#হামিংবার্ড
#তাসমিয়া_তাসনিন_প্রিয়া
#পর্ব_৬৫
“ কাজিনের বিয়েতে যেতে চাচ্ছো?”
আরিশ কিছুটা গাম্ভীর্যের সঙ্গে জিজ্ঞেস করলো। অরা চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে, আরিশ বিছানায় বসে আছে। মাত্র রাতের খাবার খেয়ে, রুমে ফিরলো দু’জন।
“ আপনি যদি অনুমতি দেন, তাহলে যাবো। “
কণ্ঠ খাদে নামিয়ে বলল অরা। আরিশ হাত বাড়াল, অরার ডান হাতটা ধরে আলতো করে টেনে নিজের পাশে বসালো তাকে। অরা কিঞ্চিৎ অবাক হলো তাতে। ভদ্রলোক কোলে না বসিয়ে পাশে কেন বসালেন আজ? তবে কি রেগে গেলেন?
“ ঠিক আছে। অনুমতি দিলাম। কবে যাবে?”
আরিশের মতিগতি বুঝতে পারছে না অরা। এতো সহজেই সে কীভাবে রাজি হলো! অরার কাছে সবটা স্বপ্নের মতো লাগলো।
“ আগামীকাল বিকেলে। আপনার কোনো অসুবিধা হবে না তো?”
ভ্রু কুঁচকে ফেলল আরিশ, শুধালো –
“ আমার কীসের অসুবিধা? আমি তো অন্যের কোম্পানিতে চাকরি করি না ডার্লিং। কোম্পানিই আমার। এজন্যই আঙ্কেল সেদিন ছুটি নিলেন, তাই না?”
“ হ্যাঁ। “
“ হুম বুঝলাম। কাল যাবে, আজ বললে! তাড়াহুড়ো করে সকালবেলা শপিং করতে হবে। “
“ আমার কিছু লাগবে না। অনেক জামাকাপড় তো পরাই হয়নি৷ “
আরিশ অরার গাল টেনে দিয়ে বলল,
“ সেগুলো থাক, নতুন কিনবে। তাছাড়া নতুন দম্পত্তির জন্যও তো উপহার কিনতে হবে। “
“ তা-ও কথা। “
আরিশ কথার ফাঁকে ফাঁকে ফোনের স্ক্রিনে তাকাচ্ছে কেবল। বিষয়টা অরার নজর এড়ায়নি। ফোনে কী এমন আছে যার জন্য বউয়ের দিকে মন নেই? অভিমান হলো হামিংবার্ডের। তার রাগী ভূতকে কখনো এমনভাবে অন্যমনস্ক হতে দেখেনি সে। আজ যদি অরা এরকম অন্যমনস্ক থাকতো, তাহলে তো দক্ষযজ্ঞ বেঁধে যেতো। মুখ গোমড়া করে মাথা নিচু করে ফেলল সে। আরিশ কাউকে কল করে কথা বলল কিছুক্ষণ। অরা সবকিছু মনোযোগ দিয়ে শুনে যা বুঝলো, বিদেশি কোম্পানির সাথে বড়ো ডিলের জন্য আগামীকাল মিটিং ছিলো। কিন্তু এখন যেহেতু অরা গ্রামের বাড়িতে যেতে চেয়েছে সেজন্য আরিশ ব্যাপারটা ম্যানেজ করার চেষ্টা করছে। বেচারা আরিশ! বউয়ের হঠাৎ বিয়ে খেতে যাওয়ার জন্য বেশ বিপাকে পড়েছে। অরা নিজের ভুল বুঝতে পেরে মনে মনে নিজেকেই তিরস্কার করল।
“ কী হয়েছে, পাখি? কী ভাবছো? কোনো সমস্যা? “
অরা কোনো উত্তর দিলো না। নিজে থেকেই আরিশের কোলে চড়ে বসল। দু’হাতে গলা জড়িয়ে দৃষ্টিনত করে বলল,
“ আমাকে আজ কোলে তুলে বসালেন না কেন, রাগী ভূত? “
আরিশ যেন আকাশ থেকে পড়লো। তার স্ত্রী নিজে থেকে কোলে বসেছে আজ এবং অভিযোগ তুলেছে। বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে আছে সে। অরা চুপ করে আছে।
“ অরা?”
“ জি। “
“ তুমি কি আমাকে পুরোপুরি ভালোবেসে ফেলেছো?”
আরিশের প্রশ্ন বুঝতে পারলোনা সে। মাথা উঁচু করে, ভদ্রলোকের দিকে তাকিয়ে বলল,
“ আমি কি আপনাকে ভালোবাসি না? পুরোপুরি ভালোবেসে ফেলেছি মানে কী?”
আরিশ অরার ঠোঁটে ঠোঁট ছুঁইয়ে দিয়ে বলে,
“ ভালোবাসো না, সেটা বলিনি। তুমি আমাকে ভালোবাসলেও কখনো পুরোপুরি মেনে নিতে পারোনি। তোমার অবচেতন মন আমার পূর্বের আচরণগুলো ভুলতে পারে না। এজন্য মাঝে মধ্যে তুমি আমার ওপর বিরক্ত হও। তুমি না বললেও আমি বুঝতে পারি। “
অরা ঠিক কী বলবে বুঝতে পারছে না। আরিশের কথা হয়তো ঠিক। কিন্তু এতে অরার কী দোষ? একটা পরিবারকে বাধ্য করে তাদের মেয়েকে বিয়ে করেছিল আরিশ, তারপর? তারপর দিনের পর দিন অস্বাভাবিক আচরণ করেছে সে, নিজের ইচ্ছে চাপিয়ে দিয়েছে অরার ওপর। আজ অবধি অরার কোনো স্বাধীনতা নেই এখানে। ভালোবেসে বশ্যতা স্বীকার করা আর জোর করে বশ মানানোর মধ্যে পার্থক্য অনেক…..
“ হেই, হামিংবার্ড?”
অরার ভাবনার ছেদ ঘটলো আরিশের ডাকে।
“ আমি আপনাকে ভালোবাসি… পুরোপুরি ভালোবাসি। এর বাইরে কোনো সত্যি নেই আরিশ। “
মুচকি হাসল আরিশ।
“ এতটুকুই যথেষ্ট আমার জন্য। বিকেলে যেন কী বলেছিলাম?“
বিকেলের ফোনালাপের কথা মনে পড়তেই লজ্জায় নুইয়ে গেলো অরা।
“ জানি না। “
“ আমি জানি, ডার্লিং। “
আরিশ অরাকে আস্তে করে বিছানায় শুইয়ে দিল. তারপর কোনো শব্দ না করে পাশে শুয়ে পড়ল। একটা নিঃশব্দ মুহূর্ত কাটলো। ঘরজুড়ে ছড়িয়ে পড়লো নিঃশ্বাসের ওঠানামা, গায়ে লাগা উষ্ণতা, অজানা উত্তেজনার হালকা স্রোত।
আরিশ ধীরে ধীরে অরার দিকে ঘুরে তাকাল।
তার চোখে ছিল এক ধরনের না বলা আকুলতা।
“ সব ক্ষেত্রে নিজেকে সামলাতে পারলেও , তোমায় ছুঁতে গেলে আমি কেমন যেন হয়ে যাই। পাখি, তুমি কি….”
