হৃদয়দহন পর্ব-২৯

0
50

#হৃদয়দহন (২৯)

রাতের খাবার খেয়ে অপরা বসেছিল কথার কক্ষে। কথা’র ভেতর অনেক অনেক কথা জমে আছে। সবটা না বলা অবধি শান্তি নেই। তাই আয়োজন চলছে। আড্ডার সময় হালকা কিছু খাবার না থাকলে, জমে ওঠে না। বাংলাদেশে শীত পুরো আসে নি। বিকেলের দিকটায় ভীষণ রোদ ও ওঠেছিল। তবে রাত হতেই মনে হলো ঠাণ্ডা লাগছে। কথা দুজনের জন্যই চা এনেছে। চা হাতে নিয়ে আরাম করে বসল দুজনে। তারপর চলল তাদের স্বাভাবিক আলাপ। অপরা’র কিছুটা সংকোচ লাগছিল। তবে কথা’র সাথে আলাপ করে মনটা ভালো হয়ে গেল। ওরা খুব রাত করে ঘুমাল। ফলশ্রুতি’তে সকালে ঘুম ভাঙল না। ঘুম ভাঙল দরজায় কড়া নাড়ার আওয়াজে। পরিচারিকা মেয়েটা ডাকছে,’আফা, ওঠেন। খবরটা শুইনা যান।’

কথা’র ঘুম ছুটছে না। অপরা জেগে ওঠল। এক পলক তাকিয়ে,ওঠে গিয়ে দরজা খুলে দিল। পরিচারিকা মেয়েটা বলল,”কিয়ান ভাইজানের মাইয়া হইছে। সবাই দেখতে যাইব। আপনাগো ও কইতে কইল।”

খবর’টা শুনে অপরা’র মনটা ভালো হয়ে গেল। মনে মনে শুকরিয়া পাঠ করল। এদিকে কথার ঘুম কিছুটা ছুটেছে। অপরা’র থেকে খবরটা পেয়ে খুশিতে ভরে ওঠল তার মুখশ্রী। ওরা তৎক্ষণাৎ তৈরি হয়ে নিল।

ফুটফুটে সুন্দর মেয়ে বাবু হয়েছে রুবিনার। অপরা’র ভেতরে কিঞ্চিৎ অস্বস্তি। ও দোমনা নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। রুবিনা অদূর থেকে ডাকল,”অপু?”

অপরা’র দিকে দৃষ্টি ফেলল সবাই। বাড়ির সবাই রয়েছে। এত গুলো চোখের দৃষ্টি দেখে অপরা’র ভেতরটা যে হু হু করে ওঠল। ও ধীর পায়ে প্রবেশ করল। একে একে কথা বলল সবাই। তবে কোথাও একটা সংকোচ অনুভব হচ্ছে। অপরা’র এই সংকোচ কাটাতে আরো একটু সময় দরকার। রুমে অনেক জন মানুষ হওয়াতে অপরা আর কথা বেরিয়ে পড়ল। অয়ন ভেতরে যায় নি। বাইরেই অপেক্ষা করছিল। কথা আসতেই বলল,”আমার কাজ পড়ে গেছে। আমি যাই। ড্রাইভার’কে পাঠিয়ে দিব।”

কথা সম্মতি জানাল। অয়ন বেরিয়ে পড়েছে। ও চলে যাওয়ার পর কথা আর অপরা নিচের ফ্লোরে এল। এখানটা বেশ খোলামেলা আর নীরব। দুজন বসে বসে গল্প করছিল। ওমন সময় অপরা’র মনে পড়ল, বাড়িতেও নীলাকে দেখে নি সে। হসপিটালেও নীলা নেই। তবে কোথায় আছে। ও একটু মিনমিনে সুরে বলল,”নীলাপু’কে তো দেখলাম না।”

এ কথার পর কথার মুখটা কেমন বির্বণ হয়ে এল। অপরা বুঝল না কিছু।

“কিছু ভুল বললাম নাকি?”

কথা উষ্ণ একটি নিশ্বাস ফেলল। তারপর অপরার দিকে চোখ মেলে চাইল।

“অনেক কিছু বদলে গেছে অপুবু।”

অপরা’র কপালে চিন্তার একটা রেখা তৈরি হলো। কথা মাথাটা নত করে বলল,”অয়ন ভাই কে দেখেছ? কেমন হয়ে গেছে। ভেতরে রস নেই। নেই কোনো অনুভূতি। সারাদিন শুধু কাজ আর কাজ।”

অপরা’র ভেতরটা উত্তেজিত হলো। তবে নিজেকে দমিয়ে রেখে অপেক্ষা করল ও।

“এই সব কিছুর জন্য নীলাপু দায়ী। আসলে, যে দুঃসময়ে পাশে থাকতে চায় না, তাকে দিয়ে জীবন চলে না।”

কথা কেমন প্যাঁচ মিশিয়ে বাক্য সাজাচ্ছে। অপরা এবার ধৈর্য হারিয়ে বলল,”বুঝতে পারছি না। সহজ করে বল। নীলাপু কোথায়?”

