হৃদকোঠোরে রেখেছি তোমায় পর্ব-৫২+৫৩+৫৪

0
426

#হৃদকোঠোরে_রেখেছি_তোমায়🖤(৫২)
#Maisha_Jannat_Nura (লেখিকা)

রাতের বেলা…..
সাগরিকা ড্রয়িং রুমে সোফায় বসে চিন্তিত মুখশ্রী নিয়ে একটু পর পর মূল দরজার দিকে লক্ষ্য করছে তার মেজো ছেলে বা ছোট ছেলে ফিরে কিনা। সেইসময় সাবরিনা ড্রয়িং রুমে আসলে সাগরিকা বললেন….

—“মেজো বউমা..! সায়মন আর রিজভী তো এখনও বাসায় ফিরলো না। তোমাকে কি কল করেছিলো? বড় খোকার আর বড় বউমার কি অবস্থা কিছু কি জানিয়েছে!”

সাবরিনা সাগরিকার পাশে বসে বললেন…
—“আম্মা…আপনি এতো বেশি উত্তেজিত হবেন না। এই উত্তেজনা আপনার শরীরের জন্য ভালো না। সায়মন আর রিজভী হাসপাতালে যখন গিয়েছে তখন পরিস্থিতি যেমনই হোক না কেনো তা ওরা জানাবেই৷”

সাগরিকা সোফার সাথে পিঠ ঠেকিয়ে চোখ বন্ধ করলেন। সেইসময় কামিনীও ড্রয়িং রুমে এসে অন্যপাশের সোফায় বসে। সাবরিনা হাতে থাকা নিজের ফোন থেকে কামিনীর নাম্বারে একটা মেসেজ সেন্ড করে…

—“আমার নাম্বারে একটা কল কর ছোট..!”

নোটিফিকেশন এর শব্দ হতেই কামিনী নিজের ফোনস্ক্রিণে লক্ষ করতেই সাবরিনার এমন মেসেজ দেখে ভ্রু কুঁচকে তার দিকে তাকাতেই সাবরিনা চোখ ইশারায় কামিনীকে কল করতে বলে। পরক্ষণেই কামিনী সাবরিনাকে কল দিলে তার ফোন বেজে উঠলে সাবরিনা বললেন….

—“আম্মা..আপনার মেজো ছেলে কল করেছে।”

এই বলে সাবরিনা কামিনীর কল কেটে দিয়ে মি*ছে-মিছি ফোন কানে ধরে সাগরিকাকে শুনাতে কলে কথা বলার নাটক করতে শুরু করলো। সাবরিনা অবাক ভাব নিয়ে বললেন….

—“কি বলছো তুমি এসব! আল্লাহ…আচ্ছা ঠিক আছে দেখো কি করলে ভালো হয় সেটাই করো।”

এই বলে সাবরিনা কান থেকে ফোন সরিয়ে সাইডে রেখে দেয়। সাগরিকা উত্তেজিত স্বরে প্রশ্ন করলেন….

—“কি হয়েছে মেজো বউমা? কি বললো মেজো খোকা?”

সাবরিনা মি*থ্যে চিন্তা ভাব নিজের মুখশ্রীতে ফুটিয়ে বললেন……
—“আম্মা..বড় ভাইয়া বড় ভাবীকে নিয়ে ডাক্তার দেখাতে গিয়েছিলেন তারপর হয়তো ঘোরাঘুরি করার জন্য শহর থেকে কিছুটা দূরে যে পাহাড় চূড়া গ্রাম আছে সেখানে গিয়েছিলেন। ঐ রাস্তায় তো খাঁ*দে*র অভাব নেই। সেখানেই তাদের গাড়ির এ*ক্সি*ডে*ন্ট হয়েছিলো। গ্রামের আশেপাশের লোকেরা বড় ভাইয়াকে ক্লিনিকে নিয়ে এসেছিলেন তার পরপরই ক্লিনিক থেকে আপনার ছেলের কাছে ফোন এসেছে। বড় ভাইয়া মাথায় গু*রু*তর ভাবে আ*ঘা*ত পেয়েছেন। ডাক্তার বলেছেন যদি আগামী ৪৮ ঘন্টার ভিতর বড় ভাইয়ার সেন্স না ফিরে তাহলে তিনি কো*মা*য় চলে যাবেন।”

সাবরিনার এরূপ কথা শুনে সাগরিকা ‘আল্লাহ গোওও’ বলে আ*র্ত*নাদ করে উঠেন। কামিনী সাবরিনার সঙ্গ দিতে মিথ্যে উত্তেজনার নাটক করে বললেন…

—“বড় ভাবীর কি অবস্থা..!”

সাবরিনা বললেন….
—“বড় ভাবীকে নাকি খুঁ*জে পাওয়া যাচ্ছে না। যারা বড় ভাইয়াকে ক্লিনিকে নিয়ে এসেছিলেন তাদের সাথে সায়মন আর রিজভী কথা বলেছিলো তারা নাকি বলেছেন গাড়িতে বড় ভাবী ছিলেন না। পরে সায়মন আর রিজভী এ*ক্সি*ডে*ন্ট স্পটেও গিয়েছিলো। গাড়িটা পাহাড়ি রাস্তার কিনারে একটা গাছের সাথে আটকে ছিলো কোনোরকম ভাবে। আর ড্রাইভিং সিটের পাশের সিটের দরজা খোলা ছিলো। গ্রামের লোকেরা আ*শং*কা করছেন বড় ভাবী হয়তো খা*দে পড়ে গিয়েছেন।”

পরমূহূর্তেই সাগরিকা এসব কথার প্রেসার আর নিতে না পেরে সেন্সলেস হয়ে সাবরিনার উপর ঢ*লে পড়ে গেলেন।

এভাবেই কেটে যায় কয়েকদিন…..
সাগরিকা নিজের রুমে আধশোয়া হয়ে বসে নিরবে চোখের পানি ফেলছেন। সেইসময় কামিনী ছুটে সাবরিনার রুমের দরজার সামনে এসে দাড়িয়ে হাঁ*পা*তে শুরু করেন। কামিনীকে এমন ভাবে হাঁ*পা*তে দেখে সাগরিকা বললেন…

—“কি হয়েছে ছোট বউ মা? এভাবে হা*পা*চ্ছো কেনো?”

