হৃদয়দহন পর্ব-১২

0
140

#হৃদয়দহন (১২)

পাড়ার ছেলেপুলেদের আসরের নতুন টপিক, ফুটবল ম্যাচ। সোলাইমানদের পাড়ায় দারুণ কিছু খেলোয়ার রয়েছে। সেই জন্য বরাবরই নাকাল হতে হয় অয়নদের পাড়ার। এবার ওরা সচেতন হলো। যেভাবেই হোক, নিজেদের নাক বাঁচাতে হবে। এভাবে চলছে না। অয়ন, রুশান, আর মুরাদ। বয়সের ফারাক থাকলেও অনেকটা বন্ধুর মতন মেলামেশা। অয়ন বেশ জোর দিয়ে বলল,”এবার যদি ম্যাচ না জিততে পারি, মান সম্মান কিছু থাকবে না।”

জবাবে মুরাদ মাথা চুলকাল। ওর মাথা চুলকানো দেখে অয়নের কণ্ঠ গুমোট হলো,”মাথা চুলকানো বাদ দিয়ে, ভালো মতন প্র্যাকটিস করবি। এত সুন্দর করে সব সাজিয়ে দেই তবু, গোল দিতে পারিস না।”

“ভাই, গোল যে কটাই হোক আমাদের। ওরা তো বেশি গোল দেয়। রুশান রে বলেন। ও একটা শর্ট ও আটকাতে পারে না।”

অয়ন রুশানের দিকে চাইল। গোল কিপার হিসেবে মাঠে খেলে সে। একটু কাঁচুমাচু হয়ে বলল,”ওরা খুব শক্তিশালী ভাই। এত জোরে শর্ট করে যে, বুঝতেই পারি না।”

“ওরা শক্তিশালী আর তুই কী? ভাত খাস না নাকি?”

“ইয়ে না মানে।”

“গোল কিপার বদলে দিব। তুই ভালো মতন প্র্যাকটিস করবি। যদি কোনো ভুল করিস।”

“ভুল হবে না ভাই।”

“ঠিক আছে। বাকিদের ও জানিয়ে দিবি। এবার যেন ভুল না হয়।”

রুশান আর মুরাদ মাথা দোলাল। ক্যারামের শেষ চাল দিয়ে, বাজিমাত করল অয়ন। হাতে আটা লেগে আছে। সেটা ঝাড়তে ঝাড়তে পেছনে চাইতেই দেখা মিলল রুবিনা আর নীলার। দুজন কথা বলতে বলতে দোকানে প্রবেশ করছে। অয়ন ঠোঁট কামড়ে চাইল। মেয়েটিকে বলেছিল একটু দেখা করতে। অথচ বলল,বের হওয়া যাবে না। এখন ঠিক ই বের হয়েছে!

রুবিনা আর নীলা জিনিসপত্র কিনছে। দুজন সম্ভবত কোথাও একটা যাবে। স্বাভাবিক ভাবেই নীলার সাথে পাড়ার ছেলেদের কথা বলার সুযোগ কম। পরিবার থেকে ভীষণ কড়া নির্দেশনা রয়েছে। তাই অয়ন রুবিনার সাথে কথা বলতে গলা পরিষ্কার করল। সেই শব্দ পেয়ে রুবিনা চাইল। একটু হেসে বলল,”অয়ন ভাইয়া! তুমি এই বেলায় এখানে?”

“খেলছিলাম। তা তোরা এই দুপুরে কী করছিস?”

“জিনিস কিনছি।”

“সেটা তো দেখছি,তবে এত সেজে গুজে কেন?”

“আসলে, নীলাপুর সাথে একটু বের হব।”

নীলার সাথে বের হবে! কথাটা শুনে অয়ন ঘাড় ফিরিয়ে চাইল। নীলা মুচকি হাসছে।

“কোথায়?”

“আপু’র বান্ধবীর বাসায়। তার নাকি বাবু হবে। তাই বাবার বাড়ি এসেছে।”

অয়ন আর ঘাটাল না। চুপচাপ সরে এল। জিনিসপত্র কিনে আগাতে লাগল নীলা আর রুবিনা। যাওয়ার পূর্বে অবশ্য পেছন ফিরল নীলা। অয়ন আর তার চোখাচোখি হতেই মেয়েটি ভেংচি কাটল। অয়ন তখনো ঠোঁট কামড়ে চেয়ে আছে।

নুহাশ পড়াচ্ছে। অপরা পড়ছে কম, ছেলেটাকে দেখছে বেশি। একদম সাদামাটা। এমন ছেলে খুব কম ই দেখা যায়। চোখে আবার চশমা ও আছে! নুহাশ এক পর্যায়ে মেয়েটির দিকে চাইল। দুজনের চোখাচোখি হতেই অপরা মেকি হাসল। সেই হাসিতে নুহাশ যেন লজ্জা পেল। যা স্পষ্ট দেখল কথা। ও একটু অপুবু’র সাথে ঘেঁষে নিল। তারপর বলল,”এটা কী হলো? নুহাশ ভাই কেন লজ্জা পাচ্ছেন?”

