হৃদকোঠোরে রেখেছি তোমায় পর্ব-৩৯ এবং বোনাস পর্ব

0
470

#হৃদকোঠোরে_রেখেছি_তোমায়🖤(৩৯)
#Maisha_Jannat_Nura (লেখিকা)

(৯৭)
অনেকসময় ধরে গাড়িতে বসে থাকায় হুমায়রা বিরক্তির স্বরে বললো…
—“এরকম দায়িত্বজ্ঞানহীন পুুরুষ আমি আর ২য় কাওকে দেখি নি। কি এমন রাজ কার্য উদ্ধার করতে ব্যস্ত হয়ে আছেন উনি যে একটাবার বাড়ির বাহিরে এসে আমার খোঁজ নেওয়ার সময় টুকু পাচ্ছেন না।”

হুমায়রা ওর কথা বলার মাঝেই কারোর ফোন বেজে উঠার শব্দ শুনতে পায়। পরক্ষণে গাড়ির ড্রাইভিং সিটের পাশে থাকা বক্সের উপর রাখা তাহিরের ফোনের দিকে চোখ পড়তেই দেখে ফোনস্ক্রিণের উপর তাহিরের মা রেবেকা তালুকদারের হাস্যোজ্জ্বল ছবি ভেসে উঠেছে। হুমায়রা তাহিরের ফোনটি হাতে নিয়ে কলটি রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে রেবেকা তালুকদারের চিন্তিত কন্ঠস্বর ভেসে আসে…..

—“তাহির…বাবা…কোথায় তুই? হঠাৎ করে কাওকে কিছু না বলে কোথায় চলে গেলি তুই? আর হ্যা…যেখানেই যাস না কেনো ভুলেও যেনো ঐ সিকদারদের বাসায় যাওয়া হয় না তোর। ঐ সিকদার পরিবার তোকে মি*থ্যে খু*নে*র দায়ে ফাঁ*সি*য়ে পাঁচ পাঁচটি বছর ধরে জেল খা*টি*য়েছে। তাই ওদের কারোর ছায়াও এবার তোর উপর পড়তে দিস না বাবা। ওদের থেকে দূরে থাক তুই। এটা তোর জন্মদাত্রী মায়ের অনুরোধ।”

রেবেকার মুখে এরূপ কথাগুলো শুনে হুমায়রার মাথার উপর যেনো বিনামেঘের ব*জ্র*পাত হয়। তাহির গত ৫ বছর যাবৎ মি*থ্যে খু*নে*র দায়ে জে*লে ছিলো এই কথা হুমায়রা আজ জানতে পারলো। এতোগুলো বছর ধরে সে তার খালা-খালু এমনকি নিজের বাবা-মায়ের থেকে এটাই জেনে এসেছিলো যে তাহির উচ্চতর ডিগ্রী লাভের জন্য আমেরিকাতে ছিলো। হুমায়রা গাড়ির কাঁচ নামিয়ে বাসার গেইটের পাশে থাকা বোর্ডের উপর বড় বড় অক্ষরে সিকদার ভিলা লেখা দেখে সাময়িক সময়ের জন্য থমকে যায়। ফোনের ওপাশ থেকে রেবেকা তাহিরের কোনো রেসপন্স না পেয়ে আবারও বললেন….

—“কি রে বাবা…কথা বলছিস না যে? তবে কি তুই সিকদারদের বাসায় চলে গিয়েছিস? তাহির….!”

রেবেকার কথা শোনামাত্র হুমায়রার হুস ফিরে। নিজেকে কোনোভাবে সামলে নিয়ে হুমায়রা বলে উঠে….

