#হৃদকোঠোরে_রেখেছি_তোমায়🖤(৪৬)
#Maisha_Jannat_Nura (লেখিকা)
(১১৪)
সন্ধ্যা মাথা নিচু রেখে চেহারায় মলিনতার ছাপ ফুটিয়ে তরুর পাশে বসে আছে। সন্ধ্যার সামনা-সামনি সোফায় বসে আছেন ছেলে সাইফুদ্দিন ইসলাম ও ছেলের বাবা শরীফ ইসলাম এবং মা জয়নাব ইসলাম। জয়নাব ইসলামের পাশেই একটা ঢাকনা ওয়ালা কাঁসার বাটি নিয়ে দাড়িয়ে আছেন তার নিজস্ব কাজের মেয়ে বিউটি। জয়নাব ইসলাম পান চিবুতে চিবুতে কাজের মেয়ে বিউটির দিকে মুখ ঘুরাতেই বিউটি ওর হাতে থাকা বাটির উপর থেকে ঢাকনাটি সরায়। অতঃপর জয়নাব বাটির ভিতর নিজের মুখ থেকে পানের পিক ফেলেন। জয়নাবের এমন কাজে তরুনিমার যেনো শরীর গু*লি*য়ে আসার উপক্রম হয়। তরু সঙ্গে সঙ্গে জয়নাবের উপর থেকে নিজের দৃষ্টি সরিয়ে নেয়। জয়নাব সন্ধ্যার দিকে তাকিয়ে বললেন……
—“মিসেস.চৌধুরী আপনার নাতনী তো দেখছি অনেক লাজুক স্বভাবের। এসে বসেছে পর সেই যে মাথা নুইয়েছে আর উঠানোর নাম গন্ধই নিচ্ছে না। নাতনীকে বলুন মাথাটা এমন নামিয়ে না রেখে একটু উপরে উঠায় যেনো, নয়তো তার চাঁদপানা মুখ দেখে আমাদের পরাণ জুরাবে কি করে!”
জয়নাবের কথাগুলো সন্ধ্যার কান পর্যন্ত পৌছালেও ওকে আগের ন্যয় মাথা নিচু রেখেই বসে থাকতে দেখে সন্ধ্যার হাতের ডানপার্শে বসারত সাগরিকা চৌধুরী শান্ত স্বরে বললেন….
—“মুখ তুলো দিদিভাই।”
তরুনিমা সন্ধ্যার হাতের বাম পার্শে বসে ছিলো। তরু ধীর স্বরে বললো…
—“মুখ তুলো সন্ধ্যা।”
সন্ধ্যা একবার দীর্ঘশ্বাস ফেলে মুখ উঠায়। জয়নাব সন্ধ্যার মুখশ্রী দেখে হাসি দিয়ে বললেন….
—“মেয়ের শরীরের রং স্বাভাবিক এর তুলনায় অনেক বেশিই ফর্সা লাগছে। মেয়ের ভিতরে কোনো চাপা অসুখ নেই তো মিসেস. চৌধুরী!”
জয়নাবের এরূপ কথা শুনে পাশ থেকে শরীফ বললেন…
—“আহহহ…সাইফের মা! উল্টো পাল্টা না বলে খেয়াল রেখে কথা বলো। ক্ষমা করবেন আপনারা আমার স্ত্রীর কথায় কিছু মনে করবেন না।”
—“এখানে মনে করার মতো কিছুই হয় নি। মানছি ওনারা সম্ভ্রান্ত পরিবার, সমাজে উনাদের ক্ষমতা ও সম্মানের তুলনা অন্যকারোর সাথে করার সাধ্য আমাদের নেই। কিন্তু ওনাদের পরিবারের মেয়ের মাঝে কোনো শারিরীক স*ম*স্যা থাকলে তা আমাদের থেকে লুকিয়ে আমার সুস্থ-স্বাভাবিক ছেলের ঘাড়ে চেপে দিতে পারেন না। ভবিষ্যতে যদি আমাদের বংশধরও তার মায়ের মতো চাপা রো*গ নিজের শরীরে নিয়ে পৃথিবীর আলো দেখে তখন কি হবে! আমি আমাদের ভালোর কথা চিন্তা করেই এই কথা বলেছি মাত্র।”
কুশল নিরব থেকে চোখ বন্ধ করে সোফার হাতলের সাথে নিজের ডান হাত ভাজ করে কপালের ডানপার্শে এক আঙুল দ্বারা আলতো ভাবে ঘষা দিচ্ছে। সন্ধ্যা কিছুটা অ*প*মা*নি*ত বোধ করে নিজের ওড়নার নিচের অংশ শক্ত ভাবে মুষ্টিবদ্ধ করে ধরলো। তরুনিমা মনে মনে বললো….
—“ছি্-হ: কি নি*চ চিন্তাভাবনা।”
সাবরিনা চৌধুরী হাসিমুখে বললেন….
—“আপনার কথায় আমরা কেউ কিছুই মনে করি নি মিসেস. ইসলাম। আর আপনার মাঝে এরূপ স*ন্দে*হ বা ভ*য় থাকাটাও অস্বাভাবিক নয়৷ এক বংশের সাথে অন্য বংশের সম্পর্ক জোড়ার পূর্বে খুঁটিয়ে খাঁটিয়ে দেখা ও জেনে নেওয়াটাও আবশ্যক।”
কামিনী বিনুনি নাড়াতে নাড়াতে বললেন….
—“মেজো ভাবী একদম ঠিক কথা বলেছেন। তাই আপনারা চাইলে সন্ধ্যার মেডিকেল টেস্টও করে নিতে পারেন।”
কামিনীর এরূপ কথা শুনে সন্ধ্যা দাঁত দিয়ে আলতো ভাবে নিচের ঠোঁট কাঁ*ম*ড়ে ধরে কান্না নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করে। জয়নাব হাসি দিয়ে বললেন….
—“তা তো অবশ্যই করতে হবে।”
জয়নাবের কথার পিঠে সাইফুদ্দিন বলে উঠলো….
—“মাম্মি….আমাকেও কি মেডিকেল টেস্ট করাতে হবে!”
জয়নাব সাইফুদ্দিনের দিকে একনজর তাকিয়ে বললেন…
—“না আমার সোনা বাবা, তোমাকে কোনো প্রকার টেস্ট করাতে হবে না। বিয়ের জন্য নিখুঁত ভাবে পরীক্ষা মেয়েদেরই করা হয়, ছেলেদের নয়।”
জয়নাবের এমন কথায় রাগে তরুনিমার শরীর যেনো রিরি করে উঠছে। শুধুমাত্র পরিবারের মান-সম্মানের কথা চিন্তা করে সে চুপচাপ সব সহ্য করে নিচ্ছে। সাইফুদ্দিন সন্ধ্যাকে উদ্দেশ্য করে বললো…..
