হিমাদ্রিণী পর্ব-১০

0
2

#হিমাদ্রিণী – ১০
লেখনীতে – আয্যাহ সূচনা

রাত গভীর থেকে গভীরতর হচ্ছে। মাটিতে বারবার অবস্থান পাল্টাতে পাল্টাতে মাশুক অবশেষে ঘুমিয়ে পড়ে। প্রচণ্ড পিঠ ব্যথা সত্ত্বেও, আজ তার মনে এক ধরনের শান্তি বিরাজমান।যা এতদিন অনুপস্থিত ছিল। হঠাৎ করে কনুই শক্ত জমিনে লেগে গেলে ব্যথায় কুঁকড়ে উঠে মাশুক। কষ্টসহকারে চোখ মেলে তাকায়। মাটিতে ঘুমানো তার জন্য কখনোই স্বস্তিকর ছিল না। তীব্র বিরক্তি নিয়ে চোখ মেলতেই ভয় পেয়ে যায়। হেমা মাটিতে বসে।তার বড় বড় চোখে তাকিয়ে আছে। বিস্মিত স্বরে সে বলল,

-“কি হলো? তুমি এখানে কেনো?”

হেমা জবাব দেয় অকপটে,

-“তোমাকে ঘুমোতে দেখছি।”

আদুরে ভঙ্গি,মায়ায় পরিপূর্ণ আদল।মাশুকের দৃষ্টি শীতল হয়ে আসে।ঠোঁটের কোণে এক চিলতে হাসি।সম্পূর্ণ প্রস্ফুটিত নয়।শান্ত,স্থির চিত্ত।মাশুক আপনাআপনি বলে ফেলে,

-“জীবনটা হুট করেই পরিবর্তন করে ফেললাম তাই না?এই হুট করে নেওয়া সিদ্ধান্তগুলো ভীষণ সুন্দর হয়।”

বাক্যজোড়া হেমার বোধগম্যতার বাহিরে।ঠোঁট কামড়ে চেয়ে রইলো।মাশুক হেমার চোখ পানে চেয়ে বললো,

-“তুমি আমাকে কখনও বুঝবে?”

হেমা নির্বাক।মাশুক আকুল হয়ে বললো,

-“তুমি আজকাল ভীষণ নীরব হেমা।”

-“হুম?”

-“আমার সাথে কথা বলো না কেনো?চুপচাপ থাকো কেনো?তোমার মনে কোনো কথা থাকলে বলো?”

হেমা ঢোক গিললো আলগোছে।বললো,

-“আচ্ছা তুমি কি এখন থেকে আমার সাথেই ঘুমোবে?”

মাশুক ধীরস্থির গতিতে মাথা দোলায়।যার অর্থ হচ্ছে হ্যাঁ। হেমাও বুঝবার ন্যায় মাথা দোলালো। মাশুকের টিশার্টে হাত রেখে চুপ হয়ে রইলো।মাশুক ডান হাত ছড়িয়ে দেয়।বলে,

-“তুমি বলেছিলে আমার গায়ের ঘ্রাণ তোমার পছন্দ।মনে আছে?”

হেমা ছোট্ট করে জবাব দেয়, -“হুম”

-“এসো,বুকে মাথা পেতে ঘুমাবে।”

হেমা মগ্ন হয়ে পড়লো ভাবনায়। যেনো মনের গভীরে কোনো সিদ্ধান্তের দোলাচলে দুলছে। মাথা পেতে দিবে কি দিবে না?এ দ্বিধায় বন্দী তার মন। মাশুকের ইচ্ছে অন্য রকম, সে চায় হেমার এই সূক্ষ্ম অনুভূতিগুলো ধীরে ধীরে জাগ্রত হোক, যেনো সে তার মস্তিষ্কের শক্তিকে পুরোপুরি কাজে লাগিয়ে নিজেই বিচার করতে শেখে।যেখান থেকে হেমা নিজেকে চিনতে পারে।তার জীবনকে স্বজ্ঞানে পরিচালিত করতে পারে।এক বর্ণনাতীত আকাঙ্ক্ষা যেনো মাশুকের হৃদয়ে।হেমার স্বতঃস্ফূর্ত আত্মপ্রকাশের প্রতীক্ষা।

হেমা অনেকটা ভেবে চিন্তে মাথা পেতে দিলো।এক শীতলতা নেমে এলো মাশুকের অন্তরে। হেমা আগেও তাকে জড়িয়ে ধরেছে।এবারের অনুভূতি ভিন্ন।মাশুক গম্ভীর কণ্ঠে জানতে চাইলো,

-“মাথায় হাত বুলিয়ে দেবো?”

