#হৃদকোঠোরে_রেখেছি_তোমায়🖤(২৭)
#Maisha_Jannat_Nura (লেখিকা)
(৭১)
সকালবেলা….
সন্ধ্যা নিজের কেবিনে বিছানায় পা ঝুলিয়ে বসে আছে আর বারবার দরজার দিকে লক্ষ্য করছে। তরুনিমা সন্ধ্যার জন্য আনা টুকটাক জিনিসপত্রগুলো গুছিয়ে নিচ্ছে। সেইসময় কেবিনের দরজা ঠেলে ভিতরে প্রবেশ করে কুশল। কুশলকে দেখামাত্র সন্ধ্যার মুখে হাসি ফুটে উঠে। পরক্ষণেই কুশলকে একা ভিতরে আসতে দেখে সন্ধ্যার হাসিমুখ মলিন বর্ণ ধারণ করে। কুশল শান্ত স্বরে তরুনিমাকে প্রশ্ন করলো….
—“সব গোছানো শেষ হয়েছে তোমার?”
তরুনিমা সোফার উপর রাখা লাগেজটার চেইন লাগিয়ে কুশলের সামনে রেখে বললো…
—“হুম শেষ। রিসিপশনে সন্ধ্যার রিলিজের জন্য ফর্ম পূরণ করার কাজ শেষ হয়েছে কি আপনার?”
—“হুম শেষ করেই আসলাম। এখন তাহলে যাওয়া যাক!”
—“হুম আপনি লাগেজটা নিয়ে এগোন আমি সন্ধ্যাকে নিয়ে আসছি।”
—“আচ্ছা।”
কুশল লাগেজটা নিয়ে কেবিন থেকে বেড়োতে নিলে সন্ধ্যা কুশলকে ডাক দেয়….
—“মেজো ভাইয়া…!”
কুশল সেখানেই থেমে গিয়ে সন্ধ্যার দিকে ঘুরে দাঁড়ায়। তরুনিমা সন্ধ্যার কাছে এসে বললো….
—“তোমার হাতে কি কোনো স*ম*স্যা হচ্ছে সন্ধ্যা?”
—“না, ভাবী।”
কুশল লাগেজটা সেখানে রেখেই সন্ধ্যার হাতের বাম এসে দাঁড়াতেই সন্ধ্যা বললো…
—“ওনার সাথে দেখা করাবে বলেছিলে।”
—“এখন সম্ভব না। নিলাদ্রের সাথে দেখা করার জন্য তোকে কিছুদিন অপেক্ষা করতে হবে। সঠিক সময় হলে আমি নিজেই তোকে নিলাদ্রের কাছে নিয়ে যাবো।”
সন্ধ্যা কিছুটা জেদী স্বরে বললো…
—“আমি ওনার সাথে আজ এক্ষুণি দেখা করতে চাই। নয়তো আমি এখান থেকে এক চুল পরিমাণ জায়গাও সরবো না।”
কুশল সন্ধ্যার দিকে রাগী দৃষ্টি স্থির করে কঠিন কন্ঠে বললো….
—“এটা কোনো ছেলেমানুষি করার সময় নয় সন্ধ্যা। এটা একটা মানুষের জীবন-মৃ*ত্যু*র বিষয়। আমাদের চারপাশে মু*খো*শ*ধা*রী অগুনিত শ*ত্রু*রা ঘোরাঘুরি করছে। আমি চাই না আমাদের করা একটা ভু*লে*র মা*শু*ল বা*জে ভাবে নিলাদ্রকে ওর জীবন দিয়ে পো*হা*তে হোক। নিজের জেদ ও ইচ্ছের উপর কন্ট্রোল রাখার চেষ্টা কর। তরুনিমা আমি গাড়িতে অপেক্ষা করছি ওকে নিয়ে দ্রুত এসো।”
এই বলে কুশল লাগেজটি নিয়ে কেবিন থেকে বেড়িয়ে যায়। কুশলের এমন কথায় সন্ধ্যার চোখ দিয়ে অশ্রুপাত হতে শুরু করে। তরুনিমা যন্তের সহিত সন্ধ্যার চোখের পানি মুছে দিতে দিতে বললো….
—“সন্ধ্যা…আমার জান…এভাবে কান্না করতে হয় না। তোমার ভাইয়া তো তোমার বা নিলাদ্র ভাইয়ার খারাপ হোক এমনটা চায় না বলো! এখন পরিস্থিতি ভালো না তাই উনি তোমার ইচ্ছেটা পূরণ করতে পারলেন না। কিছুদিন অপেক্ষা করো পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক হোক তারপর নিশ্চয়ই তুমি নিলাদ্র ভাইয়ার সাথে দেখা করতে পারবে। এখন কান্না থামাও। কাঁদলে কিন্তু তোমাকে পুরো বটগাছের শা*ক*চু*ন্নিদের মতো লাগবে। তখন নিলাদ্র ভাইয়া তোমাকে দেখে ভ*য় পাবে।”
তরুনিমার এমন কথায় সন্ধ্যা অশ্রুসিক্ত নয়নে হেসে দিয়ে কান্না থামায়। অতঃপর তরুনিমা সন্ধ্যাকে নিয়ে কেবিন থেকে বেড়িয়ে ক্লিনিকের বাহিরে দাঁড় করানো গাড়ির সামনে এসে দাঁড়ায়। কুশল ড্রাইভিং সিটে বসে আছে। তরুনিমা পিছনের দরজা খুলে সন্ধ্যাকে নিয়ে সেখানেই বসে। তরুর এমন কাজে কুশল অবাক হয়। পরক্ষণেই কুশল গাড়ির ভিতরে থাকা গ্লাসটি দিয়ে তরুর দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে দাঁতে দাঁত পি*ষে বললো…..
—“পিছনের সিটে বসে কি আমাকে আপনাদের ড্রাইভার বানিয়ে দিলেন নাকি!”
