হীরকচূর্ণ ভালোবাসা পর্ব-১৪+১৫

0
362

#হীরকচূর্ণ_ভালোবাসা
#পর্ব১৪ +১৫
#রাউফুন

‘আমি আজকে আমাদের বাড়ি যাবো তুলিকা! একটা রাত আপনি আর মিষ্টি একটু কষ্ট করে থাকতে পারবেন না?’

অফিসে বেরিয়ে যাওয়ার আগে বললো মাইজিন। অফিস থেকে সরাসরি বাড়ি যাবে মাইজিন তাই তুলিকাকে সাবধানের বুলি আউড়ালো। মাইজিন বাড়ি যাবে শুনেই তুলিকার দু চোখ ভিজে উঠে নিজের অজান্তেই। বাড়ি যাবে মাইজিন তা যেনো সে মানতে নারাজ। অন্তরটা কেমন ধক করে উঠলো তার। মাইজিন যে আজ বাড়ি যাবে এটা তো সে রাতে বললো না।

‘স্যরি আপনি কি কষ্ট পেলেন? আমার সামনে তো আপনাকে কাঁদতে বারন করেছি! তাও যদি এভাবে কাঁদেন আমার কেমন লাগে বলুন তো? দেখুন আপনি ঘুমিয়ে গেছিলেন তাই রাতে জানাতে পারিনি। বাবা ফিরছেন দেশের বাইরে থেকে। তাই আমাকে গাজীপুর যেতেই হবে। বাবার সঙ্গে দেখা করতে হবে। আমি আমাদের বিয়ের ব্যাপারে আগে বাবাকেই বলবো। তাছাড়া এক মাস হলো বাসায় ও যায়নি আমি!’

‘ আমি তো কাঁদছি না। চোখে পাপড়ি বা ময়লা ঢুকেছে মনে হয়। আর এভাবে এক্সপ্লেইন করার দরকার নেই। আপনি গিয়ে ঘুরে আসুন আমি আর মিষ্টি আজকের রাত টা ম্যানেজ করে নিবো!’

মাইজিন মানি ব্যাগ থেকে কত গুলো পাঁচশো আর হাজার টাকার নোট বের করে তুলিকার হাতে দিলো। বললো, ‘যখন তখন লাগতে পারে টাকা। তাই এগুলো রেখে দিন!’

‘আমি টাকা দিয়ে কি করবো? এতো গুলো টাকার তো প্রয়োজন নেই। আপনি রেখে দিন আপনার কাছে।’

‘নাহ রাখুন তো আপনি।’ মাইজিন হাত ঘড়িতে চোখ বুলিয়ে বললো, ‘সময় নেই তুলিকা। আসছি হ্যাঁ?’

তুলিকা মাথা নাড়ালে মাইজিন বেরিয়ে গেলো। তুলিকার দু চোখ বেয়ে জল গড়িয়ে পরতে লাগলো। বুকের ভেতর টা এমন ব্যথায় টইটম্বুর কেন হচ্ছে? কেন মনে হচ্ছে মাইজিন আসবে না আর? সে নিজের এমন অবান্তর ভাবনা নিজের মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে পরক্ষণেই!

হঠাৎই মাইজিন ফিরে এসে তুলিকাকে ফ্লাইং কিস ছুঁড়ে দিলো। তুলিকা একই সঙ্গে খুশি আর হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইলো। মনের গুপ্ত কুঠুরিতে কোথাও না কোথাও যেনো এই ছোট্ট জিনিসটাকে মিস করছিলো তুলিকা। রোজ ই তো মাইজিন এমন করে। তবে আজ ভুলে গেছিলো কিভাবে? সে মাইজিনের পেছন পেছন সিড়ি বেয়ে ছুটে নামলো! কেচি গেট খুলে মাইজিন বের হলো। তুলিকাও হুড়মুড় করে ছুটে গিয়ে ডাকলো মাইজিনকে! মাইজিন ভেজা চোখে তাকালো তুলিকার দিকে। তুলিকার ভেতরটা দুমড়ে মুচড়ে যাচ্ছে মাইজিনের ভেজা চোখ দুটো দেখে। হাঁপাতে হাঁপাতে তুলিকা বললো, ‘আমি আপনার জন্য অপেক্ষা করবো মাইজিন। কাল সন্ধ্যায় আমি আপনাকে এখানে দেখতে চাই। আপনার জন্য খুব ভালো কিছু অপেক্ষা করছে মাইজিন!’

