#হৃদয়স্পর্শী_মায়াবিনী
#নুসাইবা_ইসলাম_হুর (মিমি)
#পর্বঃ৩১
সৌরভ চৌধুরী আপনাকে আমি খুব একটা চিনি না কিন্তু আপনার ভাতিজা তাজ চৌধুরীর কথা লোকমুখে অনেক শুনেছি। আমি আমার সাধ্য মতো আপনাদের খোঁজ নিয়ে জেনেছি আপনাদের এত ক্ষমতা থাকা সত্যেও তার অপব্যবহার করেন না। দেশের সমাজের মানুষের ভালোর জন্য অনেকটা অবদান আপনারা রাখেন। তাই আপনাদের ভরসা করে আমি কিছু সত্যি জানাতে চাই। নাহির খান সবার সামনে যতটা মহান ঠিক তার চেয়েও ভয়ংকর তার ভিতরের রূপ। তার ডাক্তারি পেশার আড়ালে রয়েছে হিংস্রতা। ডাক্তারি পেশার সুযোগ নিয়ে হসপিটালে জন্ম নেওয়া নবজাতক শিশুদের কৌশলে সরিয়ে দিয়ে মৃত বাচ্চাদের বাবা মায়ের হাতে তুলে দেয়। সেই নবজাতক বাচ্চাদের সরিয়ে নিয়ে বিক্রি করে দেয় সেই সাথে রোগীদের অপারেশন করার সময় শরীরের বিভিন্ন অংশ রেখে দিয়ে কালোবাজারি ব্যবসা করে। শুধু এইটুকুতে ক্ষান্ত না বছর শেষে শত শত মেয়েদের পাচার করার ব্যবসায়ের সাথে ওনার আর ওনার ভাইয়ের হাত আছে৷ এমনকি আপনার ভাইয়ের হসপিটালের অর্ধেক শেয়ার কেঁড়ে নেওয়ার জন্য তাকে মারার প্ল্যান ও রোজ রোজ করে চলেছে। আমার কথা বিশ্বাস না হলে আপনারা খোঁজ নিয়ে বিষয়টা দেখতে পারেন তাহলে সবটা ক্লিয়ার হয়ে যবে। আপনার কাছে হাত জোর করে মিনতি করছি এই নরপশু জা* দের ধ্বংস করে দিন। তাদের জন্য রোজ রোজ হারাচ্ছে হাজারো প্রাণ। আমার বিশ্বাস আপনারা এই জা* দের উপর্যুক্ত শাস্তি দিবেন।
জানিনা আজকের পর আমার এই পৃথিবীর সূর্য দেখার আর সুযোগ হবে কিনা। আপনাকে আমি সব বলে দিয়েছি এই কথা আপনি বাসার বাহিরে পা দেওয়ার সাথে সাথে তার কানে চলে যাবে। কিন্তু এতে আমার আফসোস নেই কারণ ততক্ষণে চিঠিটা আপনার হাতে পৌঁছে যাবে। আমি আমার জীবনের বিনিময়ে এই নরপশুদের শাস্তি চাই। মুক্তি দিতে চাই হাজারো তরুণী, নবজাতক শিশু, অসহায় মানুষদের। দয়া করে এই অসহায় মানুষদের সহায় হোন৷ ধ্বংস করে দিন এই জা*দের।
চিঠিটা পড়ে স্তব্ধ হয়ে গেলো সৌরভ চৌধুরী। একজন নারী যে নিজের জীবনের পরোয়া না করে এত বড় কাজ করেছে৷ যদিও তাঁরা এই কয়দিনে খোঁজ নিয়ে নাহির খানের সব কুকর্মের কথা জেনে গিয়েছে শুধু প্রমান গুলো হাতে পাওয়া বাকি ছিলো। এই স্বার্থপর যুগে তিনি নিজের জীবন বিসর্জন দিয়ে তাদের কাছে সত্যিটা পৌঁছে দেওয়ার জন্য কতটা অবদান রেখেছে ভাবতে সৌরভ চৌধুরীর থমকে গেলো। সৌরভ চৌধুরীরকে এমন থম মেরে বসে থাকতে দেখে তাজ ড্রাইভ করতে করতে বলল, কি হয়েছে? কি লেখা আছে?