অরা চুপ করে শুনছিল। তবে তার কথা শেষ করতে না দিয়ে ঠোঁটে আঙুল চেপে ধরে বলল অরা,
“ আপনার সবকিছুতেই অভ্যস্ত হয়ে গেছি আমি। ভালোবাসি আপানাকে, আপনি যেমন তেমনভাবেই। আপনি আমার, আরিশ।”
“ আই লাভ ইউ টু, হামিংবার্ড। “
আরিশের হৃদয়ে যেনো ভালোলাগার ঢেউ বইতে লাগল। সে আর দেরি করল না। তার ঠোঁট ছুঁলো অরার গাল… তারপর কান, ঘাড়… ধীরে ধীরে নামছিল নিচে। প্রতিটি চুমুতে ছিল নিঃশব্দে বলা ভালোবাসা, আর মিশে থাকা আগুন। অরার দেহ ঠাণ্ডা ছিল, কিন্তু আরিশের স্পর্শে যেন আগুন ধরে গেল ত্বকে। সে কেঁপে উঠল। হাত দিয়ে চেপে ধরল আরিশের কাঁধ। ঠোঁটের কোণে নরম শ্বাস পড়ে, আর আরিশ তার শরীর জুড়ে ছড়িয়ে দিল ধীর অথচ তীব্র কামনা।
জানালা দিয়ে ভেতরে ঢুকে পড়া চাঁদের আলো দুজনের মুখ ছুঁয়ে রইল। শব্দহীনভাবে মিলিয়ে গেলো ভয়, অভিমান।
পরেরদিন সকালে, অরা রোকসানাকে ফোন করে সবটা জানালো। ভীষণ খুশি হলেন রোকসানা। সোলাইমান, নয়নাও খুশি – আরিশের আচরণে। মায়ের সাথে কথা বলা শেষে আরিশের সাথে শপিং করার জন্য বেরুলো অরা। তবে মনে মনে ভয়ে ছিলো, হয়তো গতবারের মতো আজও শপিং না করেই বাসায় ফিরে আসবে আরিশ। তবে তেমন কিছু ঘটলো না আজ। কারণ আরিশ শপিংমলে ঢোকার আগেই অরাকে ওড়না দিয়ে ভালো করে মুখ ঢেকে নিতে বলেছিল। ফলশ্রুতিতে অরাও তাই করেছিল। প্রায় দুই ঘন্টার শপিং শেষ করে দু’জনে বাড়ি ফিরছে এখন।
“ আইসক্রিম খাবে, হামিংবার্ড?”
পাশাপাশি বসে আছে দু’জন, গাড়ি চলছে । আইসক্রিমের কথা শুনতেই সেই প্রথমবারের কথা মনে পড়ে গেলো অরার। সেবার আইসক্রিমের বাহানা দিয়ে পালিয়ে গিয়েছিল সে।
“ হ্যাঁ খাবো। “
আরিশ একটু সামনে গিয়েই গাড়ি দাঁড় করালো।
“ কোন ফ্লেভারের আইসক্রিম ? “
আরিশের ঠোঁটের কোণে হাসি, তবে অরার মনে হচ্ছে অন্য কিছুর ইঙ্গিত দিচ্ছে সে। ব্যাপারটা বোধগম্য হতেই লজ্জায় অন্য দিকে তাকিয়ে বলল,
“ ভ্যানিলা, চকলেট আর…… না আরকিছু না।”
“ ওকে, বসো। আমি গিয়ে নিয়ে আসছি। “
আরিশ গাড়ি থেকে নেমে, জানালা দিয়ে উঁকি দিয়ে বলল,
“ আগেরবারের মতো পালিয়ে গেলে কিন্তু আর খুঁজতে যাবো না। “
অরা শব্দ করে হেসে উঠল। আরিশ আবার খুঁজতে যাবে না তাকে, হাস্যকর কথা।
“ পালানোর আর দরকার নেই, জনাব। এই পাখিটা চিরকালের জন্য আপনার হৃদয়ের খাঁচায় বন্দী হয়ে গেছে। “
“তাই?”
আরিশ জানালা দিয়ে মাথা ঢুকিয়ে, হঠাৎ করেই অরার গালে ঠোঁট ছুঁইয়ে দিলো। অরার ভেতরে যেন ঝড় বয়ে গেল। মুখটা গরম হয়ে উঠল এক নিমিষে।
আরিশ হেঁসে দিলো। তার চেহারায় এক অদ্ভুত প্রশান্তি।
“ভ্যানিলা, চকলেট আর আমার মতো হট কিছু আনব ?”
এই কথা শুনে অরা চমকে তাকালো। অরাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে আরিশ হেঁটে চলে গেল পাশের দোকানের দিকে।
গাড়ির জানালার কাঁচে অরার মুখ ভেসে উঠছে। তার চোখে এখনো সেই হাসির রেশ, কিন্তু ভিতরে ভিতরে চলছে হৃদয়ের ধুকপুক।
এই মানুষটা তার জীবনকে যতভাবে বদলে দিয়েছে, ততটা সে কোনোদিন কাউকে বুঝিয়ে বলতে পারবে না।
আরিশ ফিরে এলো হাতে আইসক্রিম নিয়ে। গাড়িতে উঠে বসলো।
” আমার মতো হট কিছু পেলাম না,ডার্লিং। ”
অরা আমতা আমতা করে বলল,
” পাবেন কীভাবে! আপনি তো এক পিসই৷ ”
আরিশ হাসল। আইসক্রিম এগিয়ে দিলো তার দিকে।
” নাও। ”
” আপনিও খান। আমি ভ্যানিলা নিচ্ছি। ”
আরিশ কাপ এগিয়ে দিলো।
“তোমার প্রিয় ভ্যানিলা, তোমার মতোই শান্ত আর ধরা না দেওয়া স্বাদ।”
অরা হাসল। “আর আপনারটা?”