কামিনী কোনো রকমে নিজেকে সামলে নিয়ে বললেন…
—“আম্মা নিচে আসুন। মেজো ভাইয়া আর রিজভী পাহাড় চূড়া গ্রাম থেকে ৩-৪দিন আগে জন্ম এক বাচ্চা মেয়েকে নিয়ে এসেছে। আর বলছে বাচ্চাটি নাকি বড় ভাবীর৷”

কামিনীর মুখে এরূপ কথা শুনে সাগরিকা বেশ অবাক হলেন। পরমূহূর্তেই তড়িৎগতিতে বিছানা থেকে নেমে কামিনীর সাথে নিজের রুম থেকে বেড়িয়ে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে আসতেই দেখলেন সাবরিনা সোফায় নিজের কোলে এক নবজাতক বাচ্চা শিশুকে নিয়ে বসে আছে। সোফার অন্যপাশে সায়মন আর রিজভীও বসে আছে। সাগরিকা আর কামিনী সাবরিনার পাশে এসে বসে। সাগরিকা সাবরিনার কোলে থাকা বাচ্চা শিশুটির দিকে শান্ত দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে রয় কিছুসময়। পরক্ষণেই দৃষ্টি সরিয়ে সায়মন আর রিজভীকে উদ্দেশ্য করে প্রশ্ন করলেন….

—“বড় বউমা কোথায়? ওকে দেখছি না তো!”

সায়মন একবার দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন….
—“আম্মা…! বড় ভাবী আর এই দুনিয়ায় নেই। এ*ক্সি*ডে*ন্টে*র কারণে বড় ভাবী নিজেও অনেক খা*রা*প ভাবে আ*হ*ত হয়েছিলেন। আর সেইমূহূর্তেই তার পানি ভে*ঙে গিয়েছিলো। প্র*স*ব বে*দ*না ও শুরু হয়েছিলো। তবুও বড় ভাইয়ের অবস্থা ভালো না দেখে তিনি অনেক ক*ষ্টে হয়তো গাড়ি থেকে নামতে সক্ষম হয়েছিলেন। এ*ক্সি*ডে*ন্ট স্পট থেকে কিছুটা দূরে একটা বাড়িতে সাহায্য চাওয়ার জন্য গিয়েছিলেন। কিন্তু পুরো কথা শেষ করার পূর্বেই তিনি নাকি সেন্স*লে*স হয়ে গিয়েছিলেন। আর সেই বাড়ির মানুষরা বড় ভাইয়ের বিষয়ে কিছু জানতেও পারেন নি সেইসময়। সন্ধ্যা নাগাদ বড় ভাবী প্র*স*ব করলে তার মেয়ে সন্তান হয়। আর সঙ্গে সঙ্গেই বড় ভাবী এই দুনিয়ার মায়া ত্য*গ করেন। বড় ভাবীর শরীরে অত্যাধিক ক্ষ*ত থাকায় আর প্র*স*ব কালীন সময়ে অত্যাধিক র*ক্ত পা*ত হওয়ায় তারা বড় ভাবীর দা*ফ*ন কার্য সম্পন্ন করার সিদ্ধান্ত নেন। আর সেদিন রাতেই তাদের গ্রাম থেকে কিছুটা দূরে একটা খোলা মাঠের পাশে বড় ভাবীর দা*ফ*ন কার্য সম্পন্ন করেন। আমরা যে বড় ভাবীকে খুঁজছি এই কথা গ্রামের অনেক মানুষই জানতে পেরেছিলেন। গত কাল গ্রামের একজন লোকের থেকে বড় ভাবীর খোঁজের কথা জানতে পেরে সেই পরিবারের একজন লোক আজ আমাকে কল করেছিলেন। ওনার কথা শুনে আমি আর রিজভী সঙ্গে সঙ্গে পাহাড় চূড়া গ্রামে সেই বাড়িতে গিয়েছিলাম। তারা আমার কোলে বড় ভাইয়া আর বড় ভাবীর শেষ চিহ্নকে উঠিয়ে দিলেন। এরপর আমরা বড় ভাবীর কবর জিরায়ত করে বাসায় ফিরে আসলাম।”

সায়মন এমন ভাবে মি*থ্যে কথাগুলো সাজিয়ে সাগরিকার সামনে তুলে ধরলেন যে সাগরিকার এই বিষয়ে সামান্য তম স*ন্দে*হ প্রকাশ করার ও অবকাশ রইলো না। তিনি সাবরিনার কোলে থাকা নবজাতক শিশুটির দিকে তাকিয়ে নিরবে চোখের জল ফেলতে ফেলতে বললেন….

—“পৃথিবীর আলো দেখতে না দেখতেই নিজের জন্মদানকারী পিতা-মাতার স্নেহ-ভালোবাসা পাওয়া থেকে ব*ন্ঞ্চি*ত হলি। কেমন কপাল নিয়ে জন্ম নিলি রে তুই অ*ভা*গী!”

সাবরিনা শান্ত স্বরে বললেন….
—“আম্মা..! যদি কিছু মনে না করেন তাহলে আমি কি আপনাদের সবার নিকট একটা প্রস্তাব এর কথা তুলে ধরতে পারি!”

সায়মন বললেন…
—“বলো তুমি কি প্রস্তাব তুলে ধরতে চাইছো, শুনছি আমরা।”

—“এ*ক্সি*ডে*ন্টের কারণে আমরা বড় ভাবীকে হা*রা*লাম। বড় ভাইয়াও কো*মা*য় চলে গিয়েছেন। বড় ভাইয়ার পুনরায় কবে সে*ন্স ফিরবে সেই বিষয়ে কোনো কিছুই বলতে পারেন নি ডাক্তার খালেকুজ্জামান ভাই। এই নবজাতক শিশু আর কুশলের পাশে এখন তাদের মা-বাবাকে ভিষণ প্রয়োজন। তাই আপনাদের কারোর কোনো আপত্তি না থাকলে আমি আর সায়মন বড় ভাইয়া-ভাবীর শেষ দুই চিহ্নকে নিজেদের সন্তানরূপে গ্রহন করতে চাই। আমাদের ছেলে কনক আমাদের কাছে যেমন প্রিয় ওরা দু’জন ও আমাদের কাছে তেমনই প্রিয় হয়ে থাকবে সবসময়। কুশলের বিষয়ে তো ডাক্তার বলেছিলেন কুশলের যেদিন সেন্স ফিরবে সেদিন থেকে সে ওর জীবনে পার করে আসা আগের বছর গুলোর সব স্মৃতি পুরোপুরি ভাবে ভু*লে যাবে। তাই আমাকে আর সায়মনকে ওর নিজের মা-বাবার রূপে গ্রহন করতেও কোনো স*ম*স্যা হবে না। ওরা দু’জন কখনও মা-বাবার অ*ভা*ব বোধ করবে না। আর তাদের কথা ভেবে যেনো কখনও ক*ষ্টও না পায় তাই ওদের কাছে ওদের জন্মদানকারী পিতা-মাতা বড় বাবা ও বড় মায়ের পরিচয় নিয়ে থাকবে। এই কঠিন সত্যগুলো আজীবন ওদের অজানাই থেকে যাবে।”

