#হারানো_হিয়ার_নিকুঞ্জ_পথে
লেখনীতে : তামান্না বিনতে সোবহান
পর্ব – ৭
মিঠি গ্রামে পৌঁছাল সন্ধ্যার পর। বাড়ির বাইরে তখন অসংখ্য মানুষ। তারমধ্যে অরূপকেও ছোটাছুটি করতে দেখে দ্রুতপায়ে নিজেদের ঘরের দিকে এগোলো।
অরূপ তাকে দেখে, এগিয়ে আসতেই মিঠি জানতে চাইল, “আম্মু ঠিক আছে?”
অরূপ উত্তর দিল, “হ্যাঁ, ডাক্তার আনিয়ে ছিলাম। উনি বললেন অতিরিক্ত দুঃশ্চিন্তার জন্য এমন হয়েছে।”
“ওহ। থ্যাংক ইউ।”
মিঠি ঘরে এসে মায়ের পাশে কিছুক্ষণ বসে, মাথায় হাত বুলিয়ে বলল, “কী দরকার ছিল এখানে একা থাকার? কাল সকালেই আমরা এখান থেকে চলে যাব। আর কখনও এখানে আসার জন্য ছটফট করবে না।”
নুহাশের সাথে ঝামেলা পোহাতে গিয়ে আর্থিক সংকটের কারণে বাবার নামের কিছু জায়গা বিক্রি করে দিয়েছিল মিঠি। গ্রামে এখন আর তাদের কিছু নেই, শুধু ভিটা ও কবরস্থান ছাড়া। তাই এখানে আসার টান নেই। তবুও তার মা ফাতেমা বেগম গ্রামে আসার জন্য ছটফট করেন।
মিঠি যেহেতু তার মায়ের সাথে আছে, অরূপ আর বেশিক্ষণ দাঁড়াল না। যাওয়ার আগে শুধু মিঠিকে বলল, “কিছু লাগলে আমাকে জানাবেন ভাবী।”
মিঠি শুকনো হাসি দিয়ে বলল, “ভাবী ডেকে আমাকে লজ্জায় ফেলবেন না প্লিজ। যে সম্পর্কের সূত্র ধরে এই সম্বোধন, সেটা যেহেতু নেই, এখন আর সম্বোধনেরও প্রয়োজন নেই। শুনতে ভীষণ হাস্যকর লাগে।”
“কিন্তু আমি তো আপনাকেই আমার ভাবী জেনে এসেছি। এবং আপনাকে ভাবী ডাকলেই শান্তি পাই।”
“সেটা আমার প্রতি আপনার সম্মান! এজন্যই হয়তো।”
“আম্মা যদি ওই সিচুয়েশন তৈরী না করতেন তাহলে হয়তো আপনাদের সম্পর্কটা বেঁচে যেত।”
“সম্পর্ক বাঁচানোর জন্য চেষ্টার দরকার হয়, ভাই৷ যেটুকু আমাদের মধ্যে একদমই ছিল না। আমি এসব নিয়ে কথা বলতে চাইছি না। প্লিজ, আপনিও আমাকে আর ভাবী ডাকবেন না।”
অরূপ কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে বিদায় নিল। মনে মনে সে একটা ছক সাজিয়ে ফেলল দ্রুত, যদি কোনোভাবে এবার ভাইকে বুঝানো যায়।
মিঠির জীবনের সব কথাই সে ফাতেহা বেগমের কাছ থেকে জেনেছে৷ জানার পর থেকে তার মনে খারাপ লাগার জন্ম নিয়েছে। আসলে কোনো মানুষই নিজের জীবনে এমন অনাকাঙ্ক্ষিত দুর্ঘটনা চায় না। যতই জীবনকে নির্দিষ্ট লক্ষ্য পর্যন্ত নেয়ার চেষ্টা থাকুক না কেন, কোনো না কোনোভাবে সেই পথও দুর্গম হয়ে উঠে। কেউ কেউ হয়তো সেই দুর্গম পথ সাহসিকতার সাথে উতরে যায় আর কেউ কেউ তিক্ত বাস্তবতার কাছে হেরে গিয়ে জীবনের সব সুখ ও সৌন্দর্য হারিয়ে ফেলে।
অরূপ বাড়ি এসে আগে নিজের স্ত্রী মুনিরার সাথে মিঠিকে নিয়ে আলাপ-আলোচনা করল। এরপর বাবা-মায়ের কাছে গিয়ে আগে দিলারা জামানকে উদ্দেশ্য বলল, “আম্মা তোমাদের সাথে জরুরী কথা ছিল।”
দিলারা জামান পান চিবোতে চিবোতে বললেন, “কী কথা?”
“তোমরা কি ভাইয়াকে সুখী দেখতে চাইছ না?”
