হীরকচূর্ণ ভালোবাসা পর্ব-২৮+২৯

0
319

#হীরকচূর্ণ_ভালোবাসা
#রাউফুন
#পর্ব২৮

উদ্ভ্রান্তের মতো তুলিকা মাইজিনের নিকট ছুটে এসেছে। নাফিস আর সে মাইজিনকে ধরে হসপিটালের উদ্দেশ্য যেতে উদ্যত হয়েছে তখনই তারা দুজন থেমে যায় কারো গম্ভীর কণ্ঠে।

‘তাহলে তুমিই সেই মেয়ে যার কারণে আমার ছেলে আমাদেরকে ছেড়ে দিয়েছে?’

গুটিগুটি পায়ে রৌফ সুলতান সামনে এলেন। তুলিকা অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে উনার মুখো পানে। চেনার চেষ্টা করলো সে। কারণ তুলিকা এর আগে কখনোই তাকে দেখে নি। নাফিস ভ্রু কুচকে বলে, ‘এগুলো কি বলছেন আংকেল? ছেড়ে এসেছে মানে কি?’

‘কেন তুমি জানো না নাফিস? ওঁ তো এখন তোমাদের বাড়িতেই থাকছে তাই না?’

‘দেখুন আমাদের এতো সময় নেই যে এখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আপনার সঙ্গে কথা বলবো। মানুষটা অসুস্থ তাকে নিয়ে হসপিটাল যেতে হবে। নাফিস ভাই চলুন আমার ভীষণ টেনশন হচ্ছে। উনার যে জ্ঞান ফিরলো না এখনো।’

‘এই মেয়ে আমার গাড়ি আছে চলো হসপিটালে পৌঁছে দিচ্ছি!’ আবারও গম গম গম্ভীর স্বর। রৌফ সুলতানের।

‘নাহ আংকেল আমাদের সঙ্গে গাড়ি আছে। আমার বন্ধুকে আমার গাড়ি করেই নিয়ে যাচ্ছি। আপনার যদি ওঁকে নিয়ে চিন্তা হয় তবে আমাদের সঙ্গে আসতে পারেন। কারণ একজন বাবাকে তো বারণ করতে পারিনা ছেলের সঙ্গে না যেতে!’

‘বেশি বাড়াবাড়ি করো না নাফিস। আমার ছেলে আমার গাড়িতে যাবে এটাতে সমস্যা কোথায় তোমার? আমার ছেলের উপর আমার কি ভালোবাসা নেই? সম্পুর্ন অধিকার আছে আমার তার উপর। সে অসুস্থ হলে আমি তাকে নিয়ে চিন্তিত হবো না?’

‘কিন্তু মাইজিন আমার গাড়িতেই যাবে আংকেল।’

‘হেই ইউ?’

‘আপনারা আপনাদের তর্ক পরে করবেন৷ আমার স্বামী এখন অসুস্থ। তার কোনো ক্ষতি আমি সহ্য করবো না। আর মিষ্টার সুলতান আপনার যদি এতোই ছেলের উপর ভালোবাসা থাকতো না? তবে উনাকে এতোটা কষ্ট পেতে হতো না ছোট থেকে৷ দিনের পর দিন মানুষটাকে সৎ মায়ের হাতে বেধড়ক মা’র খেয়ে বড় হতো না। একজন পুরুষ মানুষ হয়ে রান্না করে আপনার স্ত্রীর মুখে খাবার তুলে দিতে হতো না তিন বেলা৷ এতো ভালোবাসেন যে ছেলের অসুস্থতার সময় একবার বুকে জড়িয়ে ধরার সময় টুকু হয়নি আপনার। তার শরীর খারাপের সময় তার পাশে থাকার সময় পর্যন্ত হয়নি। সেসব কথা না হয় ছেড়েই দিলাম কিন্তু আজ? আজ তো পারতেন উনার খেয়াল রাখতে। সবাই এখানে উপস্থিত ছিলো শুধু আপনিই পরে এসেছেন। আজ কেন এসেছেন? আজকেও প্রয়োজন ছিলো না। নাফিস ভাইয়া চলুন দ্রুত!’

