হৃদমাঝারে তুমি পর্ব-২৫+২৬

0
365

#হৃদমাঝারে_তুমি
#সাইয়ারা_মম
#পর্ব_২৫

ইফতারি করার পরে আরফান মিহুকে বলল,

-পাঁচ মিনিট ওয়েট করো।আমি আসছি

আরফান চলে গেলে মিহু চারপাশে তাকিয়ে দেখে এই জায়গা টা সুন্দর।টেবিলে সুন্দর করে সাজানো কয়েকটা ফুল।পাশের খোলা জানালা থেকে মন মুগ্ধ কর হাওয়া আসছে।আকাশটা কালো হয়ে গেছে,চারপাশ নিস্তব্ধতায় ছেয়ে গেছে।আকাশ গর্জে উঠছে মাঝে মাঝে।আবার হৃদয় ছুঁয়ে যাওয়ার মতো ঠান্ডা হাওয়া বইছে।এমন সময় আরফান এসে বলল

-পরিবেশটা খুব সুন্দর তাই না?

মিহু আরফানের কথার উত্তরে শুধু হুম বলল।কিন্তু ওর মন প্রাণ জুড়ে এখনো শীতল পরিবেশটা অনুভব করছে।আরফান মিহুর হাত ধরল,খুব নরম করেই ধরল।তারপর ধীর গলায় বলল

-মিহু আমার দিকে তাকাও।

আরফানের এমন স্বচ্ছ ব্যবহারে মিহু আরফানের দিকে তাকালো।আরফানের হাতে একটা রেপিং করা বক্স দেখতে পেল।মিহুকে খুব এক্সাইটেড দেখালো।আরফান মিহুর হাতে দিয়ে বলল

-নাও এটাকে খোলো।

মিহু বক্সটা হাতে নিল।তারপর ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখতে লাগল।আস্তে আস্তে বক্সটা রেপিং ছাড়াতেই দেখতে পেল একটা সুন্দর কাঠের বক্স।কারুকাজ করা বক্সটা দেখতে খুব সুন্দর। আরফান একটা ছোট্ট রিং এ দুইটা চাবি মিহুকে দিয়ে বলল

-এই বক্সটা খোলো

মিহু চাবি দিয়ে বক্সটা খুললো।তার ভেতরে মায়ের ডায়েরি টা দেখে খুব আনন্দিত হলো।আনন্দরত গলায় বলল

-এর জন্য আপনি আমার কাছ থেকে ডায়েরিটা নিয়েছিলেন?বক্সটা খুব সুন্দর। আর ডায়েরি টা এর ভেতরে রাখলে হারানোর সম্ভবনা থাকবেনা।আপনাকে অসংখ্য অসংখ্য ধন্যবাদ।

মিহুর খুশি দেখে আরফান খুব খুশি হলো।মেয়েটা একটু আদর পেলেই খুশি হয়ে যায়। আসলে মিহু অনেক অনাদরে ছিল। ওর জীবনটা দুঃখে পরিপূর্ণ ছিল। আরফান মনে মনে বলল

-তোমাকে আর কখনো কষ্ট পেতে দেবো না বেলী ফুল।তুমি একান্তই আমার। আর আরফান আদিত্য এর জিনিস কখনো অবহেলায় থাকে না।সেখানে তুমি তো আমার বেলী ফুল!

-কী দেখছেন?

