হৃদয়স্পর্শী মায়াবিনী পর্ব-২৭+২৮

0
135

#হৃদয়স্পর্শী_মায়াবিনী
#নুসাইবা_ইসলাম_হুর (মিমি)
#পর্বঃ২৭

সিম্পল লাল টুকটুকে শাড়ি পড়ে স্তব্ধ হয়ে বসে আছে ফারিসতা। একটু আগেই রুশা ধরে বেঁধে নিয়ে এসে ওকে শাড়ি পড়িয়ে সাজিয়ে দিলো। অবাক করার বিষয় ওর কথা কেউ শুনলোই না। সবাই ওর কথা এক প্রকার এড়িয়ে গিয়েছে। ফারিসতা বুঝে উঠতে পারলো না কেউ ওর কোনো কথা শুনতে কেনো চাচ্ছে না। কি এমন কথা তাজ সবাইকে বলেছে যার জন্য সবাই এমন বিস্ময়কর বিহেভিয়ার করছে।

রুশা ফারিসতাকে সাজিয়ে যাওয়ার পর বেডের উপরে আনমনা হয়ে বসে থাকা ফারজানা বেগমের দিকে তাকিয়ে ফারিসতা ঠোঁট উল্টে বলে উঠলো আম্মু তুমি অন্তত আমার কথাটা শো…

এবারো ফারিসতাকে পথিমধ্যে থামিয়ে দিয়ে ফারজানা বেগম গম্ভীর কণ্ঠে বলে উঠলো, এখন এক্সকিউজ দিয়ে লাভ নেই। তাজকে পছন্দ করো সেটা আমাকে জানালে আমি কি বাঁধা হয়ে দাঁড়াতাম? আজ পর্যন্ত আমার কাছে যা চেয়েছো কখনো বলতে পারবে সেই জিনিসটা তোমায় দেইনি? তাজ ছেলে হিসেবে খুবি ভালো। আমার থেকে সব লুকানোর জন্য রাগ করলেও জীবনে সঠিক কাউকে বেছে নিয়েছো এই জন্য সেই রাগটা এখন নেই। তাই আমার রাগ ভাঙানোর জন্য এক্সিউজ দিওয়ার প্রয়োজন নেই। তুমি বসো আমি একটু আসছি এ বলে ফারজানা বেগম ও রুম ত্যাগ করলো।

ফারিসতার এবার সত্যি মনে হচ্ছে সবাই ইচ্ছে করে ওকে এভাবে এড়িয়ে যাচ্ছে। কেনো এমন করছে সবাই? কি করবে এখন ও ভাবতে ফারিসতা রুমের ভিতরে পায়চারি করতে লাগলো কোনো একটা উপায় বের করার জন্য। ফারিসতার পায়চারির মাঝে হঠাৎ তাজ রুমে এসে দরজা বন্ধ করে দিলো। এই টাইমে তাজকে দেখে ফারিসতা জ্বলে উঠে তেড়ে তাজের কাছে যেয়ে বলে উঠলো,

সবাইকে আপনি কি বলেছেন? কেউ আমার কোনো কথা শুনছে না কেনো? কেনো আমাকে এভাবে বিয়ে করতে চাচ্ছেন? কি মতলব আপনার সত্যি করে বলুন আর নাহলে আমার চেয়ে খারাপ আর কেউ হবে না। বলুন কেনো বিয়ে করছেন আমায়?

ভালোবাসি তাই….

তাজের মুখে ভালোবাসি শব্দটা শুনে স্তব্ধ হয়ে গেলো ফারিসতা। পরক্ষণে নিজেকে সামলে ফারিসতা আচমকা তাজের কলার টেনে ধরে দাঁত কটমট করে বলে উঠলো,

আপনার মতো গুন্ডাকে আমি কখনো বিয়ে করবো না।

আমার মতো গন্ডাকে বিয়ে তো করবেই সাথে এই গুন্ডার বাচ্চার মাও হবে।

তাজের এহেন কথায় ফারিসতার রাগে দাঁত কিড়িমিড়ি দিয়ে বলে উঠলো, কোনো দিন ও না। আমি এখনি সবাইকে বলে দিবো সব সত্যি কথা।

তাজ বাঁকা হেঁসে কলার টেনে ধরে রাখা ফারিসতার হাত নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে ভ্রু নাচিয়ে বলল, এখানে আসার পর থেকে এখন পর্যন্ত বলতে পারলে না তা এখন কিভাবে বলবে?

কি বলেছেন সবাইকে? কেউ আমার কোনো কথা শুনছে না কেনো?

