#হামিংবার্ড
#তাসমিয়া_তাসনিন_প্রিয়া
#পর্ব_৬৮
[ পর্বটি রোমান্টিক। ]
তালহা ডাক্তার শেলিনাকে নিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে গেলো। বাকিরাও রুম থেকে চলে যাওয়ার পর আরিশ অরাকে ধরে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল। আচমকা অরাকে ওভাবে পড়ে থাকতে দেখে আরিশের যেন হৃৎস্পন্দন থেমে যাচ্ছিল।
ঘুমন্ত অরার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে আরিশ। একহাতে অরার হাত ধরে রেখে অন্য হাত দিয়ে, অরার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে সে।
” আরিশ..ভাইয়া তুমি ফ্রেশ হয়ে এসো। আমি ততক্ষণ ভাবির সাথে আছি। ”
সাবিহার কথায় কোনো হেলদোল নেই আরিশের। তার সমস্ত মনোযোগ যেনো অরার দিকেই। সাবিহা চুপচাপ কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলো। তারপর আবার বলল,
” ভাইয়া?”
” তুমি যাও সাবিহা। আমার ফ্রেশ হওয়ার দরকার নেই। ”
সাবিহা মাথা নেড়ে, ধীরপায়ে রুম থেকে বেরিয়ে গেলো।
আরিশ ওভাবেই বসে রইলো, চোখ ছলছল করছে তার। মনে ভয় কাজ করছে। অরা যদি আবারও তাকে দোষারোপ করে, দূরে সরে যায়? তাহলে আরিশ কী করবে! ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে সে। পাগলের মতো অরার কপালে, হাতে ঠোঁট ছুঁইয়ে দেয় অনেকবার। কান্না মিশ্রিত কণ্ঠে বলে,
” পাখি রে আমি বড্ড অসহায়। তোমার সাথে দেখা হওয়ার আগে আমি এমন ছিলাম না। তোমাকে ভালোবেসে আমি এমন হয়েছি৷ আমার… আমার মনে হচ্ছে, তুমি আমার সাথে না থাকলে আমি নিঃশ্বাস নিতে পারবোনা। আমি অনেক ভুল করেছি, জানি এবং মানি। কিন্তু সবকিছুর বিনিময়ে হলেও তোমাকে ছাড়তে পারবোনা আমি। তোমার সাথে দূরত্ব তৈরি হলে আমি সহ্য করতে পারবোনা। ”
আরিশ নিজে নিজে অনেক কথা বলতে থাকে। একটা সময় ক্লান্ত শরীরে ওভাবেই ঘুমিয়ে পড়ে। অবচেতন অরা যদি জানতো, তার জন্য এক উন্মাদ কতটা ভাবে, ভালোবাসে!
আলতো করে চোখ খুলল অরা। জানালার ফাঁক গলে ভেতরে ঢুকে পড়েছে সকালের নরম আলো। মাথার পাশে বসে আছে আরিশ, একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তার দিকে। চোখে ক্লান্তি, কিন্তু মুখে একফোঁটা শান্তি।
“আপনি… রাতে ঘুমাওনি?”
আরিশ মৃদু হাসল।
“ঘুমিয়েছি। কিন্তু ঘুমানোর সময় চোখ তো বন্ধ হয়েছিল, মন তো না।”
অরা চোখ নামিয়ে নিল। একটুখানি সময় নীরবতা থাকলো। তারপর আরিশ বলল,
“পাখি, ভয় পেয়েছিলাম খুব। এখন কেমন লাগছে? ”
অরা শোয়া থেকে উঠে বসলো, আরিশ তাকে ধরে আছে।
” এখন ঠিক আছি। ”
” ভয় পেয়ে গেছিলাম আবার যদি আমার থেকে দূরে চলে যাও…”
“না!”
আচমকা বলে উঠল অরা। চোখের কোণে জল জমে উঠেছে।
“আমি আপনাকে ছেড়ে কোথাও যাবো না। ভয় পেয়েছিলাম আমিও। মনে জমে থাকা রক্তাক্ত স্মৃতিগুলোকে…বড্ড ভয় পেয়েছিলাম আরিশ।
আরিশ নিজের হাতের তালুতে অরার হাত রাখলো।
“তোমাকে আবার সেই রাতের স্মৃতি আঘাত করেছে। নিজেকে বড্ড অপরাধী মনে হচ্ছে। ”
” এসব বলবেন না। ভুল তো আমারও ছিলো। আমি তো মা হতাম, মায়ের তো সবচেয়ে বেশি দায়িত্ব থাকে। অথচ আমি…. আমি বাচ্চার কথা না ভেবে আপনাদের ঝামেলার মধ্যে গিয়ে দাঁড়ালাম। ”
কথা বলতে বলতে ঠুকরে কেঁদে ওঠে অরা। আরিশ তাকে বুকে জড়িয়ে ধরে, কপালে চুমু খায়।
” কান্না করে না, হামিংবার্ড। সবকিছু তকদীর। আমাদের কপালে সে ছিলো না। কিন্তু….. ”
অরা মাথা উঁচু করে তাকিয়ে শুধালো,
” কিন্তু কী?”
