#হৃদয়দহন (৬)
কথার মন আজ বিস্তর ভালো। বাড়িতে স্যার এসেছেন। পড়াবেন, কাল থেকে। তার আগে পরিচিত হতে এসেছেন। অয়ন বলল,”কথাকলি, দ্রুত অপরাকে ডেকে নিয়ে আয়।”
কথা ওঠে গেল। তার ভালো লাগছে। কোচিং করতে ইচ্ছে হয় না। অয়নের থেকে দু ব্যাচ জুনিয়র ছেলেটা। বেশ মেধাবী। অয়নের সাথে ভালো পরিচয় ও আছে। বড়ো গিন্নি নাশতা নিয়ে এলেন। টেবিলে খাবার সাজিয়ে বললেন,”বাবা, তোমার নাম কী?”
“আন্টি আমার নাম নুহাশ।”
“সুন্দর নাম, খাবার খাও। লজ্জা পেও না।”
নুহাশ মাথা দোলাল। অয়ন চায়ের কাপ তুলে নিল। তাতে সুখ চুমুক বসিয়ে বলল,”লজ্জা পাচ্ছিস?”
“না ভাই। লজ্জা না। আসলে একটু আন ইজি লাগছে।”
ছেলেটা নম্র, ভদ্র। অয়নের ভালো লাগে। সে কিছুটা দুরন্ত হলেও শান্ত মানুষ তার পছন্দ। নুহাশ চা কাপ তুলে নিয়ে চুমুক বসাল। ওমনি অপরা এসে দাঁড়াল। চোখ মুখ অন্ধকারে নিমজ্জিত। অয়ন চোখের ইশারায় শাসন করল। তবে, অপরার মাঝে কোনো পরিবর্তন এল না। সে ভয় পায় নাকি? পায় না। আবার কখনো সখনো ভয় পায় সে। অয়নের সাথে তার বিচিত্র সম্পর্ক। কোনো কূল কিনারা নেই।
“নুহাশ, ছাত্রীদের দেখে নাও। ও অপরা, আর কথাকে তো দেখেছই। দুজনকেই কিন্তু পড়াতে হবে। অসুবিধা হবে না তো?”
নুহাশ চট করেই বলল,”না ভাই। অসুবিধা কেন হবে? কোনো অসুধি নেই,আমি সর্বোচ্চ চেষ্টা করব।”
“তোমার ওপর ভরসা আছে।”
নুহাশের বাড়ি অন্য এলাকায়। যাতায়াতে অসুবিধা নেই। বাস ধরে মোড় অবধি চলে আসবে। তারপর পাঁচ মিনিটের হাঁটা পথ। পারিবারিক অবস্থা খারাপ নয়। বাবা বেশ অনেক বছর ধরে প্রবাসে আছেন। এত দিন টিউশনি ধরার ইচ্ছে যে ছিল না তেমন না, ইচ্ছে ছিল অবশ্য। তবে কোনো এক অদৃশ্য কারণেই হয়ে ওঠে নি। শেষমেশ অয়ন ভাই যখন অফার দিল, তখন আর না করতে পারল না ও। তাছাড়া টিউশনি করলে বাড়তি টাকাও আসবে। এতে হাত খরচটা আরো মোটা হবে। বিষয়টা মন্দ হবে না। সেই চিন্তা থেকেই এখানে আসা।
অবশেষে ঠিক হলো নুহাশ সপ্তাহে চার দিন পড়াবে। সন্ধ্যার পর। আবার কখনো বা দিনের কোনো এক সময়। ওরা যেহেতু তিন জন ই স্টুডেন্ট, তাই ওভাবেই সময় করে নেওয়া হলো। পুরো ব্যাপারটায় একদমই আগ্রহ নেই অপরার। ও শুধু ক্ষণে ক্ষণে দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলল। নুহাশ চলে গেল। টেবিলে, খাবার গুলো তখনো সাজানো। অন্য সময় হলে অন্তত এক টুকরো কেক নিয়ে খেত অপরা। তবে আজ খেতে ইচ্ছে করছে না। ওর মন মস্তিষ্ক হতাশায় ডুবে আছে। কিয়ান এদিক দিয়েই যাচ্ছিল। অপরার এহেন অবস্থা দেখে শুধাল,”অপু, মুখ ওমন করে আছ কেন?”
