হিসাব মিলবে কোথায় পর্ব-০১

0
56

সূচনা পর্ব
#হিসাব_মিলবে_কোথায়
কলমে : #ফারহানা_কবীর_মানাল

ছয় বছরের সম্পর্ক ছেড়ে যাওয়ার সময় ফারিসা বলেছিল, ‘সে হারাম রিলেশন রাখতে চায় না। আমি যেন তার সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা না করি।’ তাকে বাঁধা দেওয়ার মতো শব্দ আমার জানা ছিল না। কি-ই বা বলতাম আমি? কাউকে ছেড়ে যাওয়ার জন্য যে এমন শক্ত-পোক্ত অজুহাত বের করা যায় ওকে না দেখলে বুঝতেই পারতাম না। মানিক চোখ মুছে বিছানায় উঠে বসলো। সদ্য জন্মানো আ’ঘা’তগুলোয় একটু বেশিই র’ক্ত’ক্ষ’র’ণ হয়।

ঘড়িতে বেলা বারোটা বাজে। প্রচন্ড খিদে পেয়েছে তার। সকাল থেকে কিছু খাওয়া হয়নি। এ বাড়িতে মানিকের জায়গা কুকুর বেড়ালের থেকেও খানিকটা নিচে। কুকুর বেড়াল দিয়েও যাইহোক কিছু কাজ হয়। তাকে দিয়ে পরিবারের কোন কাজ হয় না। সারাদিন শুয়ে-বসে অন্ন ধ্বং’স করা মানুষকে কেউ-ই পছন্দ করে না। পছন্দ করার কথাও না। কাজেই মানিক কাউকে দোষ দেয় না। যথাসম্ভব চোখ-কান বন্ধ করে পড়ে থাকে। মাঝেমধ্যেই বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে ইচ্ছে করে। সেই ইচ্ছেকে গুরুত্ব দিয়ে মাসের মধ্যে অন্তত চারবার বাড়ি ছাড়ার পরিকল্পনা করে। সেই পরিকল্পনাও বেশিক্ষণ স্থায়ী হয় না। অজানা কারণে সে কোথাও যেতে পারে না। যেন কেউ অদৃশ্য শি’ক’ল দিয়ে তার পা আটকে রেখেছে। মানিক দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল।

ঘরের দরজা ভেজানো। জানালার পর্দায় রোদ পড়ছে। অদ্ভুত রঙের আলোয় ঘর মাখামাখি হয়ে গেছে। সুন্দর লাগছে দেখতে। মানিক সেদিকে তাকালো না। এই আলোটা তার কাছে ভালো লাগছে না। মানিকের মা দরজা খুলতে খুলতে বললেন, “ফাহিম বাড়ি আসছে। তোর ঘরটা একটু ঠিকঠাক করে রাখ।”

মানিক সহজ গলায় বললো, “এখন ঘর ঠিক করতে ইচ্ছে করছে না। পরে করবো।”

“পরে আর কখন করবি? ওরা সন্ধ্যার দিকে চলে আসবে। ওই ঘরে ফ্যান নেই। বউমা গরমে ঘুমাতে পারে না। ইমনেরও গরম সহ্য হয় না। একটু ঘামালেই এলার্জি হয়।”

“তাতে আমি কি করবো? আব্বাকে বলো গিয়ে নতুন ফ্যান কিনে আনতে। আমি কোথাও যেতে পারবো না।”

“তোর বাপের হাতে টাকা-পয়সা নেই। এখন ফ্যান কেনা যাবে না। ওরা যে ক’দিন থাকবে এ ঘরেই থাকবে। তুই বারান্দায় থাকিস। এমনিতেই তোর গরম কম।”

