হিমাদ্রিণী পর্ব-০৬

0
2

#হিমাদ্রিণী – ৬
লেখনীতে – আয্যাহ সূচনা

কানাডা থেকে খতিব সাহেবের ছেলে ফোন করেছিল। সে জানালো, নিজে বিয়ে করেছে।একটি ভিন্ন ধর্মের মেয়েকে, যার বয়স তার চেয়ে তিন বছর বেশি। বাবা-মায়ের অনুমতি ছাড়াই হয়েছে এই বিয়ে।দেশে তার বাবা মা কেউই জানতো না এই বিষয়ে। এ খবর শোনার পরই খতিব সাহেবের শরীর খারাপ হতে শুরু করে। উত্তেজনা আর ক্ষোভে তাঁর বুক ধড়ফড় করতে থাকে এবং তাতেই তার শারীরিক অবস্থা সংকটজনক হয়ে পড়ে।

মাশুকের অবস্থা চরম বিপর্যস্ত। হেমাকে কোথাও খুঁজে পাচ্ছে না, যেনো পাগলপ্রায় হয়ে উঠেছে সে। মন অস্থির, অশান্ত। দ্রুত পা চালায় হাসপাতালের দিকে, যেখানে খতিব সাহেব সংকটাপন্ন। একদিকে খতিব সাহেবের অসুস্থতা, অন্যদিকে হেমার অনুপস্থিতি।দু’পক্ষেই টানছে মাশুককে। কী করবে, কোন দিক সামলাবে, কিছুই ঠিক করতে পারছে না। যেনো তার মস্তিষ্কের দিকনির্দেশনাও হারিয়ে গেছে এই বিশৃঙ্খল মুহূর্তে।

হাসপাতালে এসে দাঁড়ালো মাশুক।ফরিদা বেগমের উদ্দেশ্যে।বললো,

-“মিসেস সরোয়ার?”

ফরিদা বেগম রাগান্বিত হয়ে উঠেন মাশুক কিছু বলার পূর্বেই।বলেন,

-“আমি জানি না ওই পাগল মেয়ে কোথায়! আমি আমার স্বামীকে নিয়ে চিন্তিত।”

মাশুক কিছু বলার পূর্বেই শান্তনু বলে উঠলো,

-“আপনার চার রুমের ঘর থেকে একটি মেয়ে এভাবেই গায়েব হয়ে গেলো?”

-“বলছি আমি জানি না! জানি না আমি।”

মাশুক বলে,

-“চিৎকার করবেন না।আমি শেষ হেমাকে তার ঘরে ঘুমন্ত অবস্থায় রেখে এসেছি।আপনাদের বাড়ি গিয়ে তাকে পাইনি।এর অর্থ কি দাঁড়াচ্ছে?”

পাশেই বসে ছিলেন ফরিদা বেগমের বড় ভাই জব্বার।বোনকে এভাবে জেরা করতে দেখে রেগে গেলেন তিনি। মাশুকের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বলে উঠলেন,

-“সরে দাঁড়ান।সরে দাঁড়ান বলছি।আপনার সাহস কি করে হয় আমার বোনের সাথে এভাবে কথা বলার।কে আপনি?”

-“আমার সাহস কতটুকু সেটা জানানোর প্রয়োজনবোধ করছি না।হেমা আমার দায়িত্ব।খতিব সাহেব নিজে আমাকে তার দায়িত্ব দিয়েছে।আমার প্রশ্ন করার অধিকার আছে।বরং আপনি এসব থেকে দূরে থাকুন।”

জব্বার সাহেব মাশুকের কথার ঝাঁঝে আরো ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেন। চেঁচিয়ে জানতে চান,

-“কিসের দায়িত্ব?কেমন দায়িত্ব?কে আপনি?”

-“হেমা আমার পেশেন্ট।আমার আন্ডারে চিকিৎসারত।আর কিছু জানতে চান?”