—“তুমি কি সবসময় গাইয়াদের মতো সালোয়ার-কামিজ পড়েই চলাচল করো নাকি! বিয়ের পর কিন্তু এসব গাঁইয়া চালচলন রাখা যাবে না। কারণ বিয়ের পর তোমাকে আমার সাথে আমেরিকাতে থাকতে হবে। সেখানে বসবাসরত সকলেই যেহেতু ওয়েস্টার্ন পোশাক পড়েই চলাচল করে তাই তোমারও ওয়েস্টার্ন পোশাক পড়তে হবে। আর তোমার নাম কি যেনো বললো! সন্ধ্যা রাইট? এই নামটাও শুনতে অনেক বোরিং লাগছে। বিয়ের পর তোমার নামটাও পরিবর্তন করে একটা স্মার্ট নাম রাখতে হবে। এখন একটা কাজ করো রুমে গিয়ে এই সালোয়ার-কামিজ পরিবর্তন করে একটা ওয়েস্টার্ন পোশাক পড়ে এসো। দেখি ওয়েস্টার্ন পোশাকে তোমায় কেমন দেখায়।”
সাইফুদ্দিন এর কথা শেষ হওয়া মাত্র কুশল নিরবতার দেওয়াল ভেঙে বলে উঠলো….
—“প্রতিটা স্বামীর উচিত নিজের স্ত্রীকে পর্দা করার জন্য বাধ্য করা। পরপুরুষের সামনে নিজের স্ত্রীর শরীরের অর্ধাংশ বের করে রেখে তাদের আকর্ষিত করে যেই স্ট্যটাসের মান রক্ষা করতে হয় সেই স্ট্যটাসের ধারের কাছে আমরা ঘেঁ*ষি না। আমাদের বংশের মেয়েরা সকলেই ঘরে-বাহিরে শালীন পোশাক পড়েই চলাচল করেন সবসময়। আর সারাজীবন এভাবেই চলাচলন করবেন।”
—“বিয়ের পর সন্ধ্যার উপর আমার অধিকার সবথেকে বেশি থাকবে। আমার পছন্দনুযায়ী চলাচল করতে সে বাধ্য থাকবে।”
কুশল শান্ত স্বরে বললো…..
—“যেখানে বিয়েটাই হবে না সেখানে বিয়ের পরের বাধ্যবাধকতার কথা উঠানোরও প্রশ্ন আসছে না।”
কুশলের এরূপ কথায় সকলেই বেশ অবাক হয়ে যায়। জয়নাব বললেন….
—“বিয়ে হবে না মানে!”
—“আপনার ছেলের সাথে আমার বোনের বিয়ে হবে না। এই সম্বন্ধ এখানেই ভেঙে দিচ্ছি আমি।”
সাবরিনা বললেন…
—“কিন্তু কু..!”
সাবরিনা পুরো কথা শেষ করার পূর্বেই কুশল হাত উঠিয়ে তাকে থামিয়ে দেয়। জয়নাব সাগরিকা চৌধুরীর দিকে তাকিয়ে রাগী স্বরে বললেন….
—“মিসেস.চৌধুরী…! আপনি চুপ করে আছেন কেনো? এই পরিবারের সবথেকে বয়োজ্যেষ্ঠ সদস্য আপনি। আপনি এখানে উপস্থিত থাকাকালীন এই ছেলে সম্বন্ধ ভে*ঙে দেওয়ার মতো এতো বড় সিদ্ধান্ত নেওয়ার সাহস পায় কোথায়!”
সাগরিকা চৌধুরী ছোট্ট করে নিঃশ্বাস ফেলে বললেন….—“দাদুভাই যখন সিদ্ধান্ত জানিয়ে দিয়েছে তখন আমি আর দ্বিমত পেষ করবো না এই সিদ্ধান্তের উপর। এই সম্বন্ধের ইতি এখানে টানা হচ্ছে মিসেস.ইসলাম। আপনারা এখন আসতে পারেন।”
সাগরিকা চৌধুরীর এরূপ কথায় জয়নাব রাগে রি রি করতে করতে বসাবস্থা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে বললেন….
—“এতো বড় অ*প*মান! আমার ছেলের মতো এতো ভালো ছেলে সারা পৃথিবী খুঁজেও আর দু’টো পাবেন না আপনি মিসেস.চৌধুরী কথাটা মনে রাখবেন। এই সম্বন্ধের ইতি টেনে ভালো করলেন না। আজ এই মুহূর্ত থেকে আপনাদের সাথে পারিবারিক ও ব্যবসায়িক বন্ধুত্বের সম্পর্কের ইতি আমি টেনে দিলাম।”
কুশল শান্ত স্বরে বললো…
—“দরজাটা ঐদিকে।”
কুশলের এরূপ কথা শুনে শরীফ ও সাইফুদ্দিন বসাবস্থা থেকে উঠে দাঁড়ায়। অতঃপর ওরা দ্রুত পায়ে চৌধুরী মেনশন থেকে বেড়িয়ে যায়। ওরা চলে যেতেই কামিনী বিনুনি নাড়াতে নাড়াতে বললেন….
—“এতো ভালো সম্বন্ধটা এভাবে হাতছাড়া না করলেও চলতো।”
কুশল বসাবস্থা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে বললো….
—“যেখানে আমার বোন নিজের জন্মগত নাম নিয়ে বাঁচতে পারবে না। নিজের পছন্দনুযায়ী শালীন পোশাক পড়তে পারবে না। সেখানে তো দু’দিন নিজের ইচ্ছে মতো নিঃশ্বাস ও ফেলতে পারতো না সে। নিঃশ্বাস ফেলতেও ওর স্বামীর অনুমতি নিতে হতো। এমন সম্বন্ধকে ভালো বলো কি করে তুমি চাচী!”
কুশলের এরূপ কথা শুনে কামিনী আর কোনো প্রতিত্তুর করার ভাষা খুঁজে পায় না। কুশল আবারও বললো….
—“যেই পরিবারে আমার বোন সম্মানের সাথে বাস করতে পারবে সেই পরিবারের ছেলের হাতেই আমি আমার বোনকে তুলে দিবো। আর এমন পরিবারের সন্ধান ও আমি নিজ দায়িত্বে করবো। তাই আমার বোনের বিয়ে নিয়ে পরবর্তীতে আর কোনো সম্বন্ধ যেনো বাড়তি কেও না আনে। এটাই আমার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত।”
এই বলে কুশল নিজ রুমে যাওয়ার উদ্দেশ্যে সিঁড়ির দিকে পা বাড়ায়। সন্ধ্যা হাসিমাখা মুখশ্রী নিয়ে তরুর দিকে তাকিয়ে ওকে জড়িয়ে ধরে। কুশলের সিদ্ধান্তে বেশ অসন্তুষ্ট হয়েছেন সাবরিনা চৌধুরী। তিনি নিজের চেহারায় অসন্তুষ্ট ভাব স্পষ্ট রেখে নিজের রুমের উদ্দেশ্যে পা বাড়ালেন। কামিনীও সাবরিনার পিছন পিছন সেদিকেই ছুট লাগালেন। সাগরিকা চৌধুরী বসাবস্থা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে বললেন….