—“খালা…আমি হুমায়রা! তাহির আমার সাথেই আছে। আমরা একটা চায়ের স্টলের সামনে বসে আছি। তাহির আমার জন্য চা আনতে চায়ের স্টলের ভিতরে গিয়েছে। আর চিন্তা করবেন না আমি তাহিরকে সিকদার ভিলার ধারের কাছেও যেতে দিবো না।”

তাহিরের ফোনে এই মূহূর্তে হুমায়রার কন্ঠস্বর শোনার মতো এসপেক্টেশন রেবেকা তালুকদার রাখেন নি। এতোগুলো বছর ধরে চেপে রাখা তি*ক্ত সত্যটি আজ হুমায়রার সামনে খোলাশা হলোই। হুমায়রা রেবেকার নিস্তব্ধতা দেখে তার অবস্থা বুঝতে পেরে বললো…..

—“এই বিষয় নিয়ে কোনো প্রকার এক্সপ্লেইন এখন আপনাকে করতে হবে না খালা। বাসায় ফেরার পর এই বিষয় নিয়ে কথা হবে আপনাদের সাথে। এখন রাখছি।”

এই বলে হুমায়রা কল কেটে দেয়। রেবেকা কান থেকে ফোনটা নামিয়ে বিছানার উপর রেখে একবার দীর্ঘশ্বাস ফেলে মুখ দিয়ে ‘চ’ শব্দ উচ্চারণ করলেন। হুমায়রা তড়িৎগতিতে গাড়ি থেকে নেমে গাড়িটি ভালোভাবে লক করে সিকদার ভিলার মেইন গেইট পেরিয়ে ভিতরে প্রবেশ করে। এই মুহূর্তে হুমায়রার হৃদস্পন্দের গতি স্বাভাবিক এর তুলনায় অনেক দ্রুততার সাথে বিট করছে। কিছুটা পথ অতিক্রম করার পর সিকদার ভিলার মূল দরজার সামনে এসে দাঁড়াতেই হুমায়রা দেখতে পায় ওর থেকে কয়েকহাত দূরে একজন মধ্যবয়সের মহিলা স্থির হয়ে দাড়িয়ে আছেন আর তার সামনে হাঁটু ভাজ করে মাথা নিচু অবস্থাতে তাহির বসে আছে। মূল দরজার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা সিকদার ভিলার কাজের মেয়ে মিতু হুমায়রাকে দেখা মাত্র কিছু বলতে নিলে হুমায়রা ইশারায় তাকে চুপ থাকতে বলে। মিতুও আর কিছু বলে না। পরক্ষণেই তাহির ওভাবে থেকেই চিৎকার করে কেঁদে উঠে বললো…..

—“হে আল্লাহ…..কি দো*ষ ছিলো আমার যার জন্য আমায় এতো বড় শা*স্তি দিলেন আপনি! নিঃস্বার্থ ভাবে কাওকে ভালোবাসার ফল বুঝি এতো ক*রু*ণ ভাবে পোহাতে হয়! আমাকে আজ এতো বেশি অসহায় কেনো বানিয়ে দিলেন আপনি! যাকে আমি আমার সবটুকু উজার করে ভালোবেসে ছিলাম। যাকে নিজের করে পাওয়ার জন্য পৃথিবীর সবরকম বাঁধার সাথে ল*ড়া*ই করেছিলাম আজ সে কিনা অন্যকারোর জীবনসঙ্গিনী রূপে নিজের জীবনের প্রতিটি সেকেন্ড সাচ্ছন্দ্যের সাথে পার করছে! বিনাদো*ষে বিগত পাঁচ পাঁচটি বছর ধরে জে*ল খাটতে হয়েছে আমায়। তবুও প্রতিটি দিনের শেষে আমার মনের ভিতর একটা আশার আলোই জ্বল জ্বল করতো যে, আমার ভালোবাসার মানুষটি আমার জন্য অপেক্ষা করছে। এই ন*র*ক য*ন্ত্র*ণা থেকে মুক্তি পাওয়া মাত্র আমি আমার ভালোবাসার মানুষটিকে পুরোপুরি ভাবে নিজের করে নিয়ে বাকিটা জীবন সুখে-শান্তিতে কাটিয়ে দিবো।”