সৌরভ চৌধুরী কোনো কথা না বলে তাজের দিকে চিঠিটা বাড়িয়ে দিলো। তাজ ড্রাইভ করার পাশাপাশি চিঠিতে চোখ বুলালো। মিসেস জেরিনার এই নিঃস্বার্থ অবদান দেখে তাজও থমকালো। ততক্ষণে গাড়ি হসপিটালে পৌঁছে যেতে মিসেস জেরিনাকে দ্রুত অ্যাডমিন করালো। দুপুরে তার জ্ঞান ফিরলো। জ্ঞান ফিরতে দুর্বল শরীরে উঠে বসে বুঝে উঠতে চাইলো কোথায় আছে তিনি। তখন তাজ আর সৌরভ চৌধুরী কেবিনে প্রবেশ করতে ভদ্রমহিলা চমকে উঠলো। তাজ আর সৌরভ চৌধুরী মিসেস জেরিনাকে কিছু একটা বলে তাঁদের সাথে নিয়ে গেলো। তিফাজ চৌধুরী ও এখন মোটামুটি সুস্থ এখন বাসায় নিয়ে যাওয়া যাবে তাই তিফাজ চৌধুরী আর মিসেস জেরিনাকে নিয়ে চৌধুরী নীড়ে প্রবেশ করতে তিফাজ চৌধুরীকে তাজ আর সৌরভ চৌধুরী ধরে নিয়ে সোফায় বসালো। অসুস্থ হওয়ার পর থেকে ছেলে আর ভাইয়ের এই কেয়ার গুলো দেখে জ্বলজ্বল করে উঠলো তিফাজ চৌধুরীর চোখ। এত বছর রাগ অভিমান করে ভাই আর ছেলের সাথে কতটাই না দূরত্ব বজায় করে ছিলো ভাবতে খুব করে আফসোস হলো কেনো আরো আগে থেকে ভাইকে আর ছেলেকে বুঝলো না তাহলে এতগুলো বছর তো এতটা সুন্দর মধুর হয়ে কাটতো। সবাই এক হয়ে থাকতো। একজনের কষ্টে আরেকজন এভাবে কাঁধে ভরসা হাত রেখে পাশে থাকতো।
তিফাজ চৌধুরীকে সোফায় বসাতে তাহমিনা আর রেহেনা বেগম তার দেখভাল করতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। কারো চোখ মিসেস জেরিনার দিকে না পড়লেও রুশার চোখ যেয়ে পড়লো দরজার সামনে গুটিশুটি হয়ে মলিন মুখে দাঁড়িয়ে থাকা মিসেস জেরিনার দিকে। অত্যান্ত রূপসীর অধিকারী ভদ্রমহিলার মুখের এক এক জায়গায় আঘাতে চিন্হ স্পষ্ট। রুশা সেদিকে কিছুক্ষণ ভ্রু তাকিয়ে তাজের উদ্দেশ্যে বলল, তাজ ভাইয়া উনি কে?
রুশার প্রশ্নে এতক্ষণ সবার চোখ মিসেস জেরিনার দিকে পড়তে তিনি আরো গুটিয়ে গেলো। তাহমিনা আর রেহেনা বেগম তাজের দিকে প্রশ্নবিদ্ধ চোখে তাকাতে তাজ গলা ঝেড়ে বলল,
সব প্রশ্নের উত্তর একটু পর জানতে পারবে। আগে ওনাকে একটু ফ্রেশ হয়ে রেস্ট করতে দেও। ওনার শরীর দুর্বল রেস্টের প্রয়োজন।
তাজের কথায় কেউ আর কোনো প্রশ্ন করলো না। রেহেনা বেগম মিসেস জেরিনার কাছে যেয়ে বলল, আমার সাথে আসুন।
মিসেস জেরিনা কোনো বাক্য বিনয় না করে গুটি গুটি কদমে রেহেনা বেগমের সাথে উপরে উঠে গেলো। তারা যেতে তাজ তাহমিনা বেগমের উদ্দেশ্যে বলল, বাবার দিকে খেয়াল রাখো আমি ফ্রেশ হয়ে আসছি এ বলে উপরে উঠে গেলো।
ছেলের যাওয়ার দিকে ছলছল চোখে তাকিয়ে তিফাজ চৌধুরী এবার সৌরভ চৌধুরীর দিকে তাকালো। ভাইয়ের ক্লান্ত মুখের দিকে তাকিয়ে তিনি নম্র স্বরে বলল, তুমিও ফ্রেশ হয়ে আসো।
এত বছর পর ভাইয়ের নম্র স্বর শুনে সৌরভ চৌধুরীর ঠোঁটে কোনে খুশির ঝলক ফুটে উঠলো। তিনি খুশি হয়ে বলল, সমস্যা নেই ওরা আসুক তারপর যাই।
আমাকে নিয়ে এত ভেবো না আমি ঠিক আছি এখন। কোনো প্রয়োজন হলে ডেকে নিবো। তোমাকে ক্লান্ত লাগছে ফ্রেশ হয়ে আসো।
ভাইয়ের কথায় চিকচিক করে উঠলো সৌরভ চৌধুরী চোখ। আজ কতগুলো বছর পর বড় ভাই রূপে বাবার মত স্নেহটা আবার খুঁজে পেয়ে আনন্দে চোখ জোড়া চিকচিক করে উঠলো।