হাওয়া বেগমের এই কথাটা মিথ্যে। মানিকের গরম কম না, বরং খুব বেশি বলা চলে। রাতেরবেলা পাখা না ঘুরলে ঠিকঠাক ঘুম হয় না। সারা গায়ে ঘামাচি ভরে যায়। চুলকাতে চুলকাতে অস্থির অবস্থা। এই চরম সত্যিটা সবাই জানে। কিন্তু কারো কিছু যায় আসে না। ফাহিম বাড়িতে আসলে মানিকের বারান্দায় ঘুমাতে হয়। বিগত তেরো বছর ধরে এই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হচ্ছে। বাড়ির বড় ছেলে বছরের মধ্যে এই একটা মাস বাড়িতে থাকে। এ সময় তার যত্ন-আত্তির কোন ত্রুটি হয় না। হবার কথাও না। বেশিরভাগ মায়েদের বড় ছেলের প্রতি বেশি নজর থাকে। মজার ব্যাপার হচ্ছে এতো বছরেও বারান্দায় ফ্যান লাগালো হয়নি। আগের মাটির ঘরেও না, এখনকার পাকা দালানেও না। এক সময় এই ব্যাপারটা নিয়ে অনেক ঝামেলা হতো। মানিক গলা ছেড়ে কাঁদত। এখন আর কিছু বলে না। বলতে ইচ্ছে করে না। গা-সওয়া হয়ে গেছে।

“চুপ করে আছিস কেন? যা।”

“কোথায় যাব?”

“ঘর ঠিকঠাক কর। শুধু ঘর ঠিক করলে হবে না। বাথরুমটাও একটু ঠিকঠাক করতে হবে। পুকুর থেকে মাছ ধরবি। কতদিন পরে ওরা আসবে! ফাহিম পুকুরের বড় মাছ খেতে চেয়েছে।”

মানিক কিছু বললো মা। শুকনো হাসি হাসলো। টাকা রোজগার করতে না পারলে মা-বাবাও যে সন্তানদের মধ্যে পার্থক্য করতে পারে তা এদের না দেখতে বোঝা যেত না। সকাল থেকে তার পেটে দানা-পানিও পড়েনি। হওয়া বেগমের সেদিকে কোন খেয়ালই নেই, হয়তো মনেও করতে পারছে না। বয়সের সাথে সাথে তার স্মৃতি শক্তি কমে যাচ্ছে। কখন কি হয় মনে করতে পারেন না। অথচ এক মাস আগে তার বড় ছেলে মাছ খেতে চেয়েছে এটা খুব মনে আছে।

মানিকের বড় ভাই বাড়ি থাকে না। প্রতি বছর ঈদের সময় এক মাসের জন্য বেড়াতে আসে। সেই সময়ে হাওয়া বেগমের দুই রূপ দেখা যায়। প্রতিদিন সকালে বড় ছেলের জন্য ডিম সিদ্ধ করেন, রাতে শোবার আগে দুধ গরম করে দেন। শুধু বড় ছেলেকেই দেন, মানিককে কখনও এসব দেওয়া হয় না। এমন নয় যে উনি মানিকের সৎ মা। তবুও কেন এমন করেন ঠিক বোঝা যায় না।

মানিকের মন তো এমনিতেই খারাপ ছিল। এখন মেজাজটাও খারাপ হয়ে গেছে। মুখের মধ্যে থু থু জমতে শুরু করেছে। প্রচন্ড বিরক্ত লাগলে তার মুখের মধ্যে থু থু জমে। চোখ জ্বলছে। চোখের পানি আসার আগে এমন করেই চোখে জ্বালা করে। হঠাৎ করে মানিকের নিজেকে খুব অসহায় মনে হতে লাগলো। এই অনুভূতিটাও তার জন্য নতুন নয়। মাঝেমধ্যেই নিজেকে খুব অসহায় লাগে। ফারিসার সাথে কথা বললে হয়তো একটু ঠিকঠাক লাগতো। কিন্তু তাকে কি আর পাওয়া যাবে!

সেদিন ছিল শুক্রবার। জুমার নামাজ শেষে ওষুধ কিনে বাড়ি ফিরছিল সে। তখনই ফারিসার কল আসলো। সহজ গলায় বললো, “আপনার সাথে আমার কিছু কথা আছে। কথাগুলো বলা খুব জরুরি। বিসিএস পরীক্ষায় সময়মত পৌঁছানোর চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।”

“বলো।”

“আমি আপনার সাথে কোন প্রকার সম্পর্ক রাখতে চাই না।”

“কেন চাও না? আমি বেকার বলে?”

