হৃদয়দহন পর্ব-১৬

0
52

#হৃদয়দহন (১৬)

মনে প্রভাব পড়েছে অপরা’র। এত গুলো বছরে সে ভুলে বসেছিল, এই বাড়িটা তার নয়। এই বাড়ির একজন সদস্য সে নয়। সে কেবল, ভালো মানুষ গুলো’র দয়ায় বেঁচে আছে। এই বিষয়টা নিয়ে ভেবে সমস্ত রাত পার হলো তার। ভোরের এক প্রহরে অনুভব করল, কান্নার দরুণ নাক বন্ধ হয়ে আছে। এই সময় এক কাপ চা খুব প্রয়োজন। সে সুন্দর মতন চা আনতে গেল। রান্না ঘরে যাওয়ার পথে একটি গলা শোনা গেল। কণ্ঠের স্বরটি কিয়ানের। অপরা কিছু শোনার প্রয়াস করতেই বেখেয়ালে হাত লেগে একটি গ্লাস পড়ে গেল। সঙ্গে সঙ্গে সেটা ভে’ঙে কয়েক টুকরো হয়ে পড়ল মেঝেতে। অপরা হতাশ হয়ে চাইল। অন্ধকার করা ছিল। মুহূর্তেই লাইটি জ্বলে ওঠল। চোরের মতন চেয়ে রইল অপরা। এদিকে কিয়ান একটু দ্বিধান্বিত। ও বিচলিত সুরে বলল,”অপু, অন্ধকারে এখানে কেন এসেছ?”

সে মিথ্যে বলল না। সত্যি টাই বলল। চায়ের কথা শুনে কিয়ান নিজেও হাসল। বলল,”আমিও চা বানাতে এসেছিলাম। কীভাবে মিলল বলো তো।”

সত্যিই কী তাই? নাকি পালানোর মতলব। অপরা’র মন বিষয়টি মানতে পারল না। কিয়ান যদিও চায়ের জন্য পানি বসাল, অপরা তবু বিশ্বাস করতে পারল না। কিন্তু মুখে যে বলবে,সে উপায়টিও নেই। কিছু সময় পর চা বানানো হয়ে গেল। কিয়ান শুধাল,”এখনই দিব তোমায়?”

“না, একটু পরে নিয়ে নিব।”

“ঠিক আছে।”

নিজের কাপটি তুলে নিয়ে চলে গেল কিয়ান। সেই সুযোগে এদিকে সেদিক উঁকি মা’রল অপরা। তবে বিস্তর কিছু বুঝতে পারল না। একটু স্মরণ করার চেষ্টা করল, কিয়ান ভাই যে কিছু একটা লুকাচ্ছেন, সেটা এক‍দম পরিষ্কার।

ভোরের আধো অন্ধকার মিশে গেল, ঝকঝকে আলোর মাঝে। পৃথিবী”র বুকে আলো এসে পৌঁছেছে। অপরা তখনো বসার ঘরে বসে। বরাবরের মতনই বড়ো গিন্নি ঘুম থেকে সবার পূর্বে ওঠেছেন। তিনি এসে দেখলেন, বাড়ির এই মেয়েটা চুপচাপ বসে আছে। হাতে চায়ের কাপ।

“সকাল সকাল চা খাওয়া ও হয়ে গেল?”

অপু ঘাড় ফিরিয়ে চায়। বড়ো গিন্নি’কে দেখে তার ভালো লাগে।

“খেয়েছি অনেক আগেই।”

“তাহলে হাতে কাপ নিয়ে বসে আছিস যে?”

“সময় কীভাবে যে গেল বড়ো মা।”

কথা টা বলতে বলতে ওঠে গেল অপরা। সেই সময়েই দোতলা থেকে নেমে এল, পিটু’নি খাওয়া তিনটে পুরুষ। তাদের মধ্যে কিয়ানের হাতে চায়ের কাপ। অয়ন বিষয়টি লক্ষ্য করল। বুঝতে পারল, দুজনের চা একই পাত্র থেকেই এসেছে। ও নুহাশ কে বলল,”তুমি আজ থেকে যেতে পারতে না?”

“ভাইয়া, একটু সমস্যা হয়ে যাবে।”

“মা, দেখো তো নুহাশ কি বলে। ও নাকি চলে যাবে। এর মানে হয় বলো?”

বড়ো গিন্নি এগিয়ে এলেন। ঘটনা শুনল। নুহাশ সত্যিই চলে যেতে চায়। অথচ ছেলেটার হাতে এখনো ব্যান্ডেজ করা।

“দেখি ছেলে, কী বললে তুমি।”

“আন্টি আপনারা শুধু শুধু ব্যস্ত হচ্ছেন। এইটুকু ব্যথা…..’

“এইটুকু ব্যথা? তুমি আমাদের পর নুহাশ? অয়ন, কিয়ানের মতই তো। আজ থেকে যাবে। কোনো কথা হয়। বুঝলে?”

এ কথার বিপরীতে নুহাশের কথা হারিয়ে গেল। কিয়ান বলল,”আরে থেকেই যাও না। সন্ধ্যায় মুড়ি মাখা আর আড্ডা হবে।”

“তাই? এই শরীরেও আড্ডার কথা চলছে।”

“আড্ডার কী দোষ বলো তো চাচি।”

“ঠিক আছে, সে না হয় আড্ডা হবে। এখন তোরা বোস তো। তিন জনকে ঔষধ দিতে হবে।”

কথা মতন ওরা তিন জন ই সোফায় বসল। অপরা আগেই ওঠে গিয়েছে। সে এখন বড়ো মা কে সাহায্য করছে। খাবার বসিয়ে দিয়ে, বড়ো গিন্নি ছুটলেন ঔষধ আনতে। কিছু ঔষধ খালি পেটে খেতে হবে।

বড়ো গিন্নি যখন ঔষধ নিয়ে ফিরলেন, অয়ন বলে ওঠল,”এখনো আমরা ছোট আছি বলো তো মা?”