মিহুর কথায় আরফানের ঘোর ভাঙল।ভালোভাবে খেয়াল না করায় আরফান মিহুর কথা শুনতে পেল না।তাই আবারো তাকিয়ে থাকলো।আরফানকে কিছু না বলতে দেখে জিজ্ঞেস করলো

-কখন থেকে তাকিয়ে থাকতেই দেখছি।কি দেখছেন?
-দেখছি না
-তাহলে?
-ভাবছি
-ভাবছেন?কি ভাবছেন বলুন তো

আরফান চেয়ারটা মিহুর দিকে সরিয়ে ওর দিকে একটু ঝুকলো তারপর বললো

-এর জন্য তো শুধু ধন্যবাদে কাজ হবে না।আমার অন্য কিছু চাই,কি পূর্ণ করবে আমার চাওয়া।

মিহুর হাসি মুখখানা নিমিষেই লজ্জায় পরিবর্তন হলো।ও বলল

-আপনি আসলেই একটা খারাপ লোক।নিজেই ডায়েরি চেয়ে নিয়ে তারপর সেটাই আবার উপহার দিয়ে এখন ফিরতি উপহার চাচ্ছেন।

-তোমার কি মনে হয় আমি খারাপ!

আরফানের গম্ভীর কথা শুনে মিহু ভাবলো আরফান কি ওর এই কথায় রেগে গেলো না তো।
-আরে আপনি রাগ করেন না আমি আসলে সেইভাবে আপনাকে বলতে চাইনি যে আপনি খারাপ আসলে

মিহুর কথা অপূর্ণ রেখেই আরফান বলল- আমি যেহেতু খারাপ তাহলে একটু খারাপ নেস তো দেখাতেই হয় নাকি?তো মিসেস আরফান আদিত্য বি রেডি।

-আরে আপনি আসলে ভুল ভাবছেন।

মিহু দাঁড়িয়ে গেলে আরফান মিহুর দিকে এগিয়ে কঠোর চেহারা করে তাকিয়ে থাকে।মিহু চোখ মুখ কুঁচকে আছে।মিহুর এমন অবস্থা দেখে আরফান হেঁসে দিল। আর বলল

-তোমার ভয় পাওয়ার দরকার নেই। আজকে আমার সাথে একটু শহরটা ঘুরলেই হবে।আমার এই ইচ্ছাটাই আপাতত পূর্ণ করো।

মৃদু বাতাস বইছে আর তার সাথে সাথে হালকা ঝিরঝিরে বৃষ্টি পড়ছে।আরফান রিক্সার হুড টেনে দিতে চাইলে মিহু বাধা দিয়ে বলে

-থাকুক না খোলা।অনেক সময় প্রকৃতির দেওয়া জিনিস সাদরে গ্রহণ করতে হয়।কারণ প্রকৃতি যে নিতান্তই একা।ওর সান্নিধ্যে থাকলে নিজেকে মুক্ত মনে হয়।

মিহুর আবদারেই আরফান রিক্সা নিল।মিহুর বরাবরেই রিক্সা ভালো লাগে।মিহু এখন খুব খুশি রয়েছে।হালকা ঝিরঝিরে বৃষ্টিতে নিজের হাত বাইরে দিচ্ছে।আবার আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকছে।থমকে থমকে বিদ্যুতে চমকাচ্ছে।বিদ্যুত চমকানোর মূহুর্তে মিহু কয়েকবার আকাশের দিকে তাকাচ্ছে কিন্তু তাকিয়ে থাকতে পারছে না।শরীরটা কাটা দিয়ে উঠছে।মিহু আরফানের হাত চেপে ধরলো।আরফানের পরিবেশটাকে রোমাঞ্চকর মনে হলে।মনে মনে আশা করল এই সময় টা যেন থেকে যায়, সময় টা যেন থেমে যায়। আরফান আর মিহুর এই গন্তব্য যেন কিছুতেই না থামে।কিন্তু আরফানের চাওয়া পূর্ণ হয় না।ওরা চলতে চলতে শহরের অনেক বাইরে চলে এসেছে।রিক্সাওয়ালা রিক্সা থামিয়ে বলল

