#হারানো_হিয়ার_নিকুঞ্জ_পথে
লেখনীতে : তামান্না বিনতে সোবহান
পর্ব – ৪
তিনদিন পর আবারও মেয়েকে নিয়ে ডাক্তার দেখাতে আসতে হলো মিঠিকে। মিশুর শরীরে চাকা চাকা দাগগুলো সামান্য সারলেও রাত থেকে কিছু খেলেই বমি করে ভাসিয়ে দিচ্ছে। এইটুকু মেয়ের এত অসুস্থতা দেখে নিজেরই খারাপ লাগছে। অফিস থেকে তাড়াতাড়ি ফিরে মেয়েকে নিয়ে চলে এসেছে। তবে আজ একা আসেনি সে। মাকে সাথে নিয়ে এসেছে।
নির্দিষ্ট সময়ে ডাক এলে, মিঠি মাকে বলল, “তুমি ওকে নিয়ে যাও তো। আমি একটু পর আসছি।”
ফাতেহা বেগম নাতনীকে কোলে নিয়ে বললেন, “এখন কোথায় যাচ্ছিস?”
“ওয়াশরুমে!”
“এখুনি?”
“উফফ আম্মু!”
ভদ্রমহিলা বিরক্তিকর মেজাজ নিয়ে চেম্বারে প্রবেশ করলে, মিঠি নিজের সিটেই বসে রইল। অর্ণবের মুখোমুখি দাঁড়ানো সাহস নেই তার। কেবলই অপরাধবোধ? না, একদমই নয়। এক আকাশ সমান অভিমান মনে পুষে রেখেছে সে। কেন এই অভিমান? এই মানুষটার ওপর অভিমান করার অধিকার ছিল তার কোনোদিন? নিজেই তো সে পথে কাঁটা সাজিয়ে রেখেছিল! তবুও কেন? কীসের টানে? একবার যখন অভিমান জন্মেই গিয়েছে, থাকুক এভাবেই! না ভাঙুক কভু, কোনো কালে!
বহু বছর পর ফাতেহা বেগম ও অর্ণব মুখোমুখি। ভদ্রমহিলা যারপরনাই চমকেছেন অর্ণবকে দেখে। কণ্ঠস্বর আটকে আসছে তার। মিশুর অসুস্থতার কথা বলবেন কী, তিনি তখনও বিশ্বাসই করতে পারছেন না, অর্ণব সামনে। নিজেকে স্থির করতে বেশ খানিকক্ষণ নিশ্চুপে দাঁড়িয়ে রইলেন তিনি। বুঝেও ফেললেন, মেয়ের ভেতরে না আসার কারণ।
অর্ণব সালাম দিয়ে, জানতে চাইল, “কেমন আছেন আন্টি?”
“আছি বাবা, ভালোই।”
“দাগগুলো মিশেনি?”
“একটু তো মনে হয় মিশেছে। গতরাত থেকে শুধু বমি করছে। কিছু হজম হচ্ছে না পেটে।”
অর্ণব বুঝে গেল, কোনো কারণে ফুড পয়জনিং হচ্ছে৷ সে বাচ্চার শরীর চেক করে জিজ্ঞেস করল, “ওর মুখে শক্ত খাবার কী কী দিচ্ছেন?”
“আসলে ও খুব ছোটোবেলা থেকে ফর্মুলা দুধ খেয়ে অভ্যস্ত। ছ’মাস পর থেকে ভাত, মাছ, মাংস, ডিম-দুধ সবই দিই। ও তো আর খেতে পারে না। একটু-আধটু জোর করে খাওয়ানো লাগে।”
“বাইরের খাবার দিচ্ছেন? চিপস্, জুস, বিস্কুট, এসব?”