তা আমি কি করে জানবো? সবাইকেই জিজ্ঞেস করো না।

একদম নাটক করবেন না। সবাইকে কি বলেছেন বলুন বলছি।

বলেছি বাসাটা সবসময় নীরব থাকে। একটা জল্লাদ মেয়ে আনা দরকার সবার সাথে ঝগড়া করার জন্য। এখন সবাই তোমাকে সিলেক্ট করেছে৷ আমি জানি নাকি তোমাকে সবাই তোমাকে কেনো সিলেক্ট করেছে।

তাজের এমন কথায় ফারিসতা চোখমুখ কুঁচকে ফেললো। বুঝতে পারলো এর দ্বারা কিছু জানা সম্ভব না যা করার ওর এই করতে হবে কিন্তু করবে টা কি? কেউ তো ওর কোনো কথাই শুনছে না। এবার ফারিসতার মন চাচ্ছে হাত পা ছড়িয়ে ছিটিয়ে কান্না করতে। কেউ ওকে বুঝচ্ছে না এমনকি ওর মাও ভাবতে মায়ের প্রতি এক আকাশ সমান অভিমান জন্মালো ফারিসতা মনে।

ফারিসতাকে এমন চুপ হয়ে যেতে তাজ শান্ত চোখে ফারিসতাকে অবলোকন করে শান্ত গলায় বলল,

লিসেন যা হচ্ছে হতে দেও। শুধু এইটুকু যেনে রাখো যা হচ্ছে তোমার ভালোর জন্য হচ্ছে। আজ হোক বা দুইদিন পর হোক আমাকেই তোমার বিয়ে করা লাগবে তাই কোনো ঝামেলা না করে যা হচ্ছে চুপচাপ মেনে নেও। তুমি যত যাই চেষ্টা করো না কেনো কেউ তোমার কোনো কথা শুনবে না।

তাজের কথা নীরবে শ্রবণ করলো ফারিসতা কিন্তু কোনো প্রত্যুত্তর করলো না। বুঝতে পারলো এখন কোনো কিছু করেও লাভ হবে না। ব্যর্থ হয়ে ফারিসতা হাল ছেড়ে দিলো। যা হচ্ছে হতে দিলো। ছেড়ে দিলো সব কিছু ভাগ্যের উপরে। সব শেষে তিন কবুল বলে নিজেকে লিখে দিলো তাজ চৌধুরীর নামে। বিয়ে সম্পন্ন হতে ফারিসতাকে তাজের রুমে নিয়ে গেলে ও একটু একা থাকতে চায় বলে শব্দ বিহীন দরজা লাগিয়ে ডুলুমুলু পায়ে ড্রেসিং টেবিলের সামনে যেয়ে দাঁড়ালো। ড্রেসিংটেবিলের ভিতরে নিজের প্রতিবিম্বর দিকে তাকাতে জ্বলজ্বল করে উঠলো নাকফুল যেটা বিয়ের আগে ওঁকে পড়ানো হয়েছিলো। ফারিসতা কাঁপা কাঁপা হাতে নাক ফুলের উপরে হাত বুলালো। ক্রমশ বুক ভারী হয়ে আসছে। চোখে ফুটে উঠছে অশ্রুকণা। ও এখন বিবাহিত। আজ থেকে ঠাই হয়ে গেলো নতুন ঠিকানায়। মাকে ছাড়া এই নতুন ঠিকানায় কিভাবে থাকবে ভাবতে ফারিসতার দম আটকে আসলো। ওর তো নতুন ঠিকানা হয়েছে যেখানে ওর সবাই আছে কিন্তু ওর মায়ের? তার তো কেউ নেই এই পৃথিবীতে ও ছাড়া। ওকে ছাড়া ওর মা কিভাবে বাঁচবে? ওতো জানে ওকে ছাড়া ওর মা একটা মুহূর্ত ও থাকতে পারে না। মায়ের কথা ভেবে মুখে হাত চেপে ডুকরে কেঁদে উঠলো ফারিসতা। দম বন্ধকর যন্ত্রণায় কাতড়ে উঠলো পুরো শরীর। এভাবে কত সময় পেরিয়ে গেলো ফারিসতার জানা নেই। হঠাৎ দরজায় ঠুকঠুক শব্দ হতে ফারিসতা দ্রুত চোখের পানি মুছে ফেললো তখন দরজার ওপারে ফারাজানা বেগমের কণ্ঠস্বর শুনে ফারিসতার চোখজোড়া আবার ভিজে উঠলো। ফারিসতা কাঁপা কাঁপা পায়ে দরজার কাছে যেয়ে দরজা খুলতে মায়ের শুকনো মুখশ্রী দেখে হুহু করে কেঁদে উঠলো ফারিসতার মন। ফারিসতা আচমকা ফারজানা বেগমকে জড়িয়ে ধরে ডুকরে কেঁদে উঠলো।

