#হৃদয়ের_দখিন_দুয়ার
#পর্ব-১৭
“এরমধ্যে বাসা নিয়ে ফেলছিস? টাকা কই পাইলি? ফাহাদ বুঝায়ে দিছে টাকাপয়সা? কবে দিলো? ”
নাতাশা মৃদু হেসে বলল, টাকা আমার কাছে ছিলো। সেটা দিয়ে ম্যানেজ করেছি।
স্বপ্না বিশ্বাস করলেন না। তার ধারণা সুপ্রীতি এসবের পিছনে আছে। সুপ্রীতি থাইল্যান্ড থেকে ফিরেছে। প্রকৃতির জন্য কিছু জুয়েলারি, পারফিউম ঘড়ি পাঠিয়েছে। কিন্তু নাতাশা আর পালক কে দিয়েছে ভরিয়ে। কতকিছু না কিনলো। স্বপ্নার রাগের সঙ্গে অপমান বোধটুকুও হলো খুব। তার নিজের মেয়ে! অথচ এই আচরণ যেন শত্রুর চেয়েও জঘন্য।
“তোর আর চিন্তা কী? তোর খাওয়া পরার দায়িত্ব তো আমার। আল্লাহ দিছেন অনেক আমারে। ”
নাতাশা ব্যাগগুলো বাইরে রাখলো। প্রকৃতিকে বলল পালক নিয়ে এগুতে। এই বাসা থেকে বেরিয়ে যাবার পর এখানে আসবে না আর। সত্যিই ওর যাবার জায়গা নেই। কিন্তু গত কয়েকমাস যে আচরণ ও পেয়েছে তারপর আর মরে গেলেও আসতে চায় না। যে খালাকে ও সমীহ করে, সম্মান করে, ভয় পায় তাকে আজ দুটো কঠিন কথা শুনিয়ে যাবে। যে কঠিন জীবন ওর শুরু হতে যাচ্ছে সেখানে চলতে ফিরতে হলে ও’কে কঠিন ই হতে হবে।
নাতাশা গলার স্বর কঠিন করে বলল,
“খালামনি আমার আসলে তোমার থেকে কিছু লাগবে না। আমি নিজের ব্যবস্থা নিজে করে নিতে পারব। আমার মন এমনিতেই ভালো নেই। এভাবে কথা বলে আর মন খারাপ করে দিও না। চলেই তো যাচ্ছি। ”
স্বপ্না স্থির চোখে তাকিয়ে থেকে বলল,
“গলার রগ কার সামনে বড় করতেছিস? এক থাপ্পড় দিয়ে দাঁত ফেলে দিতে দু’বার ভাবব না আমি। আমার মেয়ের সর্বনাশ করার জন্য উঠেপড়ে লাগছিস তুই। ওই ছোটলোকের সঙ্গে ভিড়িয়ে দেবার চেষ্টাও তুই করেছিস। ”
নাতাশা দৃঢ় গলায় বলল,
“আমি কিছু করি নি। ওরা সম্পর্কে জড়ানোর অনেক পরে ব্যাপার টা জেনেছি। সুপ্রীতিকে আমি সাবধানও করেছি। ”
“মিথ্যে বলবি না তুই? সুপ্রীতির এতো সাহস কোনোদিন ছিলো না। তুই সব করেছিস। বাপ, মা ছাড়া মেয়েগুলা এমনই হয়। অন্যের ভালো তাদের সহ্য হয় না। ”
নাতাশা এতো শক্তও হতে পারলো না। কেঁদে ফেলল। হাতের উল্টোপিঠে চোখ মুছে বলল,
“আমি কিছু করলে আল্লাহ যেন সেটার কঠিন শাস্তি দেন।”
“শাস্তি তো দিয়েছেই। সুপ্রীতির সঙ্গে যা করতে গেছিলি… এখন দেখ তোর সংসার ই টিকলো না। ”
নাতাশা গভীর শ্বাস নিয়ে বলল, এটাকে আমি তেমন কিছু মনে করছি না। তবে তোমাকে শায়েস্তা করার জন্য আল্লাহ যে অর্ণব কে মিলিয়ে দিয়েছেন সেটা আমি বুঝেছি। ”
স্বপ্নার চোখ বড় হয়ে গেল। আহত বাঘিনীর মতো চিৎকার করে বলল,
“নাতাশা তোর জিব টেনে ছিড়ে ফেলব। ”
নাতাশা আর কিছু বলল না। দ্রুত পায়ে প্রস্থান করলো। স্বপ্না ফুসতে লাগলো। সেদিনের সেই মেয়ে যে অন্যের দয়ায় বড় হলো সে পর্যন্ত কথা শুনিয়ে গেল! এতো স্পর্ধা হয়েছে একেকজনের!
