#হামিংবার্ড
#তাসমিয়া_তাসনিন_প্রিয়া
#পর্ব_৭১
#শেষ_পর্ব_প্রথম_অংশ
[ পর্বটি রোমান্টিক। ]
সকাল থেকেই পুরো বাড়িতে উৎসবের ঝলক। খান ভিলা আজ রঙে, আলোয়, সাজে একেবারে ঝলমলে। লনজুড়ে বিশাল হলুদ-সাদা প্যান্ডেল টানা, তাতে ঝুলছে অর্কিড আর গাঁদার মালা। ইনডোর–আউটডোর একসাথে সাজানো, ভেতরে মেহেদির ঘ্রাণ, বাইরে বাল্ব আর ফেয়ারি লাইটসের ঝিলমিল। আজ তামান্না আর সাবিহার গায়ে হলুদ।
বাড়ির নিচতলায় পার্টি লনে সিল্কের কুশনে মোড়া সোফাসেট, সাজানো ফটো বুথ, ঝুলন্ত ফুলে ঢাকা চকলেট-জুসের স্টেশন, পাশে হালকা বাজছে লাইভ বাউল-ফিউশন ব্যান্ডের মৃদু সুর। ডেকোরের দায়িত্বে দেশের নামী ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানি–সবকিছু নিখুঁতভাবে রঙ ও আলোয় মোড়ানো। গেট থেকে ঢোকার মুখেই ফুলে সাজানো একটা আরক দিয়ে ভেতরে ঢোকা।
তামান্না আর সাবিহা সাজছে আলাদা আলাদা ঘরে। মেকআপের জন্য এসেছে টপ ক্লাস বিউটি টিম, তাদের চারপাশে ঘোরাঘুরি করছে ভিডিওগ্রাফার, ক্যান্ডিড ফটোগ্রাফার। গায়ে হলুদের জন্য এতটা সাজগোছ, জাঁকজমকপূর্ণ আয়োজন কিংবা মেকআপ কোনোটার দরকার ছিল না। কিন্তু আরিশের মতে সবকিছু রাজকীয় স্টাইলে করতে হবে। খান বাড়িতে বহুবছর পর বিয়ে হচ্ছে। আরিশের বিয়েটা তো সেরকমভাবে হয়নি। তাই আরিশের ইচ্ছেতেই সবকিছুতে এতটা জাঁকজমকপূর্ণ আয়োজন করা হয়েছে।
আরিশ সকাল থেকেই পুরো আয়োজন তদারকি করছে, তবে তার চোখ বারবার খুঁজছে অরাকে।
অরা আজ পরেছে হালকা হলুদ-সোনালি জামদানি, ঝিনুকের মতো ছোট ছোট পার্লস দিয়ে কাজ করা ব্লাউজ, খোঁপায় গাঁদা আর গোলাপ গাঁথা ফুল। তাকে দেখে যেন এক শিল্পকর্ম লাগছে। মনে হচ্ছে কোনো শিল্পীর নিখুঁত শিল্পকর্ম।
অরা সবকিছু দেখেশুনে নিচ্ছে। তালহার আজ কোনো কাজকর্ম নেই। সাবিহা ও তামান্নার গায়ে হলুদ শেষে তালহার গায়ে হলুদের অনুষ্ঠান।
উঠোনে দাঁড়িয়ে আছে অরা। ধীরপায়ে আরিশ এগিয়ে আসছে তার কাছে। অরা পেছনে না তাকিয়েও আরিশের নিঃশ্বাস অনুভব করছে। তার ঘাড়ে আরিশের উষ্ণ স্পর্শ পেয়ে শিউরে ওঠে। আরিশ খুব আস্তে বলল,
“তোমাকে আজ দেখে মনে হচ্ছে, এই গায়ে হলুদের আসরে তুমি একমাত্র আলো।”
অরা হেসে বলে,
“আজ তো তামান্না-সাবিহার দিন। আমি তো শুধু….”