তরু পায়ের উপর পা তুলে আয়েসি ভঙ্গিতে বসে বললো…
—“চালকের সিটে বসে যে গাড়ি চালায় তাকে তো ড্রাইভার ই বলা হয়। আপনি তো গাড়ি চালাবেন জন্য স্বইচ্ছায় চালকের সিটে বসেছেন তাহলে আপনাকে নতুন করে ড্রাইভার বানানোর আমাদের দরকার কি?”
তরুর এমন প্রতিত্তুর শুনে সন্ধ্যা ওর ডান হাত দিয়ে নিজের মুখ চেপে ধরে হাসি নিয়ন্ত্রণ করার বৃ*থা চেষ্টা করছে। তরু ওর মুখের সামনে নিজের ডান হাতের আঙুল গুলো এনে হালকা ফুউউউ দিতে শুরু করে। কুশল রাগে ফোঁ*স ফোঁ*স করতে করতে গাড়ি স্টার্ট করে।
(৭২)
রূপগঞ্জ গ্রামে মহসিন মেম্বার এর স্ত্রী আমেনা বেগম নিজ বাড়ির বারান্দায় রাখা চৌকিতে বসে ছেলে মুরাদকে নিজ হাতে খাবার খাইয়ে দিচ্ছেন। সেইসময় মহসিন মেম্বার ঘর থেকে বের হয়ে বারান্দায় এসে দাঁড়িয়ে রাগী স্বরে বললেন….
—“খাওয়াও..খাওয়াও..তোমার আদরের দুলালরে নিজ হাতে ইচ্ছে মতো খাবার খাওয়াও। কাল তো বিচার বৈঠকখানায় ব*লি*র পা/ঠা*র মতো ব/লি হবে তোমার আদরের দুলাল। তাই ব*লি হওয়ার আগে গান্ডে পান্ডে খাওয়াইয়া তরতাজা করো ওরে।”
আমেনা বেগম কিছুটা রাগ নিয়ে বললেন….
—“আহহহ..ম’র*ণ! সকাল সকাল তোমার মুখ থেকে এমন অ*লু*ক্ষু*ণে কথা গুলো বের না করলেই কি হচ্ছে না নাকি গো? কতোদিন পর পোলাটা আমার হাসপাতাল থেকে বাড়িত ফিরলো, একটু শান্তিতে খাবার খাইবো তোমার তি*ক্ত কথার জন্য তো দেখছি তারও জোঁ নেই।”
—“তি*ক্ত কথা কি সাধে আমার মুখ থেকে বের হইতাছে নাকি মুরাদের মা! তোমার আদরের দুলাল যে কামটা করছে তার জন্য কাল আমাকে পুরো গ্রামবাসীর সামনে কতোখানি ছোট হওন লাগবো সেই চিন্তা কি করছিলা একটাবার! তোমার পোলার কু*কর্মের জন্য আমাকে মেম্বার এর পদ থেকেও ইস্তফা নেওয়া লাগবো। তখন এই সাধের খাওন আর জুটবো না এটাও মনে রাইখো।”
—“আমার পোলায় অ*ন্যা*য় করছে আমি মানতাছি। আর তার জন্য সেদিন রাতে শহরের বাবুটা আমার পোলাটারে তো কম মা*ই*র মা*রে নি! মা*র*তে মা*র*তে আমার পোলাটার কি দূ*রাবস্থাই না করছিলো। ৫দিন ধইরা হাসপাতালে থাকার পর বাড়িত আসতে পারছে। এতেও কি তার শা*স্তি*র দেওনের দৌড় ফুরায় নাই!”
—“যদি ফুরাইতোই তাহলে তো আর আগামীকাল বিচার বৈঠকখানা বসানোর কথা কইয়া যাইতেন না উনি। তবে একটা শেষ কথা কইতাছি শুইনা রাখো তোমরা মা-পোলায় ভালো কইরা। কালকে যদি আমারে তোমার পোলার কু*কর্মের জন্য মেম্বার এর পদ থাইকা ইস্তফা দেওন লাগে তাহলে আমিও তোমার পোলারে তেয্য-পুত্র কইরা এই বাড়িত থেকে আজীবনের জন্য বাহির কইরা দিমু।”
নিজের বাবার মুখে এমন কথা শুনে মুরাদ আর চুপ থাকতে পারে না। মুরাদ রাগ নিয়ে উচ্চস্বরে বললো…
—“শা*স্তি যদি পাইতেই হয় তবে আমি একলা পামু কেন বাবা?”
—“একলা অ*কাম করছোস তো তোর শা*স্তি*র ভাগিদার অন্যকেও কেন হইতো যাইবো হ্যা?”
—“আমি একলা ঐ চাষীর মাইয়ারে ধ্ব*র্ষ*ণ করি নি। আমার লগে চেয়ারম্যান চাচার পোলা আরিফ ও ছিলো। যদি আমার কু*কর্মের জন্য তোমারে মেম্বার এর পদ থাইকা ইস্তফা দেওন লাগে তাহলে আমার সঙ্গ দেওয়ার জন্য আরিফের বাপরেও চেয়ারম্যানের পদ থাইকা ইস্তফা দেওন লাগবো।”
মুরাদের মুখে এমন কথা শুনে মহসিন মেম্বার ও আমেনা বেগম দু’জনেই অনেক অবাক হন। পরক্ষণেই মহসিন মেম্বার কিছুটা শান্ত হয়ে বললেন….
—“চেয়ারম্যানের পোলা তোর লগে আছিলো এই কথাখান আমারে আগে কইতে কি তোর শরম করতাছিলো নাকি?”
মুরাদ কোনো প্রতিত্তুর করলো না। মহসিন মেম্বারও আর কিছু না বলে দ্রুত কদমে বাড়ি থেকে বেড়িয়ে গেলেন। আমেনা বেগম আর মুরাদ মহসিন মেম্বারের যাওয়ার পানে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন।
(৭৩)
চৌধুরী মেনশনের মূল দরজা দিয়ে ভিতরে প্রবেশ করে কুশল, তরুনিমা ও সন্ধ্যা। পরক্ষণেই কুশল সন্ধ্যাকে উদ্দেশ্য করে বললো….