রৌফ সুলতান শক্ত চোখ মুখ করে দাঁড়িয়ে রইলেন৷ কি বললো এই মেয়েটা? এতো বড় সাহস তার মুখের উপরে এতো গুলো কথা বললো মেয়েটা? কি সব আবোলতাবোল বকে চলে যাচ্ছে। সৎ মায়ের মা’র খেয়েছে মানে টা কি? তুলিকার কথার কোনো কিছুই বোধগম্য হয় না তার। শুধু বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকে তাদের যাওয়ার পানে।

মাইজিনকে ধরে গাড়িতে তুলে বসিয়ে দিলো তারা৷ তুলিকা তার মাথা ধরে তাকে জাগানোর চেষ্টা করছে। কিন্তু কোনো ভাবেই মাইজিনের জ্ঞান আসছে না। হসপিটালে যেতেই মাইজিনকে ভর্তি করানো হলো ইমার্জেন্সিতে। অস্থির তুলিকা কেঁদে কে’টে একঁশা। কালকের ব্যবহারটা সে ভুলে উঠতে পারছে না। মনে পরলেই হৃদয় উতলে কাঁন্নারা ছিটকে বেরিয়ে আসছে।

‘আই প্রমিস ইউ। আর কোনোদিন এরকম করবো না মাইজিন। আপনি সুস্থ হয়ে যান শুধু, শুধু আপনি সুস্থ হয়ে যান। প্লিজ! আল্লাহ আমার স্বামীকে সুস্থ করে দিন। মানুষটার যদি কিছু হয়ে যায় আমি যে নিজেকে কখনোই ক্ষমা করতে পারবো না আল্লাহ্!’

মনে মনে নানান প্রলাপ করে যাচ্ছে তুলিকা। সে আর নিতে পারছে না।

‘ভাবি এতো কাঁদবেন না। মাইজিন ঠিক হয়ে যাবে।’

‘নাফিস ভাই উনি ঠিক হয়ে যাবে বলুন? কিছু হবে না উনার তাই না! দেখুন না কখন থেকে অজ্ঞান হয়ে আছে।’

‘ভাবি মাইজিনের কিচ্ছু হবে না দেখে নিয়েন। আল্লাহ এতো ভালো একজন মানুষের সঙ্গে খারাপ কিছু করবেন না।’

তম্বন্ধে ডক্টর বেরিয়ে এলেন। তুলিকা হন্তদন্ত হয়ে তার নিকটে এগিয়ে গেলো।

‘ডক্টর আমার হাসবেন্ড কেমন আছে? উনার কি হয়েছে?’

‘দেখুন আপনারা শান্ত হোন। উনি এখন ঠিক আছেন। উনার অনেক গুলো টেষ্ট করা হয়েছে আমাদের সন্দেহ অনুযায়ী। রিপোর্ট না দেখে আমরা আগেই কিছু বলতে চাইছি না। আপনারা উনার স্যালাইন শেষ হলে বাসায় নিয়ে যেতে পারেন। তিন- চারদিন পর উনার রিপোর্ট গুলো নিয়ে যাবেন!’

তুলিকারা সন্ধ্যায় মাইজিনকে নিয়ে বাসায় এলো। মাইজিন তুলিকার সঙ্গে কথা বলেনি এখনো। স্বাভাবিকভাবেই এই বিষয়টা ভীষণ ভাবে দাগ কে’টেছে তুলিকার মনে। পরক্ষণেই সে ভাবলো এটা সে ডিজার্ভ করে। না চাইতেও চোখের কোণ ঘেঁষে জলের রাশিরা গড়াগড়ি খাচ্ছে। তার শাস্তি পাওয়াই উচিত। সত্যিই এটা সে ডিজার্ভ করে।

