#হীরকচূর্ণ_ভালোবাসা
#পর্ব২২
#রাউফুন
দ্বিপ্রহরিক আলস্য কাটিয়ে উঠে বসে তুলিকা। সেদিনের ঘটনার পর থেকে সে আরও কথা বলতে পারেনি মাইজিনের সাথে। বলতে গেলে কোনো রকম বাক্য বিনিময় করেনি নিজে থেকে। শুধু মাইজিন কিছু জিজ্ঞেস করলে তার প্রতুত্তরে কথার উত্তর দিয়েছে। মাইজিন তবুও অটল থেকে তুলিকাকে আপন করার চেষ্টার প্রয়াস চালাচ্ছে। সংশ্লিষ্ট ভাবে সে তুলিকাকে সম্পুর্ন খুশি করার চেষ্টা করছে নিজের কর্মকাণ্ড করে। রোজ আলাদা আলাদা ভাষায় কিছু একটা বলে যাচ্ছে অফিসে যাওয়ার আগে। না বুঝতে পেরে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে ছিলো শুধু। প্রথম দিন যেদিন বলেছে সেদিন কি যেনো ছিলো? তুলিকা মাথায় হাত ভাবার মতো করে আওড়ালো, ‘ওহ হ্যাঁ তি আমো! পরদিন বলেছে, ইয়া তেবয়া লিউব্লিউ!’
এরপর, নান্নু নিনান্নু প্রীতিসুথিন!’
তারপর, ইস লিবে দিস!’
উম তারপর, ফ্ইয়ে তাইমে!’
মুই তোমাকে ভাল্ পাও!’
লাষ্টের টা তুলিকা বুঝতে পেরেছিলো। বুঝতে পেরে খুব খুশি হয়েছিলো বটে। কিন্তু এতো কিছুর পরেও সে কিছুতেই মাইজিনকে সহজ ভাবে নিতেই পারছে না।
চলতি সময়ের মধ্যেই যেন সূর্যকরোজ্জ্বল গগনের মন ক্ষুণ্ণ হলো। শেফালি ফুলের নরম গায়ে অনিল আঁচড় কাটতেই দোলায়মান হলো তারা। ঝপঝপ শব্দ করে শালিকের দল উড়ে গেল দিগন্তে। আকাশ জুড়ে তখন কৃষ্ণমেঘের রাজত্ব। দিবালোক হয়েও যেনো নিশুতি রাতের প্রহর চলছে। কিঞ্চিৎ সময় যেতে না যেতেই গা ঝাঁকুনি দিয়ে এক পলশা বৃষ্টি নামলো তপ্ত ধরার মধ্যখানে৷ আলতোভাবে ছুঁয়ে সিক্ত করে তুললো শুভ্রতায় মোড়ানো কোমল ফুলের গা। অকৃত্রিম ঘ্রাণে মাতোয়ারা হলো আশপাশ। তুলিকা মন প্রাণ ভরে ঝমঝমিয়ে পরা বৃষ্টি উপভোগ করতে লাগলো। এই তো সেদিন বৃষ্টিতে ভিজে ভিজে মাইজিনকে ফলো করেছিলো সে। কি এমন সত্যি ছিলো যার জন্য মাইজিন তার সাথে এরুপ আচরণ করেছিলো। ঠিক কতটা কষ্ট তাকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরেছিলো তার করা ব্যবহারে সে খোঁজ তো মাইজিন রাখেনি! ঐ তিক্ততায় ভরা দুটো দিন কোনো ভাবেই ভুলে উঠতে পারে না সে৷ মন থেকে মাইজিনের সঙ্গে সহজ হতেই পারছে না। চেষ্টা তো করছে সে মাইজিনের সঙ্গে স্বাভাবিক হওয়ার। কিন্তু আসলেই কি ততটাই সহজ এভাবে একটা সম্পর্ক স্বাভাবিক করা? সে যে মানতে পারে না কোনো ভাবেই৷ তুলিকার কোনো কিছু থেকে একবার মন উঠে গেলে সেখানে মন বসাতে পারে না চাইলেও। এমন কি কোনো খারাপ আচরণ ও সে সহজে ভুলে যেতে পারে না। এই যে মাইজিনের খারাপ আচরণের পর আজ পাঁচ টা মাস কেটে গেছে তবুও সে ভুলতে পারেনি। মাইজিনকে মানতে পারেনি এতো যত্ন, এতো ভালোবাসার পরেও। মাইজিনের তার উপেক্ষার ফলে যে কতটা কষ্ট হয় সেটা খুব ভালো ভাবে উপলব্ধি করতে পারে কিন্তু তাও নিজের ইগোটাকেই সে বড় করে দেখছে। তম্বন্ধে তার কলিংবেলের শব্দে ঘোর কাটলো তুলিকার৷ সে দরজা খুলে দিলো। মাইজিন ভিজে জুবুথুবু ভাবে ফিরেছে। এই বৃষ্টিতে আবার না জ্বর বাঁধিয়ে ফেলে। মনে মনে চিন্তা হলেও তুলিকা মুখে কিছু বললো না।
মাইজিন স্বাভাবিক ভাবে ঘরে ঢুকে চেঞ্জ করে নিলো। আজকে বেশি ভিজেনি সে কিন্তু বৃষ্টির পানিতে তার অসুখ বাঁধানোর ধাত আছে।
‘আজ তারাতাড়ি ফিরলেন যে?’