সাবরিনার মুখে এরূপ কথাগুলো শুনে সায়মন, রিজভী আর কামিনী অনেক অবাক হয়। ওরা তিনজনই হয়তো মনে মনে চিন্তা করছে….

—“কি নিখুঁত ভাবে পরিস্থিতি সামলে নিতে এতো বড় একটা পরিকল্পনা তৈরি করেছে সাবরিনা।”

সাগরিকা চৌধুরী একহাতে নিজের চোখের পানি মুছে নিয়ে বললেন….
—“বেঁচে থাকো মা। তোমার এতো উদার মনের চি*ন্তা সম্পর্কে জানতে পেরেই আমার বুকের উপর থেকে বিশাল বড় একটা পাথর যেনো সরে গেলো। আমার এই বিষয় নিয়ে কোনো আ*প*ত্তি নেই।”

সাবরিনাকে সঙ্গ দিতে সায়মন বললো…
—“আমাদেরও কোনো আ*প*ত্তি নেই এই বিষয় নিয়ে আম্মা।”

সাবরিনা বললো….
—“আম্মা..আমার ছোট মেয়ের একটা নাম ঠিক করে দিন।”

সাগরিকা শিশু মেয়েটির মাথায় আলতো ভাবে আদুরে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললেন….
—“আজ থেকে তোর নাম সন্ধ্যা..সন্ধ্যা চৌধুরী।”

এরপর কেটে যায় আরো ৩ বছর। দীর্ঘসময় পর কুশলও কো*মা থেকে সুস্থ হয়ে ফিরতে সক্ষম হয়েছে। কিন্তু ডাক্তারের আ*শং*কা অনুযায়ী কুশল ওর জীবনের পেরিয়ে আসা পূর্বের ৮ বছরের সকল স্মৃতি পুরোপুরি ভাবে ভু*লে গিয়েছে। সাবরিনা আর সায়মনকেই নিজের জন্মদানকারী পিতা-মাতার রূপে গ্রহন করে নিয়েছে৷

………………….বর্তমান (১)………………..

সাবরিনার মুখে পুরো অতীত সম্পর্কে জানতে পারার পর নিলাদ্র যেনো পুরোপুরি ভাবে স্ত*ব্ধ হয়ে গিয়েছে। সম্পূর্ক সত্যটাকে মেনে নিয়ে স্বাভাবিক হওয়ার পূর্বেই ডাক্তার খালেকুজ্জামান নিলাদ্রের ডান হাতের উপরের মাংসপেশিতে একটা ইনজেকশন পুশ করে দেয়। নিলাদ্রের চোখ জোড়া ঘো*লা*টে হয়ে আসতে শুরু হয়। সে ঘাড় ঘুরিয়ে ওদের দিকে তাকিয়ে বললো….

—“তোদের সবার মৃ*ত্যু এতোটাই য*ন্ত্র*ণা দা*য়*ক হবে যে তোদের রুহ পর্যন্ত কেঁ*পে উঠবে।”

এরপর নিলাদ্র আর কিছু বলার শ*ক্তি নিজের মধ্যে যুগিয়ে উঠতে পারলো না। সাবরিনা রিজভীকে উদ্দেশ্য করে বললেন…

—“এর হাত-পায়ের বাঁধন খুলে দাও। আর একে বাসার সামনের ব্যস্ত রাস্তার মাঝে ছেড়ে দাও। এরপর এ কতোটা ক*রু*ণ য*ন্ত্র*ণা সহ্য করে মা*রা যায় সেটাও জানতে পারবে সবাই।”

রিজভী নিলাদ্রের হাত-পায়ের বাঁধনগুলো খুলতে শুরু করে। সাবরিনা আবারও ডাক্তার খালকুজ্জামানকে উদ্দেশ্য করে বললেন…

—“ওর মৃ*ত্যু নিশ্চিত হওয়ার পর ওর মুখ কিছু দ্বারা থে*ত*লে দেওয়ার ব্যবস্থা করবেন। এরপর ওর লা*শ এখান থেকে দূরে যে বড় ব্রিজটা আছে সেখানে ফে*লে রেখে আসবেন। আমরা ততোসময় আপনার বাসায় আপনার স্ত্রী ও বাচ্চার সাথে বসে আপনার ফেরার অপেক্ষায় করছি।”

……………………….…বর্তমান (২)………………………….

(১২৪)
জীবনের এই ক*রু*ণ সত্যগুলো জানার পর সন্ধ্যার কাঁদতে কাঁদতে হেঁ*চ*কি উঠে গিয়েছে। নিলাদ্র এক হাতে সন্ধ্যাকে নিজের বুকের সাথে জড়িয়ে রেখেছে। কুশল সোফায় বসে দুই হাত দিয়ে মাথার দু’পাশ চে*পে ধরে নিচের দিকে দৃষ্টি স্থির করে রেখেছে। তরুনিমাও নিরব হয়ে কুশলের পাশেই বসে অশ্র*পা*ত করছে। পরমূহূর্তেই তরুনিমা কুশলের বাম কাঁধে হাত রাখতেই কুশল চোখ তুলে তরুর দিকে তাকায়। কুশলের চোখ জোড়ায় চোখ পড়তেই তরু ভ*র*কে যায়। কুশলের চোখের মনির চারপাশের সাদা অংশ জুড়ে লাল র*ক্ত যেনো জ*মা*ট বেঁ*ধে আছে। ছোট ছোট র*গে*র মতো রেখা ভেসে আছে। তরু সঙ্গে সঙ্গে কুশলকে নিজের বুকের সাথে জড়িয়ে ধরে বললো….

