#হীরকচূর্ণ_ভালোবাসা
#পর্ব১৬
#রাউফুন
মধুর এক ধ্বনিতে গুঞ্জিত হলো চারদিক। এশারের আজান পরলো চারপাশের মসজিদে। রাস্তায় গাড়ির হর্ণ আর হেডলাইটের আলোয় চকচক করছিলো ঠিক তারার মতো। চাঁদের আলোয় আলোকিত আকাশ আঁধারের গহীনে ঢাকা পরলো। ঘুটঘুটে অন্ধকারে কেমন যেনো গা ছমছমে ব্যাপার হলো। অদুরে আকাশে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। অস্থির তুলিকা নিজেকে শান্ত করতে বারান্দায় চলে গেলো। ঠান্ডা বাতাসে তার শরীরে মৃদু কম্পন সৃষ্টি করলো। মনে হচ্ছে ঝড় হবে খুব জোরে। বারান্দায় গিয়েও তার মাইজিনের কথায় মনে পরলো৷ রোজ সময় পেলে দুজনে বারান্দায় বসে ভালোবাসার আলাপন করতো। সেই স্মৃতি মন সাপটে জাগ্রত হলো তার। সে শান্তি না পেয়ে বারান্দা থেকে রুমে এসে অবসন্ন পায়ে এগিয়ে গেল বিছানার দিকে। তুলিকার মাইজিনের প্রতি আবেগ-অনুভূতি এতটা প্রখর যে মানুষটাকে ভুলে থাকা অসম্ভব। মাইজিন বিহীন যেন তার জীবন নির্জীব,নিষ্প্রাণ। ভালো লাগার ছিটে ফোঁটা নেই তাতে। আছে শুধু বিষণ্ণতা৷ যা কখনো নিরাময় হওয়ার নয়। তার প্রতি মাইজিন নামক মানবের যত্নশীলতা-দায়িত্বশীলতা, ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কথার পৃষ্ঠে লুকিয়ে থাকা ভালোবাসার রেশ, সন্ধ্যায় ফিরে এসে জোর করে রান্না করা। হাজার বারন না মেনে তার রান্নার কাজে হাতে হাতে সাহায্য করা। তার করা প্রতিটি কাজ মন মস্তিষ্ক ওতপ্রতভাবে জড়িয়ে আছে তুলিকার।
‘বুবুজান রান্না করবা না?’
‘তোর মাইজিন ভাইয়া অফিস থেকে আসুক এক সাথে করবো! জানিসই তো আমার সঙ্গে কাজ না করলে তার চলেই না। শোনে সে আমার কথা? একটু ধৈর্য্য তো!’
‘কি বলছো বুবুজান? মাইজিন ভাইয়া তো আসেই না আর!’
মিষ্টির এই ছোট্ট বাক্যে ভাবনার সুতোই ছেঁদ পরে তুলিকার। সত্যিইতো মানুষ টাই আসে না! তার কথা ভাবতে ভাবতে মুখ থেকে তার কথায় বেরিয়ে এসেছে। একটা সপ্তাহে কোনো রকম আশায় আশায় চললেও আজ যে মানতে বড্ড কষ্ট হচ্ছে। মাইজিন আসবে এখানে এই আশাটাই যে আর সে করতে পারছে না। আবারও আজকের সেই তিক্ত অভিজ্ঞতার কথা মনে হলো। মাইজিনের তাকে ওইভাবে ধাক্কা দেওয়ার কথাটা ভেবে হতাশাজনক নিঃশ্বাস ফেললো সে।
‘আমি খাবো না। তুই দুপুরের বেচে যাওয়া খাবার খেয়ে পড়তে বস!’
‘কিন্তু বুবুজান তুমি?’
‘আমার কথা ভাবিস না। আমাকে একটু একা ছেড়ে দে প্লিজ!’
