হৃদয়স্পর্শী মায়াবিনী পর্ব-৩৭+৩৮

0
120

#হৃদয়স্পর্শী_মায়াবিনী
#নুসাইবা_ইসলাম_হুর (মিমি)
#পর্বঃ৩৭

চারেদিকে ভোরের আলো ফুটতে আরফি আড়মোড়িয়ে ঘুম থেকে উঠে রোজকার মতো আজো ছাঁদের দিকে পা বাড়ালো এক্সারসাইজ করার জন্য। আরফি ছাঁদে পা দিতে খোলা চুলে এক রমনীকে রেলিঙ ঘেঁসে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ভ্রু কুঁচকে গেলো। এত সকাল সকাল সচারাচর কেউ ছাঁদে আসে না কিন্তু আজ এই সকাল সকাল কাউকে এভাবে চুল ছেড়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ভ্রু কুঁচকে সেদিকে তাকাতে কিছুক্ষণ পর বুঝতে সক্ষম হলো খোলা চুলের এই মানবটা আসলে কে। কে দাঁড়িয়ে আছে সেটা বুঝতে আরফির মাথায় দুষ্টবুদ্ধি চেপে বসলো। আরফি পা টিপে টিপে সেই ব্যক্তির পিছে গিয়ে ভাও করে উঠতে লাফিয়ে উঠলো রাশফিয়া।

সকালে নামাজ আদায় করে রাশফিয়া ছাঁদে এসেছিলো সকালে স্নিগ্ধ বাতাসটা উপভোগ করার জন্য। বরাবর এই সকালে না ঘুমিয়ে সকালের এই পরিবেশটা উপরভোগ করতে খুব ভালোবাসে রাশফিয়া। রাশফিয়া যখন চোখ বন্ধ করে আকাশ পানে তাকিয়ে স্নিগ্ধ পরিবেশটা উপভোগ করছিলো তখন হুট করে পিছ থেকে কেউ ভাও করে উঠতে ভয়ে অন্তরাত্মা সহ সব কেঁপে উঠলো। রাশফিয়া মৃদু চিৎকার দিয়ে লাফিয়ে উঠে পিছু ঘুরতে কারো বুকের সাথে যেয়ে মাথা ঠিকতে মেয়েটা আরো ভরকে গেলো।

রাশফিয়ার কাজে হো হো করে হেঁসে উঠলো আরফি।

হঠাৎ পরিচিত কণ্ঠে হাসি কানে যেতে রাশফিয়া ছিটকে আরফির থেকে দূরে সরে বুকে হাত দিয়ে তেতে বলে উঠলো, এভাবে কেউ ভয় দেখায়? আরেকটু হলে জানটা বেড়িয়ে যেতো।

তোমার পুটি মাছের জানটা যে বেরিয়ে যায়নি তার জন্য শুকরিয়া আদায় করো।

মজা করছেন আমার সাথে? কোমরে হাত দিয়ে বলল রাশফিয়া।

একদমি না। বেশি ভয় পেয়েছো? তাহলে আমাকে একটু ছুয়ে দেও। লোকমুখে শুনেছি ভয় পেলে তাকে ছুয়ে দিলে ভয় চলে যায় কথাটা বলে আরফি ওর হাত বাড়িয়ে দিলো।

রাশফিয়া চোখ পাকিয়ে আরফির দিকে তাকিয়ে বলল, আপনি কি বড় হয়েছেন বাতাসে? এত বড় হয়েছেন এখনো লোকমুখের সেই আজাইরা কথা বিশ্বাস করেন।

এত বড় কোথায় হলাম সবে ত্রিশে পা দিয়েছি। আরো ত্রিশ বছর গেলে তারপর বড় হবো।

আরফির কথায় রাশফিয়ার চোখ বড় বড় হয়ে গেলো। ত্রিশ বছরের বুরো বলে নাকি সে এখনো ছোট, ভাবা যায়?

রাশফিয়াকে চোখ বড় বড় করে তাকাতে দেখে আরফি ঠোঁট কামড়ে হেসে এই টপিক বাদ দিয়ে বলল, তা এই সকালে ছাঁদে কি করছো?

সকালের স্নিগ্ধ পরিবেশটা উপভোগ করতে এসেছি।

ভালোবাসো সকালের এই স্নিগ্ধ পরিবেশ উপভোগ করতে?

