরিশ শুধরে যাবে। কিন্তু আসলেই কি শুধরবে? দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল অরা। হঠাৎ করে জীবনটা কেমন জানি দূর্বিষহ হয়ে উঠেছে তার।
“ আরিশ! ভেতরে আসব?”
আচমকা চাচির কণ্ঠস্বর শুনে মাথা তুলে তাকাল আরিশ। তাসলিমা খাতুন দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে আছেন। আরিশ একনজর দেখার পর আবারও ল্যাপটপের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করে বলল,
“ আসুন। “
আরিশের এমন হাবভাব অরার ভীষণ খারাপ লাগে। ছেলের ঘরে আসতে গেলেও অনুমতি লাগবে? প্রথম প্রথম তামান্নার কাছে আরিশের বিষয় সবকিছুই শুনতো অরা। আরিশ বরাবরই এমন স্বভাবের। কাউকে নিজের ঘরে আসতে দিতেও অসহ্য লাগতো তার। এমনকি কেউ অনুমতি ছাড়া ঘরে ঢুকতে পারে না।
তাসলিমা মুচকি হেসে অরার দিকে এগোলেন। অরাও হাসির বদলে চওড়া হাসি উপহার দিলো তাকে।
“ কেমন আছো এখন, অরা?”
বিছানার পাশেই দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করলেন তাসলিমা। অরা মুচকি হাসল। পরক্ষণেই ম্লান হয়ে গেলো তার চেহারা।
“ আলহামদুলিল্লাহ। আপনি বসুন, চাচি। “
তাসলিমা ধীরেসুস্থে অরার পাশে বিছানায় বসলেন। অরা আবারও বলল,
“ আপনার শরীর কেমন আছে এখন?”
“ ভালো আছি রে মা… শুধু ইদানীং কোমড়ের ব্যথাটা বেড়েছে একটু। “
“ সে কী! ঔষধ খাননি? না-কি ডাক্তার দেখাননি? “
কিছুটা ব্যতিব্যস্ত হয়ে উঠল অরা। আরিশ তার আচার-আচরণ দেখছে কেবল। একটা মেয়ে এতো সহজে কাউকে এভাবে আপন করে নিতে পারে?
“ সবকিছু করেছি। বয়স হচ্ছে তো। শরীরে এখন একটু-আধটু অসুখ থাকবে। তুমি ঠিকমতো খাওয়াদাওয়া করো, অরা। চোখমুখ কেমন ফ্যাকাসে লাগছে। “
“ জি, করবো চাচি। “
তাসলিমা খাতুন বসা থেকে উঠে দাঁড়ালেন। অরা শোয়া থেকে উঠতে চাইলে আরিশ ধমকে ওঠে –
“ উঠছো কেন?”
আচমকা ধমকে কিছুটা ভয়ই পেয়েছে অরা। তাসলিমা নির্বাক।
“ ওঠা যাবে না? এমনি বসতে চেয়েছিলাম। “
“ মাত্রই তো খেয়ে শুয়েছিলে, আরকিছু সময় থাকো। “
অরার ভালো লাগছে না। সে কথা বাড়াতে চায় না। চুপচাপ শুয়ে পড়ে। আরিশের এমন অতিরিক্ত যত্নশীল মনোভাব আজকাল বিরক্ত লাগে তার।
“ আমি আসছি, পরে কথা হবে। “
“ আচ্ছা চাচি।”
তাসলিমা খাতুন ধীরপায়ে দরজার দিকে এগোলেন। উনি চলে যেতেই আরিশ গিয়ে দরজা আঁটকে দিয়ে বিছানায় গিয়ে বসে।
অরা মুখ গোমড়া করে চুপচাপ শুয়ে আছে। আরিশ তাকে শোয়া অবস্থায় কোলের উঠিয়ে শুইয়ে দিলো। একহাতে অরার মাথা রাখা, অন্য হাতে তার কপালের ওপর পড়ে থাকা ছোটো চুলগুলো সরিয়ে দিচ্ছে আরিশ।
“ কী হয়েছে? মন খারাপ, হামিংবার্ড?”
অরা কথা বলে না। মাথা নাড়ে কেবল। আরিশ নিজে থেকেই বলে,
“ আমার পাখিটা আর আগের মতো নেই। ছোট্ট, ভীতু, আদুরে একটা মেয়ে ছিলো – আমার হামিংবার্ড। যাকে শত যন্ত্রণা দিলেও একটু ভালোবাসা পেলে গলে যেতো। সেই মেয়েটাকে হুট করেই যেন হারিয়ে ফেলেছি আমি। তুমি কি জানো অরা, কোথায় গেলে তাকে আমি পাবো?”
অরার বুক চিঁড়ে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে। চোখ ছলছল করছে। চাইলেও আগের মতো আরিশের সাথে মিশতে পারছে না সে। হয়তো শুরু থেকেই আরিশের অতিরিক্ত ভালোবাসা, আদর, জেদ, রাগ, হিংস্রতা নিয়ে অরার মনে একটা ক্ষোভ লুকিয়ে ছিলো। বাচ্চা নষ্ট হওয়ার পর থেকে সেই ক্ষোভ আরও বৃদ্ধি পাচ্ছে।
“ আমি জানি না, আরিশ। “
আরিশের বুকটা কেমন করছে। মনে হচ্ছে খালি হয়ে যাচ্ছে। ঝুঁকে অরার কপালে ঠোঁট স্পর্শ করায় সে, তারপর গালে, একে একে নাকের ডগায় এবং পরিশেষে অরার হাতে।
“ বিশ্রাম নাও। আমি একটু বের হবো। “
“ কোথায় যাবেন?”
“ কিছু কাজ আছে। সেগুলো করতে হবে। এতদিন অফিসে যাইনি তো, নানান ঝামেলা হয়েছে। “
আরিশ অরাকে বিছানায় আলতো করে শুইয়ে দিয়ে ওয়ারড্রবের দিকে এগোল।
“ ঠিক আছে। “
অরার সংক্ষিপ্ত উত্তর। আরিশ বাইরে যাওয়ার জন্য রেডি হয়ে নেয়। কিছুক্ষণের মধ্যেই রুম ত্যাগ করে। ভদ্রলোক চোখের আড়াল হতেই শোয়া থেকে উঠে বসে অরা। সাথে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে। কিছুদিন বাবার বাড়ি থাকতে পারলে ভালো লাগতো – এসব ভাবতে থাকে অরা। কিন্তু আরিশ? সো কি যেতে দেবে অরাকে! রাগে বালিশ ছুড়ে ফ্লোরে ফেলল অরা। সামান্য বাবার বাড়ি যাওয়া নিয়েই এতো ঝামেলা কার ভালো লাগে?
ফোনের রিংটোনের শব্দে নড়েচড়ে উঠল সে। কে কল করলো ভাবতে ভাবতে ফোনের স্ক্রিনে তাকিয়ে দেখল, আরিশ কল করেছে। মাত্র বাসা থেকে বেরিয়ে গেলো, এরমধ্যেই কল কেন? কিছুটা বিরক্তি নিয়ে কল রিসিভ করলো অরা।
“ হ্যালো!”
“ ঘর থেকে বেরিয়ে বেশি হাঁটাহাটি করবে না, পাখি। তোমার শরীর অনেক দূর্বল। আমি তাড়াতাড়ি ফিরে আসবো। “
“ আচ্ছা। “
কল কেটে দিলো অরা। চুপচাপ বসে রইলো ওভাবেই!
