#হীরকচূর্ণ_ভালোবাসা
#পর্ব১৮
#রাউফুন
ঝুম বৃষ্টি। সময়টা বর্ষাকাল। বৃষ্টির দাপটে রাস্তা ঘাট কাদায় চিপচিপে হয়ে থাকে। যাকে বলে কাদায় মাখামাখি অবস্থা। একদিন এমনই এক ঝুম বৃষ্টির দিনে মাইজিন হন্তদন্ত হয়ে বাড়ি আসে। নিজের কাছে থাকা ডুপ্লিকেট চাবি দিয়ে দরজার খুলে কোনো রকমে ভেতরে প্রবেশ করলো। তুলিকা তখন শুয়ে আছে আর বিভোর হয়ে মাইজিনের কথায় ভাবছে। সে তার ভাবনায় এতোটাই মত্ত যে দরজা খোলার শব্দ অব্দি তার কানে যায়নি। মিষ্টি স্কুল থেকে ফিরে ফ্রেশ হচ্ছে। এদিকে মাইজিন থরথর করে কাঁপছে অনেকক্ষন বৃষ্টিতে ভেজার ফলে। যখন মাইজিন ধপাস করে ফ্লোরে পরে যায় তখনই সেই শব্দে তার ধ্যান ভাঙে। তুলিকা তাকে দেখতে পেয়ে অস্থির চিত্তে উঠে গিয়ে মাইজিনকে তুলে ধরলো। মানুষটার প্রতি যতোই রাগ করে থাকুক না কেন তার এমন করুন অবস্থায় তো আর তাকে দূরে ঠেলে দেওয়ায় যায় না। দুই সপ্তাহ কে’টে যাওয়ার পর মানুষটাকে এমন অবস্থায় দেখতে পাবে ভাবতেই পারছে না সে। তুলিকা জোর গলায় উৎকন্ঠা নিয়ে ডাকলো মিষ্টিকে।
‘এই মিষ্টি এদিকে আয়। তোর মাইজিন ভাইয়ার কিছু একটা হয়েছে! জলদি আয়।’
মিষ্টি ছুটে এলো মাইজিনের কথা শুনেই। তুলিকার দু চোখ ভরে কান্না এলো। মানুষটার একি করুন অবস্থা! তারা দুই বোন মাইজিনকে তুলে বিছানায় বসালো।
‘মিষ্টি চুলায় সরিষার তেল আর কয়েকটা গোটা রসুন, কালো জিড়া আছে তা দিয়ে তেল গরম কর। আমি উনার ভেজা পোশাক বদলে দিচ্ছি। যাহ দ্রুত।’
‘আচ্ছা বুবুজান। ভাইয়ার এমন অবস্থা কেন? এই বিকেল বেলায় কোথায় থেকে এলো এমন কাকভেজা হয়ে?’
‘জানি না মিষ্টি। তুই দেরি করিস না যা বললাম তাই কর।’
মাইজিনের জ্ঞান ফিরেনি। তুলিকা জ্ঞান ফেরানোর চেষ্টা চালালো কিন্তু লাভের লাভ কিছুই হলো না। ভেজা শার্ট-প্যান্ট বদলে দিলো তুলিকা নিজেই। কিছু করার নেই এখন। মাইজিন সেই অবস্থায় নেই যে নিজের পোশাক নিজেই বদলে নেবে। শুকনো কাপড় পরিয়ে দিতেই কম্বল চাপিয়ে দিলো মাইজিনের গায়ে। উষ্ণ অনুভব হতেই কিছুক্ষনের মধ্যেই জ্ঞান ফিরলো মাইজিনের। তুলিকা মাইজিনের বুকে, পায়ে গরম তেল দিয়ে দিলো। কালো জিরা আর রসুন মাইজিনের মুখে দিয়ে খেতে বললো। মাইজিন আবছা চোখে তুলিকাকে দেখছে। তার জন্য এখনো কতটা অস্থিরতা মেয়েটার মধ্যে। মাইজিনের যখন পুরোপুরি জ্ঞান আসলো তখন তাকে গরম চা খাওয়ালো তুলিকা। এতে করে মাইজিন খুব আরাম বোধ করলো। মাইজিন নিরবতা ভেঙে ভাঙা গলায় প্রথমে কথা বলে,
‘এতো কিছুর পরেও আপনি আমাকে নিয়ে এতোটা চিন্তিত তুলিকা? সেবা যত্ম করে সুস্থ করে তুলছেন।’
‘সর্ব প্রথমে আমি মানুষ একজন মানুষ। এজ আ’ হিউম্যান বিং আমি মনে করি একজন অসুস্থ মানুষের সেবা করাটা দায়িত্বের মধ্যেই পরে।’
‘ওহ! তাহলে বলছেন শুধুই দায়িত্ব পালন করছেন আপনি?’