“ আমরা আবারও ট্রাই করতে পারি। “
আরিশের দুষ্ট হাসি দেখে অরা লজ্জায় মাথা নিচু করে ফেলল। আরিশ তাকে বুকে জড়িয়ে ধরে বলল,
“ চলো, ফ্রেশ হয়ে নেবে। “
“ আপনিও চলুন, গোসল সেরে নিবেন। “
“ গোসল? তুমি অসুস্থ ছিলে। তাহলে গোসল করা জরুরী নয়।“
অরা আরিশের থেকে দূরে সরে বসলো। চোখমুখ কুঁচকে ফেলল।
“ জরুরী না হলেও করতে হবে। সব ঘামের গন্ধ….. “
অরার কথা শুনে আরিশেরও খেয়াল হলো, গতকাল রাতে অফিস থেকে ফেরার পর আর জামাকাপড় চেঞ্জ করা হয়নি তার। নিজের দিকে তাকিয়ে চোখমুখ কুঁচকে ফেলল আরিশ। চেহারায় বিরক্তিকর ছাপ ফুটিয়ে বসা থেকে উঠে দাঁড়াল।
“ ভুলেই গিয়েছিলাম। উফ! তুমি এতক্ষণ কীভাবে আমার সাথে ছিলে পাখি? “
“ আমার মন অনেক বড়ো, এজন্য। “
দু’জনেই একসাথে হেসে উঠল।
“ আমি ফ্রেশ হয়ে আসছি। “
“ যান। “
আরিশ ওয়াশরুমে ঢুকতেই অরা বিছানা ত্যাগ করলো। ধীরপায়ে ঘর থেকে বেরিয়ে রান্নাঘরের দিকে এগোল।
দুপুরের রোদ ঘরের জানালা গলে নরম করে ছুঁয়ে যাচ্ছে ফ্লোর। বাতাসে হালকা গরম ভাব। পাশের রুমে ঘড়ির কাঁটা টিকটিক শব্দ করছে, কিচেন থেকে ভেসে আসছে রান্নার হালকা ঘ্রাণ।
রান্নাঘর থেকে তামান্না খাবার গরম করে আনছে। ডাইনিং টেবিলে অরা বসে আছে,সাবিহার সাথে কথা বলছে সে। আজ আরিশ ঘরে থেকে অফিসের কিছু কাজ সেরে নিচ্ছে। অরাকে রেখে অফিসে যায়নি সে। তাসলিমা খাতুন পাশে বসে বললেন,
“আজ তোমাকে হাসতে দেখে ভালো লাগছে। এখন শরীর কেমন লাগছে? ”
“ আলহামদুলিল্লাহ, চাচি। “
“ যাক আলহামদুলিল্লাহ। ছেলেমেয়ে অসুস্থ থাকলে মায়ের মন বড্ড অস্থির লাগে। “
অরা কিছু বলল না। তার চোখে এখনো অল্প জলের আভা, কিন্তু মুখে একটা দৃঢ়তা।
এমন সময় তালহা ও তামান্না এসে বসলো টেবিলে।
তালহা বলল,
“ ভাবি মা, ঘুরতে গেলেই মনটা ভালো লাগবে… দুইদিনের জন্য ভাইয়াকে নিয়ে কোথাও থেকে ঘুরে আসো। তোমার রিফ্রেশমেন্ট দরকার।”
তামান্না চুপচাপ পাশে বসে ছিল। হঠাৎ বলল,
“ হ্যাঁ ভাবি, সাজেক থেকে ঘুরে আসুন। ”
সাবিহাও তালে তাল মিলিয়ে বলল,
“ হ্যাঁ ভাবি, তোমরা ঘুরে এসো। “
(পরবর্তী পর্ব এই পেইজে পাবেন- https://www.facebook.com/Kaathgolaaap)
ইতিমধ্যে আরিশ এসে উপস্থিত হয়েছে। সবার কথাবার্তা শুনে কথার সারমর্ম কী সেটা বুঝতে সময় লাগেনি তার৷
“ তোমাদের ভাইয়াকে বলবো। “
আরিশ ধীরপায়ে ডাইনিং টেবিলের কাছে এসে দাঁড়াল, অরার পাশের চেয়ারটা টেনে বসতে বসতে বলল,
“ ঠিক আছে। তুমি বললে আগামীকালই যাবো। “
অরা কেবল মাথা নেড়ে সম্মতি জানাল। সবাই মুচকি মুচকি হাসল। অরা চাইবে আর আরিশ তাতে ‘না’বলবে এটা কখনো সম্ভব? সম্ভব না। তাসলিমা খাতুন এতক্ষণে খাওয়া শেষ করে ফেলেছেন।
“ তাহলে তাই করো আরিশ। তোমরা ফিরে আসার পরই ওদের দুই ভাইবোনের বিয়ে নিয়ে ভাববো। “
সবাই খাবার খেতে খেতে কথা বলছে। আরিশ বলল,
“ আমি মেহরাবের সাথে কথা বলেছিলাম। বলল, অফিসে কীসব ঝামেলা হয়েছে ওর৷ কিছুদিন যাক, তারপর জানাবে। “
সাবিহার মুখটা কেমন মলিন হয়ে গেলো। মেহরাব যতই বলুক কিছু হয়নি, সাবিহা ভালো করেই বুঝতে পারে সব। মেহরাবের মা একটু অন্যরকম মানুষ। উনাকে মানানো ঝামেলা । প্রথমে বিয়ের জন্য রাজি হলেও উনার অপারেশনের সময় সাবিহার না যাওয়াতে বেঁকে বসেছেন। অবশ্য এখানে সাবিহার তেমন দোষ নেই, আবার আছেও বলা যায়। মেহরাব যেমন নিজে থেকে কিছু বলেনি, তেমনই সাবিহাও কখনো তার পরিবারের লোকজনের বিষয় তেমন খোঁজ নেয়নি। ফলশ্রুতিতে এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে।
“ ঠিক আছে। “
তাসলিমা খাতুন কথা শেষে নিঃশব্দে ডাইনিং রুম থেকে চলে গেলেন। আরিশ, অরার ঘুরতে যাওয়া নিয়ে বাকিরা নিজেদের মধ্যে কথা বলতে থাকলো।
পড়ন্ত বিকেল। শহর থেকে কিছুটা দূরে অবস্থিত গ্রাম। সেই গ্রামের এক প্রকাণ্ড বড় বটবৃক্ষের নিচে বসে আছে পলাশ। পরনে তার সাদামাটা লুঙ্গি, সাথে টি-শার্ট। আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে সে। মনটা বড্ড খারাপ লাগছে। কতগুলো মাস পেরিয়ে গেলো, কতকিছু ঘটে গেলো তার জীবনে। মানুষের জীবন বড় অদ্ভুত। কখন কী ঘটে যায় বলা যায় না। সময় বয়ে চলে যাচ্ছে অথচ আজ পর্যন্ত নয়না কোনো যোগাযোগ করলোনা। ভেবেছিল নয়নাও তাকে পছন্দ করে, ভালোবাসে। কিন্তু তার ধারণা কতটা ভুল সেটা এতদিনে বুঝে গেছে পলাশ।
“ পলাশ! “
আচমকা মামির কণ্ঠস্বর শুনে আঁতকে উঠল ছেলেটা। বসা থেকে দ্রুত উঠে বাড়ির দিকে এগোল। মনের ভেতর ভয় তার। হয়তো আবারও তার মা পাগলামি শুরু করেছে!