***
তাজ রুমে প্রবেশ করতে চোখ পড়লো বেডের সাথে হেলান দিয়ে চোখ বুঁজে আছে ফারিসতা। কলাপাতা রঙের মায়ের শাড়িতে অর্ধাঙ্গিনীর দেখে মন জুড়ে ছেয়ে গেলো শীতলতা। ফারিসতার স্নিগ্ধ মুখের দিকে তাকাতে তাজের সব ক্লান্ত মুহূর্তের মাঝে ভ্যানিশ হয়ে গেলো। তাজ ধীর পায়ে ফারিসতার কাছে এগিয়ে গিয়ে কপালে হাত রাখলো জ্বর চেক করার জন্য।
কপালে কারো হাতের ছোয়া পেতে ফারিসতা পিটপিট করে চোখ খুলে চোখের সামনে তাজকে দেখে কিছুটা চমকে উঠলেও নিজেকে সামলে নিয়ে কপাল থেকে তাজের হাত সরিয়ে গাল ফুলিয়ে বলল, আমাকে সকালে আম্মুর কাছে নিয়ে যাওয়ার কথা ছিলো। নিয়ে যাননি কেনো?
ফারিসতার অভিমানী কণ্ঠস্বর শুনে স্মিত হেঁসে তাজ ফারিসতার ফুলানো গাল বাচ্চাদের মতো টেনে দিয়ে বলল, শরীরে এখনো জ্বর কাল সারারাত ছটফট করেছো এরপর ও শক্তি আছে জার্নি করার?
তাজ এভাবে গাল টেনে দিতে ফারিসতা নাকের পাটা ফুলিয়ে ক্ষেপে বলল, একদম গাল টানবেন না।
ফারিসতাকে আরো ক্ষেপানোর জন্য তাজ আবারো ফারিসতা গাল টেনে দিয়ে ঠোঁট কামড়ে হেঁসে বলল আবারো টানলাম কি করবে?
ফারিসতা এবার আরো ক্ষেপে গিয়ে তাজের হাত খামছে ধরে বলল, একদম এভাবে খামচে দিবো এ বলে হাতের বড় বড় নখ দিয়ে তাজের হাতে আচর কাটলো।
ফারিসতার এমন কাজে আহাম্মক হয়ে গেলো তাজ। ক্ষেপে গিয়ে যে এভাবে বাচ্চাদের মত খামচে দিবে কল্পনা ও করেনি৷ এই মেয়ে ক্ষ্যাপাটে স্বভাব আর সাহসিকতা দেখে ভেবেছিলো ম্যাচিউর একটা মেয়ে এখন দেখছে এতো বাচ্চার চেয়েও বাচ্চা এই জন্যই কাজের চেয়ে অকাজ একধাপ বেশি করে। তাজ ফারিসতাকে আর জ্বালাতন না করে কিছুটা সিরিয়াস হয়ে ফারিসতার পাশে বসে গলা খাকানি দিয়ে বলল,
এমন পেট ব্যথা কি প্রতি মাসে হয়?
তাজের এবারের প্রশ্নে ফারিসতা মুখের রঙ পাল্টে গেলো। এতক্ষণ দাঁত কটমট করে তাজের দিকে তাকিয়ে থাকা মুখশ্রী ধীরে ধীরে লজ্জায়, জড়তায় নুইয়ে গেলো। কাল রাতের কথা মনে পড়তে লজ্জায় আরো মিইয়ে গেলো।
ফারিসতাকে এমন লজ্জা পেতে দেখে তাজ ফারিসতাকে সহজ করার জন্য বলল, তুমি একজন সাইন্সের স্টুডেন্ট সে ক্ষেত্রে এমন প্রশ্নে তোমার কাছে এতটা লজ্জাকর হবে না। সাইন্সের স্টুডেন্ট হিসেবে কিছুটা হলেও বুঝো এটা কতটা সিরিয়াস ইস্যু। আমাদের বিয়েটা হুট করে হোক বা যেভাবে হোক আমরা এখন স্বামী স্ত্রী। তাই ফ্রেন্ডলি আমার কাছে শেয়ার করো। আমাদের মাঝে সম্পর্কটা বন্ধুত্বসুলভ না হলেও প্রমিজ করছি তোমার সবচেয়ে ভালো বন্ধু আমি হয়ে উঠবো।
কিছুমাস আগেও যেই ছেলেটার মাঝে ছিলো শুধুই হিংস্রতা সেই ছেলেটাকে এই কয় মাসে এতটা পরিবর্তন হতে দেখে চমকালো ফারিসতা। এতটা পরিবর্তন কি শুধু ওর জন্য? তাহলে কি সত্যি ও এই পারবে এই পাথর হৃদয়ের ছেলেটাকে শিমুল তুলোতে রূপ দিতে? তাজের এমন বন্ধুত্বসুলভ আচরণে ফারিসতা জড়তা ভুলে কিছুটা সহজ হয়ে মিনমিনিয়ে বলল,
আগে এমনটা ছিলো না। এই কয়েক বছর ধরে এমন ব্যথা। কখনো কখনো তীব্র ব্যথা ওঠে কখনো কখনো এর চেয়ে কম।
ডক্টর দেখিয়েছো এর জন্য?