“কেমন করেছি কিয়ান ভাই?”
“শুকনো, যেন জীবনের মায়া ত্যাগ করে ফেলেছ।”
“সম্ভবত জীবনটাই থাকবে না আমার।”
“কেন?”
“অয়ন ভাই, বাড়িতে টিচার রেখে দিয়েছেন। ভালো লাগে না আর। ওনি আমাকে দেখতেই পারেন না।”
অপরা ওঠে ক্লান্ত ভাবে চলে গেল। কিয়ান সেদিকে তাকিয়ে ঠোঁট কামড়ে ধরল। এই মেয়েটা আসলেই পড়াশোনা করতে চায় না।
রুবিনা মিষ্টি নিয়ে এসেছে। তাকে আজ দেখতে এসেছিল। ছেলে পক্ষ দারুণ বড়োলোক। টাকা পয়সার অভাব নেই। অয়নের সাথেই ওর প্রবেশ ঘটল। মিষ্টি দেখে অয়ন শুধাল,”কী রে, বিয়ে তবে করেই নিচ্ছিস?”
“হ্যাঁ, অয়ন ভাই। দোয়া করিও, যাতে সুখ উপচে পড়ে আমার কোলে।”
ওর কথায় হেসে ফেলল অয়ন। তারপর বলল,”এভাবে বলছিস কেন? ছেলে পছন্দ না?”
“পছন্দ।”
বলেই চুপ হয়ে গেল রুবিনা। ছেলে তার পছন্দ না। এর পেছনে অনেক কারণ। ছেলের বয়স চল্লিশ ছুঁই ছুঁই। আগে একবার বিয়েও হয়েছে। মায়ের পীড়াপীড়িতে রাজি হতে হচ্ছে তাকে। টাকায় নাকি সুখ হবে। অসহ্য এক অনুভূতি তার সর্বাঙ্গে। রুবিনা ছোট গিন্নির হাতে মিষ্টির পেয়ালা এগিয়ে দিল। ছোট গিন্নি বললেন,”রুবি, তোকে দেখতে এসেছিল নাকি?”
“হ্যাঁ, চাচি।”
“ছেলে কী করে রে?”
“শহরে ব্যবসা আছে। বাড়ি আছে, গাড়ি আছে।”
“বাহ, তাহলে তো বেশ ভালো।”
“হুম।”
রুবিনার কণ্ঠটা কেমন মলিন। ছোট গিন্নি মিষ্টি রেখে বললেন,”মিষ্টির কী দরকার ছিল বল তো। ঘর ভর্তি সব সময় মিষ্টি থাকে। এখন আর কেউ খেতেই চায় না।”
রুবিনা নিরুত্তর। তার কান অবধি কথা গুলো পৌঁছাতে পারে নি। অপরা নেমে এসেছিল। সকালের ঘটনায় তার মেজাজ অশান্ত হয়ে আছে। রুবিনাবু কে দেখে মনটা নিমিষেই খারাপ হয়ে গেল। তার শুধুই মনে হয়, ইস সেদিন যদি ও বাড়িতে সে না যেত। আর ছেলে পক্ষের নজরেও না পড়ত। তাহলে রুবিনাবু’র বিয়েটা হয়েই যেত। অথচ সবটা ভেস্তে গেল। শুধুমাত্র তার জন্য।
সন্ধ্যা ছুঁই ছুঁই। নীলা মাথায় ঘোমটা টেনে বের হতে নিচ্ছিল। ওমন সময় মা ডেকে ওঠলেন।
“এই অসময়ে কোথায় যাচ্ছিস নীলু?”
নীলার হৃদয় ধক করে ওঠল। শুকনো ঢোক গিলল সে।
“কী রে, কথা কানে যায় না?”
“একটু দোকানে যাব মা।”
“এই অসময়ে কেন? কত বার বলি যা লাগবে দিনের বেলায় নিয়ে আসবি। না, কোনো কথাই শুনতে চাস না!”