মাইজিন মুচকি হাসলো চোখের পানি লুকিয়ে। সে সামনে ফিরে হাঁটা ধরলো। এতোটা কষ্ট কেন হচ্ছে তার? সে তো কাল ই ফিরবে তবে যেতে এতো কষ্ট কেন হচ্ছে? বুকে এই অদ্ভুত চিনচিন ব্যথার কারণ কি? বক্ষস্থল টা শুন্য শুন্য কেন লাগছে? সে যদি পেছনে ফিরে দেখতো তবে সে দেখতে পেতো দু-জোড়া অশ্রুসিক্ত চোখ এখনো তাকে দেখছে৷ কিন্তু সে সাহস পেলো না মাইজিন। এবার পিছনে ফিরে তাকালে যে বড্ড ইচ্ছে করবে মেয়েটাকে জড়িয়ে ধরতে। বুকের সঙ্গে চেপে ধরে কপালে গাঢ় করে ভালোবাসার স্পর্শ এঁকে দিতে। গাঢ় চুম্বনে ভরিয়ে দিতে ইচ্ছে করবে খুব করে। কিন্তু তা তো সম্ভব না। অটো পেতেই সে উঠে পরলো। বাড়িতে থাকলে গাড়িতে যাতায়াত করে সে। কিন্তু এখানে তো গাড়ি সঙ্গে আনেনি তাই অটোতেই যাতায়াত করতে হচ্ছে।

মাইজিন অটোতে উঠতেই তুলিকা দৌঁড়ে চলে আসে। সিড়ি বেয়ে উঠার সময় কয়েকবার হোচট খেয়ে পরে গেলো সে। কিন্তু সে ব্যথার তোয়াক্কা না করে রুমে এসে মাইজিন যেখানে শুয়ে থাকে সেই খান টাই শুয়ে পরলো। বালিশে মুখ গুজে অশ্রু বিসর্জন দিতে থাকে। একটি বার মাইজিন ফিরে তাকালো না আর? সে তো আশা করে শেষ অব্দি দাঁড়িয়ে ছিলো যেনো মাইজিন একটি বার ফিরে তাকাই। কিন্তু মানুষটা তাকালো না। তার কষ্টটা দ্বিগুণ বারানোর জন্য যে এটাই যথেষ্ট ছিলো!


মিষ্টি স্কুলে গেছে। ব্যাগে সে পাঁচশো টাকার একটা নোট রেখেছিলো। এই মুহুর্তে সে তা খুঁজে পাচ্ছে না। বুঝতে পারলো টাকা টা কেউ চু’রি করেছে। শেষ পর্যন্ত তার ই টাকা চু’রি হতে হলো? সে একটু একটু আন্দাজ করতে পারছে কে নিয়েছে টাকাটা। কারণ শেষ বার তার ব্যাগের কাছে সে একজনকেই দেখেছিলো। সে ক্লাস ক্যাপ্টেন এর কাছে গেলো।কারণ এভাবে সে কাউকেই জাজ করতে পারে না। ক্লাস ক্যাপ্টেন টাকার সমস্যা না মিটিয়ে দিতে পারলে প্রিন্সিপাল এর কাছে নালিশ করবে। সে ক্লাস ক্যাপ্টেন রাফির কাছে গিয়ে বলল,