সিলেট থাকতে দেখিয়েছিলাম।
তাজ কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল, আজ কিছু ইম্পর্ট্যান্ট কাজ আছে যার জন্য তোমাদের বাসায় নিয়ে যেতে পারবো না। কাল যাওয়ার আগে হসপিটালে নিয়ে যাবো কিছু চেক-আপ করানো লাগবে। লান্স করেছো?
ফারিসতা দুটিকে মাথা নাড়িয়ে না বলতে তাজ বসা থেকে উঠতে উঠতে বলল, বাবাকে নিয়ে এসেছি নিচে আছে। ওয়েট করো আমি শাওয়ার নিয়ে আসছি এক সাথে যাবো কথাটা বলে তাজ টি শার্ট আর ট্রাউজার নিয়ে ওয়াশরুমে চলে গেলো।
কিছুক্ষণ পর তাজ বের হয়ে ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়াতে আয়নাত ভিতরে ফারিসতা চোখ যেতে বুকের ভিতর টিপটিপ করে উঠলো। ফারিসতা দ্রুত তাজের দিক থেকে চোখ সরিয়ে নিতে চাইলো কিন্তু বেহায়া চোখ জোড়া বার বার তাজের দিকে আঁটকে যাচ্ছে। ফারিসতা আবারো চোখ সরিয়ে নিলো কিন্তু বেহায়া মন বলছে আরেকটু দেখি। ফারিসতা ফের আরো চোখে তাজের দিকে তাকালো তখন তাজ ও আয়নার ভিতরে ফারিসতার দিকে তাকাতে চোখাচোখি হয়ে যেতে হকচকিয়ে গেলো ফারিসতা।
তাজ চুল আঁচড়াতে আঁচড়াতে ফারিসতার কান্ড দেখে ঠোঁট কামড়ে হেঁসে ফারিসতার দিকে ঘুরে বলল, আমি জানি আমি খুব সুন্দর। এভাবে তাকিও না প্রেমে পড়ে যাবে তখন আবার দোষ দিবে আমি জোর করে প্রেমে পড়িয়েছি।
তাজের দিকে ওভাবে তাকিয়ে ছিলো সেটা তাজ এভাবে ধরে ফেলায় ফারিসতার কান কোন দিয়ে গরম ধোঁয়া বের হতে লাগলো। বেহায়া মনকে সায় দিয়ে ওভাবে দেখার জন্য কি লজ্জাকর পরিস্থিতিতে পড়েছে ভাবতে মনে মনে নিজেকে একশটা গা*লি দিলো।
নিজেকে নিজে গা*লি দেওয়া শেষ হলে এবার আসতে পারেন ম্যাডাম সবাই ওয়েট করছে।
তাজের এবারের কথায় ফারিসতার চোখ বেরিয়ে আসার উপক্রম হলো। ও নিজেকে নিজে মনে মনে গা*লি দিচ্ছিলো সেটা এক লোক কিভাবে শুনলো ভাবতে চোখ গোল গোল করে তাজের দিকে তাকাতে তাজ হঠাৎ করে ফারিসতার হাত নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে ফারিসতাকে কিছু বলার সুযোগ না ওকে নিয়ে নিচে নেমে গেলো। ভাগ্যেস সেদিনের মতো আজ সবার সামনে হাতে ধরে রাখেনি। সিঁড়ির কাছে এসে হাত ছেড়ে দিয়েছিলো এই জন্য স্বস্তি নিঃশ্বাস ফেললো ফারিসতা।
#চলবে?