ফাতেহা বেগম আমতা-আমতা স্বরে বললেন, “মাঝেমধ্যে চকোলেট খায়! গতকাল রাতেও খেয়েছে।”
অর্ণব একটা দীর্ঘশ্বাস চেপে বলল, “এসব না দিয়ে বাচ্চাকে শাকসবজি খাওয়ানোর চেষ্টা করবেন। বাইরের খাবার বাচ্চাদের জন্য একদমই নিরাপদ নয় আন্টি।”
“কিন্তু ও তো খেতে চায় না।”
“ও ছোটো মানুষ! খাবেও অল্প অল্প। প্রয়োজনে অল্প দিবেন, ঘরের তৈরী খাবার। তবুও পেটে ক্ষিধে আছে ভেবে চিপস, জুস, চকোলেট ভুল করেও দিবেন না।”
অর্ণব আরও কিছু সাজেশন দিলে, ভদ্রমহিলা নাতনীকে নিয়ে চেম্বার ত্যাগ করলেন। অর্ণব দু’দিকে মাথা ঝাঁকিয়ে বিড়বিড়াল, “এই মেয়ে দেখি চকোলেটের ফ্যাক্টরি খুলে বসেছে! নিজেও মরবে, বাচ্চাকেও মারবে।”
ডায়াগনস্টিক সেন্টার থেকে বেরিয়ে, ফার্মেসি থেকে ঔষধ নিয়ে মা ও মেয়ে একটা রিকশা নিয়ে বাড়ির পথে রওনা হলেন। মিঠি দু’হাতে বাচ্চাকে বুকের কাছে আগলে ধরে রইল।
ফাতেহা বেগম আস্তেধীরে মুখ খুললেন, “তুই বলিসনি কেন, অর্ণবকেই দেখাচ্ছিস?”
মিঠি শান্তস্বরে উত্তর দিল, “আমিই গতদিন দেখা হওয়ার পর জানলাম।”
“কিছু জানতে চেয়েছে?”
“কী জানতে চাইবে?”
“তোর দ্বিতীয় বিয়ে সম্পর্কে!”
“না, উনি এই ধরনের সস্তা প্রশ্ন করে মানুষকে বিব্রত করেন না। আগেও কোনোদিন করতে দেখিনি।”
“ও কি বিয়ে করেছে?”
“করলে করুক! এতে কার কী? তুমি এত মাথা ঘামাচ্ছ কেন?”
ফাতেহা বেগম আধভাঙা স্বরে বললেন, “না, মানে, ওই নুহাশ…।”
“আম্মু, যে সময়টা আজ অতীত, সেটা নিয়ে অকারণ ভেবে ভেবে নিজেকে কষ্ট দিতে চাই না। সময় থেমে থাকে না। আমারও থামবে না। দিনগুলো ঠিকই কেটে যাবে।”
মিঠি এসব নিয়ে কথা বাড়ানোর আগ্রহ পেল না, তাই ওখানেই থেমে গেল। বাসায় পৌঁছে পুরোদমে বাচ্চার যত্ন নেয়া শুরু করল। ভুল করেও বাচ্চা যেন চকোলেট মুখে না দেয়, সেজন্য হাতের কাছ থেকে সেসব দূরে সরিয়ে রাখল।
রাতে মা-মেয়ে নিজেদের মতো গল্প করতে বসলে, গল্পের ফাঁকে ফাতেহা বেগম বললেন, “আমি ক’দিনের জন্য গ্রামে যেতে চাইছি। তুই কি মানিয়ে নিতে পারবি?”
মিঠি বলল, “আমি ওকে নিয়ে অফিস করব কী করে?”
“ডে কেয়ারে রেখে যাবি।”
“তুমি এখন গ্রামে গিয়ে কী করবে?”