-“ডাক্তার হয়ে আমাদের ব্যক্তিগত ব্যাপারে নাক গলাবেন না।”

মাশুক তুচ্ছ হাসলো।বললো,

-“রাইট! আপনিও হেমা আর তার চাচার ব্যাক্তিগত বিষয়ে নাক গলাবেন না।”

জব্বার মাশুকের বুকে ধাক্কা দিয়ে তাকে কিছুটা পেছনে সরিয়ে দেয়। দাউদাউ করে আগুন জ্বলে উঠলো যেনো মাশুকের মাথায়।এই অসম্মানটা একেবারে ভিতরে গিয়ে লেগেছে।জব্বার বলেন,

-“সাহসতো কম বড় না!দুই টাকার ডাক্তার আমাকে আমার বোনের বিষয়ে নাক গলাতে না করছে। পুলিশে দিবো আপনাকে আরেকবার যদি আমার বোনকে হেনস্তা করার চেষ্টা করেন।”

লোকটাকে দেখেই গুণ্ডা মনে হচ্ছে।কথাবার্তার ভঙ্গি ভালো না।শান্তনু এতক্ষণ চুপ থেকে এগিয়ে এলো। মাশুক হাত মুষ্ঠিবদ্ধ করে দাঁড়িয়ে আছে।নিজেকে কন্ট্রোল করার চেষ্টা করছে নীরব থেকে। শান্তনু বললো,

-“কেস নাম্বার ৯০১। খায়রুল সরোয়ার এবং নাসিমা সারোয়ার মার্ডার কেস। পাঁচজন আসামি।দুইজন এর মৃত্যুদণ্ড মঞ্জুর করেছে আদালত।আর তিনজন যাবতজীবন কারাদণ্ডপ্রাপ্ত।কিন্তু স্যার আসল আসামী এখনও মুক্ত বাতাসে ঘুরে বেড়াচ্ছে।বলুন পুলিশ ডাকবো?”

জব্বার বিস্ফোরিত চোখে চাইলো শান্তনুর দিকে। তেজষ্মী রূপটা হাওয়া হয়ে গেছে নিমিষেই।শান্তনু আবার বললো,

-“আরেহ! আমিতো ভুলেই গেছি। আমিও একজন পুলিশ কর্মকর্তা। ইন্সপেক্টর শান্তনু মজুমদার” বলে হাত এগিয়ে দিলো শান্তনু।

মাশুক আর চুপ রইলো না।দ্রুত ফোনে সিসিটিভি ফুটেজ চেক করতে থাকলো। ক্যামেরা বন্ধ।যেমনটা আশা করেছিল।মাশুক বলে উঠলো,

-“ওয়াও! যেমন আশা করেছিলাম ঠিক তেমনি হয়েছে মিসেস সরোয়ার।হেমার রুমের ক্যামেরা রাত বারোটার পর অদ্ভুতভাবে বন্ধ হয়ে যাওয়া?আমি যেদিন থেকে ক্যামেরা একসেস নিয়েছি সেদিন থেকেই আপনাদের বাড়ির ক্যামেরায় একটার পর একটা যান্ত্রিক ত্রুটি।আর?আর যেদিন ক্যামেরা ঠিক থাকে ঠিক তার পরের দিন হেমা কিভাবে দ্রুত ঘুম থেকে উঠে যায়?আরো অনেক অনেক সন্দেহের কারণ আছে মিসেস সরোয়ার।কোনটা লুকাবেন?কয়টা লুকাবেন?”

ফরিদা বেগম এবং জব্বার সাহেব দুজনই চুপ হয়ে গেছে।এতক্ষণ চোখ মুখে ক্রোধ ছিলো।এখন ভয়ের ছাপ।যেনো কোনো চুরি ধরা পড়েছে। শান্তনু বললো,

-“আমি লোক পাঠিয়েছি থানায়।যারা আসামীরূপে জেলে বসে আছে তারাই খোলাসা করবে সবকিছু। ভাগ্যিস মাশুক আমার সাথে ডিসকাস করেছে বিষয়টা।নয়তো একটা খাসা কেস আমার নজর এড়িয়ে যেতো।”

মাশুক দুহাত কোমরে রেখে দাঁড়িয়ে।ভীষণ রকমের বিচলিত সে।এক পর্যায়ে বলে উঠলো,

-“আমি হেমাকে খুঁজতে যাচ্ছি।তুই এদিকটা সামলা।”