#হৃদয়স্পর্শী_মায়াবিনী
#নুসাইবা_ইসলাম_হুর (মিমি)
#পর্বঃ৩২
আমার বয়স যখন পনের তখন বাবা-মা আমাকে নাহির খানের সাথে বিয়ে দিয়ে দেয়। এতো অল্প বয়সে বিয়েটা মানতে না পারলেও বিয়ের পর আস্তে ধীরে সব মানিয়ে নেই। কয়েক বছর ভালোই চলছিলো সংসার এরপর আমার সামনে আসতে লাগলো নাহির খানের ভালোমানুষির আড়ালে থাকা ভয়ংকর রূপ। একে একে তার কুকর্মের সব কিছু যখন আমি যেনে যাই তখন থেকে আমার জীবন হয়ে ওঠে খাঁচায় বন্দী পাখির মতো। দিনের পর দিন অত্যাচার করে গিয়েছে। এই অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে একদিন প্রতিবাদ করতে নাহিদ খান, নাসির খান দুই ভাই মিলে নির্মম ভাবে নির্যাতন করে। এক পর্যায়ে নাহির খান আমার পেটে আঘাত করে যার ফলে হারিয়ে ফেলি নিজের মা হওয়ার সত্বা। এভাবেই খাঁচায় বন্দী করে বছরের পর বছর অত্যাচার করে গিয়েছে। দীর্ঘ পনেরো বছরের সংসারে কখনো মুক্ত পাখির মতো উড়ায় সুযোগ হয়নি সবসময় বন্দী করে রেখেছিলো বাসার মধ্যে। এক সময় নিজের এই নির্মম ভাগ্যকে মেনে নিলাম। বুঝলাম যে যতদিন বাঁচবো এই নরপশুদের বন্দী কারাদন্ডে থাকতে হবে। নিজের ভাগ্যকে মেনে নিয়ে একদম চুপ হয়ে যাই। সব অত্যাচার মুখ বুজে সহ্য করে নেই। একটা সময় অনুভব করি আমি কথা বলাই ভুলে গিয়েছে। তখন খুব করে মন চাইতো কারো সাথে একটু মন খুলে কথা বলি কিন্তু কথা বলার কেউ ছিলো না।
আমি যেহেতু কখনো মাতৃত্বের স্বাদ পাবো না তাই একদিন নাহির খানের পা ধরে ভিক্ষা চাই আমাকে একটা সন্তান দত্তক এনে দেক। জানিনা সেদিন কেনো যেনো আমার সেই অনুরোধ রেখে তার পরদিন একটা ফুটফুটে কণ্যা সন্তান আমার হাতে তুলে দেয়। সেই ফুটফুটে বাচ্চাটাকে বুকে আগলে নিতে আমার জীবনের সব কষ্ট ভুলে যাই। সেই খুশিতে বাচ্চাটাকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কেঁদেছি। একটা সময় কান্না করতে করতে চোখের পানি গুলো ও শুকিয়ে গিয়েছিলো। হয়ে গিয়েছিলাম অনুভূতিহীন রোবট মানব। প্রতিনিয়ত নাহির খান এত এত অত্যাচার করে গিয়েছিলো কিন্তু আমার চেখে পানি আসেনি। সব অনুভূতি তো সেই কবেই মরে গিয়েছিলো। সেদিন সেই ফুটফুটে বাচ্চাটাকে হাতে নিতে খুঁজে পাই আমি আমাকে আবার নতুন করে। এর পর থেকে ছোট্ট বাচ্চাটাকে একটু একটু করে বড় করে তুলি। যেনো ওর মাঝেই খুঁজে পেয়েছি আমি আমার বেঁচে থাকার সম্বল। যখন ও আমাকে প্রথম মা ডাকে তখন আমার মনে হয়েছিলো এই পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী ব্যাক্তিটি হলাম আমি। এভাবেই বুকের মাঝে লুকিয়ে রেখে আমার ছোট্ট মেয়েটাকে বড় করতে লাগি। এমন ভাবে বুকের মাঝে লুকিয়ে রেখেছি যাতে একটা পিপড়েও আমার কলিজাটাকে কামড় দিতে না পারে। কিন্তু আমার কলিজাটার শেষ পরিনতি এতটা ভয়ংকর হবে আগে জানলে বুকের ভিতর লুকিয়ে না রেখে বুকের ভিতর ঢুকি ফেলতাম যাতে কোনো কালো ছায়া আমার কলিজাটাকে ছুতে না পরে কিন্তু নরপশুগুলো আমার কলিজাটাকে বাঁচতে দিলো না। ওর সাত বছর বয়সে নরপশু নাহির খান আমার কলিজাটাকে আমার বুক থেকে ছিনিয়ে নিয়ে গেলো। কথাটা বলে হু হু করে কেঁদে উঠলে মিসেস জেরিনা।