রাতের খাবার খাইয়ে দেওয়ার পর মাইজিনকে মেডিসিন খাইয়ে দিলো তুলিকা। মাইজিন নির্লিপ্ত চোখে তাকিয়ে ছিলো তুলিকার আড়ালে। মেয়েটার মুখ একদিনেই শুকিয়ে গেছে। মনে হচ্ছে সে না তুলিকাই অসুস্থ হয়েছে। মুখটা ফ্যাকাসে, র’ক্ত শুন্য লাগছে মেয়েটার। কিন্তু তার ভেতরে যে অভিমানের বাসা বেঁধেছে এটা থেকে বের হতে পারছে না কিছুতেই। মিষ্টি একবার এসে মাইজিনকে দেখে গেছে। কতক্ষণ গল্পও করে গেছে।

মাঝ রাতে মাইজিনের ঘুম ভেঙে যায় কারোর গুনগুনিয়ে কান্নার আওয়াজে। নিজের পায়ের কাছে ভারী ভারী অনুভব হয়। মাইজিন তার দুর্বল শরীরকে টেনে তুলে লাইট জ্বালিয়ে দিলো। সে ঘুম ঘুম কণ্ঠে বলে,

‘আরে তুলিকা আপনি জেগে আছেন এখনো? ক’টা বাজে?’

তুলিকা নড়েচড়ে বসে। কিয়ৎক্ষণ মৌন থেকে দৌঁড়ে ঝাপিয়ে পরে মাইজিনের বুকে।ডুকরে কেঁদে উঠে প্রিয় স্বামীর বুকে মাথা রেখে।মাইজিন হতবাক হয়ে গেছে তার এরকম কাণ্ঠে।কিম্ভূতকিমাকার, আশ্চর্য হয়ে তুলিকার মাথায় হাত রাখে। মনের মধ্যে জমে থাকা অভিমানকে আর প্রশ্রয় দিতে পারে না সে৷ প্রিয়তমা স্ত্রীকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে।

‘হয়েছে অনেক হয়েছে। এবার শান্ত হও। কি হয়েছে এভাবে কান্না করছো কেন?’

‘আ’ম রিয়েলি স্যরি মাইজিন। আমি আপনার সঙ্গে কালকে ওইভাবে কথা বলতে চাইনি। ওই যে নুশার আম্মু আছে না? উনার সঙ্গে গল্প করার সময় কথায় কথায় উনি বলেন, “পুরুষ মানুষ হলো মেয়ে লো’ভী।
স্ত্রীকে ভোগ করা শেষ হলে বাইরের মেয়েদের দিকে নজর পরে। তখন আর ঘরের স্ত্রীকে মনে ধরে না। এই দেখুন না ভাবি নুশার আব্বু, আগে কথায় কথায় বউ, বউ করে মাথায় তুলে রাখতো। সব জিনিস প্রয়োজনের আগে হাতে এনে হাজির করে দিতো৷ কিন্তু এখন? এখন আমি তার দু-চোক্ষের বিষ। সহ্য করতে পারে না আমাকে। তার নাকি এখন আর আমাকে ভালো লাগে না। ভাবি আপনি মাইজিন ভাইকে চোখে চোখে রাখবেন, ওরকম ছেড়ে দিয়ে রাখবেন না। হাতে রাখার চেষ্টা করবেন! আকর্ষণ শেষ হলেই কিন্তু অন্য মেয়ের দিকে নজর যাবে!” তাই আমি ভেবেছিলাম আপনার থেকে একটু দূরে দূরে থাকলে আমার প্রতি আপনার আকর্ষণ কমবে না।’

‘হাইরে মেয়ে মানুষ। তাই তুমি আমার থেকে দূরে দূরে থাকার জন্য ওরকম করলে? আরে এতো দিনে আমাকে এই চিনলে? যায় হোক আমার বউয়ের জায়গা কেউ-ই কোনো দিন পাবে না। সো এসব চিন্তা মাথায় রাখার দরকার নেই। যতসব লেইম কথা বার্তা মাথায় ভর্তি করে রাখা তাই না?’