মিষ্টি না চাইতেও রুম থেকে চলে যায়। তুলিকা নিজের শরীরকে গুটিয়ে নিয়ে শুয়ে চোখ বন্ধ করলো। ঘুমানোর চেষ্টা করলেও ব্যর্থ হচ্ছে। যতবার তুলিকা চোখ বন্ধ করছে ততবারই মাইজিনের চেহেরাটা ভেসে উঠছে। মাইজিনের সেই অদ্ভুত এক্সপ্রেশান। তারপর আজ যা হলো এসব কিছু তার মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে! অদ্ভুত একটা তিক্ত অভিজ্ঞতার সহিত কোনো রকমে রাত টা কাটালো তুলিকা। রোজ ফজরের নামাজ পড়তো মাইজিন তাই না? তুলিকাই নামাজ পড়ে না ঠিক করে। আজ যেহেতু ঘুম আসেইনি তাই সে উঠে ফজরের নামাজ পড়লো। মাইজিন তো তাকে নামাজের জন্য ডাকতো সে আলসেমি করে উঠতো না। নামাজ শেষ করে সে বারান্দায় গেলো৷ ভোরের চঞ্চল ঠান্ডা হাওয়ায় শরীর মন তৃপ্ত হলো। রাতে ঝুম বৃষ্টি হয়েছে। প্রকৃতি এখন খুবই শান্ত। চারিদিকে ঝকঝকে তকতক করছে।
বিকেলে কথা মতো তুলিকা একাই সেই পার্কে গেলো৷ মিষ্টি আর নুশা দুজনের কাউকেই আনেনি সে। সে জানে মিষ্টি আর নুশা এখন গ্রুপ স্ট্যাডি করবে না হলে জম্পেশ গল্প জুড়বে৷ তুলিকার পার্কে আসতে ঘন্টাখানেক লাগে। আসতে আসতে চারটে বেজে গেছে। সে হাওয়াই মিঠাই ওয়ালার কাছে এগিয়ে গেলো। তার প্রাপ্য টাকা বের করে দিয়ে বলল,
‘এই যে চাচা আমাকে চিনতে পেরেছেন?’
‘হো আম্মাজান চিনমু না ক্যান? তা আজকেও বুঝি ঘুরতে আইছেন আম্মাজান?’
‘না না চাচা আপনার পাওনা টাকা টা দিতে এসেছি। আমি একাই এসেছি আজ। এক্ষুনি চলেও যাবো।’
‘কিসের ট্যাকা আম্মাজান। আমি তো কুনো ট্যাকা পাই না।’
‘কি বলছেন এসব চাচা? আপনি বোধহয় আমাকে চিনতেই পারেননি ঠিক করে৷ কালকে কালার ছাড়া দুটো হাওয়াই মিঠাই নিয়েছিলাম মনে আছে? পাঁচশো টাকার নোট দিয়েছিলাম আমার কাছে খুচরো না থাকাই। মনে পরছে?’
‘আহা আম্মাজান আমি চিনুম না ক্যান? আমি চিনসি। আপনের বাকি ট্যাকা তো আমি কাইলই পাইছি। একখান সুন্দর দেখতে পোলায় আপনের ট্যাকা দিয়ে গেছে।’
হাওয়াই মিঠাই ওয়ালা আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই সেখান থেকে চলে গেলো। অবাক হয়ে তার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রইলো তুলিকা। কেউ তার হয়ে টাকা দিয়ে দিয়েছে? কে দিয়েছে টাকাটা? মাইজিন নয় তো? সে দৌঁড়ে হাওয়াই মিঠাই ওয়ালার দিকে গেলো। সে ডাকলো যেনো তিনি দাঁড়িয়ে পরে৷ কিন্তু তিনি বা শোনার ভান করে হাওয়াই মিঠাই এর গাড়িটা চালিয়ে চলে গেলো৷ তাকে আর ধরতে পারে না তুলিকা। না চাইতেও কালকের মতোই আজকেও তার চোখ পরলো জেব্রা ক্রসিংয়ের দিকে। আজ সে জেব্রা ক্রসিংয়ে কাঙ্ক্ষিত মানুষটাকে দেখলো না। আজকেও কি মানুষটার দেখা পাবে সে? তখনই তাকে এক প্রকার ইচ্ছে করেই ধাক্কা দিলো কেউ। সে ফুসে উঠে কিছু বলার জন্য উদ্যত হতেই দেখলো কালো হুডি পরা একটা ছেলে হেঁটে যাচ্ছে। তার পাশেই একটা শুটকো মতো লোক আছে। কাল মাইজিন এই সেইম হুডি পরেছিলো তাই না?