***
ঝিলিক এবার শান্ত হলো। নিয়মিত ইউনিভার্সিটিতে যায়, পড়াশোনা করে, খায়, ঘুমায়। ইশরাক যতক্ষণ বাসায় থাকে ততক্ষণ ওর সামনে পড়ে না। খালার সঙ্গে ইদানীং ভাব হয়েছে। খালা অল্পশিক্ষিত হলেও তার চোখে ধরা পড়েছে যে এদের মিল মহব্বত নেই। ঝিলিকের প্রতি তার এখন একটু সহানুভূতিও কাজ করে। সে ঝিলিক কে বুদ্ধি দিয়েছে তাবিজের। তার গ্রামে একজন হুজুর আছে। তার তাবিজে নাকি কাজ হয়। ঝিলিক ওসবে গুরুত্ব দেয় নি। একদিন বাবা এসেছিল, দুনিয়ার টেনশনে ছিলো বলে খেয়াল করে নি যে ঝিলিক অন্য ঘরে থাকে। ঝিলিক ভেবেছে কয়েক দিনের জন্য বাড়ি যাবে। বাবাকে দেখে ভালো লাগে নি। ভাইয়া, ভাবীর জন্য খুব মন খারাপ করে আছে।
ইশরাক আজ ফিরলো বিকেলের দিকে। সঙ্গে একটা খাবারের প্যাকেট। টেবিলের উপর রেখে দিলো। রান্নাঘরে টুংটাং আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে। ঝিলিক ওর সঙ্গে খেতে বসে না, আশ্চর্য হলেও সত্যি যে ঝিলিক এখন মেপে কথা বলছে। ইশরাক প্রথম দুদিন রাতে ভেবেছিল ঝিলিক ঠিক ই বালিশ কাঁথা নিয়ে রুমে চলে আসবে। সন্ধ্যেবেলা বাড়ি ফিরে দেখবে শাড়ি পরে সেজেগুজে আছে। সেসব কিছু হয় নি। বরং ও’কে এড়িয়ে চলছে যথাসম্ভব। এটা অবশ্য ইশরাকের জন্য ভালো। স্পেস পাওয়া যাবে। শান্তিতেও থাকা যাবে।
“কী করছিস?”
ঝিলিক চমকে উঠলো। বলল,
“ওহ তুমি?”
“আমি মানে কী? তুই অন্য কাউকে এক্সপেক্ট করছিলি নাকি?”
ইশরাক খুব স্বাভাবিক গলায় কথাটা বলল। ঝিলিক গোলাপি রঙের একটা টিশার্ট পড়ে আছে। সঙ্গে কালো ট্রাউজার। সিল্কি চুলগুলো এলোমেলো করে ছড়িয়ে রাখা। গোছানো, সাজগোছ করা ঝিলিক কে ইশরাক কখনো ভালো করে খেয়াল করে নি। এলোমেলো ঝিলিক কে খেয়াল করলো আজ। ঝিলিক নুডলস বানাচ্ছিল। ইশরাক জিজ্ঞেস করলো,
“দুপুরে কী খেয়েছিস?”
“কিছু না। তুমি কী চা খাবে? নাকি কফি? নিজে বানাবে?”
একসঙ্গে অনেকগুলো প্রশ্ন করলো ঝিলিক। ইশরাক সেসব প্রশ্নের উত্তর এড়িয়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
“তুই দুপুরে কিছু খাস না?”