আরিশ মাঝখানে বলে ওঠে,
” ইউ আর অনলি মাইন, সো ইউ’ল অলওয়েজ বি মাই প্রাইওরিটি–এভরি সিঙ্গল ডে।
অরা লাজুক চোখে তাকায়। পাশে নয়না, শিমু আর ত্বোহা দৌড়ে আসে। শিমু ও ত্বোহা তালহার মামাতো ভাইবোন।
“ আপু তোমাকে ডাকছে। ”
নয়না বলল। আরিশ ওদেরকে দেখে একটু দূরে সরে দাঁড়াল। অরা গলা খাঁকারি দিয়ে নিজেকে ধাতস্থ করে নিলো।
” কে ডাকছে? ”
আরিশ জিজ্ঞেস করলো। নয়না বলল,
” তামান্না আপু। ”
অরা ব্যস্তসমস্ত ভঙ্গিতে নয়নাদের সাথে চলে যেতে যেতে বলল,
” আমি আসছি৷ ”
আরিশ কিছু বলল না। তবে চোখের ইশারায় অনেক কিছু বোঝাল। অরা লজ্জায় মাথা ঘুরিয়ে সামনের দিকে এগোল।
গায়ে হলুদের সমস্ত আয়োজন শেষে সন্ধ্যার আলো চারদিকে ছড়িয়ে পড়েছে। ফেয়ারি লাইটগুলোর মৃদু ঝিকিমিকি, বিয়ের ব্যস্ততা—সব মিলিয়ে খান ভিলার আঙিনা যেন এক স্বপ্নপুরী হয়ে আছে। হলুদ রঙে ভেজা বিকেলটা এখন সোনালি রাতের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।
সবার চোখেমুখে ক্লান্তির ছাপ থাকলেও আজকের আনন্দ সেই ক্লান্তিকে ছাপিয়ে গেছে। তামান্না আর সাবিহা দুজনেই যেন নতুন জীবনের দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে। ঘরের ভেতর তারা বসে আছে, মেহেদির রঙ শুকিয়ে গাঢ় হচ্ছে হাতভর্তি ডিজাইনে। মুখে হালকা হাসি, চোখে একটু সংশয়, কিন্তু ভেতরে কোথাও যেন খুশির হাওয়া বইছে।
সাবিহা আয়নার সামনে বসে মেহেদির গাঢ়তা দেখে বলল,
“দেখেছো ভাবি ? তোমার মেহেদি অনেক গাঢ় হয়েছে। তালহা নিশ্চয়ই তোমাকে খুব ভালোবাসে!”
তামান্না কিঞ্চিৎ লজ্জা পেলো। হেসে বলল, ” আপনার হাতের মেহেদীর রঙও খুব সুন্দর হয়েছে। মেহরাব ভাইও আপনাকে খুব খুব ভালোবাসে।”
উল্টো দিকের সোফায় বসে থাকা তাসলিমা খাতুন হেসে ফেললেন,
” এখন কিছু খাওয়াদাওয়া করে নাও তোমরা। তারপর তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে যাও। আগামীকাল আবার সকাল সকাল উঠতে হবে। ”
সাবিহা ও তামান্না একে অপরের দিকে তাকিয়ে বলল,
” হ্যাঁ, মা। আমরা যাচ্ছি। ”
তারা দু’জন নিজেদের ঘরের দিকে এগোল। রাতে কিছু খাবে না, কিছুক্ষণ আগেই নাস্তা করেছিল।
রাত এগারোটা ছুঁইছুঁই। ব্যাকইয়ার্ডে বসে আরিশ ও মেহরাবএকসাথে চা খাচ্ছে। মিনিট পাঁচেক আগেই মেহরাব এসেছে। অরা নয়নাকে দিয়ে চা পাঠিয়ে দিয়েছে। তামান্না, সাবিহা হয়তো ঘুমিয়ে গিয়েছে।
মেহরাব বলে উঠল,
“ভাবতে পারছিস? কাল আমার বিয়ে! মা’কে ম্যানেজ করতে বড় কষ্ট হয়েছে। ”
আরিশ চুপচাপ চায়ে চুমুক দিয়ে বলল,
“তুই ভাগ্যবান। তোদের অন্তত সেভাবে বিয়ে হচ্ছে।”
মেহরাব অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল,
“তোর আফসোস হয় নাকি?”