‘হুম!’
‘আমার উপর খুব অভিমান জমেছে তাই না?’
‘রাগ ও অভিমান প্রায়ই আমাদের প্রিয় মানুষের কাছ থেকে আমাদের দুরে ঠেলে দেয়। আমার ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য হচ্ছে সেটা। অতিরিক্ত যেকোন কিছু পতন নিয়ে আসে। সবকিছু তাই নির্দিষ্ট সীমায় রাখাই শ্রেয় তাই না?’
‘তাহলে ধরেই নিচ্ছি আমি আপনার প্রিয় মানুষ!’
‘এখানে প্রিয় অপ্রিয়র কোনো কথা নেই। এতো দিন পর ফিরে এসে এখন আবার ঢং শুরু করেছেন কেন? এসব নাটক কিন্তু আমি বর্দাস্ত করবো না। অসুস্থ বলেই যে ছাড় পাবেন সেটা একদম ভাববেন না। আপনি আমাকে অনেক কষ্ট দিয়েছেন সেসব ভুলে যায়নি কিন্তু!’
‘আপনার রাগ, অভিমানের জন্য হয়তো কেউ আপনাকে শাস্তি দেবে না। কিন্তু আপনার রাগ, অভিমানই যে আমাকে তিলে তিলে শাস্তি দেবে! আমি জানি আপনার আমার উপর অভিমান করাটা স্বাভাবিক! আমি যা করেছি আমার প্রতি আপনার এই অভিমান অনুচিত নয়। সম্পুর্ন অধিকার আছে আপনার। কিন্তু আপনার মনে হয় আমি এগুলো সব কিছু ইচ্ছে করে করেছি? তুলিকা আরও পনেরো দিন কে’টে গেছে। আমি আজ সুযোগ পেয়েছি তাই আপনার কাছে ছুটে এসেছি।’
‘কেন এলেন বলুন তো? আর আপনার এরকম অবস্থায় বা কেন?’
‘মানব হৃদয় আয়নার মত। সে আয়নায় ভালোবাসার আলো পরলে তো ফিরে আসবোই। আপনি না আমাকে অনেক ভালোবাসেন হেহেহেহে আমি জানি। আপনি চাইলেও বাঁধা দিতে পারবেন না আমার এখানে আসাটা। আমি আর কক্ষনো আপনাকে ছেড়ে যাবো না। এই কান ধরছি। আপনি চাইলে আপনার পা ও ধরতে পারি হাহাহাহ! আমি আপনার কাছেই থাকবো। একদম চিপকে চিপকে থাকবো হ্যাঁ? এই আপনার মনে আছে আপনি আমাকে অনুমতি দিয়েছিলেন আপনাকে স্পর্শ করার! আমি কিন্তু এখন আপনাকে স্পর্শ করবো। একদম কাছ ছাড়া করবো না আপনার। একদম জাপটে ধরে থাকবো।’
তুলিকা নিশ্চুপ হয়ে গেলো মাইজিনের এক সাথে বলা এতো গুলো কথায়। কেমন অদ্ভুত ঠেকছে মাইজিনের হাবভাব। মানুষ টা এমন পাগলের প্রলাপ কেন বকছে? তুলিকা সত্যিই মাইজিনকে এখানে আসতে বাঁধা দিতে পারবে না। কারণ সেই তো এই বাড়িটা ভাড়া নিয়েছে। মাইজিন আলতোভাবে চোখ বন্ধ করে কাঁপছে একাধারে। আবার চোখ খুলে তার