‘এমনিতেই ভালো লাগছিলো না। ভাবলাম বউ বাড়িতে একা তাই বউকে কাম্পানি দিতে চলে এলাম! এক সাথে দু কাপ কড়া কফির সঙ্গে কোয়ালিটি টাইম স্পেন্ড করা যাবে!’
মাইজিন ঠোঁট পাউট করে চোখ টিপে চুমু দেওয়ার ভঙ্গি করলো। বিষম খেলো তুলিকা। দিন দিন মাইজিনের দুষ্টামির মাত্রা বাড়ছে তো বাড়ছেই। মাঝে মাঝে এমন বেফাঁস কথা বলে যে না হেসে পারে না সে। তুলিকা কফি করতে চলে গেলো গম্ভীর মুখে। মাইজিন তার যাওয়ার পানে তাকিয়ে রইলো শুধু। কোনো ভাবেই মেডামের মন পাচ্ছে না যে। ভালো লাগছে না তার। আজকে তুলিকাকে সত্যিটা বলবে সে। তাতে তুলিকা কষ্ট পেলে পাক কিন্তু তুলিকার স্বাভাবিক হওয়া টা জরুরি! যখন কেউ কারো প্রতি মমতা বোধ করে তখনই সে লজিক থেকে সরে আসতে শুরু করে। মায়া-মমতা, ভালোবাসা এসব যুক্তির বাইরের ব্যাপার। বেশি নৈকট্য দূরত্বের সৃষ্টি করে। তাই মাঝে মধ্যে প্রিয়জনদের থেকে দূরে থাকাই ভালো। সম্পর্ক স্থির নয়, পরিবর্তনশীল। সে যখন তুলিকার থেকে দূরত্বে ছিলো প্রতিটি মুহুর্তে মুহুর্তে উপলব্ধি করেছে সে ঠিক কতটা ভালোবাসে তুলিকাকে। কিন্তু খারাপ ব্যবহার করার পর সাহস হয়ে উঠেনি তুলিকাকে মনের কথা বলতে৷ তুলিকা কফি করে আনলে মাইজিন অকস্মাৎ তুলিকাকে বললো,
‘এদিক আসেন। আমার আপনার সাথে কথা আছে।’
মাইজিনের কন্ঠ কৌতূহল শোনায়। তুলিকা কিঞ্চিৎ অবাক হলো বোধহয়। এক সাথে কিছু অনুভূতির সংমিশ্রণে অদ্ভুত এক বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হলো মনে। সে ক্ষীণ কন্ঠে বলল, ‘আপনার কথা শুনে মনে হচ্ছে আপনি খুব সিরিয়াস কিছু বলতে চাচ্ছেন!’