“অনেকদিন তোর আব্বুর কবর দেখা হয় না। মনটা কেমন ছটফট করছে। এক সপ্তাহের জন্যই যাব। কবরের চারপাশের বেড়া এতদিনে পুরনো হয়ে গেছে। ওগুলো ঠিকঠাক করিয়ে, তারপর আসব।”
“তোমার যা ইচ্ছে, তুমি তাই করো।”
রাত অনেক হয়েছে দেখে, তিনি আর অপেক্ষা করলেন না। মিঠিকে টেলিভিশনের সামনে বসিয়ে রেখে ঘুমাতে চলে গেলেন।
মিঠি একদৃষ্টিতে সিরিয়ালের দিকে তাকিয়ে থাকলেও ভেতরে তার অন্য চিন্তা! জীবন কত অদ্ভুত ও ভয়ানক হতে পারে, নিজেকে দিয়েই উপলব্ধি করতে পারছে। ছোট্ট এই জীবনে যা চেয়েছিল, পেয়েও ছিল তাই! কিন্তু নিষ্ঠুর নিয়তি তাকে প্রতি পদে পদে অপদস্ত করে বুঝিয়ে দিয়েছে, জীবনের যেকোনো সিদ্ধান্ত নিতে গেলে একটু ভেবেচিন্তে নিতে হয়৷ একটু খোলাখুলি আলোচনা করতে হয়। সেটা যেকোনো সম্পর্কের ক্ষেত্রেই। মুখ বন্ধ করে চেপে রাখলে কষ্ট বৈ সুখ মিলে না। অথচ অর্ণব ও তার সম্পর্কে এই খোলাখুলি আলোচনাটাই ছিল না, যার জন্য কিছু কথা, কিছু অব্যক্ত অনুভূতি, কেবলই একটা ওয়াদার কাছে হেরে গেছে৷ ওইযে, অর্ণব কথা দিয়েছিল, নুহাশের কাছে তাকে ফিরিয়ে দিবে! সে কথাই কাল হয়ে দাঁড়িয়েছিল সম্পর্কে!
***
গ্রাম থেকে প্রতিদিন শহরে এসে ক্লাস করা মিঠির জন্য কঠিন হয়ে যাচ্ছে। বিয়ের প্রথম কয়েক সপ্তাহ এভাবে চললেও, অর্ণব নিজেই এই অসুবিধার সমাধান বের করল। সিদ্ধান্ত নিল মিঠিকে নিয়ে শহরে চলে যাবে। এতে করে তার ও মিঠির দু’জনেরই সুবিধা হবে। বার বার এদিক-ওদিক দৌড়ানো লাগবে না।
রাতে খাবার টেবিলে এ কথা বাবা-মাকে জানাতেই দিলারা জামান অবাক হয়ে বললেন, “শহরে যাবে মানে? ও শহরে গেলে ঘর-সংসার সামলাবে কে?”
অর্ণব সোজাসাপটা বলল, “কিন্তু আম্মা, এমন করলে ওর পড়াশোনার ক্ষতি হবে।”
“দরকার কী পড়াশোনার? গ্রামের মেয়ে-বউদের এত পড়াশোনা করতে নেই। ঠিকমতো সংসার দেখাশোনা করে বাচ্চাকাচ্চা লালন-পালন করতে পারলেই হলো।”
“আম্মা, তুমি এখনও আগের যুগে পড়ে আছো। এটা আধুনিক যুগে। এই যুগে মানুষ শিক্ষাদীক্ষাকে গুরুত্ব দিতে পছন্দ করে বেশি। তাছাড়া ও যদি পড়াশোনা না করে, তাহলে নিজেকে তো শক্তভাবে দাঁড় করাতে পারবে না। আজ হোক বা কাল, ওর বাবা-মা যখন বৃদ্ধ হবেন, তখন তো ওকেই ওর বাবা-মায়ের দায়িত্ব নিতে হবে! না কি তুমি-আমি নিব ওনাদের দায়িত্ব?”
দিলারা জামান স্পষ্টকণ্ঠে বললেন, “আমি এত কথা জানি না, বাবলা। আমি তোদের স্পষ্ট করে একটা কথা বলে দিই, এই সংসারে থাকলে হলে বউ হয়েই থাকতে হবে। পড়াশোনা করে চাকরিবাকরি করবে, বাবা-মায়ের দায়িত্ব নিবে, এমন চিন্তাভাবনা থাকলে, ওকে ওর পথ দেখতে বল!”
