#হৃদয়জুড়ে_প্রেয়সীর_আভাস
#পর্ব_১১
#মোহনা_হক
‘নিশ্চুপ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে রুয়াত। তাকে একবার পা থেকে মাথা পর্যন্ত পর্যবেক্ষণ করে নিলো আয়াজ। অনেক সময় হয়ে গিয়েছে রুয়াত চুপ হয়ে আছে। বিষয়টা খুব সহজে হজম করতে পারলো না আয়াজ।’
-‘কথা বলছো না কেনো? রাজি তুমি?’
‘রুয়াত ঘাবড়ে গেলো। কি উত্তর দিবে। আর প্রশ্নগুলোই বা কি। সব যেনো মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে তার।’
-‘হাতে এখনো ব্যাথা পাওনি। তাই কথা বলছো না?’
‘জোরে একটা নিঃশ্বাস নিয়ে বললো-
-‘করুন প্রশ্ন। আমি রাজি।’
‘ভ্রু কুচকালো আয়াজ। অবশেষে কথা বললো।’
-‘কলেজে তোমার সাথের মেয়েটি কে ছিলো?’
‘উত্তর দিতে বেশিক্ষণ সময় নিলো না রুয়াত। কিন্তু ভাবার কথা আয়াজ এসব জানে কিভাবে?’
-‘আমার ফ্রেন্ড। নিমি।’
‘আয়াজ রুয়াতের হাত আলগাভাবে ধরলো। রাগ কন্ট্রোল করা দরকার। আবার কিসব ভেবে আগের মতো হাতটা ধরলো। রুয়াত চোখ তুলে আয়াজের দিকে তাকায়। লোকটার এরূপ ব্যবহারের কারণ জানে না সে।’
-‘আজ যে ছেলের সাথে কথা বলেছো সে কে ছিলো?’
‘রুয়াত শুধু অবাক হয়ে চেয়ে আছে। আয়াজ কি তাকে সন্দেহ করছে? তার পিছনে কি আবার লোক লাগিয়েছে? এতোটা বাজে ভাবে আয়াজ তাকে?’
‘রুয়াতের উত্তর দিতে দেরি হয়েছে বলে আয়াজ তার আর রুয়াতের মাঝের দূরত্ব কমিয়ে দিয়েছে। নড়চড়ে উঠে রুয়াত। আশেপাশে তাকায় মেয়েটা।’
-‘ কথা না বললে আরও দূরত্ব কমিয়ে দিবো। যা আপনার পছন্দ হবে না।’
-‘আপনি আমায় সন্দেহ করছেন?’
-‘না। আমি শুধু জানতে চাচ্ছি। ‘
-‘একটা ছেলে ছিলো। আমার আর নিমির ফ্রেন্ড হতে চেয়েছিলো।’
‘থামে রুয়াত। পরক্ষণেই আবার বলে-
-‘তারপর আমি মানা করে দিয়েছি।’
‘আয়াজের রাগ কমে। ভুবন ভুলানো হাসি দেয়। এবার রুয়াতকে একটা জিনিস দেওয়া দরকার। সত্যি কথা বলেছে সে। রুয়াত কে কখনো সন্দেহ করার প্রশ্নই আসে না। শুধু জানতে চেয়েছে ছেলেটি কে। এমপির হবু বউয়ের সাথে কথা বলতে এসেছে একটু তো সাহস আছে বলতে হবে।’
-‘মাথা তুলে আমার দিকে তাকাও।’
‘মাথা নিচু করে রাখা রুয়াত মাথা উপরে তুলে। তার কিছু বলার নেই। মনটা একদম বিষিয়ে গিয়েছে। আয়াজ কেনো তাকে এসব জিগ্যেস করেছে বুঝে গিয়েছে।’
-‘আমি প্রথমেই বলেছি সত্যি কথা বললে তোমার হাতে অধর ছুঁয়ে দিবো।’
‘সর্বাঙ্গ শরীর কেঁপে ওঠে রুয়াতের। তা দেখে হেসে ওঠে আয়াজ। রুয়াতের হাত সামনে এনে ধরে। যেহেতু মেয়েটা ভয় পাচ্ছে সেহেতু কোনো কিছুই করলো না। রুয়াতের মুখপানে তাকিয়ে দেখে কাঁদছে সে। অবাক হয় আয়াজ। রুয়াতের ভালো লাগবে না দেখে কিছু করলো না এখন দেখছে অকারণেই কাঁদছে মেয়েটা।’
-‘কাঁদছো কেনো? আমি কিছু করিনি তো।’
‘নিশ্চুপ সে। কোনো সাড়াশব্দ নেই। শুধু অঝোরে চোখ দিয়ে পানি পড়ছে। হঠাৎ রুয়াতের কাঁদার মানে বুঝলো না আয়াজ। মেয়েটির গালে হাতের নরম স্পর্শ ছুঁয়ে দিয়ে বলে-
-‘কি হয়েছে তোমার? আমায় বলো। এই আর তোমায় মানা করেছি না আমার সামনে কাঁদবে না?’
