হৃদয়দহন পর্ব-১৩

0
143

#হৃদয়দহন (১৩)

অপরা আর অয়ন একে অপরের সাথে কথা না বলে থাকতে পারে না। দুজনের কথা বলা লাগবেই। সেটা যে কোনো উপায়ে। এই বিষয়টি একদম ছোট থেকেই ঘটে এসেছে। তবে আশ্চর্যের হলো এবার কয়েকদিন হলো দুজন একে অপরের সাথে কথা বলছে না। দর্শন ও ঘটেছে খুব কম। অয়ন ব্যস্ত ফুটবল নিয়ে, অপরা ব্যস্ত কিয়ানের সেই ছবিটা নিয়ে। ও মনে মনে সেই ছবিতে নিজেকে কল্পনা করে নিয়েছে। বিষয়টা পুরোটাই অবচেতনভাবে ঘটেছে। অপরা এখন স্বীয় কক্ষে বসে আছে। ভাবছে কীভাবে সেই ছবি খানা দেখা যায়। ও যখন এসব ভাবছে তখন ছোট গিন্নি এসে দরজায় নক করলেন। জবাব না পেয়ে ভেতরে প্রবেশ করলেন। উপস্থিতি বোধহয় বুঝতে পারল অপরা। সে চাইল। চাহনিতে প্রাণ নেই যেন। চিন্তায়, উত্তেজনায় কেমন একটা মলিনতা চলে এসেছে।
“অপু, তোর কী হয়েছে রে?”

ছোট গিন্নির কণ্ঠে চিন্তা। অপরা দীর্ঘ একটি নিশ্বাস ফেলল। তারপর ছোট গিন্নির গায়ের সাথে ঘেঁষে পড়ল।
“কিছু না গো।”

“কিছু হয় নি তো, চেহারার এমন দশা কেন? অয়নের সাথে ঝামেলা যায় নি?”

অয়নের নামটি শুনে চমকাল না অপরা। সে ফ্যাল ফ্যাল করে চেয়ে রইল। লোকটার কথা ও ভুলেই বসেছিল। ছোট গিন্নি অপরার মাথায় হাত রেখে শুধালেন,”ঝামেলা কেন করেছিস? তোদের কী ঝামেলার সম্পর্ক?”

“তার সাথে আমার কোনো সম্পর্ক নেই ছোট মা।”

“ও মা, বলিস কী রে। তুই তো সেই ছোট থেকে…..’

অপরা কথায় বাঁধা দিল। ছোট গিন্নির হাত মুঠোয় নিয়ে বলল,”তোমরা সবাই কেন সেই কথা খানা ধরে বসে আছ বলো তো। আমি কি সত্যি সত্যি তার বউ হই নাকি?”

জবাবে ছোট গিন্নি হাসলেন। তারপর বললেন,”অভিমান জমেছে?”

“না।”

“বুঝতে পারছি। অভিমান জমেছে।”

অপরা সরল চোখে তাকাল। অয়নের সাথে তার প্রণয় ঘটিত কোনো সম্পর্ক আছে কী? নেই তো। অথচ বিষয় গুলো এখন কেমন একটা রূপ নিচ্ছে। ওর ভালো লাগছে না। প্রেম, ভালোবাসা’র মতন কঠিন ব্যাপার অপরার মস্তিষ্কে আসছে না। ওর মাথায় এখন গরম ভাত আর সর্ষে ইলিশ চলছে। রান্না ঘর থেকে সর্ষে ইলিশের ঘ্রাণ নাকে এসে লাগছে। অপরার হৃদয় চনমনে হয়ে ওঠল। ও এক ছোটে নিচে চলে এল। এসে দেখল বড়ো গিন্নি মাত্রই তরকারি নামিয়েছেন। অপরা চট জলদি গরম ভাত প্লেটে নিয়ে নিল। বড়ো গিন্নি হেসে ফেললেন।

“পাগল মেয়ে, এসে গেছিস। তোর কথাই ভাবছিলাম। কখন যে আসবি। সর্ষে ইলিশ বলতে তুই আর অয়ন তো পাগল!”