‘এই রাফি আমার ব্যাগ থেইকা পাঁচশো টাকা হারায়ে গ্যাছে তুই কি খুঁইজা দিবি একটু? দেখ আমার সন্দেহ টাকাখানা ক্লাসের কেউ-ই নিসে। তুই যদি একটু খুঁইজা বাইর কইরা দিতে পারস তাইলে আমি পরীক্ষার ফী দিতে পারুম।’

রাফি অত্যন্ত বাজে ভাবে মুখ বাকালো। সে বিরক্ত হয়ে বলল, ‘দেখ মিষ্টি তোর মতো ফকিন্নি মেয়ের কাছে এতো টাকা আসবে কোথা থেকে? মিথ্যা বলার জায়গা পাস না। তোর ব্যাগ থেকে কে টাকা নিবে?’

‘বিশ্বেস কর রাফি টিফিন টাইমের আগেও আমার ব্যাগে টাকা আছিলো। তহন পরীক্ষার ফী দেওনের জন্য আমি গেছিলাম কিন্তু বড় স্যার আছিলো না। তাই ফিরে এসে ব্যাগে টাকা রাকছি। এহন দেহি নাই!’

‘হুশ যাহ ফকিন্নি। তুই আগে শুদ্ধ ভাষায় কথা বলতে শিখে আয় যাহ! ফট এই খান থেকে!’

‘রাফিইইই!’

‘চেঁচাস না মিষ্টি। তোর যদি টাকা হারিয়েও থাকে আমি খুঁজে দিতাম না।’

‘তাহলে আমি প্রিন্সিপাল স্যারকে জানাবো। ক্লাস ক্যাপ্টেন তুই আগে তোকে জানানোর প্রয়োজন ছিলো তাই জানালাম।’

রাফি অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে মিষ্টির দিকে।

‘আর এই মিষ্টি শুদ্ধ ভাষায় কথা বলতে জানে। কিন্তু আমার ওভাবেই কথা বলতে ভালো লাগে তাই বলি। আমি চাইছিলাম না ব্যাপারটা ক্লাসের বাইরে যাক। কিন্তু এখন আমাকে প্রিন্সিপাল স্যারকে জানাতেই হবে।’

‘যাহ! গেলে কি হবে? আমি ভয় পাচ্ছি মনে হয়!’

‘স্যারকে যখন বলবো তুই আমাকে সাহায্য করিসনি তাহলে কি হবে ভেবেছিস রাফি? তোকে কিন্তু ক্যাপ্টেন থেকে বাতিল ও করে দিতে পারে।’

রাফি ভাবলো এখন যদি মিষ্টি গিয়ে প্রিন্সিপালকে নালিশ করে তবে তার জন্য ভালো হবে না। এখন সবার কাছে তার দাম আছে। সবাই তাকে সমীহ করে। ভয় পাই! যদি ক্যাপ্টেন থেকে বঞ্চিত হয় তবে তো তার সেই নিজস্ব পাওয়ার টা থাকবে না। তাই সে মিষ্টিকে যেতে বারন করলো। মিষ্টি বাকা হেসে দাঁড়িয়ে পরলো। রাফি এক পলক দেখলো মিষ্টিকে। পরে সবার ব্যাগ সার্চ করলো কিন্তু কারোর ব্যাগেই টাকাটা নেই। তাই সে রাগান্বিত হয়ে গেলো। বললো,

‘এই কই ক্লাসের কারোর ব্যাগেই তো পেলাম না। তুই তো বললি তোর কাউকে সন্দেহ হয়। এখন বল দেখি কাকে সন্দেহ করছিস? নাকি মিথ্যা গল্প ফাঁদছিস। তোর টাকায় হারাইনি।’

‘আমার টাকা হারিয়েছে রাফি। তোর মানি ব্যাগ টা দে তো?’

