হৃদয়দহন পর্ব-২২

0
146

#হৃদয়দহন (২২)

অপু কলেজে গিয়েছিল। ফিরতে না ফিরতেই সদর দরজার কাছে পিয়ন’কে দেখতে পেল। হাতে একটা খামের মতন। অপরা’কে দেখেই দাঁত মেলে দিয়ে হাসল।

“সালাম আম্মাজান। আপনে কলেজ থেকে আসলেন নাকি?”

“জি চাচা। আপনি এখানে….’

“চিঠি আছে আম্মাজান।”

বলেই খাম খানা এগিয়ে দিলেন পিয়ন। লোকটা’কে এর পূর্বে কয়েকবার দেখেছে অপরা। কথা ও বলেছে। আজকাল চিঠির চল নেই। তবু কিছু মানুষ শখের বসে চিঠি লেখে। অপরা’র ঠোঁট বেঁকে গেল। তার জন্য চিঠি এসেছে। কে দিল চিঠি?

ভাবতে ভাবতে ভেতরে প্রবেশ করল অপরা। শুরুতেই বেশ অনেকজন মানুষ’কে দেখা গেল। এর মধ্যে আছে নীলা’র বাবা ও। ডাক্তারের পাশে আছে বড়ো কর্তা ও ছোট কর্তা। তারা কথা বলছেন। অপরা এক মুহুর্ত থেমে রইল। তারপর এগিয়ে গিয়ে কথার পাশে দাঁড়াল। ফিসফিস করে বলল,”কী রে। নীলাপু’র বাবা কেন এখানে?”

“বিয়ের কথা চলছে।”

“কার?”

“অয়ন ভাইয়ের।”

“সেকি’রে! কিয়ান ভাইয়ের…..’

“তার জন্যও মেয়ে ঠিক করা হয়েছে।”

এ কথায় অপরা হা হয়ে যায়। কথার দিকে পূর্ণ দৃষ্টি ফেলে। এত কিছু ঘটে যাচ্ছে। অথচ সে কিছুই জানে না! ছোট কিশোরী হতাশার মতন শ্বাস ফেলে।

“আমাকে আর কিছু জিজ্ঞাসা করিও না অপুবু। আমি আর বলতে পারব না।”

কথাটা শেষ হতে না হতেই পালিয়ে যায় কথা। সেদিকে তাকিয়ে অপরা বাক্য হারিয়ে ফেলে। রহস্য তৈরি হয় মনে। কিয়ান ভাইয়ের জন্য কাকে ঠিক করা হলো?

“অপু, ফিরেছিস। এখানে দাঁড়িয়ে কেন?”

বড়ো গিন্নি এগিয়ে আসেন। অপরার মাথায় হাত রেখে বলেন,”ঘরে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে আয়। বাসায় আজ ছানার মিষ্টি আনা হয়েছে। একদম গরম গরম। তোর তো প্রিয়।”

ছানার মিষ্টি অপরা’র অতি প্রিয়। খাবারের কথা শুনে পেটে কেমন সুরসুরি অনুভব হয়। অপরা ছোট ছোট নয়নে চেয়ে বলে,”ইস, ক্ষিধেটা বাড়িয়ে দিলে তো।”

বড়ো গিন্নি হাসেন। অপরা দ্রুত পায়ে নিজের ঘরের দিকে এগোয়। পথের মধ্যে দাঁড়িয়ে পড়ে। অয়নের ঘরের সামনে সে। উঁকি দিতেই দেখতে পায় সুর্দশন পুরুষ’টিকে। সুন্দর ছাই রঙের একটি শার্ট পরেছে। হাতাটা গুটিয়ে রাখা। চুল গুলো শৈল্পিক ভাবে সাজিয়ে নিচ্ছে। তার এমন আয়োজন দেখে অপরা ঠোঁট উল্টিয়ে ফেলে। মুখে বলে,’ঢং।’

অপরা যখন উঁকি দিয়ে রয়, তখনই উদয় ঘটে কিয়ানের। ছেলেটা নিজের কক্ষ থেকে বেরিয়েই দৃশ্যটি দেখতে পায়।

“অপু।”

হঠাৎ কণ্ঠে ভয় পেয়ে যায় অপরা। ছিটকে সরে যায় দূরে। কিয়ান ভ্রু কুঁচকে বলে,”উঁকি দিয়ে আছ কেন?”

অপরা সাথে সাথে আটকে দিয়ে বলে,”চুপ করুন কিয়ান ভাই। নবাব সাহেব জানলে আমার রক্ষা নেই।”

এবার কিয়ানের কণ্ঠ নরম হয়। ছোট স্বরে বলে,”আচ্ছা। কিন্তু এভাবে উঁকি দিচ্ছিলে কেন?”