ভাবনার মাঝেই সে রাস্তায় তাকালো। নেই কেউ-ই রাস্তায়। কে ছিলো সেই ব্যাক্তি? সে উদ্ভ্রান্তের মতো এদিক সেদিক ছুটে খুজতে লাগলো তাকে। রাস্তার অপর প্রান্তে সে দেখলো কালো হুডি পরা লোকটাকে। মানুষটা একটা অটো ধরলো সেই মুহুর্তে। তুলিকা দ্রুত রাস্তা ক্রস করে সেই অটোর পেছনে ছুটতে চাইলো। কিন্তু শা শা করে চলে গেলো অটো টা। সেও একটা অটো নিয়ে ওই অটোকে ফলো করতে লাগলো। সে অটো ওয়ালাকে বললো,
‘আংকেল প্লিজ ভালো ভাবে ওই অটোকে ফলো করতে থাকুন। যেনো হারিয়ে না যায় লক্ষ্য রাখবেন। আপনার যত টাকা লাগে আমি দেবো কিন্তু ওই অটোকে হারালে চলবে না।’
‘আচ্ছা!’ বললেন অটোওয়ালা।
এদিকে আবহাওয়া দ্রুত গতিতে খারাপের দিকে যাচ্ছে। কালো মেঘে ঢাকা পরলো সূর্যিমামা। আকাশ চিড়ে মেঘ ডাকছে গুড়ুম গুড়ুম করে। তুমুল বেগে বৃষ্টি আসবে মনে হচ্ছে। হঠাৎই সেই অটো থেমে গেলো। এখন পাঁচ টা বেজে দশ মিনিট। কখন এতোটা সময় চলে গেছে বুঝতে পারেনি তুলিকা। কালো হুডি পরা লোকটা যে মাইজিন এটা সে খুব ভালো ভাবেই বুঝতে পারছে। লোকটা নেমেই প্রায় দৌঁড়ে একটা সরু রাস্তায় ঢুকলো। তুলিকাও অটো থেকে নেমে পাঁচশো টাকার একটা নোট দিয়ে ছুটলো। অটোওয়ালা পেছন থেকে ডাকলো,
‘ম্যাডাম এতো টাকা লাগবো না। নিয়া যান অর্ধেকটা।’
কিন্তু সেসব শোনার মুডে নেই তুলিকা। সে ধীর পায়ে ফলো করতে থাকে সামনের মানবটিকে। হঠাৎই মাইজিন থেমে যায়৷ তুলিকা থমকে গিয়ে একটা ওয়ালের আড়ালে লুকিয়ে তপ্তশ্বাস নিলো। মাইজিন চারিদিকে একবার দেখে হাঁটা ধরলো৷ এবারে তুলিকা মাইজিনের ফেস টা স্পষ্ট দেখতে পেলো। তার মানে তার ধারণা ভুল নয়। ওটা মাইজিনই ছিলো। এদিকে সে কতটা ভয় পাচ্ছিলো এটা ভেবে যে কোথায় না কোথায় চলে এলো সে। যদি ভুল জায়গায় চলে আসে তবে কি হবে? মাইজিন হাঁটা ধরলে তুলিকাও হাঁটা ধরে। ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি শুরু হলো। বৃষ্টির পানিতে সে ভিজে একাকার হয়ে গেলো। তার পরনের সাদা রঙের জরজেট জামাটা
