হিংসা পর্ব-০১

0
33

#হিংসা (১)
#নুসরাত_জাহান_মিষ্টি

আমার মা মিষ্টিটা আমার হাত থেকে কেড়ে নিয়ে ফেলে দিলেন৷ আমি অবাক হয়ে তার দিকে তাকালাম। মা রাগী কন্ঠে বলে,“তোর এত মিষ্টি খাওয়ার শখ জাগছে কেন? লজ্জাও করে না? তোর বোন তোর সঙ্গে পড়ে ক্লাসে প্রথম হয়েছে আর তুই কোনরকম পাশ করেছিস। লজ্জাও করলো না এই মিষ্টিটা নির্লজ্জের মতো হাতে নিতে?”
মায়ের কথা শুনে মূহুর্তে আমার চোখে পানি চলে এলো। আমার চাচাতো বোন শোভা ক্লাসে প্রথম হওয়ায় বাড়িতে মিষ্টি নিয়ে আসা হয়েছে। সেই মিষ্টি খুশিমনে খেতে নিতে মা এমনটা করলো। আমার চোখের পানি দেখেও মায়ের একটুও দয়া হলো না। সে আবার বললেন,“শোভার সঙ্গে সারাদিন থেকে লাভ কী? যদি ওর সঙ্গে থেকেও তুই কিছু শিখতে না পারিস? ওর মতো হতে পারিস না?”

আমি কথা না বাড়িয়ে ঘরে চলে এলাম। দরজা বন্ধ করে বিছানায় পা দিয়ে কয়েকটি লাথি দিলাম। জীবনটা শেষ হয়ে গেল। এই একই কথা শুনতে শুনতে। বাবা, মা যখনই আমার মুখ দেখে তখনই তাদের একটাই কথা,“শোভার মতো হতে পারিস না?”
শোভা আমার চাচাতো বোন। পড়ালেখায় খুবই ভালো। দেখতেও বেশ সুন্দর। অন্যদিকে আমি মোটামুটি দেখতে, সেই সঙ্গে পড়ালেখায় ভালো না। আমার পড়ালেখা মোটেও ভালো লাগে না। সবাই যে পড়ালেখায় ভালো হবে এমন তো কথা নেই। কিন্তু এই কথাটা বাবা, মা বুঝতে চায় না। তাদের একটাই কথা,“সারাদিন শোভার সঙ্গে থাকিস, তাও এত গর্দভ মূর্খ কিভাবে হলি?”

বাবা-মা, চাচা-চাচী সবার এই তুলনা দিনের পর দিন আমাকে মানসিকভাবে অসুস্থ বানিয়ে দিচ্ছে। তাদের কথা শুনে একটা সময় পড়ালেখার জন্য অনেক চেষ্টা করতাম। কিন্তু তাও ফলাফল শূন্য ছিলো। কিছুতেই পড়াগুলো মনে রাখতে পারতাম না। এক কথায় মেধা খুবই খারাপ ছিলো। আর এই এক দোষের জন্য আমার বাবা, মা অব্দি আমার থেকে বেশি শোভাকে পছন্দ করে। শোভা যা করে সেটাই তাদের পছন্দ। এই যেমন আমার ছবি আঁকতে খুব ভালো লাগতো। আমি এটা নিয়েই কিছু করতে চাচ্ছিলাম। একদিন আমার আঁকা একটি সুন্দর ছবি আমার মাকে দেখালে আমার মা সেটা দেখে খুবই হেঁসেছিলেন। ব্যঙ্গ করে বলেছেন,“তোর মতো গর্দভের দ্বারা এটাই হবে। পড়ালেখায় মন নাই, সারাদিন এসব ফালতু কাজে মন। তাই তো বলি রেজাল্ট এত খারাপ কেন?”