মিসেস জেরিনার সব কথা শুনতে স্তব্ধ হয়ে গেলো চৌধুরী বাড়িটা। যেনো মিসেস জেরিনার সাথে হুহু করে কেঁদে উঠলো বাসার দেওয়াল গুলো ও সেখানে অন্য মানব গুলোর কি অবস্থা? মিসেস জেরিনার হৃদয় নিংড়ানো যন্ত্রণার অতিত শুনে চোখ বুঁজে হাত মুষ্টিবদ্ধ করে নিলো তাজ। সৌরভ চৌধুরী স্তব্ধ হয়ে একি ভাবে চেয়ে রইলো মিসেস জেরিনার কান্নারত মুখশ্রীর দিকে। সব শেষে তিফাজ চৌধুরী যেনো নড়তেই ভুলে গেলো। সবসময় চোখের সামনে দেখে আসা এতটা নম্র সভ্য বিশ্বস্ত মানুষটা আড়ালে যে এতটা ভয়ংকর এখনো যেনো বিশ্বাস করতে পারছে না।
মিসেস জেরিনার কথা গুলো শুনে পুরুষরা নিজের সামনে নিলেও নরম হৃদয়ের অধিকারী নারীগুলো নিজেদের সামলাতে পারলো না। সবার চোখ চিকচিক করে উঠলো অশ্রুতে। রুশা আর ফারিসতা নীরবে হেকচি তুলে কান্না করছে। মিসেস জেরিনার কষ্টগুলো সবার কলিজায় যেয়ে লাগলো। কি নির্মম অতীত নিয়ে বেঁচে আছে যা সহ্য করার মতো না।
কান্নার মাঝে মিসেস জেরিনা আবার বলতে শুরু করলো। যতটুকু বাঁচতে চেয়েছিলাম সেটাও আমার থেকে কেঁড়ে নিলো নাহির খান। সেদিন তো আমি এমনিও মরে গিয়েছিলাম শুধু অপেক্ষায় ছিলাম শরীর থেকে রুহুটা বেরিয়ে যাওয়ার। সৃষ্টিকর্তা ছাড়া কারো সাধ্য নেই দেহে থেকে এই প্রাণটা কেড়ে নেওয়ার। সেদিন প্রতিজ্ঞা করি যেভাবে হোক এই নরপশু হিংস্র জা* দের নিজরে জীবন দিয়ে হলেও ধ্বংস করবো। এরপর আস্তে ধীরে নিজেকে শক্ত করে নেই। একদিন একজন স্টাফের কাছে তাজ চৌধুরীর কথা শুনতে পাই। সেদিন এর পর নাহির খানের আড়ালে সেই স্টাফকে নিজের স্বর্ণালঙ্কার দিয়ে দেই তার বিনিময়ে তাকে দিয়ে চৌধুরী পরিবারের খোঁজ নেওয়াই। আস্তে আস্তে চৌধুরী পরিবারের সব খবর জানার পর সুযোগ খুঁজতে লাগি কারো সাথে যোগাযোগ করার কিন্তু নাহির খান আমাকে সন্দেহ করে সেই স্টাফকে বিদায় করে দিয়ে নতুন একজন গর্ড রাখে আমাকে ২৪ ঘন্টা নজরে রাখার জন্য। তাই কোনো ভাবে চৌধুরী পরিবারের কারো সাথে যোগাযোগ করতে পারিনি৷ কিন্তু এবার ভাগ্য আমার সহায় হয়ে সেদিন তাজ আর সৌরভ চৌধুরী নাসির খানকে মা*রা*র জন্য বাসায় যায়। সেদিন তাদের কিছু বলার সুযোগ না হলেও আজ যখন সৌরভ চৌধুরী বাসায় যায় তখন নিজের জীবনের পরোয়া না করে সৌরভ চৌধুরীকে সবটা জানানোর ছোট্ট একটা প্রচেষ্টা চালাই। এর পর একে একে তার পরের সব ঘটনা খুলে বলল। সব শেষে নিজের ভেজা চোখ মুছে তাজের দিকে তাকিয়ে ধীর গলায় বলল,
তুমি আমার ছেলের মতো। আজ তোমার মায়ের মতো কেউ একজন হয়ে তোমার কাছে হাত জোর করে মিনতি করি ওই নরপশুদেরকে ধ্বংস করে দেও। এদের সাথে যারা যারা আছে কেউকে এই পৃথিবীর বুকে শ্বাস নিতে দিয়ো না। এই পৃথিবীর বুকে তাদের এক সেকেন্ডের শ্বাস নেওয়া মানে হাজারো মানুষের জীবন কুরবানির দেওয়া।