“ইচ্ছে হলে খাই। আজ ঘুম থেকে উঠতে দেরি হলো.. খেতেও ইচ্ছে করলো না।”
ইশরাক এক দৃষ্টিতে ঝিলিক কে দেখলো। সেদিনের সেই থাপ্পড় টা একটু বেশী বাড়াবাড়ি হয়ে গেছিলো। ঝিলিক যত খারাপ কথা বলুক, যত নিচে নামুক ও কিভাবে হাত তুলল ওভাবে!
ঝিলিক নুডলস বাটিতে তুলে চা বসালো। ইশরাক বাটিটা হাতে নিয়ে ঝিলিকের হাত ধরে ডাইনিং টেবিলের কাছে নিয়ে আসলো। খাবারের প্যাকেট টা ঝিলিকের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল,
“তুই এটা খা।”
ঝিলিক কিছু একটা বলতে যাবে তার আগেই ইশরাক নুডলস মুখে দিলো চামুচে করে। ঝিলিক আর কিছু বলল না।
খাবারের প্যাকেট টা ওরকম রেখেই ঝিলিক স্থির হয়ে বসে রইলো। ইশরাক বলল,
“নুডলস কিন্তু ভালো বানাস তুই!”
ঝিলিক শান্ত গলায় বলল,
“থ্যাংক ইউ। একটা কথা জানানোর আছে। ”
“বল।”
“কাল আমি বাড়ি যাব। ”
ইশরাক কপাল কুঁচকে জিজ্ঞেস করলো,
“হঠাৎ? এমনিতে তো যেতে চাস না।”
“এমনি। বাড়িতে কেউ ভালো নেই। যাওয়া দরকার। ”
ইশরাক আড়চোখে ঝিলিক কে দেখলো। ফাহাদের ঘটনাটা খুব বাড়াবাড়ি পর্যায়ে গেছে সোশ্যাল মিডিয়ার ওই ঘটনায়। যারা না জানতো তারাও এখন জানে কেন কী কারণে নাতাশার সঙ্গে ডিভোর্স হয়েছে। কিন্তু ঝিলিক কী সেই কারণে যাচ্ছে নাকি ও ভালো নেই বলে যাচ্ছে।
“তুই খাবি না?”
ঝিলিক অনিচ্ছায় প্যাকেট টা খুলল। চাইনিজ আইটেম আছে, ওর পছন্দের রেস্টুরেন্ট থেকে আনা। প্রচন্ড খিদে থাকা সত্যেও ঝিলিকের ইচ্ছে করলো না খেতে। ইশরাক তাকিয়েই থাকলো। এতো ভালো করে, গভীরভাবে ঝিলিক কে ওর এই প্রথম দেখা। বাম হাতের আঙুলগুলোর নেইলপলিশ ফ্যাকাসে হয়ে যাওয়াও গভীর মনোযোগে দেখছে। ঝিলিক খেয়াল করছে না কিছুই। ইশরাক ঝিলিকের হাত থেকে চামুচ টা নিয়ে একটু ফ্রায়েড রাইস মুখের সামনে ধরে বলল,
“নে আমি খাইয়ে দেই।”
ঝিলিক স্মিত হাসলো। ইশরাকের আন্তরিকতাটুকু প্রত্যাখ্যান করলো হাসিমুখেই। বলল,
“আমি খেয়ে নিচ্ছি। আমি খুব খারাপ। এতো আদর সহ্য হবে না। ”
“তুই কাল ই বাড়ি যাবি?”