দিকে তাকাতেই তুলিকা দেখলো মাইজিনের চোখ মুখ অস্বাভাবিক ভাবে পাংশুটে হয়ে গেছে। শরীর কেমন জোরদমে কাঁপছে। মাইজিন জ্বরের ঘোরে আবোল তাবোল বকঁছিলো এতক্ষণ বুঝতে পারলো তুলিকা। চুপ থাকা খুব সহজ একটা কাজ। পারষ্পরিক বহু সমস্যার সমাধান শুধু চুপ থাকলেই হয়ে যায়। কিন্তু মানুষের সবচেয়ে বড় অযোগ্যাতা হচ্ছে সে মুখ বন্ধই রাখতে পারে না। অপ্রয়োজনে অনর্গল বকে যায়। এই অসুস্থ অবস্থায় চুপচাপ মাইজিন অনর্গল একটার পর একটা কথা বলেই যাচ্ছে। জ্বরের ঘোরে যত কথা আছে সব বলে যাচ্ছে মাইজিন।একেকজনের অসুস্থতা একেক ধরনের। মাইজিন অসুস্থ হলে বোধহয় বেশি কথা বলে।
মিষ্টিই আজকে রাতের রান্নাটা সারলো। কারণ মাইজিন তুলিকাকে কাছ ছাড়া করছেই না। হাত শক্ত করে ধরে আছে। মাইজিনকে রাতের খাবার খাইয়ে দিয়ে কোনো রকমে জ্বরের ওষুধ খাওয়ালো সে। মিষ্টির আজ বেশ কষ্ট হয়েছে একা একা কাজ করতে। সে বুঝতে পারলো একা একা কাজ করাটা কতটা কষ্টের৷ অথচ তার বুবুজান এতোদিন একাই কাজ করেছে। সে মনে মনে ঠিক করলো এরপর যতটা পারবে সে তার বুবুজানকে কাজে সাহায্য করবে।
রাত যখন দশটা তখন আশফির কল এলো। তুলিকা কল রিসিভ করেই বললো,’আজ মাইজিন হঠাৎ করেই এভাবে ফিরে এসেছে? আর কি সব আবোল তাবোল বকে যাচ্ছে।’
মাইজিন কিভাবে এলো তার সব কিছু বললো আশফিকে। সবটা শুনার পর আশফি বললো,
‘কি বলছিস। এটা তো খুব খুশির খবর। আগে কেন কল করিস নি? আমি জানতাম মাইজিন ভাইয়া একদিন ঠিক আসবেই। তুই প্লিজ মাইজিন ভাইয়াকে দূরে সরিয়ে রাখিস না এবারে। নিশ্চয়ই তোর ভালোবাসা উপলব্ধি করতে পেরেই ছুটে এসেছে অসুস্থ অবস্থায়। দেখ মানুষ অসুস্থ অবস্থায় কিন্তু তার কাছের মানুষকেই স্মরণ করে সবার প্রথমে।’
‘যে মানুষ টার জন্য আমি নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে যাওয়ার মতো নিশব্দে কেঁদেছি তাকে আমি কখনোই মানবো না। আমার জীবনে ফিরে আসুক এটা আমি চাই না। আমি তাকে এতো সহজেই গ্রহণ করতে পারবো না আশু। আমি এতোটাও উদার নয়।’
‘দেখ তুলি আমি মানছি মাইজিন ভাইয়া ভুল করেছে কিন্তু সেটারও নিশ্চয়ই কারণ আছে৷ তুই সেই কারণ টা কেন শুনছিস না?’