—“দিদি ভাইয়েরা তোমরা নিজ নিজ রুমে গিয়ে বিশ্রাম করো যাও।”
সাগরিকা চৌধুরী চলে যেতেই তরু ও সন্ধ্যাও স্থান ত্যগ করলো।
(১১৫)
কেবিনে নিজ বেডের সাথে হেলান দিয়ে বসে আছে তাহির। বেডের পাশে থাকা চেয়ারে বসে হুমায়রা তাহিরের জন্য বানানো স্যুপটা ফুঁ দিয়ে ঠান্ডা করছে। সেইসময় তাহির হুমায়রাকে রাগাতে মজার স্বরে বললো….
—“রাগের ঠ্যলায় আবার ফুঁ দিয়ে স্যুপ ঠান্ডা করার জায়গায় থুতু দিচ্ছিস নাকি!”
তাহিরের এমন কথা শুনে হুমায়রা রাগী দৃষ্টি নিয়ে তাহিরের দিকে তাকায়। তাহির সঙ্গে সঙ্গে নিজের দৃষ্টি অন্যত্র সরিয়ে নিয়ে বললো…..
—“এভাবে তাকাচ্ছিস কেনো? চোখ দিয়েই আমাকে গি*লে খাওয়ার ধা*ন্দা করেছিস নাকি!”
হুমায়রা দাঁতে দাঁত পি*ষে বললো…..
—“মুখ দিয়ে আর একটা শব্দ বের করলে এই গরম স্যুপ তোমার শরীরের উপর ঢেলে দিবো ধলা ইঁ*দু*র।”
হুমায়রার মুখে নিজের এমন উ*দ্ভ*ট নাম শুনে তাহিরের মুখ অটোমেটিক হা হয়ে যায়।
#চলবে ইনশাআল্লাহ………….
#হৃদকোঠোরে_রেখেছি_তোমায়🖤(৪৭)
#Maisha_Jannat_Nura (লেখিকা)
(১১৬)
সাবরিনা হনহনিয়ে নিজের রুমে প্রবেশ করে রাগের বশে হাতে থাকা ফোনটা বিছানার উপর ছুঁ*ড়ে ফেলে দিয়ে ডান হাত মুষ্টিবদ্ধ করে বাম হাতের উপর আলতো ভাবে বা*রি দিয়ে মুখ দিয়ে ‘সিট’ শব্দটি উচ্চারণ করলেন। সেইসময় কামীনি এক ছুটে সাবরিনার রুমে প্রবেশ করে দরজা ভিতর থেকে আটকে দিয়ে সাবরিনার সামনে এসে দাঁড়িয়ে বললেন….
—“ভাবী প্রতিবার যদি তোমার এই ছেলে আমাদের সব পরিকল্পনার উপর এভাবে জল ঢেলে দেয় তাহলে তো আমাদের কোনো পরিকল্পনাই সাকসেসফুল হবে না। শরীফ ইসলামের মতো এতো বড় একজন বিজনেস পার্টনার আজ আমাদের থেকে হাতছাড়া হয়ে গেলো।কোথায় আজ তাদের সাথে সম্পর্কের বাঁধনটা আরো মজবুত হওয়ার কথা ছিলো সেখানে সারাজীবনের জন্য সম্পর্কের ইতি টানার মতো পরিস্থিতি তৈরি করলো তোমার ঐ ছেলে।”
সাবরিনা রাগী স্বরে বললেন….
—“বারবার আমার ছেলে.. আমার ছেলে বলছিস কেনো তুই ছোট? তুই জানিস না কুশল আসলে র….!”
সাবরিনা পুরো কথা শেষ করার আগেই কামিনী একহাতে সাবরিনার মুখ চে*পে ধরে তাকে থামিয়ে দিয়ে বললেন…
—“চুপ করো ভাবী…দেওয়ালের ও কান আছে। এসব কথা মুখে এনো না। অ*ন*র্থ হয়ে যাবে তাহলে।”
এই বলে কামিনী সাবরিনার মুখের উপর থেকে হাত সরিয়ে ফেলে। সাবরিনা জোরে জোরে নিঃশ্বাস ফেলে নিজের ভিতরে জমে থাকা রাগ গুলোকে দমিয়ে ফেলার চেষ্টা করতে থাকে।
(১১৭)
তরুনিমা ওয়াশরুম থেকে ফ্রেশ হয়ে বের হতেই কুশলকে সোফার উপর বালিশ ঠিক করে রাখতে দেখে শান্ত স্বরে বললো…
—“আপনি বিছানায় এসে শুইতে পারেন, আমার কোনো সমস্যা নেই।”
তরুর মুখে এরূপ কথা শুনে কুশল শান্ত দৃষ্টি নিয়ে তরুর দিকে তাকিয়ে রয় কিছুসময়। অতঃপর বললো…
—“সোফায় শুয়ে শুয়ে এখন আমি অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছি। আর সমস্যা হয় না এখানে শোয়া নিয়ে। আমি এখানেই শুইতে পারবো। তুমি আরাম করে বিছানায় ঘুমাও।”
—“আজ থেকে আপনাকে আর সোফায় ঘুমাতে হবে না। এই বিছানাটা যথেষ্ট বড় আছে। দু’জন মানুষ নিজ নিজ জায়গায় আরাম করে ঘুমাতে পারবো। কথা না বাড়িয়ে বিছানায় এসে শুয়ে পড়ুন।”
—“আমি এখানেই মানিয়ে নিতে পারবো। তুমি ঘুমাও বিছানায়।”
এই বলে কুশল সোফায় বসে পড়ে। তরুনিমা চোখ ছোট ছোট করে কুশলের দিকে তাকিয়ে রইলো কিছুসময়। অতঃপর মুখে কিছু না বলে দ্রুত পায়ে কুশলের সোফার কাছে গিয়ে সোফার উপর রাখা বালিশ গুলো একএক করে বিছানার উপর ছুঁ*ড়ে ফেলতে শুরু করে। তরুর এমন কাজে কুশল তরুর আড়ালে মিটমিটিয়ে হাসে। তরু কুশলের দিকে তাকিয়ে কিছুটা রাগ বিয়ে উচ্চস্বরে বললো……
—“ভালো কথার মানুষ আপনি না। ভিষণ রকমের ঘাড়*ত্য*ড়া হয়ে গিয়েছেন। আপনার ঘাড়ে থাকা এই ত্য*ড়া র*গ গুলো সব কেটে একদম সোজা বানিয়ে….!”
তরু পুরো কথা শেষ করার পূর্বেই কুশল বসাবস্থা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে তরুর দুই ঠোঁটের মাঝবরাবর নিজের শাহাদত আঙুল ঠেকিয়ে ওকে থামিয়ে দিয়ে বললো….
—“শুউউউউপ….!”
পরক্ষণেই কুশল নিজের আঙুল সরিয়ে নিয়ে বিছানার কাছে গিয়ে নিজের জন্য বালিশ গুলো ঠিকঠাক করে নিতে শুরু করে। অতঃপর তরুও আর কিছু না বলে ধীরপায়ে বিছানার অন্যপাশে গিয়ে বালিশ ঠিক করে নিয়ে কম্বল মুড়ি দিয়ে শুয়ে পরে। কুশলও শুয়ে পড়ে।
(১১৮)
সকালবেলা…….