-“মাশুক দাঁড়া। কোথায় খুঁজবি?বরং এদের চাপ দিলে এরাই কথা উগলে দিবে।”

খতিব সাহেবের বাড়ির চারতলায় ছোট্ট একটি ঘর।যার দরজায় প্রায়ই তালা ঝুলতে দেখা যায় সবসময়। কোনো সাড়া-শব্দ নেই, ঘরটি যেনো ভুলে যাওয়া এক কোণ।আর সেই ঘর থেকেই মাঝে মাঝে ভেসে আসে বিদঘুটে গন্ধ। তৃতীয় তলায় তারা থাকেন, নিচের ফ্ল্যাটগুলো ভাড়া। একতলায় দাঁড়ালে ঘরটি নীরব, কিন্তু যতই সিঁড়ি বেয়ে উপরের দিকে ওঠা যায়, ততই সেই নীরবতা ভেঙে চিৎকারের কণ্ঠস্বর স্পষ্ট হতে থাকলো। যেনো কেউ আর্তনাদ করে প্রাণ ভিক্ষা চাইছে। মাশুকের মন মুহূর্তেই উত্তাল হয়ে উঠলো।কোনো দ্বিধা না করে এক নিঃশ্বাসে ছুটে গেলো চারতলায়। দরজার বাহিরে দাঁড়িয়েই হেমার করুণ চিৎকার শুনতে পায়। তার হৃদয়কে গভীরভাবে আঘাত করছে।

-“আমার বাবা মাকে মেরে ফেলছে…ওদের বাঁচাও। আছো কেউ? চাচ্চু…ওরা মায়ের চুল টানছে।আমার বাবা মাকে কেউ বাঁচাও”

কথাগুলো বারবার বলছে হেমা।মাশুক অস্থির হয়ে উঠলো।সাথে থাকা একজন কনস্টেবল বললো,

-“স্যার আপনি সরেন।আমি দরজা ভাঙ্গি।”

তাকে শান্তনু পাঠিয়েছে মাশুকের সাথে।মাশুক সরে গেলো।অনেক ধাক্কা, লাথি দেওয়ার পরও দরজা ভাঙার কোনো নাম গন্ধ নেই।কি করবে মস্তিষ্ক কাজ করছে না।হুট করে মনে পড়লো আগে যখন এসেছিল দুটো চাবি পেয়েছে মাশুক।একটি খতিব সাহেবের ফ্ল্যাটের।অন্যটি এই ঘরের নয়তো।মাশুক তপ্ত নিঃশ্বাস ফেলে।নিজেকে শান্ত করে পকেট থেকে চাবিটি বের করে চোখ বুঁজে প্রার্থনা করলো।যেনো খুলে যায় গেটটি। কয়েক সেকেন্ডে ভাগ্য সহায় হয়।দরজা খুলতেই হেমাকে দেখে বুক ধ্বক করে উঠে। মাশুক দৌঁড়ে তাকে দুহাতে আগলে নিলো।বললো,

-“হেমা? কিচ্ছু হয়নি।কিচ্ছু হয়নি।আমি এসে গেছি দেখো? প্লীজ শান্ত হও।”

কথাটি বলার পূর্বেই সামনে দেখতে পেলো একটি ছোট টিভি।টিভির স্ক্রিনে দেখা যাচ্ছে বিভৎস এক দৃশ্য।একজন নারী এবং পুরুষকে নির্মম হত্যার দৃশ্য। ক্ষণিকের জন্য মাশুকের শরীরও কেঁপে উঠে।হেমার মুখ ঘুরিয়ে বুকের সাথে চেপে ধরে। কনস্টেবলকে বললো,

-“টিভি বন্ধ করুন প্লীজ।বন্ধ করুন”