রাশফির একরাশ উচ্ছ্বাস নিয়ে বলল, খুব।

হাঁটতে যাবে?

আরফির প্রশ্নের মানে বুঝতে না পেরে রাশফিয়া প্রশ্নবিদ্ধ চোখে তাকিয়ে বলল, মানে?

সকালের পরিবেশটা দারুণভাবে উপভোগ করতে একটা জায়গায় নিয়ে যাবো চলো….

আরফির কথার মানে বুঝে রাশফিয়া এবার দ্বিধায় পড়ে গেলো যাবে কিনা। রশফিয়াকে কোনো কথা না বলে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে আরফি ভরসা দিয়ে বলল, আরে চলো আমরা আমরাই তো।

আমরা আমরাই তো কথাটা কর্ণগোচর হতে রাশিয়ার শিরদাঁড়া বেয়ে গড়িয়ে পড়লো কোমল স্রোতের ঢেউ। রাশফিয়া আর না করতে পারলো না কিন্তু নিজের দিকে একবার অবলোক করে আমতা আমতা করে বলল, এভাবে যাবো?

গারো সবুজ রঙের সেলোয়ার-কামিজ পড়া ফর্সা হ্যাঙলা পাতলা মেয়েটাকে আরফি একবার অবলোকন করে বলল, এতেই চলবে চলো এ বলে হুট করে রাশিয়ার হাত ধরে লিফটের কাছে এগিয়ে যেতে লাগলো।

আরফি এভাবে হাত ধরায় রাশফিয়া চমকে আরফির হাতের মুঠোয় থাকার ওর হাতের দিকে তাকালো। মুহূর্তের মাঝে একপশলা ভালোলাগায় ছেয়ে গেলো হৃদয় জুড়ে। তাকিয়ে রইলো একি ভাবে পুরুষালি শক্ত পোক্ত হাতের মুঠোয় ওর ছোট্ট হাতের দিকে।

লিফটে উঠে আরফি হাত ছেড়ে দিয়ে দুজন পাশাপাশি দাঁড়িয়ে রইলো। লিফট নিচে নামতে আরিফ রাশফিয়াকে নিয়ে সুরু রাস্তা পেরিয়ে কোথাও একটা যেতে লাগলো। পাশাপাশি দুজন হাঁটছে আর টুকটাক কথা বলার মাঝে পৌঁছে গেলো সুনসান নিরিবিলি এক নদীর পারে। চারেদিকে সবুজ শ্যামল ঘাসে ভরপুর। এদিকে এর আগে কখনো আসেনি তাই রাশফিয়া মুগ্ধ হয়ে চারপাশ দেখতে লাগলো। চারপাশ দেখতে দেখতে রাশফিয়া নদীর পাশে যেয়ে ঘাসের উপরে বসে পড়ে আলতো করে ছুঁয়ে দিলো নদীর স্বচ্ছ পানি গুলো।

আরফি দূরে দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণ রাশফিয়াকে পর্যবেক্ষণ করে ও নিজেও রাশিয়ার পাশে বসে প্রশ্ন করলো, পছন্দ হয়েছে?

রাশফিয়া উচ্ছাসিত হয়ে ঠোঁটের কোনে হাসি ফুটিয়ে বলল, অনেল অনেক পছন্দ হয়েছে।

এত পছন্দ হয়েছে বলেতো আমাকে বেমালুম ভুলে একা চলে এসেছো এখানে। তুমি জানো কত কষ্ট করে খুঁজে বের করেছি তোমার? যেদিকে তাকাই সেদিকেই দেখি সবুজ আর সবুজ।

রাশফিয়া নিজের জামার কালার খেয়াল করতে আরফির কথায় এবার হেঁসে দিয়ে বলল, আপনি বেশ মজা করতে জানেন।

একটু আধটু জানি। একটা প্রশ্ন করবো তোমায়?

একটা না একশটা করতে পারেন নো প্রবলেম।

আপাতত একটাই করি। তোমাকে যতটুকু চিনেছি তাতে প্রায় এই খেয়াল করেছি তুমি সবার আড়ালে একা একা সময় পার করতে বেশি ভালোবাসো বাট সেই সময়টা তোমার আনন্দের না বিরহের কাটে। ডোন্ট মাইন্ড আমার যেটা মনে হয়েছে আমি জাস্ট সেটা বললাম। যদি আমার ধারণা সঠিক হয় তাহলে কি জনতে পারি তোমার হাসির আড়ালে লুকিয়ে থাকার কষ্টটা?

