হৃদয়ের দখিন দুয়ার পর্ব-০১

0
1116

#হৃদয়ের দখিন দুয়ার
#পর্ব-১
সাবিকুন নাহার নিপা

সুপ্রীতি শাড়ির আঁচল টা ভালোভাবে জড়িয়ে নিলো। আজ সকালে ঘুম থেকে উঠেই ও বুঝতে পেরেছিল দিন টা খারাপ যাবে। অর্ণব ও’কে টেক্সট করলো। গাড়িতে বসতে বলল। সুপ্রীতির এখন ভয় লাগছে, অর্ণব কী ভয়ংকর কিছু করে ফেলবে! ওর চোখের ধরন খুব ভয়ংকর ছিলো। এরকম দৃষ্টি এর আগে দেখে নি। অবশ্য অর্ণব কে ও চিনেই বা কদিন ধরে! বিয়ের এক মাস হতেও আরও দুদিন বাকী। সুপ্রীতি অর্ণব কে ফোন করলো আবারও। প্রায় চল্লিশ মিনিট ধরে দাঁড়িয়ে আছে। ভ্যাপসা গরম পড়ছে, অস্বস্তিও হচ্ছে খুব। অর্ণব কী করছে ভেতরে! ভয়ংকর কিছু ঘটিয়ে ফেলল না তো!

অর্ণব এলো ঘন্টাখানেক পরে। অন্যান্য দিন হলে সুপ্রীতি এই বিষয় টা নিয়ে রাগ দেখাতো। আজকের অবস্থাটা অন্যরকম। অর্ণব সুপ্রীতির দিকে না তাকিয়েই বলল,

“গাড়িতে বসো। আর তোমার মা’কে ফোন করে বলে দাও আমরা আজ ওখানে যাচ্ছি না। ”

সুপ্রীতি গাড়িতে বসলো। কৌতুহলী চোখ টা এদিক ওদিক তাকাচ্ছে। লিফট থেকে কেউ বের হলো না। ভেতরে যে গন্ডগোল কিছু একটা ঘটেছে সেটা অর্ণব কে দেখে বোঝা যাচ্ছে। ওর শার্ট টা খোলা, কাঁধে ঝুলিয়ে রাখা। চুল থেকে ফোঁটা ফোঁটা পানি পড়ছে। সুপ্রীতির একটু ভয় লাগছে এখন, ও ভীতু না তবুও এই মুহুর্তে ভয় লাগছে।

****
“আমরা আজ আসতে পারব না। মা’কে বলিস। কবে আসব, জানাব। কল করিস না। আমি পরে কল ব্যাক করব। ”

প্রকৃতি টেক্সট দেখে মা’কে গিয়ে বলল,

“রান্নাবান্না যা করেছো সেগুলো ফ্রিজে তুলে রাখো মা। আপু, ভাইয়া আসবে না। ”

স্বপ্না অন্তত বারো পদের আইটেম করেছেন। পোলাও, রোস্ট, কালাভুনা, ভর্তা ভাজি, ডাল সহ অনেক আইটেম। সুপ্রীতির খাওয়া নিয়ে বড় বাছাবাছি আছে। অর্ণবও কম খায়, তবুও জামাই বলে কথা। তার সামনে দিতে হয়। এক চামুচ করে যদি খায় সেটাও শান্তি।

স্বপ্না কপাল কুঁচকে বললেন,

“আসবে না কেন? প্রীতি যে বলল অর্ণবের বন্ধুর বাসা থেকে ডিনার করে তারপর আসবে। ”

প্রকৃতি মায়ের উদ্দেশ্যে বলল,

“ডিনার করে আসার পর এতগুলো খাবার কী ডেজার্ট হিসেবে খাবে মা?”

স্বপ্না প্রকৃতির কথা গায়ে মাখলেন না। তার টেনশন অন্য জায়গায়। মেয়েদের সে মানুষ করেছেন কঠিন অনুশাসনে। এই যুগের মায়েদের মতো মেয়ের প্রেম মেনে নেয় নি, শক্ত হয়ে মেয়ের অন্যত্র বিয়ে দিয়েছেন। ভেবেছিলেন জামাই সহ মেয়ের সংসার তিনি কন্ট্রোল করবেন। কিন্তু অর্ণব একদম অন্যরকম। নিজের জামাই বলে অন্যরকম বলছেন, অন্য কারো হলে হয়তো বলতেন বেয়াদব। বউভাতের পর দ্বিতীয় বার সুপ্রীতিকে নিয়ে এলো। স্বপ্না কয়েক রকমের পিঠে বানালেন। গ্রাম থেকে আনা খেজুরের গুড় দিয়ে ভাপা পিঠে। অর্ণব জানালো পিঠে খাবে না। স্বপ্না তবুও জোরাজুরি করেন। যেমন টা সুপ্রীতি, প্রকৃতি, সাদাত কে করেন। অর্ণব হঠাৎই কেমন করে তাকালো। শীতল গলায় বলল,