তাহির চোখ মেলে তাকাতেই দেখে হুমায়রা ওর বাম হাতের উপর মাথা রেখে বসাবস্থাতেই ঘুমিয়ে গিয়েছে। হুমায়রার মুখের উপর ওর ছোট ছোট চুলগুলো এসে পড়ছে। তাহির আলতোভাবে ডান হাতটা এগিয়ে এনে হুমায়রার মুখের উপর পড়া চুলগুলো সরিয়ে ওর কানের পিছনে গুঁ*জে দেয়। হুমায়রার মায়া মাখানো ঘুমন্ত মুখশ্রী তাহিরকে ওর দিকে আকর্ষিত করছে। তাহির একবার দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো….
—“আমার পক্ষে কি ২য় কাওকে ভালোবাসা সত্যিই সম্ভব হবে! কখনও তোর দিকে ভালোভাবে তাকিয়েও দেখি নি আমি হিমু। আজ নিজের এতোটা কাছে তুই অবস্থান করছিস। তোর এই মায়া মাখানো মুখশ্রী আমাকে তোর দিকে এতোটা আকর্ষিত কেনো করছে! তবে কি তোর ভালোবাসার জোড়ই পারবে আমার মনেও তোর জন্য ভালোবাসার সৃষ্টি করতে!”
তাহিরের কথা বলার মাঝেই হুমায়রার ঘুম ভেঙে যায়। হুমায়রা চোখ মেলে তাকাতেই তাহিরের চোখে চোখ পড়ে যায় ওর। তাহির নিজের দৃষ্টি অন্যত্র সড়িয়ে নেয়। হুমায়রা সোজা হয়ে বসতেই তাহির নিজের বাম হাতটা একটু নাড়াতে নাড়াতে বললো….
—“আহহহ…আমার হাতের উপর মাথা রেখে আরাম করে ঘুমিয়ে তো এখন আমাট হাতের পুরো বারোটা বাজিয়ে দিয়েছিস দেখছি। কোথায় আমার সেবা করে আমাকে দ্রুত সুস্থ করে তুলবি তা না আমার সমস্যা আরো বাড়িয়ে দিচ্ছিস।”
হুমায়রা বসাবস্থা থকে উঠে দাঁড়িয়ে বললো…..
—“হাতির মতো একটা শরীর বানিয়েছো কি জন্য? সামান্য একটা মাথার ওজন কিছুসময়ের জন্য সহ্য করতে পারো না এতেই তোমার হাতের বারো-তেরোটা বেজে যায় একেবারে।”
—“তোকে কানাডায় রেখে পড়াশোনা করিয়ে খালা-খালু শুধু শুধু তাদের মূল্যবান অর্থগুলো ন*ষ্ট না করলেই পারতেন।”
হুমায়রা চোখ ছোট ছোট করে বললো….
—“মানে!”
—“মাথায় তো এতোটুকু পরিমান ভালো জ্ঞান বুদ্ধি আছে বলে মনে হয় না। যদি থাকতো তাহলে আমার সিক্স প্যক বডিকে তুই হাতির শরীরের সাথে তুলনা করতে পারতি না। আর না আমার এতোসুন্দর নামটাকে পঁ*চি*য়ে ওমন বি*শ্রী একটা নাম রাখতি।”
হুমায়রা মুখ বাঁকিয়ে বললো….
—“তোমার সাথে যেটা মানায় সেটাই বলেছি আমি। আমার সামান্য মাথার ওজন সহ্য করতে না পেরে নিজের সিক্স প্যক বডির মান তো রাখতে পারলে না। তাই তোমার শরীরকে হাতির শরীরের সাথে তুলনা করে আমি একটুও ভু*ল করি নি। আর রইলো নামের বিষয়টা। তোমার মতো লোককে এতো সুন্দর নামে ডাকাটাও বেমানান লাগে। তোমার সাথে ঐ ধলা ইঁ*দু*র নামটাই মানায়। বাসায় ফেরার পর খালা-খালুকে বলে তোমার জন্ম নিবন্ধন থেকে শুরু করে সব সার্টিফিকেট ও ভোটার আইডি কার্ড থেকে ঐ তওকির তালুকদার তাহির নামটা পরিবর্তন করে ধলা ইঁ*দু*র নামটাই পার্মানেন্ট করার ব্যবস্থা করবো।”
হুমায়রার কথাগুলো হজম করে নিতে তাহিরের কয়েক সেকেন্ড সময় লাগে। তাহির চোখ ছোট ছোট করে নিজের দু’হাত হুমায়রার দিকে এগিয়ে দিয়ে বললো…..
—“হিমুর বাচ্চা…..আর একটা উল্টো পাল্টা কথা বলবি তো তোকে আমি আমার মাথার উপরে তুলে আ*ছা*ড় মা*র*বো।
হুমায়রা আরো দু’কদম পিছনের দিকে পিছিয়ে গিয়ে বললো….
—“আগে তো আমাকে নিজের কাছে টেনে নাও। তারপর একটা কিউটি বাচ্চা গিফট করো। তখন হিমুর বাচ্চার ডায়েপার পরিবর্তন করতে করতেই তোমার অর্ধেকের বেশি সময় চলে যাবে। আর রইলো হিমুর বাচ্চাকে মাথার উপর তুলে আ*ছা*ড় মা*রা*র বিষয়টা! বাচ্চাটাতো শুধু আমার একার হবে না, তোমারও হবে। নিজের বাচ্চাকে আ*ছা*ড় মা*র*বে কি করে তুমি!”
হুমায়রার মুখে এমন কথাগুলো শুনে তাহির যেনো প্রতিত্তুর করার ভাষাই হারিয়ে ফেলেছে। হুমায়রা তাহিরের দিকে তাকিয়ে হাসি দিয়ে পিছনে দরজার দিকে অগ্রসর হচ্ছিলো সেইসময় দরজা খুলে একজন সুদর্শন পুরুষ ডাক্তার তাহিরের কেবিনে প্রবেশ করায় তার বুকের সাথে ধাক্কা খেয়ে হুমায়রা পরে যেতে নেয়। ডাক্তারটি সাথে সাথেই দু’হাতে হুমায়রার কমোর জড়িয়ে ধরে ওকে পড়া থেকে বাঁচিয়ে নেয়। হুমায়রা কিছুটা ভ*য় পেয়ে চোখ-মুখ কুঁচকে ফেলেছে। ডাক্তারটি অপলক দৃষ্টি নিয়ে হুমায়রার দিকে তাকিয়ে আছে।
বেডে বসে তাহির হুমায়রাকে অন্য কোনো পুরুষের বাহুডোরে আবদ্ধ হয়ে থাকতে দেখে রাগে বিছানার চাদর মুষ্টিবদ্ধ করে নেয়। পরক্ষণেই তাহির ওর বেডের পাশে থাকা ছোট্ট টেবিলের উপর থাকা কাঁচের পানির গ্লাসটি হাতে নিয়ে রাগের বশে মেঝের উপর ছুঁড়ে ফেলে দেয়। গ্লাস ভা*ঙা*র শব্দ হুমায়রা আর ঐ ডাক্তারটির কর্ণপাত হতেই হুমায়রা চোখ মেলে তাকিয়ে নিজেকে ডাক্তারটির বাহুডোরে আবব্ধ হয়ে থাকতে দেখে দ্রুততার সাথে সরে দাঁড়ায়। হুমায়রা তাহিরের দিকে তাকাতেই দেখে তাহির অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে রেখে জোরে জোরে নিঃশ্বাস ফেলছে।
হুট করে তাহিরের এভাবে রেগে যাওয়ার কারণটা আন্দাজ করতে হুমায়রার কয়েক সেকেন্ড সময় লাগে। হুমায়রা ঠোঁট চেপে নিজের হাসি নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করে মনে মনে বললো….
