#হৃদয়দহন (১০)
থমথমে মুখে দাঁড়িয়ে সবাই। অপরার মুখ লজ্জায় রক্তিম হয়ে আছে। এমন অপমান এ জীবনে হয় নি সে! শেষমেশ, তাকে চুন্নি বলা হলো! বিষয়টা একেবারেই মানা যায় না। তবে কিছু বলবে সেই উপায়টিও নেই। অয়নের রগরগে গলার সুরে, প্রতিবেশি’রা ও জেগে ওঠেছে। একেকজনের হাতে একেকটা অ’স্ত্র। কারো হাতে লাঠি, আর কারো হাতে ঝাঁটা। এদিকে কথাকলি চুপ। সে কোনো মতে নিজেকে বাঁচিয়ে তোলার প্রয়াস করছে। অয়নের বাবা এবার মুখ খুললেন। ছেলের দিকে তাকিয়ে বললেন,”এই কাণ্ডটা না করলে হতো না?”
অয়ন কি বলবে? সে কি জানত নাকি, চুন্নি বলে যাকে ধরেছে সে আর কেউ নয়, বরং অপরা। ও বুক ভরে দম নিল। অপরা যখন ঘরে প্রবেশ করেছিল, তখনই ওর ঘুম ভেঙে যায়। শেষমেশ চিলেকোঠার ঘরে কারো অবস্থানের টের হয়। আর তখন ই কাণ্ডটা ঘটিয়ে ফেলে সে। রুবিনা একটু লেট করে এসেছে। সে গতরাতে ঘুমের ঔষধ খেয়েছিল। তাই সজাগ পেতে, লেট হলো। ও এসে কথার কাছে দাঁড়াল।
“কী রে সবাই চুপ কেন? চোর কোথায়?”
কথা শুকনো ঢোক গিলল। তারপর অপুবু’র দিকে চাইল। আহারে,বেচারি।
“অপুবু কে চোর ভেবেছে অয়ন ভাইয়া।”
রুবিনার চোখ বড়ো হয়ে গেল। সে তাকাল অয়নের মুখের দিকে। অয়ন মেকি হাসি দিয়ে নিজের সাফাই দেওয়ার প্রয়াস করল। অতঃপর চারপাশে পুরো বিষয়টা ছড়িয়ে গেল। প্রতিবেশি’রা হেসে যায় যায় অবস্থা।শেষমেশ, অপরাকে চোর মনে করল অয়ন! আহারে অপু, বেচারির সাথে কি তামাশাই না হলো। সকলে যখন চলে গেল অপরা প্রায় কেঁদে ফেলল। শব্দ করে। ছোট গিন্নি এসে মাথায় হাত রাখলেন।
“বোকার মতন কাঁদছিস কেন?”
“আমাকে চুন্নি বলেছে অয়ন ভাই। ইচ্ছে করে এমন করেছে।”
এবার অয়ন জবাব দিল,”বললেই হলো? আমি ইচ্ছে করে করেছি। দোষ তো তোর। এই ভাবে রাত বিরেতে চিলেকোঠার ঘরে কেন গিয়েছিস?”
“ইচ্ছে হয়েছে তাই গিয়েছি। আপনি কেন চুন্নি বলে চ্যাঁচালেন?”
“আমি কি দেখতে পেয়েছি? ওখানে চুন্নিল বদলে তুই দাঁড়িয়ে।”
অপরা আর কথা বলল না। মেয়েটার সাথে কি এক ঘটনা ঘটে গেল। ও দাদিজানের ঘরে গিয়ে বসল। অসুস্থ থাকায় তিনি ওঠে আসতে পারেন না। অপরা গিয়ে সোজাসুজি অভিযোগ করল,”আমি এ বাড়িতে থাকব না। থাকব না একদম। আমাকে চুন্নি বলেছে, চুলে টান ও দিয়েছে। আরেকটু হলে পিঠে দু চারটে থা’প্প’ড় ও বসে যেত।”
কাঁদতে কাঁদতে বলল মেয়েটি। সবাই পিছু পিছু এ ঘরেই এসেছে। দাদিজান হতাশ। সব সময় ওদের দুটোর ঝামেলা হয়। অন্যদিকে কিয়ানের সাথে বরাবরই অপরার মসৃণ সম্পর্ক। দোষটা তাহলে অপরার নয়, বরং অয়নেরই। কিন্তু এখন বেশি কিছু বলা যাবে না। নতুবা কথা আর বাড়তে থাকবে। তিনি সকল কে যেতে বললেন। আর অপরার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললেন,”অপু, আমার কাছেই থাক তুই। তোর অভিযোগ সব শুনব। ঠিক আছে?”