ভরদুপুর বেলা। আকাশে কালো মেঘ করেছে। শীঘ্রই হয়তো বৃষ্টি হবে। উত্তরের ঠান্ডা হাওয়া এবং দূর আকাশের কালো মেঘগুলো অন্তত এমনই আভাস দিচ্ছে।
গত কয়েকদিন ধরে বোনের শরীর খারাপের বিষয় চিন্তিত থাকার ফলে পলাশের বিষয়টা কিছুটা হলেও ভুলে ছিলো নয়না। কিন্তু আজ ভীষণ করে মনে পড়ছে তাকে। পলাশের নতুন ফোন নম্বর স্কুলের কারোর কাছেই নেই। যাওয়ার আগে কেবল নয়নাকে নতুন সিমের নম্বরটা দিয়ে গিয়েছিল। অথচ নয়না সেটা হারিয়ে ফেলেছে। বুকের পাঁজর ফুঁড়ে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে।
“ নয়না ছাদে গিয়ে জামাকাপড়গুলো একটু নিয়ে আয়, তো। “
মায়ের গলা শুনে জানালার পাশ থেকে সরে দাঁড়াল নয়না। রোকসানা নয়নার রুমে একবার উঁকি দিলেন। তড়িঘড়ি করে যেতে যেতে ফের বললেন,
“ দাঁড়িয়ে না থেকে যা, তাড়াতাড়ি। বৃষ্টি এলো বলে…..”
“ হ্যাঁ, মা। যাচ্ছি। “
নয়না দ্রুত পায়ে ঘর থেকে বেরিয়ে সিঁড়ির দিকে এগোয়। ছাদে যেতেই তার দু-চোখ জুড়িয়ে গেল। বৃষ্টি আসার আগমুহূর্তের মতো সুন্দর দৃশ্য প্রকৃতিতে আর দ্বিতীয়টি নেই বলেই মনে হলো তার। ছাদের মাঝখানে দাঁড়িয়ে দু-হাত ছড়িয়ে আকাশের পানে মুখ করে দাঁড়াল নয়না। ঝিরিঝিরি বৃষ্টির ফোঁটা পড়ছে ধরণীর বুকে, সাথে শীতল হাওয়া বইছে। নয়নার মনটা কেমন ফুরফুরে হতে লাগলো। আচমকাই মনে পড়লো পলাশের দেওয়া সেই চিঠির কথা বক্সের কথা। চোখ খুলে ফেলল নয়না। বুক ধুকপুক করছে। ইতিমধ্যে বৃষ্টির তোপ বৃদ্ধি পেয়েছে। জামাকাপড়ের দিকে নজর পড়তেই আঁতকে উঠল সে। আজ মা নিশ্চিত বকবে ভেবে তাড়াতাড়ি সবগুলো জামাকাপড় নিজের হাতে, কাঁধে নিয়ে ছাদ থেকে নেমে গেলো নয়না।
জামাকাপড়গুলো ঠিকঠাক জায়গায় রেখে, তাড়াতাড়ি নিজের ঘরে চলে এসেছে নয়না। পলাশের দেওয়া চিঠি আর বক্সটা ড্রয়ারের ভেতরই রেখেছিল। খুব তড়িঘড়ি করে ড্রয়ার খুলে সেসব খুঁজতে শুরু করলো মেয়েটা। মনে মনে ভয় তার– যদি ওগুলোও হারিয়ে যায়! বুকটা হুহু করে ওঠে নয়নার। কিন্তু কাঙ্ক্ষিত জিনিসগুলো নজরে আসতেই স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে সে। কাঁপা কাঁপা হাতে চিঠিটা খুলতে শুরু করে।
নয়না,
তুমি আমাকে পছন্দ করো—এটুকু জানি। সেটা বুঝতে আমার দেরি হয়নি। কিন্তু ভালোবাসো কিনা, সেটা জানাও জানতে চেয়েছিলাম আমি। তবে উত্তর পাইনি। হয়তো তোমার থেকেই সেই উত্তরের অপেক্ষায় থাকবো আমি।
এই শহর ছেড়ে যাচ্ছি, কিন্তু মনটা তোমার কাছেই ফেলে যাচ্ছি। আমি জানি, একদিন ফিরে আসব—ঠিক দুই বছর পর, আর তখন আমি তোমার চোখে খুঁজবো সেই প্রশ্নের উত্তর।
তুমি হয়তো এখন দ্বিধায় আছো, তোমার অনুভূতির গভীরতা নিয়ে। সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু আমি জানি, তুমি আমার কথাগুলো মনে রাখবে। এই চিঠিটা হয়তো তোমার ডায়েরির পাতায় চাপা পড়ে থাকবে, কিন্তু কোনো এক নির্জন দুপুরে, হয়তো বৃষ্টির দিনে, তুমি এটা খুলে পড়বে… আর আমায় মনে করবে।
নয়না, আমি চাই না তুমি এখনই উত্তর দাও। আমি শুধু চাই—তুমি সত্যিই যদি একদিন বুঝো আমার ভালোবাসার মানে, তাহলে আমাকে মনে রেখো।
দুই বছর পর, যদি আমি ফিরি আর দেখি তোমার চোখে সেই একই চুপচাপ আলোটা আছে… আমি তোমার হাতটা ধরবো, আর এক মুহূর্তের জন্যও ছেড়ে যাব না।
তুমি যদি ভুলে যাও, তাও দোষ নেই। আমি ভালোবাসি বলেই তোমার স্বাধীনতাটাও ভালোবাসি।
ভালো থেকো নয়না,
আর অপেক্ষা কোরো—
কারণ আমি ফিরবো।
তোমার,
পলাশ।
চিঠির ওপরে নয়নার গাল বেয়ে কয়েক ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়েছে। নিঃশব্দে চোখের জল ফেলছে সে। বাইরে তুমুল বৃষ্টি হচ্ছে। পলাশের কথা সত্যি হয়েছে। কোনো এক বৃষ্টির দিনেই নয়না তার পলাশের দেওয়া চিঠিটা পড়েছে। তার মন কেমন করছে আজ এই বৃষ্টিমুখর দিনে।
নয়না চিঠিটা বুকে চেপে ধরে ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে। কেমন লাগামছাড়া লাগছে যেন তার। হুট করেই ফ্লোরে বসে পড়লো সে। তারপর কতক্ষণ ওভাবে বসে রইলো তার হিসাব করা হলোনা আর……..
বৃষ্টি মাথায় নিয়ে বাড়ি ফিরেছে আরিশ। সেই যে দুপুরে বৃষ্টি নামল আর থামবার নামগন্ধ নেই। গাড়িতে থাকলেও একটু-আধটু বৃষ্টির ছিটে লেগেছে আরিশের শরীরে। রুমে ঢুকেই আরিশের সজাগ দৃষ্টি অরাকে খুঁজতে লাগলো। কিন্তু কোথাও দেখতে পেলো না। কেমন অশান্ত হয়ে উঠলো সে। চিৎকার জুড়ে বসল।
“ তামান্না….. তামান্না? অরা কোথায়? “
তামান্না সাবিহার রুমে ছিলো। অরাও সেখানে। আরিশের হাঁকডাক শুনে তিনজনই রুম থেকে বেরিয়ে আরিশের রুমের দিকে এগোল।
“ কী হয়েছে ভাইয়া? ভাবি তো আমাদের সাথে ছিলো। “
অরাকে দেখে স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়ল আরিশ। ইদানীং আরিশ খুব নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে। মনে হচ্ছে এই বুঝি অরা কোথায় চলে গেলো, তাকে ছেড়ে দিলো।
“ কিছু না। ঠিক আছে। তোরা যা, অরা রুমে এসো। “
তামান্না, সাবিহা আরিশের কথামতো চলে গেলো। অরাও ধীরপায়ে রুমের ভেতর ঢুকেছে।
আরিশ ধীরে ধীরে এগিয়ে গেল অরার দিকে। ততক্ষণে অরাও বুঝতে পারছে, তার প্রতি আরিশের এই পাগলপনা কেবল রাগ বা হঠকারিতা নয়। হয়তো ভেতরের গভীর একটা ভয়, একটা শূন্যতার আশঙ্কা।
“তুমি কোথায় ছিলে? আমি রুমে এসে তোমাকে না দেখে…”
আরিশের গলা কেঁপে উঠল। অরা এগিয়ে এসে বলে,
“আমি তো এখানেই ছিলাম, সাবিহা আপুর রুমে। তামান্না আপু তো বলল।”
“জানি। তাও ভয় পাই… এই ভয়টা যাচ্ছে না, পাখি। মনে হয়—যদি হারিয়ে ফেলি তোমায় ?”