“হু। ”
“দুদিন পর যা। আমি দিয়ে আসব।”
“আমার একা যাবার অভ্যাস আছে। তোমাকে কষ্ট করতে হবে না। তুমি রেস্ট নাও, ইদানীং তোমার স্ট্রেস যাচ্ছে। ”
ইশরাক হঠাৎ হাত বাড়িয়ে ঝিলিকের মুখ টা নিজের দিকে টানলো। ঝিলিক চমকে গেল। আরও একটু বেশী চমকে দিয়ে ওর গালে চুমু দিলো। ঝিলিক স্থির চোখে তাকিয়ে আছে। ইশরাক গভীর গলায় বলল, সেদিনের থাপ্পড়ের জন্য সরি। বেশ কয়েক সেকেন্ড চোখে চোখ রাখলো। তারপর দ্বিতীয়বার চুমু দিলো ইশরাক।
***
রুবাব কে নিয়ে ইকরার একটা ভয় ছিলো। ঠান্ডা মাথার শয়তান টা যেকোনো কিছু করতে পারে। আত্মীয় স্বজনদের কাছে ব্যাপার টা জানাতে পারে এটা ইকরা ধরেই নিয়েছিল। ইকরা সেভাবে প্রস্তুতও ছিলো নিজেকে নির্দোষ ও বেচারি প্রমাণের। রুবাব ক্যারিয়ারে উন্নতি করতে পারছে না। বাবা, মায়ের কিছু প্রোপার্টি আছে যেটা যক্ষের ধনের মতো আগলে আছে। বিক্রি করে ব্যবসা করার বুদ্ধি ইকরা দিয়েছিল কিন্তু সেটা কানে নেয় নি। মোটকথা লাইফে বড় কোনো গোল নেই। থ্রিলার লিখে বইয়ের জগতে মোটামুটি নাম কামালেও বছর শেষে যে টাকা পায় সেটা ইকরার চার মাসের ইনকাম। এমন একটা মানুষের সঙ্গে ঝগড়াঝাটি, ঝামেলা করে নিজের এনার্জি লসের মানে নেই।
কিন্তু রুবাব যেটা করলো তাতে ইকরার বড়সড় ক্ষতি হয়ে গেছে। ওর বিজনেস পেজে রিপোর্ট পড়তে শুরু করেছে। বেশ কিছু অর্ডার ছিলো সেগুলো ক্লায়েন্টরা ক্যান্সেল করছে। বড় বড় ক্লায়েন্ট হাত থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে। একদম সোশ্যাল মিডিয়ায় পোস্ট করে ইকরার পেজ কে বয়কট করছে।
ইকরা রুবাব কে অসংখ্য বার ফোন করেও পাচ্ছে না। ব্লক করে রেখেছে সোশ্যাল মিডিয়া থেকেও। ওর লাইফ টা রীতিমতো জাহান্নাম বানিয়ে ফেলছে। অফিসে পর্যন্ত যেতে ভয় পাচ্ছিলো। আজ অফিসে এসেছে। ফাহাদ আর ও দুজনকেই আসতে বলেছে। ইকরা বুঝতে পারছে যে একটা কিছু ঝামেলা হবে। হয় এই অফিস থেকে চট্রগ্রাম অফিসে পাঠাবে নাহয় সোজা বের করে দিবে।
ফাহাদের সঙ্গে ইকরার দেখা হয় নি। টেক্সট করে জানিয়েছে রিলাক্স থাকতে। ফাহাদ নিজেও অবশ্য টেনশনে আছে। এমন একটা অবস্থা যে বাইরে বের হতেও লজ্জা লাগছে। কেউ একটু বেশি সময় তাকিয়ে থাকলেও মনে হয় যেন ফেসবুকে পোস্ট দেখে চিনে ফেলেছে।
ইকরাকে ম্যানেজমেন্ট জানালো যে তারা এই অফিসে ও’কে রাখতে পারছে না। হিসেব মতে দুজনেই অফিসের পরিবেশ নষ্ট করেছে কিন্তু ফাহাদ কে তারা ছাড়তে পারছে না। ধূর্ত ফাহাদের হাতে আছে বড় বড় কিছু প্রোজেক্ট। যেগুলো নষ্ট করা সম্ভব না।
ইকরা নতমস্তকে সবটা মেনে নিলো। শেষবারের মতো নিজের ডেস্কে বসলো। এই চাকরি ও’কে অনেক কিছু দিয়েছে। ত্রিশ হাজার স্যালারি তে ঢুকেছিল যেটা এখন সব মিলিয়ে পঞ্চাশের বেশীতে গিয়ে দাঁড়িয়েছে। বছরে দুটো ট্যুরের সুযোগ। একটা পার্মানেন্ট প্রোজেক্টে কাজের সুযোগ। মাসে সেখান থেকে এক্সট্রা কিছু কমিশন আসে। অফলাইনে কতো ক্লায়েন্ট পেয়েছে! সব শেষ… সব।
ইকরা লক্ষ্য করলো আজ সবাই কে মিড মর্নিং এ কফি দেয়া হলেও ও’কে দেয়া হলো না। ভালো সম্পর্ক যাদের সঙ্গে তারা কেউ একবার বিদায় পর্যন্ত জানালো না।
চলবে…..