হেমার অবস্থা গভীর সংকটে। তার উত্তপ্ত নিঃশ্বাস মাশুকের শার্ট ভেদ করে হৃদয়ের গভীরে প্রবেশ করছে, যেন আগুনের শিখা ছুঁয়ে যাচ্ছে। মাশুকের মনে ক্ষোভ আর ব্যথার স্রোত প্রবাহিত হতে শুরু করলো।এই মেয়েটা এতদিন এমন যন্ত্রণা সয়ে যাচ্ছিলো! কীভাবে তাকে এমন নির্দয়ভাবে কষ্ট দেওয়া হলো? মাশুক দ্বিধা না করে হেমাকে কোলে তুলে নিলো। হেমা আতঙ্কে তার গলা শক্ত করে জড়িয়ে ধরে, যেন এক মুহূর্তের জন্যও আলগা হতে চায় না। মাশুক দ্রুত বেরিয়ে পড়লো।

সাথে থাকা কনস্টেবলকে বললো, -“টিভিটা সাথে নিন।”

______

মেডিসিন এবং কাউন্সেলিং কোনোটিই হেমার অবস্থার উন্নতি ঘটাতে পারছিলো না সম্পূর্ণরূপে।যা উন্নতি হয়েছিলো সেটি সাময়িক।শুধু মাশুকের সামনে।কখনো মনে হয়নি যে হেমার অবস্থা অত্যন্ত খারাপ। কিন্তু কেন সে পুরোপুরি সেরে উঠতে পারছে না?

এখন সবকিছু তার কাছে পরিষ্কার হয়ে উঠেছে। কমপ্লেক্স পোস্ট ট্রমাটিক ডিজঅর্ডারে ব্যক্তির সামনে যখন অতীতের যন্ত্রণাদায়ক স্মৃতির পুনরাবৃত্তি ঘটে তখন তাদের মানসিক চাপ ব্যাপকভাবে বেড়ে যায়।হেমার সাথেও তাই হয়েছে।রাতের ঘুমের বিষয়টাও এই ভয়াবহতার সাথেই জড়িত।

স্নায়বিক চাপ কমাতে লোরাজেপাম ইনজেকশন পুশ করেছে মাশুক হেমাকে।ধীরেধীরে শান্ত হয়ে এসেছে সে। ছটফট করে ক্লান্ত হয়ে ঘুমের কোলে ঢলে পড়েছে।মাশুক তার পাশে বসে শান্তনুর উদ্দেশ্যে বললো,

-“যা সন্দেহ করেছিলাম তাই ঘটেছে।ঠিক যেমনটা ভেবেছিলাম।আমার কল্পনা এত বিশ্রী কেনো?”

-“নিজেকে দোষারোপ করছিস?”

মাশুক ভারী গলায় জবাব দিলো, -“হ্যাঁ।মনে হচ্ছে আমার ভাবনার ফলে এসব ঘটেছে।আমার কারণে হেমা এতটা কষ্ট পাচ্ছে।”

শান্তনু বললো, -“অদ্ভুত! তুই সাইকিয়াট্রিস্ট হয়ে এসব ভাবিস?”

মাশুক তার বিধ্বস্ত মুখখানা তুলে চাইলো শান্তনুর দিকে।চশমা চোখ থেকে নামিয়ে ফেলে।আরো ক্লান্ত দেখালো তাকে চোখের উপর আবরণবিহীন অবস্থায়।বললো,

-“সাইকিয়াট্রিস্ট? মানুষ নই? কখনো কখনো কিছু মিথ সত্যি মনে হয়।”

-“এসবে যুক্তি নেই।এসব ভিত্তিহীন।”

-“সবজায়গায় যুক্তি খাটানো যায় না।”

শান্তনু আর কোনো কথা বললো না।চুপচাপ তাকিয়ে দেখলো মাশুক আর হেমার দিকে। মাশুকের চক্ষু হেমার মুখমণ্ডলে আটকে আছে।একজোড়া ক্লান্ত, বিষণ্ণ চোখে নিবদ্ধ দৃষ্টি। শূন্যতার মাঝে কিছু খুঁজে পেতে চাওয়ার মতো একটা ভাব নিয়ে ক্যাবিন থেকে বেরিয়ে গেল শান্তনু। তার হাতে নতুন কেস, আর সেই কেসের জট খুলতে এখন মনোযোগ দিতে হবে।