“মায়ের কাছে সন্তান বড়ো হয় কী?”

অয়ন চেয়ে থাকে। তার মা এতটা যুক্তিবাদী! অবশেষে তিন জনকেই ঔষধ খাওয়ালেন বড়ো গিন্নি। ততক্ষণে ছোট গিন্নিও চলে এসেছে। তাদের এই দৃশ্য দেখে হেসে বললেন,”আপা, তোমার এই দায়িত্ব আজীবন থাকুক।”

বড়ো গিন্নি হাসলেন। পানির গ্লাস গুলো নিতে নিতে বললেন,”সেটা কী সম্ভব? কদিন বাদেই তো ছেলেদের বিয়ে দিতে হবে। তখন তো বউ ই এই দায়িত্ব গুলো গ্রহণ করবে।”

বাক্য শেষ করে ছেলেদের দিকে চাইলেন তিনি। বোঝার চেষ্টা করলেন, বিয়ে নিয়ে এদের মনোভাব কী। কিন্তু হতাশার বিষয় হলো, কারোই তেমন কোনো অভিব্যক্তি নেই।

মাথা ব্যথার ছলে ঘরে চলে এসেছিল অপরা। ঘুম দিয়েছিল। এখন বাজে দুপুর একটা। কথা এসেই মেয়েটিকে টেনে তুলল।

“অপুবু। ওঠো তুমি।”

অপরা আলগা চোখে দৃষ্টি মেলল। তার মাথা ঝিমঝিম করে আছে। ছল ধরে, সত্যিই মাথা ব্যথা টেনে নিয়ে এসেছে।

“কী হয়েছে রে?”

“ওঠো তুমি। একটা বেজে গিয়েছে।”

“আমার ঘুম পুরো হয় নি।”

“উফ! তুমি যে কী। এসে দেখো, নিচে চমক আছে।”

অপরা চমকের প্রতি আগ্রহ দেখাল না। তবে কথা নাছোড়বান্দা। সে অপরাকে ওঠিয়ে দিল। অপরা ফ্রেশ হবার নাম করে একেবারে গোসল সেড়ে এল। কথা ধৈর্য নিয়ে দাঁড়িয়ে। মেয়েটি বের হতেই এক প্রকার টেনে তাকে নিচে নামিয়ে নেওয়া হলো। ওরা বসার ঘরে এসে নীলা ও তার পরিবারকে দেখতে পেল। কথার থেকে জানা গেল, বড়ো কর্তা নাকি তাদের দাওয়াত করেছেন।

খাবার দেওয়া হচ্ছে। অপরা আর কথা সাহায্য করছে। এদিকে বসে খেতে নীলার লজ্জা করছে। সে ওঠে গেল। এসে অপরাদের সাথে সাহায্যের চেষ্টা করল। তবে গিন্নি’রা সেটি করতে দিলেন না। শেষমেশ চলে আসতে হলো নীলাকে। অয়ন ইশারায় ডাকল যুবতীকে। দুজন কৌশলে আড়াল হলো সকলের থেকে। নীলা বলে ওঠল,”কেউ দেখে ফেললে?”

“কী দেখবে?”

“তোমার সাথে কথা বলছি।”

“তো? আমি কী রোমান্স করছি?”

“উফ অয়ন!”

অয়ন হাসল। বলল,”চলো দাদিজানের কাছে নিয়ে যাই।”

ওরা দাদিজানের কক্ষে এল। দাদিজান বিছানায় বসে আছেন। অয়ন কে দেখেই ডাকলেন,”দাদুভাই, তোমার সাথে কে?”

অয়ন হেসে বলল,”ও নীলা, দাদিজান। ডাক্তার সাহেবের মেয়ে।”

দাদিজান ভালো মতন চাইলেন। গতদিন নীলাকে সেভাবে খেয়াল করেন নি। ভারী সুন্দর মেয়ে।

“এদিকে আসো মেয়ে। তোমাকে সেই ছোট দেখেছি। আর দেখা হয় নি।”

নীলা একবার অয়নের দিকে চাইল। অয়ন সম্মতি দিতেই দাদিজানের কাছে গেল সে। চট করেই দাদিজান বললেন,”বড়ো হয়ে দেখছি আরো সুন্দর হয়ে গেছ। এই জন্যই বুঝি আমার দাদুভাই চোখে হারায়।”

একটা ধাক্কা লাগল। দাদিজান বিষয়টি বুঝে গেছেন তবে! অয়ন কোনো মতে বিষয়টি সামলানোর চেষ্টা করছিল। ওমন সময় অপু এসে বলল,”দাদিজান, এখন খাবার দিব?”

“অপু, এতক্ষণে এলি তুই?”

অপরা চুপ হয়ে রইল। দাদিজান ভেতরে আসতে বললেন। অপরা এল না। বলল,”আমি খাবার নিয়ে আসছি।”

অপরা চলে গেল। অয়ন বুঝল মেয়েটির মন খারাপ। তাকে দেখেই চলে গেল। ও একটু হতাশ হলেও, দাদিজানের দিকে ঘুরে চাইল। দাদিজান যে নীলা কে পছন্দ করেছে, এই বিষয়ে আর কোনো দ্বিধাই রইল না।

চলবে…
কলমে ~ #ফাতেমা_তুজ_নৌশি