‘হুম। বসুন আমার সামনে।’
দুজনে কফি হাতে বসে। বাইরে বৃষ্টি তুমুল বেগে বাড়ছে। পুতুল হইতো বৃষ্টির দাপটে স্কুল থেকে বেরোতে পারেনি। প্রাইভেট শেষ করে আসতে আসতে ছয়টা বাজবে মেয়েটার। পুতুলের হাতে মুঠোফোন আছে। সে ফোন করেছিলো কফি করতে করতে। সে প্রাইভেট যাবে স্কুল থেকে বেরিয়ে। মাইজিন গলা পরিষ্কার করে দম নিলো। লম্বা শ্বাস ছেড়ে বলা শুরু করলো।
‘আমার জীবনের কিছু তিক্ত অভিজ্ঞতার কথা
জানাবো আপনাকে। আমার মা আসমা সিদ্দিকা আর শাপলা সিদ্দিকা উনারা দুইজন জমজ বোন৷ আমি আসমা সিদ্দিকার ছেলে। শাপলা সিদ্দিকা সম্পর্কে আমার খালামনি। মায়ের মৃ’ত্যুর পর শাপলা খালামনিকে মায়ের কথা রাখতে বাবাকে বিয়ে করতে হয়। আমি তখন বারো বছরের না বালক একটা ছেলে। মায়ের মৃত্যুতে শোকাভিভূত আমি মাকে সারাদিন খুঁজে যেতাম। তখন বাবা বাধ্য হয়ে শাপলা খালামনিকে বিয়ে করেন৷ আপনি সব সময় বলেন না? কেন আমি আপনাকে আপনার কাজে সাহায্য করি? আমি কোনো সময়ই চাই না আমার মায়ের মতোই আপনিও কষ্ট পান। আমি দেখেছি আমার মাকে তিলে তিলে শেষ হয়ে যেতে। আমি দেখতাম আমার দাদি, আমার মাকে কিভাবে নির্যাতন করতেন। কতটা কষ্ট দিতেন। মা সারাদিন রাত খে’টে ম’র’তো দাদির মন পাওয়ার জন্য কিন্তু কোনো ভাবেই মন জিতেনি। এমন কি তিন বেলার খাবার পর্যন্ত মাকে ঠিক মতো দিতেন না। হাড়ির শেষ পোড়া ভাত টুকু দেখতাম মা শেষে ক্ষুধার জ্বালায় চেটে পুটে খেয়ে নিচ্ছেন। এমনই চলতে চলতে দিন কে দিন মায়ের শরীরের অবস্থা খারাপ হতে থাকে। জানি না মায়ের কি অসুখ করেছিলো কিন্তু অসুখ তো ছিলো। সেটাও ভয়াবহ!’
মাইজিন থামলো। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে সে আড়ালে তার চোখ মুছে নিলো। এখনো চোখ পানিতে টইটম্বুর হয়ে চিকচিক করছে। তুলিকারও চোখ ভিজে উঠে। অবাক হয়ে জানতে চাইলো তুলিকা।
‘আংকেল কি এসব দেখতেন না?’
‘বাবা বুঝতে পারতেন কিন্তু তিনি ছিলেন নির্লিপ্ত! আমার দাদির মুখের উপর কোনো দিন ও কথা বলতেন না। উনাকে খুব সমীহ করতেন।’
‘যখন এতো কথা উঠলোই তবে এটাও বলুন আপনার শরীরে ক্ষত স্থানের কারণ কি? আমি সেদিন ভালো ভাবে দেখেছি অনেক পুরনো দা’গ ও আপনার শরীরে আছে। তার মানে আপনি এর আগেও এমন নিপীড়ন চালিয়েছে কেউ। কার নির্যা’তনের শিকার হয়েছিলেন আপনি?’