-স্যার আর সামনে যাইবো না।

-কেন? আমরা তো বলেছিলাম দুইঘন্টা ঘুরবো।এখনো তো মাত্র একঘন্টাও হয় নি।

-আকাশের অবস্থা দেখছেন?ঝড় আইবো।এহন বাড়িতে না গেলে ঝড়ের কবলে পড়তে হইবো।

-আচ্ছা তাহলে আমাদের আবার দিয়ে আসেন

-স্যার এডা পারমু না।কারণ সামনে আমাগো বাড়ি,এহন আপনাগো দিয়া আইতে গেলে অনেক সোমায় লাগবো তাইলে আর বাড়ি ফিরতে পারবো না।

আরফান আর মিহু রিক্সা থেকে নেমে দাঁড়ালো।আকাশের অবস্থা ক্রমশই খারাপ হতে লাগল। ঘন ঘন বিদ্যুত চমকাচ্ছে।বৃষ্টির ফোঁটা বড় হতে শুরু করল। আরফানকে চিন্তিত দেখাচ্ছে। মিহু আরফানকে জিজ্ঞেস করলো

-কোনো সমস্যা?
-নেটওয়ার্ক পাওয়া যাচ্ছে না।এখন কীভাবে গাড়ি পাঠাতে বলবো? আর এখানে তো থাকার ও কোনো জায়গা নেই।

ওদের সমস্যার কথা শুনে রিক্সাওয়ালা বলল-স্যার একটা কথা কমু?

-হ্যাঁ বলুন

-আপনাগো সমস্যা না হইলে আমাগো বাড়িতে থাকতে পারেন।আর এহন অনেক ঝড় উঠবো।আপনারা এমনিতেও যাইতে পারবেন না।

মাটির রাস্তায় কাদা ফ্যাচ ফ্যাচ করছে।রিক্সা মাঝে মাঝেই ঝাঁকুনি দিয়ে উঠছে।বৃষ্টিতে সবাই ভিজে গেছে।একটু পরে রিক্সা এসে থামলো একটা বাসার সামনে।মাঝারি সাইজের বাড়ি তবে টিন দিয়ে চারপাশ আটকানো।মিহু আর আরফানকে বাড়ির সামনে নামিয়ে তিনি রিক্সা পাশে একটা ছাউনি দেওয়া জায়গায় রেখে দিলেন।

—————-

আবহাওয়া খারাপ হওয়ার কারণে মাহিন একটা দোকানের নিচে আটকা পড়লো।আকাশের অবস্থা খারাপ হতে থাকার ফলে মাহিন অনেক ভিজে গেলো। এই ভেজা শরীর নিয়ে থাকা যাবে না।তাহলে ঠান্ডা লেগে যাবে।মাহিনের ঠান্ডায় সমস্যা আছে। এলাকাটা মিহুদের বাসার আসে পাশে।মাহিন মিহুকে ফোন দিল কিন্তু মিহুর ফোন বন্ধ বলছে।পিহুকে ফোন দিতেও অনেক ঝামেলা পোহাতে হলো।অনেক কষ্টে ঠিকানা নিয়ে ওদের বাসায় গেলো।

মাহিন আরফানদের বাসার সামনে বসে আছে।ওর প্রাণ ধুক ধুক করছে।মিহুর সামনে পড়লে কেমন একটা অবস্থা হবে। ও বার বার মিহুকে কথা গুলো বলতে গিয়েও আটকে যায়।কোথায় একটা জড়তা কাজ করে।অনেকক্ষণ চিন্তা ভাবনা করতেই হাঁচি দেওয়া শুরু করল।তাই বাধ্য হয়ে কলিংবেল চাপলো।কলিংবেল চাপার সাথে সাথেই নীলু দরজা খুলে দিল।

-উফ জানো আমার কতো টেনশন হচ্ছিল সেই কখন বেরিয়ে,,,,,,,,,মাহিনকে দেখে নীলু চমকে গেল। বিস্ময়ের সাথে জিজ্ঞেস করল- আপনি?