গায়ের সঙ্গে লেপ্টে গেলো। সেদিকে কোনো তোয়াক্কাই করলো না তুলিকা। সে জোর কদমে মাইজিনকে ফলো করতে ব্যস্ত। হঠাৎই মাইজিন একটা ছয়তলা বিশিষ্ট বাড়ির গেইট খুলে ঢুকে গেলো। বিল্ডিংটা অনেক পুরনো কিন্তু অনেকটা স্থান জুড়ে এই বিল্ডিং টা। আশ্চর্যের বিষয় হলো এতো বড় বাড়ির গেটে দাঁরোয়ান পর্যন্ত নেই একটা! মাইজিন নিজেই গেট খুলে ঢুকেছে৷ মাইজিন একেবারে ভেতরে প্রবেশ করলেই তুলিকা ঢুকে পরলো সেই বিল্ডিংয়ে। বিল্ডিংয়ের প্রত্যেকটা তলায় সুন্দর করে বারান্দা দেওয়া। বারান্দায় দাঁড়ালে রাস্তার সবকিছু স্পষ্ট দেখা যায়। ও সিড়ি বেয়ে এক তলায় পৌঁছায়। তার শরীর থেকে নির্গত হচ্ছে বৃষ্টির পানির ছাচ। এতে করে সিড়িতেও পানির ফোটা ফোটা বিন্দু পরছে। ভিজে জুবুথুবু অবস্থায় এই মুহুর্তে তুলিকার শরীরে মৃদু শীত শীত অনুভব হলো।
সে সিড়ি বেয়ে তিন তলায় উঠে দেখলো মাইজিন দরজার সামনে দাঁড়িয়ে কি যেনো করছে। তুলিকা লুকাতে যাবে তখনই এক মহিলার সঙ্গে তার ধাক্কা লাগলো। মহিলাটি চাপা রাগ দেখালেন চেঁচিয়ে। তুলিকা স্যরি বললো। আর তখনই মাইজিনের চোখ পরলো তুলিকার দিকে৷ সে দাঁত কিড়মিড় করে আওড়ালো, ‘শিট!’
মহিলাটি চলে যেতেই মাইজিন তুলিকার দিকে এগিয়ে এলো। ভয়ে শিউরে উঠে তুলিকা। মাইজিনের শক্ত চাহনি উপেক্ষা করার মতো না৷ বেশ ঘাবড়ে গেলো তুলিকা। কয়েক কদম এগিয়ে এসে চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে থাকে মাইজিন৷ ক্রোধের সহিত বলল, ‘এই তুমি এখানে কি করছ?
‘মাইজিন আপনি শান্ত হোন। এএএ! দ-দেখুন আ-আহ- আমি**!’
তুলিকাকে চুপ করে দিয়ে মাইজিন গর্জে উঠে ,’তুমি আমার পেছনে কেন এসেছো?হাউ ডেয়ার ইউ ষ্টুপিড গার্ল! ‘
‘আমার আপনার সঙ্গে এএ-একটু কথা বলা দরকার। আপনাকে আমি কয়েকটি প্রশ্ন করতে চাই। কেন এমন করছেন আপনি?’
মাইজিন ক্ষুব্ধ হয়ে তুলিকার দিকে এক পা এক পা করে এগেলো। মাইজিনের এভাবে এগিয়ে আসাতে ভয়ে আরও চুপসে গেলো তুলিকা। তুলিকা পিছিয়ে যেতে যেতে দেয়ালের সঙ্গে লেগে গেলো। মাইজিন দুই হাতে তার দুই বাহু শক্ত হাতে চেপে ধরে বলল,
‘আরেকবার যদি তুমি আমার পেছন পেছন আসো তাহলে তুমি শেষ হয়ে যাবে!’