—“আপনি কাঁদুন….দয়াকরে নিজের বুকের ভিতর জমে থাকা ক*ষ্ট গুলোকে বের করে ফেলুন। দয়াকরে কাঁদুন…এমন পাথরের মতো শক্ত হয়ে থাকবেন না।”

তরুর কথাগুলো হয়তো কুশলের কান পর্যন্ত পৌঁছাতে সক্ষম হলেও তার মস্তিষ্ক স্পর্শ করতে পারলো না। কুশল এখনও আগের ন্যয় শ*ক্ত হয়ে আছে। ওর চোখ জোড়া যেনো মরভূমির মতো পানি শূন্য হয়ে গিয়েছে। কুশলকে বুকে নিয়ে তরুনিমা নিজেই ডুকরে ডুকরে কাঁদছে কিন্তু কুশল কাঁদতে পারছে না।

#চলবে ইনশাআল্লাহ………..

#হৃদকোঠোরে_রেখেছি_তোমায়🖤(৫৩)
#Maisha_Jannat_Nura (লেখিকা)

(১২৫)
অনেক সময় ধরে সন্ধ্যার কোনো সাড়াশব্দ না পেয়ে নিলাদ্র নিজের বুকের উপর লক্ষ্য করেই দেখে সন্ধ্যা ঘুমিয়ে পড়েছে। কান্না করতে করতে মেয়েটার সম্পূর্ণ মুখশ্রী হালকা লাল বর্ণ ধারণ করেছে, বন্ধ চোখজোড়ার নিচের অংশ অনেকটা ফুলো ফুলো দেখাচ্ছে। নিলাদ্র আলতো ভাবে সন্ধ্যাকে নিজের পাশে শুইয়ে দিয়ে বেড থেকে নেমে দাঁড়িয়ে ওর উপর দৃষ্টি স্থির করে। সন্ধ্যার দুই চোখের কোটরে জমে থাকা নোনা জলের কণা টুকু নিলাদ্র আলতো হাতে মুছে দিতেই সন্ধ্যা হালকা নড়ে উঠে। অতঃপর নিলাদ্র একবার দীর্ঘশ্বাস ফেলে সন্ধ্যার পাশ থেকে সরে কুশল আর তরুর দিকে তাকাতেই দেখে কুশল তরুর কোলের উপর মাথা রেখে সোফায় গুটিশুটি হয়ে শুয়ে আছে। নিলাদ্র তরুকে উদ্দেশ্য করে কিছু বলতে নিবে সেইমূহূর্তে তরু নিজের ঠোঁটের উপর এক আঙুল ঠেকিয়ে ইশারায় নিলাদ্রকে চুপ করতে বললো। নিলাদ্রও থেমে যায়। পরক্ষণেই তরু নিজের পিঠের পিছন থেকে সোফার বালিশটা হাতে নিয়ে সাবধানে বসাবস্থা থেকে উঠে কুশলের মাথা সেই বালিশের উপর রাখে। অতঃপর নিলাদ্রকে ইশারা করে কেবিন থেকে বাহিরে বের হওয়ার জন্য। তরুর ইশারা বুঝতে পেরে নিলাদ্র তরুর পিছন পিছন কেবিন থেকে বের হয়ে কেবিনের দরজার পাশে রাখা চেয়ারগুলোতে বসে। তরুনিমা একবার দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো…..

—“অ*মানুষ গুলো এতোটা নি* কৃ* ষ্ট কি করে হতে পারে ভাই! বড় মায়ের মতো নিষ্পাপ মানুষটাকে কতোটা ক*রু*ণ য*ন্ত্র*ণা দিয়ে মে*রে ফেলেছে ওরা সেসব কথা ভাবতেই আমার সর্বশরীর শিউরে উঠছে। বড় বাবাকে দীর্ঘ ২০ বছর যাবৎ হাসপাতালের বেডে জীবিত লা*শে*র মতো সয্যাশায়িত করে রেখেছিলো ওরা। নিজেদের মুখোশ যেনো সকলের সামনে উন্মোচিত না হয় তাই বড় বাবাকে ২য় বারও মে*রে ফেলার চেষ্টা করেছিলো এরা। যতোক্ষণ না পর্যন্ত ঐ নি* কৃ* ষ্ট অ*মানুষ গুলোকে নিজের চোখের সামনে নি*র্ম*ম ও জ*ঘ*ন্য ভাবে মৃ*ত্যু য*ন্ত্র*ণা*য় ছ*ট-ফ*ট করতে দেখবো, অত্যাধিক অসহনীয় য*ন্ত্র*ণার পরও যখন মৃ*ত্যু তাদের গ্রহন করবে না! এরজন্য আ*ত্ম*হ*ত্যা করতে চাইবে কিন্তু সেই চেষ্টা করার শক্তিটুকু পর্যন্ত নিজেদের মাঝে জুগিয়ে উঠতে পারবে না, ওদের সমস্ত অ*হং*কা*র মাটির সাথে মিশে যেতে না দেখবো ততোক্ষণ পর্যন্ত আমার মনে শান্তি কাজ করবে না ভাই।”

নিলাদ্র কিছু বলতে নিবে সেইসময় কেবিনের দরজা খুলে কুশলকে বের হতে দেখে নিলাদ্র দাঁড়িয়ে যায়। তরুনিমাও ঘাড় ঘুরিয়ে পিছনে লক্ষ্য করতেই দেখে কুশল ওর চেহারায় শান্ত ভাব স্পষ্ট রেখে দাঁড়িয়ে আছে। পরক্ষণেই কুশল তরুর বাম হাত ধরে ওকে বসাবস্থা থেকে দাঁড় করিয়ে নিলাদ্রকে উদ্দেশ্য করে বললো…..

—“সন্ধ্যার খেয়াল রাখিস।”

প্রতিত্তুরে নিলাদ্র কিছু বলতে নিলে তরু ইশারায় ওকে থামিয়ে দেয়। অতঃপর কুশল তরুকে নিয়ে সামনের দিকে অগ্রসর হতে শুরু করে। নিলাদ্র ওদের যাওয়ার পানে তাকিয়ে রয়। কিছুসময় পর ওরা চোখের আড়াল হতেই নিলাদ্র একবার দীর্ঘশ্বাস ফেলে কেবিনের ভিতরে প্রবেশ করে।

(১২৬)
কেবিনের ভিতর বিছানায় আধশোয়া হয়ে বসে আছে তাহির। হুমায়রা ওয়াশরুম থেকে বের হতেই তাহির শান্ত স্বরে হুমায়রাকে উদ্দেশ্য করে বললো….

