হিমাদ্রিণী পর্ব-১৫

0
2

#হিমাদ্রিণী – ১৫
লেখনীতে – আয্যাহ সূচনা

আসামিদের পরিবারের উপর কঠোর নজরদারি চলছে। এরা-ই একমাত্র যারা শক্তিশালী জবানবন্দি দিতে পারে, তাই শান্তনু নাসির মোল্লাকে এক প্রকার বিকল্প হিসেবেই রেখেছে পুলিশের নিয়ন্ত্রণে। এসব নিয়ে আলোচনা করতে করতে মাশুক ঘরে ঢুকলো। ফোনটা কাঁধ ও কানের মাঝে চেপে, ব্যাগটা স্টাডি টেবিলে রাখলো। হাতার বোতাম খুলতে খুলতে খেয়াল করলো, ঘরের পরিবেশ আজ যেন অদ্ভুত রকমের শান্ত। হঠাৎই মাথায় এলো, হেমা কোথায়?

আদুরে ভঙ্গিতে ডাকলো, -“হেমা?”

কোনো জবাব আসেনি।বারান্দা থেকে টুকটুক আওয়াজ ভেসে আসে। ‘রাখি’ বলে মাশুক ফোন ছুঁড়ে ফেলে বিছানায়। বারান্দার দিকে পা বাড়ালো।দেখলো হেমা জমিনে বসে আছে।পিঠ ঠেকিয়ে রেখেছে দেয়ালে।মনোযোগ দিয়ে কি যেনো আঁকছে।মাশুক বুকে হাত গুঁজে প্রশ্ন করলো,

-“আমি এসেছি কোনো খেয়াল আছে তোমার?”

হেমা তড়াক করে মুখ ঘুরায়।মাশুকের কপালে ভাঁজ পড়ে।মেয়েটার মুখ ফুলে আছে।লালচে নাকের ডগা।মাশুক এক পা ভাঁজ করে বসলো।চিন্তিত সুরে প্রশ্ন ছুঁড়ে,

-“কেঁদেছো?”

হেমা শুধু মাথা দোলালো।অর্থাৎ সে কাঁদে নি।মাশুক হেমার গাল আলতো করে ধরলো।এদিক ওদিক ঘুরিয়ে দেখে বললো,

-“কান্না লুকানো শিখেছো আজকাল?”

-“উহু”

-“মিথ্যে কেনো বলছো?”

হেমা গোলগোল চোখে তাকিয়ে বলে, -“স… সত্যি বলছি।”

-“কে কি বলেছে?”

অদ্ভুতভাবে এড়িয়ে গেলো হেমা কথাটা।বললো,

-“তুমি না বলেছিলে তুমি বাড়ি ফিরলে তোমাকে পানি এনে দিতে,দিবো?”

মাশুক এবারে পা ভাঁজ করে বসলো জমিনে।হেমার চালচলন ভালো ঠেকছে না।দুহাত আবদ্ধ করলো নিজের দু হস্তে।বললো,

-“তাকাও আমার দিকে”

হেমা বাধ্য মেয়ের মত তাকায়।হুট করেই যেনো কালো মেঘের ছায়া পড়েছে মেয়েটির মুখে। নিশ্চয়ই মন খারাপ।মাশুক কিছু প্রশ্ন করার পূর্বেই হেমা বলে উঠে,

-“আমি কি পাগল, মাশরুম?”

মুখে একরাশ অসহায়ত্বের ছাপ।নিজের করুণ সত্যটাকে সজ্ঞানে জানবার ব্যাকুল আকাঙ্ক্ষা। প্রশ্নবিদ্ধ দৃষ্টিতে যেন মর্মবিদারক বাস্তবতার সঙ্গে মুখোমুখি হতে চাইছে।মাশুক বললো,

-“কে বলেছে তোমাকে পাগল?”

-“জানো আজ আমি নতুন মায়ের সাথে কাজ করেছি।রান্না ঘরে হেল্প করেছি তাকে।তোমার ভাবিটা আছেনা?সারাদিন ঘরে বসে থাকে সে এসে কি বলেছে জানো?”

