#হৃদকোঠোরে_রেখেছি_তোমায়🖤(৬৭)
#Maisha_Jannat_Nura (লেখিকা)
(১৫৪)
কুশল আর তরুনিমা অরুর রুমের বিছানায় পাশাপাশি বসে আছে। সেইসময় কুশলের ফোন বেজে উঠায় দু’জনের ধ্য*ন ভা*ঙে। কুশল বিছানা থেকে নেমে প্যন্টের পকেট থেকে ফোন বের করতেই দেখে তাহির নাম্বার থেকে কল এসেছে। তরুনিমা উৎসুক নয়নে কুশলের দিকে তাকিয়ে আছে। কুশল কল রিসিভ করতেই ফোনের ওপাশ থেকে তাহির শান্ত স্বরে বললো…
—“বাবা-মা রাজি হয়ে গিয়েছে ভাই।”
এমন একটা মূহূর্তে তাহিরের মুখে এরূপ খুশির সংবাদ শুনে কুশলের ঠোঁটে হালকা হাসির রেখা ফুটে উঠে। কুশল শান্ত স্বরে বললো….
—“আমাদের আর সময় ন*ষ্ট করলে চলবে না তাহির। তুমি আঙ্কেল-আন্টিকে নিয়ে আগামীকাল বিকালেই আমাদের বাসায় চলে এসো। আর আমি নিলাদ্রের ঠিকানা তোমাকে মেসেজ করে বলে দিচ্ছি। আসার পথে ওকেও পিক করে নিও।”
—“ঠিক আছে।”
এরপর তাহির কল কেটে দেয়। কুশল তরুনিমাকে নিজের দিকে উৎসুক নয়নে তাকিয়ে থাকতে দেখে ওর সামনে গিয়ে দাড়িয়ে ওর ডান কাঁধে এক হাত রেখে শান্ত স্বরে বললো….
—“তরুনিমা….মন খারাপ করে বসে থাকো না। আমাদের আগামীকাল সকালের ভিতরেই বাসায় ফিরতে হবে। যতো তাড়াতাড়ি সম্ভব সন্ধ্যা আর নিলাদ্রের বিয়ের দিন তারিখ চূড়ান্ত করতে হবে। আর ওদের বিয়ের দিন থেকেই শুরু হবে প্র*তি*শো*ধে*র এক র*ক্ত*ক্ষ*য়ী খেলা।”
তরুনিমা কুশলের হাতটি নিজের কাঁধের উপর থেকে সরিয়ে নিজের গালের উপর রেখে মাথা নাড়িয়ে ‘হ্যা’ সূচক সম্মতি জানালো।
(১৫৫)
কুশলের সাথে কথা বলা শেষ করে তাহির বিছানায় বসে ছিলো। সেইসময় হুমায়রা তাহিরের রুমে প্রবেশ করে ওর সামনে এসে বুকের উপর দু’হাত ভাঁ*জ করে দাঁড়িয়ে তাহিরের উপর নিজের তীক্ষ্ণ দৃষ্টি স্থির করে। তাহির হুমায়রার দিকে তাকিয়ে শান্ত স্বরে বললো….
—“কিছু কি বলবি?”
—“এতো সহজেই আমাকে বিয়ে করার জন্য রাজি হয়ে গেলে বিষয়টা কেনো যেনো হজম করতে ক*ষ্ট হচ্ছে আমার।”
—“আসলে কি বল তো..তোর প্রতি আমার একটু দয়া কাজ করলো।”
হুমায়রা ভ্রু কুঁচকে বললো….
—“দয়া মানে!”
—“এই যে আমাকে নিজের করে পাওয়ার জন্য সেই সুদূর কানাডা থেকে বাংলাদেশে আসলি। আসার পর থেকে সুপার গ্লুর মতো আমার সাথে সারাক্ষণ চি*প*কে থাকছিস। আমি অসুস্থ হয়ে খুব যত্নসহকারে আমার সেবাযত্ন করছিস। আমার বাবা-মায়ের স্বাস্থ্যের কথা চিন্তা করে তাদের থেকে আমার অসুস্থতার কথা লুকিয়ে মি*থ্যে বলেছিলি। তোর এসব কাজ দেখে আমার তোর প্রতি ভিষণ দয়া কাজ করলো। তাই মা যখন বললো তোর সাথে আমার বিয়ে দেওয়ার খুব ইচ্ছে তখন তার কথা আর ফেললাম না।”
তাহিরের কথাগুলো শুনে হুমায়রার হাস্যোজ্জ্বল মুখশ্রীতে মলিনতার কালো মেঘ ছেয়ে গেলো। কিছুসময় নিরব থাকার পর হুমায়রা জিহ্বার অগ্রভাগ দিয়ে আলতো ভাবে ওর শুকিয়ে আসা ঠোঁটদ্বয় ভিজিয়ে নিয়ে জোরপূর্বক ঠোঁটের কোণে হাসির রেখা ফুটিয়ে তুলে বললো….
—“ওহহ আচ্ছা। তুমি তাহলে শুধুমাত্র খালার মন রাখতে আমাকে বিয়ে করার জন্য রাজি হয়ে আমার প্রতি দয়া দেখালে! আমিও কতো বোকা জানো! কিছুসময়ের জন্য ভেবেছিলাম তুমি হয়তো আমার ভালোবাসা, অনুভূতিগুলো উপলব্ধি করতে পেরেছো তাই বিয়ের জন্য সম্মতি জানিয়েছো। যাই হোক এখন বিষয়টা ক্লিয়ার করে দিলে দেখে ভালো লাগছে।”
তাহির স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বললো….
—“তো তুই কি এখন চিন্তা করছিস যে আমাকে আর বিয়ে করবি না!”
—“না..আমি এমনটা চিন্তা করছি না। এই বিয়ে অবশ্যই হবে। হয়তো তুমি এখন আমার ভালোবাসা উপলব্ধি করতে পারছো না তবে আমি জানি একদিন এমন পরিস্থিতি আসবে যখন তুমি চিৎকার করে বলবে যে তুমি আমাকে ভালোবাসো। তখন হয়তো আমি তোমার ভালোবাসা উপলব্ধি করার মতো অবস্থায় থাকবো না।”
এই বলে হুমায়রা তাহিরকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে এক ছুটে ওর রুম থেকে বেরিয়ে যায়। তাহিরের রুম থেকে বের হতেই হুমায়রা চোখের বাঁধ ভে*ঙে অঝোরে নোনাজল ঝরতে শুরু করে। হুমায়রার বলা শেষ কথাগুলো কেনো যেনো তাহিরকে স্তব্ধ করে দিয়েছে।
(১৫৬)
কুশল আর তরুনিমা অরুর রুম থেকে বের হয়ে সিঁড়ি বেয়ে নিচে আসতে আসতে লক্ষ্য করে ড্রয়িংরুমে সোফায় তরুনিমার বাবা-মা, সন্ধ্যা আর নিলাদ্র বসে আছে। কুশল-তরু ড্রয়িংরুমে এসে দাঁড়ায়। কুশল শান্ত স্বরে নিলাদ্রকে উদ্দেশ্য করে বললো….