কিঞ্চিৎ অবাক হয় রাফি। ক্রোধের সহিত বলে, ‘তুই কি আমাকে সন্দেহ করছিস? তুই জানিস আমি কে? আমার বাপির এক্সাক্টলি কত গুলো টাকা আছে? আমি তোর ওই সামান্য পাঁচশো টাকা নেবো? চু’রির বদনাম দিস না মিষ্টি। তবে কিন্তু ভালো হবে না।’

‘আরে রিল্যাক্স দে তো আগে। এখনো সবাই টিফিন খাচ্ছে। ওঁরা আসার আগেই কাজ টা শেষ করতে হবে তো।’

রাফি কটমট করতে করতে নিজের মানিব্যাগ বের করে মিষ্টির হাতে দিলো। মিষ্টি রাফির মানি ব্যাগ থেকে কড়কড়ে একটা পাঁচশো টাকার নোট নিয়ে রাফির মানি ব্যাগ ফিরিয়ে দিলো। রাফি তখন নির্বাক। অবাক হয়ে দাঁতে দাঁত চেপে বললো,

‘তোর কি মাথাটা খারাপ হয়ে গেছে মিষ্টি? তুই আমার টাকা কোন সাহসে নিচ্ছিস?’

‘কারন আছে তাই নিয়েছি। শোন রাফি আমার টাকায় এম লেখা আছে। মানে আমার নামের ফার্স্ট লেটার। আমি এই টাকাটা নিয়ে ফী দিয়ে আসছি আর তুই আমার টাকা খুঁজে পেয়ে সেটা নিয়ে নিস!’

‘টাকা কে না কে নিয়েছে সেজন্য তুই আমার টাকা নিবি?’

‘নিজের জিনিস হারালে মানুষ যতটা গুরুত্ব দিয়ে খুৃঁজে বের করে অন্যের জিনিস খোঁজায় ঠিক ততটাই বেপরোয়া হয়। এখন তোর টাকা আমি নিয়েছি তাই তোর খারাপ লাগছে। আমি জানি এখন তুই ঠিক টাকাটা খুঁজে বের করবি। কারণ টাকাটা এখন তোর!’

রাফি হতবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো মিষ্টির যাওয়ার পানে। কি চালাক মেয়েরে বাবা। কোন ট্রিক খাটালো দেখেছো? রাফি হুলুস্থুল করে টা খোঁজায় মন দিলো।


বাড়ি ফিরে মিষ্টি আজকের ঘটনা সবটাই বললো। সবটা শুনে তুলিকা ক্ষিপ্ত হয়ে বললো, ‘এটা তুই কি করেছিস মিষ্টি? অন্য একজনের টাকা নিয়ে ফী দিয়েছিস তুই? যদি ছেলেটা টাকা না পাই খুঁজে তখন?’

‘আমি জানি বুবুজান টাকা খুঁজে পাবে রাফি। ঠিক পাবে!’

‘তবুও তুই এটা ঠিক করিস নি। কাল গিয়ে আবার যার টাকা তাকে দিয়ে আসবি। আর যেনো এমন ভুল না হয় মিষ্টি!’

‘আচ্ছা বুবুজান। কিন্তু আমার টাকা যে গায়েব হলো
তার বেলা?’

‘যে জিনিস হারিয়ে যায় সেই জিনিস নিয়ে আফসোস রাখতে নেই মনে। হারিয়ে যাওয়া জিনিস নিয়ে কখনোই আফসোস করবি না!’

