হামিংবার্ড পর্ব-৬৩+৬৪

0
9

#হামিংবার্ড
#তাসমিয়া_তাসনিন_প্রিয়া
#পর্ব_৬৩

রৌদ্রময় একটা সকাল। ঢাকার আকাশ ঝকঝকে নীল। রোদের আলো ফুটপাতে পড়ে ঠিক যেন কাঁচের মতো ঝিলমিল করছে।

আরিশ গাড়ির দরজা খুলে দাঁড়িয়ে আছে। পরনে কালো পাঞ্জাবি, সানগ্লাস চোখে। অরার আবদারেই পাঞ্জাবি পরেছে। অরা ধীরে পা ফেলে গাড়ি থেকে বাইরে বেরোল। পরনে অফ-হোয়াইট শাড়ি আর গোলাপি স্লিভলেস ব্লাউজ, চুলগুলো খোলা, সাথে হালকা গয়নাগাটি।

গাড়ি থেকে নামার সঙ্গে সঙ্গেই আশপাশের কয়েকজন পথচারী তাকিয়ে রইল অরার দিকে।

কারও চোখে অবাক হয়ে তাকানো, কেউ যেন চেনা চেনা মুখ ভেবে চেয়ে থাকল, কেউ নিছক সৌন্দর্যের প্রশংসা করল।

আর এইসব কিছুই আরিশের চোখ এড়াল না।

প্রথমে চুপ করে রইল। তারপর একটা লোক একটু বেশি সময় ধরে তাকাতেই, আরিশ পাঞ্জাবির হাতা গুটিয়ে একধরনের ঠান্ডা রাগে সামনে গিয়ে বলল,

“ভাই, সামনে তাকান। মানুষ দেখার জায়গা এটা না। পথ।”

লোকটা কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে সরে গেল। অরা পাশে এসে বলল,

“আপনি কি পাগল?”

“আমি না, ওরা পাগল। আমার বউকে এভাবে কেউ দেখবে,আমি দাঁড়িয়ে দেখব?”

” তাহলে কী করবেন? এভাবে সবাইকে বলবেন? ”

” দরকার হলে, বলবো। ”

“আরিশ, আপনি এখন রাস্তায় ঝগড়া করবেন!”

“হ্যাঁ করব। কারণ আমি জেলে যেতে রাজি আছি, কিন্তু তোমাকে কেউ কল্পনায়ও না ছুঁয়ে যায় এটাও সহ্য করতে পারি না।”

অরা অবাক হয়ে বলল,

” আপনি কি খু ন করার কথা ভাবছেন? ”

” তোমার জন্য সবকিছু মঞ্জুর। ”

অরা ঠিক কী বলবে বুঝতে পারছে না। মাঝে মধ্যে মনে হয়, মানুষটা কেন আর পাঁচটা স্বাভাবিক পুরুষের মতো নয়? কেন এতো পাগলাটে সে? দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল অরা। আরিশকে যেহেতু বদলানো যাবে না তাই মানিয়ে নেওয়া ছাড়া কিছু করারও নেই।

“আচ্ছা, এখন এক কাপ কফি খাবো। কিন্তু আশেপাশে তো দোকান দেখছি না! সকাল তো দশটা ছুঁইছুঁই, এখনো কি দোকান খোলেনি? ”

আরিশ মুখে চাপা হাসি নিয়ে বলল,

“দোকান বন্ধ থাকলেও তালা ভেঙে ভেতরে চলে যাবো। তোমার কফি খাওয়া মিস হবে না, ডার্লিং। ”

অরা হতবিহ্বল হয়ে তাকিয়ে রইলো। দু’জনে হাত ধরে সামনের দিকে হাঁটতে লাগলো। দূরে একটা কফিশপ দেখা যাচ্ছে। অরা আরিশকে বোঝানোর চেষ্টা করতে শুরু করলো।

” আচ্ছা আপনি একটু শান্ত থাকতে পারেন, না? ”

আরিশ একটু থেমে বলল,

“ তোমাকে কেউ কল্পনাতেও দেখে এটা ভাবলেই মাথা গরম হয়ে যায়।”

“তাহলে আজকে আমি চোখে কালো চশমা পরে হাঁটব। তাহলে চোখে কিছু দেখবোও না। আর তো আপনি মানুষ পেটাতে চলে যাবেন!”

“চশমার দরকার নেই। আজকের পর থেকে স্লিভলেস কোনো পোশাক পরবে না তুমি। আর সবসময় ওড়না পরবে।”

” বাসায়ও?”

” হ্যাঁ। শুধু রুমে বসে যা খুশি পরো। আর কিছু না পরলে আরো ভালো। ”

আরিশ মুচকি হেসে বলল। অরা তার কাঁধে মৃদু ঘুষি মেরে বলল,

” আপনি একটা খাটাশ। ”

” খাটাশের বউ, মাটাশ। ”

অরা শব্দ করে হেসে উঠলো।

” মাটাশ আবার কী?”

” আমি জানি না। ”

” পাগল একটা! ”

আরিশ কিছু বলল না। দু’জনে হেঁটে চলে গেল কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে। অরা মাঝে মাঝে তাকায় আরিশের দিকে—ওর ঠোঁটের কোণে এখনও হাসি লেপ্টে আছে।

শুক্রবার। সাপ্তাহিক ছুটির দিন। সোলাইমান মল্লিক আজ বাড়িতে আছেন। রোকসানা মল্লিক রান্নাঘরে, দুপুরের রান্নাবান্না করছেন। ছুটির দিন, সেই উপলক্ষে গরুর মাংসের খিচুড়ি রান্না হচ্ছে। নয়নার প্রিয় খাবার এটা।

বসার ঘরে সোফায় বসে আছেন সোলাইমান। গতকাল তার বড়ো ভাই আজমাইনের সাথে ফোনে কথা হয়েছিল। আগামী সপ্তাহে উর্মির বিয়ে। তাই দুই দিন পরই সোলাইমানকে পরিবারসহ গ্রামের বাড়িতে পৌঁছে যেতে বলেছেন তিনি। পাত্রপক্ষ এতদিন বিয়ে পিছিয়ে রেখেছিল, তাদের বাড়ির কেউ একজন অসুস্থ ছিলো বলে। নয়তো এতদিনে উর্মির বিয়েটা হয়ে যেতো।

“ হ্যাঁ গো, অফিসে ছুটির কথা বলেছো?”