—“আরে তুমি কখন আসলে!”
—“এই তো একটু আগে। সন্ধ্যা তো বলেছিলো তোমরা এখানে আসার পথে আমাকে পিক করবে। তাই আমি অপেক্ষা করছিলাম। দেখলাম তোমার আসলে না তখন সন্ধ্যার সাথে কথা বলে জানতে পারলাম তোমরা অলরেডি চলে এসেছো। তাই ওর থেকে ঠিকানা নিয়ে আমি নিজ থেকেই চলে আসলাম।”
তরুনিমা প্রতিত্তোরে বললো….
—“আসলে ভাইয়া আপনাকে পিক করার কথা আমি সন্ধ্যাকে তো বলেছিলাম ঠিকই কিন্তু তাড়াহুড়োর বশে ওনাকে বলার কথা স্মরণ ছিলো না।”
—“আচ্ছা ঠিক আছে ভাবী, সমস্যা নেই।”
এরপর কুশল-তরুনিমা সোফায় বসে ওদের সবার সাথে আড্ডায় অংশগ্রহণ করে। কিছুসময় পর তরুনিমা ওর মা তমালিকাকে বললো….
—“মা…তুমি তো বলছিলে অনাথ আশ্রমের বাচ্চাদের মাঝে শীতবস্ত্র বিতরন করবে। কিন্তু আগামীকাল সকালেই আমাদের বাড়িতে ফিরতে হবে। বিকেলবেলা সৌহার্দ্য ভাইয়া স্বপরিবারে আমাদের বাড়িতে আসবেন সন্ধ্যাকে দেখে বিয়ের দিন-তারিখ চূড়ান্ত করতে। বাড়িতে তো অনেক কাজ ও আছে। তাই বলছিলাম কি ওদের বিবাহকার্য সম্পন্ন হলে পর আরেকদিন এসে অনাথ আশ্রমের বাচ্চাদের মাঝে শীতবস্ত্র বিতরণ করবো কি বলো!”
তমালিকা হাসিমুখে বললেন…
—“আচ্ছা ঠিক আছে রে মা, তুই যেমনটা বলবি তেমনটাই হবে।”
এরপর আরো বেশ কিছুসময় আড্ডা দেওয়ার পর সৌহার্দ্য বললো….
—“তোমাদের সবার সাথে এতোটা সময় ধরে আড্ডা দিয়ে অনেক ভালো লাগলো। কিন্তু এখন আমায় উঠতে হবে বুঝলে!”
তমালিকা বললেন…..
—“সে কি বাবা..এই প্রথম তুমি আমাদের বাসায় আসলে শুধু নাস্তা করে কি করে যেতে দেই বলো! রাতের খাবার খেয়ে তারপর না হয় চলে যেতে!”
—“না আন্টি, এতোটুকু সময়েই যে আদরযত্ন করলেন এতেই আমি অনেক খুশি। এখন আমাকে এখান থেকে সরাসরি ক্লিনিকে যেতে হবে। সেখানে কিছু গুরুত্বপূর্ণ কাজ আছে তো। তাই বিয়ের পর সন্ধ্যার সাথে আরেকদিন আপনাদের বাসায় ঘুরতে আসবো। তখন কবজি ডুবিয়ে ভুঁড়ি ভোজ করা যাবে কেমন!”
—“ঠিক আছে বাবা।”
কুশল বললো….
—“চলো..আমি তোমায় গাড়ি পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে আসছি।”
—“আচ্ছা ভাইয়া চলুন।”
অতঃপর কুশল আর সৌহার্দ্য দু’জনেই সোফা ছেড়ে উঠে মূল দরজার দিকে অগ্রসর হতে শুরু করে। সিদকার ভিলার মূল দরজা পেড়িয়ে বাহিরে আসতেই কুশল সৌহার্দ্যের পিঠে বেশ জোড়ে একটা চা*প*ড় দিয়ে বললো….
—“নতুন পরিচয় পেয়ে দেখছি তোর কিছুটা হলেও উন্নতি হয়েছে।”
—“কোন দিক থেকে উন্নতি হলো আমার আবার!”
—“এই যে আমাকে এই প্রথম ভাইয়া বলে সম্বোধন করলি।”
—“তা তো করতেই হবে। যেহেতু তুই আমার হবু বউয়ের বড় ভাই হোস তাই এতোটুকু সম্মান পাওয়া তোর প্রাপ্য। কিন্তু যাই বলিস না কেনো সবার সামনে তোকে তুমি সম্বোধন করে কথা বলার বিষয়টা আমার কাছে ভিষণ কঠিন লেগেছে।”
সৌহার্দ্যের এরূপ কথাগুলো শুনে কুশল শব্দ করে হেসে উঠে। এরপর ওরা পার্কিং সাইডে চলে আসে। সৌহার্দ্য ওর গাড়িতে উঠে হাসিমুখে কুশলকে বিদায় জানিয়ে গাড়ি স্টার্ট করে। সৌহার্দ্য গাড়ি নিয়ে চোখের আড়াল হতেই কুশলও বাড়ির ভিতরে যাওয়ার পথে অগ্রসর হয়।
.
.
.
.
পরেরদিন সকালবেলা…….
কুশল, সন্ধ্যা আর তরুনিমা সিকদার ভিলা থেকে বেড়িয়ে পড়েছে চৌধুরী মেনশনে যাওয়ার উদ্দেশ্যে। বেশ লম্বা সময় ধরে জার্নি করার পর ওরা চৌধুরী মেনশনে এসে পৌঁছায়। সন্ধ্যা আর তরুনিমা গাড়ি থেকে নেমে বাড়ির ভিতরে যাওয়ার উদ্দেশ্যে হাঁটা ধরে। কুশল গাড়ি পার্কিং সাইডে রাখতে চলে যায়। সন্ধ্যা আর তরুনিমা বাড়ির ভিতরে প্রবেশ করতেই দেখে বাড়ির বাকি সদস্যরা ড্রয়িংরুমে সোফায় বসে গল্প করছে। ওদের সবাই নিজের চোখের সামনে হাসি-খুশি ভাবে গল্প করতে দেখে সন্ধ্যার ভিতরে প্র*তি*শো*ধে*র আ*গু*ন দা*উ-দা*উ করে জ্ব*ল*তে শুরু করে। সন্ধ্যা ধীরস্বরে বললো….
—“ইচ্ছে করছে এক্ষুণি এদের সবার শরীরে পে*ট্রো*ল ঢেলে আ*গু*ন জ্বা*লি*য়ে দেই। জ্ব*লে-পু*ড়ে ছাই হয়ে যায় যেনো সবগুলো।”
তরুনিমা শান্ত স্বরে বললো….