‘সেদিন আমাকে শাপলা খালামনি ফোন করে বলেছিলেন বাবা এসেছেন প্যারিস থেকে। আমি বাবার কথা শুনেই ওখানে যায়। কিন্তু গিয়ে দেখি বাবা আসেন নি। উনি মিথ্যা বলে আমাকে নিয়ে যান। বাবা আসার আগেই আমাকে উনার ভাগনি শারমিনের সঙ্গে বিয়ে দিয়ে আমার সম্পত্তি হাতাতে চাইছিলেন। কিন্তু আমি শারমিনকে বিয়ে করতে রাজি হয়নি। আমি তো আপনাকে ভালোবাসি তবে শারমিন কে কিভাবে বিয়ে করতাম? আমি বিয়ে করতে রাজি হয়নি বলে আমার উপর ট’র্চা’র করেন তিনি। যখন আমি বিয়ে করতে চাইনি তখন আমার সম্পত্তির কাগজে সাইন করাতে চেয়েছিলেন কিন্তু সক্ষম হয়নি। এর মধ্যে আমি আপনাকে ফোন করার চেষ্টা করেছি কিন্তু আমার ফোন তো কে’ড়ে নিয়েছিলেন ওই মহিলা। কোনো ভাবেই যোগাযোগ করতে পারিনি আপনার সঙ্গে। দুই বার উইলের কথা বলে বাড়ি থেকে বেরিয়ে আপনাকে দেখেছি। নাফিসের মাধ্যমে খোঁজ নিতাম আমি। নাফিস আপনার সকল প্রকার খবরাখবর আমাকে দিতো।আমার রুমে যে লুকানো ল্যাপটপ ছিলো এটা জানতো না কেউ-ই। কোনো ভাবেই যদি আপনার কথা শাপলা সিদ্দিকা জানতে পারতেন তবে যে আপনার ক্ষতি করতেন উনি। উনি কতটা সাংঘাতিক মহিলা ছোট বেলা থেকেই তা আমি জানি। তাই পারিপার্শ্বিক ভাবে আপনার সঙ্গে বাজে ব্যবহার করে ফেলি। আমার বাড়িতে কোণায় কোণায় সিসি ক্যামেরা রয়েছে সেই মুহুর্তে আপনাকে ক্যামেরায় দেখলেই চিনে ফেলতেন তিনি। আর আমার সঙ্গে সম্পর্ক আছে আপনার এটা ঠিক জেনে নিতেন আর আপনার ক্ষতি করে আমাকে ব্ল্যা’কমেইল করে সম্পত্তির কাগজে সাইন নিয়ে নিতো। আর বা’জে ব্যবহার না করলে আপনি আসতেন ও না। আমি নিরুপায় ছিলাম। এরপর বাবা এলেন আরও পনেরো দিন পর। বাবা আসার পর আমার ওরকম অবস্থা দেখার আগেই বাড়ি থেকে পালিয়ে এসেছি আমি। আমি আগেও পালাতে পারতাম। তবে ওই মহিলা ঠিক আমার ঠিকানা খুঁজে বের করতো। আর আপনার সম্পর্কে জেনে যেতো। আপনার ক্ষতি হবে ভেবেই আমি কিছু করতে পারিনি। আমার পুঙ্খাঅনুপুঙ্খ খবরা খবর তিনি ঠিক লোক লাগিয়ে জেনে নিতেন। সেদিন চেয়েছিলাম রাস্তায় আপনাকে সব কথা বলতে কিন্তু আমার উপর সব সময় নজর রাখতো ওই মহিলার লোক। দ্বিতীয় দিন বলতে চাইলাম কিন্তু সেদিনও শাপলা সিদ্দিকার লোক আপনার পাশ কে’টে চলে গিয়ে আমাকে এলার্ট করেছে। বিশ্বাস করুন তুলিকা আপনাকে না চেনার ভান করা, আপনার সঙ্গে দুর্ব্যবহার করার পর আমি নিজেও দগ্ধ হচ্ছিলাম প্রতিটি মুহুর্তে। কতটা মুমুর্ষ সময় পার করেছি কেবলই আমার আল্লাহ আর আমি জানি।’
ততক্ষণে তুলিকা হাউমাউ করে কান্না জুড়ে দিয়েছে।
কান্না বিজড়িত কন্ঠে বলে,’ আপনি এসব সহ্য করেছেন কেন? আংকেলকে বলেননি কেন?’
‘বাবা যখন থাকতেন তখন শাপলা সিদ্দিকা আমার সঙ্গে ভালো আচরণ করতেন কিন্তু বাবা না থাকলেই কোনো একটা কারণে আমাকে এমন নির্মমভাবে নির্যা’তন করতেন। উনার চোখে মুখে আমি মায়ের চেহারাটা খুঁজে পেতাম তাই তার করা অত্যা’চার সহ্য করেছি ছোট বেলা থেকে। আমার শরীরের অগণিত দা’গ যেগুলো ওই মহিলার দেওয়া আঘা’তের চিহ্ন। আর বাবাকে বলতে পারিনি কারণ মা মা’রা যাওয়ার আগে আমাকে বলেছিলেন, ‘শাপলা খালামনিকে মা হিসেবে মেনে নিতে। উনার সব কথা অক্ষরে অক্ষরে মেনে নিতে। উনি আমার সঙ্গে যা কিছুই করুন না কেন সেসব যেনো কাউকেই না বলি!’