অরা চুপ করে থাকে। আরিশ এগিয়ে গিয়ে তার কপালে ঠোঁট ছুঁইয়ে দেয়।
” সন্ধ্যায় নাস্তা করছো? চলো কিছু খাবে। চোখমুখ শুকনো লাগছে ”
অরার চোখে পানি জমে। এই মানুষটা রাগ করে, পাগলামি করে, ভুলও করে। কিন্তু ভালোবাসে প্রাণ দিয়ে। তাই যতই বিরক্ত হোক কিংবা আরিশের পাগলামি দেখে রাগ করুক অরা, অবহেলা করতে পারবে না।
“ভয় পেও না, আরিশ। আমি তোমাকে ছেড়ে কোথাও যাবো না।”
অরা ধীরে ধীরে বলল। আরিশ চুপ করে মাথা ঝাঁকায়। তারপর বলে,
“তবুও তুমি একটু চোখের আড়াল হলেই আমার বুকটা খালি খালি লাগে। বুঝতে পারো না?”
অরা এগিয়ে গিয়ে তার বুকে মাথা রাখে।
বাইরে তখনও বৃষ্টি ঝরছে, কিন্তু খানিকটা থেমে এসেছে।
চলবে..
#হামিংবার্ড
#তাসমিয়া_তাসনিন_প্রিয়া
#পর্ব_৬১
বাইরে এখনও বৃষ্টি ঝরছে, তবে একটু থেমেছে। জানালার পাশে ঘরের নরম আলোয় দাঁড়িয়ে আছে অরা আর আরিশ। অরা তার বুকে মাথা রেখে চোখ বন্ধ করে রেখেছে। সেই স্পর্শে যেন অস্থিরতা মুছে যাচ্ছে ধীরে ধীরে। আরিশও তাকে জড়িয়ে রেখেছে, এমনভাবে, যেন একটুও আলগা হলেই সব ভেঙে যাবে– হারিয়ে ফেলবে অরাকে।
“বুঝতে পারি আমি।”
ফিসফিস করে বলল অরা। একটু থেমে আবার বলতে লাগলো,
“আমি সরি, রাগী ভূত। কিছুদিন ধরে তোমার সঙ্গে খুব খারাপ ব্যবহার করছি। জানি না কেন এমন করলাম হঠাৎ।”
আরিশ তার পিঠে ধীরে হাত বুলিয়ে দিল। তারপর দুই গালে হাত রেখে মুখটা নিজের দিকে তুলে আনল। দুজনের চোখ এক মুহূর্তে আটকে গেল।
“ সময় সবকিছু ঠিক করে দিবে, হামিংবার্ড। শুধু ভয় পাই, যদি তুমি…”
আরিশের কথার মাঝখানে অরা তার ঠোঁটে আঙুল চেপে ধরে থামিয়ে দিল। মুহূর্তের জন্য আরিশ কেঁপে উঠল অরার স্পর্শে। অনেকদিন পর প্রেয়সীর এমন কাছাকাছি আসা, তাকে ভেতর থেকে নাড়িয়ে দিল। দুজনের মাঝখানে এখন নিঃশব্দতা, কিন্তু হৃদস্পন্দনে গুঞ্জরিত হচ্ছিল শত শব্দ।
“চুপ করুন। কিছু হবে না আর। আমি আছি আপনার জন্য। শুধু অনুরোধ, নিজেকে একটু বদলানোর চেষ্টা করুন।”
“চেষ্টা করছি, অরা। কিন্তু মনে হয়, নিজেরই সঙ্গে লড়ছি প্রতিদিন। আর এখানেই আমার ভয়…”
অরা একটুখানি দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলল। কী বলবে বুঝে উঠতে পারছিল না। আরিশ ধীরে ধীরে তার কোমরে হাত রেখে কাছে টেনে আনল। চমকাল অরা, তবে পিছিয়ে যায়নি। এই স্পর্শ তার অজানা নয়, সে জানে আরিশের স্পর্শের গভীরতা। আরিশ তার কপালে একটি চুমু রাখল, অনেকটা সময় নিয়ে। এরপর তার ঠোঁট নেমে এলো নিচে—ধীরে, ধীরস্থিরভাবে। তাদের ঠোঁট এক মুহূর্তে ছুঁয়ে গেল—নরম, শুদ্ধ, গভীর এক ছোঁয়া। তাতে ছিল না কোনো জেদ, কোনো অস্থিরতা, ছিল কেবল হৃদয়ের সমস্ত প্রশান্তি।
অরাও সেই মুহূর্তে চোখ বন্ধ করে রইল। একটুখানি উষ্ণতা, একটুখানি ভরসা… যেন বহুদিনের অপেক্ষার এক চিরন্তন উত্তর। তবে কিছুক্ষণ পরই অরা ধীরে বলে উঠল,
“শরীরটা ভালো লাগছে না, আরিশ। আমার একটু বিশ্রাম দরকার।”
অরার কথায় যেন হুঁশ ফিরলো আরিশের। বেপরোয়া আরিশ বরাবরই নিজের অনুভূতি সামলাতে ব্যর্থ । আবেগে ভেসে গিয়ে অরার ক্লান্তি, অসুস্থতা ভুলেই গিয়েছিল সে। বিষয়টি অনুভব হতেই সাথে সাথে নিজেকে অরার থেকে সরিয়ে নিল সে, মুখে এক ধরনের অনুশোচনা।
“তুমি বিশ্রাম নাও, পাখি। আমি… আমি ফ্রেশ হয়ে আসছি।”
আর কোনো কথা না বলে দ্রুত ওয়াশরুমের দিকে চলে গেল সে। অরা চুপচাপ তাকিয়ে রইল তার পেছনে। ভদ্রলোকটা বদলায়নি, তবুও ভালোবাসার পরশে সে একটু একটু করে নিজের কঠিনতাগুলো গলিয়ে নিচ্ছে।
মুখ গোমড়া করে বিছানায় বসে আছে সাবিহা। পাশেই ফোনে বারবার রিং হচ্ছে – মেহরাব কল করছে। অনেকবার বাজার পর আবার কেটে গেল। কিন্তু সাবিহা ফোনটা ধরছে না। গত দু’দিন ধরে মেহরাবের ফোন বন্ধ ছিল। চিন্তায় অস্থির হয়ে ছিল সে। এমনকি আরিশের এমন দুঃসময়েও মেহরাব পাশে ছিল না – বিষয়টা একদম ভালো লাগেনি সাবিহার।
“এতবার কল করছে কে, সাবিহা? রিসিভ না করে বসে আছিস যে?”
মায়ের কথায় চমকে উঠল সে। কী বলবে? মেহরাব কল করেছে…তাসলিমা খাতুন যদি ভুল কিছু ভেবে বসেন! তাই চুপ করে রইল সাবিহা। কিন্তু তাসলিমা খাতুন আবারও বললেন,
“কী রে?”
“আমার এক বন্ধু কল করছিল।”
“ওহ! তা বন্ধু যখন কল করেছে, কথা বলছিস না কেন?”
“সময় হলে বলব।”
বিছানায় পা ঝুলিয়ে বসলেন তাসলিমা খাতুন। এক দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বললেন,
“অরার অসুস্থতার জন্য তালহার বিয়েটা পিছিয়ে গেল। তোর তো ক্লাসও বন্ধ যাচ্ছে ।”
“আমি আর বিদেশে ফিরব না, মা।”
চমকে উঠলেন তাসলিমা। বিস্মিত হয়ে জিজ্ঞেস করলেন,
“কী বলছিস এসব?”