‘তিনি অসুস্থ। তার কাছ থেকে এখন আমি কিভাবে শুনবো সবকিছু? শোন আশু প্রতিজ্ঞা করার আগে একটু হলেও ভাবা উচিত। কাউকে মিথ্যা দিয়ে হাসানোর চেয়ে সত্য বলে কাঁদানোই শ্রেয়। সে আমাকে আগের মতো মিথ্যা আশ্বাস দিচ্ছে না এখন কে বলতে পারে?’
‘জানি না আমি কিছুই। তবে আমার মনে হচ্ছে মাইজিন ভাইয়ার আরেকটা সুযোগ পাওয়ার অধিকার আছে। সেও মানুষ, তার ভুল ভ্রান্তি হবে এটা স্বাভাবিক!’
‘তোর কাছে স্বাভাবিক হলেও আমি সবটা স্বাভাবিক ভাবে নিতে পারছি না।’
‘আচ্ছা নিতে হবে না। আচ্ছা একটা কথা বলবি? কেউই কি নিজের গায়ে নিজে ওতোটা বা’জে ভাবে আঘাত করতে পারে? তুই বলেছিলি মাইজিনের শরীরে অগণিত দাগ। তবে সেটা কিভাবে হলো? দেখ আমার মনে হয় তোর মাইজিন ভাইয়ার সঙ্গে থেকে এসব বিষয় খুতিয়ে দেখা উচিত।’
‘আচ্ছা আমি দেখবো খুতিয়ে। সে সুস্থ হোক আগে।’
‘হুম তার কথা আগে শুনে নে। তার প্রতিক্রিয়া দেখানোর আগে চিন্তা কর। সুস্থ হওয়ার আগ পর্যন্ত ধৈর্য্য ধর। প্রার্থনা কর আল্লাহর কাছে।’
‘আচ্ছা রাখছি।’
কল কেটে দিয়ে তুলিকা মাইজিনের কাছেই বসে রইলো এক ভাবে। বেঘোরে ঘুমোচ্ছে মানুষটা। মৃদু নাক ডাকার শব্দ পেলো সে। অতিরিক্ত জ্বর আর ক্লান্তি থেকেই মাইজিন নাক ডাকছে। অদ্ভুত শব্দ তবে সহনীয়। তুলিকা মাইজিনের মুখের দিকে অপলকভাবে তাকিয়ে রইলো শুধু। মানুষটা কি অনেক বেশি শুকিয়ে গেছে? মুখটা বেজায় শুকনো লাগছে আহারে। মনে হচ্ছে কতদিন নিশ্চিন্তে ঘুমাইনি। বড্ড মায়া হলো তার। এমনিতেই সে যতই বিরাগী হোক না কেন। মানুষটাকে তো সে মন প্রাণ উজাড় করে ভালোবাসে। এই মানুষ টার কষ্ট তো তারও সম যন্ত্রণার। সে আলতো ভাবে মাইজিনের মাথায় হাত বুলিয়ে দিলো। মাইজিন নড়েচড়ে তুলিকার কোমড় পেঁচিয়ে ধরলো। কোমড় পেঁচিয়ে ধরে মাথাও এগিয়ে নিলো। এরপর কামিজের উপর দিয়েই তার ঘ্রান্দ্রেয়ীও ঘষলো। অস্বস্তিতে কুকড়ে গেলো তুলিকা। ওভাবেই বিমুঢ় হয়ে বসে বসে বিরবির করলো, ‘হুসে নেই কিন্তু ঠিকই স্পর্শ করছে। অসভ্য বদলোক। সব ছোঁয়ার ধান্দা!’