“ওমা, আমি কেমন করে বলব?”

“সামথিং ইজ রং অপুবু?”

“একদম বাজে কথা বলবি না।”

“আমি না কেমন সন্দেহের গন্ধ পাচ্ছি।”

“তাই?”

“হুম, হুম। আর তুমি জানো, এই কথাকলির সন্দেহ কখনো….’

কথার কথা শেষ হওয়ার পূর্বেই নুহাশ একটু ধমকে ওঠল। যার ফলে চোখ বড়ো বড়ো হয়ে গেল কথার। ও বেশ ভয় পেয়ে গেছে। নুহাশকে বেশ সিরিয়াস দেখাল।

“পড়ার মাঝে কথা কীসের?”

“আমি তো…’

“হ্যাঁ তুমি তো অপু’র সাথে ফিসফিস করছিলে।”

কথা আর কিছু বলতে পারল না। অপরা’র ও মুখ ভাড় হয়ে গেছে। সব কিছু ফেলে নুহাশ বলল,”অপু।”

ছেলেটাকে লজ্জায় ফেলতে অপরা বলল,”জি স্যার।”

তবে আজ আশ্চর্যের বিষয়টি ঘটল। নুহাশ কিন্তু লজ্জা পেল না। ও বরং চোখ মুখ শক্ত রেখে বলল,”হোম ওয়ার্ক দিয়েছিলাম।”

অপরার গলা শুকিয়ে এসেছে। ও শুকনো একটি ঢোক গিলল। তারপর বলল,”মনে নেই।”

নুহাশ যেন একটু চটে গেল। রেগে বলল,”এর কোনো মানে নেই। এভাবে পড়ানো যায়?”

অপরা মনে মনে বলল,’প্লিজ পড়াবেন না।’ তবে মুখে বলল,”দুঃখিত স্যার।”

নুহাশ তেমন কিছুই বলল না। শুধু নিজের জিনিসপত্র গুছিয়ে নিল। অপরা আর কথা দুজনের মুখ চাওয়া চাওয়ি করল। তারপর দুজনেই দাঁড়িয়ে পড়ল। নুহাশ তার ব্যাগ পত্র নিয়ে বের হয়ে যাচ্ছে। যাওয়ার পূর্বে অবশ্য বলল,”এর পরে যেন কোনো কিছু মিস না হয়।”

নুহাশ সদর দরজা দিয়ে বের হওয়ার সময় কিয়ানের সাথে দেখা হয়ে গেল। দুজনের চোখাচোখি হওয়ায় দুজনেই হাসল। ঘড়িতে সময় দেখে কিয়ান শুধাল,”আজ তাড়া আছে নাকি?”

“জি ভাইয়া কিছুটা।”

“ও,যাও তাহলে।”

বাক্যটি শেষ হতে না হতে পাশ কাটিয়ে চলে গেল নুহাশ। তারপর কিছু পথ এসে লম্বা লম্বা শ্বাস নিল। তার মাথা কাজ করছে না। অপরার প্রতি এমন আকর্ষণ ভেতর থেকে যন্ত্রণা দিচ্ছে!

কিয়ান ভেতরে এসে দেখল কথা আর অপরার মুখ ভাড়। ও একটু ভালো মতন পরখ করে বলল,”কী হয়েছে?”

অপরা কিছু জবাব দিবে তার আগেই কথা বলল,”অপুবু হোম ওয়ার্ক করে নি। সেই জন্য নুহাশ ভাইয়া রেগে চলে গেলেন।”

অপরা আর কী বলবে। ও শুধু কথার দিকে চাইল। মেয়েটা এত বেশি পাকনামি করে। কিয়ান হতাশ হয়ে একটি নিশ্বাস ফেলল। তারপর অপরার দিকে চাইল। অপরা মাথা নিচু করে বলল,”এত কঠিন পড়া, আমার মাথায় না গেলে কি করব?”

সত্যিই তো। বেচারির কী দোষ? আসলে দোষ যে নেই তেমন না। অপরা চেষ্টা খুব কম করে। না পারলে হতাশ হয়ে যায় দ্রুত। কিয়ান বলল,”কী সমস্যা হচ্ছে? নুহাশের পড়া বুঝতে পারো না?”