দাদিজানের ঘর থেকে বের হয়ে অয়ন মনে মনে অপরাকে উদ্ধার করতে লাগল। মেয়েটা এই রাত বিরেতে ঘুরাঘুরি কেন করছিল! বিষয়টা বড়ো রহস্যময় লাগছে। ও যখন বিড়বিড় করছে, তখনই নীলার ম্যাসেজ এল। মেয়েটি, জানতে চেয়েছে তাদের বাড়িতে কি হয়েছে। অয়ন ঠোঁট কামড়ে রইল, তাহলে পাড়ার শেষ মাথাতেও ঘটনা পৌঁছে গেছে! তবু পুরো বিষয়টা নীলাকে জানাল অয়ন। মেয়েটা সীন করে সরাসরি কল করল। অয়ন আড়াল হয়ে কল রিসিভ করল। শুরুতেই শুনতে পেল,নীলার হাসি। অসম্ভব সুন্দর হাসির শব্দ। মন ভরে গ্রহণ করতে লাগল ও। এক পর্যায়ে নীলা বলল,”অয়ন, তুমি দেখি মেয়েটার সাথে ঝামেলা করেই যাচ্ছ।”
“এর জন্য কিন্তু তুমি দোষী।”
“ও মা, আমি কী করলাম?”
“সেই যে ছোট বেলায় অপরাকে বোকা বানিয়ে আমার কাছে পাঠিয়েছিলে, বউ হতে চায় যেন বলে। সেই কাহিনীর পর থেকেই ওর সাথে আমার নানান ঘটনা ঘটতেই থাকে।”
“মন্দ কী হুম? ওকে তোমার বউ হলে ভালোই লাগবে।”
“আচ্ছা?
চিবিয়ে বলল অয়ন। নীলা হাসি থামাতে পারছে না। তবু কোনো মতে নিজেকে সামলে বলল,”হুম,হুম।”
“তাহলে তোমার দেখি সতীন আনার বড়ো শখ।”
নীলা আর কথা বাড়াল না। হেসে বলল,”যাই হোক, তুমি কাল ভার্সিটি যাবে তো?”
“যেতে তো হবেই। গুরুত্বপূর্ণ ক্লাস আছে।”
“আচ্ছা, আমি অপেক্ষা করব। ব্রেক টাইমে দেখা করিও।”
“ঠিক আছে।”
কথা শেষ করে পেছন ফিরতেই কথার দেখা মিলল। মেয়েটা ঠোঁট কামড়ে তাকিয়ে আছে। অয়ন কিছু বলবে তার পূর্বেই কথা বলল,”চাচ্চু কে বললে কেমন হয়?”
অয়ন ভ্রু কুঁচকে তাকাল। অপরা’র সাথে থেকে থেকে কথাকলির স্বভাবটাও বিগড়ে গিয়েছে। মেয়েটা হাত চুলকাচ্ছে। অথার্ৎ ঘু’ষ চাই তার!
“বড়ো ভাইয়ের সাথে বেয়াদবি? বড়ো সাহস হয়েছে রে। হাড় ভাঙ’লে টের পাবি।”
কথা শুকনো ঢোক গিলল। অয়ন ভাইকে দিয়ে বিশ্বাস নেই। ও মেকি হাসি দিয়ে বলল,”ঠিক আছে বলব না।”
কথা চলে গেল। অয়ন সেদিকে তাকিয়ে হতাশ। কতদিন এভাবে ঘটনা লুকিয়ে রাখবে,বিষয়টা বড়ো চিন্তার ঠেকছে।
ভোর রাতে কিয়ানের আগমন ঘটল। সে শুনেছে রাতের ঘটনা। আর ঘটনা শুনেই কিছু একটা বুঝতে পেরেছে। ভাগ্যের জোরে দরজা খুলে দিল অপরা। চোখ মুখ লাল। দেখলেই মায়া হয়। কিয়ান মৃদু কণ্ঠে বলল,”কেঁদেছ নাকি?”