—“নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করো সন্ধ্যা। এতো সহজ পদ্ধতি অবলম্বন করে এদের মা*র*লে চলবে না। এদের পা*প কর্মের জন্য খুবই নি*র্ম*ম ও য*ন্ত্র*ণা-দা*য়*ক মৃ*ত্যু পাবে এরা।”
—“তাই যেনো হয় ভাবী, তাই যেনো হয়।”
অতঃপর তরুনিমা আর সন্ধ্যা নিজেদের মুখশ্রীতে জোরপূর্বক হাসির রেখা ফুটিয়ে ওদের সবার সাথে কুশলবিনিয়ম করে নিজ নিজ রুমে চলে যায়।
.
.
.
.
বিকেলবেলা…….
ড্রয়িংরুমে একপার্শে সোফায় তাহির, হুমায়রা, সৌহার্দ্য ও তাহিরের বাবা-মা বসে আছে। অন্যপাশে সোফায় চৌধুরী পরিবারের সদস্যরা সবাই বসে আছে। সেইসময় সায়মন শান্তস্বরে তাহিরের বাবা তমিজ তালুকদারকে উদ্দেশ্য করে বললেন….
—“আমি তো এটা ভেবে চিন্তায় পড়ে গিয়েছিলাম যে কার না কার সাথে কুশল আমার মেয়ের বিয়ে চূড়ান্ত করেছে তার পরিবারের সাথে আমাদের পরিবারের স্ট্যাটাস যাবে কিনা! এখন আপনার ছেলের সাথে সন্ধ্যার বিয়ের কথা চূড়ান্ত করেছে দেখে ভিষণ ভালো লাগছে। আমাদের পরিবারের স্ট্যাটাস আর আপনার পরিবারের স্ট্যাটাস একই। আসলে স্ট্যাটাস সমান না হলে সম্পর্কের বন্ধনও মজবুত হয় না বলেই আমি মনে করি।”
সায়মনের এরূপ কথাগুলো শুনে তমিজ ও রেবেকা তালুকদার সহ কুশল, সৌহার্দ্য, তাহির, হুমায়রা এরা সকলেই যে ভিষণ অ*স*ন্তু*ষ্ট হয়েছেন তার ছাপ এদের সকলের চেহারাতেই হালকা ভাবে ফুটে উঠেছে। তবুও ওরা সকলেই ওদের সামনেই স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করে। রেবেকা এই বিষয়টাকে এখানেই শেষ করতে হাসিমুখে বললেন….
—“এবার আমার ছোট বউমার চাঁদপানা মুখশ্রী দেখার সৌভাগ্যের ব্যবস্থা করুন মিসেস.চৌধুরী।”
সাবরিনা হাসিমুখে বললেন….
—“হুম…আমি এক্ষুণি সন্ধ্যাকে নিয়ে আসার ব্যবস্থা করছি।”
এই বলে সাবরিনা বসাবস্থা থেকে উঠে দাঁড়াতেই দেখলেন তরুনিমা সন্ধ্যাকে নিয়ে এদিকে আসছে। ওদের দেখামাত্র সাবরিনা আবারও আগের স্থানে বসতে বসতে বললেন…..
—“ঐ তো মেজো বউমা সন্ধ্যাকে নিয়ে আসছে।”
সাবরিনার কথা শোনামাত্র উপস্থিত সবাই সেদিকে লক্ষ্য করে। লাল পাড়ের গাড় সবুজ রংয়ের একটা শাড়ি বাঙালিআনা পদ্ধতিতে পড়ে মাথায় ঘোমটা টেনে রেখেছে সন্ধ্যা। এছাড়াও লাল-সবুজের সংমিশ্রনে দুইহাত ভর্তি কাঁচের চুড়ি ও পড়ে আছে সে। সন্ধ্যার এই বাঙালি বউয়ের মতো সাজ দেখে সৌহার্দ্যের দৃষ্টি সন্ধ্যার উপর পুরোপুরি ভাবে স্থির হয়ে যায় যেনো। তরুনিমা সন্ধ্যাকে নিয়ে একেবারে সৌহার্দ্যের সামনা-সামনি সোফায় বসিয়ে দিয়ে ওর পাশে নিজেও বসে পড়ে। রেবেকা শান্ত স্বরে বললেন….
—“দেখি মা…মুখখানা তুলো!”
সন্ধ্যা ঠোঁটের লজ্জামাখানো হাসির রেখা ফুটিয়ে তুলে মুখ তুলে তাকায়। রেবেকা হাসিমুখে বললেন…..
—“মাশাআল্লাহ…মাশাআল্লাহ। কারোর নজর না লাগুক।”
সৌহার্দ্যের ঠোঁটের কোণেও হাসি লেগে আছে। রেবেকা নিজের হাতে থাকা স্বর্নের বেশ মোটা একজোড়া বালা খুলে বসাবস্থা থেকে উঠে সন্ধ্যার সামনে দাঁড়িয়ে খুব যত্নসহকারে ওর হাতে পড়িয়ে দিয়ে ওর থুতনি স্পর্শ করে নিজের ঠোঁটে সেই আঙুল ছুঁইয়ে হাসিমুখে বললেন…
—“মেয়ে আমাদের ভিষণ পছন্দ হয়েছে। আমরা চাই যতো তাড়াতাড়ি সম্ভব মেয়েকে আমার ছোট ছেলের বউ বানিয়ে নিয়ে যেতে।”
রেবেকার এতো নিখুঁত অভিনয় দেখে তাহির আর হুমায়রা কিছুটা অবাক হয় বটে। ওদের মনে হয় সৌহার্দ্য হয়তো সত্যিই ওদের পরিবারের সদস্য। রেবেকা সত্যিই সৌহার্দ্যকে নিজের ছোট সন্তান বলে মেনে নিয়েছেন। এরপর ওরা আরো কিছুসময় কথাবার্তা বলে ৬দিন পর যে শুক্রবার পড়ছে সেদিনই সৌহার্দ্য আর সন্ধ্যার বিবাহকার্য সম্পন্ন করবেন বলে চূড়ান্ত করেন।
#চলবে ইনশাআল্লাহ…………
#হৃদকোঠোরে_রেখেছি_তোমায়🖤(৬৮)
#Maisha_Jannat_Nura (লেখিকা)
(১৫৭)
নিজের রুমে বিছানায় তরুনিমার সাথে বসেছিলো সন্ধ্যা। সেইসময় কামিনী সন্ধ্যার রুমে প্রবেশ করে বিনুনি নাড়াতে নাড়াতে বললো….
—“কি নিয়ে কথা বলছো তোমরা!”
তরুনিমা জোরপূর্বক হাসি দিয়ে বললো….
