হিমাদ্রিণী পর্ব-১৬

0
2

#হিমাদ্রিণী – ১৬
লেখনীতে – আয্যাহ সূচনা

রিপোর্ট অনুসারে হেমার অ্যামিগডালা অতিরিক্ত সক্রিয়।এটি মস্তিষ্কের লিম্বিক সিস্টেমের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ।যা আবেগ, ভয় এবং উদ্বেগ নিয়ন্ত্রণে ভূমিকা রাখে।খালি চোখেই বিষয়টি নজরে পড়েছে মাশুকের।বাকি সবকিছুই ঠিকঠাক।সৌভাগ্যবশত মস্তিষ্কে কোনো গুরুতর আঘাত নেই।অনেকদিনের বন্দী জীবন আর বারবার ভুলভাবে সেই দৃশ্যের পুনরাবৃত্তি হেমাকে আরো অসুস্থ করে তুলেছিলো।চলাফেরা,কথাবার্তা,কাজকর্ম সবকিছুর ছলে হেমাকে স্বাভাবিকভাবেই উন্নতির দিকে নিয়ে যাওয়া যাচ্ছে। তাই স্মৃতির পুনরাবৃত্তি ঘটানোর সাহসটুকু মাশুকের হয়নি। হিতের বিপরীত হতে পারে এই ভয়ে।

জহির সাহেব বললেন, -“তুমি কি চাও হেমা ওর বাবা মায়ের বিষয়টা ভুলে যাক?”

মাশুক হীনমন্যতায় ভুগছে। অসহায় চোখে বাবার দিকে চাইলো। ল্যাপটপ বন্ধ করে বললো,

-“স্বার্থপরের মতো শোনাবে,কিন্তু আমি চাই ভুলে যাক।”

জহির সাহেব ছেলের এমন কথায় বলে উঠেন,

-“এটা কি অন্যায় নয়? তুমি হেমার মস্তিষ্ক থেকে তার বাবা মায়ের স্মৃতি মুছে দিতে চাইছো?”

শুক্রবারের সকালগুলো ছিলো একসময় অন্যরকম। বাবার সাথে চায়ের আড্ডায় প্রায়শই বসতো মাশুক আর মৃদুল। আজকাল ব্যস্ততার কোলাহলে সেই মুহূর্তগুলো হারিয়ে গেছে। তবে আজ চায়ের কাপে খানিকটা সময় ফিরে এসেছে, কিন্তু মৃদুল নেই। ঢাকার বাইরে সে।

হেমাসহ বাকি পেশেন্টদের রিপোর্ট চেক করছিলো মাশুক।বাবার কথার জবাবে বললো,

-“অবশ্যই অন্যায়, কিন্তু বাবা এখানে ন্যায় অন্যায়ের অংক জটিল। হেমাকে কি বলে আশ্বস্ত করবো আমি? ওকে পুরোনো স্মৃতি মনে করাবো ঠিকই কিন্তু ওর বাবা মা’কে ফিরিয়ে দিতে পারবো? তার মধ্যে যদি এই চাওয়া জাগ্রত হয়? ওর মস্তিষ্ক যদি মেনে নিতে না পারে? তখন?”

জহির সাহেব এখনও নিউজপেপার পড়েন।তার আধুনিক যন্ত্র ঠিক জমে না।তার জন্য নিউজ পেপার চাইই চাই।হাতে থাকা নিউজপেপারটি পাশে রেখে ছেলের উদ্দেশ্যে বলেন,

-“তুমি যা বলছো সেটায় কোনো ভুল নাই থাকতে পারে। কিন্তু তাদের স্মৃতি একেবারে মুছে দেওয়া উচিত নয়।”

মাশুক বিচলিত হয়ে বলে, “বাবা তুমি দেখোনি,হেমার অবস্থার অবনতি সেই ভয়ানক ভিডিও দেখে হয়েছে।ওকে আমি কিভাবে মনে করাই সেটি?”