আরিশ হেসে মাথা নেড়ে বলল,
“না রে। অরার সাথে আমার বিয়েটা ছিল অন্যরকম। শুরুর জায়গাটা হয়তো সুন্দর ছিল না, কিন্তু ওকে পাওয়া– এটাই আমার জীবনের সবচেয়ে বড় পাওয়া। এখন ওর হাসি দেখলেই আমার পুরো পৃথিবী ভালো হয়ে যায়।”
মেহরাব মুচকি হাসে।
ওদিকে নয়না, শিমু একপাশে বসে গল্প করছে। সবাই গায়ে হলুদের সাজে, রঙিন চুড়ি, টিপ, গায়ে হলুদের উজ্জ্বল আলোয় নয়নার মুখটা অন্যরকম লাগছে। কিন্তু ওর চোখে কোথায় যেন একধরনের খালি খালি ভাব।
শিমু বলল, “তমি এত চুপ কেন?”
নয়না ছোট্ট করে বলল, ” কিছু না আপু। ”
” অনেক রাত হলো। চলো ঘুমিয়ে যাই। ”
হাই তুলতে তুলতে বলল শিমু। নয়নার থেকে এক বছরের বড়ো সে।
” হুম।”
______________
রাতটা খানিক নীরব, আবার খানিক গুঞ্জনময়। কেউ কেউ আজকের ক্লান্তি নিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে, কেউ ব্যস্ত আগামীকালকের বিয়ের জন্য। আর অরা? সে বারান্দায় দাঁড়িয়ে হালকা হাওয়া গায়ে মেখে আকাশের চাঁদ দেখছে। পাশে এসে দাঁড়িয়েছে আরিশ।
“ কী দেখছো, হামিংবার্ড?”
“ চাঁদ। “
আরিশের ভ্রু কুঁচকে ফেলল। আকাশের দিকে তাকিয়ে বলল,
“ আমাকে দেখো। “
অরা মুচকি হেসে তার দিকে তাকাল। ভদ্রলোক জেলাস ফিল করছে।
“ কী সৌভাগ্য আমার! একসাথে দু’টো চাঁদ দেখছি আমি। “
“ তাই না? “
আরিশ অরার ঠোঁটে আঙুল ছুঁইয়ে স্লাইড করতে লাগলো। অরা বলল,
“ জি, রাগী ভূত। “
“ আমার অরার জীবনে কেবলমাত্র একটা চাঁদ থাকা চাই, আকাশের চাঁদও তার জন্য নিষিদ্ধ। “
এই বলে আরিশ হঠাৎই অরার কোমর জড়িয়ে ধরল। এক মুহূর্তে দুইজনের মধ্যকার শ্বাস-প্রশ্বাস একত্রিত হয়ে গেল। বৈদ্যুতিক বাতির আলোতে অরার মুখে পড়ছে সোনালি ছায়া, আরিশের চোখ তাতে আটকে আছে।
“আজ সারাদিন শুধু দেখেছি তোমাকে। স্পর্শ করিনি, কাছে যেতে পারিনি… এখন আর নিজেকে আটকাতে পারছি না।”
আরিশের নেশালো কণ্ঠস্বর যেনো অরাকে মাতাল করে তুলছে। আরিশ হালকা চুমু খেল তার ঘাড়ে। অরা কেঁপে উঠল একটু, কিন্তু সরে গেল না। ঘাড়ে তীব্র ব্যথা অনুভব করলো সে। হাত দিয়ে দেখল, রক্ত!
[ পরবর্তী পর্ব পাবেন এই পেইজে https://www.facebook.com/Kaathgolaaap ]
“এটা তোমার জন্য নয়, আমার অস্থিরতার জন্য।”
আরিশ ফিসফিস করল।
অরা আস্তে বলল,
“আপানার ভালোবাসা এমন হিংস্র কেন, রাগী ভূত?”