‘মনে থাকবে বুবুজান।’

#চলবে

#হীরকচূর্ণ_ভালোবাসা
#পর্ব১৫
#রাউফুন

সাত সাতটা দিন কে’টে গেছে মাইজিনের দেখা মেলেনি। না কোনো টেক্সট না কোনো কল এসেছে মাইজিনের নাম্বার থেকে। বরং একাধারে তুলিকাই একের পর এক কল করে গেছে তাকে। কিন্তু প্রত্যেকবার ফোন দিয়ে হতাশ হয়েছে। ফোন বন্ধ ছিলো সারাক্ষণ। চিন্তায় চিন্তায় নাওয়া-খাওয়া সব ছেড়ে দিয়েছে প্রায় তুলিকা। এই ক’দিনে তার চোখ মুখের করুন অবস্থা হয়েছে। কিন্তু তবুও অবুঝ মন পথ চেয়ে বসে থাকে তার অপেক্ষায়! তার চোখ যেনো এক অদৃশ্য কুয়ো। অনর্গল প্রিয় মানুষটার কথা ভেবে চোখের পানি পরেই যাচ্ছে। মাথায় নানান চিন্তা ভাবনা ভর করছে। মাইজিন কি তবে আর ফিরবে না? প্রিয়জন যদি পাশে থাকে মনে হয় সব সুখ একত্রে পাওয়া হয়ে গেছে কিন্তু এখন যেনো সবকিছুই বিষাদ। সে শুনেছে, ভালোবাসা তখনি সত্যি হয় যখন ভালোবাসার মানুষটি মনের মত হয়। সেকি মাইজিনের মনের মতো নয়? মাইজিন কি তাকে ভুলে গেলো? না হলে একদিনের কথা বলে সাতদিন থেকে মানুষটা লাপাত্তা কিভাবে হয়ে গেলো? নাকি কোনো বিপদে পরেছে মাইজিন? মাইজিনের যদি কিছু হয়ে যায় তখন কি হবে তার? সে কিভাবে থাকবে মানুষটাকে ছাড়া?

‘এই আপু তুমি এখনো মন খারাপ করে আছো?’

এখন সন্ধ্যা ছয়টা বিশ বাজে। সূর্য ডুবে গেছে কিছুক্ষণ আগেই। কিন্তু তারপরও আকাশের মৃদু মন্দ আবছা আলোই চারিপাশ ভরে আছে। তুলিকা, মিষ্টি, নুশা একটা পার্কে এসেছে বেড়াতে। নুশা হলো নতুন ভাড়াটিয়া। মিষ্টির বয়সিই মেয়েটা। নুশার মা কোথাও একটা গেছেন তুলিকা আর মিষ্টির কাছে রেখে। সেকি ভাব হয়েছে মিষ্টির সঙ্গে নুশার। নুশার কথায় সম্বিত ফিরে পেলো তুলিকা।

‘নাহ কিছু না। তোমার কথা মতো এখানে তী আসলাম। তোমার মা যদি জেনে যান কি হবে ভেবে দেখেছো? চলো এখন উঠি!’

‘এই বুবুজান আরেকটু থাকি না?’

এরপর তিন জন মিলে বেঞ্চে বসে গল্প করতে থাকে। মিষ্টি জানে তার বুবুজানের মন ঠিক কতটা খারাপ। যদি পার্কে থেকে একটুখানি মন টা ভালো হয় তাতে ক্ষতি কি? থাকুক না আর কিছুক্ষন। তার মাইজিন ভাইয়ার যে কি হয়েছে কে জানে? মিষ্টি দেখলো পার্কের গেটের বাইরে একটা লোক মেশিনে হাওয়াই মিঠাই বানিয়ে সেগুলো বিক্রি করছেন। মিষ্টির খুব খেতে ইচ্ছে করছে।

‘এই বুবুজান ওই দেখো হাওয়াই মিঠাই। চলো খাবো!’

‘হাওয়াই মিঠাই! এটা তো আমারও খুব ভালো লাগে মিষ্টি। এই তুলিকা আপু চলো না।’ বললো নুশা।

‘ঠিক আছে তোমরা এখানে বসো আমি কিনে আনছি। এখানেই থাকবে কিন্তু!’

‘আচ্ছা আপু।’

তুলিকা গেটের কাছে গিয়ে হাওয়াই মিঠাই দোকানিকে বললো, ‘কালার ছাড়া দুটো হাওয়াই মিঠাই বানান চাচা!’