“এমনি, এমনি। আপনি কোথায় যান। এত সেজে গুজে?”

কিয়ান আসলে সাজে নি। সাধারণ ভাবেই বের হয়েছে। তবু কথা কাটাতে প্রশ্নটি করল অপরা।

“বের হচ্ছি। কিছু পেন্টিং করতে হবে। রং শেষ।”

এই হলো কিয়ান ভাই। যার জীবনে রং তুলিই সব। অপরা ঠোঁট উল্টিয়ে চেয়ে থাকে। কিয়ান বিদায় জানাতে বলে,”যাই অপু। তুমি তো মাত্র ফিরলে। ফ্রেশ হও।”

কিয়ান তখন সিঁড়ির দিকে পৌঁছে গেছে। অয়ন ও তখনই নিজ কক্ষ থেকে বের হয়ে আসে। অপরা’র চাহনি লক্ষ্য করে বলে,”ভালোই তো।”

এ কথায় ফিরে তাকায় অপরা। অয়ন ঠোঁট কামড়ে বলে,”কিয়ান ভাই’কে তোর পছন্দ। আগে তো জানতাম না।”

একটা মিশ্র অনুভূতি আসে অপরা’র। একটা সময় অপরা নিজেও তো মনে করত, কিয়ানের প্রতি যে ভালো লাগাটা আছে, তা বিশেষ। ও তো দিন রাত এক করে ভাবত। কিন্তু শেষমেশ অপরা বুঝেছে, এই ভালো লাগাটা প্রেম ঘটিত কিছু নয়। এই ভালো লাগাটা ব্যক্তিত্বের। কিয়ানের শান্ত চলন, বলন অপরা’র হৃদয় কে স্পর্শ করে যেত। সেটি’র আলাদা নাম হতে পারে। তবে প্রেম নয়।

“কথা নেই কেন? দাদিজান তো সব সেট করেই দিল। এখন থেকে আজীবন তোকে সহ্য করতে হবে। কোনো সুরাহা পেলাম না।”

“দাদিজান কী সেট করল?”

“ন্যাকামি করিস?”

“আজব তো। ন্যাকামি কেন করব? আপনিই তো কি সব বলে যাচ্ছেন।”

এবার অয়ন চোখ মুখ শক্ত করল। মেয়েটাকে ওর বিশ্বাস হয় না। পাক্কা অভিনয় জানে। তাই ধমকের মতন করে বলল,”তুই কিছু জানিস না। এটাও আমাকে বিশ্বাস করতে হবে?”

“চটে যাচ্ছেন কেন? আপনাকে রোগে ধরেছে নাকি?”

“উফ! এদিকে আয়, দুটো চড় বসাই।”

অপু জানে অয়ন ঠিক ই চড় বসাবে। তাই দু কদম সরে আসে।

“সব সময় মারেন কেন?”

এ প্রশ্নের জবাব অপু পেল ঠিক ই। তবে তার আগে অয়ন এগিয়ে এসে মেয়েটার মাথায় দুটো চড় বসাল। যদিও জোরে নয়, তবু অপুর ঠোঁট উল্টে গেল।

“আপনার নামে নালিশ করব অয়ন ভাই।”

“করিস। তবু ন্যাকা সাজিস না। এইটুকু মেয়ে নাকি বিয়ের করবে!”

বিয়ের কথায় অপরা’র ধ্যান ফিরল। ও এবার চোখ মুখ কঠোর করে বলল,”কী বললেন?”

“কী বললাম।”

“বিয়ে মানে। বিয়ে তো আপনি করবেন। ঐ যে নিচে নীলাপুর বাবা বসে আছেন।”

“আমার আগে তোর বিয়ে হবে।”

“মানে?”

“এত ঢং করিস না তো। অসহ্য লাগে। যাই হোক, আমি যাই। তোর সাথে কথা বলে সময় নষ্ট হচ্ছে।”

এ কথা বলেই পাশ কাটিয়ে গেল অয়ন। এদিকে অপরা হাবুলের মতন চেয়ে রইল। তার মাথায় কিছুই যায় নি। অয়ন ভাইয়ের বলা কথা গুলো, বড়ো রহস্যময়।

অনেকটা সময় ভেবেছে অপরা। তবে কিছুই যেন মিলাতে পারছে না। এখন উপায় কথা। এই মেয়েটা’কেই চেপে ধরতে হবে। ভাবনা মতই এগিয়ে যায় ও। কথা তখন উদাস ভরা নয়নে বসে আছে। জানালা দিয়ে পাখির উড়া দেখছে।

“এই মেয়ে।”

হঠাৎ ডাকায় ইষৎ চমকে যায় কথা। বুকে থু থু দিয়ে বলে,”উফ অপুবু! ভয় পাই তো।”

“আরো ভয় পাবি। যদি না আমাকে সবটা খুলে বলিস।”

কথার পাশে বসল অপরা। বাহু টেনে ধরে বলল,”আমার তো সব গুলিয়ে যাচ্ছে রে।”

“কেন?”