“কারণ তোমাকে ভালোবাসতে গিয়ে নিজেকেই হারিয়ে ফেলেছি। আর যাকে নিজের থেকেও বেশি ভালোবাসে, তাকে পেলে মানুষ শান্ত নয় বন্য হয়ে ওঠে।”
ছাদের এক কোণে দাঁড়িয়ে, চাঁদের আলো আর আরিশের স্পর্শে অরার সমস্ত অবসাদ গলে যেতে লাগল। চারপাশে শুধু নিঃশব্দতা, আর দুটো হৃদয়ের ভেতরে ওঠা তুমুল ঝড়। অরা এখন আরিশের স্পর্শে ভয় পায় না, বিরক্ত হয় না। আরিশের সবকিছুই এখন অরার উপভোগ্য। আরিশ অরাকে কোলে তুলে নিয়ে বেডরুমের দিকে এগোল।
“ তুমি! মেহরাব তুমি এতো রাতে এভাবে দেখা করতে এলে কেন? সবকিছু ঠিক আছে? “
মেহরাব সাবিহাকে আলতো করে বুকে জড়িয়ে ধরল। লজ্জায় আড়ষ্ট হয়ে গেলো সে। এই নিশীথে মেহরাব ঠিক কী কারণে বাড়ির পেছনের গেটে তাকে দেখা করতে বলেছে সেটাই বোধগম্য হচ্ছে না সাবিহার।
“ আমি ঠিক নেই। আগামীকাল বিয়ে অথচ একটা রাতও অপেক্ষা যেন সহ্য হচ্ছে না আমার। হুর করে যেনো সমস্ত ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে গেছে সাবিহা। “
সাবিহা কী বলবে বুঝতে পারছে না। আজকে মেহরাবকে সত্যি লাগামছাড়া লাগছে।
“ মেহরাব! “
“ বলো সাবিহা। “
“ এখন ফিরে যাও, প্লিজ! আগামীকাল আমাদের দেখা হবে, আমরা এক হয়ে যাবো। আজকের রাতটা শুধু… প্লিজ?”
সাবিহার কথার মধ্যে যেনো কিছু একটা ছিলো। মেহরাব তা অগ্রাহ্য করতে পারলোনা। বাহুডোর থেকে মুক্ত করলো সাবিহাকে।
“ ঠিক আছে। আসছি আমি। কাল রেডি থেকো, তোমায় নিতে আসবো আমি। “
“ থাকবো। এসো…”
মেহরাব কোনো কথা না বলে সাবিহার কপালে চুমু খেলো। তারপর নিঃশ্বব্দে চলে যাওয়ার জন্য পা বাড়াল। সাবিহা কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলো, তারপর বাড়ির ভেতর চলে গেলো।
বাইরে বৃষ্টি হচ্ছে টুপটাপ। জানালার কাঁচ বেয়ে নামছে জলের রেখা। ঘরটা আধো আলোয় ডুবে আছে। শুধু বেডসাইড ল্যাম্পটা জ্বলছে মৃদু। বিছানার পাশে দাঁড়িয়ে আছে আরিশ—চোখে একরকম নিঃশব্দ আগুন, ঠোঁটে অদ্ভুত এক রহস্যময় হাসি।
অরা বিছানায় শুয়ে আছে, খোলা চুলে, নরম স্যাটিনের রোব পরা। তার চোখে আজ কিছু একটা আলাদা… সাহসী, চঞ্চল, আর আমন্ত্রণ জানানো।
আরিশ ধীরে ধীরে এগিয়ে এসে অরার কানে ফিসফিস করে বলল,
“তুমি জানো, আজ আমি তোমাকে আর একচুলও ছাড়া দেব না।”
অরা পিছনে ফিরে তাকাল, ঠোঁটের কোণে খেলা করলো এক লাজুক কিন্তু দুষ্টু হাসি,
“তো আমি কি পালাতে চাইছি?”