“পারি। তবে মনে রাখতে পারছি না। হোম ওয়ার্ক দিলে নানান সমস্যা পাই। তখন মনে হয় একজন টিচার পাশে থাকলে হয়তো বেটার কিছু করতে পারতাম।”

আহারে অপরা। মেয়েটা এমন ভাবে বলল যে কিয়ানের বড়ো মায়া হলো। ও নিজের দীর্ঘশ্বাস লুকিয়ে বলল‍,”ঠিক আছে। আমার কাছে এসো। আমি হোম ওয়ার্কে হেল্প করব।”

কথাটা বলে কিয়ান তো চলে গেল। তবে অপরা পড়ল মসিবতে। আরে, এই অভিনয় সে করেছিল, যাতে কিয়ান দরদ দেখায়। বুঝতে পারে তার দোষ নেই। কিন্তু দরদ দেখিয়ে হোম ওয়ার্কে হেল্প করবে, এটা তো আশা করে নি সে। মেয়েটার জ্বালা এবার বাড়ল যেন। ওর মুখের অবস্থা দেখে কথা হেসে ফেলল। অপরা কাঁদো কাঁদো ভাবে বলল,”ছেড়ে দে মা, কেন্দে বাঁচি।”

রাতে অয়নের ম্যাসেজ এল। নীলা তখন খাবার খেতে বসেছিল। ম্যাসেজের টুং শব্দে বাবা, মা দুজনেই ফিরে তাকালেন। ও শুকনো ঢোক গিলল। তারপরই সামলে নিয়ে বলল,”রাইমা ম্যাসেজ পাঠিয়েছে। আসলে অনেক দিন পর দেখা করলাম কী না। তাই কিছু ছবি তুলেছিলাম। সেগুলোই চাইল।”

ওর কথার পৃষ্ঠে আর কিছু বলল না কেউ। ও আস্তে করে ওঠে চলে এল। আড়াল হয়ে লিখল,”একটুর জন্য ধরা পড়ে যেতাম। এমন সময় ম্যাসেজ দেয় কেউ?”

জবাব এল সাথে সাথেই। ম্যাসেজ খুলে নীলা দেখল, অয়ন লিখেছে,”ধরা পড়লেই ভালো হতো। তুমি খুব মিথ্যে বলছো, আমায়।”

“আরে মিথ্যে বলি নি।”

“তাই? সেই জন্যই তখন বন্ধুর বাসায় ঘুরে এলে।”

“আরে বাবা,সেটা তো প্ল্যান ছিল। তোমাকে একটু দেখব বলে।”

“মিথ্যুক।”

“আরে সত্যি, আমি চেয়েছিলাম এক ঢিলে দুই পাখি মা’রতে। আর কিছু না।”

অয়ন কিছু বলার পূর্বেই নীলার বাবা ডেকে ওঠলেন,”নীলা,হয়েছে তোমার?”

“জি বাবা। এই তো আসছি।”

ও দ্রুত ম্যাসেজ টাইপ করল,”বাবা ডাকছে। এখন টা টা। পরে কথা হবে।”

নীলা খাবারের টেবিলে আসতেই ওর বাবা একটু গুমোট হলেন। খাবার প্লেটে নাড়াচাড়া করতে করতে বললেন,”তোমাকে নিয়ে আমি সত্যিই পারি না।”

নীলা একটু কাচুমাচু হয়ে বসল। ওর মা বিষয়টা বুঝতে পেরে বললেন,”থাক না সেসব কথা।”

“থাকবে কেন? জীবনে বড়ো একটা ভুল করে বসল। সরকারি মেডিকেলে চান্স হওয়ার পর ও কী না…..’

তিনি কথাটা আর টানলেন না। খাবার নাড়াচাড়া করে বললেন,”যা হবার হয়েছে। আর কিছুই বলার নেই।”

নীলা চুপ করে রইল। মেডিকেল তার স্বপ্ন ছিল এমন না। বাবা ডাক্তার। ছোট থেকেই চেয়েছেন ডাক্তার বানাবেন। ঐ সুবাদেই পড়াশোনা করা হয়েছে বিজ্ঞান বিভাগ থেকে। মজার বিষয় হলো, অয়ন স্কুল পরিবর্তন করার পরের বছরই স্কুলে বিজ্ঞান বিভাগ চলে আসে। ভাগ্য বোধহয় চায় নি, ওরা এক হোক। তবে নীলা, ভাগ্যকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে অয়নের ভার্সিটিতে ভর্তি হয়েছে। আর তারপরই তাদের অনুভূতি নাম নিয়েছে ভালোবাসার সম্পর্কে।

চলবে….
কলমে ~ #ফাতেমা_তুজ_নৌশি