মায়ের কথায় মাথার শিরা-উপশিরায় দপদপ করে আগুন জ্বলে উঠল অর্ণবের। সে চেঁচিয়ে উঠে বলল, “এটা অন্যায়, আম্মা। একটা মানুষ পড়াশোনা করে কী করবে, কী করবে না, এটা তার ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত। এখানে তুমি-আমি নিষেধাজ্ঞা আরোপ করতে পারি না।”
“দু’দিন হয়নি বিয়ে হয়েছে, এরমধ্যেই মুখে মুখে তর্ক করছিস?”
“মাফ করো আম্মা। তুমি তার সাথে অন্যায় করছ! এমন করে কারও ইচ্ছে-স্বপ্নদের গলাটিপে হত্যা করতে নেই।”
“বাহ, খুব ভালো। আগে তো বিয়েই করতে চাসনি। আর এখন…। একেবারে বউয়ের আঁচলের তলায় ঢুকে গেলি! আমার তো মনে হচ্ছে ওর গোটা পরিবারের লোকজন তোকে যাদুমন্ত্র করছে।”
অর্ণব মাথায় হাত চেপে অসহায় চোখে বাবার দিকে তাকাল। তিনিও স্ত্রীর কথায় সায় জানিয়ে বললেন, “মেয়েদের এত উড়তে দেয়া উচিত না বাবা। মেয়েরা ঘর-সংসার সামলাবে এটাই তো নিয়ম। তাদের কেন এত পড়াশোনা করে চাকরিবাকরি করতে হবে?”
অর্ণব দু’জনের দিকে তাকিয়ে বলল, “এ কথা আগেই বলতে! ঘরে চার-পাঁচজন চাকর এনে দিতাম। একটা মেয়ের জীবন নষ্ট করতাম না।”
রাগ করে না খেয়ে চলে গেল অর্ণব। তার ছোটো ভাই অরূপও মিঠির বয়সী। সে এত তর্কবিতর্কতে গেল না। শুধু ভাইকে বলল, “খেয়ে যাও ভাইয়া।”
অর্ণব শুধু বলল, “তুই খা।”
রুমে এসে দেখল মিঠিও মন খারাপ করে বসে আছে। এতসব কথা তার কানে এলেও সে নীরব শ্রোতা হয়ে শুনেছে শুধু, কোনো কথার প্রতিবাদ করতে ইচ্ছে হয়নি।
অর্ণব ব্যাগ গুছাতে গুছাতে বলল, “আম্মার কথায় কিছু মনে করবেন না। পুরনো দিনের মানুষ তো, ওনারা আর শিক্ষাদীক্ষার মূল্য কী বুঝেন!”
“কিন্তু আপনার আম্মাও যথেষ্ট শিক্ষিত! আমি যতদূর জানি, উনি এসএসসি পাশ করেছেন।”
“তাতে কী? চিন্তাভাবনার তো পরিবর্তন হয়নি। বাদ দিন, কাল শহরে যাচ্ছি, এটাই ফাইনাল।”
“আমার জন্য আপনি নিজের বাবা-মায়ের কাছে খারাপ হয়ে যাচ্ছেন।”
“অসুবিধা নেই। মাত্রই তো ক’দিন। এরপর যখন ডিভোর্স লেটারে সাইন করে দু’জনে দুই পথে হাঁটা ধরব, তখন আর কোনো কথাই শুনতে হবে না।”
পরদিন দু’জনে তৈরী হয়ে সবার থেকে বিদায় নিতে এলে, দিলারা জামান নাকমুখ কুঁচকে নিয়ে বললেন, “বিয়ের আগে তুমি তো বলোনি তুমি পড়াশোনা করে চাকরিবাকরি করতে চাও। যদি বলতে, আমি তোমাকে এই ঘরের বউ করতাম না।”
“কেন আন্টি? বিয়ের পর কি মেয়েদের পড়াশোনা করতে নেই?”