ঢাকার গরম আর একঘেয়ে ধুলোবালির শহুরে ক্লান্তি থেকে খানিকটা মুক্তি পেতে এবং অরার ইচ্ছে পূর্ণ করতেই আরিশ সাজেক যাওয়ার পরিকল্পনা করেছে। আগামীকাল সকালে তারা রওনা হবে। সেজন্য প্রয়োজনীয় সবকিছু প্যাক করে নিচ্ছে অরা। আরিশ বিছানায় বসে আছে।
” সবকিছু ঠিক আছে? ”
” ঠিকই তো দেখছি!”
আরিশ অরার দিকে গভীরভাবে তাকিয়ে বলল। অরা নিজের দিকে তাকাতেই দেখল, পেটের শাড়ি সরে গিয়ে কিছুটা অংশ দেখা যাচ্ছে। দ্রুত সেটা ঠিক করে ফেলে অরা। কিন্তু আরিশ উঠে তার কাছে গিয়ে শাড়িটা আবারও সরিয়ে ফেলল।
” আপনি ভালো হোন। ”
” সরি,বেবি। যা বলো সবকিছুই করবো কিন্তু ভালো হতে পারবোনা। ”
ভেংচি কাটল অরা। আরিশ মুচকি হেসে অরার একটা হাত ধরে টেনে নিল নিজের দিকে, তারপর সেটি আলতো করে অরারই পিঠে চেপে ধরল। এরপর সে অরার ঘাড়ের ওপর থেকে চুলগুলো সরিয়ে দিল এক পাশে।
” আরিশ! এখন কাজ করছি….”
” আমিও কাজ করছি, ডার্লিং। ইট’স ভেরি ইম্পর্ট্যান্ট। ”
হাল ছেড়ে দিলো অরা। আরিশ তার ঠোঁটের উষ্ণ স্পর্শ ছড়িয়ে দিলো তার ঘাড়ে।
” আউচ! আরিশ… লাগছে আমার। ”
অসাবধানতাবশত আরিশ একটু কামড়ে ফেলেছে, দাঁতের চাপে ঘাড়ে লালচে দাগ পড়ে গেছে। ব্যাপারটা বুঝতে পেরে আরিশ সঙ্গে সঙ্গে অরাকে ছেড়ে দিল। অরা মুখ গোমড়া করে রইলো।
” সরি, পাখি! আমি.. আমি আসলে বুঝতে পারিনি। ”
” আপনার স্বভাব আর বদলাতে পারলেন না। মাঝখানে যে কিছুদিন রেহাই পেয়েছিলাম সেটাই অনেক। ”
অরার এমন কথা শুনে শব্দ করে হেসে ফেলল আরিশ।
” যাক অবশেষে তুমি আমাকে মেনে নিয়েছো। ”
ড্রেসিং টেবিলের সামনে থেকে ফাস্ট এইড বক্সটা নিয়ে এলো আরিশ। চুপচাপ এসে দাঁড়াল অরার পেছনে, তারপর এক হাতে তার চুল সরিয়ে দিল কাঁধের এক পাশে। ঘাড়ের লালচে দাগটা দেখে তার চোখে খেলে গেল অনুশোচনা।
“সরি, পাখি, আজকে একটু বেশিই হয়ে গেল।”
মৃদু স্বরে বলল সে। কথা না বলে অরা বসে রইল। আরিশ হাতের আঙুলে একটু মলম নিয়ে ঘাড়ে আলতো করে লাগাতে লাগল। তার স্পর্শে অরার শরীর কেঁপে উঠল এক অজানা শিহরণে।
ঘাড়ে মলম লাগানোর সময়, আরিশের মুখটা খুব কাছে চলে এলো।
“তোমাকে ব্যথা দেওয়া আমার ইচ্ছা ছিল না পাখি। কিন্তু তুমি জানো আমার ভালোবাসা এমনই, বিষাক্ত।
অরার ঠোঁট কেঁপে উঠল, কিন্তু কিছু বলল না। চোখে তার এখনও অভিমান। আরিশ তখন খুব ধীরে ঘাড়ে একটা চুমু খেলে দিল।
” ইট’স ওকে। কী আর করার… এরপর থেকে এমন করলে দাঁত ভেঙে ফেলবো হু। ”
অরার কথায় হাসতে লাগলো আরিশ। অরা কিছু বলল না। আরিশের সাথে কথা বলা বন্ধ করে আবারও ল্যাগেজ গোছাতে ব্যস্ত হয়ে উঠলো সে।
ভোর চারটায় এলার্ম ঘড়ি বেজে ওঠার আগেই অরা উঠে পড়েছে। গতকাল রাতেই স্যুটকেস গোছানো, তবুও মনে হচ্ছে – কিছু ভুলে গেল না তো? আরিশ ঘুমঘুম চোখে দাঁড়িয়ে ব্রাশ করে, ফ্রেশ হয়ে রুমে এলো। অরা দাঁড়িয়ে সবকিছু দেখছে। ঢাকা শহরের ব্যস্ত সড়ক এড়াতেই সকাল সকাল বের হবে তারা। কারণ সকালবেলা তূলনামূলক রাস্তা ফাঁকা থাকে।
” সবকিছু গোছানো হয়েছে। আমি হালকা নাস্তা তৈরি করে সাথে নিচ্ছি, আপনি রেডি হোন। ”
“তোমার যা সাথে নেওয়ার নাও, আমি শুধু তোমাকে নিয়ে যাচ্ছি। বাকিটা ভুললেও চলবে।”
অরা মুচকি হাসল শুধু।
ভোর সাড়ে পাঁচটায় তারা বেরিয়ে পড়লো। রোদের ঝিলিক এখনও ওঠেনি, আকাশ কেবল ফ্যাকাশে হয়ে উঠছে। গাড়িতে বসে অরা জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আছে। শহর এখনো ঘুমিয়ে।
আরিশ ড্রাইভ করছে, পাশের সিটে অরা হালকা ঘুমে ঢুলছে। রাস্তায় চলতে চলতে কুমিল্লা পর্যন্ত এসে নাশতার বিরতি। পরোটা, ভুনা মাংস আর গরম চা। অরার চোখ তখনও আধো ঘুমে, কিন্তু মন ফুরফুরে।
“ জানেন, আমি সাজেকে কখনো যাইনি।” বলল অরা।
“ তাহলে তো ভালোই হলো। আমার সাথে প্রথম যাবে। ” মুচকি হেসে উত্তর দিল আরিশ।
দুপুর নাগাদ তারা পৌঁছে গেল খাগড়াছড়ি হয়ে সাজেক যাওয়ার রিজার্ভ জিপ স্ট্যান্ডে।
পাহাড়ি পথে ঝাঁকুনি খেতে খেতে চারপাশে ছড়িয়ে থাকা সবুজের মাঝে হারিয়ে যেতে লাগলো তারা। পথের বাঁকে বাঁকে মেঘ হাত ছুঁয়ে যাচ্ছে। কখনও ঝিরঝির বৃষ্টি, কখনও গাঢ় রোদ।
সাজেক পৌঁছে কটেজে চেক-ইন করার সময় পাহাড়ের ঢালু বেয়ে বাতাস বয়ে আসছিল। কাঠের রুম, জানালার বাইরে সবুজে ঢাকা পাহাড় আর নিচে মেঘের সাদা আস্তরণ।
অরা বারান্দায় দাঁড়িয়ে বলল,
“এটা যেন কোনো স্বপ্নপুরী!”