-“কি বলেছে?”

-“বলেছে যে তুমি নাকি পাগলের উপর খুব বিরক্ত হয়ে যাবে।আমাকে ফেলে অন্য আরেকজনকে বিয়ে করে নিবে।আমি পাগল তাই না মাশরুম?আমি কিচ্ছু পারি না।”

আজ হেমার আচরণে এক বিশাল পরিবর্তনের আভাস মিলল। বিশেষ ওষুধটি তাহলে আপন প্রভাব বিস্তার করেছে! এই হেমা আর আগের মাসখানেকের হেমা নয়।এক সম্পূর্ণ নতুন রূপ তার,

-“তুমি আমাকে ছেড়ে যাবে?”

-“উহু! একদম না।আমি তোমাকে ছাড়া থাকতে পারিনা। তুমি কাজে গেলে তোমার জন্য অপেক্ষা করি।”

-“তুমি ভিন্ন, অপূর্ব।এটা হয়তো এক গভীর অনুভূতি।যতক্ষণ কাছে থাকো ততক্ষণ আমার আশপাশে শীতলতা বিরাজ করে।কখনও বিচ্ছেদের কথা ভাবলে আমার অস্থির অনুভব হয়।আমার অন্তর শুধু বলতে চায়,তুমি শুধু আমার আশপাশে থাকো। স্ত্রীর দায়িত্ব পালনের কোনো প্রয়োজন নেই।তোমার অস্তিত্বটাই আমার একমাত্র প্রয়োজন।”

উদাস গলায় হেমা বললো, -“বুঝিনি”

-“কথাগুলো জমা রাখো।একদিন বুঝবে,নয়তো আবার বলবো।মনে করাবো।…. আর আমি তোমার উপর বিরক্ত হবো না কখনও। ছেড়েও যাবো না।তুমি কারো কথায় কান দিবে না।”

হেমা কেঁদে ফেললো।আঘাত লুকানোর চেষ্টা করছিলো।পারলো না।কান্নারত অবস্থায় বললো,

-“আমাকে জড়িয়ে ধরো।আমার খারাপ লাগছে”

এক মুহুর্ত ব্যয় করে না মাশুক।দ্রুত উষ্ণতায় জড়িয়ে নিলো। হেমা হেঁচকি তুলে বলে,

-“তোমার ভাবিকে বলবে আমাকে এসব না বলতে।আমি নাকি কিছু পারি না।তুমি আমাকে শিখিয়ে দিও।আমিও পারবো।”

-“পারবে… সব শিখাবো।”

হেমা হুট করেই মুখ তুলে তাকায়।বড্ড অস্থির মেয়েটা!নিজেই দুহাতে মুখ মুছে নিলো।চোখের এক কোণে এখনও পানি জমে।মাশুকের এক তীব্র ইচ্ছে জেগে উঠে।কাছে এগিয়ে চোখের কোণে জমে থাকা পানিটুকু শুষে নেয়।বলে,

-“কান্না করবে।কান্না করলে মন হালকা হয়।এখন কেমন লাগছে?”

-“ভালো!”

-“আরো ভালো হলে কেমন হয়?”

মাশুকের কথা হেমার বোধগম্য হলো না।সে অপেক্ষাটুকু মাশুক করেনি।রুক্ষ অধরের অজস্র স্পর্শের বর্ষণ হলো অর্ধ সিক্ত গালে।হেমা নির্বাক, স্তব্ধ।আবারো অনুভূতির নাম দিতে গিয়ে তালগোল পাকিয়ে ফেলছে।আবারো নিঃশ্বাস আটকে রেখেছে।হেমার কম্পিত অধরের কাছে এসেই নিজেকে থামিয়ে ফেলে মাশুক। চোখজোড়া বন্ধ করলো দ্রুত।নিঃশ্বাস ফেলে বলে উঠে,

-“আমি অনিয়ন্ত্রিত হতে চাই না… হয়ে যাচ্ছি তবুও বারবার।”

হেমা ঢোক গিলে।বলে, -“তুমি.. পানি খাবেনা?”