“এক্ষুনি যাব, আর আসব।”
“লেট যেন না হয়।”
“আচ্ছা।”
নীলা যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচল। দ্রুত পায়ে হেঁটে এসে মোড়ের কাছটায় দাঁড়াল। সন্ধ্যার এই সময়টায় রাস্তার এই দিকটায় মানুষজন থাকে না। ইতোমধ্যেই সোডিয়ামের লাইট গুলো জ্বলে ওঠেছে। যার ফলে পিচ ঢালা রাস্তাটা বড়ো সুন্দর লাগছে। কয়েক সেকেন্ড পর ই অয়ন এসে দাঁড়াল। একদম ঘাড় ঘেঁষে। মেয়েটার চুল থেকে দারুণ সুবাস আসছে।
“এসে গেছি।”
হঠাৎ কণ্ঠে চমকে গেল নীলা। ফল স্বরূপ পিছিয়ে গেল কয়েক পা। এহেন অবস্থা দেখে হেসে ফেলল অয়ন।
“এভাবে কেউ পেছনে এসে দাঁড়ায়?”
রেগে বলল নীলা। অয়ন অবশ্য পাত্তা দিল না। সে বরং এগিয়ে এসে মেয়েটার হাত ধরল। বলল,”দেখি তো তোমায়।”
ফর্সা ত্বকের এই যুবতী একটু বেশিই সুন্দর। অয়ন নিজের চিন্তাকে এড়িয়ে বলল,”ভয় পেয়েছ খুব?”
“পাব না?”
“সরি।”
“এখন বলো তো, কেন ডাকলে?”
“একটু অপেক্ষা করো।”
অয়ন বুক পকেট থেকে সুন্দর স্টোন বসানো ব্রেসলেট বের করল। নীলা তখন ফ্যাল ফ্যাল করে চেয়ে আছে।
“অনেক দিন ধরেই ভাবছি, তোমাকে কিছু দিব। অথচ হচ্ছিলই না। এটা অর্ডার করে বানিয়েছি। তোমার নাম লেখা আছে।”
নীলার দুটো চোখ খুশিতে ঝলমল করে ওঠল। তারপরই খেয়াল হলো, এটা বেশ দামি। ও মুখ অন্ধকার করে বলল,”এত খরচ কেন করতে গেলে?”
“আমাদের সম্পর্কের কত দিন হয়ে গেল, অথচ তোমায় কিছুই তো দেই নি।”
“সে তো আমিও দেই নি।”
“উহু, দিয়েছ।”
নীলা প্রশ্ন নিয়ে তাকাল। অয়ন হেসে বলল,”এই যে তুমি, তোমাকেই তো তুমি দিয়ে দিয়েছ। আর কী চাই আমার, বলো তো?”
নীলার চোখ মুখ দ্যুতিতে মিলে গেল। কী এক সুখে তার অন্তর ডুবে আছে। অয়নের প্রতিটা কথা, ভীষণ ভাবে প্রভাবিত করে তাকে।
কথা আর অপরা এসেছিল দোকানে। সন্ধ্যায় নুডলস খাবে তারা। অথচ সস শেষ হয়ে গেছে। নুডলসে সস না দিলে মজা হয় না। তাই সেটাই আনতে বের হয়েছিল। তখনই নীলা আর অয়নকে দেখতে পেল। দুজনে কথা বলছে। কথার চোখ দুটো বড়ো হয়ে গেল। সে ভীষণ চালাক প্রকৃতির।
“ওরা প্রেম করছে, অপুবু?”
অপরা কি বলবে বুঝতে পারছে না। ও বিরোধ করতেই যাচ্ছিল। ওমন সময়ই নীলার হাতটা নিজের হাতের মুঠোয় নিল অয়ন। দুজনের দৃষ্টি একত্র হয়ে আছে। ও হতাশ হয়ে বলল,”দ্রুত এখান থেকে চল।”
“আমাকে দেখতে দাও।”
“কী দেখবি তুই?”
“উফ! দেখতে দাও না। ওরা প্রেম করছে। আমি সিওর পুরো।”
অপরা হতাশ হয়ে চেয়ে রইল। ওর কেবলই মনে হলো, প্রেম করার জন্য পাড়ার এই মোড়ের রাস্তাটাই পেলি তোরা, কেন রে, এলাকায় কী জায়গার অভাব হয়েছে? রাস্তাতেই কেন দুজনকে দেখা করতে হবে!
চলবে….
কলমে ~ #ফাতেমা_তুজ_নৌশি