হিসাব মিলবে কোথায় পর্ব-০২

0
58

#হিসাব_মিলবে_কোথায়
কলমে : #ফারহানা_কবীর_মানাল

|| দুই ||

পরপর চারটে সিগারেট শেষ করে মানিক ঘুমতে গেল। তার ধারণা ছিল অনেক রাত পর্যন্ত ঘুম আসবে না। বিছানায় শুয়ে এপাশ-ওপাশ করতে হবে। তবে সে ধারণা ভুল। বিছানায় শোয়া মাত্র চোখে ঘুম জড়িয়ে এলো। শেষবার মনে হলো ফারিসাকে জড়িয়ে ধরে ঘুমুতে পারলে মন্দ হতো না। ছয় বছরের মাঝে একবারের জন্যও ওকে জড়িয়ে ধরা হয়নি। ভবিষ্যতেও আর হবে না। অথচ কোন এক সময় এরা দু’জন দু’জনকে জড়িয়ে ধরার তীব্র ইচ্ছে নিয়ে ঘুরে বেড়াত। কেউ কারো কাছে প্রকাশ করত না।

ঘুম ভাঙলো অনেক বেলায়। চারদিকে রোদ ঝলমল করছে। পর্দার ওপর রোদ পড়েছে। ঘড়িতে দশটা তিন বাজে। মানিক চোখ কচলে বিছানায় উঠে বসলো। ফারিসার খু’নের ব্যাপারে কোন খবর পাওয়া যায়নি। মানিকের ধারণা ছিল পুলিশ তাকে ধ’র’তে আসবে। হয়তো কাল আসবে। তদন্ত শুরু হলেই আসবে। ওদিকে খোঁজ খবর জানা প্রয়োজন।

হাওয়া বেগম চুলায় ডাল বাগার দিচ্ছিলেন। আম দিয়ে মুগ ডাল রান্না ফাহিমের পছন্দ। ছেলেটা বাড়ি আসছে, কালকেই আসার কথা ছিল। গাড়ির সমস্যার জন্য আসতে পারেনি। আজ আসবে। তার জন্য একটু আয়োজন না করলে ভালো দেখায় না। মানিক বললো, “ভাইয়াকে আনতে যেতে হবে নাকি?”

“হ্যাঁ, যেতে হবে। ইমন তোকে না দেখলে কান্নাকাটি শুরু করে দেবে।”

“আচ্ছা ঠিক আছে। যাচ্ছি। এক্ষুনি যেতে হবে নাকি পরে গেলেও হবে?”

“ওদের আসার দেরি আছে। কল দিয়ে বলেছে বারোটা নাগাদ আসবে৷ এখন যাওয়ার দরকার নেই। পরে গেলে হবে।”

“আব্বা কোথায়?”

“নজুর দোকানে গেছে। সিয়াম এসে বলে গেল নজু ডাকছে। তাই শুনতে গেছে।”

মানিক ভ্রু কুঁচকে ফেললো। মবিন সাহেব কখনও নজু কাকার দোকানে গিয়ে বসেন না। মেয়াদ উত্তীর্ণ খাবার রাখার কারণে একবার ঝামেলা হয়েছিল। সেই থেকে দু’জনের মধ্যে ভালো সম্পর্ক নেই। তাহলে আজ হঠাৎ? কোন বিশেষ কারণ নেই তো? মানিকের মনে হলো সে একটু বেশিই চিন্তা করছে। এসব চিন্তা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলা উচিত। উল্টোপাল্টা চিন্তা করার কোন মানেই হয় না।

মানিক হাঁটছে। মাথা নিচু করে হাঁটছে। হাঁটতে তার ভালোই লাগছে। নজু কাকার দোকান বন্ধ। সকাল এগারোটায় দোকান বন্ধ করে রেখেছে কেন বুঝতে পারছে না। আব্বা কোথায় গেল তাহলে? মানিকের মুখে থু থু জমতে শুরু করলো। দোকান খোলা থাকলে একটা সিগারেট কেনা যেত। আবার না কিনলেও ভালো হয়। এখন থেকে খুব সাবধানে খরচ করতে হবে। জমানো টাকা খুব দ্রুত শেষ হয়ে যাবে। পরিকল্পনা সফল করতে গেলে অনেক টাকার প্রয়োজন।

এলাকার পরিবেশ ঠান্ডা। পাশের এলাকায় খু’ন হওয়ার পর পরিবেশ এমন ঠান্ডা থাকার কথা না। মফস্বলে সহজে এমন মুখরোচক ঘটনা ঘটতে দেখা যায় না। কাজেই সব খবর খুব দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। মানিক চিন্তিতবোধ করলো। ফারিসার খু’নের কথা এখনও কারো মুখে শোনেনি। শুধুমাত্র তার বাবার কাছে শুনেছে। তবে কি মবিন সাহেব ভুল শুনলেন? নাকি তার পরিচিত অন্য কুতুব আছে। মানিক সামনের দিকে তাকালো। খাটো মতো একটা ছেলে হেলেদুলে হাঁটছে। গুনগুন করে গান গাইছে। ছেলেটা মানিকের সামনে এসে দাঁড়িয়ে গেল। উৎফুল্ল গলায় বললো, “কি মানিক ভাই? খবর ভালো?”