-“ভালো স্মৃতি মনে করাও।বুঝাও ওকে, যে এখন আমরাই তার পরিবার।”

-“ওকে বেশি চাপ দিলে ওকে হারাতে হবে। আর আমি কিছুতেই চাই না ওকে হারা….”

বলতে বলতে থেমে গেলো মাশুক। লজ্জাজনিত কারণে। বাবার সামনে এভাবে বলা উচিত হবে না। নিজেকে বরাবরই অপ্রকাশিত রেখেছে মাশুক। গলগল করে বলে ফেলতে ইচ্ছে হলেও দমিয়ে নিলো।

নিজেকে ধাতস্ত করে মাশুক বলে উঠে,

-“আমি জানি আমি যা চাইছি তা অন্যায়। রিস্ক নেওয়া যাবেনা বাবা।”

জহির সাহেব মাশুকের মুখের দিকে তাকালেন। ফ্যাকাশে মুখমন্ডল। অজানা আতঙ্কে। স্ত্রীর প্রতি মায়া নাকি অন্য কিছু। জানতে প্রশ্ন করে বসেন,

-“তুমি কি কিছু নিয়ে চিন্তিত? ভয় পাচ্ছো?”

মাশুকের গলা শুকিয়ে আসলো। অদ্ভুত বিদ্যুৎ বয়ে গেলো দেহে। ভয়! সত্যিই ভয় পাচ্ছে সে। জহির সাহেব আবার শুধালেন,

-“আমাকে বলো”

মাশুক ভরসা পেলো যেনো।গলা ভিজিয়ে বললো,

-“গত পরশু.. হাসপতালে একটা পেশেন্ট মা রা গিয়েছে। ৯০% সেম কেস। তাকে থেরাপি দেওয়ার সময় যখন সেই ভয়ানক স্মৃতির সাথে তার পরিচয় করিয়ে স্বাভাবিক করার চেষ্টা করা হলো সে অতিরিক্ত উত্তেজিত হয়ে উঠে। আউট অফ কন্ট্রোল চলে যায়।মেডিসিন কাজ করেনি।ততক্ষণ ব্রেইনের ৭০% কোষ ড্যামেজ হয়ে গেছে।রক্ত চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। চিৎকারে গলার রগ….”

হুট করেই মাশুক ল্যাপটপ নিয়ে উঠে দাঁড়ায়। ঝটপট বলে উঠে,

-“বাবা পরে কথা বলি এই বিষয়ে…”

মাশুকের দৃষ্টিতে হেমার ক্ষীণ নড়চড়।নূপুরের মৃদু ঝংকার, কর্ণ বেয়ে মসৃণভাবে হৃদয়ে প্রবেশ করেছে। প্রেমের অনল ছড়িয়ে পড়েছে প্রতিটি স্নায়ুতে। গভীর মোহনীয় চোখ এলোমেলো চুলের দিকে মনোযোগী।বিছানায় আধশোয়া মাশুক তাকিয়ে আছে।দৃষ্টি মায়াজালে আবদ্ধ। এক নিমেষেই তাকে ভাসিয়ে নিয়ে যাবে অজানা এক প্রেমতরঙ্গে।

-“উফ!”

বলে উঠলো হেমা।মাশুকের ঘোর কাটলো না তাতেও। নজর সরলেই যেনো অনেক বড় কোনো অঘটন ঘটে যাবে।

হেমা ট্যাবলেট এর দিকে তাকিয়ে চলতে থাকা ভিডিওর উদ্দেশ্যে বললো,

-“এই মেয়েগুলো এত তাড়াতাড়ি কথা বলে কেনো! ধুর!”