“চকলেট। একটু বেশি তীব্র, কখনো কখনো তিক্ত তবে একবার অভ্যেস হয়ে গেলে ছাড়া যায় না।”
” একদম ঠিক বলেছেন। এখন চলুন, গোছগাছ বাকি অনেক। ”
” হ্যাঁ, চলো। ”
সকাল থেকেই গ্রামের আকাশটায় একটা মিষ্টি আমেজ। হালকা রোদ আর হাওয়ার মাঝে কোথাও যেন বাজছে ঢোলের ক্ষীণ শব্দ।
মল্লিকবাড়িতে আজ বিয়ের প্রস্তুতির আনুষ্ঠানিক শুরু। আগামীকাল গায়ে হলুদ, রাতে বিয়ে।
চারপাশে খুপরি ঘর, কাঁচা রাস্তা আর কাকডাকা ভোরে উঠানে চাল ধোয়ার শব্দ—সব মিলিয়ে সেই চিরচেনা গ্রামীণ বিয়ের গন্ধ। পুরো বাড়িটা রঙিন কাগজ আর ফুলের সাজে যেন নতুন প্রাণ পেয়েছে।
সোলাইমান মল্লিক, তাঁর স্ত্রী রোকসানা বেগম, ছোটো মেয়ে নয়না আর বড়ো মেয়ে অরাকে নিয়ে সন্ধ্যা নামার আগমুহূর্তে চলে এসেছেন গ্রামের বাড়িতে। সঙ্গে এসেছে অরার বর—আরিশ।
ছোটো ভাইয়ের পুরো পরিবারকে পেয়ে আজমাইন মল্লিক যেন হাতে চাঁদ পেয়েছেন। সোলাইমানের মা আনজুম বেগম ছেলেকে জড়িয়ে ধরে অনেক আদর করেছেন। অরাকেও অনেক আদর করেছেন তিনি। সেই নিয়ে নয়না আবার গাল ফুলিয়ে বসে ছিলো। অরাকে দাদি বেশি ভালোবাসে, তাকে নয়। উর্মি অরাকে পেয়ে খুব খুশি হয়েছে। অনেক বছর হয় দু’জনের দেখা হয়নি বলে কথা।
অন্যদিকে, আরিশকে ঘিরে কৌতূহলের শেষ নেই।
তাকে দেখতে অনেকেই ভিড় জমিয়েছে উঠানের একপাশে। শহুরে হালফ্যাশনের দামি শার্ট – সুট, পরিপাটি করে সেট করা চুল, হাতে ঘড়ি– যার দাম শুনে কেউ কেউ ফিসফিস করে বলছে,
“ঐটা নাকি এক লক্ষ টাকার! মাথা খারাপ?”
অরাও কম যায় না। পরেছে রাউ ডিজাইনের জর্জেট শাড়ি, সঙ্গে হালকা হীরের ঝুমকা, আর হাতে চকচকে ঘড়ি। তার পায়ে এমনকি হিলজুতো।
চাচী, ফুপু, প্রতিবেশীরা ফিসফিস করে বলছে,
“এই মেয়ে তো বিয়ের পর একদম বদলে গেছে রে!”
“জামাই তো দেখতে রাজপুত, আর গা-গতরে শহরের ছাপ! এমন জামাই পাইল কেমনে?”
“বুঝলি না? ওরা ধনী পরিবারের… শহরে অনেক সম্পদ।”
নয়না তখন এসব শুনে হেসে ফেলে। অরার কানে এসব শব্দ গিয়েই পৌঁছায়, কিন্তু সে কিছু বলে না।
শুধু একপাশে দাঁড়িয়ে আরিশের চোখে চোখ রাখে।
আরিশ তখন চারপাশের উৎসুক মুখগুলোর দিকে না তাকিয়ে, নিঃশব্দে বলে ওঠে,
“ গ্রামে এসে তো নিজেকে মহারাজা মনে হচ্ছে, পাখি। “
“ আপনি কি রাজার থেকে কম কিছু?
আরিশ কিছু বলার আগেই উঠানে তখন মেয়েরা গান ধরলো।
“সোনা জামাই আইসাছে রে… গায়ের রঙ তার জোছনার মতো ধইরা…”
অরা ইশারায় বোঝায়, গ্রামের বিয়ে বাড়ি মানেই এমন আনন্দ, গান।
চলবে……
#হামিংবার্ড
#তাসমিয়া_তাসনিন_প্রিয়া
#পর্ব_৬৬
“এই জামাই তো পুরাই হিরো গো!”
“হিরো না, রাজপুত! চুলের সেটিং দেখছো?”
চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে উঠানের একপাশে বসা ফুফু-কাকিদের মাঝে চলছে কড়া আলোচনা। আরিশ পাত্তা দিচ্ছে না এসবকে, বরং তার চোখ আটকে আছে উঠানে দাঁড়িয়ে থাকা অরার দিকে। হালকা রোদে ঝিকিমিকি করে উঠছে অরার শাড়ির পাড়। আরিশ পাশে দাঁড়িয়ে বলল,
“ জানো হামিংবার্ড, এই গ্রামের বিয়েটা আমার জীবনের সবচেয়ে সুন্দর অভিজ্ঞতা হয়ে থাকবে।”
অরা মৃদু হেসে বলে,
“তারমানে গ্রামের সৌন্দর্য দেখে আপনি শহুরে বিয়ে, হাই প্রোফাইল রিসেপশন আর ডিজে নাইট ভুলে গেছেন?”
“ভুলিনি। কিন্তু এই উঠান, চাল ধোয়া মাটির গন্ধ, আর সবার এমন সহজসরল জীবনযাপন – সবকিছুই মন কেড়ে নিয়েছে।”
“ তাহলে এখানেই থেকে যাই? “
আরিশ মুচকি হাসল। আশেপাশের উপস্থিত সবার দৃষ্টি যেন ওদের দিকেই। অরাকে তার বর কতটা ভালোবাসে সবার মুখে মুখে এখন এসব কথাই ছড়াচ্ছে।
“ থাকার তো উপায় নেই, ডার্লিং। “
“ হুম বুঝলাম। আপনার খুব অসুবিধা হচ্ছে, তাই না?”
“ তেমন কিছু না। তবে মাঝে মধ্যে একটু গরম লাগছে এই আরকি!”
অরা শব্দ করে হেসে উঠল। শহরের শীতাতপনিয়ন্ত্রিত ঘরের আরামে অভ্যস্ত মানুষ হঠাৎ করে গ্রামের কাঁচা উঠোন, খোলা বাতাস আর চড়া রোদের মাঝে পড়লে একটু তো অস্বস্তি হবেই
“ আগামীকাল বিকেলেই তো ফিরবো। ভালোভাবে বিয়েটা মিটুক শুধু। “
আরিশ অরার কানের পাশে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বলল,
“ এতো লোকজনের মধ্যে বড্ড অসুবিধা হচ্ছে, পাখি। “
“ ওমা! মাত্র তো বললেন তেমন অসুবিধা হচ্ছে না, তাহলে? “
“ এটা অন্য অসুবিধা। বউয়ের সাথে রোমান্স করতে না পারার অসুবিধা – বুঝলে?”