“যা বলছি ঠিকই বলছি। আমি আরিশ ভাইয়ার সঙ্গে কথা বলে নেব।”
“লেখাপড়া না করলে কী করবি? বিয়ে?”
মায়ের মুখে এমন কথা শুনে হঠাৎ থমকে গেল সাবিহা। মেহরাবকে বিয়ে করে সংসার করতে চায় সে। কিন্তু মাকে সেটা সরাসরি বলা যাচ্ছে না।
“সেটা পরে দেখা যাবে, মা। তুমি এত চিন্তা করো না।”
“বোঝা যায় না তোদের মতিগতি! বিদেশে গিয়ে ভালো করে পড়াশোনা করে একটা চাকরি-বাকরি করবে—এই আশায় তো পাঠালাম। আর তুই দেশে বসেই থেকে যেতে চাইছিস! যা খুশি কর!”
বলতে বলতেই রাগে ভরা মুখে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন তাসলিমা খাতুন। সাবিহা চুপচাপ বসে রইল। বলার মতো কিছু ছিল না তার কাছে।
সবচেয়ে আগে দরকার – মেহরাবের সঙ্গে কথা বলা। তারপর দেখা যাবে কী হয়!
এইভাবে দেখতে দেখতে কেটে গেছে প্রায় এক সপ্তাহ। অরার শরীর এখন অনেকটাই ভালো।
আরিশও নিয়মিত অফিসে যাচ্ছে। তালহা-তামান্নার বিয়ে নিয়ে আবারও আলোচনা শুরু হয়েছে – তবে এবার তারা তাড়াহুড়া করতে চায় না। অরা পুরোপুরি সুস্থ হওয়ার পরই বিয়ে করতে চায় তারা। আর এদিকে…সাবিহার সঙ্গে মেহরাবের কথা হয়নি নয় দিন। সেদিন মেহরাব ফোন করেছিল– কিন্তু সাবিহা রিসিভ করেনি।
পরে সাবিহা যখন নিজে থেকে কল করে যোগাযোগ করতে চেয়েছিল, তখন মেহরাবই ফোন ধরেনি। এরপর শত চেষ্টা করেও আর যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি। বাসা, অফিস—কোথাও মেহরাবকে খুঁজে পায়নি সাবিহা। আসলে মানুষ ইচ্ছে করে দূরত্ব তৈরি করলে তার কাছাকাছি পৌঁছানো মুশকিল।
সন্ধ্যার ঝলমলে আলোয় আলোকিত শহরটা যেন আজ একটু বেশিই ব্যস্ত দেখাচ্ছে। চারদিকে গাড়ির হেডলাইট, রোডল্যাম্পের নরম আলো, আর দূর থেকে ভেসে আসা হর্ণের শব্দ মিলে তৈরি করেছে এক বিশেষ শহুরে সুর।
উঁচু বিল্ডিংয়ের করপোরেট অফিসের কেবিনে বসে আছে দুজন পুরুষ—মেহরাব আর আরিশ।
একটি কাঁচঘেরা ঘর, ভিতরে নীরব আলো, বাইরে শহরের হালকা কোলাহল।
দু’জনের মাঝখানে একটি সেন্টার টেবিল, তাতে রাখা কফির কাপ। কথাবার্তা চলছে কিছুক্ষণ ধরেই– স্বাভাবিক সুরে। আরিশ, বরাবরের মতোই পরিপাটি—কালো শার্টে গাঢ় ছায়া পড়েছে তার গালের ধার ধরে, গায়ে ফিটিং ফরমাল প্যান্ট। মেহরাব আজ বেশ সাধারণভাবে এসেছে। টি-শার্ট আর জিন্স, একহাতে কফির কাপ ধরা, অন্য হাত দিয়ে চেয়ার ঘষে ঘষে কিছুটা অস্থিরতা প্রকাশ করছে। তার মুখে শান্ত ভঙ্গি।
“আন্টি এখন কেমন আছেন?”
নরম গলায় জানতে চাইলো আরিশ। মেহরাব ম্লান হেসে কফির কাপ হাতে নিয়ে মাথা ঝাঁকিয়ে বলল,
“আলহামদুলিল্লাহ, এখন অনেকটাই ভালো।
অরা ভাবির কী অবস্থা? মা’র অসুস্থতার জন্য তোর পাশে থাকতে পারিনি রে… খুব খারাপ লাগছে, সরি আরিশ।”
আরিশ একটু অবাক হয়ে তার দিকে তাকাল, চোখে ভ্রু কুঁচকে হালকা দুশ্চিন্তার ছাপ। তারপর মাথা নেড়ে বলল,
“কি সব বলছিস, মেহরাব? উল্টো আমার সরি বলা উচিত। আন্টির এত বড় অপারেশন, আর আমি জানতেই পারিনি…”
মেহরাব কফির কাপ টেবিলে রাখে ধীরে, চোখ নামিয়ে নিচু স্বরে বলল,
“কাউকেই কিছু বলার মতো অবস্থায় ছিলাম না রে। অবস্থা দু’জনেরই ভালো ছিল না। সব কিছুর পর… আলহামদুলিল্লাহ, মা আর অরা ভাবি দু’জনেই এখন ভালো আছে।”
একটা ছোট্ট নীরবতা নামল, দুজনেই যেন একসাথে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল।
“হ্যাঁ, এটাই সবচেয়ে বড় কথা।”
বলেই আরিশ তার কফির শেষ চুমুক দিয়ে কাপটা রেখে দিল টেবিলে। কিছুটা দ্বিধা নিয়ে মেহরাব আবার কাপটা হাতে তোলে। চোখ নামিয়ে, নিচু গলায় বলল,
“আরিশ, তোকে একটা কথা বলতে চাই।”
আরিশ সোজা হয়ে বসে, কৌতূহলী মুখে তাকায়।
“হ্যাঁ, বল না।”
মেহরাব একটু থেমে, মুখে একটুখানি সংকোচ নিয়ে বলে,
“ভনিতা না করে সরাসরি বলি—আমি সাবিহাকে পছন্দ করি। সাবিহাও আমাকে পছন্দ করে।
ভাই হিসেবে তোর বোনকে আমার হাতে তুলে দিতে কি তোর কোনো আপত্তি আছে?”
আরিশ মুখে হালকা মুচকি হাসি হাসলো। মেহরাবের কথায় মোটেও অবাক হয়নি সে। কারণ অরা তাকে আগেই এ বিষয় বলেছিল। মেহরাব ভালো ছেলে। আরিশের বন্ধু, সেই তার বিষয় হিসেবে সবকিছুই জানে। তাই সাবিহার সাথে মেহরাবের বিয়েতে কোনো আপত্তি করার কারণ নেই আরিশের কাছে।
“আপত্তি কিসের, ভাই! বন্ধু থেকে দুলাভাই হবি– এর চেয়ে ভালো ব্যাপার আর কি হতে পারে! যদিও সম্পর্কে আমি তোর বড়ই হবো।”
মেহরাব যেন হঠাৎ নিঃশ্বাস ফিরে পেল, মুখটা উজ্জ্বল হয়ে উঠল। চোখেমুখে একধরনের স্বস্তি খেলা করতে লাগল।
“আলহামদুলিল্লাহ, যাক! তোর বোনকে এবার টাইট দেবো। নয় দিন ধরে কথা বন্ধ—একটুও যোগাযোগ করছি না।”
আরিশ কপালে হাত ঠেকিয়ে অবাক ভান করে বলল,
“কেন রে? কী হয়েছে?”