মেয়ে এমন কান্নায় ফারজানা বেগমের ও চোখে পানি চলে আসলো। কলিজার টুকরো মেয়েটাকে আজ এখানে রেখে চলে যেতে হবে ভাবতে কলিজাটা ছিড়ে টুকরো টুকরো হয়ে যাচ্ছে। মেয়েকে আঁকড়ে ধরে এতটা বছর বেঁচে ছিলো আজকের পর থেকে তার এই কলিজাটাকে ছেড়ে থাকতে হবে ভাবতেই নিঃশ্বাস আঁটকে আসছে। মন চাইছে চিৎকার করে বলতে আমার কলিজাটাকে আমি সাথে করে নিয়ে যাই কিন্তু বলতে পারলো না।

ফারিসতার কান্নার বেগ ধীরে ধীরে বাড়তে লাগলো তা দেখে ফারজানা বেগমের কষ্ট লাগলেও নিজেকে সামলে ফারিসতার আড়ালে নিজের চোখের পানি অতি সপ্তপর্ণে মুছে নিয়ে ফারিসতার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলল,

বোকা মেয়ে কান্না করছো কেনো? মা সব সময় তোমার সাথে আছি। কান্না থামাও। প্রতিটি মেয়েকর এই এক সময় না এক সময় নতুন ঠিকানা হয় সেটাই আপন করে নিতে হয় মামনী। এখানের কেউ তোমার পর না সবাই তোমার আপন। তাহমিনা তোমার শাশুড়ি না ও তোমার আরেকটা মা। আর আমি তো আছিই। আগে তোমার একটা মা ছিলো এখন দুইটা মা হয়েছে। দেখেছো তোমার ভালোবাসা দ্বিগুণ হয়ে গিয়েছে এবার। সেই সাথে পাচ্ছো তিফাজ ভাইয়ের মত একটা বাবা। তুমি বাবা হারা বাবার ভালোবাসা পাওয়ার আকাঙ্খার কাঙাল। দেখবে তিফাজ ভাই সুস্থ হলে তোমার কত ভালো বাবা হয়ে ওঠে। এখন থেকে তুমি পরিপূর্ণ। তাজের মতো স্বামী পেয়েছো যে সবসময় তোমাকে আগলে রাখবে। আর কান্না না এখন থেকে তোমার নতুন জীবন শুরু। নতুন জীবনে সুখী হও মা সবসময় দোয়া করি।

আমার কিছু না চাই না আম্মু। আমি শুধু তোমাকে চাই আমাকে তোমার সাথে নিয়ে চলো না আম্মু কান্নায় ভেঙে পড়ে আহাজারি করে বলে উঠলো ফারিসতা।

ফারজানা বেগম ফারিসতার চোখের পানি মুছে দিতে দিতে ধেয়ে আসা গলায় বলল, বোকা মেয়ে আমার। এটা এখন থেকে তোমার সংসার। নিজের সংসার ফেলে চলে গেলে হবে? মাকে ছেড়ে সারাজীবন তো আর এখানে থাকবে না। তোমার যখন মন চাইবে মায়ের কাছে চলে যাবে। মা সবসময় আছি তোমার জন্য। আজ রাতটা এখানে থাকো। কাল সকালেই তাজ তোমায় নিয়ে যাবে আমার কাছে। সোনা মেয়ে আমার কান্না করে না। তুমিতো আমার স্ট্রং মেয়ে। নিজেকে শক্ত করো।

মায়ের কথায় ফারিসতা এবার হেকচি তুলে কান্না করে ফারজানা বেগমের দুই গালে হত রেখে বলল, কিভাবে থাকবো তোমায় ছাড়া আম্মু? আ..আমাকে এখানে ভালোবাসার মানুষের অভাব হবে না কিন্তু তোমায় কে ভালোবাসবে আম্মু? আমি ছাড়া যে তোমার এই পৃথিবীতে আর কেউ নেই। তুমি কিভাবে থাকবে আম্মু? থেকে যাও না আমার সাথে এখানে।

