হৃদয়দহন পর্ব-২৮

0
132

#হৃদয়দহন (২৮)

অপরা বাংলাদেশে পৌঁছাল বিকাল চারটায়। তাকে নেওয়ার জন্য গাড়ি পাঠানোর কথা। ও নাম্বার ডায়াল করল। রিসিভ হতেই ও বলল,”হ্যালো, আমি এসে গেছি। আপনি কোথায়?”

ওপাশের ব্যক্তি’টি জবাব দিল না। বরং কল কেটে দিল। অপরা একটু অবাক হলো। নাম্বারটি চেইক করে দেখল, ভুল নয়।

“আমার সাথে এসো।”

কণ্ঠটা ইষৎ পরিচিত লাগছে কী? হ্যাঁ তো। ছয় বছর পর কণ্ঠটা শুনলেও, অপরা তো ভুলে যায় নি। ভুলে যায় নি প্রতিটা মানুষ’কে। ও চোখ মেলে চাইল। এক দেখাতেই চিনে ফেলল, মানুষটা অয়ন। তবে আগে’র থেকে অনেক বেশি পরিপাটি মনে হচ্ছে। চেহারায় কেমন একটা পরিপক্কতা’র দেখা মিলছে।

“এখানেই দাঁড়িয়ে থাকবে?”

আবার বেজে ওঠল কণ্ঠটা। অপরা চমকে চাইল। সহসাই কেমন একটা অস্বস্তি দেখা গেল ওর মাঝে।

ওরা পথ চললেও আর কোনো কথা বলল না। ছয় বছরে একটা সংকোচ তৈরি হয়েছে কী না। অপরা মাথাটা ঈষৎ নামিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। পার্কিংয়ে পৌঁছে অপরা এবার মুখ খুলল,”রিসিভ তো ড্রাইভারের করার কথা ছিল।”

“হুম। একটা কাজে অন্য জায়গায় পাঠাতে হয়েছে। সেই জন্য আমাকেই আসতে হলো।”

তার মানে দাঁড়াল, দায় থেকেই এসেছে অয়ন। কোনো অনুভূতি থেকে নয়। অপরা’র কেমন একটা খারাপ লাগল। অয়নের মতন, বাড়ির সবাই ও কি তাকে ভুলে গেছে? তার প্রতি কোনো অনুভূতিই কি অবশিষ্ট নেই?

অয়ন ড্রাইভিং করছে। অপরা পাশেই বসে আছে। অনেকটা সময় কেউ কোনো কথা বলেনি। এবার জ্যামে পড়তে হলো। বিশাল জ্যাম। অপরা গাড়ির জানালা দিয়ে বাইরে’টা দেখছিল। ছয় বছরে বেশ কিছু পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে। দেশের ধুলোবালি অপরা’র চোখ দুটোকে ভিজিয়ে দিচ্ছে। কান্না পাচ্ছে মাতৃভূমির জন্য। ও যখন প্রায় কেঁদে দিচ্ছিল তখনই অয়ন বলল,”জানালা থেকে মাথা সরিয়ে আনো। এসি অন করি।”

এক বিন্দু জল গড়িয়ে পড়তে নিচ্ছিল। অপরা অস্পৃষ্ট ভাবে বলল,”থাক না। এভাবেই ভালো লাগছে।”

অয়ন এ প্রসঙ্গে কিছু না বলে, এত সময় পর শুধাল,”কেমন আছ অপরা?”

হঠাৎ প্রশ্নে থমকাল মেয়েটি। তারা দুজন প্রায় এক ঘন্টা ধরে এক সাথে আছে। অথচ কেউ কাউকে সেভাবে প্রশ্ন করে ওঠতে পারে নি। অয়নের প্রশ্নের জবাব দিতে গিয়ে অপরা’র ভেতরটা হু হু করে ওঠল। মৃদু সুরে বলল,”ভালো। আপনি?”

