হৃদয়দহন পর্ব-১৪

0
58

#হৃদয়দহন (১৪)

ম্যাচের সুবাদে বেশ আয়োজন করা হয়েছে বাড়িতে। অপরা উঁকি ঝুঁকি দিয়ে রান্না ঘরে প্রবেশ করল। সে একটু পেঁটুক প্রকৃতির। রান্নার ঘ্রাণে ‘ম’ ‘ম’ করছে সমস্ত ঘর। মেয়েটি বুক ভরে সমীরণ টেনে নিল। এতে করে ক্ষুধা বেড়ে গেল চট করেই। ও দ্রুত হাতে তরকারির বাটিটা নিতেই অয়ন বলে ওঠল,”চোর, চোর। রান্না ঘরে চোর ঢুকেছে।”

হায়রে কপাল! ঠিক সে সময়ই প্রবেশ ঘটল নুহাশের। তাকে দাওয়াত করা হয়েছে। খেয়ে দেয়ে বিকেলে ম্যাচ খেলতে যাবে। দুজন ব্যক্তির সামনে নাকাল হয়ে অপরা লাল চক্ষু করে চলে গেল। অয়ন না হেসে পারল না। মেয়েটাকে রাগাতে, জ্বালাতে, ছোট থেকেই ভীষণ পছন্দ করে কী না।

“এসো নুহাশ। তোমার অপেক্ষা করছিলাম।”

নুহাশ এগিয়ে এসে হাত মেলাল। যদিও সে, এ পাড়ার নয়। তবু পাড়ার হয়ে খেলবে সে। আর দায়িত্ব রয়েছ গোল রক্ষক হিসেবে। অয়ন আর নুহাশ সোফায় বসল। দুজন আলোচনা করছে বিকেলের খেলাটা নিয়ে। ওদের আলোচনা একদম শেষের দিকে। বাড়ির গিন্নি’রা খাবার সাজাচ্ছেন। এদিকে সদর দরজায় এসে উপস্থিত হলো রুবিনা। হাতে পায়েসের বাটি।

“কী রে, তোর হাতে কী?”

প্রশ্নটা করল অয়ন। রুবিনা গাল ভরাট করে হাসল। তারপর বলল,”পায়েস এনেছি অয়ন ভাই। রুবেল’টা জোর করে রান্না করাল। আজ ম্যাচ আছে না, তাই তোমাদের জন্য ও নিয়ে এলাম।”

অয়নের পছন্দের তালিকায় পায়েস অন্যতম। ও ওঠে এসে বাটিটা হাতে তুলে নিল। নুহাশ এদিকেই তাকিয়ে ছিল। দুজনের চোখাচোখি হওয়ায় রুবিনা বলল,”ভালো আছেন ভাইয়া?”

নুহাশ জবাব দিল। খুব অল্প কথায়। ছেলেটার এমন স্বল্প বাক্য বড়ো গিন্নি’র ভীষণ পছন্দের। তিনি হাসলেন। তারপর রুবিনার দিকে অগ্রসর হলেন।

“পায়েস নিয়ে আসার দরকার ছিল রে?”

“আনলাম একটু। বাড়ির দু ছেলে খেলবে, আর পায়েস খাবে না?”

বড়ো গিন্নি হাসলেন। রুবিনার মাথায় হাত রেখে মেয়েটির মুখশ্রী’র পানে তাকালেন। শ্যাম বর্ণের, হলেও চেহারায় গভীরতা রয়েছে। চট করে দেখলে হয়তো মনে ধরবে না, তবে দীর্ঘ সময় ধরে দেখলে, মেয়েটির সৌন্দর্য ঠিকই ধরা পড়বে।

দুপুরের খাবারে রুবিনাকেও রেখে দেওয়া হলো। মেয়েটা এখন খাবার পরিবেশনে সাহায্য করছে। অপরা আর কথা একে অপরের সাথে ফিসফিস করছে। তাদের বিষয়বস্তু, পাড়ায় কোথায় কী ঘটেছে, সেসবেরই বর্ণনা। ওদের এমন ফিসফিস করে কথা বলা, কিয়ানের নজরে লাগল। ও মৃদু সুরে ডাকল,”অপু, কথা। খাবার না খেয়ে গুনগুন করছো কেন?”