মাইজিনের গরম নিঃশ্বাস তুলিকার চোখ মুখে লাগছে। মাইজিন হাতের জোড় বারাতে কুকিয়ে উঠে তুলিকা। আরেকটু কাছে ঘেঁষে মাইজিন আবার বললো, ‘এন নাও জাষ্ট গো ফ্রম হেয়ার।’
এক মৃদু ঝটকা দিয়ে মাইজিন তুলিকার দুই বাহু আলগা করে দিলো। তুলিকার চোখের কোণে ঘেঁষে জল গড়িয়ে পরছে অনবরত। আজকেও এরকম ব্যবহার মাইজিনের? সে বৃষ্টিতে ভিজে যাওয়াই কাঁপছে ভীষণ। মাইজিন এক ঝটকায় নিজের পরনের কালো হুডি টা খুলে তুলিকার গায়ে জড়িয়ে দিতেই হুশ ফিরলো তুলিকার। তুলিকার চোখ পরলো মাইজিনের শরীরের দিকে। সে যা দেখলো এতে সে সেখানেই তব্দা খেয়ে বসে পরলো।
#চলবে
#হীরকচূর্ণ_ভালোবাসা
#পর্ব১৭ (বোনাস পার্ট)
#রাউফুন
মাইজিনের হাতে আর ঘাড়ে অসংখ্য কা’টা, আউড়, পো’ড়ার দাগ। যা তার লাল ফর্সা শরীরে ভীষণ বিচ্ছিরি লাগছে। মাইজিন হইতো সেই দাগ গুলো ঢাকার জন্যই কালো হুডি পরে বের হতো। তার এমন দাগ দেখে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে সেগুলো মা’রের দাগ। মনে হচ্ছে কেউ ব্লে’ড দিয়ে আঁচড়েছে। ফালা ফালা করেছে ভীষণ নৃশংস ভাবে। তুলিকা সটান হয়ে দাঁড়িয়ে খুবই অস্থির হয়ে মাইজিনের খুবই ঘনিষ্ঠ হয়ে কা’টা, পো’ড়া যুক্ত হাত, ঘা’ড় আলতো ভাবে বুলিয়ে দিচ্ছিলো। মাইজিনের এতো এতো আঘাত এর চিহ্ন দেখে তার ভেতরটা তোলপাড় চলছে। মাইজিনের সাদা টিশার্ট পেট থেকে উঠিয়ে হুরমুর করে দেখলো তুলিকা। মাইজিন বাঁধা দেওয়ার চেষ্টা করলেও পারছে না। যেনো এই মেয়েটার গায়ে অনেক জোর। হঠাৎ করে এতোটা জোর এলো কোথা থেকে এই পা’ট কা’ঠির মতো শরীরে?
‘আপনার হাতে ঘা’ড়ে সারা শরীরে এতো দাগ, এগুলো কিভাবে কে’টেছে? আপনি এই জন্য এমন করছিলেন তাই না? কে এভাবে আমার মাইজিনকে আঘাত দিয়েছে? কে বলুন!’
হাত ঝামটি দিয়ে তুলিকাকে আবার সরিয়ে দিলো মাইজিন। তুলিকার গা থেকে নিজের কালো হুডি নিয়ে নিজের গায়ে গলিয়ে নিলো। চোখ রাঙিয়ে বললো,
‘এই মেয়ে তোমাকে যেতে বলছি কথা কানে যায় না? দশ মিনিট তোমার হাতে। এক্ষুনি এখান থেকে চলে যাবে না হলে তুমি জানো না কত বড় বিপদ তোমার জন্য অপেক্ষা করছে৷ নাউ গেট আউট!’