—“তুই রুমে গিয়ে বিশ্রাম কর। বিকালে আমাদের গ্রামের উদ্দেশ্যে বের হতে হবে।”
সন্ধ্যা প্রশ্নসিক্ত নয়নে কুশলের দিকে তাকিয়ে বললো….
—“হঠাৎ আমাকেও কেনো গ্রামে যেতে হবে মেজো ভাইয়া? কোনো বিশেষ কাজ আছে কি সেখানে!”
কুশল ওর পেন্টের পকেটে দু’হাত রেখে বললো….
—“না, তোর কোনো কাজ নেই। আমার কিছু জরুরী কাজ আছে গ্রামে। শুরুতে আমি একাই গ্রামে যেতে চেয়েছিলাম। কাজ শেষ করতে গিয়ে কয়েকদিন লেগে যেতো গ্রাম থেকে ফিরতে। তোর ভাবী নাকি আমাকে ছাড়া একটা মূহূর্ত একলা কাটাতে পারবে না তাই নিজেও আমার সাথে গ্রামে যাওয়ার জন্য আর্জি জানিয়েছে। আর তোকেও আমাদের সাথে নিয়ে যাওয়ার কথা বলেছে। গ্রামের মনোমুগ্ধকর পরিবেশের মাঝে কয়েকটাদিন কাটালে তুইও দ্রুত সুস্থ হয়ে উঠতে পারবি এমনই তোর ভাবীর চিন্তা-ভাবনা।”
সন্ধ্যার সামনে কুশলের এমন কথা শুনে তরুনিমা লজ্জায় মাথা নুইয়ে ফেলে।
সন্ধ্যা তরুর বিষয়টা বুঝতে পেরে ঠোঁট চেপে হাসতে হাসতে বললো….
—“আচ্ছা ঠিক আছে।”
এই বলে সন্ধ্যা নিজের রুমের উদ্দেশ্যে হাঁটতে শুরু করে। সন্ধ্যা চলে যেতেই তরু কুশলের দিকে চোখ ছোট ছোট করে তাকিয়ে বললো….
—“আপনাকে ছাড়া একটা মুহূর্ত আমি একলা কাটাতে পারবো এই চরম মি*থ্যে কথাটা আপনাকে কে বলেছে শুনি!”
কুশল তরুর দিকে কিছুটা ঝুঁকে গিয়ে ধীরস্বরে বললো…
—“তাহলে আমার সাথে গ্রামে যাওয়ার একটা যুক্তিযুক্ত কারণ দেখাও।”
কুশলের এমন কথায় তরু কি কারণ বলবে তা ভেবে পায় না। কুশল তরুকে কিছু বলতে না দেখে বাঁকা হেসে সিঁড়ি বেয়ে উপরে চলে যায়। তরু অবাকের পাশাপাশি ভাবুক চাহুনি নিয়ে কুশলের যাওয়ার পানে তাকিয়ে বিরবিরিয়ে বললো….
—“এই লোকটা যখনি আমার কাছে কোনো বিষয় নিয়ে যুক্তিযুক্ত কারণ জানতে চায় তখন আমার বুদ্ধি গুলো এমন লো*প পেয়ে যায় কেনো? আমি তো কিছু না কিছু বলে ওনাকে ভু*ল প্রমাণিত করতেই পারতাম। কিন্তু বলতাম টা কি?”
চলবে ইনশাআল্লাহ……….
#হৃদকোঠোরে_রেখেছি_তোমায়🖤(২৮)
#Maisha_Jannat_Nura (লেখিকা)
(৭৪)
বিকেলবেলা….
তরু আর সন্ধ্যা চৌধুরী মেনশনের সামনে রাখা গাড়ির কাছে দাঁড়িয়ে আছে। ওদের গাড়ির পিছনের গাড়িতে সাদিক বডিগার্ডদের সাথে কথা বলছিলো। সেইসময় তরুনিমা সাদিককে ডাক দেয়…
—“সাদিক ভাই….এদিকে একটু আসুন তো।”
সাদিক তরুনিমার ডাক শুনে গার্ডসদের গাড়িতে বসতে বলে ওদের সামনে এসে দাঁড়িয়ে শান্ত স্বরে বললো…
—“জ্বি ম্যডাম, কোনো সমস্যা হয়েছে কি?”
—“না কোনো সমস্যা হয় নি। আপনি আমাদের গাড়িতে আপনার স্যারের পাশের সিটে বসে গ্রামে যাবেন এটা বলার জন্যই ডেকে পাঠালাম। সাদিক কিছুটা অবাক হয়ে বললো….
—“কিন্তু ম্যডাম…স্যার যদি রাগ হন?”
তরুনিমা ভ্রু কুঁচকে সাদিকের দিকে তাকিয়ে বললো…..
—“রাগ হবেন কেনো?”
—“ম্যডাম স্যার একা যদি কোথাও যেতেন তখন আমি তার পাশে বসে নিঃসংকোচে যেকোনো জায়গায় যেতেই পারতাম। কিন্তু আজ তো আপনারা স্যারের সাথে যাবেন সেই গাড়িতে আমি কিভাবে যেতে পা…..!”
সাদিক পুরো কথা শেষ করার পূর্বেই পিছন থেকে কুশল গাড়ির দিকে আসতে আসতে বললো….