-“হুম”

মাশুক হেমার চুলের গভীরে হাত রাখে।আলতো হাতে বিলি কেটে দিতে লাগলো। হেমা নিশ্চুপ,স্তব্ধ।মাশুক বললো,

-“তোমার যখন ইচ্ছে তখনই আমার বুকে মাথা পেতে দিতে পারো।”

-“তুমি ব্যথা পাবে না?”

মাশুক নিঃশব্দে হেসে জবাব দেয়,

-“শান্তি পাবো,যেমন এখন পাচ্ছি।”

এক সুবাসিত ঘ্রাণে মোহিত হলো হেমা।ভীষণ ভালো লাগছে তার। ঝড়ো নিঃশ্বাস ফেলে মাশুককে দুহাতে পেঁচিয়ে ধরে চোখ বুঁজে।মাশুক বলে,

-“এতদিন বাধ্যবাধকতার মাঝে তোমায় ভুল- সঠিক, খারাপ- ভালো শিখিয়েছি।এখন তোমায় শিখাবো অধিকার,যত্ন,সম্পর্ক আর….আর ভালোবাসা।”

হেমার মস্তিষ্কে শেষ শব্দটি গেঁথে যায়।বহুবার শুনেছে এই শব্দ।মনে পড়ছে তার।মাশুকের বুকে মুখ গুঁজে বিড়বিড় করলো,

-“ভালোবাসা?”

-“হুম…বুঝো তুমি?”

-“বাবা মা আমাকে ভালোবাসে…”

পরিষ্কার জবাব।মাশুক হুট করে হেমাকে জড়িয়ে ধরলো দুহাতের সাহায্যে। হেমা অদ্ভুত এক অস্থিরতা অনুভব করলো।কিন্তু কিছু বলতে পারলো না।নাম না জানা অনুভূতি তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে তার মধ্যে।

-“বাবা মা ব্যতীত পৃথিবীতে আর অনেক রকমের ভালোবাসা আছে হেমা।”

-“আমি বুঝি না…তোমার কথা বুঝি না। কিসব বলো তুমি।”

-“আমি তোমার কি হই?”

-“তুমি একটা মাশরুম! তুমি আমার বন্ধু হও।”

হেমা মুখ তুলে তাকায়।মাশুকের দুহাত ভাঁজ করে রাখলো।সেখানে থুতনি ঠেকিয়ে চাইলো তার দিকে।বললো,

-“তুমি খুব ভালো..আমার ভালো বন্ধু।আমার সব কথা শোনো।”

মাশুকের হাত আলতোভাবে এগিয়ে এলো, হেমার মুখের কাছে এসে থাকা চুলগুলো সরিয়ে দিলো নিঃশব্দে। তার গভীর দৃষ্টি যেনো এক শান্ত সমুদ্র, যেখানে তরঙ্গের ছন্দ লুকিয়ে আছে। হেমা হয়তো কিছুই বুঝে না।কী অর্থ লুকিয়ে আছে এই স্পর্শে?এই চোখের ভাষায়?কিন্তু মেয়েটির স্পর্শ, আদুরে কণ্ঠ আজকাল মাশুকের হৃদয়ে অদ্ভুত এক ঝঙ্কার তোলে, যেনো প্রতিটি মূহুর্তে সে নতুন করে জাগ্রত হয়, এক অনুভূতির দোলায় দুলে ওঠে।

-“আমি এখন আর তোমার বন্ধু নই”

হেমার মুখের হাসি বিলীন হয়ে গেলো।বন্ধু নয়?হুট করে সরে যেতে চাইলো মাশুকের সান্নিধ্য থেকে।মাশুক তাকে থামায়। হেমা বিচলিত হয়ে প্রশ্ন করে,