অরা মুচকি হাসল। কিছু না বলেই অন্য দিকে এগোল। আরিশ বেচারা দাঁড়িয়ে রইলো কেবল।
একটু পরেই উর্মির গায়ে হলুদের অনুষ্ঠান শুরু হবে। মল্লিকবাড়ির উঠানে টুকটাক সাজসজ্জার শেষ ছোঁয়া চলেছে। বাতাসে ভেসে আসছে মেহেদি পাতার গন্ধ, আর বিয়ে বাড়ির লোকজনের হৈহল্লা।
উঠোনের মাঝখানে পাটি বিছিয়ে বসে আছেন আনজুম মল্লিক। বয়সের ভারে ন্যুব্জ হলেও মুখে প্রশান্তির ছাপ। শাড়ির আঁচল কোমরে গুঁজে, দুই হাতে শিলনোড়ায় ঘষে ঘষে হলুদ বাটছেন তিনি।
এই বয়সেও নিজের নাতনীর গায়ে হলুদের হলুদ তিনি নিজ হাতে বাটবেন এ যেন তার দীর্ঘদিনের স্বপ্ন।
চারপাশে নারীকণ্ঠে টুকটাক গান শুরু হয়েছে,
“আয় গে উর্মি, আয় আয় রে বউ… হলুদের রঙে তুই সোনালী হবি রে…”
এই সময় নয়না এসে দাদির পাশে এসে দাঁড়ালো।
তার চোখেমুখে প্রশান্তির এক পরত, কিন্তু সেই আড়ালের নিচে লুকিয়ে থাকা গভীর বিষণ্নতা চোখে পড়ার মতো।
আনজুম মল্লিক বাটনার হাত থামিয়ে মুচকি হেসে বললেন,
“কী রে নয়না? বোনেদের তো হিল্লে হয়ে গেলো, এরপর কিন্তু তোর পালা…”
“আমি বিয়ে করবোই না,”
শান্ত স্বরে জবাব দিল নয়না।
দাদি চোখ কুঁচকে তাকালেন তার দিকে, বললেন,
“দেখা যাবে… সময় হলে নিজেই বলবি– ‘দাদি, আমারে বিয়ে দিয়ে দাও।’ ”
আনজুম মল্লিকের কথায় নয়না ম্লান হেসে ফেললো। মুহূর্তেই যেন মন ছুটে গেলো কারো দিকে। পলাশ… কেমন আছে এখন সে?
নয়নার কথা কি একেবারে ভুলে গেছে?
“এই নয়না!”
আচমকা নিশানের ডাকে হকচকিয়ে গেল নয়না।
নিশান তার ফুপাতো ভাই, সবে এইচএসসি পরীক্ষা শেষ করেছে।
“জি ভাইয়া।”
“একটা কাজ করতে হবে তোকে।”
“কী কাজ?”
নিশান হাত তুলে দূরে দাঁড়িয়ে থাকা এক কিশোরীর দিকে ইশারা করে বলল,
“ওই যে, লাল টুকটুকে শাড়ি পরে যে মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে, ওর নাম বেলি। তুই গিয়ে ওকে বলবি– ‘নিশান ভাইয়া আপনাকে কলপাড়ে দেখা করতে ডেকেছেন।’”
নিশানের ঠোঁটের কোণে দুষ্টু হাসি। নয়নাও মুচকি হাসল। হবু ভাবিকে তার বেশ পছন্দ হয়েছে।
“ঠিক আছে, ভাইয়া।”
“লক্ষ্মী বোন আমার! রাতে তোর জন্য বাতাসা আর মুড়ি নিয়ে আসব। এখন যা।”
শব্দ করে হেসে উঠল নয়না।ছোটবেলা থেকে যখনই দাদা বাড়িতে আসে নিশান, ভাইবোনেরা মিলে মুড়ি আর বাতাসা খায়– সে এক চেনা আনন্দ। নয়না ধীরে ধীরে বেলির দিকে এগিয়ে গেল, আর নিশান হাঁটতে শুরু করল কলপাড়ের দিকে।
উর্মির গায়ে হলুদের আনন্দ যেন এখনো মল্লিকবাড়ির উঠানে রয়ে গেছে। সকালের রোদ গড়িয়ে এখন বিকেলের পড়ন্ত আলো। চারদিক গাঢ় কমলা রঙে রাঙা। উঠানে সাজানো চেয়ার টেবিল, মাথার ওপর বেলুন আর রঙিন কাগজের লতাপাতা বাতাসে নড়ছে। বাড়ির ছোট ছেলেমেয়েরা হলুদের থালা হাতে দৌড়াদৌড়ি করে বেড়াচ্ছে, কেউ কেউ হলুদের গন্ধ এখনো গায়ে মেখে বসে আছে এক কোণে।
অন্তঃপুরে তখন ব্যস্ততা চরমে। উর্মিকে স্নান করিয়ে ঘরে আনা হয়েছে। ওর মা আর চাচিরা মিলে বিয়ের পোশাক, গয়না, টুকিটাকি সব সাজিয়ে রাখছে বড়ো ট্রাংকের ওপর।
রান্নাঘরে তখন ধোঁয়া উঠছে একটার পর একটা হাঁড়িতে। গরুর মাংস, পোলাও, রোস্ট, পায়েস, আর বিশেষ করে গ্রামের বিখ্যাত চালতা টক—সবই তৈরি হচ্ছে অতিথিদের জন্য। রান্নার গন্ধ ভেসে এসে বাতাসে মিশে যাচ্ছে, চারপাশে যেন এক অদ্ভুত সুখের অনুভব ছড়িয়ে পড়েছে।
অরার মা রোকসানা বেগম বারান্দায় দাঁড়িয়ে এসব দৃশ্য দেখছেন। তার মুখে একরাশ প্রশান্তির ছাপ। পাশে দাঁড়িয়ে আছে নয়না, অরা। তাদের পেছনে এসে দাঁড়ায় আরিশ। পাঞ্জাবির হাতা গুটিয়ে রাখা, চুল হালকা এলোমেলো। বিয়ে উপলক্ষে পাঞ্জাবি পরেছে সে।
“বিয়ে বাড়িতে এসে আমি যত না খাচ্ছি, তার চেয়ে বেশি রান্নার গন্ধ খেয়ে ফেলেছি, হামিংবার্ড।”
অরা মুচকি হাসল।
“এখন বুঝলেন গ্রামের বিয়ের আয়োজন কী পরিমাণ কষ্টসাধ্য?”