“এক রকম। তোর কি খবর?”

“আমার আর খবর! তোমরা টুর্নামেন্ট আয়োজন করছ না। টুর্নামেন্ট না হলে আমার মাথা ঠিক থাকে না। বাগমারার সাথে খেলা পাতালাম। হারার পর টাকা না দিয়ে চলে গেছে। এমন করলে কি হয় নাকি?”

“তোর না পরীক্ষা চলছে? পরীক্ষার মধ্যে আবার কিসের খেলাধূলা?”

“সারাক্ষণ বই পড়া কোন কাজের কথা না।”

“ওদিকের খবর জানিস? শুনলাম কুতুব কাকার মেয়ে নাকি মা’রা গেছে।”

ফিরোজ চোখ বড় করে মানিকের দিকে তাকাল। চোখে-মুখে বিস্ময় নিয়ে সরু গলায় বললো, “আমি তো এখনও শুনিনি। কখন ম’রে’ছে?”

মানিক কথার জবাব দিল না। মাথা নিচু করে হাঁটতে শুরু করলো। ফিরোজ কঠিন মুখে মানিকের দিকে তাকিয়ে আছে। লম্বা ছেলেটা এলোমেলো পায়ে সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। পিছন ফিরে তাকাচ্ছে না। এই হচ্ছে গ্রামের সবচেয়ে ভদ্র ছেলের নমুনা! কথার জবাব না দিয়ে চলে যাওয়াটা নিশ্চয়ই ভদ্রতা নয়? ফিরোজ মনে মনে দু’টো কুৎসিত শব্দ উচ্চারণ করলো। তাকে এখন কুতুবউদ্দিনের বাড়ি যেতে হবে। বাচ্চা ছেলে হলেও এলাকার সব খবর তার কাছে থাকে। লোকজন তার নাম দিয়েছে বিবিসি নিউজ। এমন ছেলে ফারিসার মৃ’ত্যুর খবর জানে না। অদ্ভুত ব্যাপার!

দুপুর হয়ে আসছে। রোদের তাপ গরম হয়ে উঠেছে। মানিক চিন্তিত মুখে চেয়ারে বসে পড়লো। বসার ভঙ্গিটা কঠিন। তার মনে একই সাথে বেশ কয়েকটি ধারা কাজ করছে। ফারিসার জন্য কষ্ট হচ্ছে। খুব কষ্ট হচ্ছে। সে তো তাকে সত্যিই ভালোবেসেছিল। এখনও হয়তো বাসে। বেইমানদের সহজে ভুলে যাওয়া যায় না। তাদের সাথে পার করা সময়গুলো চোখের সামনে ভাসতে থাকে। মধুর স্মৃতিগুলো গলায় কাঁটা হয়ে বিঁ’ধে যায়। মানিকের চোখ জ্বলছে৷ চোখে পানি আসার আগে এমন করে চোখ জ্বালা করে। লোকজনের মধ্যে থেকে সরে যাওয়া দরকার। সাতাশ বছরের ছেলেকে কাঁদতে দেখলে যে কেউ-ই হেসে ফেলবে। সমাজ মনে করে পুরুষদের কাঁদতে নেই। তাদের হৃদয় হবে পাথরের মতো শক্ত। শত আ’ঘা’তেও অশ্রু গড়াবে না।

“বাগানের মধ্যে দাঁড়িয়ে আছেন কেন? রাসেল ভাইপার বের হয়েছে জানেন না?”

কন্ঠটা পরিচিতি। রিনরিনে মিষ্টি গলা। মানিক চমকে পিছন দিকে ফিরল। সে নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছে না।

“কথা বলছেন না? ভূত দেখেছেন নাকি?”

“ফারিসা তুমি?”

“আমায় দেখে ভূত দেখার মতো চমকে ওঠার কারণ কি? আমাকে কি ভূতের মতো দেখতে?”

“না, ঠিক তা নয়। তুমি কি মা’রা গেছিলে?”

ফারিসা ভ্রু কুঁচকে ফেললো। কথায় কথায় ভ্রু কুঁচকে ফেলা তার পুরনো স্বভাবগুলোর একটি। মানিক বললো, “তুমি কি সত্যি? নাকি প্রতিশোধ নিতে ফিরে এসেছ?”

“কিসব বাজে কথা বলছেন? মাথা ঠিক আছে আপনার? আমি আবার ম’র’লাম কখন?”