দুজন চুপ হয়ে গেল। রুবিনা বড়ো একটি নিশ্বাস ফেলল। তারপর সকলের সাথে খেতে বসল। আজ তাকে বেশ খুশি দেখাচ্ছে। কথা খাবারের মাঝামাঝি সময়ে অপরা”র পায়ে গুতো দিল। এতে চমকে গেল মেয়েটি। চোখ রাঙাল। কথা দুজনের মাঝের দূরত্ব কমিয়ে বলল,”রুবিনাবু কে খুশি লাগছে খুব, তাই না?”

অপরা চাইল। ভালো মতন দেখল। তার ও কেমন যেন অতিরিক্ত খুশি মনে হচ্ছে। দুজন আবার ফিসফিস করল,”খুশি তো লাগছে। তবে তুই কী, কিছু সন্দেহ করছিস?”

কথা বেশ শক্তপোক্ত ভাবে বলল,”সামথিং ইজ রং অপুবু। আমার তো মনে হচ্ছে অয়ন ভাই ইজ দ্য মেইন কালপ্রিট।”

অপরা এত সময় যতটা মনোযোগে সবটা দেখছিল, এখন ততটাই মনোযোগ সরিয়ে নিল। আড়ালে ঠাস করে কথা’র মাথায় চ’ড় বসিয়েছে দিল। তারপর বলল,”তোর মাথায় গোবর ভরা।”

“অপুবু! আমাকে শুধু মা’রলে তুমি। পুরো কথা না শুনেই।”

“কী শুনব?”

“আমি বোঝাতে চাচ্ছি এক, তুমি বুঝেছ আরেক।”

“তোর বোঝাবুঝি বাদ দে। খাবার খা এখন।”

কথা আর সুযোগ পেল না। তাকে চুপ করতে হলো। অপরা অবশ্য ভালো মতন পুরো পরিবেশ দেখে নিচ্ছে, অয়ন আর নুহাশ খাবার খাওয়ার মাঝেই, টুকটাক আলোচনা করছে। কিয়ান চুপ করে খাচ্ছে। রুবিনা পরিবেশন করছে। সত্যি বলতে, অপরার কাছে পুরো বিষয়টাই স্বাভাবিক মনে হচ্ছে। শুধুমাত্র কথা’র বলা কথাটার জন্য, কেমন একটা প্রশ্ন জেগেছে মনে।

খেলা শুরু হবে। সকলে বড়ো মাঠে উপস্থিত হয়েছে। এত এত মানুষের ভীড়ে অয়ন একজনকেই খুঁজে চলেছে। সে হলো নীলা। মেয়েটার আসার কথা। অয়ন অধৈর্য হয়ে পড়ল। ঘুরে ঘুরে দেখতে লাগল। এক পর্যায়ে চোখ আটকাল, মেয়েটির দিকে। নীলা মৃদু হেসে কিছু একটা বোঝাল। অয়ন চোখের ইশারায় বলল আড়াল হতে। দুজন আড়াল হয়ে, কিছুটা দূরে এল। অয়নের চোখে মুখে অস্থিরতা।

“ম্যাচটা গুরুত্বপূর্ণ। জানো তো, সোলাইমান কতটা খারাপ।”

“ভরসা রাখো, পারবে।”

কথাটা শেষ করেই অয়নের হাত দুটো মুঠোয় নিল নীলা। অয়ন হাসল। এই ভরসাটা মেডিসিন এর মতন লাগছে তার।

“দোয়া রেখো। গোল কিপার বদল‍ করেছি। নুহাশ ছেলেটা বড়ো ভালো।”