মাশুকের কপালে সূক্ষ্ম ভাঁজ পড়ে। হেমা বিরক্ত হচ্ছে।খেয়াল নেই তার মাশুকের গাঢ় দৃষ্টিতে। কিছু মেয়েলি স্বাভাবিক ইচ্ছে প্রকাশ পাচ্ছে তার মাঝে। ইউটিউব ব্যবহার করতে শিখলো মাত্র কয়েকদিন।খুঁজে খুঁজে বের করেছে সাজসজ্জার ভিডিও। শ্বাশুড়ি মায়ের কাছ থেকে জোর আবদার করে চুরি, কাজল, লিপস্টিক আদায় করেছে। দেখছে আর সাজছে আয়নার সামনে বসে।

অজান্তেই মাশুকের মুখ ফুটে বেরোলো, – “ শাড়ি… আকাশি রঙের শাড়ি পরলে তোমায় আরো ভালো লাগবে…”

একহাত মাথার পেছনে ঠেকিয়ে, নিথর মুখমণ্ডল নিয়ে মাশুক যেনো নিজের সহধর্মিণীর রূপমাধুর্যে হারিয়ে গেছে।রৌদ্রের সোনাঝরা আলোতে হেমা আরও উজ্জ্বলতর হয়ে উঠছে।পৃথিবী থেমে আছে তার, এই মুগ্ধতার আবেশে। আজ শুক্রবারের কথা, নিত্য রুটিন। সেখানে তেমন হুশ নেই মাশুকের।

হেমা সময় নিয়ে জবাব দিলো মাশুকের কথার। সে এখন অনেক ব্যস্ত সাজসজ্জায়। আর সাথে বিরক্তও।বললো,

-“চুপ থাকো মাশুক”

ভিন্ন শোনায়,কিছুটা ভিন্নতা আছে এই কথায়। ধ্যান- জ্ঞানহীন মাশুকের কপালের ভাঁজ গাঢ় হয়। হেমার কথার কোনো শব্দ,কোনো অক্ষরে গড়বড় আছে।ঠোঁট ভিজিয়ে নড়েচড়ে বসে।জিজ্ঞাসা ছুঁড়ে,

-“কি বললে?”

-“উফ! তোমাকে চুপ থাকতে বলেছি।”

-“তারপর কি বলেছো?”

-“বলেছি চুপ থাকো মাশুক! কথা বলবে না। দেখছো না আমি রেডি হচ্ছি। নতুন মা আমাকে এসব কি দিলো। এই মেয়ে এত দ্রুত কেনো সাজছে। আমি হাঁপিয়ে যাচ্ছি….”

তবে মাশরুম থেকে মাশুকে রূপান্তরিত হলো। মাশুক তার নিজের পরিপূর্ণ জ্ঞানে ফিরে আসে। উঠে হেমার চুলের গভীরে হাত রাখার কয়েক সেকেন্ডে ধমক খেলো। হেমা চিৎকার করে হাত সরিয়ে দেয়।বলে,

-“আমার চুলে হাত দিচ্ছো কেনো অসভ্য ছেলে! যাও এখান থেকে।”

আচমকা ধমক খেয়ে মাশুক ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলো। দিনকাল তার ভালো না। বউয়ের ধমক খাওয়া বাকি ছিলো। মার-তো বহু আগেই খেয়েছে। নিজের চুলে হাত ফেরাতে ফেরাতে তোয়ালে হাতে নিলো। একবার চেয়ে দেখলো হেমার কর্মকাণ্ড। ভীতুর ন্যায় চুপচাপ চলে যায় ওয়াশরুমে।

গোসল শেষ। পাঞ্জাবি গায়ে দিয়েছে মাশুক ততক্ষণে। কিন্তু হেমা নিজের স্থান থেকে নড়ে নি। হতাশা ঘেরা মুখ নিয়ে আয়নার সামনে দাঁড়ালো মাশুক। চিরুনি নিবে বলে হাত বাড়ালেই হাতে চাপড় মারলো হেমা। বললো,

-“ধরবে না। একদম ধরবে না।”

মাশুক বললো, – “নামাজে যাবো। একটু নেই চিরুনিটা?”