নির্লজ্জতার শেষ সীমা পেরিয়ে তুলিকা আবার মাইজিনকে জাপটে ধরলো। দুই হাতে মাইজিনের চিবুক আগলে বলল,
‘কেন এমন করছেন মাইজিন? আপনি তো আমাকে কতটা ভালোবাসেন বলুন? আপনি ছাড়া আমি যে ভালো নেই মাইজিন। আমিও যে আপনাকে অনেকটা ভালোবেসে ফেলেছি। আমি তো আপনার বউ বলুন? আমি, আমি আপনার করা ছোট্ট ছোট্ট যত্ন গুলোকে যে খুব মিস করছি। রোজ অফিস থেকে এসে আমার সঙ্গে রান্না করেন, আমি বারণ করলেও শুনেন না। কত খুনসুটি আপনার আর আমার। সবকিছুই যে আমি বড্ড মিস করছি মাইজিন। আবার সব কিছু আগের মতো করে নিন না মাইজিন। প্লিজ! আমাকে এভাবে বার বার দূরে ঠেলে দেবেন না। প্লিজ! এই মাইজিন আপনি, আপনি তো আমার কান্না দেখতে পারেন না৷ সহ্য হয় না আমার চোখের পানি৷ এই দেখুন আমি কাঁদছি। কতো কাঁন্না করছি মুছে দিন না আমার চোখ। মুছে দিন আমার চোখ আপনার নিজের হাতে।’
মাইজিনের মধ্যে নিস্তব্ধতা, জড়বস্তু, পাথরের মতো দাঁড়িয়ে তুলিকার পা’গ’লামো সহ্য করে যাচ্ছে। সে ভেবেছিলো তুলিকাকে আর কোনো কঠিন কথা শুনাবে না। কিন্তু এখন তো থামছেই না মেয়েটা। ক’টা কড়া কথা না বললে মেয়েটাকে এখান থেকে বের করা যাবে না। তাই বাধ্যতামূলক তাকে চড়াও হতে হচ্ছে।
‘ওহ আপনি তো আমাকে আমার অনুমতি ব্যাতিত স্পর্শ করবেন না। এই যে আমি অনুমতি দিচ্ছি। আপনি আমার চোখ মুছে দিন৷ মুছে দিন।’ তুলিকা মাইজিনের দুই হাত দিয়ে নিজের গাল স্পর্শ করিয়ে নিজেই নিজের কপলে লেপ্টে থাকা নোনা পানি মুছে দিতে লাগলো।
‘আমার সামনে এভাবে কা’দবেন না!’
তুলিকা চোখে পানি কিন্তু সারা মুখে খুশি ফোয়ারা বয়ে যাচ্ছে। সে ভাবছে মাইজিন বোধহয় এবারে স্বাভাবিক হবে। তাকে আগলে নেবে। কিন্তু তার ধারণাকে ভুল করে দিয়ে আরও কিছু তিক্ত বাক্য ছুড়লো,
‘এসব ন্যাকা কান্না আমার সহ্য হচ্ছে না। লজ্জা করছে না একজন পুরুষের গায়ে এভাবে ঢলে ঢলে পরছো? মিনিমাম লজ্জাবোধ নেই তোমার হ্যাঁ মেয়ে? ছিঃ তোমাকে দয়া করে বিয়ে করেছি, একটা বাড়িতে থাকতে দিয়েছি, সুখে দিন কা’টাচ্ছো, এই কি যথেষ্ট নয়? এখন এসে আমার সঙ্গে চিপকে চিপকে যাচ্ছো? লোভী মেয়ে মানুষ কোথাকারের। আর হ্যাঁ দ্বিতীয় দিন তুমি আমার পিছু নেওয়ার চেষ্টাও করবে না। ফলটা খুবই খারাপ হবে তবে।’
তুলিকা মাইজিনের নিষ্ঠুরতম বানী শুনে থমকে গেলো মুহুর্তের মধ্যে। চারদিকে কেমন ভনভন করছে। মনে হচ্ছে সে ভুল শুনছে। সারা শরীরের শিরা উপশিরায় ঠান্ডা রক্তের শ্রোত বয়ে যাচ্ছে। মাইজিনের কঠিন বাক্যের কোনো কথায় কানে যাচ্ছে না তার। সে আবারও বেহায়ার মতো মাইজিন কে দুই হাতে আঁকড়ে ধরলো। শক্ত করে আঁকড়ে ধরে মাইজিনের ঘাড়ের সমস্ত ক্ষত স্থানে চুমুতে চুমুতে ভরিয়ে দিলো। তার এমন উম্মাদনা, এমন উদ্ভ্রান্তের মতো আচরণে মাইজিনের ভেতর টা জ্বলে যাচ্ছে। সে না পারছে সইতে না পারছে কিছু বলতে। এমনিতেই সে তুলিকাকে অনেক যন্ত্রণা দিয়েছে। মেয়েটা একটার পর একটা ধাক্কা সহ্য করার ক্ষমতা রাখতে পারবে না। মাইজিন নিজের মনের বিরুদ্ধে গিয়ে কোনো রকম বাক্য ব্যয় না করে তুলিকাকে টেনে হেচড়ে গেটের বাইরে বের করে দিলো। তুলিকাকে সোজা একটা অটোতে তুলে দিয়ে মাইজিন ভাড়া দিয়ে দিলো। নির্দিষ্ট ঠিকানায় নিয়ে নামিয়ে দিতে বললো।
‘শুনুন এই আপার মাথায় প্রব্লেম আছে। যা কিছুই হয়ে যাক তাকে কিছু জিজ্ঞেস করবেন না। জিজ্ঞেস করলেই খুব জোরদার ধুমধামে হাত চালাই। একেবারে আমার বলা ঠিকানায় নামবেন। তাছাড়া কোনো স্থানে থামবেন না!’