‘আর হবে না। আমাকে ক্ষমা করে দিন আপনি। আমি আর কক্ষনো আপনাকে কষ্ট দেবো না।’

আবার তুলিকা মাইজিনকে জাপটে ধরে৷ মাইজিন তার মুখ তুলে ধরে তার চোখ মুছে দিলো। তুলিকা আবারও তার বুকে ঘাপটি মে’রে বসে থাকে।

‘এই যে শুনো মেয়ে আর নিচে যাওয়ার দরকার নেই। এসব কিছু মহিলারাই তো মানুষের মন বিগড়ে দেই। আমার বউয়ের মতো ভোলাভালা মানুষ পেয়ে এটা সেটা মাথায় ঢুকিয়ে দিয়েছে।’

‘আর যাবো না। আপনি আমাকে ক্ষমা করেছেন তো?’

‘আরে আমি রাগ করিনি। তবে অভিমান হয়েছিলো বটে। এখন আর নেই।’

তুলিকা মাইজিনের পুরো মুখোশ্রীতে চুম্বন এঁকে দিলো। উন্মুক্ত বুকে চুমু একে দিয়ে নাক টানলো। না জানি রিপোর্টে কি আসে। বড্ড ভয় হচ্ছে তার। খুব আপন কিছু হারানোর ভয়ে অস্বস্তিতে বিমুঢ় হয়ে আসছে মন! বিষাক্ত কিছু জাপটে ধরছে তাকে। সে আরও কিছু টা জোরে আঁকড়ে ধরলো মাইজিনকে। মাইজিন আলতো হাসে। বলল, ‘আল্লাহ আস্তে আস্তে ধরো। আমি তো পালিয়ে যাচ্ছি না। এমন ভাবে ধরেছো নিঃশ্বাস নিতে পারছি না।’

তুলিকা তার কোলে বসে হাতের বাধন আরও জোড়ালো করলো। ওইভাবেই বসে থেকে তার বুকেই ঘুমিয়ে গেলো।


‘পাঁচশো টাকা দেন।’

‘আরে একটু আগেই কোচিং-এ যাওয়ার আগে তোমাকে পাঁচশো টাকা দিলাম।’

‘অতীতের কথা ভুলে যান। অতীত নিয়ে পড়ে আছেন বলেই আমাকে পটাতে পারেন না।’

মিষ্টির ঠোঁটের কোণে দুষ্টু হাসি। নাফিস কোণা চোখে তাকিয়ে রইলো তার দিকে। পাঁচশো টাকা বের করে দিয়ে বলল, ‘এভাবে আর কত টাকা নিবা? শুধু পেছন পেছন ঘুরি বলেই রোজ টাকা নাও। বিয়ের পর কি আমাকে ফকির বানিয়ে বাটি হাতে রাস্তায় নামিয়ে দিবা?’

‘ওমা আপনার কি টাকা শেষ হলো নাকি? যদি হয়ে থাকে তবে ঘুরা বন্ধ করুন!’

‘হাহ্ এই নাফিসকে ফুতুর করা তোমার মতো বাচ্চা মরিচের কাম্য নয়।’

‘আপনি দিনে প্রায় দশ বার আসেন আমার পিছনে পিছনে। যদি দশবারই টাকা নিই আপনার বাটি হাতে নিতে সময় লাগবে না।’

‘মানে?’

‘মানে কিছুই না।এখনো সময় আছে পিছু ছেড়ে দিন আমার।না হলে সত্যিই ফুতুর হতে হবে আপনার!

‘এই জীবন থাকতে আর ছাড়ছি না তোমাকে!’

নাফিসকে নিজের পিছু ছাড়াতে সক্ষম হয়নি কোনো ভাবেই মিষ্টি। তাই এই পন্থা অবলম্বন করে নাফিসের হাড় মাংস জ্বালিয়ে কয়লা করে দিচ্ছে। নানান ভাবে জ্বালাতন করছে কিন্তু কোনো ভাবেই নাফিসকে তার পিছু আসা ছাড়াতে পারেনি। এই যে রোজ নাফিসের থেকে সকাল বিকেল পাঁচশো করে টাকা নিচ্ছে এগুলো আবার জমিয়ে নির্দিষ্ট স্থানে রেখেও দিচ্ছে যাতে করে সেগুলো আবার রিটার্ণ করতে পারে!