মেহরাব একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে হালকা হেসে বলল,
“সেদিন তোকে বলেছিলাম, আমি বারবার কল দিয়েছিলাম—কিন্তু সে ধরেনি। মা’র অবস্থা তখন খুব খারাপ ছিল। সব মিলিয়ে দু’দিন যোগাযোগ করতে পারিনি। আর সেই রাগে সাবিহা আমায় একেবারে এড়িয়ে গেল। আমি তখন আর কল করিনি। মানুষ কবে কোন পরিস্থিতিতে পড়ে – তা না জেনে অনেকেই অন্যকে জাজ করে। এটাই বড় দুঃখ।”
আরিশ হালকা চোখ ছোট করে বলল,
“বুঝেছি… মেহরাব সাহেবের অভিমান হয়েছে।”
মেহরাব একটু হাসতে হাসতে বলে,
“আরে না, ঠিক তা না…”
আরিশ হেসে উঠে বলে,
“তামান্নাদের বিয়ের সাথে তোদের বিয়েটাও দিয়ে দেবো, ভাবছি!”
মেহরাব চেয়ার থেকে আধা উঠে খুশিতে বলল,
“ তাহলে তোরাও আরেকবার বিয়েটা করে নে ভাই! কী যে বিয়ে করেছিলিস, কোনো অনুষ্ঠানই তো ছিল না!”
আরিশ হেসে মাথা নাড়ে। চোখে-মুখে স্থিরতা।
“ বিয়ে তো দু’বার করা যায় না,
অনুষ্ঠান করা যায়। অরা পুরোপুরি সুস্থ হোক, তারপর হবে সব।”
মেহরাব মজা করে বলে,
“বাহ! ছেলেটা কতো ভদ্রসভ্য হয়ে গেছে!”
আরিশ চুপ করে থাকে এক মুহূর্ত, তারপর চোখে এক মায়াবি আলো নিয়ে বলল,
“সবই তোদের জন্য… আর অরার জন্য।”
তারপর হঠাৎ ঘড়ির দিকে তাকিয়ে উঠে দাঁড়ায়।
“ শোন, তাড়াতাড়ি ফিরতে হবে। অরা গতকাল চকলেট খেতে চেয়েছিল—সেগুলো কিনে নিয়ে যেতে হবে। তুই যাবি?”
মেহরাব হাত নাড়িয়ে বলে,
“না রে। আর শোন, তোর বজ্জাত বোনটাকে কিছু বলিস না। আরেকটু সোজা হোক…”
দু’জনেই হঠাৎ একসাথে হেসে উঠল। অফিস কেবিনের পরিবেশ মুহূর্তেই হালকা হয়ে গেল।
চায়ের গন্ধ, আলো, আর বন্ধুত্ব—সব মিলিয়ে সেই সন্ধ্যা হয়ে উঠল একটু বেশি রঙিন।
রুমে পায়চারি করছে অরা। কিছুক্ষণ পরপর দেয়ালঘড়ি দেখে সময় হিসেব করছে। পরনে তার হালকা আকাশি রঙের শাড়ি, খোঁপা করা চুল, চোখে কাজল। রাত দশটা পেরিয়ে গেছে। আরিশ এখনও ফেরেনি। সকালে পইপই করে বলেছিল আজ তাড়াতাড়ি বাসায় ফিরতে। অথচ এখনও তার কোনো পাত্তা নেই! ভাবনার ছেদ ঘটলো আরিশের আগমনে। দরজা পেরিয়ে রুমে প্রবেশ করতেই অরাকে এমন পায়চারি করতে দেখে ভ্রু কুঁচকে ফেলল সে।
“ এসব কী করছো, পাখি!”
“ পায়চারি… “
ভ্রু নাচিয়ে মিটিমিটি হেসে বলল আরিশ,
“ পায়চারি না করে এদিকে এসো। “
অরা আরিশের দিকে ভালো করে তাকাল। নাহ… তার হাতে কোনো ব্যাগপত্র নেই। তারমানে ভদ্রলোক চকলেট আনেনি। খুব মন খারাপ লাগছে অরার। আরিশ তো ভুলবার পাত্র নয়! তবে?
“ সেসব পরে, আপনি কি কিছু এনেছেন? “
“ কী আনবো?”
আরিশের এমন প্রশ্নে অরার ভাবনা আরও গভীর হলো। মন খারাপের সাথে রাগও হলো তার। আরিশকে কিছু বোঝার সুযোগ না দিয়ে হনহনিয়ে ওয়াশরুমের দিকে চলে গেলো সে। আরিশ মাথা চুলকে মুচকি মুচকি হাসছে। ওয়াশরুমের দিকে এগিয়ে গিয়ে দাঁড়াল সে। অরা ভেতরে ঢুকে দরজা আঁটকে দিয়েছে।
“ ওপেন দ্য ডোর, হামিংবার্ড।”
“ নাহ, খুলবো না দরজা। আমি আপনার সাথে রাগ করেছি। “
“ রাগ করেছো, ভালো কথা। কিন্তু তাই বলে ওয়াশরুমে ঢুকে দরজা আঁটকে দাঁড়িয়ে থাকবে! “
আরিশের কথায় যেন সম্বিৎ ফিরে এলো অরার। রাগের বশে ওয়াশরুমে ঢুকে দাঁড়াল কেন? নিজের কাজকর্মে বড্ড আফসোস হলো তার।
“ তাই তো, এটা তো ওয়াশরুম! এখানে কেন এলাম! “
“ তুমি বের হও।”
“ নাহ.. হোক ওয়াশরুম তবুও এখানে থাকবো। “
আরিশ জোরে হেসে ফেলল এবার। আজকাল অরার সাথে সম্পর্কটা যেনো আরো মিষ্টি মধুর হয়ে উঠেছে তার।
“ তুমি ভালো করেই জানো, আমি চাইলে দরজা ভেঙে তোমাকে বের করতে পারি। “
চমকাল অরা। ভদ্রলোক সত্যি দরজা ভেঙে ফেলবে? হ্যাঁ, এটা আরিশের পক্ষে কোনো ব্যাপার নয়। তাকে এক্ষেত্রে বিশ্বাস করা যায় না। অরা কোনো কথা না বলে আস্তে করে দরজা খুলে ফেলল। আরিশ মুচকি হেসে ওয়াশরুমের ভেতর ঢুকেই অরার হাত দু’টো পেছন দিকে চেপে ধরল। অরা চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। আরিশের এসব আচরণের সাথে পরিচিত সে।
“ আমার দিকে তাকাও, হামিংবার্ড। “
অরা একবার চাইলো কিছু বলবে, তবে কিছু না বলেই আরিশের দিকে তাকাল সে।
“ কী?”
“ এতগুলো দিন একসাথে থেকে নিজের বরকে একটুও চিনতে পারলে না তুমি। “
“ মানে?”
“ রুম থেকে বেরিয়ে দেখো, ড্রইং রুমে ডেলিভারি বয়রা চকলেটের বক্স নিয়ে এদিকে আসছে। অনেকগুলো বক্স, নিয়ে আসতে সময় লাগছে। “
অরা কী বলবে বুঝতে পারছে না। সত্যি তো, অরা না চাইতেও যে পুরুষ সবকিছু তার সামনে এনে হাজির করে – সেই অরা কিছু মুখ ফুটে চেয়েছে আর আরিশ তা ভুলে যাবে এমনটা কি হতে পারে কখনো?