—“তোমার মনে আমার জন্য ভালোবাসার অনুভূতি কাজ করছে কিনা তা বোঝার জন্য একটা বিশেষ উপায় পেয়ে গিয়েছি। তারপর তোমার মুখ থেকে আমাকে ভালোবাসার কথাও বের করেই ছাড়বো আমি।”
ডাক্তারটি হুমায়রাকে উদ্দেশ্য করে বললো….
—“আপনি ঠিক আছেন তো!”
হুমায়রা হাসি দিয়ে বললো….
—“ভাগ্যিস আপনি সঠিক সময়ে এসে আমাকে ধরে নিয়েছিলেন নয়তো আমার কি যে হতো! অনেক অনেক ধন্যবাদ আপনাকে ডাক্তার সাহেব।”
—“প্লিজ অন্য সবার মতো আপনি আমাকে ‘ডাক্তার সাহেব’ বলে ডাকবেন না। আপনি আমাকে আমার নাম ধরে ডাকলেই আমি খুশি হবো। আমার নাম নিলয়।”
—“ঠিক আছে, আমি আপনাকে আপনার নাম ধরেই ডাকবো কিন্তু আমার একটা ছোট্ট শর্ত আছে।”
—“কি শর্ত বলুন!”
—“আমার কাছে এই আপনি সম্বোধন করে কথা বলার বিষয়টা একদমই ভালো লাগে না। তাই আপনি আমাকে তুমি সম্বোধন করে কথা বললে আমিও খুশি হতাম।”
—“ঠিক আছে তাহলে তোমাকেও আমায় তুমি সম্বোধন করেই কথা বলতে হবে।”
হুমায়রা নিলয়ের সাথে কথা বলছে আর আঁড়চোখে তাহিরের সাথে কথা বলছে। তাহিরকে অত্যাধিক পরিমাণে জেলাস ফিল করতে দেখে হুমায়রার মনের ভিতর যেনো আনন্দের বন্যা বয়ে যাচ্ছে। হুমায়রা হাসিমুখে নিলয়কে বললো…
—“আচ্ছা ঠিক আছে নিলয়।”
—“আচ্ছা একটু ওয়েট করো। আমি পেশেন্টকে একবার চেক-আপ করে নেই। তারপর আমার সাথে আমার কেবিনে নিয়ে যাবো তোমায়। সেখানে বসে আমরা আমাদের বাকি পরিচয় পর্বটুকুও সেরে নিবো না হয়।”
হুমায়রা তাহিরের দিকে তাকাতেই দেখে তাহিরের ফর্সা মুখশ্রী রাগে লালচে বর্ণ ধারণ করেছে। নিলয় তাহিরকে চেক-আপ করতে ওর দিকে অগ্রসর হতে নিলেই তাহির হাত উঠিয়ে নিলয়কে থামিয়ে দিয়ে বললো…..
—“আমি ঠিক আছি। আমাকে আর চেক-আপ করার প্রয়োজন নেই। আপনি এখন আসতে পারেন।”
নিলয় অবাক স্বরে বললো…
—“কিন্তু…!”
—“আপনাকে এখান থেকে যেতে বলেছি।”
নিলয় তাহিরের এমন আচারণের মানে বুঝতে না পেরে হুমায়রার দিকে তাকায়। হুমায়রা নিলয়কে ইশারা করে চলে যাওয়ার জন্য। নিলয়ও আর কথা না বাড়িয়ে কেবিন থেকে বেড়িয়ে যায়। পরক্ষণেই হুমায়রা বললো…..
—“নিলয় তো আমাকে ওর কেবিনে যাওয়ার কথা বলেছিলো। তুমি আরাম করো আমি ওর কেবিন থেকে ঘুরে আসছি।”
এই বলে হুমায়রা দরজার দিকে অগ্রসর হতে নিলে তাহির রাগ নিয়ে উচ্চস্বরে বললো….
—“আর একপা যদি সামনের দিকে বাড়িয়েছিস তবে তোর দুই পা কে*টে আমি হাতে ধরিয়ে দিবো বে*য়া*দ*ব।”
হুমায়রা তাহিরের দিকে তাকিয়ে বললো…
—“তুমি নিজেও আমার ভালোবাসা গ্রহন করবে না আর অন্য কোনো পুরুষের সাথেও আমাকে আবব্ধ হতে দিবে না এমনটা তো হতে পারে না। হয় তোমাকে আমার ভালোবাসা গ্রহন করে আমাকে ভালোবাসতে হবে নয়তো আমাকে অন্য কোনো পুরুষের সংস্পর্শে যেতে…..!”
হুমায়রা পুরো কথা শেষ করার পূর্বেই তাহির উচ্চস্বরে হুমায়রাকে একটা ধমক দেয়। তাহিরের ধমক শুনে হুমায়রা কিছুটা কেঁপে উঠে। তাহির যে এতোটা রেগে যাবে হুমায়রা তা বুঝতে পারে নি। এখন হুমায়রার মনে কিছুটা ভ*য় কাজ করতে শুরু করে। তাহির ধমকের স্বরে বললো…
—“মুখ বন্ধ রেখে আমার পাশে এসে বোস। যদি মুখ থেকে আর একটা শব্দ বের করেছিস বা এই কেবিন থেকে বাহিরে যাওয়ার চেষ্টা করেছিস তবে এই কেবিনের মেঝেতেই তোকে জী*ব*ন্ত পুঁ*তে ফেলবো আমি।”
হুমায়রা নিজের মুখশ্রী জুড়ে ভ*য়ে*র ছাপ স্পষ্ট রেখে ধীরপায়ে তাহিরের বেডের দিকে অগ্রসর হয়। অতঃপর বেডের পাশে থাকা চেয়ারটা টেনে সেখানে মাথা নিচু করে বসে রয়। তাহির বেডের অন্য পাশে থাকা টেবিলের উপর থেকে নিজের ফোনটা হাতে নিয়ে কাওকে কল করে দ্রুত ক্লিনিকে আসার কথা বলে কল কেটে দেয়।
(১১৯)
নিজরুমে কুশল আর তরু দু’জনেই রেডি হচ্ছে। তরুনিমা ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে কানে পাতলা দুটো ঝুমকো পড়তে পড়তে বললো….