মাহিন একটু ইতস্তত বোধ করছিল।হঠাৎ করে জিজ্ঞেস করায় কি বলবে ভেবে পেল না।তাই আমতা আমতা করতে করতে বলল

-আসলে মানে বৃষ্টিতে আটকা পরেছিলা আ আ হাচ্চু।এরপর আর কোনো কথাই বলতে পারলো না।পরাপর হাঁচি দিতে লাগল।নীলু তা দেখে খেয়াল করল মাহিন ভেজা অবস্থায় আছে।তাই তড়িঘড়ি করে বলল

-আরে বাইরে দাঁড়িয়ে থাকবেন না।আসুন আসুন ভেতরে আসুন।

মাহিন নীলুর পেছনে পেছনে গেল।নীলু ওকে গেস্ট রুমে নিয়ে গিয়ে বলল- একটু অপেক্ষা করুন, আমি আপনার জামা কাপড় পরিবর্তনের ব্যবস্থা করছি।

নীলু দৌড়ে আরফানের ঘরে গেল কিন্তু কেন এত তাড়াহুড়ো করছে সেটা ও নিজেও জানে না।তাড়াহুড়োর জন্য যে পিহুকেও বলবে মাহিন এসেছে তা ভুলেই গেছে।পিহু একটু অসুস্থ হওয়ায় ঘুমিয়ে পড়েছে তাই ওর খেয়াল নেই আর নেহাল পিহুর কাছে বসে আছে।রেবেকা পিয়াসদের বাসায় গিয়েছে কিন্তু বৃষ্টিতে আটকা পড়ায় পিয়াসের মা আসতে দেয় নি।ঘরে বলতে গেলে নীলুই একা।নীলু আরফানের আলমারি খুলে মাহিনের জন্য একটা হাফ হাতার গেঞ্জি আর একটা ট্রাউজার বের করে আনলো।এত তাড়াহুড়ো করলো যে ঐগুলো নিতে গিয়ে আরো অনেক গুলো জামা কাপড় পড়ে গেল।নীলু নিজেকে নিজেই ভর্ৎসনা করল। একটা কাজ যদি ঠিক মতো করতে পারে।কাপড় গুলো উঠাতে গিয়ে লক্ষ্য করল এই শাড়ি যেগুলো মিহুর জন্য আরফান কিনেছিল আর তার ভিডিও কেউ একজন পাঠিয়েছে ওকে।শাড়িগুলো আস্তে আস্তে রেখে দিল আর নীলুর মনটা খারাপ হয়ে গেল।কেন খারাপ হলো জানে না।নীলু আরফানের ছাদের পাশে গেল।বৃষ্টির দিকে তাকিয়ে থাকলো অনেকক্ষণ। এই বৃষ্টি ধুয়ে দিয়ে যাক ধরার সব গ্লানি।হঠাৎ করে আকাশে বিদ্যুত চমকানোতে নীলুর খেয়াল এলো মাহিনের কথা।আবার দৌড়ে গেস্ট রুমে গেল।গিয়ে দেখলো মাহিন ভেজা কাপড়েই গুটি শুটি হয়ে বিছানায় শুয়ে পড়েছে।নীলু মাহিনের কপালে হাত দিতেই ভয় পেয়ে গেল।কপাল জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে।এখন ও কি করবে?ভেজা কাপড় না পাল্টালে যে আরো খারাপ অবস্থা হবে?কি করবে নীলু?

