হিসাব মিলবে কোথায় পর্ব-০৪ এবং শেষ পর্ব

0
59

#হিসাব_মিলবে_কোথায়
কলমে : #ফারহানা_কবীর_মানাল
শেষ পার্ট

রাতের আকাশ ফাঁকা। আজ তারা ফোটেনি, চাঁদও উঠেনি। ঘন কালো আঁধার ছেয়ে গেছে ধরনীতে। গাঢ় অন্ধকারের নারীমূর্তির ছায়া ভাসছে। ছাঁদের এক কোণে চেয়ারের সাথে বাঁধা পড়ে আছে। দূরের ঘরে জ্বলতে থাকা লাইটের আলোয় মুখ চেনা না গেলেও ছায়া বোঝা যায়। মানিক বরফ শীতল গলায় বলল, “আমি তোমার কি ক্ষতি করেছিলাম? এসব করে তুমি কি লাভ পেলে ভাবী?”

নববী কিছু বলল না। ভাবলেশহীন ভাবে আকাশের দিকে তাকিয়ে রইল। মানিক আবারও একই কথা বলল। নববী জবাব দিল না। নিচের দিকে তাকিয়ে রইল।

“চুপ করে আছো কেন?”

“বলার ভাষা খুঁজে পাচ্ছি না।”

“কেন ভাবী? এসব করার সময় তো একবারের জন্যও ভাবনি। তাহলে এখন কেন বলার ভাষা খুঁজে পাচ্ছো না?”

নববী দু’হাতে মুখ ঢাকতে চেষ্টা করল। পারল না। মানিক খুব শক্ত করে হাত বেঁধে রেখেছে। নববী হতাশ গলায় বলল, “আমার ভাই ফারিসাকে পছন্দ করে। ও কথায় এসব করেছি!”

“অদ্ভুত কথা বলো না ভাবী। তোমার ভাই ফারিসাকে পছন্দ করবে কেন? সত্যিটা বলো। আমার কিছু ভালো লাগছে না।”

“সত্যিই বলছি। মিথ্যে বলে নিজের সংসার হারাতে চাই না।”

মানিক হাসলো। ঘর কাঁপিয়ে অট্টহাসি দিয়ে বলল, “সিনেমার নাটক ভালো লাগছে না। দয়া করে সবকিছু খুলে বলো। সত্যিটা বলো।”

নববী গম্ভীর গলায় বলল, “আমার হাতের বাঁধন খুলে দাও।”

” আগে আমায় সবকিছু বলো। তারপর ভেবে দেখব তোমার হাতের বাঁধন খুলব নাকি অন্যকিছু করবো।”

নববীর চোখ থেকে একফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ল। মানিকের এমন ভয়ংকর রূপ সে আগে কখনও দেখেনি।

“ভাবী এসব নেকামো ভালো লাগছে না। সবাই বাড়ি ফিরে আসবে। কাজেই নিজের সংসার বাঁচাতে চাইলে সত্যি কথা বলো। না হলে আমি সবাইকে সবকিছু বলে দেব।”

“এসব আমার পরিকল্পনায় হয়নি। তিথির পরিকল্পনায় হয়েছে।”

“এলোমেলো কথা বলো না। একটু আগে বললে তোমার ভাই এসব করতে বলেছে আর এখন তিথির কথা বলছ? আসল সত্যি কি?”

“আমার ভাই ফারিসাকে পছন্দ করে। ওকে ভালোবাসে। জে’ল থেকে ছাড়া পাওয়ার পর আমি ওর সাথে দেখা করতে এসেছিলাম। তখন আমাকে ফারিসার ছবি দেখিয়ে বলল- আপা আমি এই মেয়েকে পছন্দ করি। ভালোবাসি। তুমি বিয়ের ব্যবস্থা করে দাও।
একবার দেখেই ফারিসাকে চিনে ফেলেছিলাম আমি। ভাইকে একটা ধমক দিয়ে বললাম, ” এই মেয়ের রিলেশন আছে জানিস না? তাছাড়া ফারিসা বয়সে তোর চেয়ে অনেক বড়।”
আমায় অবাক করে দিয়ে ভাই বলল, “হ্যাঁ জানি। তোমার দেবরের সাথে সম্পর্ক। তুমি ওদের সম্পর্ক ভেঙে দিবে। কিভাবে দিবে জানি না। আর যদি না দাও তাহলে আমাকে ভাই বলে পরিচয় দেবে না। জানবে তোমার ভাই ম’রে গেছে।”
প্রথমে আমি রাজি হইনি। কারণ ফারিসাও তোমাকে ভালোবাসে। আমি মাঝখান থেকে কি করবো। সত্যি বলতে তখন আমার বিবেক বেঁচে ছিল।”

মানিক ভ্রু কুঁচকে বলল, “এখন কি তোমার বিবেক ম’রে গেছে?”