আরফির কথায় মুহূর্তে মাঝে রাশিয়ার মুখের রঙ পালটে গেলো। হাস্যজ্জ্বল মুখের নেমে আসলো নিকশ কালো অন্ধকার। রাশফিয়া আখি তুলে নীরবে তাকালো আরফির দিকে। ওর জীবনের সবচেয়ে কাছে মানুষটা হলো ফারিসতা যে ওকে সবসময় বোঝে। ফারিসতার মতো করে কেউ ওকে কখনো বোঝেনি কিন্তু এই অচেনা ছেলেটা কয়েক মাসের পরিচয়ে ওকে এতটা বুঝে গেলো ভাবতে রাশফিয়ার চোখজোড়া জ্বলজ্বল করে উঠলো।

জ্বলজ্বল করতে থাকা রাশফিয়ার চোখজোড়া দেখে আরফি অপরাধীর ন্যায় বলল, সরি তোমার মনটা খারাপ করে দিলাম। এই প্রশ্নটা করা উচিত হয়নি আমার।

আরফির বলা কথায় ও কোনো প্রত্যুত্তর আসলো না রাশিয়ার থেকে। কিছুক্ষণ দু’জনের মাঝে ছেয়ে গেলো নীরবতা। নীরবতা ভেঙে রাশফিয়া ধীর গলায় বলতে লাগলো,

বাবা মায়ের একমাত্র সন্তান আমি। সবসময় শুনেছি বাবা-মায়ের এক মাত্র সন্তানরা হয় সবচেয়ে আদরের কিন্তু আমার নির্মম ভাগ্য আমাকে উপহার দিলো তার উল্টোটা। আমাকে জন্ম দিতে গিয়ে মায়ের কিছু সমস্যা হয় যার জন্য আমার আর কোনো ভাই বোন না হওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হয়। মা-বাবার ইচ্ছে ছিলো একটা ছেলে সন্তানের। আমি মেয়ে হয়ে জন্মানোতে তারা কেউ সন্তুষ্ট হতে পারলো না তার উপরে আমার আর কোনো ভাই বোন না হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি ছিলো৷ মেয়ে হয়ে জন্ম নেওয়া যে অভিশাপ সেটা যদি জন্মের আগে জানতে পারতাম তাহলে আল্লাহ কাছে বিক্ষা চেয়ে নিতাম আমাকে যেনো পৃথিবীতেই না পাঠানো হয়। মেয়ে হয়ে জন্ম নেওয়ায় বাবা সবসময় মায়ের সাথে ঝগড়া বিবাদ লাগিয়ে রাখতো কারণ তাদের ছেলের আশা পূরণ হওয়ার সম্ভাবনা নেই। বাবার মতো মাও অসন্তুষ্ট ছিলো আমার উপরে তার উপরে সব সময় বাবা এমন ঝগড়া বিবাদ লাগিয়ে রাখায় মা দিন দিন আমার উপরে আরো অতিষ্ঠ হয়ে পড়ে। বাবা-মায়ের ঝগড়া দিন দিন বাড়তে লাগায় বাবা এক সময় বিদেশ পারি জমায়। মাস শেষে শুধু টাকা পাঠানোর সময় মায়ের সাথে কথা বলতো এ ছাড়া তোমন যোগাযোগ রাখেনি। আমার জন্য বাবা-মায়ের মাঝে এমন দুরত্ব সৃষ্টি হওয়ায় মা আমাকে এক কথায় সহ্য করতে পারতো না। বলতে পারেন আর পাঁচটা সন্তানের মতো আমার বেরে ওঠা বাবা-মার সাথে হয়ে ওঠেনি৷ বাবা-মা থাকতেও না থাকার মতো ছিলো। ছোট থেকে বেরে ওঠা দাদিমার কাছে। আমাকে নিঃস্বার্থ ভাবে ভালোবেসে বড় করেছে আমার দাদি। দাদিকে মাঝে মধ্যে খুব দেখার ইচ্ছে হলেও সিলেট যাওয়ার সাহস হয়ে ওঠে না। ভাবি আমি চলে আসায় বাবা-মায়ের সম্পর্কটা যদি আবার ঠিক হয়ে যায় তাহলে আমি গেলে যদি তাদের সম্পর্কে আবার ভাঙন ধরে সেই ভয়ে ইচ্ছে হলেও নিজের জন্মস্থানে পা দেওয়ার সাহস হয়না। আমি দূরে থাকলে তারা যদি একটু ভালো থাকতে পারে তাহলে আমিও এতে খুশি। এমনি তাদের সব সুখ আমি কেঁড়ে দিয়েছি। তাই চাইনা তাদের আর সুখ কেঁড়ে নিতে তাইতো বুকে পাথর বেধে সব পিছুটান ফেলে চলে আসি এখানে।