“কষ্ট না, বরং মজা। এই দৌড়াদৌড়ি, হাঁকডাক, কাঁচা উঠানে মুরগি দৌড়ানো – এসব তো আগে কখনো দেখেনি। সেজন্য হয়তো এতটা ভালো লাগছে।”
অরা হেসে মাথা নেড়ে সম্মতি জানাল। নয়না তখন নিচে তাকিয়ে আছে চুপচাপ।
এদিকে উর্মিকে সাজানোর কাজ শুরু হয়েছে। ঘরের ভিতর হাসিঠাট্টায় জমে উঠেছে মেয়েদের আসর। উর্মির ফুপু রিনা, গলায় সোনার হার ঝুলিয়ে দিয়ে বলছেন,
“এই হারটা আমি বিয়েতে পেয়েছিলাম, এবার আমার ভাগ্নিকে দিলাম!”
বোনেরা গায়ে সুগন্ধি ছিটাচ্ছে, কেউ ঠোঁটে লিপস্টিক লাগিয়ে দিচ্ছে, কেউ কপালে টিপ পরিয়ে দিচ্ছে। উর্মি আয়নায় তাকিয়ে নিজেকেই যেন চিনতে পারছে না। লজ্জায় তার মুখ গাঢ় লাল।
বিকেলের আলো তখন একটু একটু করে ম্লান হয়ে যাচ্ছে। বাড়ির সামনে এসে দাঁড়িয়েছে আলোকসজ্জার লোক। গাছের গায়ে গায়ে বাল্ব লাগাচ্ছে তারা। বাড়ির বয়োজ্যেষ্ঠরা বারবার চেক করছে বরপক্ষের লোকজন ঠিক কখন আসবে।
সন্ধ্যার নিভৃতে মল্লিকবাড়ির উঠানে জমে উঠল বিয়ের আসর। চারপাশ আলোয় আলোকিত, ফুলে মোড়া। বরযাত্রীদের আগমনে মুখর হয়ে উঠেছে পরিবেশ। গ্রামের লোকজন আর আত্মীয়স্বজন সবাই মিলে একসঙ্গে আনন্দে মেতেছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই উর্মির বিয়ে সম্পন্ন হয়ে গেলো।
সকাল থেকে শুরু হওয়া আয়োজন আজকে বিকেলের এই মুহূর্তে সফল সমাপ্তি পেয়েছে। বর আর বউয়ের জন্য সাজানো গাড়ি আস্তে আস্তে প্রস্তুত। উর্মির মা আড়ালে বসে কাঁদছেন। একটু আগেই মা-মেয়ের কান্নাকাটি শুনে সবার মন খারাপ হয়েছিল। এখন উর্মিকে নিয়ে অরা, আনজুম বরের গাড়ির দিকে এগোচ্ছে।
অরা উর্মির কাঁধে হালকা হাত দিয়ে বলল,
“সাবধানে যাস, উর্মি। ভালো থাকিস। ”
উর্মি কিছু বলতে পারলোনা। অরাকে জড়িয়ে ধরলো শুধু।
বরপক্ষের লোকজন অপেক্ষায় আছে। উর্মি আর তার বর গাড়িতে উঠে বসলেন, হাতে হাত রেখে একে অপরকে অশ্রুস্নান করছিলেন। উঠানের লোকজন বিদায়ের শেষবারের মতো হাত নাড়ল।
গাড়িটি ধীরে ধীরে বাড়ির গেট থেকে বেরিয়ে আসলো। অরা, নয়না, আরিশ সবাই বিদায় জানালো। গাড়িটি ধীরে ধীরে মাটির পথ ধরে গ্রামের সড়ক পেরিয়ে অন্ধকারে মিলিয়ে গেলো নতুন জীবনের দিকে।
গ্রাম থেকে ফিরে এসেছে অরা আর আরিশ। গ্রাম্য বিয়ের উৎসব, কোলাহল, হাসি–আনন্দ পেছনে ফেলে এখন শহরের চেনা ছন্দে ফিরেছে তারা।
রাত তখন সাড়ে দশটা। লম্বা যাত্রায় ক্লান্ত হলেও অরার চোখে ঘুম নেই। স্যুটকেস থেকে জিনিসপত্র বের করে গুছিয়ে নিচ্ছিল সে। আরিশ শাওয়ার নিয়ে বেরিয়ে এল, চুল ভেজা, শরীরে কেবল তোয়ালে।
“ এখন এসব গোছাতে হবে না। ”
অরা পেছন ফিরে তাকিয়ে মৃদু হেসে বলল, “ সবকিছু কেমন এলোমেলো লাগছে, গুছিয়ে না নিলে শান্তি নেই ।”
আরিশ ধীরে ধীরে তার দিকে এগিয়ে এলো।
“ এলোমেলো শুধু বাসা না, এই দুইদিনে আমার ভিতরটাও এলোমেলো হয়ে গেছে।”
অরা কিছু বলার আগেই আরিশ তার পেছন থেকে এসে কোমর জড়িয়ে ধরল। গরম নিঃশ্বাস পড়লো ঘাড়ে। অরার শিরদাঁড়া বেয়ে শিহরণ বয়ে গেল।
“ আমি জানি, তুমি ক্লান্ত… কিন্তু বিশ্বাস করো, হামিংবার্ডে– তোমায় ছুঁতে না পারার যে আকুলতা নিয়ে ফিরেছি… সেটাই আমাকে আরও পাগল করে দিচ্ছে।”
“ আরিশ…” অরা হালকা কাঁপা গলায় বলল।
“ চুপ। কিছু বলো না। শুধু অনুভব করো।”
তার ঠোঁট ধীরে ধীরে অরার কানের কাছে নেমে এলো, তারপর ঘাড়ে। ঠোঁটে ঠোঁট ছোঁয়াতেই অরা চোখ বন্ধ করে ফেলল। সারা দেহে রক্তের স্রোত যেন উথলে উঠল।
আরিশ তাকে নিজের দিকে ফিরিয়ে নিয়ে বলল,
“ দুদিনের তৃষ্ণা আজ, এই মুহুর্তে মিটিয়ে দাও।”
অরা আর নিজেকে ধরে রাখতে পারলো না। সে নিজের সমস্ত অস্তিত্ব মেলে ধরল আরিশের সামনে। দু’জন ধীরে ধীরে বিছানার দিকে এগিয়ে গেল। শহরের নির্জন রাত্রি আর জানালা দিয়ে আসা হালকা বাতাসের ছোঁয়ায়, তারা একে অপরকে ছুঁয়ে দিল সমস্ত হৃদয় দিয়ে।
চাঁদের আলো ঘরের এক কোণে স্থির দাঁড়িয়ে থাকলো, আর তাদের দুটি দেহ ছায়ার মতো একাকার হয়ে মিলিয়ে গেল এক গোপন ভালোবাসার মহাকাব্যে।
চাঁদের আলো ঘরের এক কোণে স্থির দাঁড়িয়ে রইলো। আর তাদের দুটি দেহ ছায়ার মতো একাকার হয়ে মিলিয়ে গেল এক গোপন ভালোবাসার মহাকাব্যে।
রাত গভীর হলো। দু’জনেই নিঃশব্দে পাশে শুয়ে, একে অপরের নিঃশ্বাস শুনছে। অরা চোখ বন্ধ করে রাখলেও ঘুম আসছে না। আরিশের বুকের উপর মাথা রেখে ভাবছে– এই মানুষটার মাঝে হারিয়ে যেতে তার এত ভয় ছিল কেন?