মাশুক ঝড়ো নিঃশ্বাস ফেলে বললো,

-“দাও! গলা শুকিয়ে চৌচির।”

হেমা মাশুকের পা টপকে চলে গেলো পানি আনতে।মাশুক কিছু সময়ের জন্য নিস্তব্ধ হয়ে রইলো।তার স্পর্শ হেমার জন্য এখন বৈধ।কিন্তু ভবিষ্যতে?ভবিষ্যতে তাকে স্বামী হিসেবে যদি গ্রহণ না করে? তাহলে হেমা এই স্পর্শগুলো বয়ে বেড়াবে? ভেবে বসবে নাতো, তার মানসিক অবস্থার সুযোগ নিয়ে মাশুক তার সান্নিধ্যে এসেছে?

হেমা বাহিরে গেলো পানি আনতে।তার শ্রবণশক্তি হুট করে সজাগ হয় তীব্রভাবে। ডায়নিং রুমে দাঁড়িয়ে শুনতে পাচ্ছে শান্তা বেগম এবং রিমার কথাবার্তা।হেমার মন চাইলো তারা কি বলছে শুনতে।

শান্তা বেগম বলছেন, -“ তুমি হেমাকে বারবার পাগল বলবে না। বিষয়টা ভালো শোনায় না।”

রিমা জবাবে প্রশ্ন করলো, -“মা আপনি সব জেনে বুঝে আমাকে বলছেন?আপনি দেখছেন না মেয়েটা মাশুকের জীবন নষ্ট করছে?”

-“মাশুক যথেষ্ট বোধশক্তিসম্পন্ন। আর নিজের সিদ্ধান্ত নিজে গ্রহণ করতে সক্ষম। ও যদি নিজের ইচ্ছায় হেমার সাথে থাকতে চায় আমি মা হয়েও বাঁধা দিতে পারি না। একটা সময়ে এসে ছেলেমেয়েদের তাদের নিজের মতো করে চলতে দিতে হয়। শেকলে বেঁধে ফেললে পরিবারের প্রতি ওদের আক্রোশ জন্মায়।”

রিমা অবাক সুরে বললো, -“তাই বলে মা হিসেবে ওকে বোঝাবেন না।”

-“কি বোঝাবো? বিয়ে হয়ে গেছে।আর আমি হেমার মধ্যে ভয়ের কিছু দেখতে পাচ্ছি না আজকাল।”

-“এমন রোগীদের কথা বলা যায় না।কখন হিংস্র হয়ে উঠে।”

-“যেটা এখনও হয়নি সেটা নিয়ে ভাববার দরকার নেই। আজ দেখোনি?ওকে আমি হাতে হাতে কাজ করতে দিয়েছি খুব যত্ন করে করেছে।”

রিমার হাসির আওয়াজ শোনা গেলো।যেনো হেমাকে উপহাস করে হাসছে।হাসি থামিয়ে বললো,

-“ওকে বললেন তুমি টেবিলে প্লেট সাজাও,সে কি করলো?একটা প্লেট নিয়ে সেটা টিস্যু পেপার দিয়ে মুছলো।তারপর জায়গা মতো ধীরে ধীরে সাজালো।এটা বাড়ি কোনো হোটেল না।একটা কাজ করতে আধ ঘন্টা পাড় করেছে।”

শান্তা বেগম তড়িৎ গতিতে জবাব দিলেন, -“তোমাদের ভাষায় ম্যানার্স বলে এটাকে।আবার কি যেনো? পার্ফেকশন। দু চারটে ইংরেজি শব্দ আমিও জানি।যেহেতু বুঝো না তাই বোঝালাম।হেমাকে যত্ন দিলে সেও যত্ন করতে জানে।”