আরিশ তখন খুব ধীরে তার দুই হাত তুলে অরার কবজি দুটো ধরে, বিছানার সাথে চে*পে ধরলো।
“তুমি আজ আমার ইচ্ছে মতো থাকবে, পুরোপুরি আমার…”
তার গলায় কোমলতা ছিল, কিন্তু তার ভেতরে ছিল একরকম জেদ আর তীব্র অধিকারবোধ।
অরা তার চোখে চোখ রাখল। কোনো ভয় নেই, কেবল উত্তেজনা।
“আমি তো সবসময় আপনারই…”
আরিশ আঙুল ছুঁইয়ে দিল অরার কপালে। সেই আঙুল নেমে এলো ভ্রু, গাল, ঠোঁট, গলা ছুঁয়ে ধীরে ধীরে আরও নিচে… যেন এক শিল্পী তার ক্যানভাস আঁকছে। ঘরজুড়ে তখন শুধুই নিঃশ্বাসের শব্দ আর ভালোবাসার গভীরতায় হারিয়ে যাওয়া দুইটি মন।
চলবে…….
#হামিংবার্ড
#শেষ_পর্বের_উপসংহার
#তাসমিয়া_তাসনিন_প্রিয়া
বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা নামতেই খান ভিলায় যেন আলোয় ভেসে উঠল চারদিক। প্যান্ডেলজুড়ে ঝলমলে চন্দনের রঙের কাপড়, ঝুলন্ত মোগলাই ঝাড়বাতি আর ফুলের নকশায় সাজানো সেন্টারপিস। সবার মুখে হাসি, কানে কানে গুঞ্জন।
তামান্না পরেছে গাঢ় লাল জমকালো শাড়ি, মাথায় নেটের ওড়না, গলায় ভারী সোনার হার। পাশে তালহা কালো শেরওয়ানি পরে একদম রাজপুত্রের মতো লাগছে। তাদের কাবিনের সময় সবাই নিঃশব্দ। তালহা স্পষ্ট কণ্ঠে কবুল বলতেই তামান্নার মুখে রঙ ছড়ানো এক চিলতে হাসি ফুটে ওঠে। তার চোখেমুখে একটু কেঁপে ওঠা, একটু লজ্জা, আর অনেক আনন্দ।
দ্বিতীয় কাবিন হয় মেহরাব আর সাবিহার। সাবিহা পরেছে সোনালি বেনারসি, খোঁপায় গাঁথা টিউলিপ আর কাচফুল। মেহরাব সাদা রঙের পাঞ্জাবি আর ওড়না গলায় জড়িয়ে তাকিয়ে আছে একদৃষ্টে সাবিহার দিকে। কাবিনের পর, একটু চুপচাপ হয়ে বসেছিল মেহরাব। তার পাশে সাবিহা বসা। মেহরাব তার কানে কানে বলল,
“আজ থেকে তুমিই আমার সব।”
সাবিহা লজ্জায় মাথা নিচু করে রইলো। মেহরাব নিশ্বব্দে সাবিহার হাত ধরে রইলো।
এই রাত্রি, এই আলো সব মিলিয়ে খান ভিলার উঠোন যেন সাক্ষী হয়ে রইল দুই জোড়া ভালোবাসার এক নতুন শুরুতে।
আরিশ অরার হাত ধরে একটু দূরে দাঁড়িয়ে আছে। বাড়ির সকলেই খুশি। খান বাড়িটা আজ আনন্দে আনন্দে ভরে উঠেছে।