তাজ মিসেস জেরিনাকে আশ্বাস দিয়ে চোখমুখ শক্ত করে বলল, কথা দিচ্ছি এই কাজে সামিল থাকা প্রতিটা ব্যক্তিকে এর উপর্যুক্ত শাস্তি দিবো। চাচ্চু চলো এ বলে তাজ হনহনিয়ে বাসা থেকে বেরিয়ে গেলো। সৌরভ চৌধুরী এক পলক মিসেস জেরিনার দিকে তাকিয়ে তাজের পিছু পিছু সেও বেরিয়ে গেলো।
***
সোসাল মিডিয়ায় তোলপাড় হয়ে গেলো ডক্টর নাহির খানের আসল পরিচয় যেনে। ডাক্তারি পেশার আড়ালে এমন কালোবাজারি কাজ করায় রীতিমতো জনগণ রাস্তায় নেমে গেছে এর বিচার তারা চায়। নাহির খান এখন জেলে আছে। জনগণ পারলে জেল ভেঙে নাহির খানকে মে*রে দেয়। যদিও নাহির খানকে চাইলে তাজরা মে*রে ফেলতে পারতো কিন্তু এত সহজ মৃত্যু ওনাকে দিবে না তাজ তাই আগে একধাপ মেরে নিজের রাগ কমিয়ে পুলিশের হাতে দিয়ে তার আসল রূপ নিয়ে আসলো মিডিয়ার সামনে। এমন নিকৃষ্ট মানবের তো এত সহজ মৃত্যু দিলে অন্যায় হয়ে যাবে তাদের উপর যাদের এতদিন এই নরপুশুরদের জন্য জীবন হারাতে হয়েছে৷ একে তিলে তিলে মা*র*বে সেই ব্যবস্থা করেই তাজ পুলিশের হাতে তুলে দিয়েছে। সোসাল মিডিয়ায় জানিয়েছে যাতে এর শেষ পরিনতি দেখে অন্তরাত্মা কেঁপে ওঠে সকল কালোবাজারি ব্যবসায়ীদের।
নাহির খানের সাথে জড়িত সব কটাকে একে একে গ্রেপ্তার করা হলো। নাসির খানকেও হসপিটাল থেকে তুলে আনা হলো। যারা যারা এই কাজের সাথে সামিল ছিলো তাদের সহসা শিকারক্তি ছিলো তারা সবাই নাহির খানের আন্ডাদের কাজ করেছে। নাহির খানের অবস্থা রীতিমতোই আধমরা তাজের হাতে মার খেয়ে। এরপর শুরু হয়ে গেলো পুলিশের একের পর এক টর্চার।
***
সব ব্যবস্থা করে রাতে বাসায় ফিরলো তাজ আর সৌরভ চৌধুরী। বাসার পরিবেশ থমথমে। চৌধুরী পরিবার সবার চোখ টিভিতে আবদ্ধ। তাজরা বাসায় আসতে সবাই নড়েচড়ে বসলো। সবার মনে এক প্রশ্ন জাগলো ওই পশুদের পুলিশের কাছে কেনো দিলো। পুলিশকে টাকা খাইয়ে এরা আবার নিজেদের ছাড়িয়েই তো নিবে। তাজ সবাইকে অবলোকন করে কেউ কোনো প্রশ্ন করার আগে বলে উঠলো,
ফ্রেশ হয়ে এসে সবার প্রশ্নে উত্তর দিচ্ছি এ বলে ফারিসতার দিকে তাকি উপরে আসো বলে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে গেলো তাজ।
সবার মাঝে তাজ এমন উপরে যেতে বলায় কিছুটা লজ্জায় পড়ে গেলো ফারিসতা। ফারিসতাকে লজ্জা পেতে দেখে রুশা ফিসফিস করে বলল, লজ্জা পরে পেও আগে উপরে যাও আর নাহলে ভাইয়া রাগ করবে।
রুশার কথায় ফারিসতার আরো লজ্জায় মিইয়ে গিয়ে একরাশ জড়তা নিয়ে আস্তে ধীরে উপরে উঠে গেলো।
সাফোয়ান একপলক ফারিসতার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে চোখ নামিয়ে নিলো। বুকের ভিতর চিনচিনিয়ে উঠলো। ফারিসতার থেকে পালানোর জন্য সেই ভোর সকালে অফিসে চলে গেলো। আসলো এই রাতে৷ সারাদিন পালালেও সেই রাতে চোখের সামনে ভাইয়ের সাথে ফারিসতাকে দেখে বুকে ব্যথা অনুভব করলো৷ শত হলেও প্রথম ভালোবাসা। এত সহজে কি আর ভোলা যায়? এত সহজে ভোলা গেলে বিচ্ছেদের যন্ত্রণায় এত এত মানুষ আ*ত্ন*হ*ত্যা*র পথ বেছে নিতো না।
ফারিসতা রুমে এসে দাঁত কটমট করে বলল, সবার সামনে ওভাবে ডাকলেন কেনো?
