হিংসা পর্ব-০২ এবং শেষ পর্ব

0
3

#হিংসা (শেষ)
#নুসরাত_জাহান_মিষ্টি

“আমি জানি আমি খুব খারাপ। আমি পারিবারিক বৈষম্যের জন্য শোভার প্রতি হিংসাত্মক হয়ে উঠেছি। আমার সাথে যা হয়েছে তার জন্য হয়তো শোভা দ্বায়ী নয়। কিন্তু তাও আমি সবসময় ওকে ঘৃণা করে আসছি। এমনকি আজও ঘৃণা করি। এখানে আমার একটা খারাপ মানসিকতার বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে জানি আমি। কিন্তু তাই বলে শোভার রাগ আমি জাহিদের উপর দেখাতাম না। আর হ্যাঁ জাহিদকে আমার পছন্দ ছিলো না। তাই ও যদি শোভাকে পছন্দ করতো তাহলে আমি মানা করতাম না আশা করি।”
আমার এসব কথা শুনে রায়ান আমার দিকে অদ্ভুতভাবে তাকায়। সে আমার কথা বিশ্বাস করছে কি-না বুঝতে পারছি না। আমি ম্লান হেসে বললাম,“এটাই সত্যি। তাছাড়া আমার রাগ, ঘৃণা, হিংসা আমাকে দিয়ে খারাপ কাজ করায়নি এখনো। আশা করি ভবিষ্যতেও করাবে না। তবে একটা সময় আমি সত্যি শোভাকে আমার জীবন থেকে বের করতে চেয়েছিলাম। নিজের মনে ওকে মে রে ফেলার অনেক পরিকল্পনাও সাজিয়েছিলাম। সবই হিংসার বশবতী হয়ে। কিন্তু আমি কখনো এসব কাজ করার সাহস যোগাতে পারিনি। তাই আমি বুক ফুলিয়ে বলতে পারি, আমি কোন অপরাধ করিনি। হ্যাঁ আমার মস্তিষ্ক অনেক সময় অনেক বাজে চিন্তা করেছে।”
আমার এসব কথা শুনে রায়ান আমাকে আপাতত ছেড়ে দেয়। তার জিজ্ঞাসাবাদ শেষ। আমি চলে আসতে রায়ানকে এক কনস্টেবল বলে,“স্যার আমার মনে হয় এই মেয়েই খু নি। হিংসায় পড়ে মানুষ অনেককিছু করতে পারে। খু ন করে এখন নাটক করছে।”

“দেখা যাক।”
রায়ান এতটুকু বলে চুপ করে যায়। সে পুরো মামলাটি নিয়ে ভাবতে থাকে।

এদিকে আমি বাড়ি আসতে আমার বাবা, মা জিজ্ঞেস করলো পুলিশ কি জানতে চেয়েছে। আমি সবটা বললাম। অতঃপর মা বলে,“ওরা শোভাকে ছাড়েনি?”

“সেটা আমি জানি না।”
আমি এই কথা বলে নিজের ঘরে আসলাম। মা পিছন থেকে আমাকে অনেক কথা বললো। তার সবচেয়ে ভালোবাসার মেয়ে হলো শোভা। তাকে ফেলে রেখে আসা আমার উচিত হয়নি। এই পৃথিবীতে যে কিছু কিছু বাবা, মা থাকে যারা নিজের সন্তানকে দু-চোখে দেখতে পারে না তাদের মাঝে আমার বাবা, মায়ের নামটা প্রথমেই আসবে। এখানে শোভা আগে চলে আসলে আমার মায়ের এত চিন্তা হতো না আমাকে নিয়ে। এই বিষয়গুলোই আমার হজম হয় না। যদিও মাঝে মাঝে মনে হয় বাবা, মা সন্তানকে না ভালোবেসে পারে। আমার বাবা, মাও আমাকে খুব ভালোবাসে। কিন্তু আমার থেকে শোভাকে বেশি ভালোবাসে।
___
তিনদিন পর পুলিশ অফিসার রায়ান আমাদের বাড়ি আসে। বাড়িতে সবাই উপস্থিত ছিলো জাহিদের বাবা, মাও। রায়ানই সবাইকে ফোন করে ডেকে পাঠিয়েছে। পুলিশ অফিসার রায়ান আসতে জাহিদের বাবা বলে,“আমার ছেলের খু নি কে জানতে পেরেছেন?”