জানেন মাঝে মাঝে খুব ইচ্ছে হয় সবার মতো আমিও যদি একটু পারতাম মাকে একটু জড়িয়ে ধরতে। বাবার হাতে হাত রেখে বহুদূর হেঁটে যেতে। বাবা-মায়ের সাথে দিন শেষ প্রাণ খুলে একটু হাসতে। কথাগুলো বলতে বলতে টুপ করে গড়িয়ে পড়লো রাশফিয়ার চোখ থেকে কয়েক ফোঁটা পানি। সে দিকে এক ধ্যানে চেয়ে রইলো আরফি। রাশফিয়া চোখের প্রতি ফোঁটা পানি যেয়ে বিধলো আরফির বুকে। সবার মাঝে হাসিখুশি স্বাভাবিক থাকা এইটুকু মেয়েটা মনের মাঝে এতটা যন্ত্রণা নিয়ে বেঁচে আছে ভাবতে আরফির বুকের ভিতর চিনচিনিয়ে উঠলো। মন চাইলো এমন একটা ম্যাজিক ওর কাছে আসুক যেটার সাহায্যে এই মেয়েটার সব কষ্ট মুহূর্তের মাঝে ভ্যানিশ করে দেওয়া যেতো। পাহাড় সমান কষ্ট নিয়ে না হেসে মেয়েটাকে প্রাণ খুলে একটু হাসাতে পারতো। আরফি কাতর চোখে কিছুক্ষণ রাশফিয়ার দিকে তাকিয়ে থেকে রাশফিয়ার মন ভালো করার জন্য বলল,
বাদ দেও এ কথা। জীবনটা খুব ছোট। এই ছোট জীবনটা কষ্ট ভাসিয়ে না দিয়ে পাখির মতো উড়তে শেখো দেখবে তাহলেই জীবন সুন্দর। যেহেতু পিছুটান ফেলে রেখে এখানে আসতে পেরেছো সেহেতু সব ভুলে নিজের লাইফটা এনজয় করতে শেখো।

আরফি কথা নীরবে শুনে উপরনিচ শুধু মাথা দোলালো রাশফিয়া কিন্তু কিছু বলল না তা দেখে আরফি বলল,

আইসক্রিম খাবে?

রাশফিয়া মলিন হেঁসে বলল, আইসক্রিম বাচ্চাদের খাবার। এখনো আইসক্রিম খাওয়ার বসয় আছে নাকি?

তুমি কিন্তু এখনো বাচ্চাই আছো। আমি ত্রিশ বছরে পা দিয়েও যদি নিজেকে ছোট দাবি করতে পারি তাহলে তো তুমি ল্যাদা বাচ্চা বলে আরফি কিছুটা শব্দ করে হেঁসে দিলো। আরফির কথা বলার ধরনে রাশফিয়াও সব বিষাদ ভুলে আরফির সাথে হেসে দিলো। রাশফিয়াকে হাসতে দেখে আরফি স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বলল,

দুই মিনিট ওয়েট করো আমি আসছি এ বলে আরফি উঠে গিয়ে কিছুক্ষণ পর দুটো আইসক্রিম নিয়ে এসে রাশফিয়ার পাশে বসে একটা রাশফিয়ার দিকে বাড়িয়ে দিলো।

রাশফিয়া আইসক্রিমটা হাতে নিতে নিতে বলল, আপনি আসলেই খুব মজার মানুষ। আজ আপনার সাথে না আসলে তা জানতেই পারতাম না।