“কাল রাতেই তো বাবা বললো যে কুতুবের মেয়েকে কেউ খু’ন করেছে।”

“কোন কুতুবের মেয়ের কথা বলেছে জানি না। তবে আমি এখনও জীবিত আছি। আপনার সামনেই দাঁড়িয়ে আছি।”

মানিক লম্বা শ্বাস নিলো। কর্কশ গলায় বললো, “শুনলাম তোমার বিয়ে ঠিক হয়েছে। ছেলে বিশাল বড়লোক। ঢাকায় বাড়ি আছে৷ সত্যি নাকি?”

ফারিসা বিরক্ত চোখে মানিকের দিকে তাকালো। তেঁতো গলায় বললো, “আপনি ভালো দেখে একজন ডাক্তার দেখান। সাইকিয়াট্রিস্ট দেখাবেন। ডাক্তারের ব্যাপারে আগে থেকে খোঁজ খবর করে দেখবেন উনি মাথার স্ক্রু টাইট দিতে পারে কি-না। পারলে ভালো। না পারলে নতুন ডাক্তার খুঁজবেন। আমার মনে হচ্ছে আপনার মাথার নাট বল্টু ঢিলে হয়ে গেছে। না না ভুল বললাম। খুলে পড়ে গেছে।”

“কথা পেঁচাচ্ছ কেন?”

“সোজা কথা বলতে আমার ভালো লাগে না। সোজা কথা মিনারেল ওয়াটারের মতো। স্বাদহীন গন্ধহীন, আবার মাঝে মাঝে চিরতার মতো তেঁতো। আমার পছন্দ পেঁচানো কথা। ঝাঁঝালো কিন্তু মিষ্টি। কোমল পানীয় ধরনের।”

“তাহলে দু’টো কথাই মিথ্যে?”

ফারিসা হাই তুললো। সরু গলায় বললো, “হ্যাঁ মিথ্যে। শুধু মিথ্যে নয়। ডাহা মিথ্যে। আমার বিয়ে ঠিক হয়নি। আর মা’রাও যায়নি।”

“ভালো।”

“ভালো হলে ভালো।”

“আমার সাথে সম্পর্ক রাখতে চাইছো না এটাও কি মিথ্যে?”

“পঞ্চাশ শতাংশ মিথ্যে! আমি আপনার সাথে অবৈধ সম্পর্ক রাখতে চাই না। তবে আপনাকে বিয়ে করতে চাই। এক কাজ করুন। আপনাকে মাস ছয়েকের সময় দিচ্ছি। কোন রকম জোড়াতালি দেওয়া হলেও একটা চাকরি জোগাড় করুন। আমার বাপের কাছে বিয়ে প্রস্তাব দিন।”

“ছয় মাসের মধ্যে চাকরি না পেলে কি হবে?”

“আগে তো ছয় মাস যাক। দেখা গেল আমি এর মধ্যে ম’রে গেছি। বা কেউ আমায় সত্যি সত্যি খু’ন করে ফেলেছে।”

মানিক রাগী চোখে ফারিসার দিকে তাকালো। ফারিসা হাই তুললে তুললে বললো, “যাচ্ছি। সাবধানে থাকবেন।”

মানিক কিছু বললো না। তার মাথায় কাজ করছে না। সে কি সত্যিই ফারিসার সাথে কথা বললো নাকি অন্যকেউ? ওকে একবার ছুঁয়ে দেখলে সত্যিটা বোঝা যেত। মানিক দেখলো ফারিসা অনেক দূরে চলে গেছে। লম্বা লম্বা পা ফেলে সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।

মানিক চায়ের কাপ হাতে বেঞ্চির ওপর বসলো। পুরো ঘটনা এলোমেলো হয়ে আছে। বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে ভালো বেতনে চাকরি করার পরও যে তাকে ফ্যান ছাড়া ঘুমতে হয় – এমনই অবান্তর। মানিকের চাকরির বয়স বেশিদিন ছিল না। বছর খানেকের মতো। চাকরি পাওয়ার পর পরই মোটা অংকের লোন তুললো। পাকা বাড়ি বানাবে। ইট, বালি, কিনে আনা হলো। মিস্ত্রি খবর দেওয়া হলো। কাজ শুরু হলো। প্রতি মাসে বেতনের আশি ভাগ লোনের পেছনে চলে যেত। অল্প কিছু হাতে থাকলেও সংসার খরচে সব শেষ হয়ে যেত। তবুও সেবার ফ্যান কেনা হয়েছিল। লাগানো হয়নি। মানিকের আপা নিয়ে গেছে। ওদের ঘরে নাকি কোন ফ্যান নেই। বাচ্চা দু’টো ঘুমতে পারে না। মানিক অমত করেনি। এই বোন তাকে মা’য়ের চেয়ে বেশি ভালোবাসে। এর মুখের ওপর না বলা যায় না।

মানিক চায়ের কাপে শেষ চুমুক দিয়ে পকেট থেকে মোবাইল বের করলো। পাছে শোয়েব কিছু করে বসলে ঝামেলা হয়ে যাবে।

চলবে