“হ্যাঁ।”
রায়ানের এই কথায় সবাই কিছুটা খুশি হয়। সবাই আগ্রহ নিয়ে বসে আছে খু নি কে জানার জন্য। রায়ান শান্ত গলায় বলে,“জাহিদকে মূলত হিংসার বশবতী হয়ে খু ন করা হয়েছে।”

“হিংসা? তারমানে শিমু?”
শোভার এই কথায় সবাই আমার দিকে তাকায়। আমি হতভম্ব হয়ে শোভার দিকে তাকিয়ে আছি। শোভা তৎক্ষনাৎ বলে,“এই বাড়িতে একমাত্র তুই আমাকে হিংসা করিস। তারমানে তুই জাহিদকে খু ন করেছিস? কিন্তু কেন? জাহিদ আমাকে পছন্দ করতো তাই?”
শোভার এই কথায় মূহুর্তের মাঝে পরিবেশ ঘোলাটে হয়ে যায়। আমার পরিবার আমার দিকে হতভম্ব হয়ে তাকায়। সবার চোখে আমি আমার জন্য সন্দেহ দেখতে পাচ্ছিলাম। এই বিষয়টি আমি হজম করতে পারলাম না। তারা শোভাকে এতটাই পছন্দ করে যে তার এক কথায় আমাকে সন্দেহ করতে শুরু করেছে। বাবা কিছু জিজ্ঞেস করতে যাবে তখনি রায়ান বলে,“আমাকে বলতে দিন।”

সবাই চুপ হয়ে যায়। সবাই রায়ানকে বলার সুযোগ দেয়। রায়ান শোভার দিকে তাকিয়ে বলে,“আপনি তো সেদিন বললেন জাহিদ অন্য কাউকে পছন্দ করে সেটা আপনি জানলেও এটা জানেন না সেই মানুষটি কে। তবে আজ কিভাবে এত নিশ্চিত হয়ে বলছেন যে সেই মানুষটি আপনি। আর আপনাকে হিংসা করেই শিমু জাহিদকে খু ন করেছে।”

রায়ানের এই কথায় শোভা না ঘাবড়ে গিয়ে শান্ত গলায় বলে,“এই কথাটা শিমুই আমাকে বলেছে। যে জাহিদ ওকে ভালোবাসে না। আমাকে ভালোবাসতো। যদিও এই কথাটি বলেই শিমু তৎক্ষনাৎ কথা ঘুরিয়ে নিয়েছে।”

এই কথা শুনে সবাই আমাকে পুরোপুরি অবিশ্বাস করতে শুরু করে। সবাই বলছে,“তুই শোভাকে হিংসা করিস সেটা আমরা সবাই জানি। তাই বলে এতবড় কান্ড ঘটিয়ে ফেলবি।”

সবাই প্রশ্নে প্রশ্নে জর্জরিত করে ফেলে আমাকে। আমি বাকরুদ্ধ হয়ে গেছি। কারো কোন প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে একদম পাথরের মতো দাঁড়িয়ে আছি। আমার বাবা যখন এগিয়ে এসে বলে,“এসব সত্যি? তুমি খু ন?”

“ওনি খু নি নন।”
রায়ানের এই একটি কথাই যথেষ্ট ছিলো সবার মুখ বন্ধ করার জন্য। সবাই অবাক হয়ে রায়ানের দিকে তাকায়া। রায়ান বলে,“যা চোখে দেখা যায় তা সবসময় সত্যি হয় না। হ্যাঁ এখানে সবাই জানে যে শিমু শোভাকে হিংসা করে। কিন্তু এটা কেউ জানে না, এখানে এমন একজন আছে যে শিমুকে হিংসা করে।”

“কি!”
সবাই হতভম্ব হয়ে যায়। তাদের কিছুতেই বিশ্বাস হচ্ছে না আমাকেও কেউ হিংসা করতে পারে। যদিও এই কথাটি শুনে আমিও অবাক হয়েছি। এই বাড়িতে আমাকে কে হিংসা করবে। তখন সবাইকে অবাক করে দিয়ে রায়ান বলে,“তার নাম শোভা।”

“অসম্ভব। শোভা কেন শিমুকে হিংসা করবে?”
আমার পরিবারের কেউ এই কথাটি মানতে পারলো না। তখন রায়ান তাদের সামনে প্রমাণ দেখায়। যেখানে শোভা যে বান্ধবীর মাধ্যমে বিষ সংগ্রহ করেছে সেই বান্ধবীর জবানবন্দি রয়েছে। সেই সাথে একটি কল রেকর্ড রয়েছে যেটায় জাহিদ এবং শোভার একটি কল রেকর্ডিং রয়েছে। যেখানে শোভা জাহিদকে বোঝাচ্ছে, সে আমার থেকে ভালো। সব দিক দিয়ে পার্ফেক্ট। জাহিদের আমার মতো একটা ফালতু মেয়েকে নয় বরং শোভাকে জীবনসঙ্গী করা উচিত। শোভা জাহিদকে খুব পছন্দ করে। তখন জাহিদ জানায় সে ছোটবেলা থেকে আমাকেই পছন্দ করে এবং আমাকেই বিয়ে করবে। সবাইকে পড়ালেখায় ভালো হতে হবে, ভালো জব করতে হবে এমন তো কথা নেই। আমি আমার মতো ভালো। এসবে শোভা রেগে যায়, রাগের মাথায় এটাও বলে দেয় আমার সঙ্গে এত ভালো ছেলের বিয়ে সে কিছুতেই হতে দিবে না। কখনো না।