#চলবে

#হৃদমাঝারে_তুমি
#সাইয়ারা_মম
#পর্ব_২৬

শহরের কাছাকাছি এলাকা তবুও এখানে ইলেকট্রিসিটি নেই । অবশ্য থাকবেও কীভাবে ? এখানে যারা বসবাস করে তার কিছু অংশ মধ্যবিত্ত আর কিছু অংশ নিম্নবিত্ত । তারা অনেক সুবিধা থেকেই বঞ্চিত হচ্ছে । হারিকেনের আলোতে চারদিকের প্রতিচ্ছবি আবছা দেখা যাচ্ছে । মিহুরা যাদের বাসায় এসেছে সেই রিক্সাওয়ালার নাম জব্বার । মিহুর বোরকা ভিজে গেছে আর আরফান ও ভিজে গেছে । মিহু বোরকা খুলে ঘরের এক কর্ণারে টানানো রশিতে রাখল । শুধু বোরকাই ভেজেনি ওর পরনের শাড়িও ভিজে গেছে । জব্বারের স্ত্রী তার একটা নতুন কাপড় বের করে দিল মিহুকে । মিহু সেটা হাতে নিয়ে বসে আছে । কাপড় টা পড়বে কীভাবে ? আরফান আর মিহুকে ছোট্ট একটা রুমে থাকতে দিয়েছে ।সেখানে শুধু একটা ছোট খাট আর একটা পড়ার টেবিল। আরফান ও সেই রুমের মধ্যে অবস্থান করছে।মিহুকে চিন্তামগ্ন হয়ে থাকতে দেখে জিজ্ঞেস করল

-মিহু কি হয়েছে?

-হ্যাঁ?না না কিছু হয় নি।কিছু না, বলেও মিহু কাপড় টা হাতে নিয়ে বসে থাকলো।এভাবে ভেজা অবস্থায় এখনো বসে আছে দেখে আরফান আবার বলল

-এভাবে ভেজা অবস্থায় আছো কেন?পাল্টিয়ে ফেলো।নয়তো ঠান্ডা লেগে যাবে।

-পাল্টাবো কিন্তু আপনি

-ও আমাকে নিয়ে সমস্যা? পাল্টাতে পারবেনা তা বললেই হয়। আমাকে বললেই তো পারো।আমি চোখ বন্ধ করে বসে থাকলেই তো হয়

মিহু ভেবেছিল আরফান বলবে আমি চলে যাচ্ছি তাই ভেবে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলছিল কিন্তু না, ইনি তো পাল্টে গেছে।চোখ বন্ধ থাক বা নাই থাক মিহু আরফানের সামনে বসে চেঞ্জ করবে?

আরফান চোখ বন্ধ করে ছিল। ও ভেবেছে মিহু ওর কথায় রাজি হয়েছে তাই বলল-হয়ে গেছে?আমি চোখ খুলবো?মিহু কোনো কথা বলছে না দেখে আরফান বলল -আমি কি খুলব? এবারেও মিহু কথা বলছে না দেখে আরফান বলল- আমি খুললাম কিন্তু বলে চোখ খুলে দেখে মিহু যেরকম ছিল সেরকমই আছে।শুধু ওর দিকে চোখটা একটু গরম করে তাকিয়ে আছে।যে আরফানের চোখ রাঙানিতে মানুষ ভয় পায়, যার চোখের দিকে তাকাতেই পারে না সেই আরফান তার বেউ এর কাছে ভেজা বেড়াল হয়ে গেছে।মিহুকে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে আরফান কিছু না বলেই চলে গেল রুমের বাইরে।বাইরে এসে দেখল জবাব বার ও তার বউ মিলে রান্নার জোগাড় করছে।জব্বার একটু নিম্নবিত্তের মানুষ তবে সে দিনে যা রোজগার করে তা দিয়েই তাদের সংসার চলে যায়। আরফানকে ভেজা অবস্থায় দেখে জব্বার বলল

-স্যার আমনে এহনো ভিজ্জা আছেন? আপনারে তো একটা লুঙ্গি দিলাম।ওডা আমি কোনো সোমায় ই পরি নাই। আমনে পরতে পারেন।নাকি মোরা গরিব দেইখা পরতে চান না?