-“তুমি আমার বন্ধু না?তুমি কি চলে যাবে?আমি কিন্তু! আমি তোমাকে যেতে দিবো না।”

হারিয়ে ফেলা আর হারিয়ে যাওয়ার ভয় হেমার মাঝে।মাশুক তাকে টেনে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো।বললো,

-“শান্ত হও।বন্ধুর চেয়েও বেশি আমি এখন থেকে তোমার।ধীরে ধীরে বুঝবে।আমি কোথাও যাচ্ছি না হেমা।এখন ঘুমিয়ে পড়ো”

-“আমি ঘুমোবো না।তুমি চলে যাবে আমি ঘুমিয়ে গেলে।”

মাশুক হাসলো।বললো, -“তুমিতো আমাকে আটকে রেখেছো।আমাকে জড়িয়ে ধরে রেখেছো।কিভাবে পালাবো?”

হেমা আরো শক্ত করে মাশুককে জড়িয়ে ধরে বললো,

-“এখন আরো যেতে পারবে না।আমি ধরে রেখেছি”

হেমা ধীরে ধীরে ঘুমের গভীর রাজ্যে তলিয়ে গেছে মাশুকের বুকে মাথা পেতে।শক্ত জমিন যেনো পিঠের উপর এক নিরন্তর অত্যাচার চালাচ্ছে।তবুও মাশুকের চিত্তে এক অদ্ভুত শান্তি বিরাজ করছে।অর্ধরাত অবধি মাশুকের চোখে ঘুম এলো না। হেমার শান্ত, ভারী নিঃশ্বাস তার অস্তিত্বকে স্পর্শ করে যাচ্ছে। শেষরাতে, হেমার নিঃশ্বাসের ছন্দে তলিয়ে মাশুকও চোখ বুজে এলো

________

স্ত্রীর স্নিগ্ধ কেশ মৃদু হাতে গেঁথে, তাকে পুতুলের মতো সাজিয়ে রেখে এসেছে মাশুক।নতুন বউ রূপে ঘরে বসিয়ে কর্মস্থলে এসেছে বেশ কিছুক্ষণ হলো। সদ্য বিবাহিত পুরুষের মন ক্ষণে ক্ষণে উৎকণ্ঠিত হয়,অবুঝ স্ত্রীর ভালো থাকা নিয়ে। ক্যামেরায় তার প্রতিচ্ছবি স্পষ্ট,তবু কণ্ঠস্বর না শুনে তার অন্তরে একদণ্ড স্বস্তি নেই।তাইতো বারবার ফোন তুলে নেয় হাতে,সুযোগ পেলেই।

এদিকে রোগীদের আনাগোনা চলমান, তাদের নিত্য অভিযোগ তারা নাকি শীগ্রই পাগল হতে চলেছে।! মাশুক একটানা উত্তর দিচ্ছে।এসব কেবলই তাদের মনের বিভ্রম, অথচ তাতে শান্তি মিলছে না কারো।নিজেকে পাগল প্রমাণ করতেই হবে।

নাদিম এসে বললো, -“স্যার একজন এসেছে আপনার সাথে দেখা করতে।বলছে আর্জেন্ট।”

মাশুক অল্প খানি পানি খেয়ে কাঁচের গ্লাস ঢেকে রেখে বললো, -“কে?শান্তনু?”

-“না না শান্তনু’দা না।একটা মধ্যবয়স্ক লোক।”

মাশুকের ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় জানান দিলো এটা আর কেউ নয় জব্বার সাহেব।জানানো হয়েছে তাকে বিয়ের ব্যাপারটা।মাশুক আশাও করেছিলো উনি এসে হাজির হবেন।

জব্বার সাহেব হনহনিয়ে ঢুকে পড়লেন ক্যাবিনে।যেনো আঘাত করবেন মাশুককে।ভীষণ রকমের ক্ষিপ্ত সে।এসেই প্রশ্ন ছুড়লেন,

-“আপনাকে কে অধিকার দিয়েছে আমাদের বাড়ির মেয়েকে আমাদের অনুমতিবিহীন বিয়ে করার?”