তুলিকা জোরদার নিজেকে ছাড়িয়ে নেওয়ার চেষ্টা করলো। এভাবে আরেকটু থাকলেই দম বন্ধ হয়ে আসবে তার। তম্বন্ধে মাইজিন বললো,
‘আপনার রাগ, আপনার অভিমানে নাক ফুলানো আমার শিরার কোণে যে শিহরন তুলে তুলিকা। আপনার সুন্দর গোলাপি ঠোঁটে কল্পনায় কতবার আমার ওষ্ঠ ছুঁয়ে দিয়েছি। আমার স্পন্দনে, আমার নিঃশ্বাসে বিদ্ধ আপনার মন! চাইলেই আপনি আমার থেকে দূরে যেতে পারবেনা না তুলিকা।’
‘একদম আমাকে পটানোর চেষ্টা করবেন না। এতো সহজে বরফ গলছে না।’
‘বরফ কিন্তু সহজেই গলে। আপনার মতো চালাকচতুর মানুষের মুখে এমন বোকা বোকা কথা মানাচ্ছে না।’
‘এই ছাড়ুন তো মশাই! যত্তসব!’
‘লাইসেন্স যখন পেয়েছি তখন একটা চুমু দিবো?’
#চলবে
#হীরকচূর্ণ_ভালোবাসা
#পর্ব১৯
#রাউফুন
দুই দিনের মাথায় মাইজিনের জ্বর সারলো। এতো দিন অসুস্থ ছিলো বলেই তুলিকা সেভাবেই ট্রিট করেছে মাইজিনকে। তার শরীরে দগদগে ক্ষ’ত স্থানে নিয়ম করে ওষুধপত্র লাগিয়ে দিতো তুলিকা। কিন্তু একটিবার ও এই কথা জিজ্ঞেস করেনি যে এই ক্ষ’ত স্থানের কারণ কে? কে করেছেন তার প্রতি এমন নির্মমতা, এমন নিষ্ঠুরতা! তুলিকা শুধু দেখতে চাইছে মাইজিন নিজে থেকে কখন বলে সবটা। সকালের ব্রেকফাস্ট পর মিষ্টি স্কুলের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পরলো। এগারোটা নাগাদ তুলিকাও বের হচ্ছিলো। সে সময় মাইজিনের মুখোমুখি হতে হলো তাকে।
‘কোথাও যাচ্ছেন?’
‘হুম।’
‘কোথায়?’
‘সব কথা আপনাকে বলতে হবে?’
‘হ্যাঁ হবে! বলুন কোথায় যাচ্ছেন?’
‘একটা সিভি তৈরি করতে। আমার কিছু ডকুমেন্টস এর প্রয়োজন আছে। প্রথমে আমার ভার্সিটিতে যাবো। সেখানে ভর্তির সময় ইন্টারমিডিয়েট এর সার্টিফিকেট সহ কিছু ডকুমেন্টস দিয়েছিলাম সেগুলো যদি এখন পাই সুবিধা হবে।’
‘এখন নেই কেন?’
‘আগে ঐসব পুঁড়েছে এখন আমার জীবন পুড়ে শেষ হচ্ছে।’
‘ভুলেই গেছিলাম কথাটা। আমাকে বলুন আমি গিয়ে এনে দিচ্ছি আপনার যাওয়ার প্রয়োজন নেই। তাছাড়া সিভি দিয়ে আপনি করবেন টা কি?’
‘আপনার মতো শিক্ষিত মানুষকে নিশ্চয়ই এটা বলতে হবে না সিভি দিয়ে মানুষ কি করে?’
‘জানি না আমি। আপনি বলুন কি করবেন?’ ত্যাছড়া ভাবে জানতে চাইলো মাইজিন।
‘একটা চাকরি করবো। আপনার দয়ার শরীর তাই এতো দিন ঠাই পেয়েছি। সেজন্য আমি কৃতজ্ঞ আপনার প্রতি। কিন্তু আর নয়। এভাবে আর কতদিন অন্যের দয়াই বাঁচবো? এবার এই আপদ আপনার ঘাড় থেকে বরাবরের মতো নেমে যাবে!’