‘আচ্ছা ভাইয়া।’ ভয়ে ভয়ে বললো অটোওয়ালা।
তুলিকা স্তব্ধ, নিস্তেজ হয়ে বসে রইলো শুধু। মাইজিন এতোটা নিষ্ঠরতা দেখালো তার সাথে? মাইজিন? সে অটো চলতেই সে অটোর মধ্যেই উদ্ভ্রান্তের মতো গলা চিড়ে চিৎকার করে কান্না করতে লাগলো৷ কান্নার দাপটের সাথে সাথে আবোলতাবোল বকে যাচ্ছে সমান তালে। অটোওয়ালা হতচকিত হয়ে তাকিয়ে দেখলো সবটা। কিছু বলার সাহস পেলো না। সে ভেবেই নিলো মেয়েটাকে ভু’তে পেয়েছে।
বাড়িতে গিয়েই তুলিকা তার সেই আগের জামাটা পরে নিলো। মিষ্টিকেও নুশাদের ঘর থেকে টেনে আনলো৷ ঘর তালা দিয়ে যখন হন্তদন্ত হয়ে মিষ্টিকে নিয়ে নামছিলো মিষ্টি অনবরত প্রশ্ন করেই যাচ্ছিলো।
‘কি হইছে বুবুজান। আমারে এইভাবে টাইনা কই নিয়া যাইতাছো? আমারে ছাইড়া দাও। এই রাতের বেলায় কই যামু আমরা?’
‘আমাকে কোনো প্রশ্ন করিস না মিষ্টি। আমরা কোথায় যাচ্ছি, কেন যাচ্ছি তা আমি নিজেও জানি না। তবে এই বাড়িতে আমরা আর থাকবো না।’
‘কিন্তু আমরা এইহানে না থাকলে কই যামু? আমাগোর তো বাড়িও নাই। রাস্তায় থাকুম নাকি?’
‘একি ভাবি? আপনারা দুই বোন এমনভাবে এই রাতের বেলায় কোথায় যাচ্ছেন? কোনো বাজার লাগবে? তাহলে আমাকে দিন আমি এনে দিচ্ছি!’ মাইজিনের বন্ধু নাফিজ বললো। এই বাড়িওয়ালার মালিকের ছেলে।
‘নাহ নাফিজ ভাইয়া। আমরা এক্ষুনি এই মুহুর্তে এখান থেকে চলে যাচ্ছি। এই নিন আপনাদের ঘরের চাবি!’