—“আমার যাবতীয় জিনিসপত্র গুলো গুছিয়ে নে। ক্লিনিক থেকে রিলিজ নিয়ে নিয়েছি। বাসায় ফিরতে হবে একটু পরই।”

তাহিরের এমন কথায় হুমায়রা কিছুটা অবাক হয়। তাহির হুমায়রাকে অবাক ভাব নিয়ে ঠায় ওয়াশরুমের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে কিছুটা রাগ নিয়েই বললো….

—“কি রে কথা কি কানে যায় নি তোর!”

তাহিরের রাগী স্বরে বলা কথাটুকু শুনতেই হুমায়রার ধ্যন ভা*ঙে। পরক্ষণেই তাহিরের দিকে ধীর পায়ে অগ্রসর হতে হতে হুমায়রা বললো…

—“আজই বাসায় ফেরাটা কি খুব জরুরী ছিলো! আর কয়েকটা দিন এখানে থাকলেই হতো। তোমার ক্ষ*ত স্থানটিও শুকিয়ে…..!”

হুমায়রাকে পুরো কথা শেষ করতে না দিয়েই তাহির হুমায়রার দিকে রাগী দৃষ্টি স্থির করে দাঁ*ত কি*ড়*মি*ড়ি*য়ে বললো….

—“আমার ক্ষ*ত শুকানো না শুকানো নিয়েও ভাবার সময় আছে নাকি তোর! এসেছিস তো যুবক ডাক্তারদের সাথে রঙ্গলীলা করতে। তাদের স্পর্শ পেতে তো অনেক ভালো লাগে। আবার নতুন কোনো ডাক্তারের সঙ্গে লীলাখেলা খেলতে পারিস যেনো তাই আমার ক্ষ*তে*র দোহাই দিয়ে এখানে থাকতে চাইছিস! আমি বুঝি না ভেবেছিস? আমাদের বংশের যথেষ্ট সম্মান আছে। আমাদের বংশের মেয়েরা এভাবে যেখানে সেখানে পরপুরুষদের সঙ্গে ঢলাঢলি করে না৷”

তাহিরের মুখে নিজের সম্পর্কে এরূপ তি*ক্ত কথাগুলো শুনে হুমায়রার সর্বশরীর রি রি করে উঠে। মলিনতার কালো মেঘের ছাপ হুমায়রার সম্পূর্ণ মুখশ্রী জুড়ে বিরাজমান হয়। চোখজোড়া নোনা জলে টইটম্বুর হয়ে উঠে। হুমায়রা কোনোরূপ টু শব্দ না করে মাথা নতবস্থায় রেখে কেবিনে রাখা তাহিরের প্রয়োজনীয় সব ঔষধ, প্রেসক্রিশন, রিপোর্ট, কাপড় গুলো গুছিয়ে নিতে শুরু করে। তাহির নিচের দিকে দৃষ্টি স্থির করে জোরে জোরে নিঃশ্বাস ফেলে নিজের রাগকে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করছে।

(১২৭)
কুশল ড্রাইভিং সিটে বসে তার আপন গতিতে গাড়ি চালাচ্ছে। কুশলের পাশেই নিরব হয়ে বসে আছে তরুনিমা। তরু একটু পর পর কুশলের দিকে তাকাচ্ছে আবার দৃষ্টি অন্যত্র সরিয়ে নিচ্ছে। তরুর এই দৃষ্টিভঙ্গী জুড়ে ঘুরছে সহস্র প্রশ্নমালা কিন্তু মুখ ফুটে একটা শব্দ ও সে বের করতে পারছে না। বেশ লম্বা সময়ের জার্নির পর একটা ফাঁকা মাঠের সামনে এসে গাড়ি থামায় কুশল। অতঃপর কুশল নিজের সিটবেল্ট খুলতে খুলতে শান্ত স্বরে বললো….

—“গাড়ি থেকে নামে তরুনিমা।”

তরুনিমা বিনাবাক্যে গাড়ি থেকে নেমে দাঁড়ায়। কুশলও গাড়ি থেকে নেমে তরুর পাশে এসে দাঁড়ায়। থালার মতো আকাশ জুড়ে ছোট্ট একটা চাঁদের টুকরো যার চারপাশে ছড়িয়ে আছে কোটি কোটি তারারা। সেই এক টুকরো চাঁদের আলোয় পুরো পরিবেশ আলোকিত হয়ে আছে। তরু নিজের চারপাশটা ভালোভাবে লক্ষ্য করতেই দেখে ওদের থেকে ২০-৩০ হাত দূরে একটা সরকারী প্রাইমারী স্কুল এর একতলা বিল্ডিং আছে। মাঠের দুইধার দিয়ে বিশাল বিশাল আম, বট, জাম ও কাঁঠালের গাছ লাগানো আছে। তরু ঘাড় ঘুরিয়ে কুশলের দিকে তাকাতেই কুশল হাঁটু গেড়ে মাঠের উপর ধপ করে বসে পরে। তরুও সঙ্গে সঙ্গে ‘কুশল’ বলে ওর পাশে বসে পরে। কুশল দু’হাতে নিজের চারপাশের মাটি ও মাটির উপর থাকা ঘাসগুলো ছুঁয়ে দেখতে দেখতে বললো…..