ভাবলেশহীন মাশুক। হুংকারে কর্ণপাত করলেও গায়ে মাখছে না।সে উল্টো প্রশ্ন করে,

-“বোন জামাই হারানোর বেদনা কাটিয়ে উঠেছেন?”

হতবাক এর চরম পর্যায়ে জব্বার সাহেব।তার প্রশ্নের বিপরীতে অদ্ভুত প্রশ্ন।সে বললো,

-“আপনার নামে আমরা মানহানির মামলা দিবো।জোর করে বিয়ে করেছেন আপনি হেমাকে।আর এই বিয়ে জায়েজ না। হেমা তার সম্পূর্ণ জ্ঞানে নেই।”

মাশুক স্মিত হেসে জবাব দেয়, -“হেমা সম্পূর্ণ জ্ঞানে নেই কিন্তু তার প্রয়াত অভিভাবক তার সজ্ঞানে আমায় অনুমতি দিয়ে গেছেন।”

জব্বার সাহেব কপাল কুঁচকান, -“মানে?”

-“মানে টানে আমি আদালতে বুঝিয়ে এসেছি।আপনারাও বুঝবেন একটু সময় দিন।এত তাড়াহুড়োর কিছু নেই।খতিব সাহেবের শোক কাটান।আচ্ছা আপনারা আদৌ শোকে আছেন?নাকি ভনিতা করছেন?খতিব সাহেবকে মনে হচ্ছে রাস্তা থেকে সরিয়ে দিলেন?আমারতো তাই মনে হচ্ছে জব্বার সাহেব…”

দাঁতে দাঁত চেপে জব্বার সাহেব জবাব দেন, -“বড্ড বেশি বুঝে ফেলেছেন।”

-“আপনি অস্থির হচ্ছেন কেনো?”

মাশুক সরাসরি জব্বার সাহেবের চোখের দিকে চেয়ে আছে।তার কথার মধ্যকার তাড়াহুড়ো আর বারংবার পলক ফেলা বেশ ভালোভাবেই পর্যবেক্ষণ করছে মাশুক।তাকে নিশ্চুপ থাকতে দেখে মাশুক বললো,

-“আপনার হৃদপিন্ড ধড়ফড় করছে?আসুন হার্ট রেট চেক করি।”

মুখ শক্ত করে তাকিয়ে রইলেন জব্বার সাহেব।শরীর থরথর করে কাঁপছে। কথা মুখ ফুটে বেরিয়ে আসতে পারছে না আর।শব্দ সংকট।মাশুক জব্বার সাহেবকে কথার জালে ফেলে ভীষণ খুশি।বললো,

-“মঞ্জুকে চেনেনতো? দ্যা মোস্ট ওয়ান্টেড ক্রিমিনাল? যাকে আপনার বদৌলতে এরেস্ট করা হয়েছিলো?তার পরিবারকেও নিশ্চয়ই চেনেন?”

জব্বার সাহেব প্রতুত্তরে বললো, -“আমি ক্রিমিনালদের কেনো চিনতে যাবো?আর আমার কারণে কোনো ক্রিমিনাল ধরা পড়েনি।”

-“ওহ আচ্ছা।ঠিক আছে কিন্তু আমি মঞ্জুকে চেনেন।”

-“আমি চিনি না”

-“আপনি চেনেন জব্বার সাহেব।”

-“আমি বলছি আমি চিনি না।”

মাশুক ক্ষণিক সময়ের জন্য ল্যাপটপ স্ক্রিন থেকে হেমার চিত্র সরিয়ে হেমার বাবা মায়ের খুনের ভিডিও ওন করলো।ওন করেই জব্বার সাহেবের দিকে ল্যাপটপ ঘুরিয়ে দিয়ে বললো,

-“দেখেন মনোযোগ দিয়ে”

জব্বার সাহেবের মুখে উৎকণ্ঠার ছাপ স্পষ্ট। সে ধীরে ধীরে সামনে ঝুঁকে পড়ে ভিডিওটি পর্যবেক্ষণ করছে।যেনো কোনো গোপন রহস্য উদ্ঘাটনের চেষ্টা। তার চোখে সতর্ক দৃষ্টি, একবারও পলক ফেলছে না।তবে সে নিজেও জানে না কী খুঁজছে। যেনো ভিডিওর প্রতিটি ফ্রেমের মাঝে লুকিয়ে আছে কোনো অদেখা সত্য নয়তো কোনো ভুল।যা সে বের করার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করছে।

এক পর্যায়ে বলে উঠলেন, -“এখানে আমি কোথাও নেই!”