ফারজানা বেগম ফারিসতার হাত মুঠোয় নিয়ে হাতে চুমু খেয়ে বলল, আমাকে নিয়ে টেনশন করো না। আমার এক মেয়ে এখানে রেখে গেলে কি হবে আমার আরেক মেয়ে আছে তো। রাশফিয়ার সাথে একটু আগে কথা হলো। ও হোস্টেল থেকে আমার ওখানে চলে যাবে। এখন থেকে আমার সাথে থাকবে। মা একা থাকবো না একদম টেনশন করবে না। কাল তো মায়ের কাছে যাচ্ছোই তুমি। এমন আরো অনেক বুজ দিয়ে ফারজানা বেগম ফারিসতাকে শান্ত করে সবার থেকে বিদায় নিয়ে তাজের সাথে বেরিয়ে পড়লো তাজ পৌঁছে দিয়ে আসবে। এতো বুঁজের পর ও মেয়েটা তার যাওয়ার সময় কান্নায় ভেঙে পড়েছে। তার ওতো কষ্ট কম হচ্ছে না। কলিজার টুকরোটাকে এখানে রেখে যেতে তার কলিজাও পুড়ে যাচ্ছে তাও নিজেকে সামলে নিলো। প্রকাশ করলো না নিজের দুর্বলতা কারো সামনে।

****
সন্ধ্যা পেরিয়ে গিয়েছে অনেকটা সময় হলো। রাত বাজে এখন প্রায় আটটা। সাফোয়ান আনমনে গাড়ি নিয়ে এসে থামলো তালুকদার বাড়ির সামনে। সাফোয়ান গাড়ির জানা ভেদ করে সেকেন্ড ফ্লোরে বেলকনির দিকে তাকালো সাথে সাথে বুকের ভিতর মোচড় মেরে উঠলো। কত গুলো বিকেল বিভিন্ন অজুহাত দিয়ে অফিস থেকে এসে লুকিয়ে চুকিয়ে বারান্দায় বসে থাকা ফারিসতাকে দেখেছে। আর দেখা হবে না লুকিয়ে। এখন থেকে সব সময় চোখের সামনে থাকবে কিন্তু কখনো চোখ তুলে দেখার সাধ্য হবে না। শত হলেও বড় ভাইয়ের বউ এখন ফারিসতা কথাগুলো ভেবে সাফোয়ান দুর্বল চিত্তে হাসলো। ঢোক গিলে ঢোকের সাথে নিজের কষ্ট গুলো ও গিলে নিতে চাইলো কিন্তু এত সহজে যদি কষ্ট গিলে নেওয়া যেতো তাহলে কি মানুষ দিনের পর দিন ধুকে ধুকে ম/র/তো?

সাফোয়ান সেকেন্ড ফ্লোর থেকে চোখ সরিয়ে তাকালো সিক্স ফ্লোরে। চোখের সামনে ভেসে উঠলো আদরিবার আর্তনাদ। সাফোয়ান জ্বিভ দিয়ে শুকনো ঠোঁট ভিজিয়ে আদরিবার নাম্বারে কল করলো। সব সময়ের মতো এবারো প্রথম কলেই ফোন রিসিভ হলো কিন্তু সব সময় ফোন রিসিভ করেই অস্থির চিত্তে হ্যালো বলে ওঠা মেয়েটা আজ নীরব। গভীর নিঃশ্বাসের শব্দ ছাড়া আর কিছুই শোনা গেলো না ওপাশ থেকে। তখন সাফোয়ান ধীর গলায় শুধালো,

একটু নিচে আসতে পারবি?

সারাদিন পর সাফোয়ানের কণ্ঠস্বর শুনে আদরিবার চোখ জোড়া ভিজে উঠতে লাগলো। কাল জ্ঞান ফেরার পর থেকে যন্ত্রণায় দুমড়েমুচড়ে গিয়েছে মেয়েটা। জানে কাঙ্ক্ষিত মানুষটা অন্য কাউকে ভালোবাসে তবুও পিপাসাত্বক কাকের মতো অপেক্ষা করেছে মানুষটার সাথে একটু কথা বলার আকাঙ্খায়।

আসতে পারবি?

ফের সাফোয়ানের প্রশ্নে আদরিবা ঠোঁট কামড়ে ধরে কান্না আটকানো ব্যর্থ চেষ্টা করে ছোট করে হ্যা বলে ফোন কাটতে নিলে সাফোয়ান বলে উঠলো,

শোন….