“কেন চাইব না? এজন্যই তো বার বার বলছি, বিয়ে করুক। কিন্তু ও-ই তো শুনছে না।”
“একবার কি জানতে চেয়েছ সে কেন বিয়ে করতে চাইছে না?”
দিলারা জামান মুখ ঝামটা মেরে বললেন, “এসব কথা আবার জানতে চাওয়া লাগবে কেন? বয়স হয়েছে, বিয়ে করতে হবে। ব্যস…।”
“তুমি যে ভাইয়ার জীবন নষ্ট করে দিলে এরজন্য অনুতপ্ত নও?”
“আমি কেন ওর জীবন নষ্ট করতে যাব? ও-ই তো আমার কথার দাম দিল না।”
“এখনও টিপিক্যাল মন-মানসিকতা নিয়ে পড়ে আছো! তোমাদের মতো বাবা-মায়ের অতি বাড়াবাড়ি সন্তানের জীবন নষ্ট করে দেয়। মানো কি, না মানো, ভাইয়ার জীবন নষ্টের জন্য তোমরা দায়ী। বিয়ে করিয়েছ জোর করে, ডিভোর্স দিয়েছ জোর করে! এমন করে করে তোমরা তাকে মানসিক অশান্তি দিয়ে জীবনটাকে নরক বানিয়ে ছেড়েছ। অথচ ওই একটা মানুষ গোটা একটা সংসারের হাল ধরেছিল বলেই সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা পেয়েছ।”
“বাবলা কোনোদিন এসব বলেনি, তুই বলছিস কেন?”
“সে বলেনি সেটা তার ভদ্রতা!”
“যা তো এখান থেকে! মাথা খাস না।”
“আমি একটা কথা বলতে এসেছি।”
দিলারা জামান বিরক্ত হয়ে বললেন, “কী বলবি ঝটপট বল! মাথা ধরেছে আমার।”
অরূপ একটু স্থির হয়ে বসে, আস্তেধীরে বলল, “আমি বলছিলাম কী, মিঠি ভাবীকে যদি আবারও এই ঘরের বউ করে আনা যায়!”
“মাথা খারাপ তোর? ওকে আনব কেন?”
“আমার কথা শোনো আগে!”
এরপর মিঠির বর্তমান সিচুয়েশন সব বুঝিয়ে বলে, মায়ের উত্তরের অপেক্ষায় রইল। দিলারা জামান সব শুনলেন, বুঝলেন। মনে মনে মিঠির নিজের দিকের আর্থিক স্বচ্ছলতার কথা মাথায় রেখে আস্তেধীরে বললেন, “ধর্মমতে যেহেতু কোনো সমস্যা নেই, বিয়ে দেয়া যেতেই পারে। তবে আমার এক কথা, তুই মিঠির মাকে বলবি, এবার যেন মেয়েটা একটু সংসারী হয়। আর কোলের ওই বাচ্চা, ওকে যেন কোনো এতিমখানায় দিয়ে দেয়। আমি কোনো রাস্তার বাচ্চাকাচ্চাকে এই ঘরে অ্যালাও করব না।”
“কিন্তু আম্মা, বাচ্চাটার তো কোনো দোষ নেই। ভাবী একটা অসুস্থ মানুষকে বিপদে পড়তে দেখে সাহায্য করেছে। একটা পরিবারহীন অবুঝ বাচ্চার দায়িত্ব নিয়েছে। এগুলো কি কম ঝামেলার বলো? আইনী সব জটিলতা সামাল দিয়ে এই বাচ্চার দায়িত্ব নিতে হয়েছে। তাকে কেন সে হাতছাড়া করবে? আর ভাবীর কাছে যেভাবে বাচ্চাটা সুন্দর একটা পরিবেশে আছে, সেটা অন্য কোথাও পাবে না। এতে বাচ্চাটার জীবন নষ্ট হবে।”
“আমি এত কথা জানি না। পরের বাচ্চার দায়িত্ব আমরা নিতে পারব না।”
“তোমার নিতে হবে কেন? ভাবীই পারবে। সে তো এখন সাবলম্বী।”
“আচ্ছা, যা। কান খাস না। বাবলার সাথে কথা বলে দেখ।”
অরূপ স্বস্তি পেল এইভেবে যে, মাকে বুঝানো গেছে। এখন যদি অর্ণবকেও বুঝানো যায়, তাহলে মিঠি একটা সুন্দর সংসার পাবে। আর ভাইও সুখী হতে পারবে৷ সে খুশিমনে বউকে এই খবর জানাতে গেল। পাশাপাশি প্রস্তুতি নিল, ঠিক কীভাবে ভাইকে ম্যানেজ করবে!