আরিশ তার পেছনে গিয়ে হাত রাখলো কাঁধে, বলল,
“স্বপ্ন নয়, এটা আমাদের নিজের করে নেওয়া একটা শান্তির জায়গা। তুমি আর আমি।”
রাতে তারা আগুন জ্বালিয়ে বসলো কটেজের সামনে। পাহাড়ি কফি আর ঝিরঝির ঠান্ডা বাতাসে জমে উঠল কথাবার্তা। তারা দুইজনে পাশাপাশি বসে মেঘে ভেসে যাওয়া চাঁদের আলো দেখল। কল্পনার থেকেও বেশি শান্ত লাগছিল।
চলবে…
#হামিংবার্ড
#তাসমিয়া_তাসনিন_প্রিয়া
#পর্ব_৬৯
ক্যাফের এক কোণার টেবিলে মুখোমুখি বসে আছে মেহরাব ও সাবিহা। কফি ঠাণ্ডা হয়ে গেছে, কিন্তু তাদের দুজনের কথাবার্তার ভেতর জমাট অনুভূতির উত্তাপ গাঢ় হয়ে আছে।
“তুমি কী চাও মেহরাব? আমি তোমার জীবনে থাকি, না তোমার মা খুশি থাকেন?”
সাবিহা চোখে চোখ রেখে প্রশ্ন করলো। মেহরাব ধীরে কিছুটা গাম্ভীর্যের সঙ্গে জবাব দিলো,
“তোমাকে ভালোবাসি সাবিহা। সেটা তোমার চোখে চোখ রাখেই বলতে পারি। কিন্তু মা আমার জীবনের শিকড়। আমি মাকে আঘাত দিয়ে কোনো সুখ পেতে চাই না। আবার তোমাকে হারিয়ে নিঃস্বও হতে চাই না।”
সাবিহা নীরবে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল।
“তুমি বুঝতে পারো, আমি তোমার জায়গায় কেবল একজন বহিরাগত হয়ে গেছি এখন?”
মেহরাব নরম গলায় বলল,
“তুমি বহিরাগত নও। তুমি সেই মানুষ, যার স্বপ্ন আমি দেখতাম। কিন্তু বাস্তবতা এত সহজ না।
মা একা মানুষ। সারাজীবন আমাকে আগলে রেখেছে। তার অনুভূতিও সত্যি। আর তোমার অভিমান, তাও সত্যি। তোমরা দু’জনেই আমার জন্য গুরুত্বপূর্ণ সাবিহা।”
সাবিহার চোখ ছলছল করছে। মনে হচ্ছে বিয়ের আগেই তার শ্বাশুড়ি মেহরাবকে তার থেকে কেড়ে নিচ্ছে।
“তুমি কি তাহলে সবসময় ব্যালান্স করে যাবে?”
মেহরাব চোখ নামিয়ে বলে,
“আমি চাই, তুমি বুঝো—এটা ভালোবাসার ভারসাম্য নয়, এটা দায়িত্বের ভারসাম্য।
মা আর তোমার মাঝে কোনো তুলনা করি না আমি। মা আমার অতীত,বর্তমান, শিকড়। তুমি আমার ভবিষ্যৎ, আশ্রয়। আমি চাই, তোমরা দুজনেই থাকো– আমার দুই চোখের মতো।”
সাবিহা শান্ত, নরম গলায় বলল,
“তাহলে আমাকে কখনো একা ফেলে দিও না, চুপ থেকো না। তোমার চুপ থাকাটাই আমাকে সবচেয়ে বেশি কষ্ট দেয়, মেহরাব। ভয় হয়।”
মেহরাব হালকা হাসি দিয়ে সাবিহার হাত ধরল।
“আমি কথা দিচ্ছি, তোমার পাশে থেকেও মা’কে ভালোবাসবো, আর মাকে আগলে রেখেও তোমাকে বুঝবো। তুমি শুধু আমায় একটু সময় দাও।”
সাবিহা হাসল, মেহরাবের হাতে হাতটা শক্ত করে চেপে ধরে বলল,
” তুমি সময় নাও। আমিও চেষ্টা করবো মা’কে বোঝানোর। সত্যি বলতে আমার খারাপ লাগছে, মায়ের অসুস্থতার সময় যাইনি বলে। ”
” ভুলটা আমার ছিলো। আমার বলা উচিত ছিলো। তবুও যা হওয়ার হয়ে গেছে। এখন আমাদের একসাথে মাকে বোঝাতে হবে। ”
সাবিহা মেহরাবের দিকে ছলছল নয়নে তাকিয়ে আছে। মানুষটা তাকে কতটা ভালোবাসে ভাবলেই কতটা শান্তি লাগে সাবিহার। মেহরাব সাবিহার হাতে আলতো করে ঠোঁট ছুঁইয়ে দিলো। মেয়েটা আশেপাশে তাকিয়ে লজ্জায় মাথা নিচু করে ফেলল।
সাজেকের রাত অন্যরকম। দিনের তুলনায় অনেক শান্ত, নিস্তব্ধ। পাহাড়ে রাত নামলে সঙ্গে সঙ্গে তাপমাত্রা কিছুটা কমে যায়। বাতাস হয়ে ওঠে ঠান্ডা আর স্নিগ্ধ। চারদিকে সবুজ পাহাড় আর মেঘে ঢাকা উপত্যকা অন্ধকারে মিলিয়ে যায়, শুধু আশেপাশের কটেজগুলোর আলো জ্বলে থাকে– নরম, হলুদ আলোয় জায়গাটা আরও মনোরম লাগে। রাস্তাঘাট ফাঁকা হয়ে যায়, মানুষের কোলাহল কমে আসে। মাঝেমধ্যে ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক শোনা যায়, আর দূর পাহাড় থেকে আসে শোঁ শোঁ করে বাতাস বইবার শব্দ। আকাশে মেঘ না থাকলে অনেক তারা দেখা যায়, কখনো চাঁদের আলো ছড়িয়ে পড়ে পাহাড়ের গায়ে।
রাতের সাজেকের সবচেয়ে বড় সৌন্দর্য–তার নিঃশব্দতা।
চারপাশে নিস্তব্ধতা। মাঝে মাঝে পাহাড়ের বুক চিরে ঠান্ডা বাতাস এসে স্পর্শ করে যাচ্ছে অরার গাল। কটেজের সামনে কাঠের চেয়ারে বসে আছে তারা। আগুনের শিখা ধীরে ধীরে নিভে আসছে। আরিশ পাতলা চাদর মেলে দিলো অরার গায়ে।
“ঠান্ডা লাগছে?”