“বেশ ভালো।”

বেশ ভালো। হ্যাঁ অয়নের তো বেশ ভালো থাকার ই কথা। তার জীবনের পরিবর্তন গুলো তো এমন ই ছিল। যে স্বপ্ন লালন করেছিল সেটা তো পূরণ হয়েই গেছে। অয়নের জীবনের সবথেকে বড়ো সত্য ছিল নীলা। যাকে ভালোবেসেছে সবটুকু দিয়ে। সেই ভালোবাসার পূর্ণতাই নিশ্চয়ই অয়নকে ‘বেশ ভালো’ রেখেছে।

বাড়ির ভেতর প্রবেশ করতে গিয়ে অপরা’র পা দুটো কাঁপতে লাগল। চোখ হলো টলমলে। স্মৃতির দল চেপে ধরল সর্বাঙ্গে। সেই দিন গুলো অপরা চাইলেও কি পারবে ভুলতে? ভোলার কথা কি? না তো। অপরা টলমলে চোখে দেখতে পেল, একটি যুবতী মেয়ে এগিয়ে আসছে। সেই যুবতী’কে কত ছোট দেখেছে সে। অথচ এখন কত বড়ো হয়ে গিয়েছে। কথা এসেই অপরা’কে জাপটে ধরল। ওমনি অপরা’র চোখ থেকে টুপ করে অশ্রু গড়িয়ে পড়ল। অয়ন গাড়ি পার্ক করে এসে দৃশ্যটি দেখল। তবে কিছু না বলেই ভেতরে চলে গেল। কথা এবার শব্দ করে কেঁদে ফেলেছে। অপরা ওর মুখটা দু হাতে স্পর্শ করে বলল,”পাগল মেয়ে। কাঁদছিস কেন? তুই তো দেখি অনেক বড়ো হয়ে গেছিস। সেই ছোটটি আর নেই।”

তাতে কি? কথা’র কান্না কি থামে? থামে না তো। মেয়েটা কাঁদতে কাঁদতে আরো একবার অপরা’কে জড়িয়ে ধরে।

“অপুবু, এত গুলো বছর পর তোমাকে দেখতে পেলাম। আমার খুব কষ্ট হয়েছে অপুবু।”

কথার বলা একটা শব্দও মিথ্যে নয়। ও তো ভালোবাসে। ভালোবাসে অপুবু’কে। সেই অপুবুর সাথে পুরো ছয় বছর দেখা নেই। নেই কোনো যোগাযোগ। কথার আবেগ যেন খসে পড়ছে। ওদের এই আবেগের মুহূর্তেই বড়ো গিন্নি’কে আসতে দেখা গেল। তার পুরো মুখে হাসি। তিনি এসে দাঁড়ালেন। অপরা কেমন একটা অস্বস্তি অনুভব করল। তবে বড়ো গিন্নি যখন দু হাত মেলে দিয়ে কাছে ডাকলেন, তখন নিজেকে ধরে রাখতে পারল না ও। মায়ের ডাকা সারা দিয়ে, লুটিয়ে পড়ল। বড়ো গিন্নি ও দু হাতে জাপটে ধরে বললেন,”কত বছর হয়ে গেল। কেমন আছিস তুই?”

অপরা কেঁদে ফেলেছে। কান্নার দমকে কথা বলতে পারছে না। বড়ো গিন্নি সেটা বুঝে নিয়ে পিঠে হাত বুলালেন।

“ঠিক আছে। কোনো সমস্যা নেই। তুই আগে বোস তো।”

অপরা’কে বসিয়ে দিয়ে বড়ো গিন্নি ছুটে গেলেন। ছুটে গিয়ে ঠাণ্ডা শরবত নিয়ে এলেন। সেটা পান করতে করতে অপরা’র অতীতের এক টুকরো স্মৃতি স্মরণ হলো। গীষ্মের প্রচণ্ড গরমে অপরা যখন স্কুল শেষ করে আসত, তখন বড়ো গিন্নির হাতের এক গ্লাস শরবত ওর হৃদয়ে তৃপ্তি এনে দিত। সেই একই রকম অনুভূতি পাচ্ছে অপরা। ঠাণ্ডা শরবত পান করতেই অপরা’র হৃদয়টা আকুলিবিকুলি করে ওঠল। কিছুটা স্বাভাবিক ভাব ফিরে এল। বড়ো গিন্নি ফিরলেন ডাবের পুডিং নিয়ে। যা অপরা’র ভীষণ প্রিয়।

“তোমার এখনো মনে আছে বড়ো মা?”