শান্তনু গিয়ে বসলো জব্বার এবং ফরিদা বেগমের কাছে। সন্দেহপ্রবণ তার দৃষ্টি। জব্বার সাহেব বারবার কাকে যেনো কল করার চেষ্টা করছিলেন।কিন্তু শান্তনুর টিমের দুজনের তদারকীতে সেটি ভালোভাবে সম্ভব হয়ে উঠেনি। শান্তনু জব্বার সাহেবের দিকে চেয়ে বললো,

-“নিজে বাঁচবার চেষ্টা করছেন?নাকি কাউকে বাঁচাবার চেষ্টা করছেন?”

জব্বার ক্ষিপ্ত সুরে বললেন, -“ভুলভাল কথা বলবেন না ইন্সপেক্টর।”

শান্তনু হাসলো।আসলেই কি ভুলভাল বলছে সে?জবাব দিলো,

-“বলতেই পারি ভুলভাল।কিন্তু ভোরের আলো ফুটবার সাথেসাথে ভুলভাল এর জায়গায় সত্য-সত্য কথা বলা শুরু করবো।”

ফরিদা বেগম আরেকদফা কান্না শুরু করে।এক অসহায় মুখ তার।স্বামীর এই অবস্থা তারমধ্যে ছেলে এক বিরাট কান্ড ঘটিয়েছে।তারপর এমন জেরা। অসহ্য লাগছে।তিনি বললেন,

-“ক্ষমা করুন আমাদের!হাত জোড় করে বলছি।আমার স্বামীর এই অবস্থায় আমাদের হেনস্তা করবেন না।”

শান্তনু বললো, -“ইচ্ছেকৃত করছি? আপনারা করতে বাধ্য করেছেন।তারপরও আমি দমে যেতে চাইছিলাম কিন্তু হেমাকে চারতলার ঘরে আটকে তার বাবা মায়ের বীভৎস মৃত্যুর দৃশ্য দেখানো আপনাদের উপর সন্দেহ তীব্র করেছে।আর কি যুক্তি দিবেন?বলুন?”

-“দোহায় লাগে আপনাদের!আমার স্বামীকে সুস্থ হতে দিন।তখন যত প্রশ্ন করতে ইচ্ছে হয় করবেন।এখন আমাদের একটু শান্তি দিন!”

পেছন থেকে মাশুক এসে দাঁড়ালো।কথাগুলো শুনেছে সব।ফরিদা বেগমের কথার উত্তর সে দিয়ে বলে,

-“কতটুক শান্তি আপনারা পাওয়ার যোগ্য সেটা আগামীকাল ডিসাইড হবে।”

মাশুক বিরতি নেয় কিছুক্ষণের।হুট করে রূঢ় গলায় বলে উঠলো,

-“কি অবস্থা করেছেন মেয়েটার?কি ক্ষতি করেছে হেমা আপনাদের?”

জব্বার সাহেব ফুঁসছেন রীতিমতো। পুরোপুরি আটকে তারা এখানে। ইন্সপেক্টর শান্তনু মজুমদারসহ আরো দুইজন এখানে উপস্থিত।ফরিদা বেগম মাশুকের জবাবে বললেন,

-“আপনারা আমাদের ভুল বুঝছেন।পুরোপুরি ভুল বুঝছেন।”

-“মিথ্যেটাও সাজিয়ে বলতে পারেন না মিসেস সরোয়ার।নিজেই হেমার সন্ধান দিলেন,যে সে বাড়িতেই আছে।আমি প্রথমদিন থেকেই ভাবছিলাম আমাকে হেমা এত সহজে মেনে নিচ্ছে।আপনাদের কেনো মানতে পারছে না?কেনো আপনাদের বিপক্ষে তার চালচলন।আপনাদের অনীহা কেনো?কি কারণ? ওয়ারেন্ট নেই বলে এখনও নমনীয় আছি আমরা আপনাদের প্রতি।কিন্তু আমার সন্দেহ যেদিকে ইঙ্গিত দিচ্ছে,সেটি যদি সঠিক হয়।পরিণতি ভোগ করার জন্য তৈরি থাকুন।”