সবে তো জানা শুরু সামনে আরো অনেক কিছু জানতে পারবে বুঝলে? আইসক্রিম খাও গলে যাচ্ছে।

রাশফিয়া স্মিত হেঁসে আইসক্রিম খাওয়ার সাথে আরফির সাথে টুকটাক গল্প জুড়ে দিলো।

#চলবে?
ভুলত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন

#হৃদয়স্পর্শী_মায়াবিনী
#নুসাইবা_ইসলাম_হুর (মিমি)
#পর্বঃ৩৮

সকালে ঘুম ভাঙতে রাশফিয়াকে খোঁজার জন্য ফারিসতা ছাঁদে গেলো। ফারিসতার সাথে তাজ ও গেলো সকালে আরফি ছাঁদে থাকে তাই দেখা করার জন্য কিন্তু দুজন ছাঁদে এসে দেখলো ছাঁদ পুরো ফাকা। ছাঁদে রাশফিয়াকে না পেয়ে ফারিসতা চলে যেতে নিবে তখন পিছ থেকে তাজ ডাকলো, এদিকে আসো।

তাজের ডাকে ফারিসতা পিছু ঘুরে ভ্রু গুটিয়ে বলল, কি?

এদিকে আসো তারপর বলছি।

ফারিসতা আর কথা না বাড়িয়ে গুটি গুটি পায়ে তাজের পাশে দাঁড়িয়ে প্রশ্নবিদ্ধ চোখে তাজের দিকে তাকাতে তাজ পাশের গাছ থেকে সদ্য ফুটে ওঠে একটা গোলাপ ছিড়ে সেটা ফারিসতার কানের পিছে গুঁজে দিতে দিতে বলল, এবার ঠিক আছে।

তাজ এভাবে কানে ফুল গুঁজে দেওয়ায় ফরিসতা লজ্জামাখা হেসে মাথা নুইয়ে নিলো। তখন দরজার সামনে থেকে সেই দৃশ্য ফোনে ক্যাপচার করে আরফি বলে উঠলো, বাহ কি প্রেমময় মুহূর্ত।

হঠাৎ দরজার সামনে আরফির কণ্ঠস্বর শুনে ফারিসতা ছিটকে তাজের থেকে দূরে সরে গেলো।

আরফি তাজদের দিকে যেতে যেতে বলল, দেখ তোদের এই দারুণ মুহূর্তটা ফোনে বন্দী করে দিলাম এই জন্য এখন বিশাল একটা ধন্যবাদ পাওয়ার যোগ্য আমি কিন্তু আমি ধন্যবাদ নিবো না। বিয়ে করেছিস শালা এখনো পার্টি দেস নাই তাই আমাদের ছোট দাবী আজ আমাদের ট্রিট দিবি।

আরফির এমন বকবকানিতে তাজ ভ্রু কুঁচকে বলল, সবি বুঝলাম কিন্তু এখনে তোকে ছাড়া তো কাউকে দেখতে পারছি না তাহলে আমরা আসলো কোথা থেকে?

এই যে আমি সাথে বলতে বলতে ছাঁদে প্রবেশ করলো রাশফিয়া।

রাশফিয়াকে দেখে ফারিসতা রাশিয়ার কাছে যেয়ে বলল, ছিলি কোথায় এতক্ষণ? কখন থেকে খুঁজছি তোকে।

হ্যা খুজছিলি নাকি রোমাঞ্চ করছিলি তাতো দেখতেই পেয়েছি।

রাশফিয়া কাথায় ফারিসতার থতমত খেয়ে চোখ গরম করে রাশফিয়ার দিকে তাকাতে রাশফিয়া সেটা পাত্তা না দিয়ে তাজের কাছে আবদার করে বসলো আজ ওদের ঘুরতে নিয়ে যেতে হবে।

শালি আর বন্ধুর আদার রাখতে তাজ রাজী হয়ে হয়ে গেলো। সকালে থানায় যেতে হবে কিছু কাজ বাকি আছে তাই বিকেলে নিয়ে যাবে। ঘুরতে যাওয়া ফিক্সড হতে ফারিসতা আরফির উদ্দেশ্যে বলল, আচ্ছা ভাইয়া আদরিবার কি হয়েছে? এতবার ফোন কলাম রিসিভ করলো নাতো৷ বাসায় যাবো যাবো বলেও যাওয়া হয়নি।