—“মা…মা গোওওও….ও মা….কোথায় ঘুমিয়ে আছো তুমি! এই মাঠের কোন অংশে ঐ জা*লি*ম*রা তোমায় দা*ফ*ন করে দিয়েছিলো গো মা! জানো মা….আমার যে তোমার মায়া মাখানো মুখশ্রী টুকুও মনে নেই গো। মা গোওও তুমি তো আমায় অনেক আদর করেছিলে তাই না! স্নেহে ভরপুর তোমার হাত যুগল দিয়ে তো তুমি আমায় তিনবেলা খাইয়ে দিয়েছিলে বলো! তোমার কোলের উপর মাথা রেখে আমায় কবিতা শুনিয়ে শুনিয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিয়েছিলে তাই না! মা গো আমার যে এসবের কিছুই মনে নেই। ও মা তুমি আমাকে আর একটা বার তোমার কোলে মাথা রাখতে দাও না গো। কোথায় তোমার কবর গো মা! এতো বড় মাঠের কোন অংশে নিরব হয়ে শুয়ে আছো তুমি মা! তোমার ছেলের আকুল কন্ঠের এই ডাক কি তুমি শুনতে পারছো না মা! ও মা….সাড়া দাও না গো মা….আমার বুকের ভিতরটা যে য*ন্ত্র*ণা*য় শেষ হয়ে যাচ্ছে…মা…মাগোওওওওওও….
ও আল্লাহহহহহহহ…আল্লাহ গোওওওও…কোথায় আমার নিষ্পাপ মায়ের কবর…আমার মা কোথায় ঘুমিয়ে আছে আপনি বলে দিন….ইয়া মাবুদ…!”

এই বলে কুশল কাদতে কাদতে হাটু গাঁ*ড়া অবস্থাতেই যতোটা সম্ভব নিজের চারপাশের মাটি আর ঘাস গুলো ছুঁয়ে দেখতে শুরু করে। তরু কুশলকে এভাবে য*ন্ত্র*ণা পেয়ে কান্না করতে দেখে নিজের চোখের পানি ধরে রাখতে পারে না। তরুরও যেনো বুক ভে*ঙে কান্না বেড়িয়ে আসতে শুরু হয়। ২০ বছর আগের দাফনকৃত কবরের চিহ্ন এখন খুঁজে পাওয়া একেবারেই অসম্ভব তরু তা বুঝতে পেরে কুশলের কাছে গিয়ে ওকে শান্ত করতে নিজের বুকের সাথে ওকে জড়িয়ে ধরে। কুশল হু হু করে কাঁদতে কাঁদতে তরুর বুকের ভিতরেই নিজেকে পুরোপুরি ভাবে গুটিয়ে নিতে চায় যেনো। তরু কুশলের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে ওকে শান্ত করার চেষ্টা করে। এভাবেই পেরিয়ে যায় আরো বেশকিছুসময়। হঠাৎ তরু ওর সামনের দিকে লক্ষ্য করে ওদের থেকে বেশ কিছুটা দূরে ২জন ৮-১০ বছর বয়সী বাচ্চা ছেলে-মেয়ে হেঁটে হেঁটে স্কুলের দিকে অগ্রসর হচ্ছে। বাচ্চা ছেলেটির হাতে একটা হারিকেন আর বাচ্চা মেয়েটির কাঁখে একটা মাঝারি সাইজের সিসার কলসী নেওয়া যার উপর চাঁদের আলো পড়ায় চকচক করছে। তরু গভীর ভাবে ওদের কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ করতে থাকে। বাচ্চা ছেলে-মেয়ে দু’জন স্কুলের বিল্ডিং এর পাশেই থাকা বট গাছটির সামনে এসে দাঁড়ায়। অতঃপর মেয়েটি নিজের কাঁখে থাকা কলসীর পানিগুলো বটগাছটির গোঁড়ায় ঢেলে দিতে শুরু করে। দেখতে দেখতে বাচ্চা মেয়েটি কলসীতে থাকা সবটুকু পানিই শুধু ঐ গাছের গোড়াতেই ঢেলে দেয়। এরপর ওরা আবারও ওদের পূর্বের রাস্তার দিকে অগ্রসর হতে শুরু করে। ওদের এমন কাজে তরু অনেক অবাক হয়। তরু মনে মনে চিন্তা করে…..

—“এই মাঠে এতোগুলো ফলের গাছ থাকতে ওরা শুধু ঐ বটগাছের গোড়াতেই সবটুকু পানি ঢেলে দিলো কেন?”

#চলবে ইনশাআল্লাহ………

#হৃদকোঠোরে_রেখেছি_তোমায়🖤(৫৪)
#Maisha_Jannat_Nura (লেখিকা)

(১২৮)
তরু কুশলকে শান্ত করতে বললো….
—“কুশল…আপনি শান্ত হোন। আর আপনার পিছনের দিকে ঘুরে দেখুন দু’জন ৮-১০ বছর বয়সী বাচ্চা ছেলে-মেয়ে হারিকেন আর কলসী হাতে নিয়ে হাঁটতে হাঁটতে স্কুল মাঠ থেকে বেড়োতে মূল দরজার দিকে অগ্রসর হচ্ছে। আমার মন কেনো জানি না বারংবার বলছে যে, এই মাঠের ঠিক কোন স্থানে আপনার মায়ের কবর আছে সেই সম্পর্কে ঐ বাচ্চা ছেলে-মেয়ে দু’জনের গার্জিয়ানরা অবগত হতে পারেন।”

তরুর মুখে এরূপ কথা শোনামাত্র কুশল তরুর থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে পিছন ঘুরতেই ঐ বাচ্চা ছেলে-মেয়ে দু’জনকে দেখতে পায়। পরক্ষণেই কুশল আর কোনোরূপ চিন্তা-ভাবনা না করেই ‘এই যে বাবুরা শুনছো! এদিকে একটু আসবে তোমরা?’ এই বাক্য উচ্চারণ করে গলা ছেড়ে ওদের ডাক দেয়। কুশলের ডাক বাচ্চা ছেলে-মেয়ে দু’জনের কান পর্যন্ত পৌঁছাতেই ওরা সেখানেই থেমে গিয়ে কুশল আর তরুর দিকে একপলক দেখে একে-অপরের দিকে তাকায়। তরু হাত উঠিয়ে ইশারায় ওদের নিজেদের কাছে আসার জন্য ডাকছে। বাচ্চা মেয়েটি বাচ্চা ছেলেটিকে উদ্দেশ্য করে বললো….

—“ভাইয়া…ওনারা আমাদের ডাকছেন কেনো?”

বাচ্চা ছেলেটি তার বোনকে অভয় দিয়ে বললো….
—“চল তো গিয়ে দেখি কি বলেন।”

মেয়েটি ভীত স্বরে বললো….
—“না..না..আমি যাবো না। ওনারা যদি আমাকে আর তোমাকে বাবার মতো ধরে মা*রে*ন!”