‘আইচ্ছা আম্মাজান!’

গোলাপি রঙের হাওয়াই মিঠাই তার কাছে ভালো লাগে না। ওটা খেলে মুখের অবস্থাও বাজে হয়। তাই সে সাদাটা বানাতে বলে! সে আশেপাশে তাকালো। পার্কের মানুষজন এখন কমে আসছে আস্তে আস্তে। সে মাইজিনের দেওয়া শাড়ীটা নিজের ইচ্ছেতেই পরেছে। মাইজিন যাওয়ার পর প্রায় সাত দিন থেকেই এই শাড়ীটা বিকেল করে পরে ফেলে। যদি মাইজিন চলে আসে সন্ধ্যায়? সে তো মাইজিনকে বলেছিলো সন্ধ্যায় সে তাকে সারপ্রাইজ দেবে। এই শাড়ীটা নিজের ইচ্ছেতেই তো পরেছে সে। কিন্তু যার জন্য পরেছে সেই মানুষটার ই তো খোঁজ নেই। মাইজিন যাওয়ার পর সে খুবই ভালোভাবে উপলব্ধি করেছে সে ঠিক কতটা ভালোবাসে মাইজিনকে। মাইজিন নামক আপাদমস্তক মানুষটার প্রতিই তার অন্য রকম এক মাদকতা কাজ করে। মাইজিন নামটাই কেমন নেশা আছে তাই না? শুনলেই ভেতর থেকে কেমন করে উঠে।

আশেপাশে যখন সে দেখতে ব্যস্ত তখন হঠাৎ দূরে একটা পরিচিত চেহেরা দেখতে পেলো। কিয়ৎক্ষন বিমুঢ়, স্তব্ধ, নিশ্চল, একই সাথে নিষ্পলক ভাবে তাকিয়ে রইলো তুলিকা। অস্ফুটে মুখ থেকে বেরিয়ে এলো, ‘মাইজিন!’ মাইজিন জেব্রা ক্রসিং দিয়ে হেঁটে আসছে। তুলিকা নিশ্চল পা জোড়া জোর করে এগিয়ে নিয়ে গেলো তার দিকে। চোখ মুছে মুচকি হেসে পেছন থেকে মাইজিনের হাত টেনে ধরলো৷ মাইজিন হাঁটা থামিয়ে দিলো৷ সামনের দিকে ফিরে ভ্রু উঁচু করে তাকালো তুলিকার দিকে। সে ভাবতেই পারছে না মাইজিনকে এখানে দেখতে পারবে সে৷ মাইজিনের দৃষ্টিতে একটা রক্তবর্ণ ভাব দেখা গেলো। তুলিকার হাসি হাসি মুখখানা চুপসে গেলো। মাইজিনের চোখ মুখে ছিলো অন্য কিছু। যাতে করে সেই দৃষ্টিতে ভয়ে আঁতকে উঠে ভেতর থেকে। মাইজিন তুলিকার হাত এক ঝটকায় ছাড়িয়ে দিলো। এরপর আবার হাঁটা শুরু করলো। ছলছল চোখে তাকিয়ে রইলো তুলিকা। মাইজিনের হাবভাব তার কাছে একদম অন্য রকম লাগলো। মাইজিন এমন ভাব করলো যেনো তুলিকাকে সে এর আগে দেখেইনি। চেনেই না।

তুলিকা দৌঁড়ে গিয়ে আবার তার পথ রোধ করে দাঁড়িয়ে পরলো। মাইজিন তাকে এভয়েড করে অন্য সাইড দিয়ে চলে গেলো। তুলিকা চিৎকার করে ডাকলো তাকে কিন্তু মাইজিন কোনো রকম সাড়া না দিয়ে আপন মনে হাঁটা শুরু করেছে। অনর্গল চোখ থেকে পানি বেরিয়ে আসছে তুলিকার। মানুষটার হলো টা কি? সে আবারও মাইজিনের সামনে গিয়ে দাঁড়ালো।