আঁচলে হাত মুছতে মুছতে রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে এলেন রোকসানা। স্ত্রী’র প্রশ্নে নড়েচড়ে বসলেন সোলাইমান।

“ না, বলা হয়নি। আগামীকাল বলবো। তবে হঠাৎ ছুটি দিবেন কি-না, জানি না। “

“ আমি একবার অরাকে কল দিয়ে বলবো?”

“ আরে না। অফিসের বাইরে আরিশের সাথে আমার যা-ই সম্পর্ক থাকুক, অফিসে ও আমার বস। তাই ছুটির কথাও অফিশিয়ালি বলবো। “

“ সে ঠিক আছে। কিন্তু গ্রামের কথা, উর্মির বিয়েতে যাওয়ার কথা – সেসব তো বলতে হবে অরাকে। আরিশ যাবে কি-না সেটাই সন্দেহ। “

দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন রোকসানা। এরমধ্যে নয়না এলো সেখানে।

“ কোথায় যাওয়ার কথা বলছো, তোমরা?”

সোলাইমান মেয়েকে নিজের পাশে বসার জন্য ইশারা করলেন। নয়না গিয়ে তার বাবার পাশে বসলো।

“ তোর উর্মি আপুর বিয়ে আগামী সপ্তাহে। “

“ বাহ! সেজন্যই ভাইয়ার যাওয়ার কথা বলছিলে! আপু বললে ভাইয়া হয়তো, না করবে না। “

সোলাইমানও রোকসানাকে উদ্দেশ্য করে বললেন,

“ হ্যাঁ রোকসানা। তুমি এতো ভেবো না। খিচুড়ি রান্না হয়েছে? আমরা বাপবেটি বসে আছি তো। “

মুচকি হাসলেন তিনি। রোকসানা হাসিমুখে রান্নাঘরের দিকে এগোতে এগোতে বললেন,

“ ডাইনিং টেবিলে এসো, খাবার দিচ্ছি। “

সোলাইমান ও নয়না দু’জনেই চটপট ডাইনিং রুমের দিকে পা বাড়াল।

বেলা সাড়ে এগারোটা। আরিশের অফিসে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কাচঘেরা কেবিন। ডেস্কে বসে ল্যাপটপে কাজ করছিল আরিশ। হঠাৎ দরজায় টোকা।

“কাম ইন।”

দরজাটা খুলে সোলাইমান মল্লিক ভেতরে ঢুকলেন। পরিপাটি পোশাক, চোখেমুখে বিনয়ের ছাপ। আরিশ চেয়ার থেকে সোজা হয়ে বসল।

সামনে রাখা চেয়ারটার দিকে তাকিয়ে বলল—

“প্লিজ, বসুন।”

সোলাইমান বসে হালকা কাশলেন।

“স্যার, একটা দরখাস্ত ছিল আপনার কাছে।”

আরিশ মাথা নাড়ল।

“বলুন।”

সোলাইমান পকেট থেকে মোড়ানো একটা কাগজ বের করলেন।

“পারিবারিক কারণে পাঁচ দিনের ছুটি প্রয়োজন ছিল। আগামী বৃহস্পতিবার ও শুক্রবার। গ্রামের বাড়িতে একটু জরুরি যাওয়া দরকার।”

আরিশ কাগজটা হাতে নিয়ে চুপচাপ পড়ে দেখল।

“ঠিক আছে, মঞ্জুর করলাম। ফর্মালিটি শেষে এই কাগজটা এইচ.আর. সেকশনে দিয়ে দেবেন।”

সোলাইমান মাথা হেঁট করে বললেন,

“ধন্যবাদ, স্যার।”

একটু থেমে আরিশ বলল,

“আপনি নিয়মিত, সময়মতো, নিরবিচারে কাজ করেন—এমন কর্মীর ছুটি নিয়ে কখনো ভাবতে হয় না।”

সোলাইমান সংক্ষিপ্ত হাসি দিয়ে মাথা ঝাঁকালেন।

আর কিছু না বলে দাঁড়িয়ে পড়লেন।

আরিশও বসে বসে এক মুহূর্ত তাকিয়ে রইল। কিছু বলল না। হঠাৎ শ্বশুর মশাই গ্রামের বাড়িতে কেন যাবেন সেটাই ভাবছে সে।

সোলাইমান মল্লিক কেবিন থেকে বেরিয়ে গেলে আরিশ ধীরে চেয়ার হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করল।

“ সাবিহা আপা, আপনার কী হয়েছে? ক’দিন ধরেই দেখছি, কেমন মনমরা হয়ে থাকেন। “

সাবিহার ঘরে কী একটা দরকারে এসেছিল তামান্না। সাবিহার মলিন মুখ দেখে উপরোক্ত কথাটি বলল সে। সাবিহা আধশোয়া অবস্থায় ছিলো এতক্ষণ। ধীরে ধীরে উঠে বসলো সে।

“ তেমন কিছু না, গো। “

“ সত্যি, তো?”

দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল সাবিহা। মেহরাব যে তার সাথে এভাবে সবকিছু শেষ করে দেবে দুঃস্বপ্নেও ভাবেনি সে। সেদিনের পর থেকে আর যোগাযোগ হয়নি তাদের। মাঝখানে কেটে গেছে বারোটা দিন।

“ মেহরাব…. “

সাবিহা থেমে যায়। আচমকাই শব্দ করে কাঁদতে শুরু করে। আকস্মিক ঘটনায় তামান্না হতবিহ্বল হয়ে তাকিয়ে আছে শুধু। কী হলো বিষয়টা বুঝতে কিয়ৎক্ষণ সময় লাগলো তার। তারপর সাবিহার পাশে বসলো তামান্না।

“ আপা! কান্না করছেন কেন? কী হয়েছে মেহরাব ভাইয়ের? ঝগড়া হয়েছে, আপনাদের? “

সাবিহা কোনোমতে কান্না থামিয়ে বলে,

“ ঝগড়া করলেও তো হতো। কোনো যোগাযোগ রাখেনি। দুইদিন অফিসে গিয়েও তার সাথে দেখা করতে পারিনি। “

“ বাড়িতে গিয়েছিলেন?”