মাশুক বললো, -“আমি কি একবারও বলেছি আপনি এখানে আছেন?”

থতমত খেয়ে গেলেন জব্বার সাহেব।এলোমেলো দৃষ্টি ফেলে বললেন,

-“তাহলে আমাকে কেনো দেখতে বললেন?”

-“এমনিই দেখতে বললাম।দেখলাম এমন ভয়াবহ হত্যা দেখে আপনার রুহ কাঁপে কিনা।আপনি উল্টো ভয়হীন নিজেকে খুঁজে বেড়াচ্ছেন।আপনার কোনো ইন্টারেস্ট নেই হেমার বাবা মায়ের মৃত্যুর দিকে।”

কথার মারপ্যাঁচে পড়ে সোজা হয়ে দাঁড়ালেন জব্বার সাহেব।মাথা গরম হয়ে ঘাম বেয়ে পড়ছে।অস্থির লাগছে তার।মাশুক বললো,

-“আসতে পারেন।এই ভিডিওতে কিছুই নেই।আপনার সাথে ঠাট্টা করলাম একটু,আপনাদের বাড়ির একমাত্র জামাই বলে কথা”

______

মাশুক ঘরের দরজায় পা রাখতেই বিরক্তি মাথায় চড়ে বসলো। চোখে পড়লো নতুন বিপদ। রিমার ছোটবোন রাইমা এসে হাজির। সে তো আসতেই পারে, বোনের বাড়ি বলে কথা! কিন্তু ঘরের ভেতর থেকে ভেসে আসা হেমার করুণ কান্নার আওয়াজে মাশুকের রাগ তীব্র হয়ে উঠলো। রাইমাকে পাশ কাটিয়ে প্রায় দৌঁড়ে ঘরের দিকে ছুটে গেলো। হেমা পায়ের উপর মাথা রেখে হেঁচকি তুলে কাঁদছে। তার বুকভরা কান্না মাশুককে বিচলিত করলো। ব্যাগ ছুঁড়ে ফেলে পাশে।তার পাশে বসে স্নেহময় কণ্ঠে বললো,

-“হেমা? কী হয়েছে? কেনো কাঁদছো?”

হেমা সুপরিচিত আওয়াজে মাথা তুলে তাকায়।পুরো মুখ জুড়ে লাল আভা ছড়িয়ে গেছে। নাক,গাল,চোখ ফুলে গেছে। মাশুক আরো অস্থির হলো।হেমার মুখখানা দুহাতে আগলে নিয়ে বললো,

-“কি হয়েছে?কেউ কিছু বলেছে?আমাকে বলো!”

-“আমি পাগল?আমি পাগল?”

এবার রাগে মাথাটা ফেটে যাবে নিশ্চিত।চোখ গোল আর চোয়াল শক্ত হয়ে আসে। দাঁত কিড়মিড় করে মাশুক পাশে দাঁড়িয়ে থাকা নার্সের দিকে চায়। প্রশ্ন করে,

-“কে বলেছে ওকে পাগল?”

নার্স মিনমিন করে জবাব দিলো, -“আপনাদের বাসায় একজন মেহমান এসেছে…সে আরকি… আমি তাকে বারণ করেছিলাম”

-“থামুন আর কিছু বলা লাগবে না।”

হেমার চোখ মুখ দুহাতে মুছে ঘরের বাহিরে বেরিয়ে গেলো মাশুক।ভাই ভাবির রুমের বাহিরে দরজায় দাঁড়িয়ে নক করে। মিনিট তিনেক এর মধ্যে রিমা বেরিয়ে এলো রাইমার সাথে দুজনের মুখেই উচ্ছ্বাসের হাসি।সেদিকে বিন্দুমাত্র আগ্রহ নেই মাশুকের। শান্তা বেগমও ছেলেকে দেখে পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন।মাশুক রিমার দিকে চেয়ে বললো,

-“কথা বলতে চাই।”

রিমা জবাবে বলে, -“হ্যাঁ বলো কি বলবে?”