মাশুকের কথায় প্রায় পনেরো দিন আগে শান্তনু আপিল করেছিলো।কারণ কেসটা যতটা সহজভাবে দেখানো হচ্ছে, আসলে ততটা সরল নয়। শান্তনু অনুরোধ করেছিল যাতে তাকে হেমার বাবা-মায়ের সাজাপ্রাপ্ত আসামিদের সঙ্গে দেখা করতে দেওয়া হয়। তিন দিন আগে কারা অধিদপ্তর তার আপিল মঞ্জুর করে। আগামীকাল সকালে বিশেষ ব্যবস্থায় তিনি তাদের সাথে ত্রিশ মিনিটের জন্য সাক্ষাৎ করার অনুমতি পেয়েছে।

ভোর পাঁচটা বাজতে চলেছে।খতিব সাহেবের অবস্থার উন্নতি নেই।ডাক্তার জানিয়ে গেছেন চব্বিশ ঘন্টার আগে কিছু বলা সম্ভব নয়।শান্তনু উঠে দাঁড়ায়। কনস্টেবলকে তার কাজ বুঝিয়ে দিয়ে বের হওয়ার পূর্বে বললো,

-“আমি ফিরবো সংবাদ নিয়ে।সেটি আপনাদের জন্য ভালোও হতে পারে,আবার খারাপও হতে পারে।দুআ করতে থাকুন সৃষ্টিকর্তার কাছে মিসেস সরোয়ার।আসলাম”

_______

ফজরের সুমধুর ধ্বনি বাতাসে ভেসে আসছে।ভোরের আলো ফোটার অপেক্ষা মাত্র। ক্যাবিনজুড়ে নিস্তব্ধতা।নিদ্রাহীন চোখ আর ক্লান্ত দেহের ভারে মাশুক বসে আছে। যেন ভাবনার এক অসীম ঘূর্ণিতে আটকে গেছে। অগণিত প্রশ্নের সম্ভার মস্তিষ্ক জুড়ে।আর উত্তর খুঁজে বেড়াচ্ছে একাকী।প্রতিটি শ্বাসে ক্লান্তি মিশে।সে ধীরে চশমাটা খুলে টেবিলের উপর রাখলো। মাথাটা দেয়ালে এলিয়ে দেয়ার সাথে সাথে ফোন বাজে।

বাড়ি থেকে কল এসেছে।সারারাত ফোন বন্ধ থাকায় নিশ্চয়ই তারা চিন্তিত। মাশুক ফোন রিসিভ করে গাম্ভীর্যপূর্ণ স্বরে বললো,

-“হুম?”

ফোনের অন্যপাশ থেকে মৃদুল প্রশ্ন করে, -“কোথায় তুই?নূন্যতম কান্ডজ্ঞান কি নেই?সারারাত তোকে ফোন করে পাগলপ্রায় আমরা।”

অল্প শব্দে মাশুক জবাব দিলো, -“ফোনের ব্যাটারি ডেড ছিলো।”

-“তোর চিন্তায় সারারাত আমরা জেগে আছি।আম্মা রীতিমতো প্যানিক করছে। কোথায় তুই?”

-“হাসপাতালে।এখানে কল করলেই পারতে?কষ্ট করে সারারাত জাগতে হতো না।”

একে তো চিন্তায় সবার মাথা খারাপ।তার উপর মাশুকের খাপছাড়া কথাবার্তার ভঙ্গি।তেঁতে উঠতে বাধ্য করলো মৃদুলকে।সে বললো,

-“হাসপাতালে যখন ছিলি তাহলে তুই নিজে একটা কল দিয়ে জানাতে পারতি না?”

