হৃদয়দহন পর্ব-০৪

0
64

#হৃদয়দহন (৪)

সকাল সকাল ঘটনা ফাঁস হয়ে গেল। অপরা তখন সবে মাত্র এক টুকরো পরোটা মুখে দিয়েছে। ওমনি ছোট মা এসে বললেন,”অপু, এত বড়ো ঘটনা ঘটে গেল, তুই কেন বলিস নি আমাদের?”

অপরা তখনো বুঝতে পারে নি। ও খাবার টুকু চিবিয়ে শুধাল,”কোন ঘটনা ছোট মা?”

“রুবিনাকে দেখতে এসে তোকে পছন্দ করেছে যে। আর রুবিনার মা তোকে কথা শুনিয়েছে।”

অপরা মৌনতা ধরে রাখল। বড়ো মা এসে বললেন,”কী হয়েছে রে?”

“জানো আপা, বড়ো ঘটনা ঘটে গিয়েছে। রুবিনাকে দেখতে এসে অপুকে পছন্দ করেছে। আর সেই জন্য অপুকে কথা শুনিয়েছে।”

বড়ো গিন্নির দু ভ্রু কুঞ্চিত হলো। এগিয়ে এসে অপরার পিঠে হাত রাখলেন।

“কী রে, এসব ঘটে গেল। আমরা কেন জানি না?”

“তেমন কিছুই হয় নি বড়ো মা।”

“তেমন কিছু হয় নি? তুই বেশি কেন বুঝিস। তোকে কথা শোনাবে, আর আমরা চুপ করে থাকব?”

অপরা ওঠে এল। বড়ো মা কে জড়িয়ে ধরে বলল,”হয়েছে তো, অয়ন ভাইয়া ও চাচিকে বলে এসেছে। আর কিছু করতে হবে না।”

“কেন হবে না? আলবাত হবে। তোর চাচ্চু ফিরলেই আমি বলব। এত বড়ো সাহস।”

কথাটা বললেন ছোট মা। অপরা ফ্যাল ফ্যাল করে চেয়ে রইল। বড়ো গিন্নি বললেন,”ঠিক আছে। যা হবার হয়েছে। অয়ন তো বলেই এসেছে। তবে অপু, একটা কথা মাথায় রাখবি, তোকে কথা শোনালে, একদম চুপ থাকবি না।”

অপরা বুঝদার বাচ্চার মতন মাথা নাড়াল। এদিকে কথার লেট হয়ে গেছে। সে ক্রস বেল্ট অর্ধেক লাগিয়েই ছুটে এসেছে।

“আমাকে খাবার দাও। লেট হয়ে গেল।”

ছোট গিন্নি খাবার আনতে ছুটলেন। তার মেয়েটা সারাদিন টইটই করে ঘুরে, রাত হলে ফোন ঘাটাঘাটি করে, আর সকাল বেলা পড়ে পড়ে ঘুমায়। শেষমেশ এমন লেট হয়ে যায়। আর তাড়াহুড়ো করে। যার ফলে সবাইকে বেগ পেতে হয়।

অপরা আর কথা খাবার চিবুচ্ছে। কথা কাল সুযোগ পায় নি অন্তিম ঘটনা জানার। তাই এখন সর্তক হয়ে বলল,”ঘটনার কী হলো অপুবু?”

“কী হবে?”

“অয়ন ভাইয়া কিছু বলে নি?”

“বলেছে, তবে এসবের দরকার ছিল না।”

“ঠিক হয়েছে। আরো অনেক কিছু বলার দরকার ছিল। আস্ত শ য় তা ন মহিলা। কারো সাথে বনিবনা হয় না।”

ষোড়শী চুপ। তার ইচ্ছে হয় না মানুষটার নামে খারাপ কথা বলতে। কারণ এইটুকু উপলব্ধি আছে, রুবিনাবু’র বিয়েটা তার জন্যই ভেস্তে গিয়েছে। যদিও সে ইচ্ছে করে করে নি, তবু ভেতর থেকে খারাপ লাগা কাজ করছে। কেন যে কাল যেতে হলো। না গেলে এমনটা হতো না।