‘কান্নারত অবস্থায় রুয়াত বলে-
-‘আপনি আমায় সন্দেহ করেছেন তাইনা! এজন্য এমন রাগ দেখিয়েছেন।’
‘আয়াজ চোখ ছোট ছোট করে ফেললো। তার মনে এসব কিছুই আসেনি আর বোকা মেয়ে উল্টো পাল্টা ভেবে বসে আছে। নিজ হাতে রুয়াতের চোখের পানি মুছে দেয়। এখানে আসার প্রথম কারণ আজ একবারও রুয়াতের সাথে দেখা হয়নি। যেনো তার হৃদয় অশান্ত হয়ে আছে একবার প্রেয়সীর মুখখানা দেখার জন্য। বাকি সব পরে।’
-‘প্রথমত আমি তোমার সাথে দেখা করতে এসেছি। দ্বিতীয়ত ছেলেটি কে সেটা জানার জন্যই এখানে আসা। এমপির হবু বউয়ের সাথে কথা বলতে আসবে এতো সহজ?’
‘রুয়াত তাকায় আয়াজের দিকে।
-‘কেনো? কেউ কি আমার সাথে কথা বলতে আসতে পারবে না? আর আপনি লোক লাগিয়েছেন আমার পিছন?’
‘হাসে আয়াজ। বোকা মেয়ের বোকাসোকা কথাবার্তা। তবে এখানে একটি কথাও ভুল নেই। সবগুলোই সঠিক।’
-‘উহু বাহিরের মানুষের সাথে কথা বলা নিষিদ্ধ তোমার। এখন কেউ জানে না আমাদের ব্যাপার যখন জানবে তখন কোনোমতেই কথা বলা যাবে না। আর লোক লাগিয়েছি তোমার সেফটির জন্য। ভুলভাল ভেবে বসে থেকো না।’
-‘আপনার রাজনীতির আমি কেনো কষ্ট করবো?’
‘গাড়িতে হেলান দিয়ে দাঁড়ায়। রুয়াতের এ কথার কোনো যুক্তি নেই। একদম অযুক্তিযুক্ত কথা বলেছে সে।’
-‘কোঁথায় কষ্টের কথা উল্লেখ করেছি আমি?’
‘অধর কাঁটে রুয়াত। ঠিকই তো আয়াজ একবারও কষ্ট শব্দটি বলেনি।
-‘রুয়াত ফাইরোজ তয়ত্রী আপনার তো খুব সাহস বেড়েছে রাতে একজন এমপিকে কল দিয়েছেন আপনি।’
-‘আমি শুধু আপনার খোঁজ নেওয়ার জন্য কল দিয়েছি। আমার আর কোনো উদ্দেশ্য ছিলো না।’
-‘চলে যাবো আমি?’
‘রুয়াতের মন চাচ্ছে বলতে না। কিন্তু বললেই তো আবার চেপে ধরবে।’
-‘কাল বাসায় আসেননি। মা আমায় বকেছে।’
‘সটান হয়ে দাঁড়ায় আয়াজ।’
-‘আজ যেতে পারি।’
‘রুয়াতের নজর আয়াজের দিকে। খুব স্নিগ্ধ লাগছে আয়াজ কে। আবার তৎক্ষনাত চোখ সরিয়ে নেয়।’
-‘আপনি বাসায় আসলে মা বাবা খুশি হবে।’
-‘আর তুমি?’