ছেলেটি বললো….
—“ঝর্ণা…এভাবে বলতে হয় না বোন। হাজার হলেও উনি আমাদের বাবা হন।”

—“উনি যদি আমাদের বাবাই হতেন তাহলে মিঠুর বাবার মতো উনিও আমাদের নিজের কোলে বসিয়ে আদর করতেন। সবসময় চোখ রা*ঙি*য়ে কথা বলতেন না। আর কারণে-অকারণে আমাকে আর তোমাকে মা*র*তে*ন না। উনি অনেক পঁ*চা ভাইয়া। উনি আমাদের বাবা হতেই পারেন না।”

ছেলেটি রাগী স্বরে বললো…
—“চুপ করবি তুই! সবসময় বেশি বকবক করিস। মুখ দিয়ে কোনো শব্দ বের হতে শুরু করলে রেলগাড়ীর মতো তা চলতেই থাকে যেনো সঠিক সময়ে থামার কোনো নাম গন্ধ থাকে না।”

বড় ভাইয়ের রাগী স্বরে বলা কথাগুলো শুনে বাচ্চা মেয়ে ঝর্ণার মুখ ভার হয়ে যায়। ছেলেটি আবারও বললো….

—“এখন কি এভাবেই মুখ ভা*র করে দাঁড়িয়ে থাকবি নাকি আমার সাথে ওনাদের কাছে যাবি ওনারা কি বলেন তা শুনতে!”

ঝর্ণা মুখ ভার করা অবস্থাতেই মিনমিনিয়ে বললো…
—“হুম চলো!”

এই বলে ওরা দু’জন কুশল আর তরুর দিকে অগ্রসর হতে শুরু করে। কিছুসময় পর ওরা দু’জন কুশল আর তরুর সামনে এসে দাঁড়াতেই ঝর্ণা ওর ভাইয়ের পিছনে আড়াল হয়ে দাঁড়ায় আর ঘাড় বাঁকিয়ে ওদের দিকে লক্ষ্য করে। ছেলেটি কুশল আর তরুকে উদ্দেশ্য করে বললো….

—“কে আপনারা? আগে কখনও এই এলাকার আশেপাশেও দেখেছি বলে তো মনে হচ্ছে না।”

বয়সের তুলনায় ছেলেটির কথার ধরণ অনেক বেশিই গোছালো দেখে তরু কিছুটা অবাক হয়ে বললো…

—“আমরা এইখানে আজই ১ম এসেছি। তোমাদের একটা প্রশ্ন করতে পারি!”

ছেলেটি তাড়া দিয়ে বললো…
—“তাড়াতাড়ি করুন। বাড়িতে আমাদের অসুস্থ দাদু আছেন। আর মায়েরও ঘুম ভে*ঙে যেতে পারে যখন-তখন। একটু পর বাবাও বাড়িতে ফিরবেন। আমাদের বাড়িতে দেখতে না পেলে আমাকে আর বোনকে মা*র*তে মা*র*তে আমাদের দুজনেরই পিঠের ছা*ল তুলে ফেলবেন।”

ছেলেটির এমন কথা শুনে কুশল আর তরু দু’জনেই অনেক বেশিই অবাক হয়ে যায়। সেইসময় তরু লক্ষ্য করে ছেলেটির পিছন থেকে ঝর্ণা একটু পর পর তরুর দিকে তাকাচ্ছে। চাঁদের আলোয় বাচ্চা মেয়েটির ফর্সা মুখশ্রী চকচক করছে। এতো মিষ্টি একটা বাচ্চা মেয়েকে কেও কি করে মা*র*তে পারে! তরু সেসব চিন্তা মাথার আরেক পার্শে রেখে বললো….

—“এতো রাতে তোমরা দু’জন এই ফাঁকা মাঠে এসেছো কেনো? আর ঐ বটগাছের গোড়ায় বা পানি দিলে কেনো? মাঠজুড়ে তো ফল-মূলের গাছের অভাব নেই। তোমাদের তো উচিত ছিলো সেইসব গাছগুলোর গোড়ায় পানি দেওয়া।”

ছেলেটি বললো….
—“বোঝার বয়স হয়েছে পর থেকেই আমাদের দাদুভাইকে দেখে এসেছি তিনি প্রতিদিন নিয়ম করে ঐ বটগাছের গোড়ায় এক কলসী করে দিতেন। কেনো দিতেন তা আমি জানি না। কিছুদিন ধরে আমাদের দাদুভাই অ*সুস্থ হয়ে পড়েছেন। এর পর থেকে মায়ের চোখ ফাঁ*কি দিয়ে দাদুর কথানুযায়ী আমি আর বোন প্রতিদিন সময় করে এই স্কুল মাঠে আসি আর ঐ বটগাছের গোড়ায় এক কলসী করে পানি ঢেলে দিয়ে যাই।”

ছেলেটির এরূপ কথা শুনে কুশল আর তরু একে-অপরের দিকে তাকায়। কুশল কিছু বলতে নিবে সেইসময় ওদের সামনে থেকে একজন মধ্যবয়সের পুরুষালী কন্ঠস্বর ভেসে আসে…..

—“ঝর্ণাআআআ….রাসেললল….এই ব*দ*মা*শ পোলা-মাইয়া….এতো রাইতে এইনে কি করতে আইছোস তোরা? এতো অল্প বয়সেই আমাগো পরিবারের মুখ পু*ড়া*ই*তে উইঠা পইড়া লাগছোস তোরা তাই না! মাইয়া মানুষ হইয়া তোর এই রাইতের বেলা ঘরের বাহিরে ঘোরাঘুরি করা আইজ বাইর কইরা ছাড়মু আমি। আজ যদি তোদের দুইটার পিঠের ছাল আমি তুইলা না ফেলছি তয় আমার নাম ও মফিজুর নয়।”

পুরুষালী কন্ঠে বলা এরূপ কথাগুলো শোনামাত্র ঝর্ণার শরীর ভ*য়ে শিউরে উঠে। তৎক্ষনাৎ সে কোনো কিছু না ভেবেই নিজের ভাইয়ের পিছন থেকে সরে তরুর পিছনে গিয়ে লুকিয়ে পরে। কুশল, তরু আর ছেলেটি মফিজুরের দিকে লক্ষ্য করতেই দেখে মফিজুর একহাতে নিজের লুঙ্গি আঁটো করে ধরে বড় বড় কদম ফেলে ওদের দিকেই অগ্রসর হচ্ছে। ছেলেটি কুশল আর তরুর দিকে তাকিয়ে ভী*ত কন্ঠে বললো….