‘মানে? কি বলছেন এসব? বউ কোনো দিন কারোর আপদ হয়?’ মশকরা করলো মাইজিন।
‘হ্যাঁ হয়। দয়ার বিয়ের বউ হয় আপদ! আপনি তো আর আমাকে ঘটা করে দেখে, সম্বন্ধ করে, আপনার বাবা মায়ের পছন্দ করা মেয়ে বিয়ে করে আনেন নি!’ নাক ফুলিয়ে বললো তুলিকা।
‘আমার জীবনের সবচেয়ে মুগ্ধ করা অনুভূতি আপনি তুলিকা। আপনি আপদ কেন হবেন? এভাবে বলবেন না প্লিজ!’
তুলিকার ভেতরের ক্রোধ সাজানো অনুভূতি, আবেগকে মুহূর্তেই অগোছালো করে দিয়েছে মাইজিনের এই সামান্য কথায়। ভেতরের সবকিছু উথাল পাথাল করছে। তাকে পুরোপুরি নিজের ক্রোধ হতে মুক্ত করে দেওয়াই বোধহয় এই মানুষটার কাজ।
‘আর হ্যাঁ লিসেন তুলিকা এরপর নিজেকে আপদ ভাবার কোনো অবকাশ কিন্তু নেই হ্যাঁ? জেনে রাখুন এবং মাথায় গেঁথে নিন আপনি কোনো চাকরি করছেন না। আপনার বরের এখনো যা আছে তা দিয়ে পায়ের উপর পা তুলে সারাজীবন বসে বসে খেতে পারবেন।’
তুলিকা কয়েক সেকেন্ড মাইজিনের দিকে তাকিয়ে থেকে কণ্ঠ চড়াও করে বলে,
‘কে বলেছিলো আপনাকে আমায় বিয়ে করতে? কে বলেছিলো বলুন? কেনো এই দয়ার বিয়ে করলেন আমাকে? ছোট বেলা থেকে সবাই শুধু এই তুলিকা কে দয়াই করে গেলো। হায় কি জীবন পেয়েছি! জীবন সঙ্গী পেলাম এখন তার মুখেও শুনতে হয় তিনিও দয়া ধর্ম করেই বিয়ে করেছেন। আমি কি আগ বাড়িয়ে বলেছিলাম বিয়ে করতে? কিন্তু সেদিন কতটা অকপটে সবকিছু বলে দিলে! আপনি আমাকে দয়া করে করেছেন, ভালো খেতে পারছি, পোশাক পাচ্ছি, ভালো বাড়ি পেয়েছি থাকার জন্য! আর কি চাই? এই পর্যন্ত আপনি আমার জন্য যা কিছু করেছেন তার সবটাই আমি শোধ করে দিবো। তাই চাকরি আমাকে করতেই হবে।’
মাইজিন কথা হারিয়ে অবাক চোখে তাকিয়ে রইলো তুলিকার দিকে। তার ঔদ্ধত্যপূর্ণ চাহনি উপেক্ষা করতে পারলো না তুলিকা। আবার পর মুহুর্তে মাইজিনের সেই এরোগেন্স ভাব বদলেও গেলো। শুধু স্থির হয়ে চেয়ে রইলো তার দিকে।
‘ হ্যাঁ আমি সবটা শোধ করে দিবো। আর সেজন্য আমার চাকরির প্রয়োজন ভীষণ! চাকরি পেলে এখান থেকে মিষ্টি আর আমি চলে যাবো। আপনার বোঝা হবো না আমরা! অনেক বোঝা হয়েছি অন্যের। এবার নিজেকেই কিছু করতে হবে। এবার সময় এসেছে অন্যের বোঝা না হয়ে নিজে কিছু করে দেখানোর। তা না হলে যেখানেই যাবো সেখানেই সবাই দূর দূর, ছাঁই ছাঁই করবে।’