“সর্ষে ইলিশ নিয়ে কথা হবে না বড়ো মা। দ্রুত দাও।”

বড়ো গিন্নি যখন সর্ষে ইলিশ দিচ্ছেন তখনই অয়নের গলা,”আমার জন্য বড়ো পিস রাখবে মা।”

অপরা ভেংচি কাটল। তারপর বলল,”আমি আগে এসেছি। আমার জন্য বড়ো পিস।”

“বললেই হলো নাকি? আমি ওর থেকে বড়ো। তাই বড়ো পিস আমার।”

দুজনের কথা কাটি চলছে। এমন অবস্থা দেখে বড়ো গিন্নি পড়লেন বিপাকে। এদের ঝামেলা থামাতে তিনি বললেন,”কাউকে বড়ো পিস দিব না। বড়ো পিস কিয়ানের জন্য। আর সব থেকে ছোট পিস দুটো তোদের দুজনের।”

অপরা আর অয়ন একে অপরের মুখের দিকে চাইল। দুজন যেন একে অপরকে গিলে খাবে। শেষমেশ দুজনের প্লেটেই ছোট টুকরো এল। তাদের এই ঝগড়ার কিঞ্চিৎ ভাগ শুনেছে কিয়ান। ও এসেই নিজের মাছটা অপরার দিকে তুলে দিল। অপরা বিরোধ করে বলল,”আমি দু টুকরো দিয়ে কী করব?”

“খাবে। আমার তো এলার্জি। আমি খেতে পারব না।”

অপরা ফ্যাল ফ্যাল করে চেয়ে রইল। কিয়ান বরাবরই ওকে স্নেহ করে। একজন ভালো মানুষ বটে। অন্যদিকে অয়ন, সব সময় তাকে বকা ঝকা করে। কাজ করায়, দুজন ই তো একই র’ক্তের। অথচ এতটা ভিন্নতা!

মাছ কাণ্ডের পর্ব তো শেষ। এখন শুরু হলো চায়ের কাণ্ড। বিকেলের এই সময়টায় চা না হলে অয়নের চলে না। সবাই দুপুরের খাবার খেয়ে ঘুমিয়ে আছে। অপরাই বসার ঘরে বসে টিভি দেখছিল। অয়ন মনে মনে মেয়েটিকে উদ্ধার করতে লাগল। আজকাল যা অবাধ্য হয়েছে। কিছু সময় পর গলা পরিষ্কার করে বলল,”এক কাপ চা বানিয়ে আন তো।”

অপরার হাতে চিপস। সে খাচ্ছে আর টিভি দেখছে। কোনো পরিবর্তন নেই। অয়ন ফের ডাকল,”অপরা।”

জবাব এল না। ইচ্ছাকৃত ভাবে কাজটি করছে অপরা। সেটি বুঝতে পারল অয়ন। তবে সমস্যা হলো মেয়েটি আজকাল বেশিই অবাধ্য। কিছুই শুনতে চায় না। তাই স্নেহের হাতটি মাথায় না রাখলে, চিড়ে ভিজবে না। ও গিয়ে পাশে বসল। গা ঘেঁষে। এতে করে অপরা চোখ মুখ অন্ধকার করে ফেলল। অয়ন ডাকল,”অপরা, আমার মিষ্টি পাখি। এক কাপ চা বানিয়ে আনো তো।”

শুরু হলো ছেলেটার নাটক। ছোট থেকেই এহেন নাটক করে এসেছে অয়ন। অবশ্য নাটকের বিপরীতে মেয়েটির প্রতি স্নেহের ভাগটুকুও কম নয়। তবে বরাবরই অয়নের নাটকে অপরা ও গলে জল হয়ে যেত। তবে আজ আর না। অপরা এখন চালাক হয়ে গেছে। এসবে আর চিড়ে ভিজবে না। ও যেন পাত্তাই দিল না। অয়ন পড়ল বিপাকে। মেয়েটার সাথে কথা বলার ইচ্ছেটিই হলো না। রেগেমেগে চলল চা বানাতে। সেদিকে তাকিয়ে ভেংচি কাটল মেয়েটা। তারপর আওড়াল,”নাটকবাজ!”