আস্তে জিজ্ঞেস করল সে।
অরা মাথা নাড়িয়ে বলল,
“ঠান্ডাটা ভালোই লাগছে। জানেন, কতদিন পর এমন নিঃশব্দ কোনো জায়গায় এসেছি!”
আরিশ মুচকি হাসল। অরার নাকটা চেপে দিলো একটু।
” এরপর থেকে প্রতিমাসে বিভিন্ন জায়গায় ঘুরতে নিয়ে যাবো, ডার্লিং। ”
অরা বেশ খুশি হলো। বলল,
” ঘুরতে যেতে ভীষণ ভালো লাগে। তাছাড়া এমন প্রকৃতির মাঝে শুধু আমি… আপনি… আর এই মেঘ! মুহুর্তটা ভীষণ সুন্দর। ”
আরিশ চুপচাপ অরার দিকে তাকিয়ে থাকল কিছুক্ষণ। তার চোখে ধরা পড়ল একরাশ প্রশান্তি । অরার মিসক্যারেজ হওয়ার পর থেকে আরিশ কখনো তাকে এতটা হাসিখুশি দেখেনি। প্রকৃতির সান্নিধ্যে এসে মেয়েটার যেনো হৃদয়ে দোলা লেগেছে।
“তুমি জানো, অরা… এই পাহাড়ে না এলে আমি কখনো বুঝতেই পারতাম না, তুমি এতটা প্রকৃতিপ্রেমী। আগে কখনো কেনো বলোনি, ঘুরতে এতটা পছন্দ করো? ”
অরা চাদরের ভেতর থেকে হাত বের করে ধীরে ওর হাতটা ধরল। ঠান্ডা হাতের উষ্ণ ছোঁয়ায় আরিশ একটু কেঁপে উঠল। পাহাড়ি অঞ্চল, সন্ধ্যার পরে হালকা ঠান্ডা পড়ে।
“এমনি বলা হয়নি কিংবা বলার মতো পরিস্থিতি ছিলো না। সব সময় তো আপনি এমন ছিলেন না। ”
শব্দগুলো এসে আটকে গেল অরার গলায়।
আরিশ ধীরে অরার চোখে চোখ রেখে বলল,
“আমি তোমার ভালোবাসার অভ্যাসে বাঁধা পড়েছি, হামিংবার্ড। আগের মুহুর্তগুলো যেমন মিথ্যা নয় তেমনই এখনকার সময়গুলোও মিথ্যা নয়। এখন তুমি বলতে পারো, তোমার মনে যা আছে সব….তোমার অভিমানও এখন আমার প্রিয়। তোমার চুপচাপ বসে থাকাটাও আমার কাছে শব্দের মতোই স্পষ্ট।”
” ভালোবাসি রাগী ভূত। ”
আরিশ অরাকে গভীরভাবে জড়িয়ে ধরে কপালে ঠোঁট ছুঁইয়ে দিলো।
” আই লাভ ইউ টু ডার্লিং। এখন চলো। ”
” কোথায়?”
” রুমে…”
আরিশের ইশারা বুঝতে অসুবিধা হয়নি অরার।
” খারাপ লোক একটা!
[ পরের পর্ব পাবেন এই পেইজে https://www.facebook.com/Kaathgolaaap ]
“ খারাপ লোক কতটা খারাপ হতে পারে দেখাচ্ছি, চলো।
একটু দূরে কাঠের গায়ে ঝুলে থাকা বাতিটা কাঁপতে কাঁপতে নিভে গেল। রাতের নিস্তব্ধতা গাঢ় হয়ে উঠল। তারা উঠে দাঁড়ালো, বারান্দার কিনারায় এসে দাঁড়ালো পাশাপাশি।
নীচে ছড়িয়ে থাকা মেঘের ঢেউ যেন একটা বিশাল সাদা সমুদ্র। দূরে কোথাও জোনাকি জ্বলছে। আরিশ একহাতে অরাকে জড়িয়ে নিলো, মাথাটা ওর কাঁধে রেখে অরা চোখ বন্ধ করল।
“এই মুহূর্তটা রেখে দিতে ইচ্ছে করে।” ফিসফিস করে বলল অরা।
“রেখে দিয়েছি। তোমার চোখে। তুমি যখনই ক্লান্ত হবে, ফিরে এসো এই স্মৃতিতে। আমি থাকবো, ঠিক এমন করে।”
উত্তর দিল আরিশ। অরা কিছু বলল না, শুধু বুক ভরে শ্বাস নিলো। আরিশ তাকে কোলে তুলে নিয়ে রুমের দিকে এগোল। পাহাড়ি রাতের নিঃশব্দতাও যেন হঠাৎ তাদের ভালোবাসার সাক্ষী হয়ে গেল।
ভোরবেলা। কটেজের জানালার পর্দা সরিয়ে সূর্যের আলো আস্তে আস্তে ঘরে ঢুকছে। সেই আলোয় অরার মুখটা যেন এক টুকরো শান্তির ছবি হয়ে গেছে। সে এখনো ঘুমিয়ে, হালকা নিঃশ্বাসের শব্দ স্পষ্ট। চুলগুলো এলোমেলো হয়ে কাঁধে ছড়িয়ে আছে। ঠোঁটে শান্ত এক হাসির রেখা। আরিশ ওকে দেখছে–নীরবে, স্থির হয়ে।
রাতের আদরের কোমলতা এখনো ছড়িয়ে আছে ঘরের কোণায় কোণায়। তাদের শরীরের মাঝখানে রাখা কাপড়ের ভাঁজেও যেন লেপ্টে আছে অরার ফিসফাস, আর আরিশের বুকের উত্তাপ। তাদের ভালোবাসা রাতের আঁধারে বলা হয়েছে, কিন্তু তার প্রতিচ্ছবি এই সকালেও রয়ে গেছে।
আরিশ ধীরে অরার গালে হাত রাখে। অরা চোখ মেলে তাকায়। চোখে ঘুমের রেশ, তবু গভীর তৃপ্তি।
“সকাল হয়েছে?”
ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করে অরা।
” ইয়েস ডার্লিং। ”
অরা কিছু না বলে আরিশের বুকের কাছে মাথা রাখে। কিছু মুহূর্ত এমন থাকে, যেখানে শব্দের দরকার হয় না—শুধু নীরবতা দিয়েই ভালোবাসা বোঝা যায়।
” আপনি কখন উঠলেন? ”
” যখন তুমি আমার ঘাড়ে কিস করলে, তখন। ”
চমকাল অরা। শোয়া থেকে উঠে বসলো। বড়ো বড়ো চোখ করে তাকাল আরিশের দিকে। আরিশ কনুইতে ভর দিয়ে আধশোয়া অবস্থায় আছে।
” আমি? কখন?”
” এই ঘন্টাখানেক আগে। ”
” আসলেই সঙ্গ দোষে লোহা ভাসে। ”
অরা ফিসফিস করে বলল কথাগুলো। আরিশ মুচকি হেসে খুব ক্ষিপ্র গতিতে অরাকে নিজের পেটের ওপর উঠিয়ে বসাল। অরার বিস্ময় কাটে না। রাতের দৃশ্যগুলো মনে পড়ে যায়, লজ্জায় মাথা নিচু করে ফেলল সে।
” লোহা যে কতটা ভাসে তা তো গতকাল রাতেই দেখলাম। আগুন জ্বালিয়ে দিতে যতক্ষণ লেগেছিল, সেই আগুনে জ্বলতে তোমার সময় লাগেনি। উফ… অরা তুমি…. ”
আরিশ আরকিছু বলার আগেই অরা তার মুখ চেপে ধরে।
” চুপ! একদম চুপ। বেশি কথা বলেন কেন? থাকুন, ফ্রেশ হয়ে আসছি।”
অরা তড়িঘড়ি করে সেখান থেকে উঠে প্রায় দৌড়ে ওয়াশরুমের দিকে চলে গেলো। আরিশের ঠোঁটের কোণে হাসি, শরীরে অরার ভালোবাসার চিহ্ন!
সদ্য গোসল সেরে এসেছে অরা। পরনে তার শুভ্র শাড়ি, খোলা চুল থেকে টপটপ পানি পড়ছে। সে ধীরপায়ে বারান্দার দরজা খুলে দিলো। সাজেক এখন মেঘে ঢেকে গেছে। সাদা মেঘ পাহাড় ঢেকে রেখেছে, যেন বিশাল তুলোর চাদর। দূরে সূর্য উঠেছে, সেই আলো মেঘের ওপর পড়ে রূপালি ঝিলিক ছড়াচ্ছে।
চলবে,
#হামিংবার্ড
#তাসমিয়া_তাসনিন_প্রিয়া
#পর্ব_৭০
চারদিনের সাজেক ভ্রমণ শেষে অরা আর আরিশ ফিরে এসেছে ঢাকা শহরে। পাহাড়ের নিস্তব্ধতা পেরিয়ে শহরের চেনা কোলাহলে ফিরে আসা যেন দুজনকেই কিছুটা থমকে দিয়েছে। তবে এই ফিরে আসার ভেতরেও একরকম উত্তেজনা, প্রস্তুতির ঘনঘটা ছড়িয়ে আছে চারপাশে—কারণ খান বাড়িতে আসন্ন দুটি বিয়ের আয়োজন! এরমধ্যে সাবিহা ও মেহরাব তাদের সমস্যার সমাধান করে ফেলেছে। মেহরাবের মায়ের সাথে কথা বলেছিল সাবিহা। ভদ্রমহিলা একটু খিটখিটে হলেও খারাপ নন। ছেলের সুখশান্তির কথা ভেবে ও সাবিহার আচরণে বিয়েতে ‘ হ্যাঁ ‘ বলে দিয়েছেন তিনি।
তালহা আর তামান্নার বিয়ে একসঙ্গে—এই খবরে পুরো পরিবার এখন যেন একসাথে হাঁটছে উৎসবের দিকে। বাড়ির সবাই ব্যস্ত, তৎপর। গেট সাজানো হবে কীভাবে, বরযাত্রী যাবে কয়টা গাড়িতে, মেয়েদের গায়েহলুদে কোন গানে দলবেঁধে নাচ হবে–এসব নিয়ে সকাল-সন্ধ্যা চলছে আলোচনা।
শপিংয়ের জন্য আজ সবাই বেরিয়েছে। সকাল থেকেই অরা, তামান্না, সাবিহা আর তাসলিমা খাতুন রেডি হচ্ছিলেন। সাজেক থেকে ফেরা পর অরার মুখে যেন আলাদা এক শান্তির ছাপ। ঠোঁটের কোণে থাকে নরম হাসি, চোখে স্থির প্রশান্তি। তামান্না তো রীতিমতো উত্তেজনায় কাঁপছে—নিজের বিয়ে বলে কথা! ওর কথার মধ্যে অস্থিরতা, হাসির মধ্যে আনন্দ।
সবার আগে পৌঁছানো হয়েছে বসুন্ধরা সিটি শপিং মলে। লিফট থেকে নেমে রীতিমতো ছুটোছুটি শুরু হয়ে যায়। তাসলিমা খাতুন বেশি ঘোরাঘুরি করেন না, তিনি একটা নির্দিষ্ট দোকানে ঢুকে শাড়ি আর ওড়না দেখে সময় কাটাচ্ছেন। সাবিহা নিজের জন্য একটা মেরুন শাড়ি হাতে তুলে নিয়ে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে যাচাই করছে। অরা আজ হালকা রঙের একটা সালোয়ার পরে এসেছে। তার চোখে ক্লান্তি নেই, বরং চারপাশের ব্যস্ততা ও আয়োজন উপভোগ করছে নিঃশব্দে। সে মাঝে মাঝে তামান্নাকে জামার ডিজাইন দেখায়, কখনো সাবিহার জন্য গয়নাও পছন্দ করে।
তালহা আর আরিশ আলাদা করে ছেলেদের শপিং সামলাচ্ছে। আরিশ অরার পছন্দ বুঝে আজকাল নিজের স্টাইলেও হালকা পরিবর্তন আনার কথা ভেবেছে। সে হালকা ধূসর পাঞ্জাবি রঙের পাঞ্জাবি কিনেছে। অরা একবার দেখে বলেছিল, “আপনার গায়ের রঙের সঙ্গে ধূসর রঙটা খুব যায়।” সেজন্য আজ অরার অগোচরে সেই রঙের একটা পোশাক কিনলো সে, যাতে করে ভবিষ্যতে অরাকে চমক দিতে পারে।