“জানি না। বুঝতে পারছি না। অদ্ভুত লাগছে। এদিকে রুবিনাবুর…..’

ওর মুখের বাক্যটি কেড়ে নিয়ে কথা বলে,”তার তো বিয়ে হয়ে যাবে।”

“সেটাই তো। কিয়ান ভাই’কে এই প্রথম অসহ্য লাগছে।”

এ কথা বলে নজর ফেরায় অপরা। এদিকে কথা চুপ। তার মুখটা শুকনো।

“তোর মন খারাপ?”

“না।”

“তাহলে?”

“এমনি। তুমি বলো অপুবু। ক্লাস কেমন গেল।”

“ক্লাস? কেমন আর যাবে বল। যেমন যায়। পড়তেই মন চায় না।”

“অথচ তুম বলেছিলে ভালো মতন পড়বে।”

“মনের ওপর জোর আছে কী?”

এই প্রশ্নে কথার ছোট্ট হৃদয় আন্দোলিত হয়। সত্যিই তো। মনের ওপর জোর আছে কী? নেই তো। তবু কিছু জিনিস আমাদের মেনে নিতে হয়। এই যে যেমন, এখন নুহাশ আসবে পড়াতে। প্রথমবারের মতন পড়তে ইচ্ছে করছে না কথার। অথচ উপায় নেই। ব্যাগ পত্র গুছিয়ে নিতে হচ্ছে। অপরাও অলসের মতন করে পড়ার কক্ষে এগোয়। দুজন বসে থাকে। কিছু সময় পর নুহাশের দেখা মিলে। ছেলেটা এসেই অপরা আর কথার হোম ওয়ার্ক চেইক করে। খাতা গুলো দেখে ফিরিয়ে দেওয়ার পথে দেখতে পায়, তার দুজন ছাত্রী’র ই মন নেই। অপরার জন্য বিষয়টা স্বাভাবিক, তবে কথা, তার কেন মন নেই? এই প্রশ্নের জবাব মিলে না। ওদের মনোযোগ ফেরাতে নুহাশ একটু কাশে। এতে কাজ হয়।

“একটু লক্ষ্য করো। এভাবে তো পড়াশোনা হবে না। মাথায় এত কীসের চাপ? এত অমনোযোগী কেন?”

দুজন ই মৌন থাকে। নুহাশ আর কিছু বলে না। পড়াতে থাকে। পড়ানো তখন মাঝ পথে। সহসাই কথার ডাক পড়ে। কথা ওঠে চলে যায়। কক্ষে এখন নুহাশ আর অপরা। নুহাশ নিজের দৃষ্টি ফেরায়। অপরা ভাবছে কিছু। ও কিছু বলতে গিয়েও বলে না। এই মেয়েটার সাথে যথেষ্ট দূরত্ব রাখে সে। কারণ ভয় হয়। নিজের অনুভূতির প্রতি একটুও বিশ্বাস নেই।

কথা আসে পাঁচ মিনিট পর। এসে দেখে দুজন ই চুপ। যেন মৌনতার শপথ নিয়েছে।

“আজকে আমাদের একটু আগে ছাড়তে হবে।”

নুহাশ ও অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিল। হঠাৎ বলায় ঘোর কাটে। একটু থতমত খেয়ে গেলেও নিজকে সামলে বলে,”কোনো সমস্যা?”

“না তেমন কিছু না। অপুবু’র বিয়ের কথা চলছে। আমাদের ও যেতে বলা হয়েছে।”

এ কথায় অপরা’র মুখটা হা হয়ে যায়। ও বিস্মিত দৃষ্টিতে কথার দিকে চায়। কথা দৃষ্টি লুকায়। এদিকে নুহাশ, খানিকটা বিস্ময়, আর ব্যথা নিয়ে বসে থাকে। গলার কাছটা তরলশূন্য লাগে। ভেতরটা বলে, ‘কথার বলা কথাটা মিথ্যে হতো যদি।’

চলবে…
কলমে ~ #ফাতেমা_তুজ_নৌশি