***
হসপিটাল থেকে ফেরার পথে, দীর্ঘদিন পর নুহাশকে এমন বিষণ্ণ চেহারা নিয়ে, আলুথালু বেশে ফুটপাত ধরে হাঁটতে দেখে ঝটপট গাড়ি থামিয়ে ডোর খুলে নেমে পড়ল অর্ণব। সামনে দাঁড়িয়ে বলল, “আপনার এই অবস্থা কেন? সুখী মানুষের এমন দুঃখী চেহারায় একদমই মানাচ্ছে না ভাই।”
নুহাশ প্রথমে এড়িয়ে যাওয়ারই চেষ্টা করল। চিনে না এমন একটা ভাব দেখিয়ে ইতিউতি চোখ ঘুরাল। সে আসলে এই শহরের কোণায় কোণায় মিঠিকে খুঁজছে। কত্তদিন হয়ে গেল মিঠির সাথে বিচ্ছেদের। সেদিন যখন মিঠির মুখে শুনল অর্ণব তাকে ছুঁয়েছে, তখনই মাথা গরম হয়ে গেল তার। সেইসাথে মিঠির দিক থেকেও প্রতারণা মানতে পারল না। হিংস্র হয়ে উঠল। যত ধরনের অন্যায় করলে মিঠিকে পর্যাপ্ত শাস্তি দেয়া হবে, ততটাই অন্যায় করল। কিন্তু কে জানত, মিঠি এইভাবে ঘুরে দাঁড়াবে। দুর্বল মনের মেয়ের ওই প্রতিবাদী রূপ মেনে নিতে পারল না নুহাশ। বুঝিয়ে-সুঝিয়ে নিজের দিকে ফেরাতে চাইল। অথচ মিঠি শুনল না। আইনের আশ্রয় নিয়ে সম্পর্কটাই শেষ করে দিল।
অর্ণবকে দেখে আবারও সেইসব স্মৃতি মনের ভেতর আগুন জ্বালিয়ে, দপদপ করে জ্বলে উঠল৷ সে চিড়বিড়িয়ে অর্ণবের দিকে তাকিয়ে বলল, “সুখ? কীসের সুখ? আপনার জন্য সুখ আমার জীবন থেকে না-ই হয়ে গেছে!”
“মানে? কী বলছেন? আপনাদের জীবনে যেন কোনো সমস্যা না হয়, সেজন্য আমি আমার কথা রেখে দূরে সরে গেলাম। তবুও বলছেন আমি আপনার সুখ নষ্ট করেছি?”
“অবশ্যই। মিঠিকে ফিরিয়ে দিবেন বলেছিলেন কিন্তু তাকে ব্যবহার করবেন বলেননি! ছ’মাস নিজের কাছে রেখে ইচ্ছেমতো ব্যবহার করে এরপর সেকেন্ড হ্যান্ড মাল আমার হাতে ধরিয়ে দিয়েছেন। আমিই বোকা, জেনে-বুঝে একটা নর্দমাকে কাঁধে তুলে নাচতে শুরু করেছি।”
নুহাশের কথাগুলো বুঝতে একটু সময় লাগল অর্ণবের। যখন বুঝল, তখন তাকে বুঝাতে বলল, “আপনি ভুল ভাবছেন নুহাশ ভাই। যা হয়েছিল, একটা ভুল থেকে হয়েছিল। এখানে মিঠির কোনো দোষ নেই। ও বেচারি ওইদিন অসুস্থ ছিল।”
“তাই? দোষ থাকবে কী করে? লোভে পড়ে গিয়েছিল কি না!”
“এখন কিন্তু বাড়াবাড়ি হচ্ছে!”
“আর অন্যের সুখ নষ্ট করার সময় বাড়াবাড়ি মনে হয়নি?”
অর্ণব ঝামেলা এড়াতে বলল, “বাদ দিন এসব কথা। আপনি মিঠিকে নিয়ে থাকুন, এটাই সবসময় চেয়ে এসেছি আমি। আজও চাই।”
“এসব ড্রামাটিক কথাবার্তা বাদ দিন। যে নেই তাকে নিয়ে কীভাবে সুখী থাকব!”
ভ্রু কুঁচকে নুহাশের কথা বুঝার চেষ্টা করল অর্ণব। মুখফুটে প্রশ্ন করতে হলো না। তার আগেই নুহাশ বলল, “দেড় বছরের বেশি হতে চলল মিঠির সাথে ডিভোর্সের!”
“কী? ডিভোর্স?”
“হ্যাঁ, বনিবনা হচ্ছিল না, তাই।”
“এসব আপনি কী বলছেন! ডিভোর্স হলে মিঠির কোলের ওই বাচ্চাটা কে?”
“কোন বাচ্চা? কার বাচ্চা?”