—“তোমাকে আমি আমার পরিবারেরই একজন সদস্য বলে মনে করি সাদিক। আমার সবরকম কাজে, বিপদে-আপদে তুমি ছায়ার মতো সাথে থাকো। তাই আমার পরিবারের বাকি সদস্যদের সাথে একই গাড়িতে তুমি নিঃসংকোচে যেতে পারো।”
কুশলের মুখে এমন কথা শুনে তরু আর সন্ধ্যার মুখে হাসি ফুটে উঠে। সন্ধ্যা হাসিমুখে সাদিককে বললো…
—“মেজো ভাইয়ার কথা শুনে আপনার সব সংকোচ বোধ নিশ্চয়ই ইতিমধ্যে কে*টে গিয়েছে! এবার গাড়িতে উঠে বসুন তো আপনি।”
সাদিক হাসিমুখে বললো….
—“আপনারা বসুন ম্যডাম। আমি গার্ডসদের একবার চেক করে আসছি।”
এই বলে সাদিক পিছনের গাড়ির কাছে চলে যায়। সন্ধ্যা আর তরু ওদের গাড়ির পিছনের সিটে বসে পরে। কুশল গাড়ির ড্রাইভিং সিটে বসে পরে। পরক্ষণেই সাদিক এসে কুশলের পাশের সিটে বসতেই কুশল গাড়ি স্টার্ট করে।
(৭৫)
চেয়ারম্যান আমজাদ হোসেন নিজ বাড়ির আঙিনায় রাখা জলচৌকিতে বসে কুলকুচি করছিলেন। রান্নাঘরে আমজাদ হোসেনের স্ত্রী শরিফা বেগম রাতের খাবার রান্না করছেন। বারান্দায় রাখা বড় চৌকিতে বসে আরিফ ফোনে গেইম খেলছিলো। সেইসময় মহসিন মেম্বার চেয়ারম্যানের বাসার মূল দরজা খুলে ভিতরে প্রবেশ করে। মহসিন মেম্বারকে ভিতরে আসতে দেখে আমজাদ হোসেন হাতে থাকা ছোট পানির কলসটা নিচে রেখে পাশ থেকে গামছাটা নিয়ে মুখ মুছতে মুছতে বললেন….
—“কি ব্যপার মহসিন মেম্বার! হঠাৎ কি মনে কইরা আমার বাড়িত আসলেন?”
মহসিন মেম্বার চেয়ারম্যানের পাশে বসতে বসতে বললেন…
—“আমার ছেলের কু*কর্মের কথা তো ইতিমধ্যে আপনার কান পর্যন্ত পৌঁছাইছে নিশ্চয়ই!”
—“হ, শুনলাম টুকটাক কিছু কথা। কাল তো আপনার পোলার কু*কর্মের জন্য বিচার বৈঠকখানাও বসানোর কথা বইলা গেছেন কুশল চৌধুরী।”
—“আমি এতো ঘুরায় প্য*চা*য় কথা কইতে পারি না চেয়ারম্যান সাহেব। যা কওনের সরাসরি কইতাছি। মনোযোগ দিয়া আমার কথাগুলো শুইনেন।”
আমজাদ হোসেন কিছুটা অবাক হয়ে মহসিন মেম্বারের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলেন…
—“কি কথা বলতে চাইতাছেন আপনি মহসিন মেম্বার!”
—“আমার পোলায় একটা অ*ন্যা*য় কইরা ফেলছে আমি মানতাছি। কাল বিচার বৈঠকখানায় আমার পোলার কু*কর্মের জন্য আমারেও মেম্বারের পদ থাইকা ইস্তফা দেওন লাগতে পারে। যা আমি কিছুতেই চাই না। আজ আমার পোলায় কইলো সে একা নাকি চাষীর মেয়েকে ধ্ব*র্ষ*ণ করে নি। ওর লগে আপনার পোলা আরিফ ও সঙ্গ দিয়েছিলো। সেই কথা যে আপনে জানেন এটাও আমি জানি। নিজের পদ, সম্মান ও ছেলের জীবন বাঁচানের লাইগা আপনে হয়তো কোনো না কোনো ব্যবস্থা ঠিকই লইছেন ইতিমধ্যে। কিন্তু আপনে একা এই স*ম*স্যা থাইকা বাঁইচা যাবেন এইটা তো হয় না। যেহেতু আপনার আর আমার পোলা দু’জনে একই দো*ষে দো*ষী হইছে তাই বাঁচার অধিকারও ওদের দু’জনেরই আছে। তাই আগামীকাল বিচার বৈঠকখানা বসার আগেই এমন কোনো ব্যবস্থা গ্রহন করুন যেনো সা*প ও ম*রে আর লাঠিটাও অ*ক্ষ*ত থাকে। আর যদি তেমন কিছু না কইরা আপনে একলা বাঁচার চেষ্টা করেন তাহলে আরিফের কু*কর্মের সত্যটা আমি পুরো গ্রামবাসীর সামনে কইয়া দিমু। কুশল চৌধুরী স্বয়ং উপস্থিত থাকবেন সেখানে, তার বাছ-বিচারে কোনো ভু*ল-ত্রু*টিও হবে না আমি জানি। তখন আমাকে তো আমার মেম্বারের পদ থাইকা ইস্তফা দেওন লাগবেই সাথে আপনাকেও চেয়ারম্যানের পদ থাইকা ইস্তফা দেওন লাগবে। তাই যা করার একটু ভাইবা-চিন্তে করিয়েন। বাঁচার হইলে আমারে সাথে লইয়া বাঁচার চেষ্টা করেন আর না হলে আমি আপনারে লইয়াই ম*র*মু।”
মহসিন মেম্বার এর কথাগুলো শুনে আমজাদ হোসেনের চেহারায় চিন্তার ছাপ স্পষ্ট হয়। মহসিন মেম্বার আর কিছু না বলে বসাবস্থা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে আমজাদ হোসেনের বাসা থেকে বেড়িয়ে যান।
(৭৬)
কুশলরা ইতিমধ্যে ২ঘন্টার পথ অতিক্রম করেছে। বেলা ডুবে গিয়েছে বেশ কিছুসময় পূর্বে। আকাশটা হালকা মেঘাচ্ছন্ন হওয়ায় চারপাশ কেমন অন্ধকারে ছেয়ে আছে। সেইসময় তরুনিমা বললো….