“হ্যাঁ। ম’রে গেছে। তারপর থেকে আমার ভাই ক্রমাগত আমাকে বিরক্ত করে গেছে। ভয় দেখিয়েছে। আমি আর কি করতাম! নিজের ভাইয়ের চেয়ে তো আর তুমি আপন না।”

“আমি কখনও তোমার আপন হতে পারিনি। সে এখন থাক। বাদ দাও। নজু কাকাকে কি বলেছ?”

“ভাই আমাকে বলেছিল যে তোমার কাছে ফারিসার বিয়ের কথা বলতে। তাহলেই তোমাদের মধ্যে ভুল বোঝাবুঝি সৃষ্টি হবে।”

“তারপর?”

“কিন্তু কাকে কি বলতাম? হঠাৎ একদিন খেয়াল এলো আমার কাছে নজু কাকার মোবাইল নম্বর আছে। উনাকে দিয়ে কিছু হলেও হতে পারে। তারপর এদিন সাহস করে কল দিলাম। কাজটা করতে বললাম। আমাকে অবাক করে দিয়ে উনি রাজি হয়ে গেলেন। কথা ছিল এখানে এসে উনাকে টাকা দেবো।”

মানিক হাসল। সরল ধরনের হাসি। শান্ত গলায় বলল, “ফারিসার খু’নের ব্যাপারটা? ওইটা বাবাকে বললে কেন?”

“এটা আমি করিনি। তিথি করেছে। ওই আব্বুকে কল দিয়ে এসব বলেছে। ব’ল’দ একটা!”

“তোমাকে বলে করেনি?”

“না করার পর বলেছে।”

“তোমার কথা আমার বিশ্বাস হচ্ছে না। কেমন যেন খাপছাড়া খাপছাড়া লাগছে।”

“বিশ্বাস না করলেও এটাই সত্যি।”

“ভালো।”

মানিক নববীর হাতের বাঁধন খুলে দিলো। শান্ত গলায় বলল, “ইমনের কথা ভেবে তোমাকে ছেড়ে দিলাম। ভালো থাকবে।”

নববী কিছু বলল না। শান্ত ভঙ্গিতে ছাঁদ থেকে নেমে চলে গেল। পাশের বাড়ি থেকে আলো আসছে না। ছাঁদ অন্ধকারে ডুবে গেছে। মানিক পকেটে থাকা শেষ সিগারেটটা ধরালো। আজই শেষ! এরপর থেকে আর সিগারেট খাওয়া যাবে না। ফারিসা জানলে খুব রাগ করবে। মেয়েটা একটু বেশিই রাগী।

বাড়ির পরিবেশ থমথমে হয়ে আছে। কেউ কারো সাথে কথা বলছে না। মানিক বারান্দার ঘরের দরজায় শেকল তুলে দিল। তার খুব অদ্ভুত অনুভূতি হচ্ছে। অনুভূতিটা খারাপও নয় আবার ভালোও নয়। দু’য়ের মাঝামাঝি কোন কিছু। মানিক গোটা ঘটনা মনে করার চেষ্টা করতে লাগলো। পারল না! আজকাল হঠাৎ হঠাৎ কোন কিছুই মনে করতে পারে না। সবকিছু এলোমেলো হয়ে যায়।

হাওয়া বেগম বিছানা ঝাড়ছিলেন। শোবার আগে বিছানা না ঝাড়লে তার ঘুম আসে না। মবিন সাহেব চেয়ারে বসে বইয়ের পাতা উল্টাতে উল্টাতে বললেন, “কুতুব সাহেব একটা প্রস্তাব দিয়েছে।”

“কি প্রস্তাব?”

“উনার মেয়ের সাথে মানিকের বিয়ে দিতে চান। আমাকে বললেন ভেবে দেখতে।”

“তুমি কি চাইছ?”

“মানিক তেমন কাজ কাম করে না। বেকার ঘুরে বেড়ায়। এখন বিয়ে দিয়ে কি হবে? আগে কাজবাজ হোক। তারপর না হয় ভেবে দেখা যাবে।”

“ফারিসা মেয়েটা খারাপ না। দেখতে শুনতে মোটামুটি ভালোই। তুমি রাজি হয়ে গেলেই পারতে।”

“কি যে বলো না তুমি! হুট করে বেকার ছেলের কাছে মেয়ে বিয়ে দেওয়ার কোন না কোন কারণ তো নিশ্চয়ই থাকবে। মেয়ের নিশ্চয়ই দোষ আছে।”

হাওয়া বেগম কিছু বললেন না। ছাঁদের দিকে তাকালেন। ফ্যান ঘুরছে না। গরমে শরীর ঘেমে যাচ্ছে। হঠাৎই তার খুব কষ্ট হতে লাগলো। কষ্টের কারণটা তিনি জানেন কিন্তু স্বীকার করতে চান না। কোন মানুষই নিজের দোষ স্বীকার করতে চায় না। লুকিয়ে রাখতে পছন্দ করে। বিশেষ করে নিজের কাছে!