তখনও শাশুড়িকে আম্মা বা মা ডেকে অভ্যস্ত হতে পারেনি মিঠি। তাই আন্টিই ডাকত। ডাক শোনে দিলারা জামান খিটমিটে মেজাজে বললেন, “দেখেছিস, আমাকে আম্মা ডাকতেও তার মুখে আটকায়!”
“অভ্যাস হতে সময় লাগবে।”
“ওহ, তাই বলো। কোন ঘরের নবাবজাদী গো তুমি, শাশুড়িকে আম্মা ডাকতে অসুবিধা হবে?”
“আমি তো অসুবিধার কথা বলিনি। আপনি অযথাই রাগ করছেন। আমি তো শুধু বলেছি, আপনাকে আম্মা ডাকতে সময় লাগবে।”
“কী বলতে চাও তুমি? এখন তোমার আম্মা হতেও আমাকে পরীক্ষা দিতে হবে?”
“ছিঃ ছিঃ এসব আপনি কী বলছেন! একই গ্রামের বাসিন্দা হওয়াতে আপনাকে আমি আগে থেকেই আন্টি ডেকে অভ্যস্ত। বহুদিনের পুরনো অভ্যাস বদলে আম্মা ডাকাটা কঠিনই।”
“তা তো হবেই। তুমি তো আর শাশুড়িকে নিজের মা ভাবোনি। তাই আমার কথারও কোনো মূল্য দিতে চাইছ না। যাও, যেদিকে মন চায়, যাও। আমার কী?”
মিঠি মনে মনে হাসল শুধু। যে মুখে তিনি কিছুদিন আগেও মায়া দেখেছিলেন, আজ সে মুখের দিকে করুণার দৃষ্টিতেও তাকালেন না।
অরূপ মিঠিকে বলল, “মন খারাপ করবেন না, ভাবী। মনোযোগ দিয়ে পড়াশোনা করবেন। আমার বিশ্বাস, আপনি একদিন অনেকদূর পর্যন্ত এগোবেন।”
দেবরের কথায় মিঠি খানিকটা স্বস্তি পেল। শ্বশুর-শাশুড়িকে কদমবুসি করে বিদায় নিয়ে, গাড়িতে উঠলে দিলারা জামান দাঁত কিড়মিড় করে বিড়বিড়ালেন, “দেখব, পড়াশোনা করে কতদূর, কী উল্টাও।”
উত্তরে দূর থেকে নিষ্পাপ হাসি দিয়ে বাড়ি ছাড়ল দু’জনে। এরপর থেকে দু’জন মানুষ ছাড়া হাত-পা নিয়ে শহরের আনাচে-কানাচে ঘুরে বেরিয়ে নিজেদের সময়টাকে উপভোগ করতে লাগল। একদিকে অর্ণব বাইরে যাওয়ার প্রস্তুতি নিতে লাগল, অন্যদিকে মিঠি পড়াশোনা নিয়ে সিরিয়াস হয়ে গেল৷ মাঝেমধ্যে নুহাশের সাথে তার দেখা হতো। তখন পুরোদমে আড্ডা চলত। না, সেই আড্ডা প্রেমিক-প্রেমিকার নয়! বরং বন্ধুত্বের৷ তিনজনে মিলে জমিয়ে আড্ডা দিত তারা।
সময়ের সাথে সাথে পাল্লা দিয়ে সম্পর্ক একটা নির্দিষ্ট গণ্ডিতে আটকে রেখেই এগোচ্ছিল, কেউ নিজেদের কথার বরখেলাপ করার সাহস দেখায়নি। দু’জনে একই রুমে থাকলেও ভুল করেও কাছাকাছি আসেনি কিংবা কোনো ধরনের বিব্রতকর পরিস্থিতির মধ্যেও পড়তে দেয়নি কেউ কাউকে। শ্রদ্ধা, সম্মান ও বিশ্বাস বজায় রেখে দিন কেটে যেতে লাগল।