—“৬দিন পরেই তো সন্ধ্যার বিয়ে। হাতে তো আমার সময় খুবই কম। তাই ওর জুয়েলারী, মেকআপ আইটেম আর লেহেঙ্গা-শাড়িগুলো কোথায় থেকে কিনলে ভালো হবে সেসব নিয়েই কথা বলছিলাম আমরা চাচী।”
—“ওহহ আচ্ছা। যাই হোক যেটা বলার জন্য এসেছিলাম সেটা বলি। তোমরা যেহেতু বিয়ের কেনাকাটার বিষয় নিয়েই আলোচনা করছো তাই আমার জন্য কসমেটিকস থেকে শুরু করে জুয়েলারি, শাড়ি এগুলোর জন্য সবথেকে বেস্ট যেগুলো সেগুলো সিলেক্ট করার দায়িত্বও আমি তোমাদের দিচ্ছি। আমার একমাত্র ভাতিজির বিয়ে বলে কথা। তাই বিয়েতে উপস্থিত সবার মধ্যে আমাকেই সবথেকে সুন্দর লাগতে হবে। যথাসময়ে আমার জিনিসগুলো যেনো আমি পেয়ে যাই।”
—“ঠিক আছে চাচী। আপনি নিশ্চিন্ত থাকতে পারেন। সবথেকে বেস্ট জিনিসগুলো আমরা আপনাকেই দিবো।”
কামিনী ভেংচি কেটে বিনুনী নাড়াতে নাড়াতে বললো….
—“ঠিক আছে…ঠিক আছে…এসব পরেই দেখা যাবে।”
এই বলে কামিনী সন্ধ্যার রুম থেকে বেড়িয়ে যায়। সন্ধ্যা কিছুটা বিরক্তি নিয়ে বললো….
—“ভাবী তুমি ঐ শ*য়/তা*ন মহিলার জন্য কেনা-কাটা করার দায়িত্ব কেনো নিলে? উনি কি আমাদের নিজের কাজের লোক মনে করেছেন নাকি!”
—“সন্ধ্যা কি করছো! আস্তে কথা বলো।”
সন্ধ্যা নিজের রাগ-বিরক্তকি নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করে ধীরস্বরে বললো…..
—“আমার এদের কাওকে সহ্য হচ্ছে না বিশ্বাস করো ভাবী।”
—“হুম বুঝতে পারছি।
এই বলে তরুনিমা বিছানা থেকে নেমে দরজার কাছে গিয়ে উঁকি মেরে চারপাশ ভালোভাবে দেখে রুমের দরজাটা ভিতর থেকে আটকে দিয়ে আবারও সন্ধ্যার পাশে গিয়ে বসে বললো….
—“কামিনী চাচীর কোন আচারণটা তোমার সবথেকে বিরক্ত লাগে?”
—“উনি পুরো মহিলাটাই আমার কাছে বিরক্তির কারণ। আলাদা করে কি বলবো!”
—“আচ্ছা আমি একটা উদাহরণ দেই, এইযে উনি সবসময় বিনুনী নাড়াতে নাড়াতে প্রতিটি কথা বলেন আমার ইচ্ছে করে ওনার বিনুনীটা ধরে গো*ড়া থেকে একদম খাঁ*চ করে কে*টে দেই বা এমন কিছু করি যেনো ওনার মাথার সব চুল পড়ে যায় উনি পুরোপুরি ভাবে টা*ক*লু কাকুদের মতো দেখতে হয়ে যান।”
তরুনিমার এমন কথা শুনে না চাইতেও সন্ধ্যা শব্দ করে হাসতে শুরু করে। সন্ধ্যাকে হাসতে দেখে তরুর ঠোটেও হাসির রেখা ফুটে উঠে। কিছুসময় পর সন্ধ্যা হাসি থামিয়ে ভাবুক স্বরে বললেন….
—“ওনার নিজের সৌন্দর্য নিয়ে অধিক বরাই করার বিষয়টা আমার ভিষণ বিরক্ত লাগে ভাবী।”
তরুনিমা কিছুসময় ভাবার পর বললো…
—“এখন তুমি আমাকে আরেকটা প্রশ্নের উত্তর দাও তো।”
—“কি প্রশ্ন!”
—“শিকার যদি স্বইচ্ছায় শিকারীর পাঁ*তা*নো ফাঁ*দে পা দিতে চায় তখন শিকারীর কি করা উচিত?”
—“নিশ্চিন্ত মনে শিকার করা উচিত।”
তরু হাসিমুখে বললো…..
—“হুম, এখন থেকে আর মাথা ঠান্ডা রাখার চেষ্টা করো এটা ভেবে যে শ*ত্রু*পক্ষ আমাদের প্র*তি*শো*ধ নেওয়ার রাস্তা নিজ হাতে খুলে দিয়েছেন।”
সন্ধ্যা তরুর কথার ভাঁজ বুঝতে না পেরে বললো….
—“মানে তুমি কি বলতে চাইছো ভাবী! তোমার সব কথা আমার মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে।”
—“নিলাদ্র ভাইয়াকে কল করো।”
—“এখন! কিন্তু কেনো?”
—“আহা…বাড়তি প্রশ্ন না করে যেটা করতে বলছি সেটা করো। তারপর সব বুঝতে পারবে।”
সন্ধ্যাও আর কথা না বাড়িয়ে নিলাদ্রকে কল করে। তরুনিমা বললো….
—“ইয়ারফোন লাগাও।”
সন্ধ্যা বালিশের পাশ থেকে ইয়ারফোনটা নিয়ে ফোনে সেট করে। এরপর ওরা দু’জনে দু’টো লাইন নিজেদের কানে লাগায়। নিলাদ্র কল রিসিভ করতেই তরুনিমা ইয়ারফোনের স্পিকারটা মুখের কাছে নিয়ে বললো….
—“নিলাদ্র ভাইয়া…আমি তরুনিমা বলছি।”
—“ভাবী…আপনি! সন্ধ্যার ফোন থেকে কল করেছেন যে! সব ঠিক আছে তো?”
—“হ্যা…হ্যা সব ঠিক আছে। সন্ধ্যা আমার পাশেই আছে। আমি একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে কথা বলার জন্য আপনাকে কল করেছি।”
—“হুম ভাবী, বলুন কি বিষয়!”
তরুর মুখে পুরো পরিকল্পনা শুনে সন্ধ্যা আর নিলাদ্র দু’জনই কিছুসময়ের জন্য স্ত*ব্ধ হয়ে গিয়েছে। তরুনিমা বললো….
—“কি হলো তোমরা কিছু বলছো না কেনো?”
সন্ধ্যা বললো…
—“কিন্তু এতোটা রি*স্ক নিয়ে কাজগুলো করতে গেলে তো আমরা ধ*রা*ও পরে যেতে পারি মেজো ভাবী।”
নিলাদ্র বললো…
—“ধ*রা পড়ার ভ*য় মনের ভিতর পুষে রাখলে আমাদের প্র*তি*শো*ধের আগুনে আমরাই পু*ড়ে ছাই হয়ে যাবো সন্ধ্যা৷ ভাবী যেই পরিকল্পনা করেছে তা যদি বাস্তবায়ন করা হয় তাহলে আমাদের শ*ত্রু*রা তাদের পা*প কর্মের জন্য উপযুক্ত শা*স্তি পাবে।”
সন্ধ্যা আবারও বললো….