শপিংয়ের ব্যাগ ক্রমশ ভারী হচ্ছে, তালিকা শেষ হয় না যেন। কেউ কনের জন্য গয়নাবক্স খুঁজছে, কেউ বরের জুতা। মেয়েদের পার্লারের অ্যাপয়েন্টমেন্ট, গায়ে হলুদের মেহেদির ডিজাইন, বর-কনের কো-অর্ডিনেটেড ড্রেস—সবকিছুই যেন একটা রঙিন পরিকল্পনার খুঁটিনাটি। শহরের একেকটা দোকান ঘুরে সবাই ধীরে ধীরে উপলব্ধি করছে–বিয়ে শুধু এক অনুষ্ঠান নয়, এটা বিশাল দায়িত্বের ব্যাপার।
“ তোমাদের হলো?”
অরা জিজ্ঞেস করলো সাবিহা ও তামান্নাকে। তাসলিমা খাতুন আগেভাগে তালহার সাথে গিয়ে গাড়িতে বসেছেন। আরিশ পেমেন্ট করার জন্য সবগুলো ব্যাগপত্র নিয়ে সামনের দিকে এগোচ্ছে।
“ হ্যাঁ, ভাবি। চলো। “
সাবিহা হাসি হাসি মুখে এগিয়ে এলো। আরিশের পিছুপিছু ওরা তিনজন এগোতে লাগলো। শপিং করতে গিয়ে গোটা একটা দিনই যেন চলে গেলো।
“ বিকেলে তালহা আসবে, তোকে ও বাড়িতে নিয়ে যেতে। “
নিজের কিছু কাপড় ভাজ করে ওয়ারড্রবে ঢুকিয়ে রাখলেন রোকসানা। নয়না মায়ের বিছানায় পা ঝুলিয়ে বসে আছে।
“ ঠিক আছে। “
নয়নার সংক্ষিপ্ত উত্তর। রোকসানা মল্লিক দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন। এগিয়ে গেলেন নয়নার দিকে।
“ তোর কী হয়েছে নয়না? দিনদিন কেমন মনমরা হয়ে গেছিস!”
মেকি হাসল নয়না। মা’কে যেন কিছু বুঝতে দিতে চায়না সে।
“ আমার আবার কী হবে মা? সামনে ফাইনাল পরীক্ষা, টেনশন হচ্ছে। এছাড়া কিছু না। “
“ সত্যি তো? “
মেয়ের মাথায় হাত রাখলেন তিনি। নয়না হুট করে মা’কে জড়িয়ে ধরে, বলে,
“ হুম মা। “
“ আচ্ছা। তুই বস, আমি গিয়ে রাতের জন্য রান্না বসাই। “
“ আচ্ছা মা।”
নয়না মা’কে ছেড়ে দিলো, রোকসানাও ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন। মা চলে যেতেই দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল মেয়েটা।
বিকেল নামছে ধীরে ধীরে। জানালার কাঁচে লেগে থাকা মরা রোদের আলো ঘরের ভেতরে এসে পড়েছে। নয়না চুপচাপ মায়ের ঘরের জানালার পাশে বসে আছে। মা রান্নাঘরে ব্যস্ত। তালহার আসার কথা, কিন্তু তার চেয়েও বেশি অপেক্ষা নয়নার মন করছে সেই কারো জন্য যার খোঁজ অনেক দিন নেই। মা এসে দরজা খুলে বললেন,
“তালহা এসেছে মা। রেডি হয়ে আয়।”
“ আচ্ছা। “
নয়না আর কিছু বলে না। ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ায়। ওয়ারড্রোব থেকে ওড়নাটা তুলে নেয়, ব্যাগ কাঁধে ঝুলিয়ে নেয়। আয়নার সামনে দাঁড়ায় এক মুহূর্ত। নিজেকে দেখে। চোখে হালকা ক্লান্তি। ঠোঁটে একরকম প্রাপ্তিহীনতার নীরবতা।
রাত গভীর। চাঁদের আলো ঘরের জানালার ফাঁক গলে নরম ছায়া ফেলে রেখেছে বিছানায় শুয়ে থাকা দু’টি মানুষের ওপর। জানালার পর্দা হালকা দুলছে বাতাসে। সেই বাতাসে মিশে আছে ক্লান্তির, প্রশান্তির, আর ভালোবাসার গন্ধ। অরা বিছানায় আরিশকে জড়িয়ে ধরে ঘুমিয়ে আছে। নিঃশ্বাসের তালটা শান্ত, ঘাড়ে লুটিয়ে থাকা চুলগুলো ঘামে ভেজা। আরিশ ঘুমায়নি। চোখ মেলে মেয়েটাকে দেখছে। এলোমেলো চুল, ঘুমিয়ে পড়ার পরও ঠোঁটে রয়ে যাওয়া একরকম ভালোবাসার ছাপ,যেটা তার নিজের হাতে এঁকে দেওয়া।
কিছুক্ষণ আগেই, সেই ঘন নিঃশব্দে তারা একে অন্যকে ছুঁয়ে ছুঁয়ে খুঁজে নিয়েছে নিজের মতো।
তীব্র কামনার ঢেউ এসে ধাক্কা দিয়েছে দুজনের শরীরে। অরার তপ্ত কাঁধ, দুলে ওঠা বুক, কানে ফিসফিস করে বলা আরিশের স্বর–সবকিছু মিলিয়ে যেন অন্ধকারে লেখা এক দীর্ঘ কবিতা।
আরিশ অরাকে এতটাই নিবিড়ভাবে ছুঁয়েছিল, যেন স্পর্শের মধ্য দিয়েই সমস্ত কষ্ট ছুঁড়ে ফেলে দিতে চাইছিল। অরা তার ডাকে সাড়া দিয়েছিল দমবন্ধ করা দীর্ঘশ্বাসে, অদ্ভুত নিঃশব্দতায়।
ক্লান্ত হয়ে, শান্ত হয়ে, এখন সে ঘুমিয়ে আছে।
[ পরের পর্ব পাবেন এই পেইজে https://www.facebook.com/Kaathgolaaap ]
আরিশ তাকিয়ে থাকে অরার দিকে। নিজের আঙুল দিয়ে ওর চুলের এক ফাঁকা গোছা পেছনে সরিয়ে দেয়, কপালে একটুখানি চুমু খায়।
তার বুকের ভেতর হঠাৎ হাহাকার করে ওঠে।
মনে পড়ে যায়– যদি সেই ছোট্ট প্রাণটা টিকে থাকতো… যদি একফোঁটা কান্না এই ঘরে যোগ হতো…তাহলে কি আজকের রাত আরও অন্যরকম হতো? আরেকটা ছোট হাত কি তাদের মাঝখানে শুয়ে থাকতো?