হুমায়রার দু’চোখ বেয়ে অঝোর ধারায় নোনাজল ঝরে পড়ছে। তাহিরের বলা প্রতিটি শব্দ যেনো হুমায়রার বুকের ভিতর বি*ষা*ক্ত তীর হয়ে বিঁ*ধ*ছে আর অসহ্য য*ন্ত্র*ণায় ওর ভিতরটা ছাঁ*ড়*খার করে দিচ্ছে। নিজের ভালোবাসার মানুষটির মুখে তার ভালোবাসা হারিয়ে ফেলার কারণে আফসোসের বুলি শোনা ও অসহায়ের মতো তাঁকে কান্না করতে দেখার পর মনের ভিতর কাজ করা জ*ঘ*ন্য রকম য*ন্ত্র*ণা দায়ক অনুভূতি হয়তো পৃথিবীতে আর ২য় কিছুর জন্য হয় না। একটা মানুষ কাওকে কতোটা ভালোবাসলে তাকে হারানোর বেদনায় এমন অসহায়ের মতো কান্না করতে পারে তা হুমায়রা তাহিরকে দেখে বুঝতে পারছে।

তাহিরের এমন কান্নায় তমালিকা সিকদারের মনের ভিতর জমে থাকা সব রা*গ যেনো হাওয়ায় মিলিয়ে যায়। কিন্তু একজন মা হওয়ায় নিজের সন্তানের ভালোর কথা চিন্তা করার মতো ক্ষমতা তার ভিতর থেকে লোপ পায় না। তমালিকা সিকদার এহেনু পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে স্বা*র্থ*পর মায়ের মতো তাহিরকে উদ্দেশ্য করে বললেন….

—“সৃষ্টিকর্তা সকল পুরুষ ও নারীর জন্য একজন সঠিক জীবনসঙ্গী বা জীবনসঙ্গিনীকে সৃষ্টি করে রেখেছেন অনেক পূর্বেই। কিন্তু এখন যে বড্ড দেড়ি হয়ে গিয়েছে তাহির। বাস্তবতা ও সত্যটা যতো তি*ক্ত বা কঠিনই হোক না কেনো আমাদের তা মেনে নেওয়া উচিত। তরুনিমা এখন অন্য কারোর জীবনসঙ্গিনী। তাই ওকে আবার নিজের করে পাওয়া তোমার জন্য অসম্ভব। এই বাস্তব সত্যটাকে মেনে নিয়ে আমার মেয়েটাকে তুমি ভুলে যাও বাবা। ওর নতুন জীবনে তোমার ছায়া আর পড়তে দিও না। প্রকৃত ভালোবাসা যেমন মানুষকে স্বার্থপর হতে শিখায় তেমন পরিস্থিতির বিপাকে পড়লে প্রকৃত ভালোবাসা মানুষকে ত্য*গ করতেও শিখায়। আমার মেয়ে তরুনিমার প্রতি তোমার ভালোবাসা যদি সত্যিই প্রকৃত ও নিঃস্বার্থ হয়ে থাকে তাহলে তুমি আমার মেয়ের সুখময় জীবনটাকে ন*ষ্ট করে দিও না। এটা তোমার নিকট একজন মায়ের আকুল অনুরোধ রইলো।”

তমালিকার বলা প্রতিটি কথা তাহিরের বুকের ভিতরে তৈরি হওয়া ক্ষ*ত স্থানের উপর শান্তনার পাতলা প্রলেপ এর মতো ছড়িয়ে যায়। তাহির দু’হাতে নিজের চোখের পানি মুছে মাথা তুলে তমালিকা সিকদারের দিকে অসহায় দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে আকুল কন্ঠে বললো….