“হয়তো শ্বশুরবাড়ি।”

অপরা কেমন একটা ধাক্কা খেল। ছোট,ছোট চোখে দৃষ্টি মেলে দিয়ে বলল,”মানে? অয়ন ভাইয়ের সাথে….’

ওর মুখের কথা কেড়ে নিয়ে কথা বলল,”বিয়েটা হয় নি অপুবু। অয়ন ভাইকে শেষ করে দিয়ে গেছে।”

অপরা’র মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়ল। অপরা চলে যাওয়ার পর ই তো নীলা আর অয়নের বিয়ে হওয়ার কথা ছিল। তবে, কি এমন ঘটে গেল। ওর ভেতরটা শুকিয়ে আসছে। ও বলল,”আমি একটু পানি খেয়ে আসি।”

কথাকে রেখেই ওঠে পড়ল অপরা। দ্রুত গিয়ে পানি পান করল। চোখে মুখেও ছিটাল। এতে কিছুটা ভালো অনুভব হচ্ছে।

অপরা’র কিছুটা মন খারাপ হলো। মন খারাপ হলো অয়নের জন্য। এই মানুষ’টা অপরা’র জীবনে বিশেষ। সেই ছোট থেকে অয়নের সাথে ভাব তার। জীবনের টানাপোড়েনে অনেক দূরত্ব তৈরি হয়েছিল। তাই বলে সব তো ভুলে যায় নি সে। অয়ন’কে সব সময় মনে পড়ত অপরা’র। মানুষটার শাসন, কাজ করিয়ে নেওয়া, চায়ের জন্য ফোর্স করা, সব অপরা’কে প্রায়শই আবেগে ভাসাত। সেই মানুষটার জীবনে এমন কিছু ঘটে গেছে, ভাবতেই তো অপরা’র কান্না পাচ্ছে। কান্নাটা গিলে নিয়ে পাড়ায় প্রবেশ করেছিল অপরা। ওমন সময় আরো একটি পরিচিত কণ্ঠ শুনতে পেল। ডাকটা নুহাশের। ও কিছুটা দূরে ছিল। ছুটে এসে সামনে দাঁড়াল।

“অপু?”

নুহাশের কণ্ঠে উত্তেজনা। অপরা অনেকটা সংকোচে ডুবে গেল। কেমন একটা অস্বস্তি মিশিয়ে বলল,”জি।”

“তুমি তো কত বড়ো হয়ে গেছো অপু। চেনাই যাচ্ছে না।”

সত্যিই কি অপরা’কে চেনা যাচ্ছে না? নাকি নুহাশ বাড়িয়ে বলছে। অপরা ভেবে সুরাহা করতে পারল না।

“কেমন আছ? তুমি এসেছ শুনেই মনে হলো একবার দেখা করি। তাই আসা। মাঝে তোমাকে পেয়েও গেলাম।”

এবার অপরা’র লজ্জা লাগল। নুহাশ এতটা কষ্ট করে এসেছে। আর সে কি না সৌজন্যতা দেখাতেও কার্পণ্য করছে।

“আপনি কেমন আছেন?”

“ভালো। চলছে খারাপ না। চাকরি করছি, ঘুরে বেড়াচ্ছি। তুমি?”

“গ্রাজুয়েশন শেষ হলো এবার।”

“বাহ! তাহলে তো বেশ ভালো। একটা সময় তো পড়াশোনা করতেই চাও নি।”

এ কথা বলে নুহাশ নিজেই হাসল। অপরা’র ভালো লাগল। ভালো লাগল এটা ভেবে, দূরের একজন যে কী না ওর শিক্ষক ছিল। সেই মানুষটা এখনো তাকে মনে রেখেছে। অথচ অপরা আজও জানল না,নুহাশের হৃদয়ে তার জন্য বিশাল একটা জায়গা রয়েছে।

চায়ে চুমুক দিয়ে অয়নের মেজাজ খারাপ হলো। চিনি এত বেশি। ও বিরক্ত হয়ে চায়ের কাপটা রেখে দিল। বাড়ির সামনে যেখানটায় বড়ো ওঠান ছিল। সেখানে বেশ বড়ো একটা গ্যারেজ করা হয়েছে। অনেক গুলো গাড়ি রাখা। অয়ন কিছু লোক দিয়ে গাড়ি গুলো পরিষ্কার করাচ্ছিল। ওমন সময় অপরা বাড়িতে প্রবেশ করল। অয়ন পরিচারিকাকে ডেকে বলছে,”চায়ের মধ্যে চিনি এত বেশি কেন? এটা চা নাকি শরবত?”