‘আপনার কি মনে হয় না, আপনার মা সবটাই আন্দাজ করতে পেরেছিলেন আগে থেকেই। শাপলা আন্টির সঙ্গে হইতো কোনো ভাবে আংকেলের কোনো অবৈধ সম্পর্ক ছিলো যেটা আপনার মা জানতে পেরেছিলেন আর আপনাকে আগাম বার্তা দিয়েছিলেন এসবের। না হলে তিনি আগে থেকেই এসব কিভাবে কথা দেয়ালেন?’
‘জানি না আমি। আমারও এখানে খটকা লাগে কিন্তু উত্তর পাইনি আজও।’
‘শাপলা আন্টিকে দেখে তো মনে হয়নি উনি এতোটা নিচ মানুষ!’
বিদ্রুপাত্মক হাসিটা ঠোঁটের প্রান্ত অব্দি এসেও অদৃশ্য হয়ে গেল তার। কারণ ওই মহিলা কেমন ধারা মানুষ সেটা তো সে জানে। তবে মুখে কিছু বললো না মাইজিন।
#চলবে
#হীরকচূর্ণ_ভালোবাসা
#পর্ব২৩
#রাউফুন
‘আপনি আপনার বাবার সঙ্গে কথা বলেন না কেন? নাহ মানে এখানে আসার পর দেখিনি আপনাকে উনার সঙ্গে কথা বলতে। তাছাড়া কতদিন থেকে এখানেই থাকছেন। আপনার বাড়ি থেকে তো কোনো খোঁজ খবর নিচ্ছে না কেউ?’
মাইজিন কিয়ৎক্ষন মৌনতা বজায় রাখে তুলিকার এই প্রশ্নে। সুদীর্ঘ শ্বাস ফেলে বলে,
‘আমি ওঁদের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করেছি। সম্পত্তির অর্ধেকটা বাবাকে দিয়েছি। রাজশাহীর ফ্যাক্টরির নিচের ডিপার্টমেন্টের সম্পুর্নটা শুধুই এখন আমার। আর বাকি ডিপার্টমেন্টটা বাবার! আমি সবটাই দিয়ে দিতে পারতাম কিন্তু বাকি সম্পত্তি তো মায়ের। আমি আমার মায়ের সম্পত্তির অংশ কাউকে দিবো না। আর বাবার সঙ্গে দেখা হয় কিন্তু কথা বলতে পারি না। হইতো সংকোচে কিংবা অস্বস্তিতে।’
‘আংকেল আপনাকে কোনো রকম প্রশ্ন করেন নি? কেন আপনি এমন করলেন?
মাইজিন প্রসঙ্গ পালটে বলল, ‘ছাড়ুন না ওসব!’
‘এখন আমার মনে হচ্ছে আপনি শুধু মাত্র আমার জন্য এতোটা সেক্রিফাইজ করলেন। আমি না থাকলে হইতো এতোটা দু-টানা থাকতো না আপনার জীবনে।’
‘উঁহু আপনার জন্য না তো। আমার জন্য করেছি সবটা। আমার আপনার সঙ্গে ভালো থাকাটা ভীষণ ইম্পর্ট্যান্ট আমার কাছে! আমার আপনার প্রতি ভালোবাসা! মোহ, সবকিছুই আরোপিত আপনার কাছে, শুধুই আপনার কাছে সমর্পণ করেছি সবটা। মানুষ বলে মোহের কাছে পরাজিত হওয়া ঠিক নয়। কিন্তু খুব কম মানুষই মোহ যুদ্ধে অপরাজিত থাকে। আপনার সঙ্গে যতদিন ছিলাম খুব সুন্দর ছিলো সবটা৷ আমি আমার লাইফের বেস্ট সময় কাটাচ্ছিলাম সে-সময়। খুব বেশি সুন্দর কোন কিছু দীর্ঘস্থায়ী হয় না! তাই তো আমার জীবনেও স্থায়ী হয়নি সে-সময়। ভীষণ ভয় হয় আমার। এই ছোট ছোট মুহুর্ত, আপনার সঙ্গে কাটানো সুখের মুহুর্ত হারানোর ভয়, আপনাকে হারানোর ভয় হয়।’
‘ভয় পাবেন না আমি আছিতো।আমিও সেই সুন্দর দিন গুলো মন সাপটে গেঁথে রাখবো আজীবন। সবচেয়ে সুন্দর কিছু মুহুর্ত উপভোগ করেছি আমি তখনই। তাই ওই সব স্মৃতি রোমন্থন করে রাখা আমার দায়িত্ব!’