“ কোন অধিকারে যাবো, ভাবি? সে তো আমাকে কিছু বলেনি। আমিই একটু বেশি এগিয়েছিলাম। “

তামান্নাকে এখন, ভাবি বলেই সম্মোধন করে সাবিহা। মেয়েটার এমন কষ্ট সহ্য হচ্ছে না তামান্নার। সাবিহা একটু থেমে আবার বলে,

“ আমাকে কেউ ভালোবাসে না কেন? আমি কি কারোরই ভালোবাসার যোগ্য নই, ভাবি? যার কাছেই যাই, সে-ই…….. “

সাবিহা কথা বলতে পারছে না। কাঁদতে কাঁদতে হেঁচকি তুলে ফেলেছে সে। কে বলবে এই মেয়েটা একসময় অন্যের ক্ষতি চাইতো?

“ আপা শান্ত হোন। আমি অরা ভাবির সাথে কথা বলবো। উনি সরাসরি মেহরাব ভাইয়ের সাথে কথা বলবেন। তবে একটা কথা! যে মানুষগুলো আমাদের ভালোবাসে না, তাদের জন্য এভাবে কষ্ট পাওয়া উচিত নয়। কেউ আপনার অনুভূতির মূল্য দিচ্ছে না বুঝেও সেখানে অনুভূতি ইনভেস্ট করা মানে নিজেকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করা। এটা করতে নেই, আপা। “

সাবিহা কিছু বলে না। তামান্নাকে জড়িয়ে ধরে কেবল।

অন্যদিকে মাত্রই অফিস থেকে বাসায় ফিরেছিল আরিশ। দোতলার বারান্দা দিয়ে নিজের ঘরের দিকে যাওয়ার সময় আচমকা সাবিহার কান্নার শব্দে স্থির হয়ে দাঁড়িয়েছিল সে। তারপর তামান্না ও সাবিহার সব কথাই শুনেছে সে।

আয়নার সামনে বসে আছে অরা। ইদানীং মুখে বেশ পিম্পল দেখা দিচ্ছে। সেজন্য অরার মনটা একটু খারাপ। আরিশকে রুমে ঢুকতে দেখে অরা পেছন ফিরে তাকাল। ভদ্রলোকের চেহারা কেমন থমথমে লাগছে আজ। রুমে ঢুকে কোনো কথাও বলেনি। অরা বুঝতে পারছে না, আরিশের মতিগতি। ভয়ে চুপ করে বসেই রইলো অরা। আরিশ টাই আলগা করে, পরনের কোট, শার্ট খুলে বিছানায় ছুড়ে ফেলল। অরা চুপচাপ তাকিয়ে আছে কেবল। আরিশ এবার তার দিকে দৃষ্টিপাত করলো।

“ ওখানে বসে আছো কেন? কাছে এসো। “

আরিশের গম্ভীর কণ্ঠ অরাকে বেশ ভয় পাইয়ে দিলো। সে কোনো কথা না বলে দ্রুত আরিশের পাশে গিয়ে বসল। আরিশ তার কোমরে হাত রেখে, কোলে তুলে বসাল। অরা টাল সামলাতে আরিশের গলা জড়িয়ে ধরল। বিছানা থেকে ফোনটা হাতে নিয়ে মেহরাবের নম্বরে কল দিলো আরিশ। অরা চুপচাপ গলা জড়িয়ে বসে আছে।

“ হ্যালো! কী খবর দোস্ত? “

“ তোর খবর বল মেহরাব। “

মেহরাব তখন একটা জুয়েলারি শপের সামনে দাঁড়িয়ে ছিলো। সাবিহার জন্য একটা নেকলেস কিনতে এসেছিল। হাতে তার জুয়েলারিসহ, ফুল, চকলেট আর টেডিবিয়ার। সবগুলো জিনিসপত্র একহাতে নিয়ে, অন্য হাত দিয়ে বড়ো কষ্টে কল রিসিভ করে ফোনটা কানে ধরে আছে সে। সামনেই গাড়ি। সেদিকে এগোচ্ছে মেহরাব।

“ আমার আবার কী খবর? তোর গলাটা এমন লাগছে কেন? কিছু হয়েছে? “

অরা কিছুই বুঝতে পারছে না। তবে আরিশের এমন রাগী হাবভাবে তার আগের মতো ভয় লাগছে।

“ মানঅভিমান কিংবা শাস্তির একটা লিমিট আছে মেহরাব। সাবিহাকে অতিরিক্ত কষ্ট দিচ্ছিস তুই। এটা বাড়াবাড়ি হচ্ছে। “

জিনিসপত্র পেছনের সিটে রেখে, ড্রাইভিং সিটে বসলো মেহরাব।

“ বোনের কষ্ট সহ্য হচ্ছে না বলে এত রাগ? আমি বুঝি খুব সুখে আছি?”

“ আমার এসব কথা ভালো লাগে না, মেহরাব। যাকে ভালোবাসি তাকে কষ্ট দেবো কেন?”

অরা মুখ বাঁকাল, ভেংচি কাটল। তবে আরিশ তা দেখলো না।

‘ভালোবাসে যাকে তাকে কষ্ট কেন দিবে– জীবনটা তেজপাতা বানিয়ে সাধু সাজা হচ্ছে। ‘

মনে মনে কথাগুলো বলল অরা। আরিশ কথার ফাঁকে ফাঁকে অরার কপালে ঠোঁট ছুঁইয়ে দিলো কয়েকবার।

“ সরি! ভাই….. আমি পথে আছি। তোদের বাসায়ই আসছি। আর একটু সময় অপেক্ষা করতে বল, তোর বোনকে। “

“ তুই বল। শয়তান একটা। রাখছি। “

আরিশ কল কেটে ফোনটা বিছানার ওপর রাখল। অরা পুতুলের মতো কোনো নড়নচড়ন ছাড়া বসে আছে দেখে আরিশ বলল,

“ কী হয়েছে? “

“ আমি তো জানি না । “

“ তোমার কী হয়েছে, সেটা বলো। “

“ আপনি রেগে ছিলেন……”

“ ভয় পেয়েছ?”

অরা মাথা নেড়ে বলে,

“ একটু!”