#চলবে

#হীরকচূর্ণ_ভালোবাসা
#পর্ব২৯
#রাউফুন

ঘটনাটা পরের দিন ভোর বেলার। মাইজিন নড়েচড়ে উঠে। তার দম বন্ধ লাগে, হাসফাঁস করছে সে। বুকের উপর ভারী কিছু অনুভব হয়। সহাস্যে রেগেমেগে এলোপাতাড়ি উঠে বসে। কোনো কিছু না ভেবে তুলিকাকে নিজের বুকের উপর থেকে ধাম করে ধা’ক্কা দিয়ে ফেলে দেই বিছানা থেকে। আকস্মিক ঘটনা হতবিহ্বল তুলিকা। ধাক্কার তাল সামলাতে না পেরে বিছানা থেকে ফ্লোরে ছিটকে পরে। আক্রোশে ফেটে পরেছে মাইজিন। এই মুহুর্তে তাকে দেখে যে কেউ ভয় পাবে। অত্যন্ত কর্কশ টোনে বলে,

‘তোমার সাহস কি করে হয় আমার কাছে আসার? অসভ্য মেয়ে মানুষ!’

মাইজিন ওয়াশরুমের দিকে চলে যায়। তুলিকার ঘুম ঘুম ভাব উবে গিয়েছে তখনই। মাইজিনের এমন ব্যবহারে যারপরনাই অবাক হয়। আকাশসম বিস্ময় নিয়ে মেঝেতেই বসে রইলো সে। এ কেমন ব্যবহার মাইজিনের? এমন অদ্ভুত ভাবে রেগেই বা গেলো কেন? সে পরে যাওয়ায় মাজায় ব্যথা পেয়েছে। উঠতে চাইলেও পারলো না। কোনো রকমে খাটের পাশি ধরে উঠার চেষ্টা করতেই মাইজিনের গলা পেলো।

‘আরে তুলিকা, ফ্লোরে বসে কি করছো?’

তুলিকার কাছে দুই মিনিটের মধ্যে মাইজিনের এই বদলে যাওয়া টা দেখে অদ্ভুত ঠেকে। কি হলো মাইজিনের?

‘আপনার মনে নেই আমি কিভাবে পরলাম এখানে?’

‘কি মনে থাকবে? দেখি উঠো!’ মাইজিন তুলিকাকে ধরে তুলে খাটে বসালো।

‘ নিশ্চয়ই বা’জে স্বপ্ন দেখছিলে তাই না? খুব বেশি জোরে পরে গেছিলে নাকি? ব্যথা পেয়েছো?’

তুলিকা তখনও মাইজিনের দিকে তাকিয়ে আছে। এখনো তার চোখ মুখে বিস্মিত ভাব বিরাজমান। মাইজিন মুচকি হেসে বললো, ‘কি দেখো? আমার মিসেসের দেখি আমার থেকে চোখ সরছেই না? আদর চাই নাকি? লাগলে বলতে পারো!’

‘আপনি জানেন একটু আগে কি হয়েছে? আপনি আমাকে নিজে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিয়েছেন। এবং রেগেমেগে ওয়াশরুমে চলে গেছেন। আর এখন সম্পুর্ন উল্টোটা করছেন। যেনো কিছু হয় ই নি।’ মাইজিন তার দিকে ভ্রু কুচকে তাকিয়ে থাকে। মাইজিন বেফাঁস হেসে উঠলো। হাসতে হাসতে বললো,

‘বা’জে স্বপ্ন দেখেছো? আমি তোমাকে ধা’ক্কা দেবো? আমি? ভুল করেও তোমাকে আমি আ’ঘা’ত দিতে পারি না এটা জানো তুমি।’