‘সেকি কথা ভাবি! এভাবে তো আপনারা এই বাড়ি থেকে যেতে পারবেন না। আপনাদের এখানেই থাকা লাগবে।’
‘আপনার বন্ধুকে বলে দিবেন আমরা আর এখানে থাকবো না। তার অনেক দয়ার শরীর। তাই আমাদের দুই বোনকে দয়া করে এখানে থাকতে দিয়েছিলো। কিন্তু এখন আর তার দয়া আমাদের চাই না।’
‘ভাবি, ভাবি দাঁড়ান। আমার কথা শুনুন। আপনারা এক্ষুনি ঘরে যাবেন। আর হ্যাঁ আমাদের বাড়িটা মানে আপনারা যে রুম গুলো ভাড়া নিয়েছেন তা কন্ট্রাক্ট পেপারে সাইন করে নিয়েছেন। এক বছর এর আগে এই বাড়ি থেকে আপনারা কেউ-ই কোথাও যেতে পারবেন না। আর আমরাও এক বছর এর ভাড়া পেয়ে গেছি। তাই যেতে দিতে পারছি না।’
‘এই বাড়ি যিনি ভাড়া নিয়েছেন তাকেই বলুন এখানে এসে থাকতে।’
‘আপনারা যেতেই পারবেন না। কারণ আমরা আপনাকেই ভাড়া দিয়েছি বাড়ি। ওই কন্ট্রাক্ট পেপারে আপনার নামেই ভাড়া দেওয়া হয়েছে। সো আপনারা বাধ্য এখানে থাকতে।’
দাঁতে দাঁত চেপে বাধ্য হয়ে তুলিকা আর মিষ্টি ঘরে গেলো আবারও।
রুমে গিয়ে পাগলের মতো আচরণ করতে লাগলো তুলিকা। মিষ্টি ভয়ে আঁতকে উঠলো নিজের বোনের এমন অবস্থা দেখে। তুলিকা মাইজিনের দেওয়া সমস্ত ড্রেস বের করে গায়ের জোরে টেনে টেনে ছেড়ার চেষ্টা করলো। কোনো কা’চি না পেয়ে বটি নিয়ে এলো সে। নিজের বোনের হাতে ব’টি দেখতেই মিষ্টি শিউরে উঠে।
‘এইইই বু-বুবু-জান ওটা কেন এনেছো? ওটা রাখো। ওটা রাখো বুবুজান। হাত কা’টবে কিন্তু। ফেলে দাও বলছি।’
তুলিকা কোনো কথায় কানে তুললো না মিষ্টির। ধপ করে বসে মাইজিনের দেওয়া সমস্ত পোশাক কু’চি কু’চি করে কা’টলো। কেন এমন আচরণ করলো সে নিজেও জানে। শুধু জানে এখন তার শরীর জ্বলে যাচ্ছে। কোনো কিছুই ভালো লাগছে না। এক সময় সে থেমে গেলো। মিষ্টি দুই হাতে মুখ চে’পে ধরে কান্না করছে। তার বুবুর এরকম অস্বাভাবিক আচরণে ভয়ে গুটিয়ে গেছে সে। সারা শরীর থরথর করে কাঁপছে তার। হঠাৎই তুলিকা মিষ্টিকে জাপটে ধরে হাউমাউ করে কাঁন্না করলো। গলা ফাটিয়ে চিৎকার করছে আর বলছে,
‘আমাদের সঙ্গেই কেন এমন হচ্ছে বলতে পারবি বোন? প্রথমে আল্লাহ আমাদের বাবা-মাকে কে’ড়ে নিয়ে আমাদেরকে এতিম করে দিলেন। মাথার উপর থেকে ছাদ কেড়ে নিলেন। কারোর কাছেই ঠাই হলো না আমাদের দুই বোনের। ছোট বেলা থেকেই তো কষ্ট সহ্য করে আসছি বল। আর পারছি না আমি সইতে।আর কতো সইবো বলতে পারিস? এতো যন্ত্রণা যে আর নিতে পারছি না আমি। সবে একটু সুখের মুখ দেখেছিলাম সেটাও যে আর রইলো না। সেও যে দয়া দেখালো আমাদের। যে মানুষটাকে মন প্রাণ উজাড় করে ভালোবাসলাম সেই মানুষটাও যে রাতারাতি বদলে গেলো। সুখ বলে হইতো কোনো কিছু আমাদের কপালে নেইরে মিষ্টি। তা না হলে বলতো আমাদের সাথেই কেন এমন হচ্ছে? কেন? কেন?’
দুই বোন দুজনকে জড়িয়ে ধরে নিজেদের চরম বিষাদকে উড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা চালাচ্ছে। কাঁন্না ছাড়া যেনো কোনো কিছুই তাদের কপালে লিখেন নি সৃষ্টিকর্তা। মিষ্টি তার বুবুকে শান্ত করার ব্যর্থ প্রয়াস চালাচ্ছে।
#চলবে