হাওয়া বেগম আলমারি খুলে কয়েকটা শাড়ি বের করলেন। শাড়ির ভাঁজে কিছু খুঁজতে চাইছেন, কিন্তু তার হাত চলছে না। নিজের সন্তানের মাঝে এতো বৈষম্য কেন? কেন তিনি সব সন্তানের মা হতে পারলেন না? কিছু কষ্ট বুকে পুষে রাখতে হয়! মুখে বলা যায় না। চোখে পানি আসে না।

আজ শুক্রবার। অবাক হওয়ার মত কয়েকটা ঘটনা ঘটে গিয়েছে। হাওয়া বেগম নিজে গিয়ে ফ্যান কিনে এনেছেন। মিস্ত্রি দিয়ে সেই ফ্যান লাগানো হচ্ছে। শুধু তাই নয়। ফারিসার সঙ্গে মানিকের বিয়ের কথা পাকাপাকি করে এসেছেন। আজ সন্ধ্যায় বিয়ে হবে। ঘরোয়া আয়োজন। কাজি সাহেব বিয়ে পড়াবেন। মানিক নিজের কৌতুহল আঁটকে রাখতে পারছে না। তার মায়ের সাথে কথা বলতে ইচ্ছে করছে। তবে তাকে পাওয়া যাচ্ছে না। রান্নাঘর থেকে মশলার গন্ধ ভেসে আসছে। ভালো-মন্দ কয়েক পদের রান্না হবে বোধহয়!

মানিকের মনে হতে লাগল সে স্বপ্ন দেখছে। সুন্দর একটা স্বপ্ন। ঘুম ভাঙলেও যে স্বপ্নের রেশ রয়ে যায়। শেষ মুহুর্তে দেখা গেল মানিক স্বপ্ন দেখছে না। তার চারপাশে যা কিছু হচ্ছে সবটাই সত্যি। তখন মানিক বেশ লজ্জা পেয়ে গেল। ঠোঁটের কোণে হাসির রেখা ফুটে উঠলো। জীবন কি তাকে এত সুখ দিতে পারে?

বিয়ের কাজ শেষ হতে হতে রাত দশটা বেজে গেল। বাসর ঘর সাজানো হয়েছে। বিশেষ কিছু নয়। ঘরের দুই কোণায় দু’টো মোমবাতি জ্বলছে। বিছানায় নতুন চাদর বিছানো হয়েছে। ব্যাস এতটুকুই! হালকা গোলাপি ফুলের নকশা করা চাদর। সেই চাদরের ওপরে ফারিসা বসে আছে। তার পরনে কটকটে হলুদ রঙের শাড়ি। হওয়া বেগম নিজে পছন্দ করে এমন শাড়ি কিনেছেন। ফারিসার পছন্দ হয়নি। তবে না-ও বলতে পারেনি। মানিক বিছানার ওপর বসে পড়ল। সরু গলায় বলল, “আমি কি স্বপ্ন দেখছি?”

ফারিসা তরল গলায় বলল, “না, তুমি স্বপ্ন দেখছ না। যা হচ্ছে সব বাস্তবে।”

“তুমি বাবাকে রাজি করলে কিভাবে? কোন বাপই তো তার মেয়েকে বেকার ছেলের হাতে তুলে দেয় না।”

“এটা আমার সিক্রেট। বলা যাবে না। ধরে নাও গল্পের গরু গাছে ওঠে!”

মানিক হো হো করে হেসে উঠলো। এখন তার চমৎকার লাগছে। ফারিসা তার গলায় স্বর অনেকখানি নিচু করে বলল, “তুমি হয়তো জানো না আমি তোমায় ভালোবাসি।”

“জানি।”

“আচ্ছা ভালো কথা। জানলে তো ভালো।”

“তুমি কি রেগে আছো?”

“না আমি রেগে নেই। ভাবছি।”

“কি ভাবছ?”

“এই যে আমাদের গল্পটা এলোমেলো খাপছাড়া হয়ে গেল। এই গল্পটা কি আর একটু সুন্দর হতে পারত না? আর একটু সাজানো যেত না।”

“সব জিনিস সাজানো গোছানো ভালো লাগে না। কিছু জিনিস এলোমেলো থাকাই ভালো। গোছানো গল্পের প্রশংসা পাওয়া যায় ঠিকই কিন্তু এলোমেলো খাপছাড়া লেখার সমালোচনা হয়। মাঝেমধ্যে সমালোচনাই ভালো। ভালো জিনিস আমরা খুব একটা মনে রাখি না। খারাপটা অনেকদিন মনে থাকে। মাঝেমধ্যে গালি দেওয়ার জন্য হলেও মনে রাখতে হয়।”

“তুমি কি লেখক নাকি?”

“নাহ! আমি তোমার স্বামী।”

ফারিসা হাসলো। সুন্দর লাগল দেখতে! মানিকও হাসছে। তাকেও বেশ সুন্দর লাগছে। পূর্ণতার হাসি বোধহয় সুন্দরই হয়।

সমাপ্ত