ফারিসতার প্রশ্নে আরফি এবার সিরিয়াস মুড নিয়ে ফারিসতা আর রাশফিয়ার উদ্দেশ্যে বলল, এই প্রশ্ন তোমাদের করবো করবো করে এতো ঝামেলার জন্য ভুলে গিয়েছিলাম। হুট করে আদরিবার কি হয়েছে বুঝতে পারছি না। কেমন মন মরা হয়ে থাকে সবসময়। ভাই হিসেবে ওর খেয়াল সবসময় সর্বোচ্চ দিয়ে রাখার চেষ্টা করেছি। আমার জানা মতে ওর কোনো রিলেশনে ও নেই তাহলে হুট করে ও এমন ভেঙে পড়ছে কেনো? তোমাদের কাছে কি কিছু বলেছে? বা ও কি কাউকে পছন্দ করে? যদি জানো আমাকে নিরদ্বিধায় বলতে পারো। আমি ওর কোনো পথে কখনো বাঁধা হয়ে দাঁড়াবো না। আমি আমার বোনের সুখের জন্য সব করতে রাজি।

আমাদের জানা মতেও ওর কোনো রিলেশন নেই। কি হলো মেয়েটার হুট করে? চিন্তিত হয়ে বলল ফারিসতা।

আরে এত চিন্তা করিস না আজ বিকেলে ধরে বেঁধে ওকে সাথে নিয়ে যাবো তখন ওর থেকে সব জানতে পারবো অভয় দিয়ে বলল রাশফিয়া।

রাশফিয়ার অভয়ে কিছুটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো আরফি। সবাই আরো কিছুক্ষণ ছাঁদে সবে টুকটাক কথা বলে নাস্তা করার জন্য নিচে নেমে গেলো। তাজ আর আরফি নাস্তা করে চলে গেলো থানায়। যারা বন্দী আছে তাঁদের সবার উপর্যুক্ত শাস্তির ব্যবস্থা করা হলো। এই কালোবাজারি খেলায় আসল কালপ্রিট কে সেটা একমাত্র নাহির খান এই জানতো বাকি কেউ জানে না। জানা থাকলে এত টর্চারের পরও মুখ না খুলে পারতো না। তাই এদের দিয়ে দেশের ক্ষতি ছাড়া আর কোনো কাজে আসবে না। এদের জন্য কত হাজার হাজার অসহায় তাজা প্রাণ গিয়েছে এদের এত সহজে ছাড়া যায় না। নাসির খান সহ আরো যারা যারা এই কালোবাজারি কারবারের লিডার ছিলো তাঁদের সবাইকে ফাঁ*সি*র রায় দেওয়া হলো আর যাঁরা এতে সহযোগিতায় ছিলো তাদের সবাই মৃত্যুর আগ পর্যন্ত জেল থেকে ছাড়া পাবে না।

সব কালোবাজারি কারবারের অবসান ঘটিয়ে সোর্স লাগিয়ে দিলো এই কালোবাজারি কারবারের আসল কালপ্রিটকে খুঁজে বের করার। খুব শীঘ্রই তাকেও খুঁজে পেয়ে যাবে এইটুকু ভরসা জণগণকে দেওয়ায় জনগণ একটু স্বস্তির পেলো।

সব ঝামেলা চুকিয়ে তাজরা বিকেলের দিকে বাসায় এসে ফারিসতাদের নিয়ে বের হলো ঘুরতে যাওয়ার জন্য। সবার সাথে আদরিবাকেও নিয়ে গেলো। ঘুরতে এসে রাস্তার পারে ফুসকা দেখে মেয়েদের আর পায় কে। তিনজন মিলে ফুসকা খেতে চলে গেলো। গাড়ির সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে তাজ আর আরফির কথপোকথনের মধ্যে আরফি বলে উঠলো, দোস্ত প্রেমে পড়ার কয়েকটা লক্ষণ বলনা।

আরফির কথায় তাজ চোখ ছোট ছোট করে বলল, এই প্রশ্ন পাপনকে না করে আমাকে করছিস কোন দুঃখে?