“আমি পিঠে খাই না, আপনি এক লক্ষ বার বললেও খাব না। আমার না মানে সেটা না ই। কেউ সেটাকে হ্যাঁ করতে পারে না। ”

স্বপ্না স্তব্ধ হয়ে গেলেন। টেবিলে সুপ্রীতি প্রকৃতি তার বোনের মেয়ে স্নেহা, তমশাও ছিলো । স্বপ্না খুব অপমানিত বোধ করলেন। কান দিয়ে গরম ধোঁয়া বের হচ্ছে টের পেলেন। আড়চোখে তাকালেন সুপ্রীতির দিকে। ও নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে পিঠে খাচ্ছে।

খাবার গুলো বক্স ভরে রেখে দিচ্ছেন। ওরা যেদিন আসবে সেদিন আবার নতুন করে রাধতে হবে। এই খাবার গুলো অর্ণবের সামনে দেয়া যাবে না।

প্রকৃতি ঘরে এসে সুপ্রীতিকে টেক্সট করলো,

“আপু সব ঠিকঠাক? ”

ওদিক থেকে জবাব এলো না। প্রকৃতির একটু চিন্তা হয়, আবার ভাবে আপু যা স্মার্ট যেকোনো সমস্যা সামলে নিবে ঠিকই।

****
নাতাশার ধারণা ঠিক, ফাহাদ সত্যিই নতুন সম্পর্কে জড়িয়েছে। অনেক দিন ধরে ব্যাপার টা সন্দেহ করলেও কখনো জিজ্ঞেস করে নি। ফাহাদ সবার সঙ্গে ঠিক আছে শুধু ওর সঙ্গেই অশান্তি করে। ছোট ছোট ব্যাপার গুলো নিয়ে কথা শোনায়। ভেজা তোয়ালে টা গুছিয়ে না রাখার কারণে সেদিন নাতাশার রান্না খাবার খেল না। বাইরে থেকে বিরিয়ানি আনিয়ে খেয়েছে। কত বছর হলো ওদের বিয়ের! পাঁচ টা বছর! এক্ষুনি কেন ফাহাদের বিরক্তির কারণ হলো ও! সব তো ওর ইচ্ছেতেই হয়েছে। পালকের জন্ম ওর ইচ্ছেতে, চাকরিতে জয়েন না করার ইচ্ছেটাও ফাহাদের ছিলো। যদি ফাহাদের অ্যাফেয়ারের ব্যাপার টা সত্যি হয় তাহলে নাতাশা কী করবে! পালকের কী হবে!

“বৌমনি, ঝিলিক আপুকে মেহেদী পরাতে লোক এসেছে। ”

নাতাশা বেরিয়ে আসে। বিয়ে বাড়ির এতো কাজ যে দু:খ, কষ্ট অনুভব করার সময়টুকু পর্যন্ত ওর নেই। শাশুড়ী দেখেই বললেন,

“তুমি ঘরে গিয়ে বসে থাকলে হবে? ওই বাড়িতে জিনিসপত্র পাঠাতে হবে সেগুলো গোছানো বাকী! এতো মানুষ খাবে তার রান্নাবান্না আছে!”

নাতাশা জবাব দিলো না। ঝিলিক ওর ছোট ননদ। ইউনিভার্সিটিতে পড়ছে। বিয়ে ঠিক হয়েছে বড় চাচার ছেলের সঙ্গে। পাশাপাশি দুই বাড়ি। নাতাশা রান্নাঘরে গেল। রান্নার খালা আছেন, তার হাবভাবে মনে হয় কাজের ইচ্ছে নেই। সেও বিয়েবাড়ির আমেজ উপভোগ করতে চায়। সকালে নাতাশাকে দেখে একবার বলেছিল, কামের মানুষ সবসময় কামের মানুষ ই থাকে। বাড়ির মানুষ হয় না।

নাতাশা ডাল চড়িয়ে দিলো। সবজি কেটে রাখা হয়েছে, আর গরুর মাংস। এর বেশী আইটেম করবে না। তবুও শাশুড়ী রাগ করবেন। বড় জামাই আসবে তাকে কিভাবে এগুলো খেতে দিবে! নাতাশা অবশ্য একটা কাজ করে রেখেছে। তিন চার টা পদ রান্না করে ফ্রিজে রেখেছে। সেগুলো গরম করে দিতে পারবে।