আদরিবারো এবারো কান্না আঁটকে ছোট করে বলল হুম…

আন্টিকে বলে আসিস ফিরতে একটু লেট হবে একটা জায়গায় যাবো।

সাফোয়ানের কথায় আদরিবা সম্মতি দিয়ে আমেনা বেগমের থেকে অনুমতি নিয়ে ধীরে নিচে নেমে আসলো। অন্য সময় হলে এক ছুটে হুমড়ি খেয়ে নিচে নেমে যেতো কিন্তু আজ নেই কোনো তাড়া উল্টো সামনে যত আগাচ্ছে বুক তত ভারী হচ্ছে। ক্রমশ কান্নাগুলো দলাপাকিয়ে উপচে পড়তে চাচ্ছে। আদরিবা ধীর পায়ে গেট পেরিয়ে বাহিরে আসতে জানালা ভেদ করে সাফোয়ানের মুখশ্রীর দিকে চোখ যেতে হঠাৎ বুকের ভিতর ছ্যাত করে উঠলো।

#চলবে?

#হৃদয়স্পর্শী_মায়াবিনী
#নুসাইবা_ইসলাম_হুর (মিমি)
#পর্বঃ২৮

নির্জন কোলাহলহীন রাস্তার পাশে ছোট একটা বেঞ্চিতে পাশাপাশি বসা সাফোয়ান আর আদরিবা। করো মুখে নেই কোনো কথা। আদরিবা আরো চোখে বার বার ল্যাম্পপোস্টের হলদেটে আলোয় সাফোয়ানের দিকে তাকাচ্ছে। হুট করে সাফোয়ানকে এমন বিধ্বস্ত লাগছে কেনো ভাবতে আদরিবার বুকের ভিতর মোচড় মেরে উঠছে। কালকের ঘোরের মাঝে বলে ফেলা কথাগুলোর জন্য কি তার এই অবস্থা ভাবতে আদরিবার জ্বিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে আমতা আমতা করে নীরবতা ভেঙে বলল,

সাফোয়ান ভাই কালের কথা গুলোর জন্য আমি দুঃখিত। ঘোরের মাঝে কি বলতে কি বলেছি আমি নিজেও জানিনা।

কাল ঘোরের মাঝে কথাগুলো না বললে কি সারাজীবনের জন্য নিজের অনুভূতি লুকিয়ে রাখতি?

সাফোয়ানের প্রশ্নে আদরিবা চুপ হয়ে গেলো। কি জবাব দিবে এই প্রশ্নের?

আদরিবাকে চুপ হয়ে যেতে দেখে সাফোয়ান অন্ধকার আকাশের তাকিয়ে স্লান হেসে বলল, আজ তাজ ভাইয়ের সাথে ফারিতার বিয়ে হয়েছে জানিস?

সাফোয়ানের কথাটা কর্ণগোচর হতে বিনা মেঘে বজ্রপাতের ন্যায় বাজতে লাগলো আদরিবার কানে। আদরিবা মৃদু চেচিয়ে বলে উঠলো কি…?

যেটা শুনেছিস সেটাই। আগে থেকে জানতি ওরা একে অপরকে ভালোবাসে?

আদরিবা এবার আরো চমকালো। ওদের জানা মতে তো ফারিসতা তাজকে ভালোবাসে না তাহলে সাফোয়ান কেনো বলছে দুইজন একে অপরকে ভালোবাসে। এমন ঘোর পেচানো কথায় আদরিবা কি জবাব দিবে তাতক্ষণিক খুঁজে পেলো না। আদরিবা নড়েচড়ে বসে তাকালো সাফোয়ানের ব্যথার্ত মুখের দিকে। শত হলেও তো এই লোকটা ফারিসতাকে ভালোবেসে। এক পাক্ষিক ভালোবাসা মানুষকে কতটা পোড়ায় তা ওর চেয়ে ভালো আর কে জানে? আদরিবা সাফোয়ানকে প্রশ্নবিদ্ধ চোখে ওর দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে মাথা নিচু করে ওপর নিচ দোলালো তা দেখে সাফোয়ান গম্ভীর কণ্ঠে বলল, আগে কেনো বললি না কথাটা আমায়?

সাফোয়ানের এমন প্রশ্নে আদরিবা থতমত খেয়ে বলে উঠলো, তুমি কখনো জিজ্ঞেস করেছো? কি বলতাম আমি?

তা বলবি কেনো পারবি তো সব কিছু নিজের মনের ভিতর লুকিয়ে রাখতে ষ্টুপিড।

আদরিবার চোখ ছোট ছোট করে বলল, শোকের কারণে পাগল হয়ে গেছো? আজব কিছু না জিজ্ঞেস করলে কি বলতাম আমি?