আরিশ খুব যত্নসহকারে তাকে বিছানায় বসিয়ে দিয়ে নিজে বসা থেকে উঠে দাঁড়াল।

“ ফ্রেশ হয়ে আসছি, ভয় কাটিয়ে দেবো। “

আরিশের হাসির কারণ অরার অজানা নয়। অরা লজ্জায় মাথা নিচু করে ফেলল। আরিশ তোয়ালে হাতে, ওয়াশরুমের দিকে এগোল।

চলবে…..

#হামিংবার্ড
#তাসমিয়া_তাসনিন_প্রিয়া
#পর্ব_৬৪_ক

ঢাকা শহরের রত যেন এক গাঢ় ক্লান্তির পরও অদ্ভুতভাবে জেগে থাকা এক শহরের চেহারা। রাস্তা থেকে তখনও পুরোপুরি গাড়ির শব্দ মিলিয়ে যায়নি– দূরে বাসের হেডলাইট গড়িয়ে যাচ্ছে, সিএনজির শব্দ মাঝে মাঝে কানে বাজে। কিছু রাইডার ধীরে ধীরে ছুটছে, কাঁধে ব্যাগ, পিঠে ক্লান্তি।

ফার্মগেট, নিউ মার্কেট, মিরপুর কিংবা মোহাম্মলপুর– এমন কিছু জায়গা এখনো আলো ঝলমলে। ছোট ছোট চায়ের দোকানে বসে কেউ এখনো ধোঁয়া ওঠা চায়ের কাপ হাতে আড্ডা দিচ্ছে, কেউবা ফোনে কথা বলছে নিচু গলায়। টং দোকানে বাজছে পুরোনো কোনো গান—রাত যত বাড়ে, ততই যেন করুণ হয়ে ওঠে সুরটা।

বেইলি রোড বা বনানীর কিছু রেস্টুরেন্ট তখনও খোলা, শহরের কিছু এলিট অংশ এখনো আলোর ঝলকে ভরা। আর পুরান ঢাকার অলিগলিতে তখনো হাঁটছেন কয়েকজন মানুষ—নীরব কিন্তু নিঃসঙ্গ না।

চন্দ্রিমা উদ্যান, হাতিরঝিল কিংবা গুলশান লেকের পাশ দিয়ে যারা হেঁটে যাচ্ছে– তাদের মুখে বাতাসের হালকা ছোঁয়া। আকাশে তখন অল্প মেঘ, চাঁদটা ঢেকে দিয়ে আবার বেরিয়ে আসছে। বাতাসে গরম আর স্নিগ্ধতার মিশেল– নিশ্বাসে যেন একটু হালকা ধুলো, একটু কাঁটাআলো, আর একটু হাফ-আলসেমি।

নিজের ঘরেই শুয়েছিল সাবিহা। সবাই খাওয়াদাওয়া করে নিলেও সাবিহা এখনও রাতের খাবার খায়নি। হঠাৎ দরজায় ঠকঠক আওয়াজে সেদিকে তাকাল সে।

“ ভাবি! ভেতরে এসো। তোমার আবার নক করা লাগে! “

অরা মুচকি হেসে রুমে ঢুকল। সাবিহা শোয়া থেকে উঠে বসেছে।

“ রাতে কি না খেয়েই থাকবে, আপু? চলো খাবার খেয়ে নিবে। “

“ আমার ইচ্ছে করছে না, ভাবি। আজকের রাতটা না খেলে কিচ্ছু হবে না। “

বিরস মুখে বলল সাবিহা। অরা স্বাভাবিক ভঙ্গিতে কথা বললেও তার চোখেমুখে আনন্দের ঝিলিক। সাবিহা সেটা বেশ ভালো করে বুঝতে পারছে।

“ বেশ! তবুও একবার নিচে চলো, একজন তোমার সাথে দেখা করতে এসেছে। “

কিছুটা অবাক হলো সাবিহা। কৌতূহল মেটাতে শুধালো,

“ আমার সাথে আবার কে দেখা করতে এসেছে?”

“ সেটা তো ড্রইং রুমে গেলেই বুঝতে পারবে, ননদী। চলো…..”

অরা এবার সাবিহার হাত ধরেই বিছানা থেকে নামিয়ে নিয়ে, ঘর থেকে বেরোলো। সাবিহা তো কিছুই বুঝতে পারছে না। কে এসেছে, আচমকা অরার এতটা খুশি হওয়ার কারণ – সবকিছুই সাবিহার মাথার ওপর দিয়ে যাচ্ছে যেন।

ড্রইংরুমে বসে আছে মেহরাব, পাশেই আরিশও বসা। মেহরাবের মুখোমুখি সোফায় বসে আছেন, তাসলিমা খাতুন । তামান্না আপ্যায়নে ব্যস্ত, তালহা মায়ের সোফার পাশে দাঁড়িয়ে আছে। আরিশ যেহেতু আগেই বিয়ের বিষয় বাড়িতে জানিয়েছিল তাই নতুন করে কিছু বলার নেই। তবে মেয়ের হবু বর কেমন বাজিয়ে দেখতে টুকটাক কথাবার্তা বলেছেন তাসলিমা। মেহরাব অবশ্য এতটুকু সময়ের মধ্যেই তাসলিমার মন জয় করে নিয়েছে।

“ তাহলে তো আর দেরি করার কারণ দেখছি,চাচি। তামান্না আর তালহার বিয়ের সাথে ওদের বিয়েটাও হোক। “

তালহা বেশ খুশি হলো। একসাথে বিয়ে হলে মন্দ হয় না। তাসলিমা মুচকি হাসলেন। আরিশের ওপর পূর্ণ ভরসা আছে তার।

“ তুমি যা বলবে তাই হবে, আরিশ। “

মুচকি হাসল আরিশ। মেহরাবের কাঁধে হাত রেখে বলল,

“ যা শ্লা সিঙ্গেল অবস্থায় আর মরা হবে না তোর, ভেবেছিলাম সিঙ্গেলই মরবি তুই…… “

আরিশের কথায় সবাই হেসে উঠল। এরমধ্যে অরা সাবিহাকে নিয়ে ড্রইংরুমে চলে এসেছে। মেহরাব যখন সবার সাথে হাসিতে মেতে ছিলো ঠিক তখনই সাবিহার দৃষ্টি আটকে যায় তার ওপরে। মুহুর্তেই চমকায় সে, বুকটা ধক করে ওঠে। মেহরাব এসেছে! না আসার তো কিছু নেই। আরিশের বন্ধু, সেই হিসেবে তো আসতেই পারে সে।