কথাগুলো বলতে গিয়ে তুলিকা অনুভব করলো তার গলা ধরে আসছে। কণ্ঠনালীতে শক্ত কিছু আটকে আছে যেনো। কথা বের হচ্ছিলো না ভালোভাবে৷ মাইজিনের চেহারায় এবার বিভ্রান্ততা দেখা গেলো। এতোক্ষণে তাকে দেখা বোঝা যাচ্ছে সে অনুশোচনা বোধ করছে ভীষণ ভাবে। কিন্তু এখন এ অনুশোচনা বোধ করে কি কোনো লাভ হবে? সে তো তার শক্ত কথার বাণে তুলিকাকে ভীষণভাবে আঘাত করে ফেলেছে। এখন এ আঘাতের ক্ষ’ত কি তার অসহায়ত্বের কথা শুনে শুকিয়ে যাবে! মোটেও না। যেভাবেই হোক, যে কারণেই হোক না কেন তার মনের সুপ্ত রাগ তো মাইজিন নিয়ন্ত্রণ করতে পারেনি। তার সঙ্গে যা কিছুই হোক না কেন, পরোক্ষভাবে তো সে ওই খারাপ ব্যবহার ডিজার্ভ করেনা তাই না? মাইজিন তাকে তার সমস্যার কথা বলতে পারতো! সে কি বুঝতো না? সে তো অবুঝ নয় একেবারে! বুঝিয়ে বা ইশারায় বললেও তো সে বুঝতো। তুলিকা তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে তার মুখপানে তাকিয়ে আবার বললো,
‘জানেন, মানুষের মুখের ক’টু কথা বন্দুকের গুলির আগে কলিজায় আ’ঘাত হানে? আপনি আমাকে আপনার কথার বা’নে মে’রে’ছেন। সেই কথা গুলো না চাইলেও ফেরাতে পারবেন না আপনি। আমার বুড়ো দাদু বলতেন সব সময়। ❝সাফল্যের চেয়ে ব্যর্থতার থেকে বেশি কিছু শেখা যায়। কারণ ব্যর্থতা কখনো থামতে দেই না। এটি চরিত্র গঠন করে। যদি তোমার সফল হওয়ার সংকল্প দৃঢ় হয় তাহলে ব্যর্থতা তোমাকে কখনোই অতিক্রম করবে না।❞ এই কথা টা কেন বললাম জানেন, আপনি হলেন আমার জীবনের সেই ব্যর্থতা। আপনার জন্য আমার হৃদয় ক্ষ’ত বিক্ষ’ত হয়েছে ঠিকই কিন্তু আমি এখনো শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে আছি আপনার সামনে। আমি একটা শিক্ষা লাভ করেছি আপনার জন্য! এবারে আপনার মুক্তি। চাকরি টা পেলেই ডিভোর্স কার্যকর এর ব্যবস্থা করে ফেলবো।’
মাইজিন এই পর্যায়ে গিয়ে ভীষণ রেগে যায়!
‘এই মুহুর্তে আপনি রুমে যাবেন। এক পাও এগোলো পা ভেঙে ঘরে ফেলে দিবো। কোনো মুক্তি নেই আপনার আমার থেকে। আপনি আমার একান্ত ব্যাক্তিগত মানুষ, আমিই আপনাকে আঘাত দিবো, আমিই আপনার সেই আঘাতে প্রলেপ দিবো। কিন্তু ছেড়ে যাওয়ার কথা যেনো ভুলেও আর না শুনি। তা হলে মাইজিন সুলতানের ভালোবাসা দেখেছেন এই পর্যন্ত এরপর দেখবেন তার খড়তা!’
তুলিকা কিছু বলতে নেয় কিন্তু পরক্ষণেই মাইজিনের ক্রোধান্বিত রক্তিম নেত্রের দিকে তাকিয়ে আর কিছু বলার সাহস পেলো না। এর মূখ্য কারণ সে কখনোই এর আগে মাইজিনকে রাগ করতে দেখে নি। তার সামনে তো এক্কেবারেই না। উপরন্তু এই মুহুর্তে কিছু বলা মানে বিস্ফোরণ ঘটানো। তাই অবশেষে আজ আর বেরোলো না তুলিকা। এক মুহূর্ত বিলম্ব করে না অন্য রুমে গিয়ে দরজা আটকে বসে রইলো। মাইজিনও শব্দ করে রুমের দরজা লাগিয় দিলো। নাফিসকে কল করে ডাকলো এই ঘরে। সঙ্গে গিটার আনতে বললো যাতে করে রাগ টাকে দমন করতে পারে সে। কথা মতো নাফিস উপস্থিত হলো।
‘হঠাৎ কি হলো? এতো রাগের উৎস কি?’