হেমা পানির গ্লাস হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে।শুনছে কথাগুলো।এত দ্রুত ঘটে যাচ্ছে যে কিছু বুঝতে পারলো আর কিছু বুঝতে পারলো না। হুট করেই মাশুক পাশে দাঁড়িয়ে হেমার বাহুতে হাত রাখে। হেমার ধ্যান ভাঙলে কদমজোড়া টলমল করে উঠলো।মাশুক দ্রুত হাতে হেমা আর পানির গ্লাস দুটোই সামলে নেয়।সাথে নিয়ে যায় ঘর অব্দি।চোখের পলকে ঔষধ খাইয়ে দিলো। হেমাও নাকোচ করেনি। ঔষধ খাওয়ার পর বিশ্রাম করতে হয় কিছুক্ষন হেমার।মস্তিষ্ক শান্ত রাখার জন্য।হেমাকে শুইয়ে দিয়ে লাইট বন্ধ করে তার পাশে বসলো মাশুক।মাথায় হাত বুলিয়ে বললো কিছু বাক্য,

-“তুমি আমার কাছে ঠিক শিশুর মতো।যার প্রতিটি পদক্ষেপ আমি সাবধানে শিখিয়ে দিচ্ছি, হাত ধরে হাঁটতে শিখাচ্ছি,নতুন করে পথ দেখাচ্ছি, ভালোবাসা দিয়ে গড়ে নিচ্ছি। আমার যত্নে গড়া এই মায়ার বন্ধন বিচ্ছেদ দিয়ে ভাঙবে না তো? উপহারস্বরূপ আমাকে বিরহ দিও না।”

হেমা ঝুঁকে থাকা মাশুকের গলা পেঁচিয়ে ধরে। জোরপূর্বক জড়িয়ে ধরে রাখলো। মিয়ে কণ্ঠে বললো,

-“তোমার কথা কিন্তু আমি একটু একটু বুঝি….আচ্ছা মাশরুম?”

-“হুম?”

-“আমি মনে হয় সত্যিই পাগল,তাই না?”

-“নাহ” গম্ভীর ধীর কণ্ঠে জবাব দিচ্ছে মাশুক।

-“তোমার ভাবি বলেছে আমাকে পাগল।আচ্ছা?আমি পাগল থেকে ঠিক হয়ে যাবো?ঠিক হয়ে গেলে আমি দ্রুত খাবার টেবিল সাজাতে পারবো। আজ প্লেটে অনেক ময়লা ছিলো।আমি সেগুলো টিস্যু দিয়ে পরিষ্কার করেছি।তারপর সুন্দর করে প্লেট আর গ্লাস সাজিয়েছি।এসব করতে করতেইতো দেরি হলো।তোমার ভাবি বলে আমি একটা টেবিল সাজাতে এতক্ষণ সময় নিলাম?বিচার দিচ্ছিলো নতুন মায়ের কাছে।”

-“তারপর মা কি বললো?”

-“নতুন মা বললো যে, উম….পার্ফেকশন আর ম্যনার্স বলেছে।”

বাঁকা হাসলো মাশুক।মাশুকের গলা পেঁচিয়ে রেখেছে হেমা।ছাড়ছে না কিছুতেই।ঝুঁকে থাকা অবস্থায় মৃদু আলোতে তার মোহিত মুখখানি দেখা গেলো। দীর্ঘশ্বাস ফেলে হেমাকে বুঝাবার জন্যে জবাব দেয়,

-“এখন থেকে তোমার নতুন মা-ও তোমার দলে। ভাবিকে বকে দিয়েছে।এবার চোখটা বন্ধ করো।”

-“তুমি থাকো!”

কপালে ঠোঁট ছুঁইয়ে দেয়।যদি বিচ্ছেদ আসে তাহলে ভুলে যাক এই স্পর্শ আর স্মৃতিগুলো।জবাবে বলে,

-“আছি আছি…কোথাও যাওয়ার পথ ফাঁকা রাখোনি তুমি।”

_______

-“আমি চাইছি না বুজুর্গ কারো সাথে রাগ দেখাতে।তাই ভদ্রভাবে আরো একবার প্রশ্ন করছি,কেনো মেরেছেন হেমার বাবা মাকে?”