‘আমার সামনে থেকে সরো!’ শান্ত কিন্তু কড়াভাবে বললো মাইজিন।

‘নাহ সরবো না। আমি আপনাকে ডাকছি দেখছেন না? আপনি কেন এমন করছেন? একদিনের কথা বলে এক সপ্তাহ কে’টে গেছে মাইজিন। আপনি ফিরেন নি কেন? আর যখন দেখা হলো এরকম অদ্ভুত বিহেভিয়ারের মানে কি?’

‘আমার সামনে থেকে সরো। নইলে ভালো হবে না।’

‘কেন কি এমন করবেন আপনি?’ তুলিকা দুই হাত আড়া-আড়ি করে ভাজ করলো। তার ধারণা হলো কোনো একটা কারণে মাইজিন হইতো রেগে আছে তার উপির।

হঠাৎ মাইজিন ওর কালো হুডি দিয়ে ঢাকা মাথায় হায় ঢুকিয়ে মাথা চুলকালো। এমন কি সে অস্বাভাবিক আচরণ করা শুরু করলো। দাঁত কিড়মিড় করছে সে। দেখে এমন মনে হচ্ছে যেনো সে নিজের রাগকে নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা করছে। তুলিকা পুরো শকড হয়ে যাচ্ছে মাইজিনকে এইভাবে দেখে। আঁচানক মাইজিন তুলিকার বুকের ঠিক উপরে ডান হাত দিয়ে জোরেশোরে একটা ধাক্কা দিলো।

‘সরো বলছি। কখন থেকে বলছি সামনে থেকে সরতে? সরো না কেন? রাস্তা ঘাটে পুরুষ মানুষ দেখলে মাথা ঠিক থাকে না হ্যাঁ?’

কথা শেষ করেই মাইজিন দ্রুত হেঁটে তার চোখের আড়াল হয়ে গেলো৷ দুইজনের হাবভাব নজর কাড়া হওয়াই যাতায়াতকৃত সকলে আড়চোখে তাদেরকে দেখছিলো। মাইজিন প্রস্থান করাই আবার সবকিছু স্বাভাবিক হলো। আরেকটু জোরে ধাক্কা দিলেই সে মেইন রোডের মাঝ খানে চলে আসতো। এই কি সেই মাইজিন যে তাকে একটাও কটু কথা বলতো না। চোখ রাঙানো তো দূর শক্ত গলায় একটা কথা পর্যন্ত বলতো না। মানুষটা তাহলে আজ কেন এরুপ আচরণ করলো? আজ সে কাকে দেখলো? এই মানুষটাকে যে তার একদম অন্য রকম লাগছে। সম্পুর্ন ভিন্ন একজন মানুষকে দেখছে সে আজ। তুলিকা চোখমুখ শক্ত করে শাড়ির আঁচল খামচে ধরলো। নাক, চোখ লাল হয়ে গেছে তার। এই বুঝি কান্নারা ছিটকে বেরিয়ে আসবে। আর সেই কান্নাকে আটকে রাখার চেষ্টা করলেও আটকাতে পারবে না।
একমুহূর্তের জন্য থমকে গেছে সে। অভিমান হয় রাজ্যসম। নয়নের তারা চিকচিক করে উঠে। এতটাই নিষ্ঠুর বুঝি মানুষটা? কি অবলীলায় বলে দিলো কথাগুলো। তাদের বিয়ের শুরু থেকে যে মাইজিনকে তুলিকা দেখেছে সে আজকের মাইজিনকে দাবিয়ে দিয়েছে। তার মানে কি সত্যিই শুরু থেকে সবটা মিথ্যে ছিল? সব ছলনা ছিল? রাগে-ক্ষোভে দাঁতে দাঁত চেপে তাকায় নিজের পরনের শাড়ির দিকে। ইচ্ছে করছে এক টানে এটাকে খুলে ফেলে দিতে। আঁচল চেপে হাত মোচড়াতে থাকে সে।

‘আম্মাজান আপনের হাওয়াই মিঠাই নিবেন না?’