—“সামনে কোথাও চায়ের স্টল আছে কি?”
কুশল গাড়ি চালাতে চালাতে প্রতিত্তোর করলো…
—“হুম, আর মিনিট পাঁচেক পথ অতিক্রম করলেই চায়ের স্টল পড়বে একটা।”
—“সেখানে গাড়ি দাঁড় করিয়েন একটু, অনেকসময় ধরে বসে আছি তাই বোর লাগছে। চা পান করলে যদি মনটা একটু রিফ্রেশ ফিল করে।”
—“আচ্ছা।”
প্রায় পাঁচ মিনিটের পথ অতিক্রম করার পর সেই চায়ের স্টলের পাশে গাড়ি থামায় কুশল। এরপর ওরা গাড়ি থেকে নেমে চায়ের স্টলের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। সাদিক ভিতরে গিয়ে সবার জন্য চা অর্ডার করে। তরু আর সন্ধ্যা গাড়ির পাশে দাঁড়িয়ে আছে। কুশলের ফোন আসায় সে সাইডে চলে যায় কথা বলার জন্য। কিছুসময় পর সাদিক তরুনিমা আর সন্ধ্যার জন্য দুই কাপ চা এনে ওদের দেয়। সন্ধ্যা চায়ের কাপ নিয়ে গাড়ির ভিতরে গিয়ে বসে। তরুনিমা চায়ের কাপ হাতে নিয়ে সাদিককে উদ্দেশ্য করে বললো….
—“সাদিক ভাই…আপনার স্যার কি কাজের জন্য গ্রামে যাচ্ছেন আমাকে বলুন তো একটু।”
সাদিক মাথানিচু করে শান্ত স্বরে বললো…
—“ক্ষমা করবেন ম্যডাম…এই বিষয়ে আমি আপনাকে কিছু জানাতে পারবো না।”
তরুনিমা কিছুটা রাগ নিয়ে বললো….
—“আপনি যদি আমাকে সত্যটা না জানান তাহলে আমি আপনার নামে ওনার কাছে মি*থ্যে না*লি*শ করবো বলে দিলাম।”
তরুনিমার এমন কথায় সাদিক কিছুটা ভ*য় পেয়ে যায়। অতঃপর আর কোনো উপায় না পেয়ে সাদিক কুশলের গ্রামে যাওয়ার সম্পূর্ণ কারণ তরুনিমাকে জানিয়ে দেয়। তরুনিমা স্তব্ধ হয়ে গিয়েছে ইতিমধ্যে। পরমূহূর্তে সাদিক অনুরোধের স্বরে বললো…
—“ম্যডাম…আমি যে আপনাকে এসব জানিয়েছে দয়াকরে স্যারকে জানাবেন না। তাহলে স্যার আমার উপর অনেক রু*ষ্ট হয়ে যাবেন।”
তরুনিমা স্তব্ধ কন্ঠে বললো….
—“আচ্ছা।”
অতঃপর সাদিক আবারও চা-স্টলের ভিতরে চলে যায়। কিছুসময় পর কুশল ফোনে কথা বলা শেষ করে তরুর পাশে এসে দাঁড়াতেই তরুকে চায়ের ভরা কাপ হাতে নিয়ে এক ধ্যনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বললো….
—“তুমি কি ঠান্ডা চা পান করে নিজের মনকে রিফ্রেশ করো নাকি!”
আকস্মিক কুশলের কন্ঠ শোনামাত্র তরু কিছুটা ভরকে যায়। পরমূহূর্তে নিজেকে সামলে নিয়ে বললো….
—“চা হলেই হলো…ঠান্ডা বা গরমে কিছু যায় আসে না।”
কথাটি বলেই তরুনিমা কুশলকে অবাক করে দিয়ে একচুমুকে সবটুকু চা পান করে মাটির পাত্রটি সাইডে ফেলে দিয়ে গাড়িতে উঠে বসে। বিষয়টা হজম করে নিতে কুশলের কয়েকসেকেন্ড সময় লাগে। পরক্ষণেই কুশল চা-স্টলে গিয়ে চা পান করে নেয়। কিছুসময় পর কুশল আর সাদিক গাড়িতে এসে বসে পরে। কুশল গাড়ি স্টার্ট করে, গাড়ি চলতে থাকে আপন গতিতে। বেশকিছু সময় পর তিনমাথায় থাকা পুলিশরা কুশলদের গাড়ি থামাতে বললে কুশল গাড়ি থামিয়ে ওর পাশের গ্লাস নামিয়ে দিতেই একজন পুলিশ এসে শান্ত স্বরে বললেন….
—“স্যার…এই রাস্তা দিয়ে আজ গ্রামে যাওয়া যাবে না। গতকাল রাতে বড় ধরণের ঝড়বৃষ্টি হওয়ায় রাস্তার উপর অনেকগুলো গাছ ভে*ঙে পড়েছে। সকাল থেকে সেগুলো সরানোর কাজে নিয়োজিত আছে আমাদের টিম। আপনাদের যদি গ্রামে যাওয়া জরুরী হয় তাহলে আজকের জন্য জঙ্গলের রাস্তা ধরে চলে যান।”
অতঃপর কুশল ওর পাশের গ্লাসটা উঠিয়ে গাড়ি স্টার্ট করে জঙ্গলের রাস্তা ধরে যাওয়া শুরু করে। কুশলরা চলে যেতেই সেখানে থাকা একজন পুলিশ পকেট থেকে ফোন বের করে কাওকে কল করে।
চলবে ইনশাআল্লাহ………..