বড়ো গিন্নি ঠোঁট দুটো প্রসারিত করে হাসলেন। পাশে বসে অপরা’র এক হাত তুলে নিয়ে বললেন,”অপু, তুই আমার সন্তান ছিলি, আছিস। তোর পছন্দ ভুলব কেমন করে?”

অতীতের দিন গুলো অপরা’কে আরো একবার স্পর্শ করে যায়। এই স্মৃতি গুলো জড়ো করেই তো দিন পার করেছে সে। অপরা মাথাটা নত করে শুধায়,”আর কাউকে তো দেখতে পাচ্ছি না। সবাই কি রাগ করে আছে?”

একটা ছোট্ট মন খারাপ ভেসে এল মেয়েটির কণ্ঠ থেকে। বড়ো গিন্নি সেটা বুঝে নিয়ে বললেন,”না রে। রাগ কেন করবে। সবাই তো খুশিই ছিল। তবে কি বল তো, একদম হঠা‍ৎ করেই রুবিনা’র ব্যথা শুরু হলো। মনে হচ্ছে আজই নতুন অতিথির আগমন ঘটবে।”

নতুন অতিথি! তার মানে কিয়ান ভাই আর রুবিনাবু’র তরফ থেকে নতুন প্রাণ আসতে চলেছে। অপরা’র কেমন একটা অনুভূতি হলো। চোখ দুটো টলমল করে ওঠল। মনে মনে খুশি হলো, এমন একটা সময় আসতে পারার জন্য।

ছয় বছর আগেও দাদিজান অসুস্থ ছিলেন। আজ ও তাই। বয়স তো কম হয় নি। অসুস্থ হওয়াটা স্বাভাবিক। অপরা দরজার কাছে এসে ঠকঠক করল। দাদিজান তাসবিহ পাঠ করছিলেন। বয়সের জন্য প্রায় সময় ই কাপড় অপবিত্র হয়ে যায়। তবু যখন সুযোগ পান, তিনি আল্লাহ’র নাম পাঠ করতে থাকেন। আজ ও এমন একটা সময়। অপরা’র ঠকঠক শব্দে ঘাড় ফিরিয়ে চাইলেন তিনি। ছোট সুরে বললেন,”কে?”

ঝাপসা চোখের দৃষ্টিতে অপরা’কে ঠিক ঠাক বুঝতে পারেন নি তিনি। অপরা কান্না আটকে রেখে বলল,”আমি,অপু।”

“অপু? এসে গেছিস।”

অপরা অনেকটা ছুটে গিয়ে দাদিজানের পায়ের নিকট বসে পড়ল। দাদিজান ঝাপসা চোখে অপরা’কে দেখতে লাগলেন। অপরা অভিমানের মতন করে বলল,”এতদিনে আমাকে মনে পড়ল তোমার? আমি তোমার এত পর?”

অপুর এই অভিমান স্বাভাবিক। দাদিজানের এত এত শর্তের বেড়াজালে পড়ে, অপরা’কে সব ছাড়তে হয়েছিল। যোগাযোগ রাখার ও পথ ছিল না। অপরা কেঁদে ফেলল শব্দ করে। দাদিজান এবার অপরা’র মাথায় হাত রাখলেন। মৃদু সুরে বললেন,”কদিন ধরেই মনে হচ্ছিল, আল্লাহ আমাকে ডাকছেন। তাই তোকে দেখার ইচ্ছে হলো। মা রা যাওয়ার আগে একটি বার না দেখতে পেলে বড়ো আপসোস থেকে যেত। তুই ভালো আছিস তো?”

চলবে….
কলমে ~ #ফাতেমা_তুজ_নৌশি