– আরে না না একথা না।আসলে আমি লুঙ্গি পড়ায় অভ্যস্ত নই তো তাই।

-কিন্তু স্যার আপনে এহন না পাল্ডাইলে তো ঠান্ডা লাইগা যাইবো।হেতে মেলা সমেস্যা হইবো

জব্বারের কথায় যুক্তি খুজে পায় আরফান।তাই আর কথা না বাড়িয়ে লুঙ্গি টা পড়ে নেয়।সেই কোন ছোটবেলায় একবার পড়েছিল আর এখন পড়েছে।কোনভাবে লুঙ্গি আটকাবে ভেবে পায় না।অনেক কষ্টে গিট্টু দিয়ে পড়েছে।পড়নের শার্ট খুলে ফেলেছে।শার্টের নিচে গেঞ্জি ছিল হাফ হাতার তাই এ যাত্রায় বেচে গিয়েছে।আরফান ওদের কাছে আসলে আরফানকে একটা চেয়ারে বসতে দেয়। আরফান বলে

-আমরা এসে আপনাদের খুব কষ্ট দিলাম মনে হয়।

-কি যে কইলেন স্যার।এতে কষ্ট হইবো কেন? আপনারা হইলেন আমাগো বারির মেহমান।মেহমান হইলো আল্লাহর বরকত।মেহমানগো খাওয়াইলে আল্লাহ খুশি হয়।

-কিন্তু তারপর ও এভাবে হঠাৎ করে আসায় এখন আপনাদের বিপদে পড়তে হয়েছে। এখন আবার আমাদের জন্য রান্না করা লাগছে

-না স্যার এডা কোনো কতাই না। এমনেই মোগো এহন রান্না করা লাগতো।এই বিষ্টির দিনে মোর মাইয়ায় খিচুরি খাইতে ভালোবাসে।হেইতে রান্না করি

-আচ্ছা আপনার মেয়ে আছে?কয়জন ছেলে মেয়ে আপনার?

-দুইডা মাইয়া।একটারে বিয়া দিছি আরেকটারে বিয়া দিতে চাইছিলাম কিন্তু হেয় আবার লেহাপরায় ভালো।হেইতে বিয়া দিই নাই।

-কোথায় আপনাদের মেয়ে

-হেয় গেছে বরো মাইয়ার বারিতে।এই কাছেই হেগো বারি।আইয়া পরবে একটু পরে।

এমন সময় আকাশে অনেক বড় বিদ্যুত চমকালো।আরফান ভাবলো মিহু একা ভয় পেতে পারে তাই ও মিহুর কাছে গেলো।কিন্তু গিয়ে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকলো।কারণ পুরো রুম জুড়ে অন্ধকার। আরফান মিহুকে ডাক দিল

-মিহু?মিহু? আলো নিভিয়ে রেখেছো কেন?

এমন সময়ে একটা ঠান্ডা হাত আরফানের গলায় ছুঁয়ে দিল।তারপর আরফানের মুখে তরল জাতীয় কিছু জিনিস গড়িয়ে পড়ল। আরফান এমনিতে ভয় পায়না।কিন্তু পরিবেশটাই এমন যে ভয় পাওয়া লাগে।কেউ আরফানের চার পাশে ঘুরতে লাগলো।হঠাৎ করেই কেউ বলে উঠলো

– আরফান আদিত্য ভয় পেয়েছেন?

আরফান হালকা ভয় পেয়েছিল।কিন্তু মিহুর গলা শুনে হাফ ছেড়ে বাঁচল।তারপর ফোনের ফ্লাস টা অন করে সামনে তাক করলো।এতক্ষণ ভয় না পেলেও এবার ভয় পেল।ভয়ে মিহু বলে চিৎকার দিল।মিহু আরফানের ভয় পাওয়া দেখে খিল খিল করে হাসতে লাগল। আরফান একটু ভয় পেয়ে গিয়েছিল কারণ মিহু তার পুরো চেহারায় পাউডার আর লাল লিপস্টিক দিয়ে ভয়ংকর ভাবে সেজেছে।মিহুর হাসি থামছেই না।আরফান প্রথমে দিয়াশলাই দিয়ে হারিকেন জ্বালালো তারপর জানালার কাছে গেল।মৃদু এই আবছা আলোতে মিহুর খিল খিল হাসি আরফানের কাছে জীবনের শ্রেষ্ঠ একটা দৃশ্য।মিহু হাসতে লাগল আরফান ও মৃদু হেসে জানালা খুলে হাত বারালো। তারপর হাতে পানি নিয়ে সেটা ছিটিয়ে দিল মিহুর চেহারায়।মিহু তার হাসি থামালো।থামিয়ে একটু সময়ে আরফানের দিকে তাকিয়ে থাকলো।তারপর দৌয়ে গিয়ে বৃষ্টির পানি দিয়ে ভিজিয়ে দিল আরফানকে । আরফানের মুখে আগেই মিহু পানি দিয়ে ভয় দেখিয়ে ছিল। আরফান তার চুল গুলো ঝাঁকিয়ে সামনে থেকে পেছনে নিল। তারপর মিহুর দিকে তাকিয়ে বলল,