কেটে গেছে অনেকগুলো বছর। সময়ের নিয়মে খান ভিলার সেই ব্যস্ততা এখন অনেকটা স্তিমিত, কিন্তু দেয়ালগুলো এখনো সাক্ষ্য দেয় সেই বর্ণিল দিনগুলোর। উঠোনের একপাশে ছোট্ট খেলার জোন, যেখানে একরত্তি সিয়াম দৌড়াচ্ছে হাসতে হাসতে,তামান্না আর তালহার ছেলে। তার হাসি যেন পুরো বাড়িটাকে জীবন্ত করে রাখে।
তামান্না এখন পুরোপুরি মায়ের ভূমিকায়। চোখেমুখে যেন মাতৃত্বের প্রশান্ত দীপ্তি। সে মাঝে মাঝে বিভিন্ন হস্তশিল্পের কাজ করলেও তার পুরো সময়টাই সিয়ামকে ঘিরে।
অন্যদিকে, অরা এখন ঘরের শান্ত কোণেই গড়ে তুলেছে নিজের অফিস কর্নার। কোম্পানির প্রজেক্ট মেইল, কনফারেন্স, রিপোর্ট—সবই বাসায় বসে সেরে নেয় সে। প্রতিদিন সকালে কফির মগ হাতে খোলা জানালার পাশে বসে কাজ শুরু করে অরা। আরিশ অরাকে একেবারে বিজনেস হিউম্যান করে তুলেছে। তবে সবকিছুই বাড়িতে বসে। খুব দরকার ছাড়া অরাকে নিয়ে বাইরে বের হয় না সে। কারণ একটাই! আরিশের জেলাসি…
অবশ্য অরা এখন আরিশের সবকিছু নিজের সাথে মিশিয়ে ফেলেছে। তার রাগ, জেদ, বিষাক্ত ভালোবাসা, দখলদারিত্ব সবকিছুই এখন অরার অভ্যাসে পরিণত হয়েছে।
রাত দশটা বাজে। অরা জানালার পাশে দাঁড়িয়ে আছে। চাঁদের আলো গায়ে পড়ছে। তার হাতে ধরা এক জোড়া ছোট বেবি বুটিজ, যেগুলো সে কয়েক মাস আগে না ভেবেই কিনে ফেলেছিল, শুধু হঠাৎ আশা জাগায়। আরিশ পেছন থেকে এসে অরাকে জড়িয়ে ধরে।
“আবার এই বুটিজটা বের করেছো?”
অরা কিছু বলে না। শুধু মাথা নাড়ে।
আরিশ একটু চুপ থেকে বলল,
“ এবার অন্তত আমাদের ঘরে নতুন অতিথি আসুক, হামিংবার্ড।”
অরা চোখ বন্ধ করে। বুকের মধ্যে কী যেন একটা ভেঙে পড়ে। তারপর আস্তে করে বলে,
“আমি ভয় পাই, আরিশ। আবার যদি… আবার যদি হারিয়ে ফেলি তাকে?”
আরিশ এবার অরার সামনে এসে দাঁড়ায়। চোখে চোখ রাখে।
“তুমি জানো, আমি তখন কীভাবে ভেঙে পড়েছিলাম। কিন্তু তুমি? তুমি তো আরও বেশি কষ্ট পেয়েছিলে। আমার থেকে হাজারগুণ বেশি যন্ত্রণা সহ্য করেছিলে। কিন্তু অরা ওটা একটা দূর্ঘটনা ছিলো। তাই বলে কি আমরা নিঃসন্তান থাকবো?”
অরা এবার চোখ মুছে বলল,
“আমি জানি, আপনিও চান। আমিও চাই… কিন্তু আমার সাহস হয় না।”
আরিশ অরার কপালে চুমু দেয়।
“আমি তো তোমাকেই চাই, অরা। বেবি আসবে, যখন সে আসার কথা। শুধু এটুকু মনে রেখো।তোমার পাশে আমি আছি, ছিলাম, থাকবো। আবার না-হয় নতুন করে স্বপ্ন দেখি? আমি আর তুমি একসাথে?”