‘আপনার জীবনে কি সত্যিই খুব সুন্দর কিছু উপভোগ করতে দিয়েছি আমি? আপনাকে ভালো রাখার প্রতিশ্রুতি দিয়েও আপনাকে ভালো রাখতে পারিনি। উলটো একটা সমস্যার জন্য আপনাকে দূরে ঠেলে দিয়েছিলাম খুব নোং’রা ভাবে। আমাকে ক্ষমা করবেন তুলিকা। আমি সত্যিই ক্ষমা চাওয়ার মুখ রাখিনি আপনার কাছে কিন্তু তবুও আপনার তরে ক্ষমা প্রার্থনা করছি। পারলে এই অধম টাকে ক্ষমা করে দিন!’
‘আমি ছোট্ট একটা উপদেশ দেয় মাইজিন সুলতানকে? ক্ষমা চাওয়ার ফার্স্ট কন্ডিশন হলো,যে কারণে ক্ষমাটা চাচ্ছেন সেটা যেনো দ্বিতীয়বার আর না হয় এবং নিজে থেকে শ্বপথ নেয়া এরকমটা যেনো আর না হয়। মানুষ মাত্রই ভুল হয়। কিন্তু সেই ভুল থেকে শিক্ষা নেওয়ার নামই মনুষ্যত্ব। আপনি যখন সবার সাথে চলবেন,সবাইকে সম্মান করবেন, দেখবেন সম্মান যতটুকু আপনার প্রাপ্য সেটুকু ঠিকই আপনার ঝুঁলিতে আসবে।’
মাইজিন কিছু না বলে অপলক তাকিয়ে থাকে তুলিকার দিকে। স্পষ্ট ব্যথিত নয়ন তার। সে মোলায়েম কণ্ঠে বলে, ‘আপনার মনে আমাকে নিয়ে আর কোনো স্বংশয় নেই তো? আপনি ক্ষমা না করলে যে আমি শান্তি পাবো না।’
‘আমার কাছে আপনার কোনো ভুল নেই বলবো না। ভুল তো আপনার ছিলো তবে সেই ভুলের পরিপ্রেক্ষিতে যে আমি আপনার করা সব ভালো কিছুকে ভুলে যাবো তা তো নয়। ওই যে বললাম, মানুষ মাত্রই ভুল হয়। যেহেতু আপনি মন থেকে ক্ষমা চাইছেন তবে ক্ষমা করলাম। ক্ষমা করা মহৎ গুণ। আর যেনো এমন না হয়!’
‘ঠিক আছে।’ খুশিতে গদগদ হয়ে মাইজিন তুলিকাকে জড়িয়ে ধরতে উদ্যত হলেও হাত ফিরিয়ে নিয়ে মাথার পেছনে হাত দিয়ে চুলকে নিলো। মাইজিনকে অবাক করে দিয়ে তুলিকা মাইজিনের দু হাত নিয়ে নিজের কোমড়ে ধরিয়ে দিলো। অতঃপর নিজে থেকেই মাইজিনের গলা আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরলো। যারপরনাই অবাক হয়ে মাইজিন তুলিকাকে প্রথম বারের মতো সজ্ঞানে স্পর্শ করলো। যা ছিলো অপ্রত্যাশিত! মাইজিন তুলিকার এলোকেশীতে চুমু দিয়ে বললো,
‘এই পৃথিবীতে চেয়েছি তোমাকে,
এক সমুদ্র ভালোবাসা রয়েছে এই বুকে,
যদি কাছে আসতে দাও, যদি ভালোবাসতে দাও,
এক জনম নয়, হাজার জনম ভালোবাসবো তোমাকে।’
লজ্জায় আড়ষ্ট হয়ে মুখ লুকালো তুলিকা।
‘লজ্জা পাওয়ার জন্য বেস্ট স্থানটা চুজ করেছেন মিসেস সুলতান!’