#হৃদকোঠোরে_রেখেছি_তোমায়🖤(২৯)
#Maisha_Jannat_Nura (লেখিকা)
(৭৭)
জঙ্গলের রাস্তা ধরে বেশ খানিকটা পথ অতিক্রম করতেই হঠাৎ কুশলদের গাড়ির সামনে কেও একজন চলে আসলে কুশল দ্রুত ব্রেক কষে গাড়ি থামায় যার ফলে তরু ও সন্ধ্যা সামনের দিকে কিছুটা ঝুঁকে আসে। তরু রাগী স্বরে বললো…
—“এভাবে কেও ব্রেক করে নাকি? এখুনি তো সামনের সিটের সাথে মাথা লেগে সাং*ঘা*তি*ক কিছু হয়ে যেতে পারতো।”
সাদিক বললো…
—“ম্যডাম..হুট করেই গাড়ির সামনে কে যেনো চলে এসেছে তাই স্যার তাকে বাঁচাতে গিয়ে এভাবে ব্রেক করে গাড়ি থামাতে বাধ্য হয়েছেন। স্যার আমি দেখছি কে এসেছে।”
এই বলে সাদিক দরজা খুলে গাড়ি থেকে নেমে গাড়ির সামনে দাঁড়ানো সেই মানুষটির কাছে যায়। কুশল, তরুনিমা, সন্ধ্যা গাড়ির ভিতর থেকেই লক্ষ্য করছে বিষয়টা। পরক্ষণেই সাদিকের সাথে দাড়ানো লোকটি তার কমোরের ভাজ থেকে একটা ধাঁ*রা*লো ছু*ড়ি বের করে কুশলের দিকে একপলক তাকায়। কুশল লোকটির হাতে ছু*ড়ি দেখা মাত্র দ্রুততার সাথে সিটবেল্ট খুলে গাড়ি থেকে নামতে নামতে বললো….
—“এ…এ…সাদিককককক…!”
সাদিক কুশলের ডাক শুনে সেদিকে তাকাতেই লোকটি সাদিকের পেটে ছু*ড়ি*টি ঢুকিয়ে একবার মো*চ*ড় দিয়ে একটানে বের করে নেয়। সাদিক হতভম্ব হয়ে লোকটির দিকে তাকিয়ে একহাতে পেট চেপে ধরে ‘আআআআ’ বলে চিৎকার করে উঠে অন্যহাত দিয়ে ছু*ড়ি*কা*ঘা*ত করা লোকটিকে ধরার চেষ্টা করলেও ব্যর্থ হয়। কুশলকে আসতে দেখে লোকটি একদৌড়ে জঙ্গলের ভিতরে অন্ধকারের মাঝে হারিয়ে যায়। সাদিকের চিৎকারে পিছনে থাকা গার্ডসদের গাড়ি থেকে সবাই নেমে কুশলের গাড়ির চারপাশ ঘিরে ধরে। কুশল সাদিকের কাছে যেতেই সাদিক মাটিতে লুটিয়ে পড়ে দ*রু*ণ য*ন্ত্র*ণা*য় আ*র্ত*নাদ করতে থাকে। কুশল ২জন গার্ডসকে ডাক দেয়। গার্ড ২জন আসতেই কুশল বললো….
—“সাদিককে দ্রুত গাড়িতে উঠাও৷”
গার্ড দুজন সাদিককে তুলে গাড়ির কাছে আনছে দেখে তরুনিমা সন্ধ্যাকে বললো…
—“আমি এখন সামনের সিটে বসছি, সাদিককে তোমার পাশে এখানে শুইয়ে দিক।”
তরুনিমা দরজা খুলে গাড়ি থেকে নেমে দাঁড়ায়। গার্ডস ২জন সাদিককে সন্ধ্যার পাশে পিছনের সিটে শুইয়ে দিতেই তরুনিমা দরজা আটকে দিয়ে গাড়ির সামনের দরজা খুলে সেখানে বসে পড়ে। কুশল গাড়ির কাছে আসতে নিলে সাদিককে ছু*ড়ি*কা*ঘা*ত করা সেই লোকটি আকস্মিক কুশলের কাছে এসে ওকেও আ*ঘা*ত করার চেষ্টা করলে কুশল কৌশলে লোকটির হাত ধরে ছু*ড়ি*টি তারই গলায় চে*পে ধরে রাগী স্বরে বললো….
—“একটুও নড়ার চেষ্টা করলে এইমূহূর্তেই তোর শরীর থেকে মাথাটা আলাদা করে দিবো।”
কুশলের এমন কথায় লোকটি পুরোপুরি ভাবে স্থির হয়ে যায়। সেইসময় আরো দু’জন গার্ডস এসে লোকটিকে ধরে নিজেদের গাড়িতে ব*ন্দী করে নেয়। অতঃপর কুশল গাড়িতে এসে বসে সাদিকের দিকে ঘুরে বললো….
—“সন্ধ্যা…সাদিকের ক্ষ*ত স্থান একটা কিছু দিয়ে বেঁধে দে যেনো র*ক্ত*পাত কম হয়। আর ওর গালে হালকা হাতে চা*প*ড় দিতে থাক, ও যেনো সেন্স*লে*স হয়ে না যায়।”
কুশল গাড়ি স্টার্ট করে আবারও গ্রামের দিকেই যেতে শুরু করে। তরুনিমা বললো…..
—“গ্রামের দিকে যাচ্ছেন কেনো? ওখানে কি সাদিক ভাইয়ের চিকিৎসার কোনো সু-ব্যবস্থা পাওয়া যাবে!”
—“শহরে যেতে মিনিমাম ৩ঘন্টা সময় লাগবে। ততোক্ষণে সাদিকের অবস্থা হাতের বাহিরে চলে যেতে পারে। আমরা গ্রামের কাছাকাছিই চলে এসেছি। সেখানে সাদিকের প্রাথমিক চিকিৎসার জন্য যেকোনো একটা ব্যবস্থা হয়েই যাবে। সাদিকের অবস্থা কিছুটা সুবিধাজনক হলেই শহরে নিয়ে গিয়ে প্রোপার ট্রিটমেন্ট এর ব্যবস্থা নিবো।”
সন্ধ্যা হিজাব এর পাশাপাশি সাইড দিয়ে একটা লং ওড়না নিয়েছিলো। তাই সেই ওড়নাটি খুলে সাদিকের পেটের ক্ষ*ত স্থানটি বেঁধে দিয়ে ওর গালে হালকা হাতে চা*প*ড় দিতে দিতে বললো….