আমার মায়ের সেদিনের কথাটা আমার বুকের ভেতর তীরের মতো বিঁধলো। সেদিন শুধু আমার মা নয় সঙ্গে পরিবারের প্রত্যেক সদস্য আমাকে নিয়ে মজা নিচ্ছিলো। আসলে তারা বুঝতেই চাচ্ছিলো না, এই জগতে প্রত্যেক মানুষের আলাদা আলাদা ট্যালেন্ট থাকে। আমারও তেমন ছবি আঁকার। কিন্তু বাঙালির কাছে পড়ালেখায় ভালো হওয়া মানেই বিশ্ব জয়। সে পড়ালেখায় ভালো সে সবকিছু পারে এমন ধারণা কিছু মানুষের। যদিও এই ঘটনায় আমার কষ্ট হলেও তখনও আমি শোভাকে খুব পছন্দ করতাম। তার প্রতি আমার কোন হিংসা জন্মায়নি। কিন্তু! যেদিন দেখলাম শোভা আমার থেকে অনেক বাজে একটি ছবি এঁকে পরিবারের সবাইকে দেখায় তখন সবাই তার খুব প্রশংসা করছিলো। আমার যে মা আমার ছবিটা ভালোভাবে না দেখেই ব্যঙ্গ করেছিলো সেই মা বলে,“আমি জানি তো। আমার শোভা মা খুবই মেধাবী। ভবিষ্যতে খুব ভালো আর্টিস্ট হতে পারবি।”
এই ঘটনার পর শোভাকে আর্ট ক্লাসেও ভর্তি করা হয়। অথচ এই স্বপ্নটা ছিলো আমার। আমি এই কথা অনেকবার পরিবারকে বলেছিলাম। আমি এটা দিয়ে কিছু করতে চাই। কিন্তু তারা পাত্তা দেয়নি। তাদের কথা,“টাকা নষ্ট করে এসব শিখিয়ে লাভ নেই। তোর মোটা মাথায় এসব ঢুকবে না।”

অতঃপর দিনের পর দিন একই পরিবারে বড় হওয়ার পরও দুজনার প্রতি দুইরকম আচরণ আমার বিরক্তির কারণ হয়ে গিয়েছিলো। আমি ভুলে যাই শোভা আমার বোন। তাকে আমি ঘৃণা করতে শুরু করি। প্রচন্ড রকমের ঘৃণা। যার জন্য আমাদের দুই বোনের সম্পর্ক খারাপ হয়ে যায়। আমরা একই বাড়িতে থাকার পরও কেউ কারো সঙ্গে কথা বলতাম না।

____

এতক্ষণ অব্দি আমার কথা খুবই মনোযোগ সহকারে শুনছিলেন পুলিশ অফিসার রায়ান মল্লিক। আমার কথা শেষ হতে রায়ান বলে,“এটা তো গেল আপনার এবং আপনার বোনের গল্প। এখান থেকে খু ন অব্দি বিষয়টা কিভাবে গড়ালো সেটাও বলুন?” আমি তার কথা শুনে ম্লান হেসে বলি,“আপনি জানতে চাইছিলেন শোভার সঙ্গে আমার ঘটনা। আমি সেটাই বললাম। এখানে খু নের কোন সম্পর্ক নেই।”

“সত্যি কি তাই!”
রায়ান উপহাসের সুরে কথাটি বলে। আমি সেই কথা শুনে ম্লান গলায় বলে,“আপনার কী মনে হয়? আমি জাহিদকে খু ন করেছি?”

“প্রমাণ ছাড়া সরাসরি তো খু নের কথা বলা যায় না। তবে শোভা তার জবানবন্দিতে স্পষ্টভাবে বলেছে জাহিদ আপনার সঙ্গে বিয়ে করতে চাইনি। সে অন্য কাউকে পছন্দ করতো। তবে শোভা জানে না সে কে।”
একটু থেমে আবারও বলে,“আমার মনে হয় সেই মানুষটি শোভা। আর আপনি যখন জানতে পারলেন যে শোভার জন্য ছোটবেলা থেকে আপনি এত অপমান, এত লাঞ্ছণা সহ্য করেছেন। আপনার প্রিয় মানুষটিও সেই শোভাকেই পছন্দ করে। তখন আপনি অনেক ভেঙে পড়েন। সেই সঙ্গে শোভার প্রতি থাকা আপনার ঘৃণা আরও বেড়ে যায়। যার ফলে আপনি সিদ্ধান্ত নেন জাহিদকে মে রে ফেলার। হতে পারে চোখের সামনে শোভা এবং জাহিদকে এক হতে দেখতে পারতেন না আপনি তাই এই কান্ড ঘটিয়ে ফেলেছেন।”
রায়ানের এসব কথা শুনে আমি মৃদু হাসলাম। অতঃপর বললাম,“আপনার যা খুশি তাই ভাবুন। তাই প্রমাণ করুন। আমার কিছু বলার নেই।”