“তেমন কিছু নয়। আপনার সাথে কখনও টাকা সম্পর্ক ছিল না। কোনদিন হবেও না।”

“তাহলে সম্পর্ক রাখতে চাইছ না কেন? আজকাল তো কথা বলা কমিয়ে দিয়েছি। সময় দেওয়ার জন্য তোমাকে বেশি জোর করি না।”

“সত্যি বলতে আমি কোন ধরনের হা’রা’ম রিলেশন রাখতে চাই না। আপনি মুসলিম হলে এটা অন্তত বিশ্বাস করা উচিত যে আমাদের সম্পর্কটা হা’রা’ম। কাজেই এটা ছাড়তে হবে।”

“ছয় বছর আগে এ কথা মনে হয়নি কেন?”

“তখন এতকিছু বুঝতাম না। তাছাড়া মানুষ যে কোন সময়ে হেদায়েত পেতে পারে। এটা নিয়ে উপহাস করার কিছু নেই।”

“উপহাস কোথায় করলাম?”

“আমাদের যেসব কল রেকর্ড, ছবি, ভিডিও আছে সেগুলো ডিলিট করে দিয়েন।”

“ফারিসা!”

“বলেন?”

“ছেলে বন্ধুদের সাথে ছবি তুলে সে-সব স্যোশাল মিডিয়ায় আপলোড করা কি খুব জায়েজ কাজ?”

ফারিসা কিছু না বলে কল কেটে দিলো। গত বছর এক ধরেই ওর মাঝে পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে। মানিকের সাথে কথা বলতে চায় না। নিজে থেকে কল দেয় না। মানিক কল দিলেও ব্যস্ত থাকে। এসএমএস দিলে রিপ্লে দেয় না। কাজ করি, শরীর খারাপ, হেন তেন নানান অযুহাত। সোজা ভাষায় যাকে অবহেলা বলে। অবশ্য ফারিসার এসব অবহেলা সহ্য করেই মানিক ওর সাথে থেকে গেছে। ছেড়ে যাওয়ার যে কোন উপায়ই রাখেনি। নিজের সবটুকু দিয়ে ওকে ভালোবেসেছে। এই শহরের সব পুরুষ ঠকবাজ হয় না। সবাই পুরাতনকে ভুলে গিয়ে নতুন প্রেমে পড়তে পারে না। নিকোটিনের ধোঁয়ায় কষ্ট কমানোর চেষ্টা করে শুধু!

মানিকের জীবন এমন ছিল না। বছর দুয়েক আগেও বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ভালো বেতনের চাকরি করতো। হাওয়া বেগম কোন কালেই মানিককে তার বড় ছেলের থেকে বেশি পছন্দ করেননি। তবে চাকরি থাকা অবস্থায় ওকেও বেশ গুরুত্ব দিত। সকালে উঠে গরম ভাত রান্না করে দেওয়া থেকে শুরু করে রাতের বেলা মাথায় তেল পর্যন্ত। ফারিসার সাথেও বেশ ভালো সম্পর্ক ছিল। কাজের ফাঁকে দিনের বেশিরভাগ সময় একে-অন্যের সাথে গল্প করতো। হঠাৎ করে চাকরি চলে যাওয়ার পর থেকেই সবার মাঝে পরিবর্তন দেখা দিয়েছে। কেউই ওকে ঠিক সহ্য করতে পারছে না। কিছু দেওয়ার ক্ষমতা না থাকলে পৃথিবীর কেউই কাউকে গুরুত্ব দেয় না। মানিক ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস গোপন করে চোখ বন্ধ করলো। ঘরের মধ্যে থাকতে পারছে না। মনে হচ্ছে ঘরের দেয়ালগুলো ওকে চেপে ধরবে।

নজু কাকার দোকানে লোকজন নেই। দুপুরের সময় এখানে কোন লোক থাকে না। রোদের তাপে টিনের চাল গরম হয়ে ওঠে, বসা যায় না।

“কাকা একটা সিগারেট দেন।”

নজু কাকা পোকায় ধরা দাঁত বের করে হাসলেন। সরু গলায় বললেন, “সিগারেট খাওয়া শুরু করে কবে থেকে?”