—“সাদিক ভাই… আপনার কিচ্ছু হবে না। মনোবল হারাবেন না, আপনাকে সজ্ঞানে থাকতে হবে। সাদিক ভাই…সাদিক ভাই…!”
সাদিকের শরীর ধীরে ধীরে নিস্তেজ হয়ে যাচ্ছে। সাদিক অশ্রুসিক্ত চোখে সন্ধ্যার দিকে তাকিয়ে ওর একহাত শক্ত করে চে*পে ধরে মুখ দিয়ে কিছু বলার অনেক চেষ্টা করেও ব্য*র্থ হয়। পরমুহূর্তেই খুব জোড়ে একবার নিঃশ্বাস নিয়ে সাদিক পুরোপুরি ভাবে নিস্তব্ধ হয়ে যায়। সন্ধ্যা উপলব্ধি করে সাদিকের ধরে রাখা হাতের সেই শক্ত বাঁধনটি হালকা হয়ে গিয়েছে। সন্ধ্যা নিজের উপর স্থির হওয়া সাদিকের শীতল দৃষ্টির দিকে স্তব্ধ নয়নে তাকিয়ে রয়। সাদিকের চোখজোড়া যেনো চিৎকার করে সন্ধ্যাকে বলছে…..
—“আমার শেষ নিঃশ্বাস পড়ার সাথে সাথে তোমার জন্য একটু একটু করে সৃষ্টি হওয়া না বলা সকল অনুভূতি গুলোরও আজ মৃ*ত্যু হলো। তোমারে আমি কতোটা ভালোবাসি তা আর কখনও জানা হইবো না তোমার।”
পরক্ষণেই সন্ধ্যা ওর কাঁ*প*তে থাকা হাতটি সাদিকের নাকের কাছে রাখতেই শিওরে উঠে। নিঃশ্বাস পড়ছে না….নাহ্ সাদিকের নিঃশ্বাস আর পড়ছে না। সন্ধ্যা কুশলের দিকে তাকিয়ে মিইয়ে যাওয়া স্বরে বললো….
—“ম-মে-মেজো ভ-ভাইয়া….সা-সাদিক ভা-ভাইয়ের ন-নিঃ-নিঃশ্বাস থেমে গিয়েছে।”
সন্ধ্যার মুখে এমন কথা শোনামাত্র কুশল তৎক্ষনাৎ গাড়ির ব্রেক কষে। তরুনিমা নিজের সিটবেল্ট খুলে উপর হয়ে সাদিকের পালস্ চেইক করতেই থমকে যায়। সাদিকের পালস্ চলছে না। তরুনিমা সাদিকের মেলে থাকা চোখজোড়া বন্ধ করে দিয়ে নিজের সিটে সোজা হয়ে বসে মলিন কন্ঠে বললো….
—“সাদিক ভাই আর আমাদের মাঝে নেই।”
কুশল গাড়ির সিটের সাথে মাথা ঠেকিয়ে একহাতের দুটো আঙুল দিয়ে দুই চোখের কোটর চেপে ধরে চোখ বুঁজে নেয়। তরুনিমা মাথা নিচু করে বসে রয়। সন্ধ্যা সাদিকের বুঁজে যাওয়া নিস্তব্ধ মুখশ্রীর দিকে তাকিয়ে নিরবে অশ্রুপাত করতে থাকে৷
(৭৮)
তালুকদার ভিলায় নিজের রুমে বিছানায় শুয়ে আছেন তমিজ তালুকদারের স্ত্রী রেবেকা তালুকদার। রেবেকার হাতের বাম পার্শে চিন্তিত মুখশ্রী নিয়ে বসে আছেন তমিজ তালুকদার। রেবেকার হাতের ডান পাশে একটা চেয়ারে বসে রেবেকার প্রেসার মাপছেন ওদের পারিবারিক ডাক্তার রফিক আজম সাহেব। ওদের সম্মুখে গম্ভীর মুখশ্রী নিয়ে দাঁড়িয়ে পুরো বিষয়টা পর্যবেক্ষণ করছে তাহির। সেইসময় ডাক্তার রফিক আজম সাহেব শান্ত স্বরে বললেন…..
—“মিসেস.তালুকদার সাহেবা সঠিকভাবে খাওয়া-দাওয়া করার অভ্যাস হয়তো ছেড়ে দিয়েছেন! প্রেসার একেবারেই লো হয়ে গিয়েছে, তাই শরীর দূর্বলতার কারণে মাথা ঘুরে উঠেছিলো ওনার। এছাড়া চিন্তার কোনো বিশেষ কারণ নেই। এই বয়সে পুষ্টিকর খাবার খাওয়া আর পর্যাপ্ত পরিমাণ বিশ্রাম নেওয়া প্রয়োজন
ওনার। কোনো বিষয় নিয়ে দুশ্চিন্তা একদমই করা যাবে না। এতে ওনার শারীরিক অবস্থা দিনকে দিন আরো বেশি অবণতির দিকে চলে যাবে। আমি আপাতত কয়েকটা ঔষধ লিখে দিচ্ছি এই ঔষধ গুলো নিয়ম মাফিক খেতে হবে, এতে ওনার খাবার খাওয়ার প্রতি রুচি বৃদ্ধি পাবে আর টেনশন মুক্ত থাকতে পারবেন।”
এই বলে রফিক আজম সাহেব বসাবস্থা থেকে উঠে দাঁড়াতেই তমিজ তালুকদার বললেন…
—“তাহির…তোমার ডাক্তার আঙ্কেলকে একটু এগিয়ে দিয়ে এসো।”
—“ঠিক আছে।”
অতঃপর তাহির আর রফিক আজম সাহেব একসাথে স্থান ত্যগ করলেন। ওরা চলে যেতেই রেবেকা তৎক্ষনাৎ শোয়াবস্থা থেকে উঠে বিছানা থেকে নেমে দাঁড়ালেন। তমিজ তালুকদার চোখ বড় বড় করে নিজের স্ত্রীকে দেখছেন। রেবেকা কিছুটা বিরক্তি ভাব নিয়ে বললেন…
—“ওমন ভূ*তে*র মতো গোল গোল চোখ করে আমার দিকে চেয়ে আছো কেনো?”