—“শেষ বারের মতো একটাবার তরুনিমাকে দেখার সুযোগ আমায় দিবেন প্লিজ! আমি কথা দিচ্ছি ওর কাছে যাওয়ার চেষ্টা করবো না কিংবা আমার তরফ থেকে ওর কোনোরূপ ক্ষ*তিও আমি হতে দিবো না। আমার জন্য ওর বর্তমান জীবনে কোনোরূপ সমস্যারও সৃষ্টি হবে না। শুধু দূর থেকে ওকে একপলক দেখবো। নিজের নতুন জীবনে ও কতোটা সুখে আছে এতোটুকু দেখবো। তারপর ওর সামনেই ওর সুখের জন্য আমি আমার ভালোবাসার অনুভূতিগুলোর কু*র*বা*নি দিয়ে সারাজীবনের জন্য ওর থেকে অনেকদূরে চলে যাবো। যেখানে চলে গেলে আর কখনও ওর জীবনে আমার ছায়া পড়বে না সেখানে চলে যাবো।”

তাহিরের আকুল কন্ঠে করা আবেদনটি ফেলার মতো স্বা*র্থ*পর মানসিকতা তমালিকা সিকদার নিজের মধ্যে করে উঠতে পারলেন না। তাই চৌধুরী মেনশনের ঠিকানা তিনি তাহিরকে দিয়ে দিলেন। তাহির বসাবস্থা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে পিছন ঘুরতেই দরজার সামনে হুমায়রাকে স্তব্ধ হয়ে দাড়িয়ে থাকতে দেখতে পায়। হুমায়রা কিছু না বলে সামনের দিকে অগ্রসর হয়। তাহিরও সিকদার ভিলার মূল দরজা পেরিয়ে বাহিরে চলে যায়।

সিকদার ভিলার সামনে দাঁড় করিয়ে রাখা তাহিরের গাড়ির কাছে এসে পিছনের দরজাটি খুলে সেখানে বসে পরে হুমায়রা। পরক্ষণেই তাহির গাড়ির কাছে এসে ড্রাইভিং সিটের দরজাটি খুলে পিছনের সিটে হুমায়রাকে মাথা নিচু করে বসে থাকতে দেখেও মুখে কিছু না বলে নিজ সিটে বসে দরজা লাগিয়ে দিয়ে গাড়ি স্টার্ট করে। পুরো রাস্তা গাড়ির ভিতর পিনপতন নীরবতা বিরাজ করে। তাহির বা হুমায়রা কেও কারোর সাথে একটা টু শব্দ ও করে না।

#চলবে ইনশাআল্লাহ…….

#হৃদকোঠোরে_রেখেছি_তোমায়🖤(বোনাস পর্ব-২)
#Maisha_Jannat_Nura (লেখিকা)

(৯৮)
পশ্চিমাকাশে ক্লান্ত সূর্য হেলে পড়ে সন্ধ্যা হওয়ার পূর্বাভাস দিচ্ছে। অনন্যার গর্ভে চৌধুরী পরিবারের নতুন সদস্য আসার আনন্দে চৌধুরী মেনশন জুড়ে যেনো আনন্দের মেলা বসেছে। রিসিপশনের জন্য চৌধুরী মেনশনের পিছন পার্শে বাগান সাইডটা খুব সুন্দর ভাবে সাজানো হয়েছে। বেশিরভাবগ অতিথিরাই ইতিমধ্যে এসে পড়েছেন।
.
.
নিজ রুমে অনেকসময় ধরে তরুনিমা কুশলের পছন্দ করে দেওয়া গাড় নীল রংয়ের সেই শাড়িটি পড়ার চেষ্টা করছে। কিন্তু প্রতিবারই বিপত্তি বাঁধছে শাড়ির কুঁচি ঠিক করার সময় একবার কুঁচি গুলো ছোট-বড় হচ্ছে তো আরেকবার কুঁচিগুলো এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। আবার আঁচলে পিন সেট করার সময় বুকের উপর থাকা কুঁচি গুলোও অগোছালো হয়ে যাচ্ছে। সবমিলিয়ে একপ্রকার যাচ্ছেতাই অবস্থা হয়ে দাঁড়িয়েছে তরুনিমা। পরক্ষণেই তরুনিমা একহাতে শাড়ির কুঁচির অংশটুকু আর অন্যহাতে শাড়ির আঁচলের অংশটুকু ধরে কাঁদো কাঁদো স্বরে বললো….