‘হইতো তাই হবে।’ কোনো রকমে মনের ভ্রম ভেবে উড়িয়ে দিলো তুলিকা ব্যাপারটা।

তুলিকা উঠে ফ্রেশ হতে চলে যায়। অজু করে এসে নামাজে বসে৷ মাইজিনও নামাজ পরে নিলো তার সঙ্গে।

মাইজিন আজকে অফিস যেতে চেয়েছিলো কিন্তু তুলিকা তাকে যেতে দেইনি কোনো ভাবেই। সে পুরো-পুরি সুস্থ না হওয়া পর্যন্ত কোনো ভাবেই অফিস করতে পারবে না তার কড়া হুকুম। বউয়ের হুকুম মেনে মুখ গোমরা করে বসে আছে সে। তুলিকার এমন যত্ন, অধিকার বোধ, ছোট ছোট চোখে তাকিয়ে থাকা বেশ এনজয় করছে। কিন্তু হুট করেই সকালের কথা মনে পরলো তার। সে কি সত্যিই তুলিকাকে ধাক্কা দিয়েছিলো তার বুকের উপর থেকে? না হলে তুলিকা বলবে কেন সে কথা? নাকি বা’জে স্বপ্নই দেখেছে? কিছুই বুঝে উঠতে পারে না সে।


শাপলা সিদ্দিকা বসে আছে শারমিনের সঙ্গে। তাদের প্রতিটি কার্যক্রম সফল হওয়ার আগেই ফ্লপ হয়ে গেছে।

‘এখন আমাদের করনীয় কি আন্টি? মাইজিন তো বিয়ে করে নিয়েছে এখন কি করবো আমরা?’

‘জানি না। তবে তোর আংকেল দেশে থাকা পর্যন্ত আমাদের চুপ থাকতে হবে। কত নির্যাতন করলাম কিন্তু কোনো ভাবেই সম্পত্তি হাতে এলো না। নিজের বোনের স্বামীর চোখে নিজের বোনকে খারাপ প্রমাণ করে তার সঙ্গে প্রেমের অভিনয় করে তাকে ফাসালাম। বোনকে দিনের পর দিন ওষুধ দিয়ে অসুস্থ করে রেখে মে’রে দিলাম। বোনের জায়গা নিলাম কিন্তু কোনো ভাবেই সম্পত্তি হাতে পেলাম না। এই যে এতো এতো সম্পত্তি আমার সব চাই সব।’

‘আহ আন্টি আস্তে কথা বলো। এসব কথা যদি কেউ শুনে ফেলে কি হবে ভেবে দেখেছো? আংকেল বাড়িতে ভুলে যেও না।’

‘আরে ধুর বিশ বছর থেকে ওই লোকের সঙ্গে সংসার করছি। আমি চিনি ওঁকে। এক নম্বরের গর্ধব লোকটা। কিছুই টের পাইনি এতো বছর আর আজকে একদিনেই টের পেয়ে যাবে? আমি যা কিছু বলি তাই বিশ্বাস করে এসেছে এই পর্যন্ত বুঝলি? বড্ড বোকা তোর আংকেল। আমার অভিনয় বুঝতেই পারেনি। তবে তুই চিন্তা করিস না এবার আমাকে কিচ্ছু করতে হবে না। যা হওয়ার তা তো হবেই। আমার পথের কা’টা এমনিতেই সরে যাবে।’

‘সত্যিই আন্টি ইউ আর আ’ জিনিয়াস৷ যেমন রুপ তেমন গুণ! ওহ হ্যাঁ শয়’তা’নি গুন!’