এমন করে করে দিন কাটাতে গিয়ে মিঠির একটা ভরসার জায়গা হয়ে গেল অর্ণব। সে চলতে পথে তাকেই বিশ্বস্ত ভেবে ঘরণী হয়ে উঠতে না পারলেও পুরোদমে অর্ণবের কাছের একজন হয়ে গেল। দাম্পত্য জীবনের ঠিক পাঁচ মাসের মাথায় মিঠির বাবা আলমাস কবীর দ্বিতীয়বার স্ট্রোক করেন এবং সেদিনই পৃথিবীর বুক থেকে নিজের নাম ও অস্তিত্ব মুছে নেন।
খবর পেয়ে বাবার মৃতদেহ শেষবারের মতো দেখতে গ্রামে গেল মিঠি। একমাত্র মেয়ের জামাই হিসেবে অর্ণবকেই সবকিছু সামাল দিতে হলো৷ এতে করে দিলারা জামান আরও রাগে-ক্ষোভে ফেটে পড়তে লাগলেন। তিনি নিশ্চিত হয়ে গেলেন, ছেলেকে বিয়ে করিয়ে বউ আনেননি, বরং ঘরে একটা কালনাগিনী ঢুকিয়েছেন। যার মায়া ও মোহে পড়ে অর্ণব বাবা-মাকে পর করে দিয়েছে। যেন বউ-ই তার সব!
এক বিধবা মহিলাকে তিনি সান্ত্বনা দিবেন কী, উলটে বকাঝকা করে এসেছেন। বাড়িভরা লোকের সামনে ছেলের হাত টানতে টানতে বললেন, “তুই এখানে কী করছিস, বাবলা? কেন এদের নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছিস! বাড়ি চল তাড়াতাড়ি।”
মায়ের আচরণে অর্ণব হতভম্ব হয়ে বলল, “আম্মা মিঠি এসব সামাল দিতে পারবে না। ও বাচ্চা মানুষ। এইমুহূর্তে ওদের পাশে একটা ভরসার হাত ভীষণ দরকার।”
“আত্মীয়স্বজন আছে, পাড়াপ্রতিবেশি আছে, তারা দেখবে। তুই আয়।”
“আমি যাব না, আম্মা। হাত ছাড়ো আমার।”
জোরপূর্বক অর্ণব নিজের হাত ছাড়িয়ে ঘরের বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে মিঠির চাচা ও ফুপুর সাথে আলোচনা করতে চাইলে, সকলের সামনে দিলারা জামান ছেলেকে প্রায় হুমকি দিয়ে বললেন, “হয় তুই ওকে তালাক দিবি, নয় তোর আব্বা-আম্মাকে জীবন্ত কবর দিবি।”
“আম্মা! এসব তুমি কী বলছ? কেন বলছ? তোমার মাথা খারাপ হয়ে গেছে। এদিকটা সামলে নিই, আমি তোমাকে শীঘ্রই একজন সাইকিয়াট্রিস্ট দেখাব।”
“পাগল আমি হইনি। তুই হয়েছিস। ওর রূপে অন্ধ হয়েছিস। আম্মা কী, এখন আর সেটাও চিনিস না!”
উপস্থিত মানুষের সামনে মায়ের এমন আচরণ অর্ণবকে যে-ই লজ্জা ও অপমানের মুখে ফেলেছে, সেসবের পর নিজেকে আর স্পষ্ট করতে ইচ্ছে হয়নি। বলতে ইচ্ছে হয়নি, আমার সবকিছুই তো তোমরা! তোমরাই যদি আমাকে ভুল বুঝো, আমি কার কাছে নিজের দুঃখগুলো জমা রাখব?
***
চলবে…