“এইতো আজকে থেকেই। তোমার দোকান থেকে প্রথম সিগারেট কিনলাম। এরপর যত সিগারেট কিনবো- তোমার দোকান থেকেই কিনবো।”

নজু কাকা কিছু বললেন না। বিরস মুখে তাকিয়ে রইলেন।তার মধ্যে খুশির কোন লক্ষন দেখা গেল না। মানিক সিগারেট ধরালো। প্রায় বছর চারেক পর আজ আবার সিগারেট টানছে। একসময় খুব খাওয়া হতো। একদিনে একশটা পর্যন্ত সিগারেট টানার রেকর্ড আছে তার। ফারিসাকে ভালো লাগার পর থেকে এসব ছেড়ে দিয়েছে। ফারিসাই বলেছিল- সিগারেট খাওয়া ছেলেদের তার একদম পছন্দ হয় না। মুখ থেকে বিশ্রী গন্ধ আসে। ছেলেদের কাছে প্রিয় মানুষের কথার দাম অনেক। মানিকের কাছেও ছিল। সে সিগারেট খাওয়া বন্ধ করে দিলো। প্রথম দিকে একটু একটু কষ্ট হতো। মাথার ভেতরের সূক্ষ্ম যন্ত্রণা অনুভব হতো। পরে আস্তে আস্তে ঠিক হয়ে গেছে।
সিগারেট বিস্বাদ লাগছে। খালি পেটে সিগারেট টানার জন্য পেট মোচড়াচ্ছে। বমি আসছে। মানিক গলা কেশে একদলা থু থু ফেললো। নিচু গলায় বললো, “এক কাপ চা বানাও কাকা। চিনি দেবে না। শুধু লিকার। থাকলে একটু লেবু চিপে দিও।

নজু কাকা হাত বাড়িয়ে চায়ের কাপ আনলেন। গরম পানি ঢালতে ঢালতে বললেন, “খবর শুনছো?”

“কি খবর?”

“ওই পাড়ার কুতুবের মেয়ে বিয়ে ঠিক হইছে। ছেলে বিশাল বড়লোক। ঢাকা শহরে চারটে বাড়ি, ছেলের নিজেরই দু’টো গাড়ি আছে। ছেলে পক্ষ কাল খোঁজ খবর নিতে এসেছিল। আমার দোকানে বসে অনেককিছু জিজ্ঞেস করলো।”

মানিক চমকে উঠলো। সেই চমক নজু কাকার নজর এড়ালো না। তিনি তীক্ষ্ণ চোখে মানিকে দিকে চেয়ে রইলেন। কুতুবের মেয়ে মানেই ফারিসা। এতক্ষনে রিলেশন রাখতে না চাওয়ার কারণ পরিষ্কার হলো। এমন অবস্থায় মানিকের রেগে যাওয়া উচিত। কিন্তু সে রাগছে না। শান্ত ভঙ্গিতে চায়ের কাপে চুমুক দিচ্ছে। পেট মোচড়াচ্ছে। পেটের নাড়িভুড়ি পর্যন্ত বাইরে বেরিয়ে আসতে চাইছে। অথচ মানিক খুব শান্ত। বরফের মতো শীতল!

রাতের বেলা মবিন সাহেব ঘরে ঢুকতে ঢুকতে বললেন, “বুঝলে ফাহিমের মা, খবর খারাপ আছে। কুতুবের মেয়েটাকে কেউ খু’ন করে ফেলেছে। সন্ধ্যার দিকে লা’শ পাওয়া গেছে। সারা শরীরের আঁচড়ের দাগ। চোখ উপড়ে ফেলেছে।”

হাওয়া বেগম আৎকে উঠলেন। তরল গলায় বললেন, “মানিক! ক’দিন কিন্তু বাইরে যাবি না। কখন কার ওপর পুলিশের নজর পড়ে বলা যায় না।”

মবিন সাহেব ভ্রু কুঁচকে ফেললেন। তেঁতো গলায় বললেন, “সারাদিন তোমার ছেলে কোথায় ছিল?”

“বাড়িতেই ছিল। কোথাও যায়নি। দুপুরের দিকে একটু বেরিয়েছিল ঠিকই। কিন্তু দশ মিনিটের মাথায় ফেরত এসেছে।”

“ঠিক বলছো?”

“হ্যাঁ। আমি নিজের চোখে দেখেছি।”

মবিন সাহেব দীর্ঘশ্বাস ফেলে ঘরের মধ্যে চলে গেলেন। হাওয়া বেগম বললেন, “এই কি তোর সেই ফারিসা?”

মানিক জবাব দিলো না। শান্ত ভঙ্গিতে বই বন্ধ করলো। তার ঠোঁটের কোণে রসহ্যময় হাসি ফুটে উঠেছে।

চলবে।