হো হো করে হেসে উঠলো শারমিন আর শাপলা এক সাথে। পর্দার আড়াল থেকে দুটো পা তম্বন্ধে সরে গেলো। হাতের মুঠো শক্ত করে নিজের রুমের ভেতরে প্রবেশ করে।

দুপুরে রান্নায় ব্যস্ত তুলিকা। মাইজিনের শরীরে রক্ত কম। সেজন্য ডক্টরের পরামর্শ অনুযায়ী সেসব খাবার খাওয়াতে হবে যেগুলো খেলে শরীর ভালো হবে। কবুতরের মাংস, শিং মাছ, শাক সবজি। কতকগুলো পদ করেই ক্ষান্ত হয় তুলিকা।

মাইজিন তাকে রান্নার কাজে সাহায্য করতে যায় কিন্তু তুলিকার গরম চোখের চাহনীতে চুপসে যায়। হুট করেই মস্তিষ্কে নাড়া দিলো অস্বাভাবিক কিছু। সে ফল কা’টার ছু’ড়ি নিয়ে এগিয়ে যায় রান্না ঘরে৷

‘আচ্ছা যদি আমার হাত কা’টা হয় কত গুলো রক্ত বের হবে? আমি দেখতে চাই!’

কি ভয়ানক সে কথা। তুলিকা ভয়ে শিটিয়ে যায়। মাইজিন নিজের হাতের শিড়া বরাবর ছু’ড়ি ধরে। কেমন অদ্ভুত ভাবে হাসে।

‘ওটা রাখুন মাইজিন। আপনি আমাকে কেন ভয় দেখাচ্ছেন কেন? হাত কে’টে যাবে মাইজিন। প্লিজ রাখুন ছু’ড়িটা!’

মাইজিন হেসে নিজের হাতে ছু’ড়ি বসিয়ে টান দিতে উদ্যত হয় তখনই কলিং বেল বেজে উঠে। সেই সুযোগে মাইজিনের হাত থেকে ছুড়িটা কে’ড়ে নিলো তুলিকা।

‘আমি দেখবো, দেখবো, দেখবো, কত গুলো র’ক্ত হয় দেখবো!’

মাইজিন পাশের রুমে গিয়ে বসে পরলো ধড়াম করে। তুলিকার চোখ দিয়ে অনর্গল পানি পরছে। সর্বাঙ্গে কাঁপন সৃষ্টি হয়েছে তার। গলা শুকিয়ে কা’ঠ হয়ে গেছে একেবারে। ঢকঢক করে পানি পান করে সে। এদিকে অনবরত কলিং বেল বেজেই যাচ্ছে। তুলিকা নিজেকে ধাতস্থ করে দরজা খুলে দিতে যাবে তখনই মাইজিন আসে।

‘আরে তুলিকা কখন থেকে কলিংবেল বাজছে শুনছো না? ঠাই দাঁড়িয়ে আছো। কি যে করো না। ঠিক আছে আমিই খুলে দিচ্ছি!’

মাইজিনের পর পর এরুপ আচরণে খেই হারিয়ে গেছে তার। কতটা ক্যাজুয়ালি কথা বলছে মাইজিন। অথচ একটু আগেই কেমন অস্বাভাবিক আচরণ করছিলো। কিছুক্ষন আগের ঘটনা মস্তিষ্কে অন্য কিছুর আভাস দেই তার। নাকি মাইজিন মজা করছিলো তার সঙ্গে? না হলে এরকম কেন করবে? কলিংবেল বাজছে জন্য হইতো সে বিষয়ে কথা বললো না এখন। তুলিকা নিজের ঘার্মাক্ত মুখ মুছে মাইজিনকে বলে,

‘কে এসেছে মাইজিন? দরজা খুলে দাঁড়িয়ে আছেন কেন?’

‘ভেতরে আসুন!’ বললো মাইজিন।

তুলিকা দরজার কাছে এসে অবাক হয়ে যায় দরজায় দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটাকে দেখে।

‘আপনি এখানে?’

‘এতো অবাক হওয়ার কি হয়েছে? আমি কি আমার ছেলেকে দেখতে আসতে পারি না?’