আরে ওই শালা সত্যি কারে প্রেমের মানে বোঝে নাকি? ওতো সেকেন্ডে সেকেন্ডে একটা রেখে আরেকটা ধরে। ফারিসতার প্রেমে পড়ার পর কি কি লক্ষ পেয়েছিলি বলনা মামা।

তাজ বুকে হাত গুঁজে ওদের থেকে কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে হাস্যজ্জ্বল মুখে ফুসকা খেতে থাকা ফারিসতার দিকে মুগ্ধ নয়নে তাকিয়ে তাজ ধীর গলায় বলতে লাগলো, প্রেম কাকে বলে আমি জানিনা। প্রেমের সাথে আমার পাথর হৃদয়ে কখনো পরিচয় হয়নি কিন্তু স্নিগ্ধ এক ভালোবাসার সাথে আমার প্রথম পরিচয়। যেই স্নিগ্ধ ভালোবাসায় আমার পাথর হৃদয় স্পর্শ করে ধীরে ধীরে শিমুল তুলোর ন্যায়ে পরিণত করে দিলো চোখের পলকে। যাকে ভালোবাসবি তাকে গোছালো, অগোছালো, এলোমেলো সর্বাবস্থায় দেখলে বুকের ভিতর এক শান্তি স্রোত বয়ে যাবে। যাকে ভালোবাসবি তার ঠোঁটে এক টুকরো হাসি ফোঁটানোর জন্য অস্বাদ্যকেও স্বাদ্য করে ফেলার প্রবণতা চলে আসবে। যাকে ভালোবাসবি তাকে ছুয়ে দেখার চেয়ে, এক নজর দেখার ইচ্ছের প্রবনতা অনেক বেশি থাকবে। তাকে এক পলক দেখার মাঝেই অস্থির হৃদয় মুহূর্তের মাঝে শান্ত হয়ে যাবে। তার মুখশ্রী এক পলক দেখায় দূর হয়ে যাবে শরীরে সব ক্লান্তি। মনের মাঝে ভীর করবে শুধু ভালোলাগা আর ভালো-লাগা যেখানে থাকবে না কোনো বিরক্ত।

তাজের বলা প্রতিটা কথা নীরবে শ্রবণ করে আরফি অবিশ্বাস্য চোখে তাজের দিকে তাকিয়ে বলল, দোস্ত তুইকি সত্যি আমাদের তাজ? বিলিভ মি আমি বিশ্বাস করতে পারছি না তোর এত পরিবর্তন।

আরফির কথায় তাজ স্মিত হেঁসে আরফির কাঁধে হাত দিয়ে বলল, পুরুষের সবচেয়ে দূর্বল জায়গা হলো নারী। একজন নারী সংস্পর্শে সবচেয়ে কঠিনতম পুরুষটাও সবচেয়ে নরম হয়ে যেতে পারে। ভালোবাসিস রাশফিয়াকে?

তাজের শেষের প্রশ্নে চমকে উঠলো আরফি। রাশফিয়ার কথা তো ও কখনো ভুলেও কারো সামনে তোলেনি তাহলে তাজ জানলো কিভাবে ভাবতে আরফি চমকে তাজের দিকে তাকাতে তাজ ফের স্মিত হেঁসে আরফির কাঁধে মৃদু চাপর মেরে বলল, একজন ছেলে হয়ে আরেকজন ছেলের চোখের ভাষা বুঝবো না সেটা হয় নাকি? তা প্রপোজ করছিস কবে? ব্যবস্থা করে দিবো?

আরফি মাথা চুলকে বলল, প্রপোজ করলে যদি রিজেক্ট করে দেয় সেই ভয় হয়।

ভয়, লজ্জা নারীদের ভূষণ। ভয়কে জয় করে নেওয়াই হলো সত্যিকারে পুরুষের কাজ। কাপুরুষের মতো একশ বছর বেঁচে না থেকে বীরপুরুষের মতো একদিন বাঁচা ভালো। ভালোবাসা জয় করতে হলে বুকের পাটা লাগে আশা করি সেটা তোর আছে। কবে প্রপোজ করতে চাস শুধু বল। আমার তরফ থেকে সব কিছুর ব্যবস্থা আমি নিজ দায়িত্বে করে দিবো।

সবে ওর সাথে একটু ফ্রী হয়েছি আরো কিছুদিন যাক তারপর ভেবে দেখবো।

যা ভালো বুঝিস এবার চল এদের এই আনহেলদি খাবার খাওয়া থামাতে হবে আর নাহলে এদের খাওয়া থামবে না শেষে দেখা যাব সব কয়টা এক সাথে বিছানায় পড়েছে এ বলে তাজ আর আরফি মিলে সবাইকে নিয়ে অন্য কোথাও নিয়ে গেলো। সবাই এক সাথে ঘোরাঘুরি করে পুরো বিকেল কাটিয়ে রাতে বাসায় ফিরলো৷ এর ভিতরে আদরিবার কি হয়েছে জানার জন্য ফারিসতা আর রাশফিয়া অনেক চেষ্টা করেছে কিন্তু আদরিবা বিষয়টা ওদের থেকে এড়িয়ে গিয়েছে যার জন্য জানা হলো না মেয়েটার হুট করে কি হলো।