আমার মাথা বলতি।

সাফোয়ানকে এমন উল্টা পাল্টা বকতে দেখে আদরিবা পূর্ণ দৃষ্টিতে সাফোয়ানের দিকে তাকিয়ে বলল, বেশি কষ্ট হচ্ছে?

না মজা লাগছে যাকে ভালোবেসেছি এখন তাকে ভাবি ডাকতে হবে। আদরিবা আমি কি করবো বুঝতে পারছি না। ফারিসতা আমার প্রথম অনুভূতি হলেও এখন ও আমার বড় ভাইয়ের বউ। আমার খুব অস্বস্তি হচ্ছে। কি করে ওর সামনে দাঁড়াবো?

সাফোয়ানের অস্বস্তি টের পেয়ে আদরিবা ছোট করে বলল, এতো চাপ নিও না ফারিসতা তো আর বিষয়টা জানেনা।

তুই জানিস এখানেই তো ভয়। তোর যেই ঠোঁট পাতলা। পেটের সব কথা সবার কানে না পৌঁছানো পর্যন্ত তোর পেটের ভাত হজম হয়না। এই কথা যদি ভুলেও ফারিসতার কানে যায় তাহলে তোর খবর আছে।

আদরিবা ঠোঁট উল্টে বলে, এই কথা সত্যি বলবো না।

সত্যি বলছিস তো?

একদম সত্যি এই যে তোমাকে ছুয়ে বললাম এ বলে আদরিবা অনামিকা আঙুল দিয়ে সাফোয়ানের হাতে গুতা মারার মতো করে ছুঁয়ে দিলো।

আদরিবার এমন বাচ্চাসুলভ আচরণে সাফোয়ান চোখ ছোট ছোট করে বলল, এখনো বড় হলি না।

সাফোয়ানকে আগের মত স্বাভাবিক ভাবে কথা বলতে দেখে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো আদরিবা। কাল ঘোরের মাঝে সব বলে দিয়েছিলো ভাবতে অস্বস্তিতে গাট হয়ে ছিলো কিভাবে সাফোয়ানের সাথে কথা বলবে। ভাবতেও কেমন অবকা লাগছে পাশাপাশি দুটি মানব বসা যারা দু’জনেই ব্রোকেন কিন্তু চাপা কষ্ট গুলো নিজেদের মাঝে চাপা রেখে স্বাভাবিক ভাবে কথা বলছে।

***
রাত ১২ টার দিকে বাসায় ফিরলো তাজ। ফারজানা বেগমকে পৌঁছে দিয়ে হসপিটালে বাবার কাছে যায়। তিফাজ চৌধুরীর কাছে রিফাজ চৌধুরী আর সৌরভ চৌধুরী ছিলো তাই তাজ যেতে তারা তাজকে আর আজ থাকতে না দিয়ে বাসায় পাঠিয়ে দিলো। তিফাজ চৌধুরীর দেখাশোনা করে তাজ বাসায় ফিরে নিজের রুমে প্রবেশ করতে দেখলো ফারিসত গুটিসুটি হয়ে বেডের এক কোনে ঘুমিয়ে আছে। এখনো শরীরে সাথে লেপ্টে আছে লাল শাড়ি। মুখের সাজসজ্জা তুলে ফেললেও শাড়িটা পাল্টানো হয়নি। ফর্সা শরীরে লাল শাড়িটা একটু বেশি মানিয়েছে। তাজ ধীর পায়ে ফারিসতার কাছে এগিয়ে গেলো। নীরবে অবলোকন করলো ঘুমন্ত মুখশ্রীটাকে। নাকের ডগা সহ দুই গাল লাল হয়ে আছে। ভেজা ঘন চোখের পাপড়ি। এখনো চোখের কোটরে পানি জমা হয়ে আছে। বুঝতে পারলো মেয়েটা কান্না করতে করতে ঘুমিয়ে পড়েছে। তাজ গভীর ভাবে ফারিসতাকে পর্যবেক্ষণ করে ধীর গলায় বলল, কাউকে কান্নার পর এতটা স্নিগ্ধ লাগে সেটা তোমায় না দেখলে জানাই হতো না এ বলে ফারিসতার চোখের কোটরে জমা হওয়া পানি বৃদ্ধাঙ্গুল দিয়ে মুছে দিয়ে আলতো করে ফারিসতার মাথায় হাত বুলিয়ে বলল, ক্ষনিকের কষ্ট দিয়েছি কিন্তু এর বিনিময়ে পৃথিবীর সবটুকু সুখ তোমায় এনে দিবো প্রমিজ শুভ্র পরী এ বলে তাজ ফারিসতার থেকে সড়ে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে নিচে নামলো৷

তাজ নিচে নামতে তাহমিনা বেগম তাজকে খাবার বেড়ে দিলো। তাজ চুপচাপ খাবার মুখে দিতে গিয়ে কিছু একটা মনে করে তাজ তাহমিনা বেগমের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলো, ও খেয়েছে?