আরিশ এক হাতে অরার চুলে বিলি দিতে দিতে বলল,
“তুমি জানো পাখি, এই মুহূর্তটার জন্য আমি কতোদিন ধরে অপেক্ষা করছিলাম?”
অরা নিরুত্তর। বুকের ওপর কানপেতে নিঃশব্দে আরও একটু কাছে সরে এলো। লজ্জায় যেন গলার ভেতর কথা আটকে গেছে।
আজ প্রথমবার অরা নিজ থেকেই আরিশকে আলতো করে আলিঙ্গন করেছিল। ঘনিষ্ঠতার মুহূর্তগুলোতে অরার কোমলতা আর আবেগময় প্রতিক্রিয়া আরিশের হৃদয় স্পর্শ করে গেছে অনেক গভীরভাবে। তার নিঃশব্দ কণ্ঠস্বর, শিথিলতা, আর নিজের অনুভূতি প্রকাশের সাহস এসব মিলেমিশে তৈরি করেছিল এক নতুন এক অন্যরকম অনুভূতির পরশ, যা আরিশের মধ্যে এক অসীম আনন্দ ও তৃপ্তির স্রোত বইয়ে দিয়েছিল। সে আজ খুব খুশি, কারণ অরা তার প্রতি যত্ন ও ভালোবাসা প্রকাশের জন্য নিজেকে পুরোপুরি উন্মুক্ত করেছে।
“ কী হলো পাখি? লজ্জা পাচ্ছো? নট ব্যাড! বাট এতো লজ্জাবতী পাখিটাও যে এতো….. “
অরা আরিশের ঠোঁটে আঙুল চেপে ধরে কথা থামিয়ে দিয়ে বলে,
“ আপনি আসলেই একটা বজ্জাত লোক। এসব নিয়ে আরকিছু বললে…..”
অরার কণ্ঠ থেমে গেলো। আরিশ তার কোমল ঠোঁটে ঠোঁট ছুঁইয়ে দিলো।
“ কিছু বলছি না আর। ঘুমাও। আগামীকাল অফিসে জরুরি কাজ আছে। সকাল সকাল উঠতে হবে। “
অরা কিছু না বলে আরিশকে আরেকটু গভীরভাবে জড়িয়ে ধরে চোখ বন্ধ করলো।
চলবে…..
#হামিংবার্ড
#তাসমিয়া_তাসনিন_প্রিয়া
#পর্ব_৬৭
সকালটা একটু ধীর গতিতে শুরু হয়েছিল আজ। তবে শহরের যানজট পেরিয়ে যখন আরিশ তার অফিসে পৌঁছাল, তখন ঠিক সাড়ে ন’টা। গেট থেকে ঢুকে অফিস বিল্ডিংয়ের লিফটে ওঠে। লিফট থেকে নেমেই অফিসের করিডোরে হেঁটে নিজের কেবিনে ঢুকে বসল সে। ডেস্কে বসেই প্রথম কাজ তার —ল্যাপটপ অন করা নয়, বরং ফোন খুলে অরার একটা ছবি দেখে নেয়া। এই ছবিটা ওদের গ্রামে থাকা সময় তোলা।
“তুমি জানো, তোমার এই ছবিতে তাকিয়ে থাকলে অফিসে বসেও শান্তি পাই। ”
মৃদু স্বরে নিজেকেই বলল আরিশ। দরজায় টোকা পড়তেই মাথা তুলে দেখে, শাওন দাঁড়িয়ে আছে ফাইল হাতে।
“স্যার, মিটিংয়ের সময় হয়ে গেছে। ক্লায়েন্ট ওয়েট করছেন কনফারেন্স রুমে।”
“আসছি, তুমি যাও।”
কিছুক্ষণ পর কনফারেন্স রুমে ঢুকলো আরিশ। কাঁচের দেয়ালঘেরা আধুনিক সেই রুমে আলো-ছায়ার খেলা চলছে। বড় স্ক্রিনে চলছে প্রেজেন্টেশন, আরিশ নিজের স্লাইডস উপস্থাপন করছে দৃঢ় কণ্ঠে। কিন্তু মাঝেমধ্যে তার চোখ স্লাইডের ভেতরের একটা লাইনে আটকে যায়, যেখানে লেখা—
“We design emotions that stay.”
মন যেন হুট করে অরার দিকে চলে গেলো।
আরিশ হালকা হাসে নিজের মনে।
“স্যার?”
“জি?”
“আপনি একটু গা-ছাড়া লাগছে। ঠিক আছেন তো?”
“হ্যাঁ, ঠিক আছি। একটু…আনমনা হয়ে গিয়েছিলাম। যাইহোক আবার শুরু করছি। ”
সবাই মুচকি মুচকি হাসছে। জীবনের প্রথম কর্মক্ষেত্রে এমন বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়তে হলো আরিশকে। বেচারা বউয়ের প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছে।
সামনে নয়নার এসএসসি পরীক্ষা।
স্কুলের মাঠে শেষ বিকেলের রোদে লালচে আভা ছড়িয়ে আছে। গাছে বসে কাক, দূরে খেলছে পঞ্চম-ষষ্ঠ শ্রেণির কিছু ছেলে-মেয়ে। স্কুলের বারান্দায় বসে আছে নয়না, রাণী আর তানহা –ওরা তিন বান্ধবী।
রাণী হাতে একটা ছোট আয়না ধরে নিজের মুখ দেখছে। কপালে টিপটা সোজা লাগছে কি না, বারবার ঠিক করছে। সাজগোজের বিষয় খুব সতর্ক সে। তানহা পাশেই বসে ছিলো। হুট করে বলল,
“আয়না ফেলে দে, পরীক্ষা সামনে। চেহারা নয়, এখন পড়াশোনার প্রস্তুতি দরকার।”
রাণী চোখ ঘুরিয়ে বলল,
“রচনার নাম যদি হয় ‘আমার প্রেম’ তাহলে আমি টপার হবো।”
তিনজনেই হেসে উঠল। হাসির ফাঁকেই তানহা নয়নার দিকে তাকিয়ে বলল,
“তোর চোখ কেমন যেন… শান্ত, কিন্তু বিষণ্ন। কী ব্যাপার রে? পলাশ ভাইয়ের কথা মনে পড়ছে?”