—“আগে মেজো ভাইয়ার সাথে এই পরিকল্পনার বিষয়ে কথা বলা উচিত আমাদের। তারপর ভাইয়া যদি সম্মতি জানায় তাহলেই এই পরিকল্পনা চূড়ান্ত করতে হবে।”
তরুনিমা বললো….
—“তুমি নিশ্চিন্ত থাকো সন্ধ্যা আমি তোমার মেজো ভাইয়ার সাথে কথা বলবো এই বিষয়ে। আর আমি শতভাগ নিশ্চয়তা দিতে পারি যে তিনি দ্বিমত পেষণ করবেন না। আর নিলাদ্র ভাইয়া আপনাকে যেই কাজ করতে বললাম সেটা দ্রুত করার ব্যবস্থা করুন।”
নিলাদ্র বললো….
—“ঠিক আছে ভাবী।”
এরপর নিলাদ্র কল কেটে দেয়। তরুনিমা শান্ত স্বরে সন্ধ্যাকে উদ্দেশ্য করে বললো….
—“পরিস্থিতি যতোই বেগতিক হোক না কেনো সন্ধ্যা সকলের সামনে নরমাল থাকার চেষ্টা করবে। নিজের রাগ, আবেগকে যথাসম্ভব নিয়ন্ত্রণে রাখার চেষ্টা করো।”
—“আমি চেষ্টা করবো ভাবী।”
—“গুড গার্ল। আচ্ছা শুনো…এখন এসব নিয়ে কোনো চিন্তা করো না। সামনে তোমার বিয়ে। সেটাও তোমার ভালোবাসার মানুষের সাথে। তাই বিয়েতে ফোকাস করো। পুরো বিষয়টা খুব সাবধানতার সাথে আমি হেন্ডেল করে নিবো।”
—“ঠিক আছে ভাবী।”
এরপর তরুনিমা সন্ধ্যার রুম থেকে বের হয়ে নিজের রুমের উদ্দেশ্যে হাঁটা ধরে।
(১৫৮)
তালুকদার ভিলায় ড্রয়িংরুমে সোফায় বসে ছিলেন তমিজ, রেবেকা আর হুমায়রা। সেইসময় তাহির ড্রয়িংরুমে এসে সোফায় বসতে বসতে বললো….
—“বাবা-মা…! আমি চাই আগামী ২দিনের ভিতর আমার আর হুমায়রার বিবাহকার্য সম্পন্ন হোক।”
তাহিরের এরূপ কথা শুনে হুমায়রা শান্ত দৃষ্টি নিয়ে তাহিরকে একবার দেখে সাথে সাথেই দৃষ্টি সরিয়ে নেয়। হুমায়রার এই চাহনীতে যেনো প্রা*ণ নেই। বিয়ে যতো ভালোলাগা, অনুভূতি, উত্তেজনা হুমায়রার মনে কাজ করছিলো একদিন আগে পর্যন্তও তার কিন্ঞ্চিত পরিমাণ ছাপ ও যেনো এখন ওর মুখশ্রী জুড়ে দেখা যাচ্ছে না। রেবেকা বললেন….
—“এতো তাড়াহুড়ো করলে কি চলে রে বাবা? তুই আমাদের একমাত্র ছেলে। আর হুমায়রার মা-বাবারও তো ওর বিয়ে নিয়ে অনেক আশা-আকাঙ্ক্ষা, স্বপ্ন আছে।”
তাহির স্বাভাবিক স্বরেই বললো…
—“শুরুতেই তো বলেছিলাম পারিবারিক ভাবে বিয়ে হবে। আর একান্তই যদি জাঁকজমকপূর্ণ পরিবেশের মাঝে মেয়ের বিয়ে দেওয়ার ইচ্ছে তাদের থাকে তাহলে খালা-খালুকে বলে দাও মেয়ের জন্য অন্য ছেলের সন্ধান করতে।”
তাহিরের এমন প্রতিত্তুর শুনে হুমায়রার কান্না, খারাপ লাগা গুলো যেনো ওর গলায় দলা পেঁ*কে আসে। হুমায়রা ওর খারাপ লাগা গুলোকে এক ঢোকে গি*লে নিয়ে জোরপূর্বক হাসি দিয়ে বললো….
—“খালা আমিও চাই না এতো জাঁকজমকপূর্ণ অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে বিয়ে করতে। তাহির যেমনটা বলছে তেমনটাই করুন আপানারা।”
—“কিন্তু..!”
—“কোনো কিন্তু না খালা।”
—“আচ্ছা ঠিক আছে যেমন তোমাদের ইচ্ছে। আমি তোমার বাবা-মাকে আজই বলে দিচ্ছি তারা যেনো পড়শু সকালের ভিতর বাংলাদেশে আসতে পারে।”
—“আচ্ছা।”
এই বলে হুমায়রা সোফা ছেড়ে উঠে সিঁড়ি বেয়ে দ্রুত পায়ে উপরে নিজের রুমে চলে যায়। তাহির একপলকে হুমায়রার যাওয়ার পানে তাকিয়ে রয়। রেবেকা ও উঠে রান্নাঘরে চলে গেলেন। তমিজ শান্ত স্বরে বললেন….
—“বেটা আমি তোমার বাবা হই ঠিকই কিন্তু সবসময় তোমার সাথে বন্ধুসুলভ আচারণ করেছি। তোমাকে এমন ভাবে শা*স*ণ করি নি কখনও যে তুমি আমার কাছে তোমার পারসোনাল কোনো সমস্যা হলে সেই বিষয়টা লুকিয়ে যাবে। তাই সেই জায়গা থেকেই তোমাকে একটা কথা বলছি, ‘ভালোবাসার মানুষটা যতোদিন বেঁচে আছে তোমার কাছে আছে ততোদিন তাকে নিজের সবটা উজার করে ভালোবেসো কারণ কখন কার মৃ*ত্যুর ঘন্টি বেজে যাবে তা কিন্তু আমরা কেও বলতে পারবো না, ভালোবাসার মানুষটা যখন আমাদের থেকে চিরতরের জন্য দূরে চলে যাবে যেখানে একবার চলে গেলে আর তাকে ফেরানো সম্ভব হয় না তখন এটা ভেবে যেনো তোমাকে আ*ফ*সোস করতে না হয় যে তুমি চাইলেই তাকে আরেকটু বেশি ভালোবাসতে পারতে, চাইলে তাকে ক*ষ্ট না দিয়ে যত্ন করে আগলে রাখতে পারতে, চাইলেই তাকে এতো অ*ব*হেলা নাই করতে পারতে।’ আমার কথাগুলো একটু পজেটিভলি চিন্তা করে দেখো বেটা। কোথাও তুমি এমন কাজ করছো না তো!”
এই বলে তমিজ সোফা ছেড়ে উঠে নিজের রুমের উদ্দেশ্যে হাঁটা ধরলেন। তাহির মাথা নিচু করে দুই হাটুর উপর দুই হাত রেখে মেঝের উপর দৃষ্টি স্থির করে রাখে।
.