—“আপনাদের জন্য আজ আবারও আমাদের বাবার হাতে মা*র খেতে হবে। আপনারা যদি আমাদের না ডাকতেন তাহলে বাবা বাড়িতে ফেরার আগেই আমরা বাড়িতে চলে যেতে পারতাম।”

ছেলেটির কথাগুলো শুনে কুশলের চোয়াল শক্ত হয়ে আসে। মুফিজুর ওদের কাছে এসে দাঁড়িয়ে ছেলেটির হাত শক্ত করে ধরে রাগী স্বরে বললো….

—“কোথায় লুকাইলো রে ঐ ব*দ*মা*ই*শ মাইয়াটা! আজ ওর একদিন কি আমার যতোদিন লাগে। বড্ড বার বাইরা গ….।”

মফিজুরের রাগী স্বরে বলা কথাগুলো বলতে নিয়ে নিজের সামনে তরু আর কুশলকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বেশ অবাক হয়। তরুর পিছনে দাঁড়িয়ে ঝর্ণা মফিজুরের বলা কথাগুলো শুনে ভ*য়ে তরুর শাড়ির পিছনের অংশ খাঁ*ম*ছে ধরে রেখেছে। তরু তা অনুভব করতে পারছে। মুফিজুর তরু আর কুশলের দিকে তাকিয়ে ভ্রু কুঁচকে বললো…

—“আপনেরা কেডা? এই গাঁয়ে এর আগে তো কখনও দেখি নাই। পোশাক-আশাক দেইখা তো শহরের ম্যম-বাবুগো মতোন লাগতাছে। ইস্কুলের বাইরে দেখলাম বিশাল একখান চার চাকার গাড়িও দাঁড় করানো। ঐ গাড়িখানা কি আপনাগো?”

তরু বললো….
—“আমরা শহর থেকে এসেছি। আর ঐ গাড়িটা আমাদেরই।”

—“এইহানে এতো রাইতে কি মনে কইরা আইছেন আপনেরা?”

তরু বললো….
—“কেনো এসেছি সেসব তো পরেও জানতে পারবেন। কিন্তু এখন একটা কথা বলুন তো। ঝর্ণা আর রাসেলের মতো ওমন ফুটফুটে মিষ্টি বাচ্চা ছেলে-মেয়ে দু’জনকে আপনি মা*র*তে চাইছিলেন কেনো? কি দো*ষ করেছে ওরা!”

তরুর এমন প্রশ্নে মফিজুর ওর কন্ঠে পুরুষালী একটা বিশেষ ভাব এনে বললো….

—“হেইয়ার কইফিয়াত আমি আপনেরে দিতাম কিল্লাই? আমার পোলা-মাইয়া আমি হেগোরে জন্ম দিয়া এই দুনিয়াত আনছি, তিন বেলা খাওয়াইতাছি, পড়াইতাছি হেগোরে আমি মা*র*মু নাকি কা*ই*টা ফা*লা ফা*লা করমু সম্পূর্ণ আমার ব্যপার।”

মফিজুরের এমন কথা শুনে কুশল নিরব থেকে ওর দু’হাত মুষ্টিবদ্ধ করে ফেলে। সেইসময় মফিজুরের পাশ থেকে ছেলেটি বলে উঠলো…

—“বাবা আপনে তো ভু*ল বললেন! আপনে তো আমাদের তিনবেলা খাইতে দেন না। সকালে দু’জনকে দুইখান বাসি রুটি থাকলে তা দেন আর রাইতে আপনার আর মায়ের সারাদিনের খাওনের পর বাইছা যাওয়া সাদা ভাত যাতে মা পানি ঢাইলা দিয়া রাখে ঐ ভাতগুলো খাইতে দেন। আমরা তো ওমন খাবার ঠিকভাবে খাইতেও….!”

ছেলেটি ওর পুরো কথা শেষ করার আগেই মফিজুর ওর গালে একটা থা*প্প*ড় দিয়ে বসলেন। থা*প্প*ড়ের বে*গ এতোটাই বেশি ছিলো যে ছেলেটি ছি*ট*কে ওদের থেকে কিছুটা দূরে মাঠের উপর গিয়ে পরে। মফিজুরের এমন কাজে কুশলের রাগে যেনো সর্বশরীর জ্ব*লে উঠে। সে আর নিরব হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে পারে না। কুশল মফিজুরের কাছে এসে দাড়িয়ে ওর শার্টের কলার্ট ধরে স্বজোরে ওর বাম গালে পরপর ৪বার থা*প্প*ড় দেয়। আকস্মিক কুশলের এমন কাজে তরুর পিছনের দাঁড়িয়ে থাকা ঝর্ণা ও মাঠে পরে থাকা রাসেল অনেক অবাক হয়ে যায়। তরুর ঠোঁটে কোনে স্মিত হাসির রেখা ফুটে উঠে। কুশল মুফিজুরের কলার্ট ছেড়ে দিয়ে ওর নাক বরাবর একটা ঘু*ষি প্রয়োগ করে। সঙ্গে সঙ্গে মফিজুর মাঠের উপর লুটিয়ে পরে। কুশল রাগ নিয়ে উচ্চস্বরে বললো…

—“জন্ম দিয়েছিস মানে এই নয় এই নিষ্পাপ শিশুগুলোর শরীরে আ*ঘা*ত করার অধিকার তোর আছে। আর একবার যদি তোর ঐ হাত এই নিষ্পাপ শিশুদের উপর উঠিয়েছিস তৎক্ষণাৎ তোর হাতজোড়া কে*টে তোকে এই মাঠের ১০০ ফিট নিচে পুঁ*তে ফেলবো আমি।”

এই বলে কুশল রাসেলের কাছে গিয়ে ওকে ধরে উঠায়। মফিজুর দুই হাতে ভর দিয়ে উঠে বসে নিজের নাকের নিচে হাত রাখতেই দেখে নাক ফে*টে র*ক্ত বের হচ্ছে। ঠোঁটের কোণা কে*টে ও র*ক্ত ঝড়ছে।

#চলবে ইনশাআল্লাহ…….