“ আমি ভাবলাম….. “
“ দুনিয়ার সবকিছু নিয়ে ভাবা বন্ধ করে, শুধু আমাকে নিয়ে একটু ভাবতে পারো পাখি? “
“ আমি চকলেট, খাবো। “
ফিক করে হেসে বলল অরা। আরিশও হাসল। আঁড়চোখে একবার বাথটাবের দিকে তাকাল। পরক্ষণেই অরাকে সেদিকে ইশারা করে বলল,
“ যখন ওয়াশরুমে এসেই পড়েছ গোসল সেরে যাও, হামিংবার্ড। “
আরিশের কথার মানে বুঝতে অসুবিধা হয়নি অরার। সে কোনোমতে আরিশের থেকে সরে ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে গেলো। আরিশ চেঁচিয়ে বলল,
“ দূর থেকে দেখো, ডেলিভারি বয়দের কাছে যাওয়ার দরকার নেই……. “
“ ঠিক আছে…. “
অরার কণ্ঠস্বর শুনে স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়ল আরিশ। ধীরপায়ে বাথটাবের দিকে এগোল সে।
চলবে,
#হামিংবার্ড
#তাসমিয়া_তাসনিন_প্রিয়া
#পর্ব_৬২
অরা ওয়াশরুম থেকে বেরিয়েই দৌড়ে চলে গেল বসার ঘরের দিকে। বেগুনি রঙের শাড়ির আঁচল দুলে উঠলো পেছনে, খোলা চুল উড়ল মুখের দুই পাশে। পা দুটো যেন মাটিতে টেকেই না, একরকম ভেসে ভেসে চলে গেল সে ড্রইং রুমে। চকলেট তার সবচেয়ে প্রিয় খাবার।
ড্রইং রুমে পৌঁছাতেই চোখ ছানাবড়া করে থমকে দাঁড়াল অরা। ঘরের মাঝখানে তিনজন ডেলিভারি বয়, একটার পর একটা চকোলেটের বক্স নামাচ্ছে। সোফার একপাশে, টেবিলের ওপর, এমনকি নিচে পর্যন্ত জায়গা নেই প্রায়। বক্সের গায়ে রঙিন ফিতা বাঁধা, কোনোটা গোলাপি, কোনোটা নীল। কোথাও লেখা – For Hummingbird.
অরা হাঁ করে তাকিয়ে আছে। বুকের ভেতরটা হঠাৎ কেমন যেন মোচড় দিয়ে উঠল। একটা চকলেট চেয়েছিল সে শুধু। আরিশ জানে, অরা হাজারটা কখনোই চাইবে না, বললেও হয়তো খাবে না। তাই বলেনি কিছু, সারপ্রাইজ দিয়েছে। কিন্তু অরার একটুকু চাওয়া যেন আরিশের কাছে ছিল একটা মহাকাব্য।
আরিশ ঠিক এমনই—অরার চাওয়া কখনও ছোটো হয়ে যায় না তার কাছে। সে জানে, বাচ্চা নষ্ট হওয়ার পর থেকে অরা যতই মুখে রাগারাগি করুক হয়ে, তার ভেতরে একটা কোমল পাখি বসে থাকে। সেই পাখিটার জন্য একটুখানি আনন্দ মানে আরিশের কাছে শতগুণ বেশি আনন্দ দেওয়া।
অরা ধীরে ধীরে এগিয়ে গেল টেবিলের কাছে। একটা বক্স তুলে নিল হাতে। খুলে দেখল ভেতরে হ্যান্ডমেড চকলেট, তার প্রিয় কফি ফ্লেভারের গন্ধ উঠে এল। হঠাৎ খেয়াল হলো অরার, আরিশ তাকে ডেলিভারি বয়দের কাছাকাছি যেতে মানা করেছিল। অরা ধীরপায়ে হাতের চকলেট বক্সটা রেখে সিঁড়িতে গিয়ে দাঁড়াল। সেখান থেকেই সবকিছু দেখছে। এরমধ্যে আরিশ বেরিয়ে এলো ঘর থেকে। অরাকে ওভাবে সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে সবকিছু পর্যবেক্ষণ করতে দেখে মুচকি হাসল। যাক আগের অরাকে খুঁজে পাচ্ছে সে। পেছন থেকে হেঁটে এসে আরিশ বলল,
” চলো, চকলেট দেখবে। ”
অরা মুচকি হাসল। আরিশ তার হাত ধরে সামনে এগিয়ে যেতে লাগলো। যে মানুষটার মনে অরার জন্য এতটা ভালোবাসা তার একটু-আধটু পাগলামি সহ্য করা যায় বলেই আজ অরা বাধ্য মেয়ের মতো সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে ছিলো।
আরিশ অরাকে নিয়ে এগিয়ে এসে এক ঝলক চোখ বুলিয়ে নিল পুরো ঘরে ছড়িয়ে থাকা চকলেটের বক্সগুলোর দিকে। তারপর ঠোঁটে একটা প্রশান্ত হাসি নিয়ে ডেলিভারি বয়দের দিকে তাকিয়ে বলল,
“টেবিলের ওপর রাখুন, আর যেগুলো জায়গা পাচ্ছেন না সেগুলো সোফার সামনে মেঝেতে সাজিয়ে দিন। সাবধানে… এগুলো কিন্তু আমার স্ত্রীর জন্য।”
একটু থেমে আবার বলল,
“আরেকটা কথা—একটা বক্সও যেন উল্টে না পড়ে। ”
ডেলিভারি বয়েরা হেসে ফেলল,
“ঠিক আছে স্যার!”
আর অরা তখন দাঁড়িয়ে—চোখে অবিশ্বাস, মনে একরাশ ধরা না পড়া ভালোবাসা।
“এখনও বুঝলে না, আমি কেমন বর?”
অরা চোখ নামিয়ে হেসে ফেলল।
“আপনি বর না, আপনি একটা পাগল।”
“তোমার পাগল, এইটুকু মনে রাখলেই হবে।”
অরা কিছু বলল না। শুধু গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল আরিশের গায়ের সঙ্গে হেলান দিয়ে। চকোলেটের ঘ্রাণে মিশে থাকল ভালোবাসার অদৃশ্য সুবাস।
আরিশ অরার মুখে একটুকরো চকলেট তুলে দিলো। অরা ইশারায় বোঝালো, ঘরে গিয়ে খাবে। আরিশ কথা শুনলো না। অরার গালে চকলেট লাগিয়ে দিলো। ঠোঁটে দিতে গেলেই অরা খপ করে চকলেটটুকু খেয়ে ফেলল। এরমধ্যে ডেলিভারি ম্যানরা চলে গেছে। পুরো ড্রইং রুমে শুধু অরা, আরিশ আর চকলেট!
” ঠোঁটে, গালে চকলেট লেগে গেছে। মুছে দিন….”
অরার কথার মানে বুঝতে পারলোনা আরিশ। কারণ অরা নিজেই তো মুছে নিতে পারতো, আরিশকে বলল কেন? অরা মিটিমিটি হাসছে। আরিশের ঠোঁটের কোণেও হাসি ফুটল।
” বড্ড দুষ্ট হয়ে গেছো, হামিংবার্ড। বাট আমার থেকে বেশি না!”
অরা কিছু না বলেই ধীরে মুখটা এগিয়ে দিলো আরিশের দিকে। তার ঠোঁটে লেগে থাকা হালকা চকলেটের ছোপ চোখে পড়তেই আরিশ নিঃশব্দে সামান্য ঝুঁকে এলো। আরিশ ধীরে, খুবই ধীরে, তার মুখ নামিয়ে আনলো অরার ঠোঁটের কাছে। কোনো শব্দ হয়নি, কেবল নিঃশ্বাসে হালকা কাঁপুনি ছিল। সে এমনভাবে সেই মিষ্টি চিহ্নটুকু সরিয়ে দিলো, যেন তার স্পর্শের বদলে অনুভবটাই বলছিল সব কথা। ঠোঁট ছুঁয়ে যায়নি পুরোটাই, কিন্তু অরার হৃদয়টা ধুকধুক করে উঠলো, তাকে ছুঁয়ে যাওয়া এই মুহূর্তের গোপন ইশারায়। অরার গালটা লজ্জায় লাল হয়ে উঠলো, কিন্তু সে চোখ সরালো না। ভালোবাসা কখনও কখনও শব্দের চেয়ে স্পর্শহীন ইঙ্গিতেই বেশি বলে ফেলে সব।
কিয়ৎক্ষণ বাদে অরা ইশারায় বোঝালো– ‘গালেও চকলেট লেগে আছে, একইভাবে সেগুলোও…. ’
আরিশ তার কানের পাশে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বলল,
” তুমি হয়তো ভুলে গেছো, ছোট্ট পাখি– তোমার বর কতটা রোমান্টিক। এসব বিষয় আমাকে কিছু বলার দরকার পড়বে না তোমার। ”
” মোটেও না, জনাব খান। ”
অরার দুষ্টমিগুলো ভীষণ উপভোগ করছে আরিশ।
ডেলিভারি বয়রা চকলেটের বক্স সাজিয়ে বেরিয়ে যেতে না যেতেই ড্রইংরুমের দিকে এল তালহা। ওর হাতে একটা কাপ ছিল, সম্ভবত চা খেতে নিচে নেমেছিল। ঘরে ঢুকে চকলেটের পাহাড় দেখে থমকে গেল সে। আরিশ তখন অরার গালের চকলেটগুলো সরাতেই যাচ্ছিল, আচমকা তালহার আগমনে অপ্রস্তুত হয়ে গেলো তারা। তালহা অবশ্য কিছু বুঝতে না পারার ভান করে বলল,
“আরে এত চকলেট! এখানে কি বিয়ের গিফট-প্যাকিং হচ্ছে নাকি?”