নয়না চমকে তাকাল তানহার দিকে। কিছু বলতে চেয়েও থেমে গেল। কয়েক মুহূর্ত চুপ থেকে বলল,
“ওর কথা তো ভুলিনি কখনো, তানহা। আমি শুধু ভাবি… ও এখন কেমন আছে। ভালো আছে কি না। আমাকে মনে পড়ে কি না… এসব।”
রাণী মুখে বাঁকা হাসি এনে বলল,
“তোর মতো মেয়েকে কেউ ভুলতে পারে?”
“তোর মনে হয় সে এখনো তোর কথা ভাবে?” জিজ্ঞেস করল তানহা।
নয়না আকাশের দিকে তাকিয়ে বলল,
“ভালোবাসলে মনে পড়ে, চাইলেও ভুলা যায় না। আমি এখনো প্রতিদিন তার দেখা পাওয়ার আশায় স্কুলের গেটের দিকে তাকাই। হয়তো একদিন হঠাৎ চলে আসবে। দুই বছর হওয়ার আগেই হয়তো চলে আসবে– মাঝে মধ্যে এসব মনে হয়। ”
রাণী আর তানহা এবার আর ঠাট্টা করলো না।
তানহা ধীরে নয়নার হাতটা চেপে ধরল। বান্ধবীর মন খারাপের পাল্লা কতখানি তা দু’জনেই অনুভব করতে পারছে।
“তুই কি তাহলে এখনো ওর জন্য অপেক্ষা করছিস?”
নয়নার চোখে জল চিকচিক করল, কিন্তু মুখে হাসি রাখল সে।
“আমি নিজেও জানতাম না, আমি তার জন্য এভাবে অপেক্ষা করবো। আমি কাউকে বলিনি আমার এই দূর্বলতার কথা। আজ বললাম, তুই-রাণী ছাড়া কেউ জানেও না। আমি অপেক্ষা করছি না, আমি প্রার্থনা করি— যেন নির্দিষ্ট সময়ে মানুষটা সুস্থভাবে আমার কাছে ফিরে আসে। ”
কিছুক্ষণ চুপচাপ কাটল। হঠাৎ সেখানে তাদের এক ক্লাসমেট এসে জানালো দু’দিন পর প্রি-টেস্ট পরীক্ষা শুরু হবে। তানহা হেসে বলল ,
“ভালোবাসা গেল, এবার পরীক্ষার প্রেমে পড়!”
রাণী বলল,
“হ্যাঁ, আর যদি পরীক্ষার রেজাল্ট ভালো না আসে, পলাশ ভাই তোকে নেবে না!”
নয়না হেসে ফেলল এবার। মনের গভীর শূন্যতায় একফোঁটা রোদ পড়ে গেলে যেমন হয়, তেমন শান্তি লাগল তাকে।
তিনজন একসাথে ব্যাগ কাঁধে ঝুলিয়ে বেরিয়ে পড়ল স্কুলের গেট পেরিয়ে। নয়নার চোখ আবার একবার ঘুরে গেল ডান পাশে, যেখানে একসময় পলাশ দাঁড়িয়ে থাকত।
আজ সে কোথাও নেই। তবুও নয়না জানে, তার হৃদয়ের উঠোনে এখনো পলাশের একটা বসার জায়গা ফাঁকা পড়ে আছে।
সন্ধ্যাবেলা। ড্রইং রুমে বসে টিভিতে নিউজ দেখছে অরা। দেশের পরিস্থিতি ভালো না। হ ত্যা, ধ র্ষ ণ, চাঁদা*বাজি সবকিছুই বেড়ে গেছে। চব্বিশের জুলাই যেন ফের ধরা দিয়েছে পঁচিশে এসে। অরার কোমল হৃদয় এসব নিতে পারে না। র*ক্ত দেখলেই সেদিনের দূর্ঘটনার কথা মনে পড়ে যায়। সেই সিড়ি থেকে পড়ে যাওয়া…. তারপর র*ক্ত… আর! আচমকাই চিৎকার করে ওঠে অরা। রান্নাঘরে তামান্না চা তৈরি করছিল । আচমকা অরার চিৎকার শুনে আঁতকে উঠল সে। কাজকর্ম সব রেখে ছুটে ড্রইং রুমে পৌঁছে দেখল অরা অবচেতন অবস্থায় ফ্লোরে লুটিয়ে পড়ে আছে।
“ ভাবি! ভাবি! কী হলো আপনার? “
তামান্না ব্যস্ত হয়ে উঠল। অরার মাথাটা নিজের কোলে নিয়ে বারবার ডাকতে লাগলো তাকে। এরমধ্যে তামান্নার গলার আওয়াজে সাবিহা ও তাসলিমা খাতুনও ড্রইং রুমে চলে এসেছেন। অরাকে এভাবে পড়ে থাকতে দেখে তারা-ও ঘাবড়ে গেলো।
“ ভাবি, অরা ভাবির কী হয়েছে? “
সাবিহাও অরার পাশে বসেছে। তাসলিমা খাতুন দাঁড়িয়ে আছেন।
“ আমি জানি না আপা। রান্নাঘরে ছিলাম, আচমকাই ভাবির চিৎকারের শব্দ পেলাম। তারপর এসে দেখি!”
“ সোফায় তুলে বসা অরাকে, আমি আরিশকে কল করে আসছি। “
তাসলিমা খাতুন ফোন করার উদ্দেশ্য পা বাড়ানোর সাথে সাথে কলিংবেলের শব্দ ভেসে এলো। তামান্না বলল,
“ ভাইয়া চলে এসেছেন, হয়তো। “
“ আমি যাচ্ছি, দরজা খুলে দিচ্ছি। “
তাসলিমা খাতুন গিয়ে দরজা খুলতে এগোলেন। এদিকে সাবিহা ও তামান্না মিলে ধরাধরি করে অরাকে সোফায় তুলে বসিয়েছে।
[ পরবর্তী পর্বে এই পেইজে পাবেন- https://www.facebook.com/Kaathgolaaap ]
দরজার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা আরিশের মুখভঙ্গি দেখে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছিল, সে কিছুটা ক্লান্ত। অফিসের টানা কাজ শেষে ফিরেছে। কিন্তু তাসলিমা খাতুনের মুখের আতঙ্ক আর কণ্ঠে উদ্বেগ শুনে মুহূর্তেই তার চোখের ভাষা পাল্টে গেলো। তালহা তার পাশে দাঁড়িয়ে আছে।
“ আরিশ, অরা বেহুঁশ হয়ে গেছে!”