বাড়ির সব থেকে বড়ো ছেলে কিয়ান। একদম চুপচাপ শান্ত মেজাজের। অয়নটা ঠিক যত বিচ্ছু, কিয়ানটা ঠিক ততটাই শান্ত। নিজের কাজ নিজেই করে। এমনকি আসরেও তাকে দেখা যায় না। যদিও সে বাড়ির ছোট কর্তার ছেলে, তবু বয়সের দিক থেকে অয়নের দু বছরের বড়ো। অয়ন দরজায় এসে ঠকঠক করল। কিয়ান তখন ছবি আঁকতে ব্যস্ত। ছেলেটা এই আঁকা আঁকিতে কোন মোহ যে খুঁজে পেল। অয়নের বুঝে আসে না।

“অয়ন, ভেতরে আয়।”

“তোমার এই আঁকা আঁকির ভূত এ জন্মে নামবে কী?”

সমস্ত ঘর রঙের ছিটেতে ভরে গিয়েছে। কেমন একটা রঙের গন্ধ ও নাকে আসছে। কিয়ান হেসে বলল,”এটা একটা শিল্প, চর্চা না থাকলে হারিয়ে যাবে।”

“উফ, তুমি শুধুই বড়ো বড়ো কথা বলো। একটা বিষয় বলো, এই অবধি আঁকাআঁকি দিয়ে কিছু করতে পেরেছ?”

“সে তো, তুই ও পারিস নি। পেরেছিস কী?”

“আমি ফাইনাল ইয়ারে ব্রো, দেখবে এক্সামটা দিয়েই দারুণ এক চাকরিতে ঢুকে যাব।”

ওর কথায় কিয়ান হাসল। সে গ্রাজুয়েশন দিয়েছে আরো তিন বছর আগে। ছোট থেকেই বেশ মেধাবী ছিল। তবে এই মেধা কোনো কাজেই লাগে নি। একটা বছর ঘুরেও সে কোনো চাকরি পায় নি। পায় নি বললেও ভুল হবে, পেয়েছিল অবশ্য। তবে সেটা খুবই নিম্ন পদে, অথবা চাকরির পূর্বে বেশ টাকা খরচা করতে হবে এমন কিছুতে। সেসবে আর যোগ দেওয়া হয় নি কিয়ানের। শেষমেশ এই আঁকাআঁকির কাজ ই করতে লাগল। যদিও মাঝে মধ্যে বাজারের পারিবারিক বড়ো মিষ্টির দোকানটায় যাওয়া আসা হয়। কোনো বড়ো সড়ো অর্ডার থাকলে। সব মিলিয়ে এভাবেই চলছে কিয়ানের জীবন। অয়ন অনেক সময় ধরেই গিটারটা দেখে চলেছে। এক সময় দুই ভাই গিটার বাজাতো, গান বাজনা করত, তবে এখন আর সেটি হয় না। সব কেমন হারিয়ে গেছে।

অপরা আজ কলেজ যায় নি। এর একটি কারণ ও রয়েছে। তার কলেজে উইকলি এক্সাম হয়। আর সেই এক্সামের ক্রোয়েশ্চন হয় ভীষণ কঠিন। অপরা ডাহা ফেল করবে বিধায় যায় নি। এদিকে এক্সাম না দেওয়াতে অয়নের ফোনে ম্যাসেজ এসেছে। সেটা দেখেই ও চ্যাঁচিয়ে ওঠল।

“অপরা, এই অপরা। কোথায় রে তুই। বাঁদর, তুই আজ কলেজ কেন যাস নি?”

পেট ব্যথার নাটক করছে অপরা। ছোট গিন্নি এসে জানাল মেয়েটার শরীর খারাপ। অয়ন ঠোঁট কামড়ে বলল,”ওর অভিনয় সব। দেখাচ্ছি মজা।”

ছোট থেকেই অয়ন একটু বিচ্ছু ধরণের। বাড়ির দুটো মেয়েকেই চাপের মধ্যে রাখে। অপরা একটু বেশিই ফাঁকি দেয় পড়াশোনাতে। সেই জন্য আরো বেশি বকা খায় অয়নের কাছে। অয়ন ষোড়শীর ঘরে এসে দেখল বালিশ পেটে চাপা দিয়ে ঘুমাচ্ছে। বোঝাতে চাইছে, মেয়েলি বিষয়। শুরুর দিকে এসবে থেমে যেত অয়ন। তবে যখন থেকে বুঝেছে, মেয়েটি নাটক করে, তখন থেকে ওর মায়া দয়া হাত থেকে হাঁটুতে নেমে এসেছে। ও অপরাকে টেনে ওঠাল। ষোড়শী অসহ্য নয়নে বলল,”শরীর ভালো না অয়ন ভাই।”

“নাটক করছিস? আমাকে বোঝাতে চাচ্ছিস?”