—“সকাল সকাল কোথায় যাওয়ার জন্য তৈরি হতে বললেন আপনি আমায় আর সন্ধ্যাকে!”
কুশল ওর শার্টের হাতা দু’টো ফোল্ড করতে করতে বললো….
—“একটা শুভ কাজের উদ্দেশ্যে বিশেষ একটা জায়গায় নিয়ে যাবো তোমাদের।”
—“জায়গাটার নাম টাও কি বলা যায় না!”
—“বলা গেলে তো বলতাম ই। এতোসময় অপেক্ষা করাতাম না তোমাদের।”
তরুনিমা কুশলের কথা শুনে কোনো প্রতিত্তুর না করে হালকা ভাবে মুখ বাঁকায় মাত্র। অতঃপর তরু আর কুশল একসাথে ওদের রুম থেকে বের হয়ে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে আসে। ড্রয়িংরুমে সোফায় বসেছিলো সন্ধ্যা সহ চৌধুরী পরিবারের বাকি সদস্যরা। কুশল আর তরুকে আসতে দেখে সন্ধ্যা কামিনীকে উদ্দেশ্য করে বললো….
—“ঐ তো মেজো ভাইয়া আর ভাবী এসে গিয়েছে। এবার মেজো ভাইয়ার থেকেই জেনে নাও কি কারণে সকাল সকাল সে আমাকে আর মেজো ভাবীকে রেডি হতে বলেছে। আর কোথায় নিয়ে যাবে! এতোসময় তো এটা জানতে প্রশ্ন করতে করতে আমার মাথা ন*ষ্ট করে ফেলছিলে।”
কামিনী তরু আর কুশলের দিকে তাকিয়ে বিনুনি নাড়াতে নাড়াতে বললেন….
—“কি এমন বিশেষ কাজে সকাল সকাল বের হতে হচ্ছে তোমাদের যে সেই কাজের বিষয়ে আমাদের কাওকে অবগত করা যাবে না!”
কুশল কামিনীর জানার আগ্রহকে এড়িয়ে শান্ত স্বরে বললো…
—“আমি বাহিরে গাড়ি বের করছি। তুমি সন্ধ্যাকে নিয়ে এসো দ্রুত তরুনিমা।”
এই বলে কুশল মূল দরজার দিকে অগ্রসর হতে শুরু করে। কামিনী কিছুটা অ*প*মা*ন বোধ করে ঘনঘন করে নিজের বিনুনি নাড়াতে শুরু করে। সন্ধ্যাও বসাবস্থা থেকে উঠে তরুর সাথে বাহিরের দিকে অগ্রসর হয়। তরু আর সন্ধ্যা বাহিরে আসতেই দেখে কুশল মূল গেইটের সামনে গাড়ি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তরু আর সন্ধ্যা গাড়ির কাছে এসে দাঁড়ায়। অতঃপর সন্ধ্যা গাড়ির পিছনের দরজা খুলে সেখানে বসে পরে আর তরু সামনের দরজা খুলে কুশলের পাশের সিটে বসে পরে। ওদের দু’জনকে বসতে দেখে কুশল গাড়ি স্টার্ট করে।
#চলবে ইনশাআল্লাহ……….
#হৃদকোঠোরে_রেখেছি_তোমায়🖤(৪৮)
#Maisha_Jannat_Nura (লেখিকা)
(১২০)
নিলাদ্রকে ভর্তিকৃত ক্লিনিকের সামনে এসে গাড়ি থামায় কুশল। তরুনিমা আর সন্ধ্যার মনে অজস্র প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে। কুশল শান্ত স্বরে বললো…
—“গাড়ি থেকে নেমে এখানেই দাঁড়াও তোমরা। আমি গাড়ি পার্ক করে আসছি।”
কুশলের কথায় সন্ধ্যা আর তরু নিঃশব্দে গাড়ি থেকে নেমে দাঁড়ায়। পরক্ষণেই কুশল গাড়ি পার্ক করে ওদের সামনে এসে দাঁড়িয়ে বললো….
—“ভিতরে চলো।”
সন্ধ্যা ভিতরে যাওয়ার কারণ জানতে কুশলকে প্রশ্ন করতে উদ্যত হলে তরু সন্ধ্যাকে থামিয়ে দেয়। অতঃপর তরু একবার দীর্ঘশ্বাস ফেলে সন্ধ্যাকে নিয়ে কুশলের পিছন পিছন ক্লিনিকের ভিতরে যেতে শুরু করে। কিছুটা পথ অগ্রসর হতেই কুশলের সামনে নিলাদ্রের চিকিৎসায় নিয়জিত ডাক্তার আকরাম সাহেব এসে পড়েন। আকরাম সাহেব শান্ত স্বরে কুশলকে উদ্দেশ্য করে বললেন….
—“এসেছেন মি.কুশল চৌধুরী! আপনার অপেক্ষাতেই ছিলাম আমি। চলুন এবার আসল কাজের উদ্দেশ্যে পেশেন্টের কেবিনের ভিতরে যাওয়া যাক।”
কুশল ঘাড় ঘুরিয়ে তরু আর সন্ধ্যাকেও ওর সাথে কেবিনের ভিতরে আসার জন্য ইশারা করে। পরক্ষণেই ওরা তিনজন কেবিনের ভিতরে প্রবেশ করতেই দেখে বেডের উপর একজন প্রাপ্ত বয়সের সুঠাম দেহী পুরুষ শুয়ে আছেন যার সম্পূর্ণ মুখশ্রী সাদা পট্টি দিয়ে বাঁধানো রয়েছে। পুরুষটির পাশে ২ জন পুরুষ নার্স ও দাঁড়িয়ে আছেন। সন্ধ্যা আর তরুনিমার কাছে পুরুষটি অপরিচিত হলেও কুশল জানে এই পুরুষটি আসলে নিলাদ্র যার বর্তমান নাম সৌহার্দ্য ইশরাক।
ডাক্তার আকরাম সাহেব শান্ত স্বরে বললেন…..
—“আপনারা কিছুসময় এখানেই বসে অপেক্ষা করুন। পেশেন্টের ঘুম ভাঙার সময় হয়ে গিয়েছে। উনার ঘুম ভাঙলেই আমি উনার মুখ থেকে পট্টিগুলো খুলে দিবো।”
কুশল শান্ত স্বরে বললো…
—“ঠিক আছে, ডাক্তার সাহেব।”
এই বলে কুশল কেবিনের ভিতরেই রাখা সোফার উপর গিয়ে বসে পড়ে। ডাক্তার আকরাম সাহেব নার্স দু’জনকে উদ্দেশ্য করে বললেন….