“ কী হলো? সারপ্রাইজ! “

অরার কথায় ভাবনার ছেদ ঘটলো সাবিহার। সঙ্গে সঙ্গে সবাই ওদের দিকে তাকাল। সাবিহার মনে অভিমান জমেছে বেশ। সে ইচ্ছে করেই ফ্লোরের দিকে তাকিয়ে রইলো। মেহরাব লম্বা একটা নিঃশ্বাস ফেলে বসা থেকে উঠে দাঁড়াল। ধীরপায়ে এগিয়ে গেলো সাবিহার দিকে। অরা কিছুটা দূরে সরে দাঁড়াল এবার। আরিশ তাকে ইশারায় কাছে ডাকল। আরিশের পাশে গিয়েই দাঁড়াল অরা।

মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছে সাবিহা ও মেহরাব। দুজনের বুক ধুকপুক করছে যেন, কারো মুখে কোনো কথা নেই। সাবিহার চোখ ছলছল করছে। ইচ্ছে করছে মানুষটার বুকে একবার মুখ গুঁজে দিতে। মেহরাব সাবিহাকে অবাক করে দিয়ে হাঁটু গেড়ে বসে পড়লো। সাবিহা অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো কেবল। মেহরাব ঠোঁটের কোণে হাসি বজায় রেখে, সাবিহার সামনে একটা বক্স ধরে সেটা খুলল। সহসাই সাবিহার সামনে একটা সুন্দর হীরার নেকলেস উন্মুক্ত হলো। বিস্ময় কাটে না সাবিহার। মেহরাব এবার মুখ খুলল,

“ আমাকে বিয়ে করবে, সাবিহা? “

সাবিহা থমকে গেলো। মনে হলো মেহরাব মজা করছে তার সাথে। কিন্তু পরক্ষণেই আশেপাশে নজর বুলাতে বুলাতে মনে হলো, না এটা মজা না। কারণ বাড়ির সবাই উপস্থিত এখানে। সাবিহা মেহরাবের দিকে তাকায় এবার। মেহরাব উত্তরের অপেক্ষায় আছে। সাবিহা বলে,

“ আপনি খুব খারাপ….. আপনি আমার কল রিসিভ করেননি, টেক্সটের রিপ্লাই করেননি। আর আর দেখাও করেননি। “

“ সব অভিযোগ শুনবো, আগে আমার প্রশ্নের উত্তর দাও। “

সাবিহা চুপ করে রইলো তবুও। অরা বলল,

“ আগে উত্তরটা দিয়ে দাও ননদী। “

সাবিহা সবার দিকে একবার তাকাল। সবাই হাসি হাসি মুখে তাদের দিকেই তাকিয়ে আছে। তামান্নাও রান্নাঘর থেকে, খাবার-দাবার নিয়ে ড্রইংরুমে চলে এসেছে।

“ হ্যাঁ, করবো। তবে কথা দিতে হবে, ভবিষ্যতে আর কখনো এমন করবেন না। “

মেহরাব মুচকি হাসল। একহাতে কান ধরে বলল,

“ কথা দিলাম, আর কখনো এমন করবো না। “

সাবিহা হেসে মেহরাবের হাত থেকে বক্সটা নিলো। বসা থেকে উঠে দাঁড়াল মেহরাব। সবাই হাততালি দিচ্ছে। তামান্না অরার পাশে এসে দাঁড়িয়ে ফিসফিস করে বলল,

“ ভাবি আপনার কাজ বেড়ে গেলো। এখন দু’জনকে বউ সাজাতে হবে। “

অরা হেসে বলল,

“ কোনো সমস্যা নেই। “

হাসি-আনন্দে দুই যুগলের বিয়ে নিয়ে অনেকক্ষণ কথা হলো সেই রাতে। মেহরাব, সাবিহার সাথে কিছুক্ষণ একান্তে কথা বলেছিল। দু’জনের মধ্যে জমে থাকা মান-অভিমান, তিক্ততা ধীরে ধীরে গলে গেল। চোখে চোখ রেখে যেন একটা নীরব বোঝাপড়া হয়ে গেল তাদের সব ভুলে, সব পেছনে ফেলে নতুন করে শুরু করার অপেক্ষায় তারা।

দু’দিন ধরে ঝুম বৃষ্টি। বাইরে বেরোনোর যেন উপায় নেই। জানালার পাশে দাঁড়িয়ে আছে অরা। সময়টা বিকেলবেলা, আসরের আজান হয়েছে কিছুক্ষণ আগে। হঠাৎ ফোনের রিংটোন বেজে ওঠাতে নড়েচড়ে উঠল অরা। বিছানার কাছে গিয়ে ফোন হাতে নিয়ে দেখলো, মা কল করেছে।

“ আসসালামু আলাইকুম, মা! কেমন আছো?”

“ ওয়া আলাইকুম আসসালাম। আলহামদুলিল্লাহ, তোরা কেমন আছিস সবাই? “

“ আমরাও আলহামদুলিল্লাহ, ভালো আছি। বাবার শরীর কেমন আর নয়না কী করছে?”

“ তোর বাবা ভালোই আছেন। নয়না ঘুমাচ্ছে। “

“ এখন? শরীর ঠিক আছে তো?”

“ হ্যাঁ, ঠিক আছে। আচ্ছা শোন, উর্মির বিয়ে চারদিন পর। তোর চাচ্চু খুব করে সবাইকে নিয়ে যেতে বলেছেন। তোর আর আরিশের কথাও বলেছেন খুব। তুই একটু আরিশকে বল, নিশ্চয়ই শুনবে। সবাই একসাথে গ্রামে যাবো। “

অরা ভাবনায় পড়লো কিছুটা। আরিশ রাজি হবে কি-না কে জানে।

“ ঠিক আছে, মা। আমি বলবো উনাকে। রাতে বাসায় ফিরুক তারপর। “

রোকসানা মল্লিক খুশি হলেন। হেসে বললেন,

“ ঠিক আছে। আগামীকাল সকালে বলিস, আরিশ কী বলে। “

“ আচ্ছা, মা। জানাবো। “

“ রাখছি তাহলে, ভালো থাকিস। “

“ তুমিও, ভালো থেকো। আল্লাহ হাফেজ। “

“ আল্লাহ হাফেজ। “

________

“ আপু কী বলল, মা?”