তাজের প্রশ্নে তাহমিনা বেগম হতাশ শ্বাস ফেলে বলল, খায়নি ফারজানার জন্য কান্না করেই যাচ্ছে মেয়েটা। জোর করেও এক ঢোক পানি খাওয়াতে পারিনি।

মায়ের কথা নীরবে শ্রবণ করে তাজ খাবার মুখে নিতে নিতে বলল, এক প্লেট খাবার বেরে রেখে তুমি ঘুমাতে যাও রাত অনেক হয়েছে শরীর খারাপ করবে।

যাচ্ছি তুই খাওয়া শেষ কর। তোর বাবার কি অবস্থা এখন? আজকের ঝামেলার জন্য তো হসপিটালে যেতে পারলাম না।

টেনশন নিও না বাবা ঠিক আছে। দুই এক দিনের ভিতরে বাসায় নিয়ে আসা যাবে।

সব কিছু ঠিক আছে শুনে তাহমিনা বেগম স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে ছেলের পাশে বসে রইলেন। তাজের খাওয়া শেষ হলে সব কিছু গোছগাছ করে ঘুমাতে গেলেন।

তাজ খাবারের প্লেট নিয়ে রুমে এসে প্লেটটা টেবিলের উপরে রেখে ফারিসতার কাছে গেলো। ফারিসতার ঘুমন্ত মুখশ্রীর দিকে তাকিয়ে ইচ্ছে করলো না ঘুমটা ভেঙে দিতে। কিন্তু কি করার কিছুতো খেতে হবে। দুপুরেও খায়নি এখন ও না খেলে শরীর খারাপ করবে তাই তাজ ফারিসতাকে মৃদু ধাক্কা দিয়ে ডাক দিতে ফারিসতা পিটপিট করে চোখ খুলতে চোখের সামনে তাজকে দেখে আচমকা ফারিসতা হুমড়ি খেয়ে উঠে বসলো। উঠে বসে রুমের চারপাশে চোখ বুলাতে লাগলো তাজ কিভাবে ওর রুমে এসেছে কিন্তু রুমে চোখ বুলাতে খেয়াল হলো এটা তাজের এই রুম। তখন কান্না করতে করতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছে নিজেও জানেনা।

টেবিলের উপরে খাবার আছে খেয়ে যত খুশি ঘুমাও।

ফারিসতা তাজের থেকে চোখ সড়িয়ে টেবিলের উপরে খাবারের দিকে একবার অবলোকন করে ফের চোখ সরিয়ে এনে গাল ফুলিয়ে বলে উঠলো, খাবো না।

খাইয়ে দিতে হবে নাকি? ভ্রু নাচিয়ে বলল তাজ।

তাজের এমন গা ছাড়া ভাব কথায় ফারিসতার শরীর জ্বলে উঠলো। এই ছেলে আগেই ভালো ছিলে সব সময় গুনে গুনে কথা বলতো যতটুকু বলতো ধকম আর থ্রেট দিতো। আর সেই ছেলেকে ইদানিং এমন পট পট করতে দেখে ফারিসতার মনে হলে এর চেয়ে আগের মতো গুনে গুনে ধমক খাওয়াও ভালো ছিলো। ফারিসতা তাজের দিকে তাকিয়ে দাঁত কটমট করে বলল,

আমি বলেছি খাইয়ে দিতে হবে?

তো কি? ইচ্ছে করেই না খেয়ে আছো যাতে খাইয়ে দেই। আমার কিন্তু সমস্যা নেই আমি খুব ভালো করে খাইয়ে দিতে পারি।

তাজের কথায় ফারিসতার চোখ বড় বড় হয়ে গেলো। মনে পরে গেলো সেদিনের কথা যেদিন টেবিলে সবার সামনে তাজ ওকে খাইয়ে দিয়েছিলো। মুখের খাবার গিলার সুযোগ টুকুও দেয়নি একের পর এক চামচে খাবার তুলে ওর মুখে পুরে দম আঁটকে ফেলার মত অবস্থা করেছে আর সেই ছেলে নাকি বলে ভালো করে খাইয়ে দিতে পারে।