একটু থেমে গলা চড়িয়ে উঠল তালহা,
“ ভাইয়া, এতগুলো চকলেট কি শুধু ভাবি মায়ের জন্য?
আরিশ হেসে বলল,
” অরা যদি তোমাদেরকেও দেয় তাহলে ভাগ পেতে পারো। ”
অরাও মিটিমিটি হাসছে। আরিশ যে মজাও করতে পারে তা আজ প্রথম দেখলো সে।
পেছন থেকে সাবিহা এল সালোয়ার-কামিজ পরনে, ঘুমঘুম চোখে। তার চোখ চকলেটের দিকে যেতেই কপালে হাত রেখে বলল,
“ওয়াও! বউকে খুশি করতে গিয়ে একেবারে চকোলেট কোম্পানির সাপ্লাই কিনে এনেছো, ভাইয়া!”
তামান্না আসতেই চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকল কিছুক্ষণ। মুখে হালকা ঈর্ষার ছাপ, চোখে মুগ্ধতা। তারপর হেসে বলল,
“এই বাড়িতে বউ হলে চকলেটের খেত জুটবে বুঝি?”
সাবিহা ফিসফিস করে বলল,
“তুমি তো তালহা ভাইয়ার বউ হচ্ছো। ও তো তোমাকে বললেই বলে—‘মিষ্টি জাতীয় খাবার কম খাও, মোটা হবে।’ চকলেট কি আর দেবে!”
তালহা ভুরু কুঁচকে বলল,
“আরে তুই চুপ কর তো সাবিহা!”
আরিশ তখন দরজার পাশে দাঁড়িয়ে, অরার মুখে আরেক টুকরো চকলেট পুরে দিয়ে, একটু খোশ মেজাজে দাঁত বের করে বলল,
“বুঝলে না তো, অরা আমার হামিংবার্ড। ও একটা চাইলে, আমি হাজারটা দেবো—এইটাই তো প্রেমের ইনভেস্টমেন্ট। ”
সাবিহা হেসে ফেলল,
“এত ইনভেস্ট করে লাভ কী?”
আরিশ কপট গম্ভীর গলায় বলল,
“হুম, লাভ একটাই– অরা আমার দিকে তাকালে, আমি বেঁচে থাকার কারণ খুঁজে পাই।”
ঘরজুড়ে হেসে উঠল সবাই। অরা তখন চুপচাপ দাঁড়িয়ে, মুখ নামিয়ে রাখলেও মনে মনে ভাবছে– এই মানুষটা আমাকে যতটা ভালোবাসে, আমি কি সত্যিই তাকে বুঝে উঠেছি?
সবাই যখন চকলেট নিয়ে হাসি-ঠাট্টায় ব্যস্ত, তখন চুপচাপ সরে গেল তামান্না। কারও চোখে না পড়েই সিঁড়ি বেয়ে ছাদে উঠে গেল সে। চারপাশে নরম বাতাস, আকাশে হালকা মেঘ। তবু তামান্নার বুকের ভেতরটা ভারী লাগছে।
ও চায়নি ঈর্ষা করতে। তবু পারল না নিজেকে সামলাতে।
আরিশ যেভাবে অরার দিকে তাকায়… যেভাবে একটা কথার ভেতরে হাজারটা অনুভব ভরে দেয়—তামান্না মনে মনে জানে, তালহার চোখে সে সেই উন্মাদনা কখনও দেখেনি। তালহা ভালো, স্থির, দায়িত্ববান। কিন্তু এমন পাগলামি তার মধ্যে নেই। টাকাপয়সা, দামী উপহার নয় তবে সব মেয়েই চায় আরিশের মতো একটা পাগলাটে পুরুষ জুটুক তার কপালে। যে পুরুষ বরাবর তার জন্য পাগলামি করবে, আর অনেক ভালোবাসবে।
সিঁড়ির নিচ থেকে তালহার গলা ভেসে এল,
“তামান্না?”
সে চুপ। বাতাসে চুল উড়ে পড়ছে মুখে, তাও সরাল না। তালহা ধীরে ধীরে উঠে এসে ছাদের এক কোণে ওকে দাঁড়িয়ে দেখল। গলায় একরাশ মায়া নিয়ে বলল,
“তুমি এমন চুপচাপ চলে এলে কেন, তামু?”
তামান্না চোখ ফেরাল না। কেবল বলল,
“আমি শুধু দেখছিলাম, কেউ কাউকে কতটা ভালোবাসতে পারে।”
তালহা একটু থমকে গেল। বুঝে ফেলল, তামান্না কী বলতে চাইছে।
“তুমি কি ভেবেছো, আমি তোমার জন্য এমন কিছু করব না?”
তার কণ্ঠে কোনো রাগ নেই, আছে কেবল নরম জিজ্ঞাসা।
তামান্না এবার তাকাল। চোখে একটুখানি জল জমে উঠেছে।
“ বিয়ে ঠিক হওয়ার আগে মাঝে মধ্যে ফুলের মালা, গাজরা নিয়ে আসতে কিন্তু এখন?”
তালহা এবার একধরনের অনুতাপে ভিজে গেল। ধীরে ধীরে ওর কাছে এগিয়ে এল।
“ সরি, তামান্না ভাটিয়া। ইদানীং কাজের চাপে সব ভুলে যাই। শোনো, সবাই তো একরকম হয় না, বলো? আমি এত পরিশ্রম করছি কার জন্য? আমাদের ভবিষ্যতের কথা ভেবেই তো, নাকি? ”
তামান্না ঠোঁট কামড়ে নিচে তাকাল। তালহা হাত বাড়িয়ে ওর হাত ধরল। ফের বলল,
” তারপরও আম সরি। তোমার দিকে বেখেয়ালি হয়ে যাওয়ার কারণে। আজকের পর থেকে আর কখনোই এমন ভুল হবে না, প্রমিস!”
তালহা দু’হাতে নিজের কান ধরে বলল, এবার। তামান্না আর অভিমান পুষে রাখতে পারলোনা, হেসে ফেলল।
” থাক! আর কান ধরতে হবে না। এরপর থেকে যেনো কথাগুলো মনে থাকে। ”
তালহা খুশিতে তামান্নাকে আলতো করে বুকে জড়িয়ে ধরল। লজ্জায় লজ্জাবতী পাতার মতো নুইয়ে গেলো সে।
“ একশোবার মনে থাকবে। এখন চলো, নিচে যাই। শোনো,তোমাকে চকলেট কিনে দেবো না, চকলেট ফ্যাক্টরি কিনে দেবো। খুশি?”
“ আমি ভাবির মতো চকলেট পাগল নই, তালহা ভাইইইইই! আমার ফুল চাই, সাথে কাঁচের রেশমি চুড়ি। “
তামান্নাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে, চিবুকে হাত রেখে তাকাল তালহা। ঠোঁটের কোণে তার দুষ্ট হাসির রেখা। তামান্না ভ্রু উঁচিয়ে শুধালো,
“ কী হলো?”