রাতে খাওয়া দাওয়া শেষ করে রুমে যেতে তাজ ফারিসতার উদ্দেশ্যে বলল, বই খাতা সব প্যাক করে নেও কাল সকালে চলে যাবো।

চলে যাওয়ার কথা শুনে ফারিসতার হাসিখুশি মুখটা চুপসে গেলো। মাকে ছেড়ে আবার চলে যেতে হবে ভাবতেই ফারিসতার কান্না পেয়ে গেলো। ফারিসতা কাঁদো কাঁদো হয়ে বলল, কাল এই চলে যেতে হবে?

হ্যা নেক্সট উইকে রুশার বিষয়ে অ্যারেজমেন্ট শুরু হয়ে যাবে এখন থেকেই সব কিছু ম্যানাজ করতে হবে।

আর কিছুদিন থাকলে হয়না?

আন্টিও যাচ্ছে আমাদের সাথে।

ফারিসতা এবার মন খারাপ, কান্না সব ভুলে উৎফুল্ল হয়ে বলে উঠলো সত্যি আম্মু যাবে?

বিশ্বাস না হলে জিজ্ঞেস করে আসো।

আচ্ছা আমি জিজ্ঞেস করে আসি এ বলে এক ছুটে ফারিসতা রুম ছেড়ে বেরিয়ে ফারজানা বেগম রুমে সামনে এসে হাক ছাড়ে ডাক লাগালো আম্মুয়য়য়….

ফারিসতার এমন ডাকে ফারজানা বেগম ভড়কে গিয়ে তড়িঘড়ি করে দরজা খুলে বিচলিত হয়ে কিছু বলতে যাবে তার আগে ফারিসতা উচ্ছাসিত হয়ে বলে উঠলো, আম্মু সত্যি কাল আমাদের সাথে তুৃৃমি যাচ্ছো?

ফারজানা বেগম ফারিসতার মাথা মৃদু চাপর মেরে বলল, এই কথা জিজ্ঞেস করার জন্য কেউ এভাবে ডাকে? ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম।

আআআআ আম্মু আগে বলো না যাবে কিনা।

হ্যারে বাপ যাবো শুধু আমি একা না আমরা সবাই যাচ্ছি। আদরিবারাও যাচ্ছে।

ফারিসতা চোখ গোল গোল করে বলল, সবাই যাচ্ছো আমাকে আগে কেনো বলোনি?

এখন শোনা আর আগে শোনা একি কথাই তো।

ফারিসতা এবার গাল ফুলিয়ে বলল, একদম এক না। আমাকে এখন আর কেউ ভালোবাসো না এই জন্য আমাকে কিছু বলার ও প্রয়োজন মনে করো না কেউ।

তোকে কেনো ভালোবাসবে? এখন আন্টি শুধু আমাকে ভালোবাসবে। তোকে ভালোবাসার জন্য চৌধুরী পরিবারের মানুষের অভাব নেই। যা ভাগ আন্টি শুধু এখন আমার। রুম থেকে বের হতে হতে কথাগুলো বলে উঠলো রাশফিয়া।

রাশফিয়ার কথায় ফারিসতা ভেঙচি কেটে ফারজানা বেগমকে এক পাশ থেকে জড়িয়ে ধরে বলল, বললেই হলো নাকি? আম্মু শুধুই আমার।

দুজনের বাচ্চামো দেখে ফারজানা বেগম হেসে ফারিসতাকে এক হাত দিয়ে আগলে নিয়ে আরেক হাত দিয়ে রাশফিয়াকে কাছে এনে হাসিখুশি মুখে বলল, তোর দুজনেই আমার মেয়ে। সারা জীবন মায়ের ভালোবাসা সন্তানের উপরে সমান থাকে। এক তিল পরিমাণ ও কমে না আর কমবেও না।

#চলবে?
ভুলত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন

হ্যাপি রিডিং…