অরা একটু হাসল। চোখের পানি গড়িয়ে পড়ছে। আরিশ তা মুছে দিলো।
“ ঠিক আছে। এবার সময় এসেছে ছোট্ট আরিশকে নিয়ে আসার।”
” আরিশ না, আমার ছোট্ট অরাকে চাই। ঠিক তোমার মতো একটা ছোট্ট পাখি”
অরা খিলখিল করে হাসে। আরিশ জবাব দেয় না। সে শুধু অরাকে বুকে চেপে ধরে রাখে।
একটা রাত, দুটো মানুষ, একটা আশা…
সন্ধ্যাবেলা। ড্রইংরুমে বসে আছে তালহা, আরিশ। সিয়াম এককোণায় বসে খেলছে। তামান্না ও অরা রান্নাঘরে, চা – নাস্তা তৈরি করছে। তাসলিমা খাতুন নিজের ঘরে আছেন। বয়স হয়েছে উনার। ইদানীং বেশি হাঁটাচলা করতে পারেন না। সাবিহা মেহরাবের সাথে চুটিয়ে সংসার করছে।
“ বড়ো আব্বু….. “
সিয়াম এসে আরিশের সামনে দাঁড়াল। আরিশ মুচকি হেসে তাকে কোলে তুলে নিয়ে বলল,
“ ইয়েস, পাপ্পা। “
“ আমার একটা কালো জামা লাগবে, তোমার মতো। “
তালহা সিয়ামের কথায় হাসলো। আরিশ জিজ্ঞেস করলো,
“ আমার মতো?”
“ হু, তোমার মতো। তুমি চব সময় কেমন কালো জামা পরে থাকো, কুব সুন্দর লাগে । “
রান্নাঘর থেকে অরা ও তামান্না হাতে চা ও স্নাকস নিয়ে ড্রইংরুমে উপস্থিত হতেই সিয়ামের মিষ্টি মিষ্টি কথাগুলো শুনতে পেলো। সবাই ওর কথায় হাসছে।
“ যাক… তুমি অন্তত বুঝলে, কালো পোশাকে আমাকে সুন্দর লাগে। আমি তোমাকে বিকেলে একটা সুন্দর ব্লাক শার্ট এনে দেবো, ওকে?”
সিয়াম আরিশের কপালে চুমু খেলো।
“ ওকে বড়ো আব্বু। “
সিয়াম আরিশের কোল থেকে নেমে আবারও খেলতে চলে গেলো। অরা, তামান্না বসলো। সবাই মিলে চা খেতে খেতে কথা বলতে লাগলো।
[হামিংবার্ড বইয়ের প্রি-অর্ডার চলছে। মাত্র তিনশো বিশ টাকায় বইটি অর্ডার করতে পারবেন যেকোনো বুকশপে। ]
বিকেলের নরম আলো এসে পড়েছে খান ভিলার ছাদের এক কোণে। সেখানে একা বসে আছে নয়না। হাতে একটা ছোট্ট স্কেচবুক, পাশে পেনসিল ছড়িয়ে রাখা। কিন্তু সে কিছু আঁকছে না। শুধু বসে আছে, চোখ রাখছে দূরের রোদে ভেজা গাছে, কোথাও একটুকরো একাকিত্ব জমে উঠছে তার চোখে।
গতকাল খান বাড়িতে এসেছিল নয়না। নয়না এখন ইউনিভার্সিটিতে পড়ে। খুব বেশি ব্যস্ততা নেই, কিন্তু মনটা আগের মতো চঞ্চলও না। আনমনে স্কেচবুকে কিছু একটা লিখে ফেলল নয়না।
“কখনো কখনো কারো কাছে কিছুই না হয়েও তার অনুপস্থিতি যেন অসম্পূর্ণ করে তোলে একটা গোটা দিন।”
পেছন থেকে ছোট্ট সিয়াম ছুটে এলো ছাদের সিঁড়ি বেয়ে।
“নয়ন খালামনি! সিয়াম খালা খাল খেলবে!”
নয়নার মুখে একটুকরো হাসি ফুটে উঠল। সিয়ামকে কোলে তুলে নিলো সে, হালকা বলল,
“সিয়াম খালা খাল না, সিয়াম হচ্ছে রাজা। খালামনি হলো রাজ্যের একজন সৈনিক।”
“তা হলে তুমি আমার ঘোড়া। হিনহিন করে হাঁটো!”