তুলিকার ধ্যান ভাঙে হাওয়াই মিঠাইওয়ালার কথায়। সে তার হাত থেকে হাওয়াই মিঠাই নিয়ে আবার হাঁটতে লাগলো।

‘আম্মাজান ট্যাকা দিলেন না যে?’

‘ওহ হ্যাঁ দিচ্ছি চাচা!’

তুলিকা ব্যাগ থেকে টাকা বের করে দেখলো পাঁচশো টাকার নোট। মাইজিন তো শুধু তাকে বড় নোট দিয়েছিলো সেদিন।

‘আমার কাছে যে পাঁচশো টাকার নোট ছাড়া ভাংতি টাকা নেই চাচা!’

‘এতো ট্যাকার খুচরা আমি কই পামু আম্মাজান?’

‘স্যরি চাচা। আমি অন্যদিন এসে যদি আপনার টাকাটা দিই তাহলে হবে? আমি বরং কাল এসে দিয়ে যাবো? এখন সন্ধ্যা হয়ে গেছে বাসায় যেতে হবে তো!’

‘আইচ্ছা আম্মাজান দিয়েন আপনে। আমি বিকেলে এইহানেই বসি।’

‘আচ্ছা।’

‘আম্মাজান আপনে কানতাছেন ক্যান?’

তুলিকা ঝটপট চোখ মুছে হাসার চেষ্টা করে বললো, ‘না চাচা ক-কিছু না।’

বলেই চলে এলো সে। তার মনে চলছে তুমুল ঝড়। শরীরের বল যেনো ছেড়ে দিচ্ছে। কোনো রকম নিজেকে সামলে নিয়ে আলুথালু পায়ে সে পার্কের দিকে এগিয়ে গেলো। পার্কের বেঞ্চে মিষ্টি আর নুশা ভীষণ অধৈর্য্য হয়ে বসে আছে।

সে আবার ভাবনায় বিভোর হলো। এটা কি ছিলো? মানুষটা তাকে এভাবে ধাক্কা দিলো? তার কি হয়েছে? আর আচমকা এরকম ব্যবহার ই বা কেন করলো? সে মানতেই পারছে না কিছুতেই না। বক্ষস্থলটা যেনো খঞ্জন দিয়ে কেউ খোচাচ্ছে খুব বিশ্রি ভাবে। দগদগে ঘা হয়ে গেছে বক্ষস্থল টাই।

‘ওই বুবুজান এতো দেরি করলা কেন?’

‘এমনি। এই নাও হাওয়াই মিঠাই!’

নুশা আর মিষ্টি হাওয়াই মিঠাই নিলো। ‘আরে আপু তোমার জন্য নাও নি?’ বলল নুশা

‘নাহ আমি খাই না।

‘সেকি! বুবুজান তোমার তো খুব পছন্দ হাওয়াই মিঠাই! তাইলে নিলা না কেন?’

‘আজ থেকে আর কোনো পছন্দ রইলো না তোর বুবুজানের। বাসায় চল সাত টা বেজে গেছে।’

‘কি হয়েছে বুবুজান? এভাবে কেন কথা বলছো? তোমার চোখ-মুখের একি অবস্থা করেছো?’ বিচলিত হয়ে শুধালো মিষ্টি।

‘আজকে থেকে সব প্রিয় জিনিস অপ্রিয় হয়ে গেলো। প্রিয় জিনিস থাকতে নেই রে। প্রিয় জিনিস থাকলেই যে সেটা ধুলাই লুটিয়ে যায়। বড্ড অবহেলায় হারিয়ে যায়৷ বড্ড অবহেলায়!’

#চলবে