মাশুক হাত মুষ্ঠিবদ্ধ করে দাঁড়িয়ে তীরের মতো ছুড়লো কথাগুলো।মেজাজ সপ্তম আসমানে।শান্তনু দেখছে তার লালাভ চোখ। ধৈর্যশীল মানুষগুলোর রাগ ভীষণ ভয়ংকর।শার্টের হাতা ছাড়িয়ে জমিনে শক্ত পা গেড়ে দাঁড়িয়ে জেরা শুরু করেছে।

জব্বার সাহেব থেকে কোনো জবাব না পেয়ে উচ্চ আওয়াজে বললো,

-“রিমান্ডে যেতে চান এই বয়সে?হ্যাঁ! বলুন,ব্যবস্থা করি তাহলে।আসলে আপনাদের মত মানুষের প্রতি রহম করা উচিত না।”

তারপরও জবাব দিলো না জব্বার সাহেব।দুহাত একজোড় করে বসে আছেন মাথা নামিয়ে। নাছোড়বান্দার মতো মুখে কুলুপ এঁটে।মাশুক এগিয়ে গেলো।জব্বার সাহেবের দিকে সামান্য ঝুঁকে বললো,

-“ওয়ান লাস্ট টাইম! আর সুযোগ দিবো না।আমি আউট অফ কন্ট্রোল হয়ে যাওয়ার আগে মুখ খুলুন।জলদি!”

বলে সোফার হাতলে নিজের হাত দিয়েই জোরে আঘাত করলো।ঘাবড়ে গেলেন জব্বার সাহেব। মৃত্যুদণ্ড প্রাপ্ত আসামীদের মধ্যে একজন জবানবন্দি দিয়েছে।তারা জব্বার সাহেবের উস্কানিতে নগদ দুই লক্ষ টাকার বিনিময়ে খু ন করেছে। হ ত্যাকাণ্ড ঘটানোর পূর্বে তাদের নে শাজাতীয় দ্রব্য দেওয়া হয়।যেনো এক মুহূর্তের জন্য হাত না কাঁপে।

শান্তনু চেয়ার থেকে উঠে এসে মাশুকের কাঁধে হাত রেখে বলে, -“শান্ত হ”

মাশুক হাত সরিয়ে দিলো। শরীর কাঁপছে তার। বারবার ভেসে উঠছে ওই দৃশটুকু। কিভাবে নির্দয়ের মত মে রে ফেলা হচ্ছিলো দুজন নর-নারীকে।মাশুক খানিক অস্থির গলায় বলে,

-“মানুষের জীবন বাঁচাতে তাদের আপনজনেরা টাকা, শ্রম সব উজাড় করে।ডাক্তারেরা রোগীকে শেষ অব্দি বাঁচানোর জন্য নিজেদের সবটুকু দেয়।আর এরা? নিমিষেই মে রে ফেললো! এত আক্রোশ? নাকি টাকার লোভ! কত টাকা চাই ওনার জিজ্ঞেস কর! এত সম্পদ থাকা স্বত্তেও কেনো অন্যের খু নে হাত ময়লা করলো?”

জব্বার সাহেব মুখ খুললেন, -“আপনারা আমাকে প্রমাণ ছাড়া জেরা করে যাচ্ছেন। ক্ষমতা আছেতো তাই আমার উপর চড়াও হচ্ছেন।”

অবাক না হয়ে পারলো না মাশুক আর শান্তনু।লোকটা এখনও এসব কথা বলছে! সাহসের তারিফ না করলেই নয়। মাশুক তেড়ে গেলো।বললো,

-“আপনার বন্ধু নাসির মোল্লা ঘটনা অর্ধেকটা বলেছেন। এমনকি আপনার জন্য কাজ করা আসামীরাও জবানবন্দি দিয়েছে। আর কি চাই?”

-“ওরা মিথ্যে বলছে”

-“মিথ্যে আপনি বলছেন! বলুন কারণ কি এই খুনের পেছনে? ব্যক্তিগত নাকি টাকার লোভে পড়েছিলেন?”