আরিশ জানে,এই কথা অরার ঘুম ভেঙে বললে ও নিশ্চয় কেঁদে ফেলত। তাই সে চুপচাপ চোখ বন্ধ করে মেয়েটার কপালের হাড়ে ঠোঁট রেখে থাকে কিছুক্ষণ। তার খুব ইচ্ছে করে অরাকে জাগিয়ে তুলে আবার একটু গায়ে মুখ ঘষে বলুক,
“এই যে, ঘুমিয়ে গেলে কেন?”
তার খুব ইচ্ছে করে অরার গলা বরাবর আঙুল টেনে নামিয়ে আনুক, বুকের গাঁথুনিতে মুখ লুকাক, আবার হারিয়ে যাক সেই উষ্ণতার গভীরে। কিন্তু না। কাল বিয়ের দিন, গায়ে হলুদও আছে । অরার শরীর ভেঙে পড়লে ওর মিষ্টি মুখটায় আলো ঝলমল করবে না । তাই সে নিজেকে সংযত করে।
সারাটা ঘর নিঃশব্দ। তবু এই নীরবতায় আরিশ অনুভব করছে–এই নারী, এই দেহ, এই ভালোবাসা–এটাই তার জীবনের সবচেয়ে সুন্দর আশ্রয়।
[ হামিংবার্ড বইয়ের প্রি-অর্ডার করেছেন তো?]
বাহিরে এক পশলা বাতাস জানালার পর্দা সরিয়ে দিয়ে ঘরের ভেতর ঢুকে পড়ে। ঝিরিঝিরি বৃষ্টি হচ্ছে। আরিশ নিজের পাশে রাখা পাতলা কম্বলটা টেনে নেয় অরার শরীরজুড়ে। তারপর নিজের শরীরটাকেও ওর গায়ে একটু ঢেকে নেয়।
ঘুমানোর আগে শেষবারের মতো একবার ফিসফিস করে বলে ওঠে–
“তুমি ঘুমোলে রাতের শব্দ থেমে যায়।
আর আমি তোমাকে ছুঁয়ে,
নিজেকেই খুঁজে পাই, হামিংবার্ড।”
সকালের আলো বিছানায় পড়তেই ধীরে ধীরে ঘুম ভাঙে অরার। চোখের পাতায় সূর্যের নরম আলো এসে পড়ে, আর পাশে কাত হয়ে শুয়ে থাকা আরিশের গলা বরাবর তার কপাল স্পর্শ করে। অরার চোখ খুলতেই দেখে আরিশ তাকিয়ে আছে, ঠোঁটে দুষ্টু হাসি
“এইভাবে দেখলে কিন্তু ভালো হবে না।”
ঘুমভাঙা গলায় বলে অরা।
আরিশ হেসে বলে,
“আমি তো আমার মানুষকেই দেখছি। সেটা কি নিষেধ?
অরা কাঁথাটা মুখ পর্যন্ত টেনে নেয়, হালকা লাজুক হয়ে পড়ে।
“ তা বলিনি তো। “
আরিশ অরাকে ধরে শোয়া থেকে উঠিয়ে বসাল, শক্ত করে তার কোমরে হাত রেখে নিজের কোলে তুলে বসাল।
“ কিছু বলো না, ডার্লিং। আমার দিকে তাকিয়ে থাকো, আমি আজন্মকাল ধরে তোমার চোখের চাহনি দেখি৷ “
অরা ভেংচি কাটল। হেসে বলল,
“ সব জানি। এখন ছাড়ুন। সকাল হয়েছে অনেকক্ষণ, কাজকর্মের তদারকি তো করতে হবে মশাই। “
আরিশ ওভাবে শোয়া থেকে উঠে বসলো।
“ পাখি, ভাবছিলাম ওদের বিয়েটা হওয়ার পর আমরাও অনুষ্ঠান করে বিয়ে করে নেবো। “
“ কী!”
“ যা শুনেছ তাই। “
“ ঠিক আছে। বউ আপনার, সিন্ধান্তও আপনার! “
অরা হেসে উঠল, ধীরপায়ে ওয়াশরুমের দিকে এগোল সে। আরিশ মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো কেবল।
সকাল থেকেই বাড়িতে উৎসবের হাওয়া। উঠোনজুড়ে হলুদের রঙে মোড়ানো প্যান্ডেল, গাঁদার মালায় সাজানো গেট, আর চারপাশে হাসির শব্দে মুখরিত পুরো খান বাড়ি। আজ তামান্না আর সাবিহ গায়ে হলুদ।
চলবে,