-“না এটা আমার। যাও ভাগো”

চিরুনি পাওয়ার আশা বাদ। আতর হাতে তুলতেও ভয় করছে কিছুটা মাশুকের। মেয়ের মেজাজ সপ্তম আসমানে। আতর নিতে গেলেও না আবার ধমকে বসে। মাশুক নিজের কর্মকাণ্ডে তড়িৎ গতিতে বিরক্ত হয়ে যায়। সে কি ভয় পাচ্ছে বউকে? ফোস করে নিঃশ্বাস ফেলে আতরটা চট করে তুলে নেয়। হেমা চোখ পাকিয়ে তাকালো।কিছু বললো না। গায়ে আতর মেখে বেরিয়ে পড়ার পূর্বেই হেমা হাত টেনে ধরে মাশুকের। উঠে এসে বলে,

-“আজকে তোমার কাছ থেকে অন্যরকম ঘ্রাণ আসছে। একেবারে মিষ্টি ঘ্রাণ।”

মাশুক হাসলো। বললো, -“ভালো লেগেছে?”

হেমা মাশুকের বুকে নাক ঘষে দিয়ে বললো, “খুব! আমার ইচ্ছে করছে তোমাকে জড়িয়ে ধরে ঘুমিয়ে যাই। সাজগোজ বাদ। ক্লান্ত হয়ে গেছি আমি।”

মহাবিপদ! নামাজের সময় হচ্ছে। হেমা জেদ ধরলে ঠেকানো মুশকিল। মাশুক বললো,

-“বাড়ি ফিরলে জড়িয়ে ধরে ঘুমাবে। এখন নামাজে যাচ্ছি, কেমন?”

-“নাআআ”

হেমার গালে হাত রেখে আদুরে ভঙ্গিতে মাশুক বললো,

-“জেদ করে না। ফেরার পথে তোমার জন্য জিলেপি নিয়ে আসবো।”

হেমা হুট করেই কেমন যেনো থমকে গেলো। মস্তিষ্কের গহ্বরে এক স্মৃতি ঝাপসা আলোয় ধরা দিচ্ছে। বুঝতে পারলো না হেমা। কথাটি আগেও কোথাও শুনেছে। কে যেনো বলেছিলো তাকে। অদ্ভুতভাবে কিছু দৃশ্য অপরিষ্কার হয়ে চোখের সামনে ভাসতে লাগলো। মাশুক প্রশ্ন করে,

-“আসি?”

হেমা চিন্তিত ভঙ্গিতে মাথা দোলায়।বলে,

-“হুম”

______

মসজিদের বাহিরে পরিচিত একটি জিপ। মাশুকের চিনতে এক মুহুর্ত দেরি হয়নি। দুইদিন যাবত গায়েব থাকা ছেলেটি এখানে হঠাৎ? বাবাকে বাড়ি ফিরতে বলে দ্রুত এগিয়ে গেলো। পায়ের গতি বাড়িয়ে জিপের সামনে এসে দাঁড়ায়। তীক্ষ্ণ গলায় প্রশ্ন ছুঁড়ে,

-“কিরে?”

শান্তনু উঁকি দিলো।জানতো এখানেই পাবে মাশুককে আজ। জুম্মার দিনে পাড়ার মসজিদেই নামাজ আদায় করে সে।স্কুল কলেজে থাকাকালীন মাঝেমধ্যে তাকে এখান থেকেই জোরজবরদস্তি তুলে নিয়ে যেতো শান্তনু।

শান্তনু বেরিয়ে এলো হাসিমাখা মুখে।বললো,

-“কি খবর?”

মাশুক আশ্চর্য হয়ে বলে, – “খবর? খবরতো তুই দিবি।”

-“ওহ হ্যাঁ, আমিইতো দিবো। কোনটা শুনবি আগে?”