অপরার ইচ্ছে হলো সমস্ত অভিযোগ ঢেলে জানাতে। তবে পারল না। শুধু মাথা দোলাল। কিয়ান শুকনো ঢোক গিলল। তারপর সোজা দোতলায় ওঠে গেল। সেদিকে তাকিয়ে অপরার কান্না পাচ্ছে। কেন পাচ্ছে সেটি অবশ্য সে জানে না।
এদিকে কিয়ান সোজা চিলেকোঠার ঘরে চলে এসেছে। ছবিটা এখানেই রাখা। সে বড়ো যত্ন করে লুকিয়ে রেখেছে। ছবি খানা সুরক্ষিত আছে দেখে স্বস্তি মিলল। তবে অপরার আগ্রহ ওকে চিন্তায় ফেলে দিচ্ছে। ও ছবি খানা দেখে এসে নিচে নামল। দেখল তখনো মেয়েটি সোফায় বসে আছে। দুজনের চোখাচোখি হলো। কিয়ান বলল,”ঘুমাতে যাও। শরীর খারাপ করবে।”
অপরা ওঠেই যাচ্ছিল। ওমন সময় অয়নের গলা শোনা গেল,”ঘুমাবে কেন, না ঘুমিয়ে সমস্ত বাড়ি ভূতের মতন ঘুরঘুর করবে। আর আমি চুন্নি বললেই দোষ।”
অপরার কিছু বলতে হলো না। কিয়ান ই বলল,”দোষ শুধুই অপু’র?”
“সেটা বলছি না। কিঞ্চিৎ দোষ আমার ও আছে। আমি মুখ না দেখেই চুন্নি বলে ফেলেছি। তবে কথা হচ্ছে, রাত বিরেতে চিলেকোঠার ঘরে কী করে ও?”
এমন প্রশ্নে গলা শুকিয়ে গেল অপরার। দুজন ব্যক্তির কাছেই সে ধরা পড়তে চায় না। ঘটনা দুজনের একজন জানলেও,বিষয়টা ভালো হবে না। ও কেবল প্রার্থনা করতে লাগল। আর আশ্চর্যের হলো কিয়ান নিজেই ওকে বাঁচিয়ে দিয়ে বলল,”গিয়েছে হয়তো ভালো লাগছিল না বিধায়। সব কথা তো আমাদের বলবে না তাই না।”
সুযোগটা কাজে লাগাল অপরা। ও নাক টেনে বলল,”ঠিক। সব কথা আপনাকে কেন বলব?”
প্রশ্নে অয়নের ভ্রু কুঞ্চিত হলো। এই দুজনের মহব্বত একটু বেশিই বেড়েছে মনে হচ্ছে। ও আর কিছু বলল না। বরং প্রসঙ্গ বদলে বলল,”কাজের কী খবর বলো?”
“ভালো। সারা রাত জেগে কাজ করেছে কর্মচারী’রা। এখন রেস্ট নিচ্ছে।”
“সকাল সকাল প্যাকিং এর কাজ শুরু হবে?”
“হুম। কিছু সময় পর ই চলে যাব।”
অপরা মাঝ থেকে বলল,”এখনই তো এলেন।”
“যেতে হবে দ্রুত। সময় নেই।”
“আমি চা করে দেই। চা খেয়ে যান।”
কথাটা বলেই অপরা ছুটল রান্না ঘরের দিকে। সে দিকে তাকিয়ে অয়নের মুখশ্রী থমথমে হয়ে গেল। মেয়েটা নিজ থেকে তাকে তো কখনো চা করে দেয় নি!
চলবে….
কলমে ~ #ফাতেমা_তুজ_নৌশি