—“তোমার না শরীর অনেক দূর্বল! একটু আগেই একলা শোয়াবস্থা থেকে উঠে বসতে পর্যন্ত পারছিলে না! চোখের পলকেই শরীরে এতো এনার্জি আসলো কি করে?”
—“এতো বছর ধরে আমার সাথে সংসার করতেছো এখনও আমাকে চিনে উঠতে পারলে না! কেমন স্বামী তাহলে তুমি একটাবার চিন্তা করো।”
—“তারমানে তুমি সম্পূর্ণরূপেই সুস্থ আছো শুধু তাহিরের সামনে অ*সুস্থতার নাটক করেছো এতোসময়! কিন্তু এমন করার কারণ কি?”
রেবেকা তমিজের দিকে ঘুরে দাঁড়িয়ে বাঁকা হেসে বললেন…
—“কারণ না থাকলে এমন একটা ড্রামাসিন ক্রিয়েট করতাম নাকি?”
—“কি কারণ বলো আমায়।”
—“তোমার ছেলে তো আজই ঐ মেয়ের সাথে সাক্ষাৎ করতে তার বাড়িতে যাবে বলে তৈরি হয়েছিলো। ওর যাওয়া আটকানোর জন্যই আমাকে অ*সুস্থ হওয়ার নাটক করতে হলো।”
—“এই নাটক করে তাহিরের যাওয়া না হয় আজ আটকাতে পারলে কিন্তু কালকে আটকাবে কি করে?”
—“কাল ভোরের মধ্যে আমার বোনের একমাত্র মেয়ে হুমায়রা কানাডা থেকে বাংলাদেশে আসছে। হুমায়রা দেখতে মাশাআল্লাহ যেকোনো পুরুষের নজর কাড়ার মতো সৌন্দর্যের অধিকারী। আর ও অনেক বছর আগে থেকেই তাহিরকে মনেপ্রাণে পছন্দ করতো। আমার বোন আজ সকালেই আমাকে জানিয়েছে হুমায়রা তার নিকট তাহিরের বউ হওয়ার ইচ্ছে প্রকাশ করেছে। তাই আমি খুশিমনে হুমায়রাকে দেশে আসতে বলেছি। হুমায়রাই পারবে তাহিরের মন ও মস্তিষ্ক থেকে একেবারের জন্য ঐ মেয়ের সকল স্মৃতি ও অনুভূতি গুলো মুছে ফেলে নিজের জায়গা বানিয়ে নিতে। আমি আমার ছেলেকে আর ঐ মেয়ের সংস্পর্শে যেতে দিবো না। একবার যাওয়ার চেষ্টা করে নিজের জীবনের ৫টা বছর সে ন*ষ্ট করেছে কিন্তু আর ১টা সেকেন্ড ও ন*ষ্ট হতে দিবো না আমি।”
—“তাহির ঐ মেয়ের জন্য যেই পরিমাণ দিওয়ানা, হুমায়রার পক্ষে তাহিরের মন ও মস্তিষ্ক থেকে ঐ মেয়েকে ভুলিয়ে দিয়ে নিজের জায়গা বানিয়ে নেওয়ার জার্নিটা এতোটা সহজ হবে বলে আমার মনে হয়।”
—“সহজ হবে না জানি। কিন্তু অসম্ভব তো না, তাই চেষ্টা করতেও কোনো দো*ষ নেই।”
রেবেকা ও তমিজের কথপোকথনের মাঝেই ওদের রুমের বাহির থেকে কারোর পায়ের আওয়াজ ভেসে আসলে রেবেকা দ্রুততার সাথে বিছানায় শুয়ে পড়তে পড়তে বললো….
—“নিশ্চয়ই তোমার ছেলে এসেছে।”
রেবেকা বিছানায় শুয়ে পড়তেই তাহির রুমে প্রবেশ করে হাতে থাকা প্যকেটটা তমিজের দিকে এগিয়ে দিয়ে বললো…..
—“মায়ের ঔষধগুলো এই প্যকেটের ভিতর রাখা আছে। সময় মতো খাইয়ে দিও বাবা। আমার একটু কাজ আছে, বাহিরে যেতে হবে।”
এই বলে তাহির রুম থেকে বেড়োতে নিলে রেবেকা ধীরস্বরে তাহিরকে ডাক দেয়। তাহির আবারও পিছন ঘুরে দাঁড়াতেই রেবেকা ধীরস্বরে বললেন…
—“তাহির…বাবা…আমার পাশে এসে বসবি একটু!”
তাহিরে বিনাবাক্যে ওর মায়ের হাতের ডান পার্শে এসে বসতেই রেবেকা তাহিরে একহাত নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে বললেন….
—“আজ একটু আমায় সময় দে বাবা…বাহিরে যাস না।”
মায়ের এমন আবদার তাহির ফেলতে না পেরে শান্ত স্বরে বললো…
—“আচ্ছা, ঠিক আছে মা..আমি কোথাও যাচ্ছি না আজ।”
রেবেকা তাহিরের কথা শুনে স্মিত হাসলেন। তমিজ তালুকদার মনে মনে বললেন….
—“আমার বউ এতো নিখুঁত ভাবে অভিনয় করতে পারে আগে কেনো বুঝলাম না…!”
চলবে ইনশাআল্লাহ….