মাশুক আশ্চর্যের চরম সীমায় পৌছে যাচ্ছে। খবর তার জানামতে একটাই। কেস সংক্রান্ত। মাথা থেকে টুপি সরিয়ে বললো,

-“তুই জব্বার সাহেবের রিমান্ড মঞ্জুর করিয়ে কোথায় চলে গিয়েছিলি? ফোন করে ফোনেও পাইনি তোকে।”

শান্তনু দাঁত বের করে হেসে বললাম, -“নিষ্ঠুরের মত একা একা সংসার করছিলি। আমার সইছিলো না। তাই বিয়ে করতে গিয়েছিলাম।”

মাশুকের কপালে বিস্ময়ের চিহ্ন স্পষ্ট, ঘামের ছোট্ট বিন্দুগুলো সেখানে চিকচিক করছে।বিরক্তি আর বিস্ময়, সবটাই যেন ভাঁজ পরা কপালের ভঙ্গিতে ফুটে উঠে তার। নতুন কিছু নয়।সেই সূক্ষ্ম ভাঁজ তার প্রশ্নের ভার বহন করে।

-“কি বলছিস এসব?”

শান্তনু এগিয়ে এলো। প্রিয়তম বন্ধুর কাঁধে হাত রাখলো অবলীলায়। বললো,

-“পাহাড়ে গিয়েছিলাম, পাহাড়ী বউ আনতে। দুইদিন আগে রাতেই মা’কে নিয়ে রওনা হই। মালার বাবা মা ওকে অন্য জায়গায় বিয়ে দেওয়ার পাঁয়তারা করছিলো। আমি গেলাম রাত তিনটের লগ্ন পড়লো। বিয়ে করলাম আর গতরাতে বউ নিয়ে ঢাকা ফিরলাম। এটাই কাহিনী।”

মাশুক কাঁধ থেকে হাত সরিয়ে নিলো খানিক রেগে।বললো,

-“জানাস নি কেনো?”

-“তাড়াহুড়োতে ছিলাম বন্ধু।”

-“যাত্রা পথে মনে হয়নি আমাকে একবার ফোন করার কথা?”

মাশুকের কথাও ঠিক। ভুল নেই একবিন্দু। কিন্তু সেই সময় শান্তনু সেই অবস্থায় ছিলো না। পরিস্থিতি অন্যরকম ছিল।শান্তনু আবারো কাঁধে হাত রেখে জোরপূর্বক। বলে,

-“তুই কি অভিমান করছিস?”

-“এসব মেয়েলি স্বভাব আমার নেই।”

-“তুই রাফ এন্ড টাফ… বউয়ের সাথেও কি এমন?”

মাশুকের মনে পড়লো কিছুক্ষন আগের কথা।তার গোমরা মুখ দেখলেই মানুষ কথা বলতো মেপে মেপে। নিজেদের মনে মনেই তাকে রাগী ভেবে নিতো। প্রতিক্রিয়াহীন গম্ভীর মুখ। কিন্তু সেই মাশুক কিছুক্ষন পূর্বে বউয়ের ভয়ে চিরুনিটুকু হাতে তুলতে পারেনি। এতো অধঃপতন!

মাশুক জবাব দেয়,- “বাড়ি চল, দেখে নিস আমি আমার বউয়ের সাথে কেমন?”

-“নাহ রে আজ না। অন্য একদিন তোর ভাবীকে নিয়ে আসবো। আজ বাড়িতে প্রথমবার রান্না করেছে”

-“আচ্ছা” এক শব্দে জবাব দিলো মাশুক।

-“ ভুরিভোজ করে করে শরীরে শক্তি জোগাবা। তারপর থানায় যাবো জব্বার সাহেবের খাতিরদারি করতে।”

মাশুক বললো, -“আপডেট দিস।”

-“আচ্ছা বন্ধু! গেলাম তাহলে?”

__________

-“তোমার জন্য পায়েস এনেছি”

আগামীকাল এক পেশেন্টের সার্জারি। তারই কেস স্টাডি করছিলো মাশুক। হুট করেই হেমার কণ্ঠে ফিরে তাকালো। হেমা চশমার আড়ালে থাকা চোখজোড়া দেখে মুচকি হাসে। আজ সারাদিন সেজেগুজে বেরিয়েছে। রাত তখন দশটা। হুট করে পায়েস?