হাই তুলতে তুলতে মায়ের ঘরে ঢুকল নয়না। রোকসানা মেয়ের দিকে তাকিয়ে বললেন,

“ বলল রাতে আরিশ বাসায় ফিরলে, ওর সাথে কথা বলবে। আগামীকাল সকালে জানাবে। “

“ ওহ, আচ্ছা। “

নয়না তার খোলা চুলগুলো দু’হাতের সাহায্যে খোঁপা করে, বিছানার একপাশে বসলো। রোকসানা মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন একবার।

“ চোখমুখে পানির ছিটে দিয়ে আয়। আমি যাচ্ছি রান্নাঘরে, চা আর পকোড়া বানাবো। “

“ ঠিক আছে, মা। “

নয়না আগের মতোই ধীরপায়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো। রোকসানা মল্লিক রান্নাঘরের দিকে এগোলেন।

অফিসের ঘড়িতে তখন বিকেল সাড়ে পাঁচটা । বাইরের আকাশে রোদ ফুরোবার প্রস্তুতি, জানালার কাঁচে আলোর ছায়া ঝিমিয়ে পড়ছে। কিন্তু খান ইন্ডাস্ট্রির কনফারেন্স রুমে তখন উত্তেজনার পারদ যেন হঠাৎ চড়তে শুরু করেছে।

আরিশ টেবিলের ওপাশে বসে, মুখ থমথমে। ফাইল হাতে নিয়ে এক পৃষ্ঠা পড়েই চেয়ারের পিছনে হেলে গিয়ে ঠাণ্ডা গলায় বলল,

“এই রিপোর্টটা কে বানিয়েছে?”

কেউ সরাসরি জবাব দিল না। কিন্তু মেহেদী নামের এক জুনিয়র স্টাফ ধীরে ধীরে এগিয়ে এসে বলল,

“স্যার, আমি… মানে আমি ইমেইল করেছিলাম আপনাকে…”

আরিশ চোখ তুলে তাকাল। তার গলার স্বর তখনো নিচু, কিন্তু ভয়ংকরভাবে কড়া।

“তুমি বুঝতে পারো, একটা সংখ্যার ভুল মানে পুরো রিপোর্টের তথ্য ভেঙে পড়া? আমাদের ক্লায়েন্টকে তুমি ভুল ডেটা পাঠিয়েছো, আর সেটা আমি জানতে পারলাম বাইরের লোকের কাছ থেকে? হোয়াট দ্য হেল ইজ রং উইথ ইউ?”

মেহেদী ঘেমে উঠেছে। অফিস ঘরটা যেন হঠাৎ নিঃশব্দ হয়ে গেল।

আরিশ দাঁড়িয়ে গেল এবার, টেবিলের উপর রিপোর্টটা ছুঁড়ে ফেলে বলল,

“আমি যখন বলি ‘ডাবল চেক করে জমা দিতে’, সেটা শুধু বলা কথা না। এটাই প্রফেশনালিজম। আমরা যদি নিজের কাজেই সিরিয়াস না হই, তাহলে এই চেয়ারগুলোতে বসে কী করো তোমরা? সময় কাটাতে আসো?”

তার কণ্ঠে রাগ না, হতাশাও না– একধরনের দৃঢ়তা, নেতৃত্বের স্পষ্ট নির্দেশ। অফিসের বাতাস ভারি হয়ে আছে। কেউ কফির কাপ তুলেও চুমুক দিচ্ছে না।

আরিশ কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলল,

“এটা আমার শেষ ওয়ার্নিং, মেহেদী। পরেরবার এমন হলে শুধু রিপোর্ট নয়, চাকরিটাও তোমার রিপোর্ট করবে।”

মেহেদী কেবল মাথা নাড়ল। সবাই চুপ করে রইলো।

চলবে….

#হামিংবার্ড
#তাসমিয়া_তাসনিন_প্রিয়া
#পর্ব_৬৪_খ

কনফারেন্স রুম থেকে বেরিয়ে ধীরে পা ফেলে নিজের কেবিনে ঢুকল আরিশ। তার মুখ থমথমে, ভ্রু কুঁচকে আছে এখনো। জানালার পাশে রাখা চেয়ারটায় বসে গা এলিয়ে দিল। ঘরের বাতি জ্বলছে, কিন্তু ভেতরের আলো যেন নিঃশব্দ, ভারী। ডেস্কের উপরে রাখা রিপোর্টটা একবার দেখে আবার চোখ ফিরিয়ে নেয়।

ঠিক তখনই ফোনটা বেজে উঠল। স্ক্রিনে ভেসে উঠল—“হামিংবার্ড কলিং…”

এক মুহূর্ত তাকিয়ে রইল স্ক্রিনে। ভেতরে জমে থাকা রাগ, বিরক্তি, হতাশার ভিড়ে হঠাৎ এক নরম স্পর্শের মতো মনে হলো নামটা।

কল রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে ভেসে এল পরিচিত কণ্ঠ–
“কী করছেন?”
আরিশ এক মুহূর্ত চুপ করে থেকে জবাব দিল,
“কিছু না।”

আরিশের কণ্ঠস্বর শুনেই অরার খটকা লাগলো। নরম গলায় জিজ্ঞেস করলো,

“অফিসে কিছু হয়েছে?”
“একটা রিপোর্টে মারাত্মক ভুল ছিল। রাগটা এখনো যাচ্ছে না।”

অরার গলা তখনও নরম, ঠাণ্ডা জলর মতো,
“ আপনি সবকিছু নিখুঁত চান… কিন্তু আপনিও যেমন মানুষ, বাকি সবাইও তাই। একটু ভুল হতেই পারে। জানি একটুখানি ভুলের জন্যও অনেক বড়ো ক্ষতি হয়ে যায় কিন্তু রাগ করলে কী কিছু মেটে, রাগী ভূত? আপনি ভেঙে পড়বেন না।”