“ এখন, হবে… “
তালহা খুব ধীরে তামান্নার ঠোঁটের দিকে এগোতে লাগলো। তালহার মতিগতি বুঝতে অসুবিধা হলো না তামান্নার। লজ্জায়, অস্বস্তিতে একপ্রকার লাফালাফি জুড়ে বসল সে।
“ খবরদার! এটা করবে না, তুমি। “
“ এটাই করবো, মিস তামান্না ভাটিয়া। আরও ডাকো, ভাইয়া!”
“ না, না,না! আর কখনো ভাইয়া বলে ডাকবো না। “
“ শিওর? “
“ হ্যাঁ, হ্যাঁ। “
তালহা হাসতে হাসতে তামান্নাকে ছেড়ে দিলো। তামান্না যেন হাঁপ ছেড়ে বাঁচল।
রাতের খাওয়াদাওয়া শেষে যে যার রুমে চলে গিয়েছে। তবে আরিশ আজ অরাকে নিয়ে ছাঁদে যাবে বলে ঠিক করেছে। ভদ্রলোক প্রায়শই খেয়াল করেছে, তালহা তামান্নার সাথে ছাদে সময় কাটায়। হয়তো অরারও ভালো লাগবে বলেই সেই প্রয়াস।
“ আজ হঠাৎ ছাদে যাবেন, বললেন? “
হাতে হাত রেখে সিঁড়ি বেয়ে উঠছে দু’জন। আরিশের পরনে কালো রঙের টি-শার্ট আর সাথে ট্রাউজার, অরা বেগুনি রঙের শাড়ি পরে আছে, চুলগুলো খোঁপা করা।
“ এমনি!”
“ আচ্ছা, বুঝলাম। “
মুচকি হাসল আরিশ। অরার হাত ধরে ধীরে ধীরে ছাদে উঠলো সে। ছাদে তখন হালকা বাতাস বইছে, চারদিকে নরম আলো ছড়াচ্ছে বৈদ্যুতিক বাতিগুলো। দূরের আকাশটা ছিল নীলচে কালো, জোছনা দেখা যায় না ঠিক, কিন্তু অসংখ্য তারা যেন ঝিকিমিকি করছে নীরব আনন্দে।
ছাদে পা রাখতেই চোখে পড়লো—তালহা গিটার হাতে দাঁড়িয়ে, যেন ঠিক তখনই গান শুরু করবে। তার সামনে তামান্না বসে আছে চুপচাপ, চোখেমুখে প্রশান্তির ছায়া।
আরিশ আর অরাকে দেখে তামান্না আনন্দে চমকে উঠলো। সঙ্গে সঙ্গে দাঁড়িয়ে পড়ল, ঠোঁটে হাসি।
“ ভাবি! আপনারা ছাদে এসেছেন! “
“ হ্যাঁ এলাম। তোমাদের ভাইয়া নিয়ে এলো। “
কথাটা বেশ গর্ব করে বলল অরা। আরিশ অরার ভালোলাগার কারণ বুঝতে পারছে। তালহার থেকে গিটারটা নিজের হাতে নিয়ে বলল সে,
“ কতো বছর গিটার ধরিনি! “
তালহার চোখ ছলছল করছে। ছোটো থেকে আরিশকে কখনো এভাবে স্বাভাবিক দেখেনি সে। অরাও অবাক হচ্ছে, আরিশের গিটার বাজানোর চেষ্টা দেখে।
“ তুমি চেষ্টা করলেই বাজাতে পারবে ভাইয়া। “
মুচকি হাসল আরিশ। কয়েকবার চেষ্টা করতেই সুর এলো তাতে। অরার ভীষণ আনন্দ লাগছে। মনে হচ্ছে পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মানুষ হলো, সে।
“ এই গানটা, তোমার জন্য – আমার হামিংবার্ড!”
অরার মুখ থেকে কোনো কথা বের হলোনা আর। তিনজনই আরিশের গান শোনার জন্য চুপ করে রইলো। সবার বুকের ভেতর কেমন ডিপ ডিপ করছে। আরিশ গান শুরু করলো, তার দৃষ্টিতে কেবল অরা।
❝ যখন ও রূপ স্মরণ হয়
থাকে না লোকলজ্জার ভয়
যখন ও রূপ স্মরণ হয়
থাকে না লোকলজ্জার ভয়
লালন ফকির ভেবে বলে সদাই
লালন ফকির ভেবে বলে সদাই
প্রেম যে করে সে জানে
ঐ প্রেম যে করে সে জানে
আমার মনের মানুষের সনে
আমার মনের মানুষের সনে। ❞
গান শেষে অরা নিঃশব্দে এসে জড়িয়ে ধরল আরিশকে। তালহা, তামান্না হাত তালি দিতে শুরু করেছে। আরিশ অরার আচরণে এতটা খুশি হয়েছে যে তার চোখ ছলছল করছে।
“ খুব সুন্দর হয়েছে, রাগী ভূত। “
“ থ্যাংক ইউ, ডার্লিং। এবার তালহা শুরু কর, আমরা শুনি। “
তালহা বলল,
“ হ্যাঁ অবশ্যই। “
আরিশের থেকে গিটারটা নিলো সে। সবাই এবার তালহার গানের অপেক্ষায়। গান শুরু হলো। এভাবেই সেই রাতে চারজনের মধ্যে একটা সুন্দর সময় কাটতে লাগলো।
নয়নার দিনগুলো এখন আর ক্যালেন্ডারে জমে থাকা সংখ্যার মতো নয়। প্রতিটা দিন যেন একেকটা অনুপস্থিত চিঠি। পলাশের অভাবে নয়নার জীবনটা নিঃশব্দের অভ্যাস হয়ে গেছে।
ভোরবেলায় ঘুম ভাঙে, কিন্তু ঘুম ভাঙার কোনো কারণ থাকে না। জানালার বাইরে পাখিরা ডাক দেয়, কিন্তু সেই ডাকগুলো তাকে আর জাগায় না। আগের মতো আর চুল বেঁধে আয়নায় দাঁড়িয়ে মুখ দেখে না সে।
পলাশও কি একইভাবে মনে করে তাকে? ও জানে না। তবে এটুকু জানে—প্রতিদিন সে একটা মানুষকে মিস করে, যার সাথে কখনো ভালোবাসার কথা বলা হয়নি। কিশোরী মন সবকিছু নিয়ে খুব ভাবে। জীবনের প্রথম ভালোবাসার অনুভূতিকে সামলাতে বড্ড হিমসিম খাচ্ছে সে।
আজকাল বিকেল হলেই নয়না ছাদে ওঠে। একা বসে থাকে সেখানে। মোবাইল হাতে নিয়ে হাজারবার সেই পুরনো নামটা সার্চ করে—”পলাশ।” তবে পলাশের আইডি এক্টিভ নেই। দীর্ঘদিন কোনো পোস্ট নেই আইডিতে। পলাশের কী হয়েছে ভেবে কখনো চোখে জল আসে আবার কখনো আসে না, কিন্তু বুকটা জলে ভিজে যায়।
কেউ দেখে না, কেউ বোঝে না—এই মেয়েটা কেমন করে একটানা এক মানুষকে ভালোবেসে গেছে, শুধু অপেক্ষার বিনিময়ে।
বন্ধুরা জিজ্ঞেস করে—“নয়না, তুই এখনো পলাশ ভাইকে ভুলিসনি?”
সে হেসে বলে,
“ভুলে যাওয়ার জন্য তো কাউকে আগে সম্পূর্ণভাবে পাওয়া লাগে।”
রাতে নয়না যখন ঘুমাতে যায়, মাথার পাশে পলাশের দেওয়া সেই চিঠি রাখে। ভাঁজে ভাঁজে সে চিঠির কালি ফ্যাকাশে হয়ে যেতে শুরু করেছে। তবু সে পড়ে, প্রতিদিন, পলাশের লেখা সেই কথাগুলো।
চলবে……