মাশুক জানে পায়েস তার মা রেঁধেছে।তারপরও পায়েসের বাটি হাতে নিয়ে জিজ্ঞেস করে,

-“তুমি বানিয়েছো?”

হেমা ওড়না হাতের মুঠোয় জড়ো করে মাশুকের সামনে এসে বসলো। আগ্রহী গলায় বললো,

-“আমি তিন চামচ চিনি দিয়েছি। নতুন মা রেঁধেছে। কিন্তু আমিও হেল্প করেছি তাকে। মা বললো তোমাকে দিতে। তাই এনে দিলাম। আমি ডাবল কাজ করেছি।”

-“ভেরি গুড।হেমা এর পাশাপাশি পড়াশোনা করতে হবে কিন্তু”

পড়াশোনার কথা শুনে মুখ কুঁচকে গেলো হেমার। বলে উঠলো,

-“আমার পড়তে ভালো লাগেনা। আমি পড়বো না।”

-“কি ভালো লাগে?”

হেমা ঠোঁটে ঠোঁট চেপে হাত এগিয়ে পায়েসের বাটি হাতে তুলে নেয়। নিজে এক চামচ মাশুকের মুখে পুরে দিয়ে বললো,

-“আমার শুধু তোমার সাথে থাকতে ভালো লাগে, মাশরুমমমম”

মাশুক ফিক করে হেসে ফেললো সুরেলা কন্ঠ শুনে।বললো,

-“আজকাল আমাকে জব্দ করতে পারো বেশ”

রাত্রির প্রহর ক্রমশ গাঢ় হয়ে এলো,আর হেমার তন্দ্রাও ততটাই গভীরে নিমজ্জিত। তার মুখখানি কোমল প্রশান্তিতে আচ্ছন্ন, ঠোঁটজোড়া সামান্য ফাঁক করে সে যেন নিদ্রার নিবিড়তায় ডুবে আছে। মাশুকের কোমর জড়িয়ে রেখেছে। অথচ মাশুকের চোখে আজ ঘুমের ‘ ঘ’ টুকু নেই। আগামীকাল সার্জারি। যদিও সে নিজে সার্জারিতে থাকবে না, তবুও রোগীর মানসিক পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করা তার দায়িত্ব। কাজের মাঝে এক ফাঁকে চশমাটি খুলে পাশে রাখে, এরপর নিঃশ্বাসের প্রশান্ত ঢেউয়ে মগ্ন হেমার দিকে তাকিয়ে স্নিগ্ধ হেসে তার সারা মুখে হাত বুলিয়ে দেয় মাশুক।

বলে,- “ এক টুকরো শান্তি”

ঘন্টাখানেক পর মাশুক ল্যাপটপ বন্ধ করে শুয়ে পড়লো।ঠিক তখনই বিকট চিৎকার শোনা গেলো হেমার কণ্ঠে। মাত্র নিদ্রা ধরা দিয়েছিলো তার চোখে। এমন আওয়াজে লাফিয়ে উঠলো। হেমার চোখ বন্ধ। ছটফট করছে। পাগলের মত হাতপা ছোড়াছুড়ি করছে।মাশুক বাতি জ্বালায়। উঠে হেমাকে চেপে ধরে গালে আলতো চাপড় দিতে লাগলো। বললো,

-“হেমা!…. হেমা? চোখ খুলো।”

হেমার যেনো নিঃশ্বাস আটকে ছিলো। বিস্ফোরিত চোখে তাকালো। লম্বা নিঃশ্বাস ফেলে। ধড়ফড় করে উঠে যায়। বুকে হাত রেখে আর্তনাদ করে বলে,

-“বাবা… মেরে ফেলছে! মাকেও…”

দুঃস্বপ্ন! মাশুকের বুঝতে বাকি রইলো না হেমার অবস্থা সম্পর্কে। সেই আগের স্মৃতি স্বপ্নে ধরা দিয়েছে। মাশুক হেমার ছটফট থামাতে তাকে চেপে ধরে। অতিরিক্ত ছটফট তার জন্য উচিত হয়।

হেমা চিৎকার করলো আবারো।ততক্ষণে বাড়ির সকলের ঘুম ভেঙে গেছে।দরজার কাছে দাঁড়িয়ে ডাকছে। মাশুক বিচলিত হয়নি। একহাতে হেমাকে আটকে রেখে অন্যহাতে ঘরের দরজা খুলে দিলো কোনো রকম। সবার উদ্দেশ্যে তেজি গলায় বললো,

-“ওর কিছু হয়নি… খারাপ স্বপ্ন দেখেছে, দ্যাটস ইট!”