আমার মুখে এমন কথা শুনে রায়ান আমার চোখের দিকে রহস্যময় দৃষ্টিতে তাকালো। আমি আমার চোখ নামিয়ে নিলাম। রায়ান শান্ত গলায় বলে,“আপনার সাথে যা হয়েছে সেটা ঠিক নয়। পরিবারের মানুষদের এভাবে দুই বোনের ভেতর কমপ্রেয়ার করা উচিত হয়নি। সেই সঙ্গে অবশ্যই তারা আপনার ইচ্ছাকে প্রধান্য না দিয়ে অন্যায় করেছেন। আপনাকে আপনার প্রতিভা প্রমাণ করার সুযোগ তারা দেয়নি। অথচ আপনার চোখের সামনে অন্যকেউ সেটা পেয়েছে। এইগুলো থেকে আপনার শোভার প্রতি যে রাগ, ঘৃণার জন্ম হয়েছে সেটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। এখানে আপনার চেয়ে আপনার পরিবার বেশি দোষী। কিন্তু তাই বলে আপনি এভাবে কাউকে খু ন করার মতো অপরাধ….।”
রায়ানকে মাঝপথে থামিয়ে আমি শান্ত গলায় বললাম,“আমি কোন খু ন করিনি। আপনি ভুলপথে তদন্ত করছেন।”

“আমি ভুল পথে আছি নাকি সঠিক সেটা তো সময় বলবে।
এবার বলুন, জাহিদের সঙ্গে আপনার পরিচয় কিভাবে হয়েছে?”
রায়ানের এই কথায় আমি হেসে দিলাম। হাসিমুখেই বললাম,“খুবই ফালতু একটা প্রশ্ন।”

“মানে?”
রায়ান বুঝতে না পেরে জিজ্ঞেস করে। আমি খুবই স্বাভাবিক গলায় বললাম,“জাহিদ আমার মামাতো ভাই। তার সঙ্গে আমার কিভাবে পরিচয় হয়েছে এটা জিজ্ঞেস করা কেমন দেখায় না? আমাদের পরিচয় তো ছোটবেলা থেকেই।”

“ওহ হ্যাঁ। আপনারা তো কাজিন। ভুলে গিয়েছিলাম।”

“আপনাদের মতো পুলিশ অফিসাররাও ভুলে যায়?”
আমার এই প্রশ্নে অফিসার রায়ান আমার দিকে শান্ত চোখে তাকিয়ে থাকে। এই কথার জবাব না দিয়ে বলে,“আপনাদের বিয়েটা কিভাবে ঠিক হয়েছিলো?”

“আমার মামা, মামী এসে জাহিদ ভাইয়ের সঙ্গে আমার বিয়ের প্রস্তাব রাখেন। আমাদের পরিবারেরও জাহিদ ভাইকে খুব পছন্দ ছিলো, তাই রাজি হয়ে যায়।”
আমার এই কথা শুনে রায়ান কিছু একটা ভাবলো। অতঃপর বলে,“আপনার কষ্ট হচ্ছে না আপনার হবু স্বামী এভাবে খু ন হলো? না মানে আপনার চোখেমুখে তেমন কষ্টের ছাপ দেখা যাচ্ছে না।”

“কোথায় লেখা আছে কষ্ট পেলে সেটা অন্যদের দেখাতে হবে?
তাছাড়া আমি মনে করি কষ্টগুলো একান্তই ব্যক্তিগত। কাউকে এটা দেখানো উচিত নয়।”
একটু থেমে আমি আবারও বললো,“আমি জীবনে এত কষ্ট পেয়েছি যে আমার কষ্টগুলোও অন্যদের কাছে হাস্যকর ছিলো। সেই অবস্থানে দাঁড়িয়ে আমার কষ্টগুলো আমার মাঝেই থাক।”

“আপনি খুব সুন্দর গুছিয়ে কথা বলতে পারেন।”
অফিসার রায়ান যে পুরোপুরি ভাবে আমাকে সন্দেহ করছে সেটা আমি বুঝতে পারলাম। তবে তেমন ভাবান্তর না দেখিয়ে শান্ত গলায় বললো,“আমার হিংসা, আমার রাগ, আমার ঘৃণার সমন্বয়ে যদি আমি একজন খু নি হয়ে উঠতে পারতাম তবে আমি প্রথম খু নটা শোভাকেই করতাম।”


চলবে,

(ভুলক্রটি ক্ষমা করবেন।)