ওঁকে ওয়েট খাইয়ে দিচ্ছি এ বলে খাবার হাত নিতে যাবে তার আগে ফারিসতা চেচিয়ে না বলে হুমড়ি খেয়ে উঠে গিয়ে খাবারের প্লেট নিজের হাতে নিয়ে বলে উঠলো আমি নিজেই খেতে পারবো।

ফারিসতার কাজে তাজ ঠোঁট কামড়ে হেঁসে গুড বলে বেডের উপরে যেয়ে বসলো। ফারিসতাকে খাবার না খেয়ে খাবার হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ভ্রু কুঁচকে বলল, খাচ্ছো না কেনো আমি আসবো ওখানে?

ফারিসতা দাঁত কটমট করে মনে মনে তাজের গোষ্ঠী উদ্ধার করে ধীর পায়ে সোফায় যেয়ে বসে ছোট ছোট লোকমা তুলে অর্ধেক খাবার শেষ করে উঠে যেতে নিবে তখন তাজ তীক্ষ্ণ কণ্ঠে বলে উঠলো পুরো খাবার শেষ করবে একটাও যেনো না থাকে।

ফারিসতা এবার তেতে উঠে বলে উঠলো, একদম আমার মায়ের মতো শাসন করবেন না। এই পৃথিবীতে একমাত্র আম্মু আমাকে শাসন করবে। আম্মু ব্যতিতো কারো শাসন আমি ফারিসতা পরোয়া করবো না বলে ফারিসতা অর্ধ খাওয়া প্লেট নিয়ে রুম থেকে হনহনিয়ে বেরিয়ে গেলো।

ফারিসতার যাওয়ার দিকে চোখমুখ কুঁচকে তাকিয়ে তাজ বলে উঠলো, সবার আগে এর ত্যাড়া রগ সোজা করতে হবে তারপর যা করার করবো। একটু আগে কান্না করে সব ভাসিয়েছে আর এখন আবার যেই সেই ঘাড় ত্যাড়া জেদি মেয়ে।

ফারিসতা নিচে নেমে কিচেনে যেয়ে এটো প্লেট ধুয়ে রেখে হাত মুছতে মুছতে উপরে উঠলো। রুমে এসে দেখলো তাজ বেডের সাথে হেলান দিয়ে ফোন স্ক্রোল করছে। ফারিসতা রুমে এসে তাজকে অবলোকন করে বলে উঠলো আমি সোফায় ঘুমাতে পারবো না আমার ঘুমাতে বেশি জায়গা লাগে।

ফারিসতার কথায় তাজ ভ্রু কুঁচকে বলল, তা আমি কখন তোমায় বললাম সোফায় ঘুমাতে?

আপনি বেডে রাজত্ব করে বসে আছেন তো আমি কোথায় ঘুমাবো?

তাজ নিজের পাশে থাকা বিশাল আকৃতির জায়গা অবলোকন করে ফারিসতার উদ্দেশ্যে বলল, পাশে যথেষ্ট জায়গা আছে।

অসম্ভব আপনার সাথে এক বেডে জীবনেও ঘুমাবো না। সোফায় যান বেড আমাকে দিন।

আমার রুম আমার বেড আর আমাকে বলছো সোফায় ঘুমাতে?

কে বলেছে আপনার রুম আপনার বেড? এখন থেকে সব কিছুতে সমান অধিকার আমার আছে। বিয়ে করার খুব শখ তাইনা? এবার বুঝবেন বিয়ে করার মজা।

তাজ ঠোঁট গোল গোল করে বলল, ওও আচ্ছা… যার সমস্যা সে সোফায় যাক আমার কোনো সমস্যা নেই এ বলে তাজ সোজা হয়ে শুয়ে পড়লো।

তাজের কাজে ফারিসতা কোমরে হাত দিয়ে কিছুক্ষণ তাজের দিকে দাঁত কটমট করে তাকিয়ে থেকে ধুপধাপ পা ফেলে সেখান থেকে চলে যেতে নিবে তখন আচমকা পিছ থেকে হাতে টান পড়লো। ফারিসতা দাঁত কটমট করে ঘাড় ঘুরিয়ে তাজের দিকে তাকাতে তাজ উঠে স্মিত হেঁসে বেডে যাও বলে ফারিসতার হাত ছেড়ে দিয়ে রুমের লাইট নিভিয়ে ড্রিম লাইট জ্বালিয়ে দিয়ে সোফায় শুয়ে পড়লো৷

#চলবে?

ভুলত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।
হ্যাপি রিডিং…🥰