তার কথা শুনে মাইজিন তাচ্ছিল্যের হাসি হাসে আড়ালে। তুলিকা অপ্রস্তুত হেসে বললো,

‘না না আংকেল তা কখন বললাম। আপনি আসেন নি তো এর আগে কখনোই। আপনি ভেতরে আসুন না প্লিজ!’

রৌফ সুলতান ভেতরে প্রবেশ করলেন। রুমে ঢুকে পুরো রুমে চোখ বুলিয়ে নিলেন তিনি। রুম গুলো তেমন বড় না। জিনিসপত্রও কম। তবুও রুম গোছানো আর পরিপাটি থাকাই দেখতে ভালো লাগছে। রৌফ সুলতান কাউচে বসলেন। তুলিকা আর মাইজিন নিশ্চুপ। অবাক হয়েছে তারা ভীষণ।

‘আ-আমমম এভাবে তাকিয়ে আছো কেন তোমরা? আমি আসায় কি অসুবিধা হলো তোমাদের?’

‘ছিঃ ছিঃ না আংকেল। আপনি কি নেবেন চা -কফি!’

‘কিছুই জানো না দেখছি মেয়ে। এই দুপুরে কি কেউ চা-কফি খাই?’

তুলিকা বেশ লজ্জা পেলো। মাইজিন তখনও নিশ্চুপ। তার ভীষণ অস্বস্তি হচ্ছে। যতোই অপছন্দ করুক না কেন লোকটাকে সে তো তার বাবা। এভাবে বাসায় এসেছে প্রথম বার তার মুখের উপর কি চটাস চটাস করে কথা বলা যায়। তুলিকা শরবত করতে চলে যায়। মাইজিন আর রৌফ সুলতান মুখোমুখি বসে আছে এই মুহুর্তে। হঠাৎই নিরবতা ভেঙে মাইজিন গলায় স্বর টেনে টেনে বলল, ‘ হঠাৎ কি মনে করে__ আসলেন?’

‘তোমাকে দেখতে এসেছি! এখন তোমার শরীর কেমন?’

এই এটুকু কথায় যেনো এতো দিনের সমস্ত অভিমান গলে জল হয়ে গেলো। মাইজিন অনুভব করলো তার শরীর, গলা কাঁপছে অদ্ভুত ভাবে। মাইজিনের অস্বস্তি কা’টা’তে তুলিকার আগমন হয়। তার হাতে ফলমূল আর শরবতের গ্লাস৷ তুলিকা আসায় বেশ স্বস্তি পেলো মাইজিন। তুলিকা ঠান্ডা শরবত এগিয়ে দিয়ে বলল, ‘আংকেল শরবতটা খান!’

‘এই মেয়ে কি আংকেল আংকেল করছো? সহবত জানো না নাকি? সম্পর্কে আমার ছেলের বউ তুমি। সে অনুযায়ী আমি কি তোমার আংকেল হয়? আংকেল আংকেল করছো তখন থেকে!’

‘তাহলে কি বলবো?’ মিন মিন করে বললো তুলিকা।

‘বাবা বলবে। আজ, এখন থেকে।’

তুলিকা আর মাইজিন অবাক সাথে খুশি হয়ে তাকিয়ে থাকে রৌফ সুলতানের দিকে৷ মাইজিন আর রাগ করে থাকতে পারে না। দুজনেই নিরবে অশ্রু ফেলে। এই অশ্রু আনন্দের! এই অশ্রু সুখের! মাইজিন নিজের বাবাকে জড়িয়ে ধরে। তার বাবা উপরে উপরে গম্ভীর ঠিকই কিন্তু ভেতর থেকে ততটাই কোমল। ঠিক কত বছর পর এভাবে বাবার বুকে মাথা রেখেছে সে। এরকম সুন্দর দৃশ্য কি সব সময় দেখা যায়? তুলিকা প্রাণ ভরে তাদের বাবা ছেলের মিলন দেখছে। কাঠখোট্টা, রাগী, গম্ভীর মানুষটার চোখেও আজ জল। রৌফ সুলতান চোখ মুছে ছেলেকে আঁকড়ে ধরেন।

#চলবে।