সবাই এসব শুনে বিষ্ময়ের চোখে শোভার দিকে তাকায়। শোভা সব অস্বীকার করতে চাচ্ছিলো রায়ান একটু ভয় দেখাতে শোভা স্বীকার করে নেয়। শোভা বলে,“সারাজীবন সব ভালো জিনিস আমি পেয়েছি৷ শিমু আমার থেকে অনেক অনেক কম যোগ্যতার একটা মেয়ে। সেই মেয়ের বিয়ে কি-না হবে এত ভালো জায়গায়। তাছাড়া আমি জাহিদকে পছন্দও করতাম। তাই কিছুতেই এই বিয়ে মেনে নিতে পারিনি। সুযোগ বুঝে জাহিদের খাবারে বিষ দিয়ে দেই।”

শোভার স্বীকারোক্তি পেয়ে আমার পরিবারের সবার মাথানত হয়ে গেল। এটা দেখে রায়ান বলে,“সারাজীবন আপনারা একটা ঘরের মাঝে দুইটা মেয়ের সঙ্গে দুইরকম আচরণ করে গেছেন। তার পরিপেক্ষীতে শিমুর শোভাকে হিংসা করাটা তেমন বিশেষ কিছু ছিলো না। এখানে আমি তার দোষ কমই দিবো। সব দোষ আপনাদের। আপনারা তাকে ছোটবেলা থেকে ভালোবাসা দিলে সে শোভাকে এত হিংসা করতো না। যাই হোক আপনারা তাকে অপছন্দ করেন তাই তার হিংসাটা খুব সহজেই চোখে পড়েছে। কিন্তু শোভার হিংসা চোখে পড়েনি। কারণ শোভাকে আপনারা অনেক ভালোবাসেন। ভালোবাসায় অন্ধ হয়ে আপনারা এটা দেখলেন না যে এই শোভাও শিমুকে প্রচুর হিংসা করে। প্রচুর ঘৃণা করে। এখানেও দোষটা আপনাদের। একজনকে এত এত সুযোগ দিয়ে মাথায় তুলেছেন, তাকে বুঝিয়েছেন যে সে সেরা এবং অন্যজন তার পায়ের জুতার মতো। তাই তো শিমুর ভালো স্থানে বিয়েটা শোভা মেনে নিতে পারেনি।
এখানে সম্পূর্ণ দোষটা আপনাদের।”
এসব বলে রায়ান শোভাকে গ্রেফতার করে নিয়ে যায়। শোভা যেতে চায় না। তাকে টেনে নিয়ে যাওয়া হয়। আমার পরিবার নিজেদের ভুল বুঝতে পেরে সেখানেই থ মেরে বসে পড়ে। পরক্ষণে বোধহয় আমার কথা মনে পড়ে। তাই আমার বাবা, মা আমার দিকে আসতে নেয়। তবে তাদের কোন কথা বলার সুযোগ না দিয়ে আমি দ্রুত পায়ে হেঁটে ঘরে চলে যাই।

পরিশেষে, হিংসা খুবই খারাপ জিনিস। যার ফলাফলস্বরূপ আমাদের পরিবারটা ধ্বংস হয়ে গেল। এখন পরিবারের কেউ ভালো নেই। একে তো শোভা জেলে, তার উপর আমিও পরিবারের কারো সাথে কথা বলি না। সব মিলিয়ে সন্তানদের হারিয়ে বাবা-মা, চাচা-চাচী খুবই ভেঙে পড়েছে। তাদের অবস্থা দেখে আমার আর মায়া হয় না। আমার মন বলে, এটাই তাদের প্রাপ্য ছিলো। তবে এই ঘটনার পর থেকে আমি নিজেকে নতুনভাবে চিনলাম। আমি ততটা খারাপ নই। আমি হিংসাত্মক ছিলাম কিন্তু তাও কখনো কাউকে মা রারা সাহস যোগাতে পারিনি। হয়তো পারতামও না। এর কারণ বোধহয় আমার মাঝে কিছুটা হলেও ভালো মানুষি রয়েছে। যেখানে দাঁড়িয়ে শোভা হিংসার কাছে হেরে গিয়ে একটা মস্তবড় অপরাধ করে ফেলেছে৷ তার অপরাধটা আমাকে এবং আমার পরিবারকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখালো, সবখানে শোভা সেরা নয়। আমিও কোথাও গিয়ে সেরা।

(সমাপ্ত)