.
.
নিজের রুমে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজের প্রতিচ্ছবির উপর দৃষ্টি স্থির করে রেখেছে হুমায়রা। পরক্ষণেই দু’চোখ দিয়ে নোনাজল ফেলতে ফেলতে বললো….
—“দুনিয়াটা এমন কেনো বল তো? যে যারে ভালোবাসে সে তার ভালোবাসা পাওয়ার জন্য কা*ঙা*ল হয়ে ঘুরলেও কেনো তার ভালোবাসা পায় না! প্রকৃত ভালোবাসার বিনিয়মে কেনো তু*চ্ছ-তা*চ্ছি*ল্য, অবহেলা সহ্য করতে হয়? এই প্রতিচ্ছবি….আমাকে একবার ভালোভাবে দেখে বল না তুই, আমি কি খুব অসুন্দর দেখতে! ওর ভালোবাসা পাওয়ার স্বপ্ন একটু একটু মনের ভিতর গেঁ*থে আসছি বহু বছর হলো। ওর সামনে ভালোবাসার দাবি নিয়ে কা*ঙা*লে*র মতো ঘুরছি। কখনও কখনও ওর আচারণ, কথা বলার ধরণ দেখে মন বলেছে ও হয়তো আমার ভালোবাসা, আমার অনুভূতি গুলো উপলব্ধি করতে পারছে। কিন্তু পরমূহূর্তেই ওর ভিতর এতোটা পরিবর্তন কেনো আসে! বুকের ভিতরটা ধাঁ*রা*লো ছু*রি দিয়ে ক্ষ*ত-বি*ক্ষ*ত করে দেওয়ার মতো কথা কেনো বলে ও! আর কি করলে ও আমাকে বুঝবে বল না! আমার যে ভিষণ ক*ষ্ট হচ্ছে। ভিষন….!”
কথাগুলো বলতে বলতে হুমায়রা সেখানেই মেঝেতে বসে পড়ে হু হু করে কাঁদতে শুরু করে।
#চলবে ইনশাআল্লাহ
#হৃদকোঠোরে_রেখেছি_তোমায়🖤(৬৯)
#Maisha_Jannat_Nura (লেখিকা)
(১৫৯)
দুইদিন পর………
খুব ছোট করে ঘরোয়া ভাবেই তাহির আর হুমায়রার বিয়ের আয়োজন করেছেন তমিজ তালুকদার। হুমায়রার রুমে ওকে খুব যত্নসহকারে নতুন বধুর সাজে সাজিয়ে দিচ্ছে তরুনিমা আর সন্ধ্যা। গাড় লাল রংয়ের বেনারসি শাড়ির সাথে হালকা সাজ আর হালকা গহনা পড়িয়ে দেওয়ার পর হুমায়রাকে কোনো অপ্সরাদের থেকে কম মনে হচ্ছে না। সন্ধ্যা হুমায়রার মুখোমুখি বসে চোখ ছোট ছোট তাকিয়ে বললো…
—“এতোসময় নিয়ে এতো সুন্দর করে সাজিয়ে দিলাম তোমায় এখন তো মনে হচ্ছে আমাদের সব পরিশ্রম বৃ*থা গেলো।”
হুমায়রা অবাক দৃষ্টি নিয়ে সন্ধ্যার দিকে তাকিয়ে বললো…
—“মানে!”
—“আগে এই প্রশ্নের উত্তর দাও, তাহির ভাইয়াকে তো তুমি ভালোবাসো তাই না?”
হুমায়রা ছোট্ট করে একবার নিঃশ্বাস ফেলে অত্যন্ত ধীরস্বরে বললো…
—“আমি আমার সবটা উজার করে ওকে ভালোবাসলেও ওর কাছে না আমার মূল্য আছে আর না আমার ভালোবাসার।”
সন্ধ্যা হুমায়রার কথা গুলো স্পষ্ট ভাবে শুনতে না পেরে বললো….
—“কি বললে!”
হুমায়রা হালকা হাসি দিয়ে বললো…
—“হুম ভালোবাসি তো।”
—“কিন্তু তোমাকে দেখে মনেই হচ্ছে না যে তুমি তোমার ভালোবাসার মানুষটাকে আজ নিজের করে পাবে! মনে হচ্ছে তোমাকে জোর করে বেঁ*ধে কোনো বুড়ো, পেট মোটা, টাকলু দাদুর সাথে বিয়ে দেওয়া হচ্ছে।”
সন্ধ্যার এমন কথা শুনে শত মন খারাপের মাঝেও হুমায়রার মুখে হাসি ফুটে উঠে। সন্ধ্যা হাসিমুখে বললো…
—“ইসস হাসলে কি মিষ্টি লাগে তোমায়! এই হাসিটাই তো এতোসময় মিস করছিলাম। সবসময় এভাবেই হাসিখুশি থেকো বুঝলে! নয়তো পরে যদি আবারও দেখেছি মুখটাকে বাংলার পাঁচের মতো চু*প*ষা*নো অবস্থায় রেখেছো তাহলে সত্যি সত্যিই তাহির ভাইয়ার জায়গায় কোনো বুড়ো দাদুকে বসিয়ে দিবো।”
হুমায়রা হাসিমুখে বললো….
—“হাসলে কিন্তু তোমাকেও ভারি মিষ্টি লাগে সন্ধ্যা।”
সন্ধ্যা ওর সামনে থাকা চুল গুলো হাত দিয়ে পিছনে সরিয়ে দিয়ে একটু ভাব নিয়ে বললো….
—“হুম..হুম..আমি জানি!”
তরুনিমা শান্ত স্বরে বললো…
—“সন্ধ্যা..নিচ থেকে একবার ঘুরে এসো আর দেখো আমাদের কেও খুঁজছে কি না!”
—“আচ্ছা মেজো ভাবী।”
এই বলে সন্ধ্যা বিছানা থেকে নেমে রুম থেকে বেড়িয়ে যায়। তরুনিমা হুমায়রার মাথার উপর থাকা ওড়নাটায় লাস্ট পিনটা সেট করে দিয়ে ওর সামনে এসে বসে শান্ত স্বরে বললো….
—“হুমায়রা..তুমি কোনো বিষয় নিয়ে আপসেট হয়ে আছো?”
হুমায়রা তরুর দিকে শান্ত দৃষ্টি স্থির করে রেখেছে। আজ প্রথম সে তরুকে এতোটা কাছে থেকে নিখুঁত ভাবে পর্যবেক্ষণ করছে। তরু হুমায়রার হাতের উপর হাত রেখে বললো….