“সত্যিই ভালো না। আপনি তো মেয়ে না। বুঝবেন না।”

“মা কে ডাকব? জিজ্ঞাসা করব,সমস্যা কী?”

অপরা অসহায় দৃষ্টিতে চাইল। বড়ো মা কে ডাকলেই সমস্ত নাটক ফাঁস হয়ে যাবে। তার সমস্যাটি শুরু হবে আরো অনেক দিন পর। কোনো অজুহাত ই কাজে দিবে না। ওর এমন চুপচাপ অবস্থা দেখে আরেক দফায় ধমকাল অয়ন। এতে মুখ ভাড় করে রইল ষোড়শী।

“পড়াশোনা না করলে ঘরে রেখে কী করব? বিয়ে দিয়ে দেই? দাদিজান কে বলব? বলব কী?”

অপরার মাথায় তৎক্ষণাৎ দুষ্টুমি খেলে গেল। ও ভেংচি কেটে বলল,”বলেন, দাদিজান আপনার ঘাড়েই ফেলবে।”

ওর কথায় অবাক হলো না অয়ন। মেয়েটা মাঝে মাঝে বড়ো সত্য কথা বলে ফেলে।

“পরীক্ষা কেন দিলি না?”

“দিলে ফেল হয়ে যেতাম।”

“তাই বলে নাটক করবি?”

ষোড়শী চুপ। অয়ন দীর্ঘ একটি নিশ্বাস ফেলল। তারপর বলল,”বাসায় টিউটর রাখার ব্যবস্থা করছি। তোকে আর কথাকলিকে পড়িয়ে যাবে। দেখব, কেমন করে পড়াশোনা না করিস।”

অপরার হৃদয় ভেঙে চুরমার হয়ে গেল। কলেজে ভর্তি হওয়ার পর থেকে, সে ভেবেছিল অন্তত প্রাইভেট কোচিং টা বুঝি থেমে গেল। তবে না, সেটি হলো না। অয়ন নামের মানবটি, অপরার সুখ শান্তি সহ্য করতে পারল না।

বাড়ি ফিরেই কথা জানতে পারল বাড়িতে টিউটর রাখা হবে। তার কোচিং করার দরকার নেই। এটা জেনে সে একটু খুশিই হলো। ক্লাস শেষে কোচিং এ যেতে একদমই ভালো লাগে না। এদিকে অপরার মন খারাপ। এত বড়ো হয়েছে সে। এখনই বাসায় এসে টিচার পড়াবে, বিষয়টা কেমন একটা অনুভূতি দিচ্ছে। কথা হাত মুখ ধুয়ে এসে আঁচার নিয়ে এল। চুরি করে এনেছে। মায়ের কড়া নির্দেশ ভালো মতন না শুকানো অবধি আঁচার খাওয়া যাবে না। তবে কথা এসব শুনে না। অপরা এক টুকরো আঁচার মুখে দিয়ে বলল,”কী ঝামেলায় পড়লাম বল তো। এই টিচারকে ভাগাব কেমন করে?”

“ভাগাবে কেন? বাসায় এসে পড়ালে তো ভালোই হবে। বাইরের ঝামেলা কমবে।”

“ধুর, তোকে বলে লাভ নেই। পড়ুয়া কোথাকার।”

কথা সারাদিন যাই করুক না কেন, পড়াশোনায় ভালো। একদম বড়ো ভাই কিয়ানের মতন। অয়ন ও পড়াশোনায় বেশ দুর্দান্ত। শুধু অপরাটাই হয়েছে পড়াচোর। সে প্রায় বছরে প্রায় সব পরীক্ষাতেই ফেইল করত। তবে ফাইনালে গিয়ে কীভাবে যেন পাস করে আসত। তখন বাড়ির সবাই ভীষণ অবাক হয়ে বলত,’হ্যাঁ রে অপরা, নকল করেছিস নাকি? সারা বছর ফেইল করে, এবার পাস করলি কেমন করে?”

চলবে….
কলমে ~ #ফাতেমা_তুজ_নৌশি