এতশত কথা ভালো লাগছে না শুনতে। বিরক্তির পাল্লা ভারী হচ্ছে।একেকটা শব্দ অত্যন্ত ওজনদায়ক।মাশুক বললো,

-“একটু ঝামেলায় ছিলাম।”

ফোনের অন্যপাশে শান্তা বেগম বারবার তাড়া দিচ্ছেন মৃদুলকে।ছেলের খবর জানতে আনচান করছে মায়ের হৃদয়। নাইট ডিউটি সচরাচর থাকেনা মাশুকের। হুট করেই সারারাত গায়েব থাকা? ঘাবড়ে যাওয়া স্বাভাবিক।মৃদুল হাত তুলে মাকে থামতে ইশারা করে।বলে,

-“কি ঝামেলা? এনিথিং সিরিয়াস?”

-“উহু। টেনশন করো না ঘুমিয়ে পড়ো।কাজ শেষ হলে ফিরবো আমি।”

-“কখন?”

-“যখন কাজ শেষ হবে তখনই।আমাকে কল করে বারবার বিরক্ত করবে না। রাখছি”

মাশুক মুখে পানির ঝাপটা দিয়ে বেরিয়ে যায় ক্যাবিনের বাহিরে।হেমার পাশে একজন নার্সকে রেখে এসেছে।খতিব সাহেবের হালচাল জানা হয়নি এতকিছুর মাঝে। লিফটে করে চলে গেলো দোতলায়,ইমার্জেন্সী বিভাগে। ডিউটিরত ডাক্তারের সাথে হ্যান্ড শেক করে মাশুক প্রশ্ন করলো,

-“এনি ইমপ্রুভমেন্ট?”

ডক্টর জিয়াউর রহমান মাথা দুলিয়ে বললেন,

-“না। পেশেন্ট ফার্স্ট স্ট্রোকের কিছু সময়ের ব্যবধানে সেকেন্ড স্ট্রোক করে।ডানপাশ অলমোস্ট প্যারালাইজড।থ্রম্বোলাইটিক থেরাপি দেওয়া হয়েছে। আই উইশ… দেখা যাক ডক্টর মাশুক!আমরা আমাদের বেস্ট ট্রায় করছি।”

-“জ্বি থ্যাংকস।”

মাশুকের হৃদয়ে এক অজানা খারাপ লাগা কাজ করলো খতিব সাহেবের জন্য। তিনি কোনো অপরাধের সাথে জড়িত কিনা, তা এখনও অজানা। তবু তার এই ভগ্ন অবস্থা কোনোভাবেই কাম্য নয়।

হেমার গায়ে সাদা লং ফ্রক।শুভ্র রং তার মুখের সহিত মিলেমিশে গেছে।কাপড়ে ময়লা লেগে গেছে,যখন জমিনে বসে ছটফট করছিলো।তবে মুখ একেবারে শান্ত, সরল।যার মধ্যে লুকিয়ে থাকা আঘাতের ছাপ এখন অদৃশ্য।কাপড়ের ওই ধূসর কালো দাগ যেন চিহ্নিত করছে এক অব্যক্ত যন্ত্রণার কাহিনী।কতখানি কষ্ট হয়েছে তার?কবে থেকে হচ্ছে এই কষ্ট?

মাশুক দাঁড়িয়ে আছে হেমার বেডের পাশে।মেরুদণ্ড সোজা, পকেটে হাত গুঁজে। তার মুখে প্রবাহিত গুরুগম্ভীর ভাব।চারপাশের নীরবতায় এক অপার্থিব শূন্যতা।

রক্তশূন্য, ফ্যাকাশে মুখ।কি অপরূপ মায়া আছে এই মুখে! কি অদ্ভুত শান্তির ছোঁয়া? যে কোনো মানুষের মনকে নিজের দিকে আকৃষ্ট করতে পারে।অথচ এই মানুষটার জীবন আঘাত এবং দুঃখে ভরপুর।শান্তির কোনো চিহ্ন নেই।এমন হওয়ার কথা ছিল না।তার বিগত সময়গুলো এতটা কষ্টকর না হলেও পারতো।

-“কিছু স্পর্শ যেন অলৌকিক শান্তির আধার।যা অদৃশ্য জাল বুনে টেনে নিয়ে যায় গভীর মোহের অতলে।সে যেনো এক হিমাদ্রিণী,তার নির্মল সংস্পর্শে হৃদয়ের উত্তাপ নিঃশেষ হয়ে যায়।”

চলবে…