-“কোনোটাই না”

-“আপনাকে খুব স্বাভাবিক দেখাচ্ছে। কি ভাবছেন পাড় পেয়ে পাবেন? দশ বছর পূর্বের পাপের ঘানি টেনে এখনও আপনি শান্ত! এবার কোনো আপোস নয়।”

শান্তনু মাশুকের কাছে গিয়ে বললো, -“এরেস্ট ওয়ারেন্ট আসবে বিকেলের মধ্যেই। রিমান্ডে নিলে উনি আপনাআপনি মুখ খুলবেন তুই চিন্তা করিস না।”

মাশুক দৃষ্টিপাত করলো শান্তনুর দিকে। মাশুক নিজেও মানসিকভাবে অশান্ত। সারাদিন হেমা এবং অন্যান্যদের মানসিক সেবা দিতে দিতে নিজের যত্ন নেওয়া হয়না।ক্লান্ত হয়ে পড়ে সেও।বোঝাতে পারছে না কাউকে! বললো,

-“আইন সত্যিই অন্ধ! আসল আসামীকে খোলা আকাশের নিচে রেখে তার ইশারায় কাজ করা চ্যালাদের কয়েদী বানিয়েছে।”

শান্তনু চোখ নামায়। কথা সত্য। আগে এই কেসের ভার কার কাঁধে ছিলো জেনেছে। লোকটা অলস প্রজাতির।দ্রুত কেস সলভ করে টাকা কামানোর উদ্দেশ্যে ইনভেস্টিগেট করেনি ঠিকমতো।শান্তনু বললো,

-“আগে যে এই কেস হ্যান্ডেল করেছে সে ভেবেছে এটা ওপেন কেস।”

-“ওপেন কেস? তাহলে তার মতে মূল আসামী ছিলো নাসির মোল্লা। কই তাকেও ধরতে পারেনি। সেতো দেশেই ছিলো,ইভেন এই শহরেই ছিলো।”

শান্তনু জানে বোঝানোর চেষ্টা ব্যর্থ হবে।তাই বললো,

-“আমি এখানে আছি….তোর হেমা তোর জন্য অপেক্ষা করছে।যা বাড়ি যা”

-“শান্তনু…”

-“আমি এই লোককে ছাড়বো না। বিশ্বাস রাখ বন্ধুর উপর। যা, দেড়ি করিস না।”

আজ অন্য হাসপাতালে ক্যাম্পেইন ছিল। সেখানে নানান দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত রোগীরা; তাদের শারীরিক এর পাশাপাশি মানসিক স্বাস্থ্য পরীক্ষার প্রয়োজন।সহানুভূতির পরশ ছাড়া এই রোগ দেহ পেরিয়ে মন মস্তিষ্কে বাসা বাঁধতে পারে।

গাড়ি চলছে, কিন্তু মাশুকের বুকের ভেতর এক প্রবল ঝড়। হঠাৎই ফোনে মেইল আসে। গাড়ির গতি মন্থর করে খুলে দেখে।কিছুদিনের মধ্যেই ‘লাইফ কেয়ার’ নামের প্রাইভেট হাসপাতালে ক্যাম্পেইন। নিঃশ্বাস ছেড়ে মাশুক ভাবে, ভালো লাগছে না তার কিছুই।কিছুটা বিরতি প্রয়োজন।

অল্পক্ষণের মাঝেই বিশাল জ্যাম।হতাশ হয় মাশুক।বসে দেখলো একটি ছেলে নূপুর নিয়ে হাজির।গাড়ির গ্লাস নামানো ছিলো।ছেলেটি অসহায় গলায় বললো,

-“স্যার স্যার! আমার আর চারটা নূপুর বিক্রি বাকি।নিয়ে নেন না,বাড়ি যামু।”

মাশুক হাত বাড়ায়।ছেলেটির চুলে হাত ফিরিয়ে বললো,

-“দাম কত?”

-“পঞ্চাশ টাকা,চারটা দুইশো।আপনার লেইগা বিশ টাকা কম রাখুম।”

মাশুক পকেট থেকে মানি ব্যাগ বের করলো।হাত এগিয়ে দিলো নুপুরগুলো নেওয়ার জন্য।পাঁচশত টাকা বের করলো।জ্যাম ছাড়তে সময় লাগবে।প্রথমেই দুইশত টাকা দিলো।ছেলেটি নূপুর এগিয়ে দিয়েছে।ছেলেটি চলে যাওয়ার পূর্বে মাশুক ডাকে,

-“এই শুনো!”