কেউ কিছু বলার পূর্বেই চুপ হয়ে যায়। শান্তা বেগম বিছানার একপাশে এসে বসলেন হেমার পাশে। রিমা বলে উঠলো,

-“মা যাবেন না। ও আপনাকে আঘাত করবে”

মাশুক অগ্নিদৃষ্টিতে রিমার দিকে চাইলো। মুখ শক্ত করে নীরবে চেয়ে রইলো। রিমা চোখ নামিয়ে নেয়। মাশুক মায়ের উদ্দেশ্যে বলে,

-“ওকে ধরো! আমি ইনজেকশন আনছি..”

প্রথমবার সাহস করলেন শান্তা বেগম। জাপটে ধরলেন হেমাকে। শরীরে যতটুকু শক্তি আছে ততটুকু দিয়েই। ফ্রিজে ইনজেকশন। মাশুক নিয়ে এসেছে। ততক্ষণে হেমা বিছানায় লুটিয়ে ছটফট করছে। মুখ দিয়ে লালা পড়ছে অনবরত, চোখ- মুখ ভেজা অশ্রুতে। গুঙিয়ে বলছে,

-“আমার মা’কে মারছে! চুল টানছে…. বাবার গায়ে রক্ত… কেউ বাঁচাও না! ওরা মরে যাবে!”

শান্তা বেগম শাড়ির আঁচল দিয়ে মুখ মুছিয়ে দিলো হেমার। মাশুক হেমার হাত টেনে তাকে বসালো। দুইহাত আবদ্ধ করলেন শান্তা বেগম ছেলের কথামত। মাশুক ইনজেকশন পুশ করে। হেমার গালে হাত চাপড়ে বললো,

-“গেট আপ হেমা! তাকাও আমার দিকে… শুনতে পাচ্ছো?”

হেমা হেঁচকি তুলে আবার ঢলে পড়তে চাইলো। মাশুক তাকে আটকে ফেলে। হেমা বললো,

-“বাবা!”

মাশুক হেমার গাল আলতো করে চেপে বললো,

-“এই মেয়ে! তাকাও আমার দিকে, শুনো আমার কথা।”

হেমা ঘনঘন নিঃশ্বাস ফেলে চোখ খুলে তাকালো। মাশুকও দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে। বললো,

-“ বাবা মায়ের জন্য কান্না করে তাদের কষ্ট দিচ্ছো? জানো তোমার জন্য তারা কষ্ট পাচ্ছে! যত কান্না করবে তত কষ্ট পাবে তারা। কি স্বপ্নে দেখেছো? তাদের গায়ে রক্ত?”

হেমা মাথা দোলায়।অর্থ হচ্ছে ‘হ্যাঁ’ । মাশুক বললো,

-“কোনো রক্ত নেই… তারা সৃষ্টিকর্তার কাছে আছেন। একদম ভালো আছেন।”

-“এনে দাও! এনে দাও বাবা মা’কে”

-“নাহ! তারা চলে গিয়ে তোমাকে নতুন বাবা মা দিয়ে গেছেন। তাকাও তোমার নতুন মায়ের দিকে, দেখো নতুন বাবাও আছে এখানে। আমি আছি। আমরা তোমাকে ভালোবাসি না? যত্ন করি না?”