—“ধূ*র এই সব শাড়ি কি একা একা ঠিক ভাবে পড়া যায় নাকি! বাড়ির সবাই তো নিজ নিজ কাজে নিচে ব্যস্ত হয়ে আছে আমাকে সাহায্য করার মতো এখানে কেও নেই। এখন আমি কি করবো!”

সেইসময় আকস্মিক পিছন থেকে রুমের দরজা বন্ধ হয়ে যাওয়ার মতো খ*ট করে শব্দ হলে তরু পিছন ঘুরে দাঁড়িয়ে থাকা অবস্থাতেই বললো…..

—“কে?”

কুশল শান্ত স্বরে বললো…
—“আমি।”

—“আপনার এখানে এখন কি কাজ? বাহিরে যান আমার শাড়ি পড়া শেষ হয় নি এখনও।”

—“নিচে বেশিরভাগ অতিথিরা ইতিমধ্যে এসে পড়েছেন। আর সবাই কুশল চৌধুরী বউকে খুঁজছেন।”

কুশলের এমন কথা শুনে তরু অবাক স্বরে বললো…

—“চৌধুরী পরিবারের নতুন সদস্য তো বড় ভাবীর গর্ভে আসতে চলেছে তাকে দেখার জন্য ব্যকুল না হয়ে আমাকে খোঁজার কারণ কি?”

—“গুরুজনরা বলছেন বছর ঘুরতেই যেনো তারা চৌধুরী পরিবারে আরেকজন নতুন সদস্য আসার আনন্দ অনুষ্ঠানে আসতে পারেন তাই কুশল চৌধুরীর বউয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দোয়া দেওয়ার জন্য তোমায় খুঁজছে।”

কুশলের কথার ভাঁজ বুঝতে না পেরেই তরু বলে উঠে….
—“ওহহ আচ্ছা…এই ব্যপার।”

পরক্ষনেই তা বুঝতে পেরে তরু লজ্জায় চোখ-মুখ খিঁচে বন্ধ করে ফেলে। কুশল তরুর অবস্থা বুঝতে পেরে নিঃশব্দে হাসি দেয়। তরু লজ্জার হাত থেকে কিছুটা রেহাই পেতে কুশলকে উদ্দেশ্য করে বললো….

—“এই আপনি এখন যান তো। আমাকে শাড়ি পড়া শেষ করতে দিন।”

কুশল ভ্রু কুঁচকে তরুর দিকে তাকিয়ে বললো….
—“আমি কি তোমাকে ধরে রেখেছি নাকি যার জন্য তুমি শাড়ি পড়তে পারছো না!”

কুশলের এমন কথায় তরুর শরীর যেনো তেলে-বেগুনে জ্ব*লে উঠে। তরু দাঁত কিড়মিড় করে বললো….

—“হয় রুমের বাহিরে গিয়ে দাঁড়ান নয়তো বেলকনিতে চলে যান। তবুও এখানে থাকা হবে না আপনার।”

কুশল শান্ত দৃষ্টি নিয়ে তরুর দিকে তাকিয়ে বললো….
—“আমার উপস্থিতি যখন তোমায় এতোটাই অস্বস্তিতে ফেলছে তখন আমি বেলকনিতেই চলে যাচ্ছি।”

এই বলে কুশল বেলকনিতে চলে যায়। তরু ঘাড় বাঁকিয়ে বেলকনির দিকে একটু ঝুঁকতেই কুশলকে অন্যপাশ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ছোট্টো করে একবার নিঃশ্বাস ফেলে আবারও শাড়ি পড়ার কাজে মনোনিবেশ করে। প্রায় আধঘন্টা ধরে বেলকনিতে দাঁড়িয়ে থাকার পর তরুর শাড়ি পড়া শেষ হয়েছে ভেবে কুশল রুমে প্রবেশ করতেই দেখে তরু এখনও আগের ন্যয় শাড়ি হাতে নিয়েই দাঁড়িয়ে আছে। কুশল বুঝতে পারে তরু একা শাড়িটা পরে উঠতে পারছে না। রুমের ভিতর আবারও কুশলের উপস্থিতি টের পেয়ে তরু বললো….