আরিশ হেসে উঠল। অদ্ভুত এক ক্লান্ত, অস্ফুট হাসি।
“ভেঙে পড়িনি, শুধু… মাথার ভেতরটা কেমন জ্বালা করছে।”

“ তাহলে কথা বলুন আমার সাথে। রাগ গলে যাবে।”

অরা চোখ বন্ধ কথাটা বলল, পরে নিজেই লজ্জায় পড়ে গেলো। আরিশের ঠোঁটের কোণের হাসি আরো চওড়া হলো তার কথায়।

“ যাক এতদিনে বুঝতে পেরেছো, তুমি আমার কতটা জুড়ে আছো। “

আরিশ চেয়ারটা পিছনে হেলে দিয়ে চোখ বন্ধ করল। অরা মুচকি মুচকি হাসছে।

“ আজ একটু তাড়াতাড়ি বাসায় ফিরবেন? “

ভ্রু কুঁচকে ফেলল আরিশ, ঠোঁটের কোণে অন্য রকম হাসির ঝিলিক। যেন একটু আগে কনফারেন্স রুমে ঘটে যাওয়া ঘটনা ভুলে গেছে সে।

“ বউ বললে একটু তাড়াতাড়ি নয়, বলা মাত্রই হুকুম তামিল করতে হয়। আমি অফিস থেকে বের হচ্ছি, ডার্লিং। “

লজ্জায় চুপ করে রইলো অরা। আরিশ কেবল তার নিঃশ্বাসের শব্দ শুনতে পাচ্ছে। আরিশ ফিসফিস করে ফের বলল,

“ বি রেডি, বিকজ আই’ম কামিং ফর ইউ—অ্যান্ড দিস টাইম, আই ওউন্ট অ্যাস্ক ফর পারমিশন….”

অরা আরকিছুই না শুনে কল কেটে দিলো। লজ্জায় নিজের ওড়না দিয়ে মুখ ঢেকে মিটিমিটি হাসছে সে। ভদ্রলোক আর ভদ্র হলো না!

রাতের শহরে আজ হালকা বাতাস। মাথার উপর আধখানা চাঁদ, চারপাশে নরম আলো। ব্যস্ত ঢাকা শহর যেন আজ একটু ধীরে হাঁটছে– হয়তো মেহরাব আর সাবিহার জন্য। দীর্ঘ সময়ের মান-অভিমান, দূরত্ব আর ভুল বোঝাবুঝির পরে আজকের রাতটা যেন নতুন এক শুরু। একসাথে শহরে বের হয়েছে তারা হাত ধরে, না বলা শত আবেগ বুকের ভেতর জমিয়ে।

ধানমণ্ডি লেকের পাশে হাঁটছে দু’জনে। মেহরাব পরেছে হালকা নীল রঙের ক্যাজুয়াল শার্ট, হাতা একটু গুটানো, সাথে জিন্স প্যান্ট। সাবিহা পরেছে গোলাপি থ্রিপিস, চুল ঢিলে করে বেঁধে রেখেছে, একটু হালকা ওয়েভ –স্বাভাবিক, নরম একটি লুক। মেহরাবের হাতে সাবিহার হাত, কিন্তু চোখে চোখ না রেখেও সব কথা বলা হয়ে যাচ্ছে যেন। হঠাৎ এক সময় সাবিহা থেমে গেল।

“মেহরাব… মনে আছে, এই জায়গায় আগেও এসেছিলাম আমরা?”

মেহরাব হালকা হাসল,

“মনে থাকবে না? সেদিন তো তুমি রাস্তা পার হওয়ার সময় আমায় হাত ধরেছিলে। তখনও বলোনি এতটা ভালোবাসো!”

সাবিহা হেসে ফেলে, চোখ নামিয়ে বলে,

“তখন ভাবতাম, বললে হয়তো সব বদলে যাবে।”

“আর এখন?”

“এখন ভাবি… না বললেই হয়তো হারিয়ে ফেলতাম তোমাকে।”

মেহরাব তার দিকে একটু ঝুঁকে এসে কপালের ঠিক মাঝখানে চুমু দিল।

“তুমি আমার জীবনের প্রথম ও শেষ ভালোবাসা। আমি তোমাকে কখনোই আবার দূরে যেতে দেব না।”

“ দূরে যেতে দিলে তো!”

মেহরাব খিলখিল করে হেসে উঠল। সাবিহা তার কাঁধে মাথা রাখল। চারপাশের নীরবতা যেন হঠাৎ তাদের হৃদস্পন্দনের সুরে ভরে উঠল। হাত ধরাধরি করে আবার হাঁটতে শুরু করল তারা।পেছনে পড়ে রইল অভিমান, কষ্ট, পুরোনো গ্লানির ছায়া। শহর আজ যেন আরও আলোকিত, শুধু তাদের জন্য।

“ কী গো? অরাকে কল করেছিলে তুমি? আগামীকাল বিকেলের মধ্যে গ্রামের বাড়িতে যেতে হবে। ভাইজান বড্ড রাগারাগি করছেন। “

অফিস থেকে ফিরে, ফ্রেশ হয়ে এসে ড্রইংরুমে বসলেন সুলাইমান। রোকসানা স্বামীর জন্য চা নিয়ে এসেছেন। নয়না পড়াশোনা নিয়ে ব্যস্ত।

“ আজ বিকেলেই তো কথা বললাম, অরার সাথে। সকালে জানাবে। আরিশের সাথে রাতে কথা বলবে, বলল। “

সুলাইমান রোকসানার হাত থেকে চায়ের কাপটা নিলেন। ধীরেসুস্থে চায়ে চুমুক দিয়ে বললেন,

“ বেশ। তবে তুমি গিয়ে আমাদের জামাকাপড় ও প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র গুছিয়ে নাও। পাঁচ দিন ছুটি নিয়েছি, তারমধ্য একদিন গেলো অফিসের ঝামেলায়! ছুটি নিয়েও শান্তি নেই। “

কিছুটা হতাশা প্রকাশ করে বললেন কথাগুলো।

“ কী হয়েছিল অফিসে?”