হেমা থম মেরে রইলো। ঠোঁটজোড়া কিঞ্চিৎ ফাঁকা। নিঃশ্বাসের ঘনত্ব কমে এসেছে। বললো,

-“নতুন বাবা মা’কেও ওরা মেরে ফেলবে…”

-“অসম্ভব! কক্ষনো না! তোমার বাবা মা তোমাকে আমাদের কাছে গিফট দিয়ে গেছেন। আমি আর তোমার নতুন বাবা মা কক্ষনো তোমাকে ছেড়ে যাবেনা।”

-“আমি আমার বাবা মাকে…”

-“কি বলেছি শুনেছো? তোমার বাবা মা সৃষ্টিকর্তার কাছে আছেন। অনেক সুখে আছেন। আর তোমার কান্নার ফলে তাদের কষ্ট হচ্ছে। তুমি চাও তাদের কষ্ট দিতে? বলো!”

হেমা দ্রুত গতিতে মাথা দোলায়। হাঁসফাঁস করে বলে উঠে,

-“না একদম না।”

-“তুমি দেখেছো তোমার বাবা মাকে একদল খারাপ লোক মেরে ফেলছে? এগুলো মিথ্যে।”

-“মিথ্যে?”

-“হ্যাঁ মিথ্যে। খারাপ স্বপ্ন দেখেছো তুমি। এমন কিছুই ঘটেনি।”

হেমা অবাক সুরে জানতে চাইলো আবারো,

-“এগুলো সব মিথ্যে ছিলো?”

-“হ্যাঁ। খারাপ স্বপ্ন ছিলো।”

-“তাহলে বাবা মা কেনো গেলো সৃষ্টিকর্তার কাছে?”

মাশুক ভারী নিঃশ্বাস ফেলে।চোখ বুঁজে রাখলো কয়েক সেকেন্ডের জন্য। জবাব দিলো,

-“সৃষ্টিকর্তার তোমার বাবা মা’কে খুব পছন্দ হয়েছে। তাই নিয়ে গেছেন। তাদের কোনো আঘাত দেননি।তারা তোমাকে দেখতে পায়। তুমিও তাদের দেখো তাই না?”

-“হুম!”

-“যা দেখেছো ভুলে যাও। যখনই তোমার বাবা মায়ের রক্ত তোমার চোখের সামনে ভেসে উঠবে তখন ভাববে এগুলো সবকিছু মিথ্যে। তোমাকে বিরক্ত করা হচ্ছে”

হেমা আবারো ছটফট করে উঠে।নিজেকে ছাড়িয়ে নেয়। লাফিয়ে সরে যায় বিছানার অন্যপ্রান্তে।বলে,

-“আমিও যাবো সৃষ্টিকর্তার কাছে। আমি আমার বাবা মায়ের কাছে যাবো। থাকবো না এখানে! থাকবো না”

অবস্থা নিয়ন্ত্রণের বাহিরে চলে গেলো। ইনজেকশন কাজ করতে শুরু করবে ধীরেধীরে। ততক্ষণ নিজের ক্ষতি না করে বসে হেমা। মাশুক সবাইকে ঘর থেকে বেরিয়ে যাওয়ার আদেশ দিলো।দরজা বন্ধ করে বাতি নিভিয়ে হেমার দুহাত একত্রে চেপে জোরপূর্বক তাকে শুইয়ে দিলো। যত নড়চড় করবে তার জন্য ক্ষতিকর।হেমা আয়ত্তে আসছে না। চিৎকার করে গলা বসে যাচ্ছে। বল প্রয়োগ করতে বাধ্য করলো সে। হুট করেই মাশুক হেমার ঘাড়ে মুখ গুঁজে দিতেই নিস্তব্ধ হয়ে গেলো হেমার সম্পুর্ণ কায়া।বরফের ন্যায় জমে গেছে,ছটফট নিমিষেই উধাও।খামচে ধরেছে মাশুকের টিশার্ট। মাশুক মিনিটখানেক বাদে হেমার প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করে বললো,

-“আর কোনো উপায় রাখোনি। নিজে পুড়বে, সাথে আমায়ও ভস্ম করবে”

চলবে…