•
সুন্দর এক সকালের সঙ্গে মাইজিনের ঘুম ভাঙে।
প্রাণ প্রিয় প্রেয়সীর এক গাছি চুল এলোমেলো হয়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে পুরো মুখশ্রী জুড়ে। মেয়েটাকে বাচ্চা বাচ্চা লাগছে পুরো। ঘুম ভাঙ্গায় না আর সে। স্মিত মুখে তাকিয়ে থাকে। আকস্মিক তার ইচ্ছে করে চুলগুলো গুছিয়ে দিয়ে তাকে নিজের কাছে টেনে নিতে৷ কিন্তু এটা যে এই মুহূর্তে সম্ভব নয়৷ একটা সুন্দর দিনের পর তাদের জীবনের নতুন সূচনা করবে। মাইজিন দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে মোহগ্রস্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলো তার স্ত্রীর দিকে। ক্ষণেই নিজেকে ছন্নছাড়া লাগলো তার। মস্তিষ্ক হলো শূণ্য। আনমনে আওড়ায় সে, ‘ আপনার সম্মোহনের কাছে মদ্যপনেশাও অতি নগন্য তুলিকা।’
অনেক দিন পর মাইজিন ব্রেকফাস্ট তৈরি করলো সেই পুরনো দিনের মতো। তুলিকার আজকে ভীষণ খুশি খুশি লাগছে। কোনো এক ভালো লাগায় আবিষ্ট হচ্ছে মন। মনে হচ্ছে মন থেকে ভারী কিছু সরে গেছে। কালকে মাইজিনের তার কাছে সবটা শেয়ার করাই হইতো। মাইজিনকে নিয়ে ভাবতে আরও বেশিই ভালো লাগছে। তুলিকা বিছানা ছেড়ে উঠে রান্না ঘরের দিকে যায়। সে জানে মাইজিনকে এই মুহুর্তে রান্না ঘরেই পাবে। আজকে আর মাইজিনকে কিছু বললো না। সেও কাজে হাত লাগাই। মাইজিন সাহস করে তুলিকাকে জড়িয়ে ধরে পেছন থেকে৷ আকস্মিক স্পর্শে কেঁপে উঠে তুলিকা। কাল হঠাৎই কি হয়েছিলো তার? লাজ লজ্জা ভুলে মাইজিনকে জড়িয়ে ধরেছিলো। ভাবতেই লজ্জায় লাল হয়ে যাচ্ছে সে। পোড়া গন্ধে মিষ্টি আসে এখানে। এমন দৃশ্য দেখতেই খুক খুক করে কাশে। ঝটপট সরে দাঁড়িয়ে পরলো মাইজিন। মিষ্টি অপ্রস্তুত হয়ে মিনমিন করে বলে,
‘আপু ভাজি পুড়ে যাচ্ছে। আর একটু তারাতাড়ি করলে ভালো হয়। আমার স্কুলের দেরি হচ্ছে!’
‘তুই যা। হয়ে এসেছে সব রান্না।’
মিষ্টি নিজের বুবুজানকে আর অস্বস্তিতে ফেলতে চাইলো না। ঠোঁট চেপে হেসে রুমে চলে গেলো। ফোন হাতে নিয়ে কাউকে একটা ফোন করলো সে।
তুলিকা ফোস করে শ্বাস ফেলে বলে, ‘ইশ কি ভাববে এখন মিষ্টি। ওর সামনে যাবো কি করে এখন আমি?’
‘আমি কি করে জানবো এখন মিষ্টি আসবে।’
‘আচ্ছা যদি সত্যিই আমি প্রেগন্যান্ট হতাম তখন? আপনি আমাকে স্পর্শ করেন নি! তাহলে হুট করে আমি মা হতে যাচ্ছি যখন শুনলেন তখন আমাকে সন্দেহ হলো না একটুও? আমাকে নিয়ে মনে সন্দেহের বীজ বপন হতেই পারতো। আপনি তো এক মুহুর্তের জন্যও আমাকে সন্দেহ করেন নি? যদি সত্যিই রিপোর্ট টা আমারই হতো?’