নয়না এবার হেসে ফেলল। একটুখানি সারল্য ফিরল তার চোখে। সিয়ামকে পিঠে তুলে দৌড় দিতে দিতে ভাবল,হয়তো জীবনের সব প্রশ্নের উত্তর একসাথে আসে না, কিন্তু কিছু উত্তর পাওয়া যায় শিশুদের হাসির ভেতরেও।
পেছনে পড়ে রইল সেই ফাঁকা ছাদে এক পৃষ্ঠা খোলা স্কেচবুক। পাতাটায় লেখা:
“আমি ভালো আছি – এই বলে বাঁচা আর সত্যিই ভালো থাকা এক না।”
তামান্না ছাদে এসেছে জামাকাপড় তুলতে, সিয়ামও সাথে এসেছিল তাই। নয়নার সাথে সিয়ামকে খেলতে দেখে কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে হাসছে তামান্না।
অরা টেবিলে বসে ল্যাপটপে কোম্পানির একটা রিপোর্ট টাইপ করছে। চুল খোলা, চোখে হালকা চশমা, পরনে সফট মেরুন কামিজ। পাশের টেবিলে ধোঁয়া ওঠা কফির কাপ আর বাচ্চাদের কিছু ছবি ছড়ানো।
আরিশ একটু আগে বাইরে থেকে ফিরেছে। এখন সে দাঁড়িয়ে আছে অরার ঠিক পেছনে। অরার কাঁধে হাত রাখতেই সে থেমে যায়, তাকায় পেছনে।
“আপনি এসেছেন? কখন ফিরলেন?”
“এই তো। মিনিট দশ হবে। তুমি কিছু খেয়েছো?”
অরা হালকা মাথা নাড়ে।
আরিশ চুপচাপ তার চুল সরিয়ে গালে আলতো চুমু দেয়।
“তুমি আগের চেয়েও সুন্দর হয়ে গেছো জানো?”
অরা হেসে বলে, “আপনিও আগের মতোই আধপাগল, টক্সিক একটা মানুষ হয়ে রয়ে গেছো।”
আরিশ এবার চেয়ারে বসে অরার মুখোমুখি হয়ে বলে,
“ সে আমি যেমন আছি বেশ আছি। আজ কোনো কাজ নয়। এখন আমি তোমার সাথে একটু সময় কাটাতে চাই। সবকিছু সাইডে রাখো ডার্লিং। ”
“ আরিশ প্লিজ! অনেক কাজ…..”
অরা কথা শেষ করার আগেই আরিশ তার ঠোঁট দখল করে নিলো। এক মুহূর্তে সব রিপোর্ট, মেইল, সময়ের হিসাব ভুলে গিয়ে অরা আবার ভেসে গেল ভালোবাসার অথৈজলে। যেখানে কেবল ছিল তারা দু’জন, একটা চুম্বনে গলে যাওয়া যত ভুল বোঝাবুঝি,আর একটা প্রেম– যেটা কোনোদিনও শেষ হয়নি, হবেও না।
শেষকথা
সব গল্প শেষ হয়, কিন্তু কিছু সম্পর্ক কোনোদিনও শেষ হয় না। অরা আর আরিশের সম্পর্ক ছিল সেইরকমই রাগে-ভালোবাসায় বাঁধা, ক্ষতে-ঘায়ে গড়া, অথচ ভীষণ নিজের। তাদের ভেতরে যত হিংস্রতা ছিল, তার চেয়েও বেশি ছিল আকুলতা। তারা একে অপরকে জিতেছে, আবার হারিয়েছে। শেষমেশ, ভালোবাসা জিতেছে শব্দহীন এক স্বীকারোক্তিতে, নিঃশ্বাস গায়ে লাগার মুহূর্তে। কারণ ভালোবাসা যদি সত্যি হয়, সেটার শেষ হয় না, ওটা শুধু রূপ বদলায়।
আর নয়না? সে ভালোবাসা পায়নি, ভালোবাসার মানুষকে খুঁজে পায়নি, তবু সে ভালোবেসে যাচ্ছে।
কারণ ভালোবাসা না পেলেও, কখনো কখনো ভালোবেসে যাওয়াটাই একমাত্র পূর্ণতা।
সমাপ্ত