তাসলিমা খাতুন দরজার দিকে ইশারা করে তাড়াহুড়ো করে বললেন। আরিশ এক মুহূর্ত দেরি না করে জুতো খুলে ছুটে গেলো ড্রইং রুমে।
অরাকে সোফায় হেলান দিয়ে বসিয়ে রেখেছে তামান্না ও সাবিহা। চোখদুটো বন্ধ, মুখটা কেমন ফ্যাকাশে। হালকা ঘেমে গেছে কপাল। ভাইয়ের পেছন পেছন তালহাও দৌড়ে এসে দাঁড়াল একপ্রকার।
“অরা!”
আরিশ ছুটে গিয়ে তার সামনে হাঁটু গেড়ে বসলো। কপালের ঘামটা মুছে দিয়ে নাম ধরে ডাকল বারবার।
“এই কী হলো তোমার? চোখ খোলো, প্লিজ… এই পাখি!”
তার কণ্ঠে ভয় আর উদ্বেগ মিশে গিয়ে যেন পুরো ঘরে কাঁপন তুলল।
তামান্না বলল, “টিভিতে একটা র*ক্তাক্ত লাশের ছবি দেখাচ্ছিল, সম্ভবত সেদিকে তাকিয়ে আচমকা চিৎকার করে উঠেছিল ভাবি। আমি রান্নাঘরে ছিলাম। ”
আরিশ থমকে গেলো। ঠোঁট চেপে ধরলো।
তার মুখের পেশীগুলো শক্ত হয়ে উঠল। মুহূর্তে মাথার ভেতর ঝড় উঠে গেলো– সেই পুরোনো স্মৃতি, সেই সিঁড়ি থেকে পড়ে যাওয়া, হাসপাতালের করিডোরে অপেক্ষা করতে থাকা তার নিঃসহায় মুখ। অরার কোল থেকে সেদিন হারিয়ে যাওয়া ভ্রূণটা আজও তাকে তাড়া করে ফেরে। হয়তো সেসব স্মৃতি অরাকে আজও মানসিকভাবে ভোগাচ্ছে। ডাক্তার তখনই বলেছিল – অরার মানসিক ট্রমা কাটতে অনেক সময় লাগবে।
“আমার অরাকে এসব কেন দেখতে দিলে তোমরা? ”
আরিশের কণ্ঠে কষ্ট আর রাগের দাগ। চোখ লাল হয়ে গেছে তাট। সে আবার অরার মুখের দিকে তাকাল। হুট করেই কোলে তুলে নিলো। তালহা ডাক্তারকে কল কর, ফাস্ট!
” কল করেছি আমি। উনি আসছেন। ”
স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়ল আরিশ। অরাকে নিয়ে বেডরুমের দিকে এগোল।
বাড়ির সবাইও আরিশের পিছুপিছু যেতে লাগলো।
রাত প্রায় আটটা বাজে। তাহলার ফোন পেয়ে তড়িঘড়ি করে ছুটে এসেছেন ডা. শেলিনা আক্তার।
এতক্ষণ ভালো করে অরাকে পর্যবেক্ষণ করেছেন তিনি। আরিশ অরার মাথার পাশে বসে আছে। বাকিরা দাঁড়িয়ে আছে ঘরের এককোনায়।
ডা. শেলিনা মাথা হেঁট করে একটুখানি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন,
“এই রকম রেসপন্স সাধারণত কোনো মানসিক ট্রমা থেকে আসে। আমি জানি, ও আগেও একটা দুর্ঘটনায় গর্ভপাতের শিকার হয়েছিল। সেই সময়ের স্মৃতি, রক্তের ভয়, আর মানসিক চাপ মিলিয়ে এই ধরনের রিয়্যাকশন আসতে পারে।”
আরিশ যেন গিলতে পারল না কথাগুলো। মুখ শক্ত হয়ে গেল। যা ভেবেছিল তাই হলো।
“এটা পোস্ট ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিজঅর্ডার (PTSD) এর অংশ হতে পারে।”
ডা. শেলিনা ব্যাখ্যা করলেন,
“ওর স্নায়ু এখন অনেক বেশি সংবেদনশীল। একটু ভয়, অথবা রক্তের মতো কিছু দেখলেই তার মধ্যে আতঙ্ক জন্ম নিচ্ছে। সেই কারণেই বেহুঁশ হয়ে যায়। ভালো করে বিশ্রাম দিতে হবে। প্রয়োজনে একজন সাইকোলজিস্টের সঙ্গে কথা বলানো উচিত।”
আরিশ বলল, “কী করলে ভালো হবে? প্লিজ, ওকে সুস্থ করতে হবে। ”
“সবার আগে ওর মানসিক শান্তি দরকার। মানসিক চাপ দেওয়া যাবে না। কিছু হালকা ঘুমের ওষুধ দিচ্ছি, রাতে ভালো ঘুম হলে মাথা ঠান্ডা থাকবে। আর, কেউ যেন ওর সামনে এসব ভয়াবহ খবর বা আলোচনার প্রসঙ্গ না তোলে। বুঝেছেন?”
” আমি ব্যবস্থা নেব, ডক্টর। ওর সামনে এমন কিছু আর আসতে দেবো না।”
আরিশের গলায় দৃঢ়তা। ডা. শেলিনা হালকা হাসলেন।
“আমি জানি মিস্টার খান। আপনার মনোযোগই এখন ওর সবচেয়ে বড় ওষুধ।”
আরিশ কিছু বলল না। ডাক্তার শেলিনা আক্তার বসা থেকে উঠতে উঠতে বললেন,
” তাহলে আমি আসছি। ঔষধ দিয়েছি যেগুলো ওগুলো খাওয়াবেন। আপাতত ভয়ের কিছু নেই। ”
” থ্যাংক ইউ ডক্টর। তালহা উনাকে গাড়িতে উঠিয়ে দিয়ে আয়, জলিলকে বল ঠিকমতো পৌঁছে দিয়ে আসতে। ”
” ঠিক আছে, ভাইয়া। ”
তালহা ডাক্তার শেলিনাকে নিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে গেলো। বাকিরাও রুম থেকে চলে যাওয়ার পর আরিশ অরাকে ধরে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল। আচমকা অরাকে ওভাবে পড়ে থাকতে দেখে আরিশের যেন হৃৎস্পন্দন থেমে যাচ্ছিল।
চলবে…..