বরাবরই এমন ভুল করে পরিচারিকা মেয়েটা। অয়নের মেজাজ বিগড়ে যায়। অপরা একটু এগিয়ে এসে গ্যারেজের কাছে দাঁড়াল। অয়ন তখনো চ্যাঁচিয়ে বলছে,”ঠিক ঠাক ওয়াশ করবেন। কাল কে বড়ো ট্রিপে যাবে। কোনো খামতি যেন না হয়।”

এ কথা বলে পেছন ঘুরতেই অপরা’র মুখোমুখি পড়তে হলো। হঠাৎ দর্শনে দুজনেই চমকাল।

“ফিরে এলে যে?”

অয়ন শুধাল। অপরা মিনমিনে সুরে বলল,”ভালো লাগছিল না। তাছাড়া দাদিজান ও তো বাসায় একা।”

“ও।”

এরপর নীরবতা। অয়ন আর অপু দুজনের মাঝেই বিশাল দূরত্ব তৈরি হয়েছিল। আর এই দূরত্ব ছয় বছরে বেড়েছে আরো অনেক বেশি। অপরা ঘরের ভেতরে প্রবেশ করতে নিচ্ছিল। তখনই কিছু একটা ভেবে ফিরে এল। অয়ন ফিরে চাইল। নরম সুরে শুধাল,”কিছু বলবে?”

“আমি চা করে দিব?”

অয়নের ভেতরটা কেমন একটা করে ওঠল। একটা সময় এই মেয়েটিকে দিয়ে কত কাজ করিয়েছে সে। না করলে চুল টেনে দিয়েছে। ধমক দিয়েছে। সময়ের পালা বদলে, আজ কাজে সম্মতি দিতে গিয়েও আটকে যাচ্ছে। অপরা জবাব না পেয়ে বলল,”চিনি তো এক চামচ ই খাওয়া হয়, তাই না?”

অয়নের ধ্যান ফিরে। ও ছোট করে বলে,”হ্যাঁ।”

এরপর আর কথা বাড়ায় নি অপরা। ও চলে গিয়েছে চা বানাতে। আর অয়ন, থমকে দাঁড়িয়েছে। ওর ভেতরে অনেক গুলো অপরাধবোধ কাজ করে। তার মধ্যে অপরা’র ব্যাপারটা বেশি পুড়ায়। কারণ, যে দায়িত্ব ছোট বয়সে সে পেয়েছিল, বড়ো হয়ে সেই দায়িত্ব ভুলে বসেছিল। নিজের জীবন নিয়ে এতটাই ব্যস্ত হয়ে গিয়েছিল যে, ভুলে বসেছিল অপরা’কে। অথচ জীবন তাকে সব দিক থেকে হারিয়ে দিল। নীলা যেদিন তাকে ছেড়ে গেল, তখন মনে হয়েছিল পৃথিবীটা শেষ হয়ে যাচ্ছে। অয়নের ফাইনাল পরীক্ষা ছিল কিছুদিন পরেই। সেটা আর দেওয়া হয় নি। পড়াশোনার পাঠ ওখানেই চুকে গেছে। তারপর কত গুলো মাস অয়নের ভেতরটা এক টুকরো শীতল বাতাসের জন্য হাহাকার করেছে। দীর্ঘদিন নিজেকে আড়াল করে রেখে, বুঝিয়েছিল নিজেকে। মন, মস্তিষ্কের লড়াই শেষ করে পড়াশোনায় ফেরা হয় নি। একদিন হুট করেই মনে হলো কিছু করা প্রয়োজন। সেই প্রয়োজন থেকেই পুরনো এক গাড়ি কিনেছিল অয়ন। ঠিক ঠাক করার পর, প্রায় দ্বিগুণ দামে সেটা বিক্রি হলো। এরপর ধীরে ধীরে গাড়ির ব্যবসায় পুরো ডুবে গেল অয়ন। এখন গ্যারেজে তাল ছয় খানা গাড়ি রয়েছে। যার প্রতিটাই ভাড়ায় চলে। অয়ন এক টুকরো অতীত স্মরণ করে দীর্ঘশ্বাস ফেলল। নিজের জীবনটা’কে নিয়ে মাঝে মাঝে আপসোস হয়। আপসোস হয়, ভুল ভালোবাসার। যেই ভালোবাসা অপরা’র থেকে তাকে দূরে সরিয়ে দিয়েছিল। ভুলে বসেছিল নিজের দায়িত্ববোধ। যা এখনো দহন দিয়ে যায়। জাগিয়ে তুলে অপরাধবোধ। তাই এখন, অপরাধবোধ নিয়েই লুকিয়ে থাকতে ইচ্ছে হয়। মনে হয়, মেয়েটার ওপর,তার আর কোনো অধিকার ই বেঁচে নেই। নিজের দোষেই তো সবটুকু হারিয়েছে সে।

চলবে….
কলমে ~ #ফাতেমা_তুজ_নৌশি