ঝিলিকের রুম থেকে হাসির শব্দ পাওয়া যাচ্ছে। নিজের বিয়েতে ঝিলিক খুব খুশি। অথচ ও জানে যার সঙ্গে ওর বিয়ে ঠিক হয়েছে সে পাগলের মতো অন্য একজন কে ভালোবাসতো। এখনো বোধহয় বাসে।

ঝিলিকের বিয়ে হচ্ছে ইশরাকের সঙ্গে। ইশরাক তথাকথিত ভালো ছেলেদের কাতারে পড়ে। ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করে আইটি কোম্পানিতে ভালো স্যালারির জব করছে। শান্ত, ভদ্র তবে আমুদে। নাতাশা নিজের ননদ কে চিনে। ঝিলিক ভালো মেয়ে, দেখতেও মিষ্টি। কিন্তু ওর কাছে মনে হচ্ছে মেয়েটা আগুনে ঝাপ দিচ্ছে।

ঝিলিকের ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে নাতাশা শুনলো ঐশী ঝিলিক কে বলছে,

“তোর কষ্ট হচ্ছে না! ইশরাক ভাই অন্য একজন কে ভালোবাসে!”

ঝিলিক রুক্ষ গলায় জবাব দিলো,

“তাতে আমার বা*!”

নাতাশা চলে এলো। খুশি ও’কে খুঁজতে এসেছে। খুশি বড় ননদ।

“এই যে ভাবী… দেখো তো ইশরাক কী যেন বলবে। ”

নাতাশা ফোন কানে নিয়ে বলল,

“বলো ইশরাক। ”

ইশরাকের গলাটা অন্যরকম। শুনলেই বোঝা যায় ছেলেটা অস্থির সময় পাড় করছে।

“ভাবী একবারের মতো কী একটু যোগাযোগ করিয়ে দেয়া যায়! প্লিজ। তুমি চাইলেই সম্ভব। ”

নাতাশা জবাব দিতে সময় নিলো। খুশি তাকিয়ে আছে জিজ্ঞাসু চোখে। তাকানোর কথা, ইশরাক যে মেয়েটিকে ভালোবাসে দূর্ভাগ্যবশত সেই মেয়েটি নাতাশার বোন। নাতাশা ঠান্ডা গলায় বলল,

“না ভাই। ”

ফোন ছাড়তেই খুশি জিজ্ঞেস করলো,

“কী বলল?”

নাতাশা জবাব দিতে সময় নেয়। চটজলদি মিথ্যে কথা ও বলতে পারে না।

****
দুদিন ধরে অর্ণব সুপ্রীতির সাথে কথা বলছে না। আজ বাসায় ফেরার পর দেখলো হাতে ব্যান্ডেজ করা। উদ্বিগ্ন গলায় জিজ্ঞেস করলো,

“তোমার কী হয়েছে? এক্সিডেন্ট? ”

অর্ণব ঠান্ডা গলায় জবাব দিলো,

“না। নাদিম শু*য়োর টাকে মারতে গিয়ে লেগেছে।”

সুপ্রীতি একই সঙ্গে বিস্মিত ও হতভম্ব! কী অবলীলায় কথাটা বলছে। নাদিম অর্ণবের বন্ধু। যতটুকু সুপ্রীতি শুনেছে ওরা একই সঙ্গে স্কুলে, কলেজে পড়েছে। ওদের আরেক বন্ধু হিমুর বাসায় ওইদিন পার্টি ছিলো। সুপ্রীতি অর্ণব এর সঙ্গে সেই পার্টিতে গিয়েছে। নাদিম শুরু করেছে ঠাট্টা। প্রথমে সেগুলো স্বাভাবিক হলেও পরে সেটা অশ্লীল পর্যায়ে গেল। হঠাৎ ই বলে উঠলো,

“ভাবীকে হট পিংক শাড়িতে হট লাগছে! অর্ণইব্যার কপাল! ”

সুপ্রীতির গাল লাল হয়ে উঠলো লজ্জায়। বন্ধুদের অশ্লীল রসিকতা স্বাভাবিক হলেও ব্যপারটা ওর ভালো লাগে নি। অর্ণব সঙ্গে সঙ্গে গিয়ে নাদিমের কলার ধরে একটা ঘুষি মারলো। নাদিম বেচারা ততক্ষনে হুশে এলো যে কথাটা বলা উচিত হয় নি। সুপ্রীতি পরিস্থিতি খারাপ দেখে অর্ণব কে বলল,

“থাক বাদ দাও। চলো। ”