পাঁচ মিনিট পরের ঘটনা। ফোনে রিলস দেখা শুরু করেছে অপরা। দারুণ এক ফানি রিলস। ও জোরে হাসছিল। ওমন সময়ই রান্না ঘর থেকে মৃদু চিৎকার শোনা গেল। অয়নের গলা। কণ্ঠটা শুনেই গলা শুকিয়ে এল অপরার। এক সেকেন্ড বিলম্ব হলো না তার। ও ছুটে এল রান্না ঘরে। এসে দেখল হাত ধরে বসে আছে অয়ন। আর মেঝেতে লাল বর্ণের কিছু একটা লেগে আছে। ও চিৎকার করে ওঠল।

“কী হলো এটা? র ক্ত! অয়ন ভাই, হাতটা দেখতে দেন।”

উত্তেজিত সুরের সাথে এগিয়ে এল অপরা। দ্রুত অয়নের হাতটা চেপে ধরল। মেঝেতে অনেকটা লাল তরল মিশে আছে। অপরার চোখে একদম জল চলে এল। অয়নের হাতটা চেপে ধরে কান্নার সুরে বলল,”হাত কা’টল কীভাবে? এতটা র ক্ত!”

মেঝেতে অনেকটা লাল তরল। সে দিকে চেয়ে অপরার কান্না যেন বাড়তে লাগল। ওর জন্য এমন টা হলো। ও যদি চা বানিয়ে দিত, তবে এমনটা হতো না। ওর কান্না বাড়ছে। অয়ন এবার নিজেকে ধরে রাখতে পারল না। হেসে ফেলল শব্দ করে। সেই শব্দ কানে যেতেই অপরার হুস ফিরল। কিয়ৎকালেই বুঝে নিল পুরোই অভিনয়। মেঝেতে, হাতে লেগে থাকা লাল তরল মোটেও র ক্ত নয়। রাগে দুঃখে অপরা দাঁড়িয়ে পড়ল। চ্যাঁচিয়ে ওঠল।

“সুযোগ নিলেন। আমাকে কাঁদালেন? শুধু শুধু, এমনটা করলেন।”

মেয়েটার কান্না বেড়ে গেছে। ওর অনুভূতিতে আ’ঘা’ত করল অয়ন। বাড়ির প্রতিটা মানুষ কে ভালোবাসে ও। সামান্য আ’ঘা’তেও ওর অন্তর জ্বলে যায়। আর সেই সুযোগটিই নিল অয়ন! ওর কান্না বাড়ছে। ততক্ষণে বাড়ির সবাই এসে গেছে। এসে দেখল কাঁদছে অপরা। অয়ন ফ্যাল ফ্যাল করে চেয়ে আছে। সে বুঝতে পারে নি, অপরা এভাবে রিয়েক্ট করবে। মেয়েটা আজকাল বড়ো অচেনা হয়ে ধরা দিচ্ছে। এ যেন এক ভিন্ন অপরা! যাকে বুঝতে পারে না অয়ন। কোনো ভাবেই বুঝতে পারে না। অথচ অতীতের সম্পর্কটা কতটা মসৃণ ছিল! তবে কী সব বদলে যাচ্ছে? সেটি ভাবতেই অয়ন এর হৃদয়ে ইষৎ দহন সৃষ্টি হলো।

চলবে….
কলমে ~ #ফাতেমা_তুজ_নৌশি