হুট করেই মাইজিন তুলিকার দুই গালে হাত গলিয়ে নিজের দিকে মুখ ঘুরালো। মন্থর কন্ঠে বলল, ‘যে মেয়েটা নিজের স্বামীকে স্পর্শ করতে দেইনি এখনো অব্দি। সেই মেয়েটা যে অন্তত কোনো আজে-বা-জে কাজ করবে না সে আমি জানি। মেয়েটা বাজে সম্পর্কে লিপ্ত হবে এটা আমার ভাবনায় কেন, আমার মাথাতেও আসতো না। এমন নিকৃষ্ট চিন্তা যেনো আমার না আসে কোনো দিনও। আপনি আমার পবিত্র ফুল। শুধুই আমার ফুল।’
তুলিকা মাইজিনের দিকে ছলছল করে তাকিয়ে থাকে। মাইজিন তুলিকার গাল থেকে হাত সরিয়ে মুচকি হাসে। মশকরা করে বলল,
‘যদি বাচ্চা আসতোও না, সমস্যা ছিলো না আমার। ফ্রীতে একটা বাচ্চা তো পেতাম!’
‘আপনি আমাকে এতোটা বিশ্বাস করেন মাইজিন?’
‘যাকে ভালোবাসি তাকে অবিশ্বাস করবো কিভাবে? তাহলে তো ভালোবাসা শব্দটাই নড়বড়ে হয়ে যাবে। ভালোবাসা নামক পবিত্রতাকে বিকৃত করা হবে। এই পাগলি কাঁন্না করেন কেন? বলেছিলাম না আমার সামনে কাঁদবেন না? আমি ভুল করলে আমার সাথে ইচ্ছেমতো ঝগড়া করে নিবেন! কিন্তু কখনো রাগ, অভিমান করে আমার সাথে কথা বলা বন্ধ করনে না প্লিজ! এই-যে এখানে লাগে।’ মাইজিন হার্টে হাত দিয়ে দেখি বললো।
‘আপনি ছোট থেকেই কতটা নিদারুণ, নিষ্ঠুর পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়েছেন আর আমি কি না আপনাকে ভুল বুঝলাম সত্যিটা না জেনে। আপনি ওই মহিলার এতো অত্যাচার সহ্য কেন করেছেন বলুন তো? আমার মনে পরলেই কষ্ট হচ্ছে ভীষণ!’
‘এখন আমি আমার মায়ের মতো দেখতে একজন মহিলাকে কিভাবে পুলিশের কাছে দিতাম বা তার গায়ে হাত তুলতাম? উনার জায়গায় যদি আমার নিজের মা হতো কখনোই হইতো আমাকে এতোটা আ’ঘা’ত করতেন না। কিন্তু ওই যে উনার ফেস টা, উনার ফেস টা যে আমার মায়ের ছিলো। আর মাইজিন সুলতান এতোটাও বেয়া-দব না যে একজন মায়ের বয়সি মহিলার সঙ্গে মিস-বিহেভ করবে। সে যতটাই খারাপ প্রকৃতির হোক না কেন!’
‘আচ্ছা আর এসব কথা কখনোই তুলবো না আমরা। চলুন মিষ্টির দেরি হচ্ছে!’
ব্রেকফাস্ট করার পর অফিসে যাওয়ার জন্য বের হলো মাইজিন। দরজা থেকে ঘুরে এসে টুপ করে একটা চুমু দিলো তুলিকার গালে। সে জমে গেলো একদম।
‘কিমিও আইশিতের।’বললো মাইজিন!
‘এটা আবার কেমন ভাষা?’
‘আপনি বুঝে নিন।ভালোবাসার কথা বললে সেটা যে ভাষায় হোক না কেন ভালোবাসার মানুষ টা ঠিক বুঝে যায়।আমি জানি আপনি বুঝেন!’
ঠোঁট এলিয়ে হেসে তুলিকা মাইজিনের যাওয়ার তাকিয়ে থাকে অপলকভাবে!
#চলবে
।