‘আর বলিস না তুলিকা কি সব উলটো পালটা কথা বলছে। সে সময় কি বলতে কি বলে ফেলেছি ওই কথায় ধরে বসে আছে। আমি নাকি ওঁকে দয়া দেখিয়ে বিয়ে করেছি। ওঁ এখন সেই দয়ার বিয়ে থেকে মুক্তি দেবে আমাকে।’
‘তুই ভাবিকে সবটা বলছিস না কেন? আমি শিওর সত্যিটা জানলে ভাবি আর এমন করবে না!’
‘এখন বললে বলবে যে আগে তো অনেক বলার সময় ছিলো তখন কেন বলিনি। বললেই তো সবটা সমাধান হতো। এখন মনে হচ্ছে বলেও লাভ নেই। আমি মানছি আমি অনেক ভুল করেছি কিন্তু তার কারণ ছিলো! তাই বলে সে আমাকে ছেড়ে দেওয়ার কথা বলবে? সে আমাকে অন্য সব শাস্তি দিক আমি মাথা পেতে নেবো কিন্তু ছেড়ে যেতে চাইলেই মে’রে ফেলবো একেবারে!’
‘ আরে বন্ধু আমার দেখি ভাবির প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছে। তবে আগেই যদি বলতি তবে হইতো এই পরিস্থিতি হতোই না।’
‘আরে নাফিস কিভাবে বলতাম বল তো? তখন পরিস্থিতি কি ছিলো সেটা এক মাত্র আমিই জানি। তুই তো জানিস সবটা!’
‘আংকেল না ফিরলে তো বেরিয়ে আসতে পারতি না মনে হয়। আংকেলকে জানাচ্ছিস না কেন তুই?’
‘ বাবা এসেছেন বলেই আসতে পেরেছি। ওই মহিলাও আসতে দিয়েছে ধরা পরবে বলে। ওই মহিলা যে আমাকে মিথ্যা বলে নিয়ে যাবে আমি ঘুনাক্ষরেও টের পাইনি। নেহাৎ মাকে কথা দিয়েছি তা না হলে সব বলে দিতাম বাবাকে। আমি আমার মায়ের কথা রাখতে সব করতে পারি। যত যন্ত্রণায় সইতে হোক না কেন আমার। মাকে কথা দিয়েছি তাই এখনো অব্দি ওই মহিলা অক্ষত আছেন। না হলে এই মাইজিন সুলতান কখনোই তাকে ছা’ড় দিতো না।’ ক্ষুব্ধ হয়ে বললো মাইজিন।
‘আচ্ছা রিলেক্স হো। এই নে তোর গিটার। বাজিয়ে রাগ নিয়ন্ত্রণ কর। গিটার বাজালে তো আবার তোর রাগ পানি হয়ে যায়।’
মাইজিন গিটার হাতে নিয়ে টুংটাং শব্দ তুললো গিটারে। এক সময় এই গিটার ছাড়া সে কিছু বুঝতো না। কিন্তু এখন এই গিটার তার থেকে অনেকটাই দূরে চলে গেছে। শখের গিটার এখন সেভাবে বাজানো হয় না আর। মাইজিন জোর গলায় গান ধরলো।
❝তুমি না ডাকলে আসবো না
কাছে না এসে ভালোবাসবো না
দুরত্ব কি ভালোবাসা বাড়ায়?
না কি চলে যাওয়ার বাহানা বানায়?
দূরের আকাশ নীল থেকে লাল
গল্পটা পুরনো!
ডুবে ডুবে ভালোবাসি
তুমি না বাসলেও আমি বাসি,
ডুবে ডুবে ভালোবাসি
তুমি না বাসলেও আমি বাসি!❞
#চলবে