—“এই আপনি কি একটু সময়ের জন্য স্থির হয়ে বেলকনিতে দাঁড়িয়ে থাকতে পারছিলেন না! একে তো আপনার পছন্দ করে দেওয়া শাড়িটা আমাকে অনেক সময় ধরে জ্বা*লা*চ্ছে তার উপর আরেক আপনি একটু পর পর উদয় হয়ে শাড়ি পড়ার কাজে আমার মনোযোগটাই ন*ষ্ট করে দিচ্ছেন।”

—“দীর্ঘ ৩০ মিনিট ধরে তুমি শাড়িটা পড়ার জন্য দারুণ পরিশ্রম করে যাচ্ছো কিন্তু পরিশেষে ব্য*র্থ হয়ে পূর্বের জায়গাতেই ফিরে আসছো। এভাবে চলতে থাকলে আজকের পার্টিতে তোমাকে দোয়া দেওয়ার জন্য অপেক্ষাকৃত অতিথিরা তোমার দেখা না পেয়ে হতাশ হয়ে খাওয়া-দাওয়ার পর্ব শেষ করে নিজ নিজ বাড়িতে চলে গিয়ে শান্তিতে ঘুমিয়ে যাবেন। তাই তাঁদের হতাশ করার ইচ্ছে যদি তোমার না থাকে তাহলে তুমি চাইলে আমি তোমার শাড়ির কুঁচিগুলো ধরে তোমাকে দ্রুত শাড়ি পড়ার কাজ শেষ করতে সাহায্য করতে পারি।”

কুশলের এরূপ কথা শুনে তরু শান্ত দৃষ্টি নিয়ে ওর দিকে তাকায়। পরক্ষণেই তরু শাড়ির কুচি করার অংশটুকু হাত থেকে ফেলে দেয়। তরুর সম্মতি পেয়ে কুশল হাসিমুখে তরুর কাছে গিয়ে হাটু ভাজ করে নিচে বসে পরে। অতঃপর তরুর দেখানো অনুযায়ী কুশল তরুকে শাড়ির কুচি গুলো সমান ভাবে গুছিয়ে নিতে সাহায্য করে। কুচির ভাঁজে একটা পিন সেট করে দিয়ে কুশল বসাবস্থা থেকে উঠে দাঁড়ায়। তরু ড্রেসিংটেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে বুকের উপরের কুঁচি গুলো ঠিক করে পিন লাগাতে নিলে কুশল আবারও তরুর কাছে গিয়ে পিনটি লাগিয়ে দেয়। এরপর কুশল তরুর দুই কাঁধে দু’হাত রেখে তরুকে টুলের উপর বসিয়ে দিয়ে ড্রেসিং টেবিলের উপর রাখা জুয়েলারি গুলো নিয়ে তরুকে খুব যত্নসহকারে পড়িয়ে দিতে শুরু করে। জুয়েলারি গুলো পড়ানো শেষ হলে তরু হালকা মেকআপ করে ঠোঁটের উপর হালকা গোলাপি লিপস্টিক দিয়ে বসাবস্থা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে বললো….

—“আমার সাজ সম্পন্ন হয়েছে, চলুন এখন নিচে যাওয়া যাক।”

কুশল ড্রেসিং টেবিলের পাশে দেওয়ালের সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে এতোসময় ধরে তরুকে দেখছিলো। তরুর এরূপ কথা শুনে কুশল তরুকে একপলকে উপর থেকে নিচ পর্যন্ত দেখে নিয়ে বললো…..