-“হেমাকে কি বলা হয়েছে?সে পাগল?”

ঝড়ের পূর্বে এক নীরব থমথমে পরিবেশ বিরাজ করে যেমন,ঠিক তেমনি শোনাচ্ছে মাশুকের কন্ঠস্বর। রিমা শ্বাশুড়ির দিকে এক পলক চেয়ে গুরুত্বহীন ভঙ্গিতে বললো,

-“পাগলকে পাগল বললে দোষ?”

মাশুকের দৃষ্টি নত।হাত শক্ত করে মুষ্ঠিবদ্ধ।ভারী কন্ঠ তুলে বললো,

-“ও পাগল না।মানসিকভাবে বিপর্যস্ত।আপনি একজন শিক্ষিত মানুষ ভাবি।আপনার আর আপনার বোনের কাছ থেকে এসব আশা করা যায় না।”

রাইমা বলে উঠে, -“আপনি রাগ করছেন কেনো?আমরা তো হেমার সাথে মজা করেছি। পাগলি আদুরে ডাক।”

মাশুক অন্যদিকে চেয়েই বললো, -“আমি ভাবির সাথে কথা বলছি।”

রিমা বললো, -“তুমি আমার বোনের সাথে এমন আচরণ করতে পারো না।”

-“আমি আপনার বোনের সাথে এমন আচরণ করতে পারিনা কেনো?”

-“কারণ ও আমার বোন,এই বাড়ির মেহমান।”

মাশুক বললো, -“ঠিক! হেমা এই বাড়ির বউ,আমার স্ত্রী আপনার ছোট জা। আশা করবো কোনো মেহমান আমার স্ত্রীকে পাগল বলে অপমানিত করবে না।”

হেমার পাগলামি যেন ক্রমশই বেড়ে উঠে।চিৎকারে ঘরটিকে কেঁপে উঠলো।বিছানার চাদর এক হাতে টেনে ছুঁড়ে ফেলতে শুরু করে।নার্স এগিয়ে এলে, হঠাৎ করেই তাকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দেয়, এক অস্থির উত্তেজনায়। মাশুক, রাগী দৃষ্টিতে রিমা ও রাইমার দিকে তাকিয়ে, একপ্রকার দ্বিধাগ্রস্তভাবে ঘরে চলে যায়। নার্সকে বাহিরে পাঠিয়ে, সে দরজা বন্ধ করে দেয়। তড়িৎ গতিতে হেমার কাছে গিয়ে দুহাত টেনে ধরে বলে,

-“আমি ওদের বকে দিয়ে এসেছি।শান্ত হও।”

মুখভঙ্গি বিকৃত করে হাত ছাড়িয়ে নিলো হেমা।মাশুকের বুকে আঘাত করতে লাগলো।বললো,

-“আমি কান্না করছি তুমি আমাকে ফেলে রেখে বাহিরে গেলে কেনো?আমি একা একা কান্না করছিলাম।তুমি আমাকে রেখে চলে গেছো।তোমাকে ভালো লাগেনা না।যাও! আমার সামনে থেকে সরে যাও।”

বল প্রয়োগ করে হেমার দুহাত পেছনে বেঁধে ফেললো মাশুক,নিজের হাতের সাহায্যে। তীক্ষ্ণ নজরে তাকিয়ে বললো,

-“রাগ দেখাচ্ছো?দেখাও।কিন্তু কি চাও সেটা বলো?”

হেমা রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে বললো, -“আমাকে ফেলে রেখে গেলে কেনো?”

-“তোমাকে যে বকেছে তাকে বকতে গিয়েছিলাম।”

হেমা ক্ষিপ্ত সুরে বলে উঠে, -“না যেতে পারবে না।আমাকে ছাড়ো!”

-“তুমি কাঁদলে আমি তোমার পাশে থাকি,এটাই চাওতো?”

-“হ্যাঁ! হ্যাঁ!”