-এতক্ষণ আমাকে অন্ধকারে ভয় দেখিয়েছো । এবার আমি তোমাকে আলোকিত ঘরেই ভয় দেখাবো।বলে মিহুর গালে একটা ভালোবাসার পরশ দিল।মিহু এতক্ষণ মজায় মেতে থাকলেও এবার চুপ হয়ে গেল।গালে হাত দিয়ে আরফানের দিকে তাকিয়ে রইল। ওর শিরদাঁড়া বেয়ে কিছু শিহরণ বয়ে গেল।মিহুকে এভাবে জমে থাকতে দেখে আরফান বেরিয়ে গেল।ভাবলো একটু বিস্ময় থাকা অনেক সময় ভালো কিছু ঘটায়।

__________

সারা রাতে নীলু দু চোখ এক করতে পারে নি। মাহিনের পোশাক পরিবর্তন করার জন্য বাধ্য হয়ে নেহালকে ডাকতে হয়েছিল।নেহাল এসে মাহিনকে দেখে অনেক অবাক হয়।নীলু ওকে বলার পরে নেহাল মাহিনের কাপড় চেঞ্জ করে দেয়।কিছুক্ষণ নেহাল ছিল ওর কাছে তারপর নীলু ওকে পিহুর কাছে পাঠিয়ে দিয়েছে।বলেছে এখন যেহেতু মাহিনের জ্বর তেমন টা নেই তাই ওর থাকার কোনো কারণ নেই।নেহাল বলেছিল

– তুই একা মেয়ে মানুষ একটা ছেলের কাছে থাকবি ব্যাপারটা কেমন না?কিন্তু নীলু বলেছে

– আমি থাকবো কই?আমিও তো রুমে যাবো।মাহিন ভাইয়ের জ্বর টা নেমে গেছে তাই থাকার দরকার নাই

যদিও নীলু না থাকার কথা বলেছে তবুও ও ঘুমাতে পারে নি।কারণ বার বার নিজের রুম থেকে উঠে চলে এসেছে।একটু পর পর চেক করছে জ্বরটা কমল কিনা।নীলু যে এগুলো কেন করছে সেটা নিজে বুঝতে পারছে না।শুধু মনে একটা খটকাই লাগছে যে মাহিনের কিছু হয়ে গেল না তো?

এক সময় নীলু মাহিনের খাটের কাছে ওর হাত ধরে ফ্লোরে বসে পড়ল।তারপর ঘুমে চোখ লেগে এলে খাটে মাথা রেখে ওভাবেই ঘুমিয়ে গেল কিন্তু মাহিনের হাত ছাড়ল না।