নুহাশের নাম শুনে তাকাল নীলা। কিছুটা দূরে বিধায় নুহাশের মুখটা দেখা যাচ্ছে না।

“আচ্ছা শোনো, ভীড়ের মাঝে থাকবে না। তোমাকে কারো পাশে সহ্য হবে না আমার।”

অয়নের কথায় আরেক দফায় হেসে ফেলল নীলা। বলল,”ঠিক আছে। তুমি যা বলবে।”

অয়ন এগিয়ে এসে নীলার মাথায় হাত রাখল। দুজনের দৃষ্টি একে অপরকে দেখে চলেছে। কি দারুণ এক মুহুর্ত তাদের।

খেলা শুরুর আগে, নুহাশ নিজের মস্তিষ্ককে শীতল করে নিচ্ছে। তার দৃষ্টি আজকাল খুব নড়াচড়া করছে। এত সিরিয়াস সময়েও অপরার মুখটা মনে পড়ছে। এদিকে খেলার সময় হয়ে যাচ্ছে। ও নিজের মনেই বলল,’শান্ত হও নুহাশ। তোমার পথ মোটেও মস‍ৃণ হবে না। নিজেকে সামলে নাও।’

আপনমনে,অদৃশ্য বার্তা শেষ করে মাঠে এগিয়ে গেল নুহাশ। সকলে নির্দিষ্ট জার্সি পরেছে। অয়নদের টিমের ক্যাপ্টেন কিয়ান। তারা সবাই খেলার পূর্বের নিয়ম গুলো করে নিচ্ছে। এদিকে অয়ন আর সোলাইমানের চোখের যুদ্ধ চলছে। দুজন একে অপরকে হেমলকের মতন মনে করে। মুরাদ অয়নের বাহু টেনে ধরল।

“ভাই, এখন ভেজাল করে লাভ নেই।”

অয়ন বুঝল কথাটা। এখন ভেজাল করে আসলেই লাভ নেই। তবে, সোলাইমান যে মাঠে খুব একটা ভালো আচরণ করবে না, এ বিষয়ে শতভাগ নিশ্চিত সে।

অয়নের কথা মতন ভীড়ে যায় নি নীলা। সে অপরাদের দিকে চলে এসেছে। এখানে অপরার সাথে কথা ও রুবিনা রয়েছে। সবাই বেশ উত্তেজিত। নীলা আর অপরার দৃষ্টি বিনিময় হলো। এতে অপরা চোখ সরিয়ে নিলেও নীলা বলল,”কেমন আছ অপু? তোমার সাথে কথাই হয় না একদম।”

তাদের ছোট বেলার পর আর কখনোই কথা হয়ে ওঠে নি। অপরা একটু অস্বস্তি অনুভব করল। কথা আবার এদিকে ভীষণ চটপটে। ও হেসে বলল,”নীলাপু, তোমাকে হেব্বি লাগছে।”

কথার কথা শুনে, লজ্জায় হাসল নীলা। রুবিনা বলল,”পাড়ার সব থেকে সুন্দরী, এমনি এমনি তো বলা হয় না।”

“রুবিনা! তুই ও না।”

“একটু প্রশংসা করলেই কী হয় নীলাপু?”

“হয়েছে তো। আর প্রশংসা লাগবে না। কথা, তোমার খবর কী বলো?”

“আমার আর কী খবর? আমি তো ঘুরি, ঘুমাই আর পড়াশোনা করি।”

“আর নিউজ কালেক্ট,সেটা করো না?”

চট করেই প্রশ্নটি করল নীলা। কথা হেসে বলল,”তুমিও জেনে গেছ!”

নীলা কেবল হাসল। ওদের কথা বার্তা চলছে। এদিকে অপরা ভীষণ অসহায় অনুভব করল। তার শুধুই মনে হলো,নীলাকে পেয়ে রুবিনা আর কথা ওকে ভুলে বসেছে।

চলবে….
কলমে ~ #ফাতেমা_তুজ_নৌশি