তাজ ফারিসতার প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে একি ভাবে চেয়ে রইলো ফারিসতার মুখের দিকে। তা দেখে ফারিসতা চোখমুখ কুঁচকে বলল, কেনো ডেকেছেন?
ক্লান্তি দূর করতে….।
বেকুববনে গেলো তাজের কথায় ফারিসতা। ক্লান্তি দূর করতে ওঁকে কেনো আনবে? ও কিভাবে দূর করবে আজব কথাটা ভেবে ফারিসতা চোখ ছোট ছোট করে বলল, তো? আমি কিভাবে আপনার ক্লান্তি দূর করবো?
ফারিসতার প্রশ্নে তাজ ফারিসতার নাক টেনে দিয়ে বলল বাচ্চা মেয়ে বুঝবে না।
ফারিসতা চোখমুখ কুঁচকে নাকের পাটা ফুলিয়ে বলল, আবার?
ফারিসতাকে চেতে যেতে দেখে তাজ মিটিমিটি হেঁসে বলল হ্যা আবার। আমার বউ আমি গাল টানবো নাক টানবো তাতে তোমার কি? এক গ্লাসে পানি দেও।
পারবো না।
তাহলে কিন্তু সবার সামনে এবার শুধু হাত ধরবো না জড়িয়েও ধরবো।
তাজের কথায় ফারিসতা হকচকিয়ে দ্রুত গ্লাসে পানি ঢালতে ঢালতে বলে উঠলো অসভ্য গুন্ডা একটা এ বলে পানি ঢেলে ফারিসতা তাজের দিকে পানি বাড়িয়ে দিতে তাজ অমায়িক হাসি উপহার দিয়ে পানি খেয়ে গ্লাসটা ফের ফারিসতার হাতে দিতে ফারিসতা রাখতে যেতে নিবে তার আগে তাজ হাত ধরে ফেললো।
আচমকা তাজ এভাবে হাত ধরায় ধড়ফড়িয়ে উঠলো ফারিসতার বক্ষ। ফারিসতা তাজের হাতের মুঠোয় থেকে নিজের হাত ছুটাতে যাবে তার আগে তাজ ফারিসতাকে মৃদু টান দিয়ে দুজনের মাঝে দূরত্ব ঘুচে নিলো। তাজের এমন দূরত্ব ঘোচায় কম্পিত হলো ফারিসতার সর্বাঙ্গ। ফারিসতা তাজের থেকে ছোটার চেষ্টা করে কাঁপা কণ্ঠে শুধালো, ক..কি করছেন ছাড়ুন।
তাজ ছাড়লো না কিন্তু ফারিসতাকে অবাক করে দিয়ে তাজ ফারিসতার কপালে গলায় হাত স্পর্শ করলো। হঠাৎ পুরুষালি হাতের স্পর্শ গলায় পড়তে কেঁপে উঠল ফারিসতা। তাজ ফারিসতার জ্বর চেক করে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বলল যাক অবশেষে জ্বর মামা পালালো।
তাজের কথায় ফারিসতার চোখ কপালে উঠে গেলো। জ্বর চেক করার জন্য এত কাছে আনা লাগে? এতো কাছে আসলে যে ওর হার্টবিট বেরে যায় এই লোককি বোঝে না? সব কিছুই তো না বলতে বুঝে যায় এমনকি মনে মনেও কিছু বলা যায় না সেটাও শুনে ফেলো। তাহলে এটা বোঝে না?
সকালে তোমাদের বাসায় নিয়ে যাবো তার আগে হসপিটালে যাবো দেন সেখান থেকে তোমাদের বাসায়।
বাসায় যাওয়ার কথা শুনে সব ভুলে ফারিসতা একরাশ উচ্ছ্বাস নিয়ে বলল, সত্যি?
তাজ ফারিসতার উচ্ছ্বাসিত মুখের দিকে নিষ্পলক তাকিয়ে রইলো। বুক জুড়ে ছড়িয়ে পড়লো অন্যরকম এক ভালোলাগা। এই স্নিগ্ধ মুখে এক টুকরো হাসি দেখার জন্য অনায়াসে সব করতে পারবে ও। তবুও এই স্নিগ্ধ মুখে সবসময় হাসি দেখতে চায়।
#চলবে?
ভুলত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন
হ্যাপি রিডিং…