—“তোমরা এখন বাহিরে যাও। পরে কোনো প্রয়োজন পড়লে আমি ডেকে নিবো।”
নার্স দু’জন কেবিন থেকে বেড়িয়ে যেতেই তরুনিমা কুশলের হাতের বাম পার্শে এসে সোফায় বসে। সন্ধ্যা নিলাদ্রের হাতের দিকে লক্ষ্য করতেই দেখে ওর বাম হাতের অনামিকা আঙুলে একটা স্বর্ণের আংটি চিকচিক করছে। সন্ধ্যা ধীরপায়ে নিলাদ্রের দিকে অগ্রসর হয়। নিলাদ্রের পাশে এসে দাঁড়িয়ে কাঁপা কাঁপা হাতে নিলাদ্রের বাম হাত স্পর্শ করে। সন্ধ্যার স্পর্শে নিলাদ্রের হাত কিছুটা কেপে উঠে। সন্ধ্যা নিলাদ্রের হাত ধরে ওর হাতে থাকা আংটিটা ভালোভাবে দেখে ছলছল দৃষ্টি নিয়ে কুশলের দিকে তাকিয়ে আধভাঙা স্বরে বললো……
—“নি..নিলাদ্র…..! ম..মেজো ভাইয়া উনি আমার নিলাদ্র! ওনার হাতে তো নিলাদ্র নামে খোদাই করা আংটিটাও আছে।”
তরু একবার সন্ধ্যাদের দিকে তাকায় আরেকবার কুশলের দিকে তাকিয়ে বললো…
—“উনি সত্যিই নিলাদ্র ভাইয়া! আপনি তো বলেছিলেন নিলাদ্র ভাইয়ার প্লাস্টিক সা*র্জা*রি করা হবে। তবে কি নিলাদ্র ভাইয়ার অপারেশন সাকসেসফুল হয়েছে! আজ নিলাদ্র ভাইয়াকে নতুন রূপে দেখতে পারবো আমরা!”
কুশল শান্ত স্বরে বললো….
—“হুম ও নিলাদ্র৷ আমাদের নিলাদ্র। তবে আজ থেকে আমরা ব্যতিত পুরো পৃথিবী ওকে সৌহার্দ্য ইশরাক নামেই চিনবে। সম্পূর্ণ নতুন চেহারা, নতুন পরিচয় লাভ করবে সে। সন্ধ্যা তোকে অধৈর্য হয়ে পড়লে চলবে না। মুখের পট্টিগুলো খুলে ফেলার পর নিলাদ্র যখন নিজের নতুন রূপ দেখবে তখন এই কঠিন সত্যটাকে মেনে নিতে না পেরে ওর ভিতর উত্তেজনাও কাজ করতে পারে। যা ওর শরীরের জন্য একদমই ভালো হবে না। তাই সেইসময় তোকেই নিলাদ্রের পাশে থাকতে হবে। ওকে ভরসা দিতে হবে। ওর এমন অবস্থা করার পিছনে আসলে কারা জড়িত তা জানাটা আমাদের জন্য অনেক বেশিই জরুরী।”
কুশলের কথা বলার মাঝেই নিলাদ্রের ঘুম ভে*ঙে যায়। নিলাদ্রকে নড়তে দেখে ডাক্তার আকরাম সাহেব নিলাদ্রের কাছে গিয়ে বললেন……
—“সাবধানে উঠে বসুন নিলাদ্র।”
সন্ধ্যার সাহায্য নিয়ে নিলাদ্র শোয়াবস্থা থেকে উঠে বসে। সন্ধ্যা শান্ত স্বরে বললো…
—“নিলাদ্র! আপনি উত্তেজিত হবেন না। আমি, মেজো ভাইয়া আপনার কাছাকাছিই আছি৷ আপনার মুখে থাকা পট্টিগুলো এখন খুলে দেওয়া হবে। তারপর আপনি সম্পূর্ণভাবে সুস্থ বোধ করবেন।”
নিলাদ্র সন্ধ্যার এরূপ কথা গুলো শুনে ওর হাত শক্ত ভাবে মুষ্টিবদ্ধ করে ধরে। ডাক্তার আকরাম নিলাদ্রের মুখে থাকা পট্টিগুলো ধীরে ধীরে খুলতে শুরু করেন। কিছুসময়ের মধ্যেই সম্পূর্ণ ভাবে পট্টিগুলো খোলা শেষ হলে ডাক্তার আকরাম নিলাদ্রের সামনে থেকে সরে দাঁড়ান। নিলাদ্রকে নতুন রূপে দেখে সন্ধ্যার চোখযুগল স্বাভাবিক এর তুলনায় বেশ বড় হয়ে যায় ওর মুখ অটোমেটিক হা হয়ে যায়। ডাক্তার আকরাম শান্ত স্বরে বললেন….
—“এবার ধীরে ধীরে চোখ খুলুন।”
নতুন রূপে নিলাদ্রকে দেখে কুশল আর তরুনিমার চোখে মুখে তৃপ্তির হাসি ফুটে উঠেছে৷ নিলাদ্র ধীরে ধীরে ওর চোখ জোড়া খুলতে শুরু করে। চোখ জোড়া খুলে নিলাদ্র নিজের সামনে কুশল আর তরুকে হাসিমুখে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখতে পায়। নিলাদ্রের ঠোঁটেও তৃপ্তির হাসি ফুটে উঠে। পরক্ষণেই ঘাড় ঘুরিয়ে নিজের পাশে সন্ধ্যাকে বড় বড় চোখ করে মুখ খুলে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বললো….
—“কি রে চোখ গুলো রসগোল্লার মতো বড় করে এভাবে মুখ খুলে আমার দিকে তাকিয়ে আছিস কেন? তোর ঐ ছোট মুখে আমার এতো বড় মাথা ঢুকবে না। মুখ বন্ধ কর ই*ডি*য়ে*ট।”
নিলাদ্রের এমন কথায় সন্ধ্যা কিছুটা লজ্জা পেয়ে মুখ বন্ধ করে মাথানিচু করে বিরবিরিয়ে বললো….
—“এই লোক নাকি নিজের নতুন রূপ দেখে উত্তেজিত হয়ে পড়বে হাহ্! চোখ মেলার সাথে সাথেই আমাকে পঁ*চি*য়ে জৈব সার বানিয়ে দিলো সবার সামনে। সে যাই হোক…উনি তো আগের থেকেও আরো বেশি হ্যন্ডসাম হয়ে গিয়েছেন। আমার তো ওনার উপর থেকে চোখ ই সরাতে মন চাইছে না। আল্লাহ আমাকে ধৈর্য দিন।”
কুশল আর তরুনিমা নিলাদ্রের বেডের কাছে এসে দাঁড়ায়। কুশল নিলাদ্রকে জড়িয়ে ধরতেই নিলাদ্র বললো…
—“কতোদিন পর আমার প্রাণ প্রিয় ভাই সমতুল্য বন্ধুকে বুকে জড়িয়ে ধরতে পারলাম। আমার বুকটা জুড়িয়ে গেলো।”
—“আল্লাহর অশেষ রহমত যে তুই পুরোপুরি ভাবে সুস্থ হয়ে গিয়েছিস নিল।”
নিলাদ্র কুশলকে ছেড়ে দিয়ে সোজা হয়ে বসে বললো…
—“আমার সামনে একটা আয়না আনার ব্যবস্থা কর আমি আমার নিজের নতুন রূপ দেখার জন্য অনেক বেশিই এক্সাইটেড হয়ে আছি গত দু’দিন যাবৎ।”
নিলাদ্রের এরূপ কথা শুনে ডাক্তার আকরাম কেবিনের ভিতরে থাকা ছোট বেলটিতে ক্লিক করে। পরমুহূর্তেই একজন পুরুষ নার্স কেবিনের দরজা খুলে ভিতরে প্রবেশ করে। ডাক্তার আকরাম নার্সটিকে একটা মাঝারি সাইজের আয়না আনার কথা বললেন। কিছুসময় পর নার্সটি আয়না নিয়ে আবারও কেবিনের ভিতর প্রবেশ করে। কুশল আয়নাটি নিজের হাতে নেয়। নার্সটি চলে যায়। কুশল আয়নাটি নিলাদ্রের সামনে ধরে। নিলাদ্র আয়নায় পড়া নিজের প্রতিচ্ছবি খুব ভালো ভাবে দেখতে থাকে। পরক্ষণেই নিলাদ্র ডাক্তার আকরামকে উদ্দেশ্য করে বললো…..