“আপনি জানেন না?”
“না। ডিভোর্সের পর থেকে ওর কোনো খোঁজ আমি জানি না।”
এরপর কেন, কীভাবে ডিভোর্স হয়েছে, সব কথা স্পষ্ট করে জানাল নুহাশ। শোনে একটা চাপা নিঃশ্বাস ফেলে অর্ণব বলল, “অনেক বড়ো ভুল করে ফেলেছেন। আপনাকে উনি সত্যিই অনেক ভালোবাসতেন। আপনি তার ভালোবাসার মর্যাদা দিতে পারেননি।”
“আমি ভেবেছি সে আপনার প্রতি দুর্বল!”
“এমনটা হলে আমাদের ডিভোর্স হতো না! একটা ভুল ভাবনা আপনার গোটা সংসার নষ্ট করে দিয়েছে। অথচ আপনি আমাকে দোষী ভাবছেন!”
নুহাশ খুব অসহায় চোখে চারপাশে তাকাল। এরপর নিজের মতো করে হাঁটতে লাগল। অর্ণব গাড়িতে উঠে বসতেই অরূপের কল এলো। রিসিভ্ করার সাথে সাথে ওপাশ থেকে অরূপ বলল, “বাড়ি আসতে পারবে? খুব জরুরী কথা ছিল তোমার সাথে!”
***
চলবে…
‘আমার মাথায় হাত ছুঁয়ে একটা কথা দিবি এখন।’
‘কী কথা, আম্মি?’
‘খুব শীঘ্রই তুই বিয়ে করবি। রাঙামাটিতেই ঘর-সংসার শুরু করবি। যার মায়ায় তুই ডুবে আছিস, তাকে সারাজীবনের জন্য ভুলে যাবি। বল, আমার কথা মেনে নিবি? যদি না মানিস, আমি মরে-পঁচে গেলেও তুই আমার সামনে যাবি না।’
‘এ কেমন শাস্তি, আম্মি? একটা ভুলের জন্য তুমি এত নিষ্ঠুর হতে পারছ?’
‘আমার সন্তানের সুখের জন্য আমি সব করতে পারি।’
‘কিন্তু আমার সুখটা যে ওই একজনের মাঝেই।’
‘এটা তোর ভুল ধারণা। সাময়িক মোহ। বিয়ের পর এই মোহ কেটে যাবে। তুই রাঙামাটি যাওয়ার পরপরই বিয়ের আয়োজন শুরু হবে।’
আদিয়ান হাত সরিয়ে নিয়ে বলল, ‘এখন এসব কথা থাক, আম্মি। পরে কোনো একসময় এই নিয়ে কথা হবে।’
‘আমার যা বলার আমি বলে দিয়েছি। সিদ্ধান্ত তোর। তুই যদি ওই মেয়েকে চাস, আমাকে ত্যাগ কর। আর যদি তোর আম্মিকে চাস, তাহলে ওই মেয়েটাকে ত্যাগ কর।’
এরকম একটা পরিস্থিতিতে মায়ের এই কথাগুলো বিষাক্ত কাঁটার যন্ত্রণার চেয়েও দ্বিগুণ যন্ত্রণা হয়ে বুকে চেপে বসলো আদিয়ানের মনে। তার মন তো জানে, নওমীকে সে ভালোবাসলেও, তার ভালোবাসা কখনওই হতে পারেনি, পারবেও না। দু’জনের মধ্যে যে পার্থক্য, যে দূরত্ব, সেটুকু ডিঙিয়ে এক হওয়া সম্ভব নয়। তখনই সম্ভব হতো, যদি নওমী তাকে চাইত। কিন্তু…। মনকে মানিয়ে নিতে কষ্ট হলেও মাকে আর হারাতে ইচ্ছে হলো না আদিয়ানের। জীবনে বাবার আদর খুব কমই পেয়েছে। যতটুকু পেয়েছে, সেটুকুও আবছা। মায়ের আদর-শাসনের খুব প্রয়োজন এখন। যাক না ভালোবাসা দূরে, হারিয়ে যাক চিরতরে, মনের এককোণে সে না হয়, ভীষণ যত্নে আমৃত্যু থেকে যাবে।
সিদ্ধান্ত নিয়ে দু’হাতে মাকে জড়িয়ে ধরল আদিয়ান। ভাঙাগলায় বলল, ‘তুমি যা চাইবে, তা-ই হবে, আম্মি। তোমার পছন্দের মেয়েকেই বিয়ে করব আমি। তবে একটা কথা, যদি কোনোদিন দেখো, মানসিক বন্ধনটা পাকাপোক্ত হয়নি বলে, ছেলে অসুখী, সেদিন আফসোস করো না।’
*** চলবে