—“তোমার সাজ তো এখনও সম্পন্ন হয় নি।”

তরু ভ্রু কুঁচকে কুশলের দিকে তাকায়। কুশল স্মিত হাসি দিয়ে বললো…..
—“তোমার এই টানা টানা চোখ জোড়ায় হালকা করে কাজল লাগালে আর কপালের মাঝ বরাবর গাড় নীল রংয়ের ছোট্ট একটা টিপ পড়লে তবেই তোমার সাজ সম্পন্ন হবে।”

কুশলের মুখে এমন কথা বলে তরু সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠলো….
—“না…না…নাআআ..আমি কাজল লাগাবো না। কাজল লাগাতে নিলেই আমার চোখ জোড়া নোনা জলে টইটুম্বুর হয়ে উঠে। তাই যেমন আছি এটাই যথেষ্ট।”

কুশল তরুর কথাকে পাত্তা না দিয়ে বললো….
—“আমি তোমার দু’চোখে কাজল লাগিয়ে দিচ্ছি। দেখবে চোখে একটুও পানি আসবে না।”

—“না…না…প্লিজ এখন আমি আর সাজ ন*ষ্ট করতে চাই না।”

কুশল তরুর ঠোঁট জোড়ার উপর নিজের শাহাদত আঙুল ঠেকিয়ে শান্ত স্বরে বললো…

—“চুপ……কোনো কথা হবে না। বসো এখানে।”

তরু রিতীমত বাধ্য হয়ে টুলে বসে পড়ে। কুশল তরুর সাজের জিনিসগুলো ভিতর থেকে কাজলটা হাতে নিয়ে খুব যত্ন সহকারে তরুর দু’চোখে লাগিয়ে দিয়ে বললো….

—“এখন উপরের দিকে তাকিয়ে কিছুসময় ঘনঘন চোখের পলক ফেলতে থাকো।”

কুশলের কথানুযায়ী তরু ঘনঘন চোখের পলক ফেলতো শুরু করে। কিছুসময়ের মধ্যেই তরু স্বাভাবিক হয়ে যায়। চোখে আর কোনো প্রকার পানি আসছে না দেখে তরু কুশলের দিকে শান্ত দৃষ্টি স্থির করে বললো…..

—“এর আগে আরো কতোজন মেয়ের চোখে কাজল পড়িয়ে দিয়েছিলেন যে এই কাজ এতো দক্ষতার সাথে সম্পন্ন করলেন।”

কুশল হাসিমুখে বললো…..
—“পুরুষ মানুষের কান্না করা বারণ। যখন আমার কোনো বিষয় নিয়ে খুব খারাপ লাগে তখন কিছুসময় ধরে ঘনঘন দুই চোখের পলক ফেলে নিজের আবেগগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করি। পরিশেষে আমি সফল ও হয়ে যাই। সেই পদ্ধতিই এখন অবলম্বন করলাম।”

তরু স্তব্ধ দৃষ্টি নিয়ে কুশলের দিকে তাকিয়ে আছে। অতঃপর কুশল টিপের পাতা থেকে গাড় নীল রংয়ের একটা ছোট্ট টিপ নিয়ে তরুর দুই ভ্রুর মাঝ বরাবর পড়িয়ে দিয়ে চোখ দিয়ে ইশারা করে ওকে আয়নার দিকে তাকাতে বলে। তরু কুশলের ইশারা বুঝতে পেরে আয়নার দিকে লক্ষ্য করতেই নিজের প্রতিচ্ছবি নিজেই দেখে মুগ্ধ না হয়ে পারে না। সামান্য কাজল আর একটা ছোট্ট টিপ যে কারোর সৌন্দর্য এতোটা বাড়িয়ে দিতে পারে তা হয়তো তরু আজ নিজেকে না দেখলে বুঝতে পারতো না। কুশল হাসি দিয়ে বললো….

—“চলো তাহলে এখন নিচে যাওয়া যাক।”

তরু হাসিমুখে বসাবস্থা উঠে দাঁড়ায়। অতঃপর ওরা দু’জনে একসাথে রুম থেকে বের হয়ে নিচে যাওয়ার উদ্দেশ্যে।

চলবে ইনশাআল্লাহ……..