মাশুক শান্ত হয়ে বললো,

-“তাহলে সেটা মুখ ফুটে বলো নি কেনো? কি শিখিয়েছি এতদিন তোমাকে? সব ভুলে গেছো? তুমি কি চাও সেটা সরাসরি বলতে শিখাই নি?”

আকস্মিক শান্ত হয়ে গেলো হেমা। ছটফট থেমে গেলো। মাশুকের শেখানো বিষয়গুলো ধীরেধীরে মনে করতে লাগলো।কেমন কেনো আবছা সবকিছু।তারপরও কিছুটা মনে পড়ছে।মাশুক ফের বললো,

-“মনে পড়েছে? আর কি বলেছিলাম? কেউ যদি রাগানোর চেষ্টা করে কি করবে?কেউ যদি তোমাকে পাগল বলে কি করবে?”

হেমা মুখ ঘুরিয়ে বললো, -“মনে নেই!”

মাশুক অন্যহাতের সাহায্যে হেমার মুখ চেপে নিজের দিকে ঘুরিয়ে নিলো।বললো,

-“তাকাও আমার দিকে।চোখে চোখ রেখে কথা বলবে। মনে নেই?”

হেমা চোখ বড়বড় করে চেয়ে বলে, -“না না মনে নেই”

-“মিথ্যে বলছো”

হেমার মুখটা চুপসে গেলো।ঠোঁটে ঠোঁট চেপে ধরলো।ইচ্ছেকৃত চোখ এদিক ওদিক ঘোরাচ্ছে। মাশুক তীর্যক দৃষ্টিতে চেয়ে। জানা আছে তার এই ভনিতা। মিথ্যে বললেই মুখ এমন বানায়।মাশুক পূনরায় প্রশ্ন করলো,

-“উত্তর দাও হেমা”

হেমা বিড়বিড় করে বললো,

-“কেউ পাগল বললে তার দিকে তাকাতে না করেছো”

-“আর?”

-“ভুলে গেছি।”

-“আমি চলে যাবো কিন্তু”

-“সত্যিই ভুলে গেছি।সত্যি!”

ফোস করে নিঃশ্বাস ফেলে মাশুক।ব্লাড টেস্ট এর রিপোর্ট অনুযায়ী তাকে ভুল মেডিসিন দেওয়া হচ্ছিলো।সেটা মাশুকের দৃষ্টির অগোচরে। ভয়াবহ দৃশ্যগুলো দেখানো হচ্ছিলো বারবার।যার কারণে হেমার অবস্থা যতবার উন্নতি হয়েছে তার চেয়ে দুইগুন বেশি অবনতি হয়েছে।এখন সেই রিস্ক নেই।

মাশুক হেমাকে ছেড়ে দিলো।দুহাতের সাহায্যে এলোমেলো চুলগুলো ঠিক করে দিয়ে বললো,

-“চুপচাপ বসো এখানে।আমি ফ্রেশ হয়ে আসছি।তারপর এসে তোমার পড়া ধরবো।”

হেমা বলে উঠে, -“না”

-“হ্যাঁ! তোমাকে এতগুলো বই কেনো দিয়েছি?পড়তে হবে হেমা।চুপচাপ বসো এখানে।এক পা নড়চড় যেনো না হয়।”

হেমা মুখ ফুলিয়ে বসে রইলো।রাগ হচ্ছে ভীষণ।মাশুক কেনো তার সাথে এমন আচরণ করলো।তাকে কি করে শিক্ষা দেওয়া যায়? ওদিক ওদিক চেয়ে দেখলো।কি করবে? কিছুই বুঝতে পারছে না।হুট করে চোখ গেলো ওয়াশরুমের দরজায়। হেমা ঠোঁট কামড়ে হাসে।এক লাফে উঠে বাহির থেকে দরজা বন্ধ করে বললো,

-“তোমাকে আটকে রেখেছি শুনছো! আমি বই পড়বো না।আমার পড়তে ভালো লাগেনা।”

মাশুক এর অর্থ বুঝেছে কয়েক মিনিট পর।দরজা বন্ধ বাহির থেকে। হেমা খিলখিল করে হেসে চলেছে।মাশুক বললো,

-“পুরোপুরি সুস্থ হও একবার।তারপর সব উসুল তুলবো আমি”

চলবে….