—“তুমি চাইলে আমাকে তোমার খারাপ লাগার কারণগুলো শেয়ার করতে পারো। হয়তো আমি তা কমিয়ে দেওয়ার মতো কোনো ব্যবস্থা করতে পারবো না তবুও বলবো নিজের ভিতরে পুষে রেখে য*ন্ত্র*ণা সহ্য করার থেকে বিশ্বাসযোগ্য কারোর কাছে শেয়ার করা ভালো। এতে খারাপ লাগা একটু হলেও কমে যায়। বুকের ভিতরটা হালকা অনুভব হয়।”
হুমায়রা শান্ত কন্ঠে বললো….
—“তুমি ভিষণ রকম সৌন্দর্যের অধিকারী তা কি তুমি জানো তরুনিমা! তোমার সম্পূর্ণ মুখশ্রী জুড়ে ভিষণ মায়া মিশে আছে। একবার যে তোমার দিকে গভীর দৃষ্টি নিয়ে তাকাবে তার পক্ষে তোমার মায়া কাটিয়ে উঠা সহজ হবে না।”
হুমায়রার এমন কথায় তরু বেশ অবাক হয়। হুমায়রা আবারও বললো….
—“তাই হয়তো দীর্ঘ ৫বছর ধরে তোমার থেকে দূরে থেকেও তাহির তোমার মায়া আজও কাটিয়ে উঠতে পারে নি। এ কারণেই হয়তো আমার সৌন্দর্য, আমার ভালোবাসা, আমার পা*গ*লা*মী, আমার যত্ন গুলো ওর চোখে পড়ে না। আমাকে অ*ব*হে*লা করতে, বুকের ভেতরটা ধাঁ*রা*লো ছু*রি দিয়ে ক্ষ*ত-বি*ক্ষ*ত করে দেওয়ার মতো কথা বলতে ওর একটুও বাঁ*ধে না। তুমি জানো তরুনিমা! তাহির আমাকে বিয়ে করছে শুধু মাত্র খালার মন রাখতে! আমাকে বিয়ে সে দয়া দেখাচ্ছে এই কথাও সে নিজে নির্দ্বিধায় আমাকে বলেছে। আমিও কতো বোকা ছিলাম মাঝে মাঝে ওর কিছু কাজকে ভালোবাসার অংশ মনে করতাম। এই বিয়ে নিয়ে আমার আর মনে কোনো আনন্দ কাজ করছে না। তবে আমি এটা বুঝতে পারছি যে তাহির এখনও তোমাকে ভালোবাসে। তোমাকে ভুলে আমাকে ভালোবাসা ওর পক্ষে আদেও কখনও সম্ভব হবে কি না আমি জানি না।”
তরুনিমা নিরব শ্রোতার মতো হুমায়রার প্রতিটি কথা শুনলো। হুমায়রার চোখ দিয়ে অঝোর ধারায় নোনাজল গড়িয়ে পড়ছে। কিছুসময় পর তরুনিমা কোনো প্রতিত্তুর না করেই বিছানা থেকে রুম থেকে বের হয়। হুমায়রা অশ্রুসিক্ত নয়নে তরুর যাওয়ার পানে তাকিয়ে রয়।
.
.
.
কুশল আর নিলাদ্র যত্ন সহকারে তাহিরকে বরের বেশে সাজিয়ে দিচ্ছে। সেইসময় তরুনিমা তাহিরের রুমের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে শান্ত স্বরে বললো…
—“কুশল, নিলাদ্র ভাইয়া আপনারা দু’জন রুম থেকে বের হন কিছুসময়ের জন্য।”
আকস্মিক তরুর এমন কথায় ওরা তিনজনই বেশ অবাক হয়। কুশল তরুর সামনে এসে দাঁড়িয়ে শান্ত স্বরে বললো….
—“কি হয়েছে তরুনিমা! কোনো স*ম*স্যা কি?”
—“দয়াকরে কোনো প্রশ্ন না করে দু’জনেই রুম থেকে বের হন আমার তাহিরের সাথে কিছু পারসোনাল কথা আছে।”
তরুর এরূপ কথা শুনে কুশল আর নিলাদ্র আর কোনো কথা না বলে রুম থেকে বের হয়। তরুনিমা ওদের মুখের উপর ভিতর থেকে ঠা*স করে দরজা লাগিয়ে দেয়। নিলাদ্র কুশলের কাঁধের হাত রেখে ভাবুক স্বরে বললো…
—“কি রে, ভাবী তো আমাদের মুখের উপর দরজা বন্ধ করে দিলো। ভাবীর কথার ধরণ শুনে মনে হচ্ছে ভাবী কোনো বিষয় নিয়ে ভিষণ রেগে আছেন।”
—“আমারও তো তাই মনে হচ্ছে। কিন্তু হঠাৎ আমার বউয়ের হলো টা কি!”
নিলাদ্র কুশলের কাঁধের উপর থেকে হাত সরিয়ে দরজায় কান পেতে ভিতরের কথপোকথনের শব্দ শোনার চেষ্টা করে।
.
.
.
তাহির শান্ত স্বরে বললো….
—“কি হয়েছে তরুনিমা!”
তরুনিমা কোনো প্রতিত্তুর না করে তাহিরের সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে নিজের সর্বশক্তি প্রয়োগ করে তাহিরের গালে একটা চ*ড় বসিয়ে দেয়। যার শব্দ বাহির থেকে কুশল আর নিলাদ্র দু’জনেই স্পষ্ট ভাবে শুনতে পায়। নিলাদ্র বললো…
—“এ থা*প্প*ড় দেওয়ার শব্দ শোনা গেলো তো! ভাবী কি তাহিরকে থা*প্প*ড় দিলো!”
কুশল শারিরীক অঙ্গভঙ্গি দ্বারা বুঝালো যে ‘হতেও পারে’। তরুর আকস্মিক এমন কাজে তাহির ওর চেহারায় হ*ত*ভ*ম্ব*তার ছাপ ফুটিয়ে গালে একহাত রেখে যেই না কিছু বলতে নিবে ওমনি তরুনিমা অন্যহাতে দিয়ে আবারও নিজের সর্বশক্তি প্রয়োগ করে তাহিরের অন্য গালে একটা চ*ড় বসিয়ে দেয়। নিলাদ্র নিজের দু’গালে দু’হাত রেখে বললো…
—“আবার থা*প্প*ড় দিলো!”
তাহির ওর দু’গালে দু’হাত রেখে তরুনিমার দিকে তাকিয়ে আছে। তরুনিমা দাঁতে দাঁত চে*পে বললো….
—“মুখ দিয়ে এখন আর একটা শব্দ উচ্চারণ করার চেষ্টাও যদি করেছেন আপনি তাহলে ঐযে বেডসাইড টেবিলের উপর রাখা ঝুড়ির ভিতর ছু*ড়ি*টা দেখছেন ওটা দিয়ে আপনার জি*হ্বা*টা একদম কে*টে ফেলবো।”
তরুর এমন কথায় তাহিরের চোখ স্বাভাবিক এর তুলনায় কিছুটা বড় হয়ে যায়। তরুনিমা আবারও বললো…
—“এখন যা যা প্রশ্ন করবো সবগুলোর সত্য উত্তর চাই আমি। হ্যা বা না মাথা নাড়িয়ে তা বুঝিয়ে দিবেন।”
তাহির সঙ্গে সঙ্গে একপার্শে মাথা নাড়িয়ে আচ্ছা বুঝায়। তরুনিমা শব্দ করে নিঃশ্বাস ফেলে বললো…
—“আমি যে বিবাহিত এই কথা আপনি কি জানেন?”