অর্ণব রক্তচক্ষু নিয়ে সুপ্রীতিকে দেখে বলল,

“নিচে যাও, অপেক্ষা করো। আমি আসছি। ”

সেদিন ওখানে কী হয়েছে না হয়েছে সুপ্রীতি জানেনা। অর্ণবের শীতল আচরণে বরং ভয় পেল খানিকটা। সেদিন রাতে প্রায় সারারাত অর্ণব শাওয়ারে ভিজলো। সুপ্রীতি অনেক বার ডেকেছে। এক পর্যায়ে ওয়াশরুমের দরজা খুলে সুপ্রীতিকে টেনে নিয়ে শাওয়ারের নিচে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। কতক্ষণ ওভাবে কেটে গেল, শাওয়ার অফ করে অর্ণব ফিসফিস করে বলল,

“তুমি কী নাদিমের কথাটা এনজয় করেছ?”

সুপ্রীতি রাগী গলায় বলল,

“ওহ! আমার বুঝি এনজয় করার কথা!”

“তাহলে আমাকে কেন বাদ দিতে বললে! আমি তো তখনই শু*য়োর টাকে পুতে ফেলতাম। ”

সুপ্রীতি অদ্ভুত চোখে তাকিয়ে ছিলো। অর্ণব ও’কে ঠেলে দিয়ে বের করে আবারও নিজে ভিজলো।

ভোরের দিকে সুপ্রীতির ঘুম ভেঙে গেল। অর্ণব ভেজা শরীর নিয়েই শুয়েছে। নির্ঘাত জ্বর আসবে। সুপ্রীতি ও’কে বলল,

“মানলাম ব্যাপার টা রাগের। তাই বলে নিজেকে এভাবে কষ্ট দেয়ার তো মানে নেই। ”

অর্ণব ও’কে শান্ত চোখে দেখলো। চোখ দুটো রক্তবর্ণ। বিয়ের আগে শুনেছে অর্ণবের রাগ সম্পর্কে। হঠাৎ হঠাৎ রেগে যাওয়া ওর স্বভাব নয়। তবে যখন রেগে যায় তখন ভয়ংকর। সুপ্রীতি সেই ভয়ংকর রুপ দেখে ফেলেছে।

সুপ্রীতি খোলা বারান্দায় দাঁড়ালো। এরেঞ্জ ম্যারেজ যেটাকে বলা হয় ওদের টা তেমন। বিয়ের আগে একজন আরেকজন কে জানার সুযোগ পেয়েছে মাত্র কয়েক সপ্তাহ। প্রথম দেখায় অর্ণব কফির মগে চুমুক দিয়ে প্রশ্ন করেছিল,

“তোমার এই বিয়েতে আপত্তি নেই?”

সুপ্রীতি স্বাভাবিক গলায় বলেছিল,

“না নেই। ”

“শিওর?”

“হ্যাঁ। ”

“ভালো করে ভেবে তারপর জানাবে। আমি বিয়ে একবার ই করব। তুমি যদি ভেবে থাকো এখন বিয়ে করলাম ভালো না লাগলে ছেড়ে চলে আসব তবে আমাকে না বলবে। কারণ আমি মানুষ ছাড়ার লোক না। আর বউ ছাড়ার তো প্রশ্নই আসে না।”

সুপ্রীতির জীবন তখন টালমাটাল অবস্থায় ছিলো। বাবা, মায়ের পছন্দ করা অর্ণব কে অতো খারাপ লাগে নি। একটা ব্যাপার ও জানে, স্পষ্টভাষীরা সবার চোখে ভালো হয় না। নিজের রাগের সমস্যা টুকু অর্ণবও ও’কে জানিয়েছিল। সুপ্রীতি রাজী হয়েছে। ওর জীবনের অসংখ্য সমস্যা আছে, যেগুলো অর্ণব কে ও জানায় নি।

সুপ্রীতি বারান্দায় দাঁড়ালো। প্রকৃতির অসংখ্য মেসেজ এসেছে। ও টেনশন করছে। লাস্ট মেসেজে লিখেছে,

“আপু ভাইয়ার সঙ্গে কোনো সমস্যা চলছে? প্লিজ আমাকে বলো। আমি কাউকে বলব না। ”

সুপ্রীতি মেসেজ লিখতে গিয়ে ভাবলো। কী লিখবে! প্রকৃতি ওর জীবনের সব জানে। ওর হাহাকার, অপমান, রাগ, জেদ সব। ও’কে কী লেখা যায়, জানিস কেউ একজন আমাকে তার জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ জিনিস ভাবে। আমার কী তাকে সব টা উজাড় করে ভালোবাসা উচিত!

চলবে।