বৃষ্টি থেমে গিয়েছে অনেক আগেই তবুও এখন ও একটু দমকা হাওয়া বইছে।যার ফলে বাইরে শো শো আওয়াজ হচ্ছে শুধু।হালকা ঠান্ডা পড়েছে তবে সেটা সহনীয় পর্যায়ের।যার ফলে ঘুমটা অনেকেরই গাঢ় হয়েছে।সাহরীর সময় হয়েছে কিন্তু অনেকেই ঘুমে বুদ হয়ে আছে।মাহিনের জ্বরটাও ছেড়ে গিয়েছে।এখন শুধু হালকা একটু গরম।চোখ মেলে প্রথমে স্মৃতিচারণ করল কালকে কি কি ঘটেছিল। ও যে মিহুদের বাড়িতে আছে এটা মনে পড়তেই শোয়া থেকে উঠে বসল।কিন্তু উঠতে গিয়ে হাত টান পড়ায় দেখলো নীলু ওর হাত ধরে ঘুমিয়ে আছে।বেশ অবাক হলো মাহিন। এই মেয়েটা কি খুব ভালো?না হলে ওর সেবা করবে কেন?নীলুর দিকে তাকিয়ে মাহিনের মনে হলো নীলু অনেক নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে আছে।আচ্ছা এই মেয়েটার মুখে কি মায়া আছে? এসব ভাবতে থাকে কিন্তু পরক্ষণেই মনে পড়ে ও মিহুকে ভালোবাসে।ও তাহলে অন্য মেয়ে নিয়ে ভাবছে কেন।হালকা করে নীলুকে ডাক দেয়

-নীলু শুনছো?এই নীলু

নীলু ধড়ফড় করে উঠে গেল।মাহিনকে উঠে বসতে দেখে বলল- আপনি উঠে পড়েছেন?জ্বর কমেছে? দেখি দেখি এদিকে আসুন তো

বলে মাহিনের কপালে হাত দিয়ে দেখল এখন ঠিক আছে।মাহিন নীলুর এমন অস্থিরতা দেখে বলল

– এত অস্থির হচ্ছো কেন? আর আমাকে এভাবে সেবা করার মানে কি

নীলু প্রথমে একটু থতমত খেল কিন্তু তারপর সুন্দর করে গুছিয়ে বলল- ঘরে কেউ নেই।পিহু ভাবিও অসুস্থ, তাই নেহাল ভাই তার কাছে।এখন আমি কিভাবে একজন অসুস্থ মানুষকে ফেলে রেখে যাই।আচ্ছা আমি গেলাম

বলার পরে নীলু দৌড়ে নিজের ঘরে চলে গেল।মাহিনের দিকে তাকালে কেমন যেন ওর ভেতরে অস্থিরতা কাজ করে।এক প্রকারের মিশ্র অনুভূতি কাজ করে যেটা ও কাউকে বোঝাতে পারছে না আবার নিজেও বুঝতে পারছে না।মাহিনের দিকে তাকালেই নীলুর কেমন যেন লাগে।

—–

সাহরীর সময়ে আরফানের ঘুম ভেঙে গেল। ছোট এই খাটটিতে দুজনের খুব কষ্ট করে ঘুমাতে হলো কিন্তু এই কষ্টের মাঝেও আরফান এক ধরনের তৃপ্তি বোধ করছে কারণ মিহু ঘুমের ঘোরে আরফানকে জড়িয়ে ধরেছে।আরফান বারে বারে চায় এই সময় টা যেন থেমে যায়। ওর খুব আফসোস হয় যে ওর কাছে কোনো টাইম থামানোর যন্ত্র নেই।কিন্তু এটা এক দিক দিয়ে ভালো যে এই সময়টা শুধু ও একাই অনুভব করতে পারবে।আর সেইটা ভেবেই খুশী হবে।কোনো একটা জিনিস বেশী পেয়ে গেলে সেটার আর মূল্য থাকে না।এই সময় টা চলে যাচ্ছে এটাই ভালো বিষয় কারণ এই সময় টা স্মৃতিতে থেকে যাবে ওর কাছে । আরফান মিহুকে ডাকল

-মিহু,মিহু।উঠে পড়ো সাহরীর সময় হয়েছে।

#চলবে

(ভুলত্রুটি ক্ষমা সুলভ দৃষ্টিতে দেখবেন।)