তাহির মাথা নাড়িয়ে হ্যা সূচক জবাব দেয়।
—“শুনলাম আপনি এখনও আমায় ভালোবাসেন! এটা কি সত্য?”
তরুর ২য় প্রশ্ন শুনে তাহির নিরব থাকে। তরুনিমা রাগী স্বরে বললো…
—“ভেবে চিন্তে উত্তর করুন। নয়তো আজ আপনার গাল দু’টো ঠিক থাকবে না।”
তাহির ওর গাল থেকে সরিয়ে মাথা নাড়িয়ে হ্যা সুচক জবাব দেয়। তরুনিমা মুখে কিছু না বলে সঙ্গে সঙ্গে তাহিরের গালে আরেকটা থা*প্প*ড় বসিয়ে দেয়। তাহির ওর মাথা নিচু করে ফেলে। তরুনিমা রাগী স্বরে বললো….
—“একজন বিবাহিত নারীর জন্য এখনও নিজের মনে ভালোবাসার অনুভূতি গুলোকে বাঁ*চি*য়ে রেখেছেন কোন লজ্জায়! আপনার কি মনে হয় আমি আমার স্বামী কুশল চৌধুরীকে ছেড়ে দিয়ে আবারও আপনার কাছে ফিরে আসবো!”
তাহির কোনো প্রতিত্তুর করে না। তরুনিমা বললো…
—“আমার চোখের দিকে তাকান তাহির।”
তাহির তরুর চোখের দিকে তাকায়। তাহিরের দু’চোখের মনির চারপাশের সাদা অংশ ইতিমধ্যে হালকা লাল বর্ণ ধারণ করেছে। তরুনিমা আবারও বললো….
—“হুমায়রা যে আপনাকে ভালোবাসে এই কথা কি আপনি জানেন!”
তাহির আবারও মাথা নাড়িয়ে হ্যা সূচক জবাব দেয়। তরুনিমা এবারও তাহিরের অন্যগালে স্বজোরে একটা থা*প্প*ড় দেয়। পরপর চার চারটে থা*প্প*ড় খেয়ে তাহিরের ফর্সা গাল দু’টোও হালকা লাল বর্ণ ধারণ করেছে। তরুনিমা দাঁতে দাঁত পি*ষে বললো….
—“একজন বিবাহিত নারীর জন্য মায়া, ভালোবাসার স্মৃতি মনের ভিতর পুষে রেখে হুমায়রার ভালোবাসাকে ছোট করার, ওর অনুভূতি গুলোকে অমূল্যায়ন করার অধিকার আপনাকে কে দিয়েছে!”
তাহির আর তরুর চোখের দিকে তাকিয়ে থাকতে পারে না। সে মাথা নিচু করে ফেলে আবারও। তরুনিমা তাহিরের পাঞ্জাবির কলার্ট একহাতে চেপে ধরে রাগী স্বরে বললো….
—“যাকে পাওয়া আর কখনও সম্ভব না তার স্মৃতি মনের ভিতর পুষে রেখে যে আপনাকে পা*গ*লে*র মতো ভালোবাসে তার ভালোবাসাকে ঠু*ক*রা*চ্ছেন আপনি! ছিহ্:। একটা কথা পরিষ্কার বাংলা ভাষায় বলছি, আমার সব স্মৃতি মন ও মস্তিষ্ক থেকে চিরতরের জন্য মুছে ফেলুন আর হুমায়রাকে বোঝার চেষ্টা করুন। ওকে ওর সবটা উজার করে একবার আপনাকে ভালোবাসার সুযোগ দিন দেখবেন আপনিও ওকে ভালোবাসতে বাধ্য হবেন। তবে হ্যা লাস্ট আরেকটা কথা বলে রাখছি এটাও মাথার ভিতর ঢুকিয়ে নিন ভালো ভাবে, আজকে এই মূহূর্তে পর যদি আর কখনও আপনার কোনো কথায় বা আচারণে হুমায়রার মন খারাপ হয় বা ওর চোখে থেকে এক ফোঁটা অশ্রু ঝরে বা আমি জানতে পারি আপনি আবারও আমার কথা স্মরণ করে ওকে বিন্দুমাত্র অ*ব*হে*লা করেছেন তবে সেইদিনটাই হবে আপনার জীবনের শেষ দিন।”
এই বলে তরুনিমা তাহিরের কলার্ট ছেড়ে দিয়ে দ্রুত পায়ে দরজার কাছে এসে দরজা খুলতেই নিলাদ্র ধ*প করে মেঝের উপর পরে যায়। তরুনিমা বুঝতে পারে এতোসময় নিলাদ্র দরজায় হেলান দিয়েই দাঁড়িয়ে ছিলো তাই এই পরিণতি হলো ওর। তরুনিমা সামনে তাকাতেই দেখে কুশল ওর দিকে শান্ত দৃষ্টি স্থির রেখে দাঁড়িয়ে আছে। তরুনিমা কোনো কথা না বলে স্থান ত্যগ করে। কুশলও কিছু বলে তরুনিমাকে বাঁধা প্রয়োগ করে না। কুশল নিলাদ্রের পায়ে হালকা করে একটা লা*থি প্রয়োগ করে বললো….
—“উঠ ব্যটা।”
নিলাদ্র উঠে দাড়িয়ে তাহিরের সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে বললো…
—“তোমার গাল দু’টো ব্য*থা করছে না ভাই? বরফ দিবে!”
তাহির ছলছল দৃষ্টি নিলাদ্রের দিকে তাকিয়ে আলতো ভাবে ওর গালে দু’হাত রেখে বিছানার কাছে যেতে যেতে বললো….
—“তা আর বলতে! আআআহহহ কি ব্যথা! ভাই বরফ এনে দাও জলদী।”
নিলাদ্র দ্রুত রুম থেকে বেড়িয়ে যায় বরফ আনতে। কিছুসময় পর নিলাদ্র বরফ এনে তাহিরের গালে লাগিয়ে দিতে থাকে। নিলাদ্র বললো….
—“কুশল…..বন্ধু আমার! সাবধানে থাকিস তুই সবসময়। তাহির কি ভু*ল করেছে তা তো জানি না। কিন্তু এতেই ওর কি হাল করে দিয়েছে দেখছিস তো। তুই যদি কোনো ভু*ল করিস তাহলে তোর যে কি অবস্থা করবে আমাদের ডে*ন্ঞ্জা*রা*জ ভাবী সেটা ভেবে এখনি আমার শরীর শিউরে উঠছে।”
#চলবে ইনশাআল্লাহ….……..