“ একটা প্রজেক্ট রিপোর্ট জমা দেওয়ার ডেট ছিল ছুটির সময়েই। বলেছিলাম, মেহেদী যেন ঠিকমতো হ্যান্ডেল করে। কিন্তু কি আর বলব, রিপোর্টে এমন ভুল—শেষ পর্যন্ত নিজেই গিয়ে সংশোধন করে দিতে হলো। অফিস গিয়ে তিন ঘণ্টা বসে কফি আর টেনশনে কাটাতে হয়েছে!”

“ বুঝতে পেরেছি। আচ্ছা শোনো, আমি সব গুছিয়ে নিচ্ছি। “

সুলাইমান মল্লিক আরকিছু বললেন না কেবল মাথা নেড়ে সম্মতি জানালেন। রোকসানা নিজের ঘরের দিকে এগোলেন।

সন্ধ্যার আগে আগে আরিশ অফিস থেকে বের হলেও বাড়িতে ফিরতে ফিরতে রাত ন’টা বাজল। রাস্তায় যা জ্যাম, তাতে দুই ঘন্টার পথে যেন চার ঘন্টা লাগার উপক্রম!

বিছানায় চুপচাপ বসে আছে অরা। অনেক দিন হলো কোথাও বেড়াতে যাওয়া হয়নি অরার। তাই আজকে যেভাবেই হোক বুঝিয়ে শুনিয়ে কাজিনের বিয়েতে যাওয়ার প্ল্যান করছে অরা। এজন্যই আরিশকে আজ তাড়াতাড়ি বাসায় ফিরতে বলেছিল সে। তবে এতো দেরি হওয়ার কারণে মনটা কেমন খচখচ করছে অরার।

“ কী খবর, পাখি?”

আচমকা আরিশের কণ্ঠস্বর শুনে সামনে তাকাল অরা। অন্যমনস্ক হয়ে ছিলো বলেই, ভদ্রলোকের পায়ের শব্দ টের পায়নি।

“ ভালোই। এই বুঝি আপনি তাড়াতাড়ি ফিরলেন?!

প্রিয়তমার কণ্ঠে অভিমানের আভাস পেয়ে আরিশের মনটা যেনো নেচে উঠলো। অরার একটু ভালোবাসা পেলে আরিশের নিজেকে সবচেয়ে সুখী মানুষ মনে হয়। সে অরার পাশে গিয়ে দাঁড়াল, দুহাত বাড়িয়ে দিলো– ঠিক যেভাবে ছোটো বাচ্চাদের কোলে নেওয়ার জন্য হাত বাড়ানো হয় সেভাবে। অরা আরিশের কাছে এগিয়ে গেলো। ভদ্রলোক বরাবরের মতোই কোলে তুলে নিলো অরাকে।

“ রাস্তায় অনেক জ্যাম ছিলো, হামিংবার্ড। “

“ আচ্ছা, বুঝতে পেরেছি। যান, ফ্রেশ হয়ে আসুন। আমার অনেক খিদে পেয়েছে। “

“ খিদে পেলে খাও… সামনেই তো দাঁড়িয়ে… “

আরিশ মিটিমিটি হাসে, কথা শেষ করলোনা। অরা তার দুষ্টমি বুঝে গেছে।

“ আগে খাবার তারপর… এসব…. “

অরা কিছু বলতে যাচ্ছিল, কিন্তু আরিশ হঠাৎ এগিয়ে এসে তার মুখ থামিয়ে দিল। চোখে চোখ রেখে মুহূর্তখানেক তাকিয়ে থাকল, তারপর অরার ঠোঁটে নিজের তীব্র উপস্থিতি ছাপ ফেলে গেল।

অরা প্রথমে একটু চমকে উঠলেও একটুও বাধা দিল না, বরং দু’হাতে আরিশের শার্ট শক্ত করে চেপে ধরল। আরিশ তার ঠোঁটে নরম আদরের ছাপ রেখে বলল,

“ওকে ডার্লিং। আগে না হয় খাবার খেয়ে আসি,তারপর…”

অরা লজ্জায় চোখ নামিয়ে ফেলল। কিন্তু ঠোঁটের কোণে তীব্র আবেগে লেগে রইল লালচে ছায়া,যেটা শুধু আরিশই রেখে যেতে পারে। অরাকে রেখে ফ্রেশ হওয়ার জন্য ওয়াশরুমের দিকে পা বাড়াল আরিশ।

নিশুতি রাত। চারপাশে গভীর নীরবতা, জানালার বাইরে কেবল পাখার ঘড়ঘড় শব্দ আর দূরের কোনো কুকুরের ডাকে মাঝেমধ্যে ছেদ পড়ছে।

নয়না বিছানায় শুয়ে আছে, চোখের পাতায় ক্লান্তি আছে, কিন্তু ঘুম নেই। বালিশে মাথা রাখলেই মনে পড়ে– পলাশের কথা। সেই সহজ হাসি, নিরব চোখের ভেতরে জমে থাকা অনুভব, আর নিঃশব্দে পাশে থাকার যে ক্ষমতা ছিল ওর।

পলাশ তাকে ভালোবাসত, নয়না সেটা টের পেয়েছিল, কিন্তু তখন বুঝতে পারেনি যে ও নিজেও ভালোবেসে ফেলেছে। তবে পলাশের অনুপস্থিতিতে সেটা বুঝতে পারছে। আজ যখন পলাশ নেই, ঘরজুড়ে তার অনুপস্থিতির নীরবতা, তখন প্রতিটি নিশ্বাসে শুধু তার ছায়া।

বালিশে মুখ গুঁজে নয়না চোখ বন্ধ করে। ঘুম আসছে না। পলাশ চলে যাওয়ার পর ঘুম যেন অভিমান করে সরে গেছে। তাকে ছুঁয়ে থাকা স্মৃতিগুলো এখন নয়নার নিঃশ্বাসে ছায়া হয়ে জড়িয়ে থাকে। তাদের শেষ দেখা, কথা, পলাশের হার্ট লক করা সবকিছুই নয়না বারবার মনে করে। চোখ ভিজে ওঠে জলে।

পলাশের সাথে কথা বলতে না পেরে প্রতিদিন একটু একটু করে পুড়ে যাচ্ছে নয়নার বুক—নিঃশব্দে, নিঃশ্বাসে, ঘুমহীন রাতের পর রাত।

চলবে….