—“ডাক্তার সাহেব আপনার হাতে তো জাদু আছে দেখছি। আমার চেহেরা পুরোপুরি ভাবে পরিবর্তন করে দিয়েছেন। কিন্তু আমার চেহারার সাথে আবার অন্য কারোর চেহারার মিল রাখেন নি তো! এমনিই জীবনে স*ম*স্যার শেষ নেই। পরে আবার এই চেহারার আসল মালিকের পরিবারের কারোর সাথে দেখা হয়ে গেলে চিনতে না পারার দো*ষে সকলের সামনে গণপি*টু*নি খেতে না হয়।”
নিলাদ্রের এমন কথা শুনে ওরা সকলেই স্বশব্দে হেসে উঠে।
(১২১)
নিজের কেবিনে বেডে আধোশোয়া হয়ে কপালের উপর একহাত ভাঁজ করে চোখ বন্ধাবস্থায় বসে আছে তাহির। তাহিরের বেডের পাশে থাকা চেয়ারটিতে অনেক সময় হলো গুটিসুটি হয়ে বসে আছে হুমায়রা। তাহিরের চোখে-মুখে রাগের ছাপ এখনও স্পষ্ট থাকতে দেখে হুমায়রা নিজের মুখ থেকে একটা টু শব্দ ও বের করার সাহস জুগিয়ে উঠতে পারছে না। সেইসময় ওদের কেবিনের দরজায় কারোর নক করার পাশাপাশি “আমি কি ভিতরে আসতে পারি স্যার?” এরূপ বাক্য উচ্চারণের আওয়াজ ভেসে আসে। তাহির শান্ত স্বরে বললো…
—“ভিতরে এসো, হাশেম।”
তাহিরের অনুমতি পাওয়া মাত্র দরজা খুলে হাশেম নামের একজন প্রাপ্ত বয়সের পুরুষ কেবিনের ভিতর প্রবেশ করে। তাহির চোখ মেলে হাশেমের দিকে তাকিয়ে বললো…..
—“তোমাকে একটা বিশেষ কাজ সম্পন্ন করার জন্য আসতে বলা হয়েছে হাশেম।”
—“হুকুম করুণ, স্যার।”
—“এই ক্লিনিকে নিলয় নামে একজন প্রাপ্ত বয়সের ডাক্তার আছেন। তুমি ক্লিনিকের হেড অফিসারের সাথে কথা বলে ডাক্তার নিলয় এমন জায়গায় ট্রান্সফার করার ব্যবস্থা করো যেনো সেখান থেকে তার নিজ শহরে আসতে অনেক বেশিই বেগ পেতে হয়। আর এই কাজ সম্পন্ন করার জন্য যতো টাকা ব্যয় করতে হয় করো। কিন্তু কাজটা আজকের ভিতরে সম্পন্ন হতে হবে।”
তাহিরের মুখে এমন কথা হুমায়রার মুখ অটোমেটিক হা হয়ে যায়। হাশেম শান্ত স্বরে বললো….
—“আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন স্যার। আমি আজকের ভিতরেই ডাক্তার নিলয়কে আর উচিত ঠিকানায় পাঠানোর সম্পূর্ণ ব্যবস্থা করে ফেলবো।”
—“এখন তুমি আসতে পারো।”
অতঃপর হাশেম তাহিরের কেবিন থেকে বেড়িয়ে যায়।
(১২২)
কুশল ডাক্তার আকরামকে উদ্দেশ্য করে বললো….
—“ডাক্তার সাহেব নিলাদ্রকে ক্লিনিক থেকে রিলিজ করতে আর কতোদিন সময় লাগবে?”
—“নিলাদ্রের শরীরের বিভিন্ন জায়গায় থাকা ক্ষ*ত গুলো সব শুকিয়েই এসেছে চৌধুরী সাহেব। আপনারা চাইলে আজই ওনাকে রিলিজ করে বাসায় নিয়ে যেতে পারবেন। তবে চিন্তার কোনো কারণ নেই আর কিছুদিন ওনাকে বেডরেস্টে রাখলে ওনার শারীরিক দূর্বলতা পুরোপুরি ভাবে সেরে যাবে।”
এই বলে ডাক্তার আকরাম কেবিন থেকে বেড়িয়ে যায়। কুশল নিলাদ্রের পাশে বসে শান্ত স্বরে বললো…..
—“ভাই…এবার আমাদের বল তো তোর এই অবস্থার পিছনে আসলে কারা দায়ী! তোর সেদিনের হওয়া এ*ক্সি*ডে*ন্টটি যেনো সাধারণ কোনো এ*ক্সি*ডে*ন্ট ছিলো তা বুঝতে আমার বাকি নেই। সম্পূর্ণ সত্য ঘটনাগুলো খুলে বল আমাদের কাছে, কিছু লুকাস না।”
নিলাদ্র ওদের তিনজনের দিকে একপলক তাকিয়ে নিজের দৃষ্টি নিচের দিকে স্থির করে একবার দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো….
—“জীবনে কখনও এতো বড় কঠিন সত্যের সম্মুখীন হতে হবে তা আমার কল্পনারও বাহিরে ছিলো কুশল। সেই কাল রাত্রীর পর আমার বেঁচে যাওয়ার হয়তো একটাই কারণ আছে তা হলো তোদের সবার সামনে মি*থ্যা*র জাল বুননকারীদের মু*খো*শ উন্মোচন করে তাদের আসল রূপ দেখানো। সেই কঠিন সত্যের সম্মুখীন হওয়ার পর নিজেকে শক্ত রাখিস তুই এবং সন্ধ্যা দু’জনেই। জানি তোদের মনের অবস্থা ভালো হবে না সম্পূর্ণ সত্যটা জানার পর। কিন্তু সত্য যতো কঠিন ই হোক না কেনো তা মেনে নেওয়ার ক্ষমতা আমাদের মাঝে সর্বক্ষণ রাখা উচিত।”
#চলবে ইনশাআল্লাহ………