‘এমন কথার উত্তর নেই আসলে। আর কখনো দিতেও পারবে না সে।’
-‘তোমার উত্তর চাই না। শুধু একটা কথাই মনে রাখবে তোমার নজর শুধু আমাতেই সীমাবদ্ধ থাকবে। দু’বার বলা হবে না তোমায়। আশাকরি বুঝেছো।’
‘মাথা নাড়ায় রুয়াত। আয়াজ পাঞ্জাবীর কলার ঠিক করে হাঁটা শুরু করেছে। পিছন পিছন হাঁটছে রুয়াত। আয়াজের বড় বড় পায়ের সাথে পাল্লা দিতে পারছে না। গুটিশুটি পায়ে হাঁটছে। একবার পিছনে তাকায় আয়াজ। পথ শেষ হলে আয়াজ থামে রুয়াতের বাসার সামনে। দরজার পাশেই রুম থাকাতে ভিতরের সব দেখা করা যায়। সোফায় এক অপরিচিত পুরুষ দেখে ভ্রু কুচকে আসে তার। মজুমদারদের বাসায় ছেলে। প্রাপ্তবয়স্ক। মাথা নিচু করে হাঁটায় রুয়াত ধাক্কা খায় আয়াজের সঙ্গে। লজ্জায় ছিটকে সরে যায়। যেনো এক লোহার সাথে ধাক্কা খেয়েছে।’
‘পাশ ফিরে রুয়াতের দিকে তাকায় আয়াজ। আস্তে করে বলে-
-‘তোমাদের বাসার এই ছেলে কে?’
-‘ফুপির ছেলে। ওনারা এসেছেন আজ।’
‘সামনের দিকে পা বাড়ায় আয়াজ। আদিব মাথা তুলে দেখে। আয়াজ কে সামনাসামনি দেখছে। ইনিমার বিয়ের সময় সে ছিলো না। সে সুবাদে দেখাও হয়নি। আর সব সময় আয়াজ কে টিভি দেখেছে। বাস্তবে এভাবে দেখা হয়ে যাবে ভাবতে পারেনি। নিজের চক্ষু কে বিশ্বাস করতে পারছে না। এই ফাঁকে তাড়াতাড়ি পা ফেলে রান্নাঘরে যায় রুয়াত। আবিদ অপ্রত্যাশিত হেসে আয়াজের সাথে হাত মিলালো।’
-‘আমি আবিদ। ইনিমার ফুপাতো ভাই।’
‘আয়াজ হাসে। রুয়াত গিয়ে মেহরুবা কে ডেকে আনে। হান্নান মজুমদার ও এসেছেন। সবাই প্রায় অবাক আয়াজ হঠাৎ এসেছে বলে। এমনিও আসে না। সবার সাথেই কথা বলেছে আয়াজ। রুয়াতের ফুপি ও এসেছেন আয়াজ কে দেখতে। সবার মাঝে চুপটি করে দাঁড়িয়ে আছে রুয়াত। সবার সাথে কি ভালো ভালো কথা বলছে। আর সব বকা তাকেই দেওয়া হয়।মেহরুবা নাস্তা দেয় আয়াজ কে। মেহরুবা বেশ খুশি আয়াজ আসাতে। যখন ইনিমার সুবাদে তার সাথে পরিচয় তখন ভুলেও আসত না। আজ এসে একদম সারপ্রাইজড করে দিয়েছে মেহরুবা কে। হান্নান মজুমদার জোর করে আয়াজ কে রাতের খাবার খেয়ে যাওয়ার জন্য। কিন্তু সে কোনোমতেই রাজি হলো না। বাসায় যেতে হবে তার। সবার সাথে কথা বলতে বলতে অনেক দেরি হয়ে গিয়েছে। আজ ড্রাইভার বা গার্ড কাউকে নিয়ে আসেনি। অপর পক্ষ থেকে যেকোনো রকম অ্যাটাক আসতেই পারে। তবে সব সময় না। আর সে যে এখানে এসেছে কারও জানার কথা ও না। যদি কেউ জেনে যায় তখন সমস্যা হতে পারে। সবার থেকে বিদায় নিয়ে আয়াজ বাসায় যাওয়ার জন্য উদ্যত হয়। একবার রুয়াতের দিকে তাকায়। রুয়াত ও তার দিকে তাকিয়েছিলো। নজর সরিয়ে আয়াজ বের হয়ে পড়ে বাসা থেকে আদিব তার সাথে গিয়েছে।’
‘রুমে এসে শুয়ে পড়ে রুয়াত। তার ফুপাতো বোন তুলিও তার সাথে এসেছে। রুয়াতের পাশে শুয়ে পড়ে সে। বেশ কৌতূহল নিয়ে জিগ্যেস করে-
-‘আয়াজ ভাইয়া কি সাধারণ মানুষের সাথে কথা বলে না রুয়াত আপু?’