-“জ্বি সাহেব?”

-“তোমার বাড়িতে কে কে আছেন?”

-“আব্বা,আম্মা আর আমি।”

-“খেয়েছো?”

-“না স্যার।এই টাকা দিয়া চাল ডাইল কিনা নিয়া যামু।”

মাশুক তার ঠিক বাম দিকে ঘুরে তাকালো। ছোটোখাটো গ্রসারি স্টোর। তার গাড়ি এসে আটকেছে রাস্তার দ্বারে।হুট করেই গাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়লো।ছেলেটিকে ইশারায় বললো এখানে থাকতে।কিছু কেনাকাটা করে নিয়ে আসে পাঁচ মিনিটের মধ্যেই।তখনও জ্যাম ছাড়ার কোনো নাম গন্ধ নেই।তিনটে বিরিয়ানির প্যাকেট আর কিছু জিনিসপত্র ছেলেটির দিকে এগিয়ে দিয়ে বলে উঠে,

-“কার দুআ কখন লেগে যায় বলা যায় না…”

-“কি?”

-“আরো তিনশো টাকা দিচ্ছি।এগুলো নিয়ে সোজা বাড়ি যাবে।”

ছেলেটি ছলছল নয়নে মাশুকের হাত ধরে বললো,

-“আপনার ভালো হোক স্যার।অনেক অনেক ধন্যবাদ।”

মাশুক হাসলো। ঘাড় বাঁকা করে দেখলো ছেলেটিকে।সত্যিই রিকশা নিয়েছে রোডের অন্যপাশে গিয়ে।তার চলে যাওয়া দেখে তপ্ত নিঃশ্বাস ফেলে।আরো পাঁচ মিনিট পর জ্যাম ছেড়ে দিলো।

বাড়ি ফিরে ভিন্ন চিত্র।বাবার সাথে বসে লুডো খেলছে হেমা। হাসছে খিলখিল করে। মাশুককে দেখে চোখজোড়া আরো জ্বলজ্বল করে উঠে। দৌঁড়ে এসে পানি দিলো তাকে। মাশুক দুটো নূপুর টেবিলে রেখে রিমা আর শান্তা বেগমের উদ্দেশ্যে বললো,

-“এমনিতেই আনলাম। ভালো লাগলে পড়ো দুজনে।”

বলে উঠে যায়। শান্তা বেগম এবং রিমা অবাক, বিস্মিত।এমনটা আগে কখনোই করেনি সে। হেমা তার পিছু ছুটে।প্রশ্নবিদ্ধ করে,

-“আমারটা?”

মাশুক দুষ্টু গলায় জবাব দেয়, -“তোমার জন্য আনিনি।”

হেমার মুখে আঁধার ঘনিয়ে আসে।বিছানায় বসে কুঁজো হয়ে রইলো। যেনো মানতে পারছে না। মাশুক ফ্রেশ হয়ে এসে তার নেতিয়ে থাকা মুখটা দেখে আনমনে হেসে উঠে।

-“রাগ?”

হেমা মাথা দোলায়। মিথ্যে বলছে সরাসরি।মাশুক একটির বদলে দুটো নূপুর হেমার কোলে রাখলো।বললো,

-“একটা নয় দুটো এনেছি তোমার জন্য।”

হেমা ছুঁয়েও দেখলো না নূপুরগুলো। মুখ ফুলিয়ে সরিয়ে রাখলো অন্যত্র।আবারো অভিমান! মাশুক জমিনে পা গেড়ে বসে।একটি একটি করে নূপুর নিয়ে নিজেই দুই পায়ে পড়িয়ে দিলো।উঠে দাঁড়িয়ে হেঁচকা টানে হেমাকে দাঁড় করায়। প্রতিক্রিয়া দেওয়ার পূর্বেই বাহুডোরে আটকে বলে উঠে,

-“আমি ক্লান্ত… ভীষণ ক্লান্ত। বেশকিছু সময় থাকো আমার কাছে।নড়চড় করবে না।”

চলবে….