‘রুয়াত পাশ ফিরে দেখে তুলি শুয়ে আছে তার সাথে। তুলির চুলে হাত বুলিয়ে দিয়ে বললো-‘
-‘সবার সাথেই কথা বলেন।’
-‘ওহ্।’
‘রাতের খাবার না খেয়েই ঘুমিয়ে যায় রুয়াত। অভ্যাস আছে তার। মাঝে মাঝে এমন করে সে। মেহরুবা ডাকতে এসেছেন। রুয়াতের থেকে কোনো সাড়া না পেয়ে চলে যায়। এখন গলা ফাটিয়ে চিৎকার করলেও রুয়াত উঠবে না জানে। মেয়ের এরূপ কান্ডে বিরক্ত প্রায় তিনি। সব সময় নিজের খাওয়া দাওয়া নিয়ে ছেলেখেলা করে। জিদ দেখিয়ে চলে যান তিনি।’
‘হুড়োহুড়ি করে সাতসকালে ঘুম থেকে ওঠে রুয়াত। আজ ভীষণ দেরি হয়ে গিয়েছে। একপ্রকার তাড়াতাড়ি নাস্তা খেয়ে রেডি হয়ে কলেজ এসেছে। হান্নান মজুমদার পৌঁছে দিয়েছেন রুয়াত কে। দু দিন পর তাদের বিদায়। তাই কলেজ কে সাজানো হচ্ছে। রুয়াতের মনে হলো এইতো সেদিন কলেজে ভর্তি হলো। দু দিন পর বিদায় হয়ে যাবে। দীর্ঘ নিঃশ্বাস বেরিয়ে এলো তার। কতশত স্মৃতি জড়িয়ে আছে এ কলেজের সাথে। রুয়াত কলেজের সাজানো দেখতে দেখতে ক্লাসরুমে ঢুকে। সারা ক্লাস চোখ বুলিয়েছে। নিমি কোঁথাও নেই। ক্লাসরুম থেকে বের হয়ে এসে দেখে নিমি আজ তার জায়গায় বসেছে। দূর থেকে নিমি তার চকচকে দাঁত গুলো দেখে হাসি দিয়েছে। রুয়াত ও মুচকি হাসে৷ আবার হাসি বন্ধ হয়ে যায় নিমির কর্মকান্ডে। মানা করার পর দৌড়ে আসছে। মেয়েটা আর বড় হলো না।
‘নিমি বেশ একটা জমজমাট খবর নিয়ে এসেছে এখানে। কিন্তু কথাটা বলার আগেই ধমক দেয় রুয়াত।’
-‘কতবার বলেছি আমায় দেখলে দৌড়ে আসবি না। দরকার হলে জোরে হেঁটে আসবি। কখনো যদি আবার দেখি দৌড়ে এসেছিস আমি কিন্তু তোর সাথে কথা বলবো না।’
‘মন খারাপ হয় নিমির। সে কোনো কথা না বলেই আবার উল্টো দিকে হাঁটা শুরু করেছে। রুয়াত বুঝেছে নিমি রাগ করেছে। নিমি কে জড়িয়ে ধরে বলে-
-‘আমি তোর ভালোর জন্য বলেছি নিমি। রাগ করিস না।’
‘নিমি হেসে দেয়। সে একটু অভিনয় করেছে। রুয়াতের হাত চেপে ধরে বলে-
-‘আরে বাদ দে। আমি এতো রাগ করতে পারি না। তোর সাথে তো একদমই না। আমি কি কখনো তোর সাথে রাগ করেছি নাকি। আচ্ছা জানিস এবার আমাদের বিদায় অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি হিসেবে কে আসবেন?’
‘দু দিকে মাথা নাড়ায়। অর্থাৎ সে জানে না।’
‘নিমি বেশ আগ্রহ নিয়ে বলে-
-‘তোর হবু বর এমপি সাহেব থাকছেন এবার প্রধান অতিথি হিসেবে। ‘
#চলবে..