#হৃদয়ের_দখিন_দুয়ার
#পর্ব-১৮
নাতাশা অবাক গলায় বলল,
“সত্যি এই রান্না তুই করেছিস?”
সুপ্রীতি হাসলো। নাতাশা লাউ চিংড়ির তরকারি টা আরেকটু নিয়ে বলল,
“কোনোদিন রান্নাঘরে যাস নি, এই ক’মাসে এতো ভালো রান্না শিখেছিস তুই!”
“থ্যাংক ইউ। ভালো রাঁধুনি যখন রান্নার প্রশংসা করে তখন ব্যাপার টা সত্যি হিসেবে মেনে নিচ্ছি। ”
“আসলেই ভালো রাঁধছিস। অবশ্য এতো যত্ন করে শেষ কবে আমাকে কে খাইয়েছে তা মনেও পড়ে না।”
সুপ্রীতি জবাব দিলো না। পালক ওর কোলে ঘুমিয়েছে। নাতাশা এখনো খাট কিনে নি। তোশক বিছিয়েছে। কাল সারাদিন এটা সেটা কিনে সময় পাড় করেছে। প্লেট, কাপ, গ্লাস, বাটি একটা সংসারে কতোকিছু না দরকার। মা মেয়ের ছোট্ট সংসার।
“বারান্দায় কিছু গাছ রেখো আপু। ভালো লাগবে। ”
নাতাশা আনমনে জবাব দিলো,
“হু। ”
সুপ্রীতি পালক কে শুইয়ে দিয়ে এসে নাতাশার পাশে বসলো। নাতাশা তখন রুই মাছের মাথাটা খাচ্ছে। সুপ্রীতি জিজ্ঞেস করলো,
“ওর দাদা এসেছিল শুনলাম? ”
নাতাশা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
“হ্যাঁ। উনি খুব কষ্ট পাচ্ছেন। ”
“বাকীরা?”
“ঝিলিক এসেছিল, খুব হম্বিতম্বি করে গেছে। ওর স্বভাব ই তো অমন। ”
ঝিলিকের প্রসঙ্গ আসায় সুপ্রীতির মনে পড়ে গেল ইশরাকের কথা। জিজ্ঞেস করলো,
“ঝিলিক ভালো আছে? ”
নাতাশা সুপ্রীতির চোখের দিকে তাকিয়ে বলল,
“বাকীদের কথা থাকুক, তুই যে ভালো আছিস সেটা দেখে আমি ভীষণ খুশি। জানিস তোর জন্য কতো দোয়া করেছি আমি!”
সুপ্রীতি স্মিত হাসে। নাতাশাকে বলতে হয় নি সুপ্রীতির কিছুই। নাতাশা বুঝে গেছে ওর চেহারা দেখে। বিয়ের পর কতো সুন্দর হয়ে গেছে। শেষবার যখন বিয়ের আগে দেখা হয়েছিল তখন কী বিষন্ন ছিলো সুপ্রীতি! আর এখন হাসিটাও প্রানখোলা। নাতাশা হঠাৎ জিজ্ঞেস করলো,
“তোকে একটা ব্যক্তিগত কথা জিজ্ঞেস করি?”
সুপ্রীতি নি:শব্দে হাসলো। বলল,
“তোমার আমার এমন ফর্মালিটির সম্পর্ক কেন হলো আপু? আমার বিয়েতে তোমাকে ডাকি নি তাই?”
নাতাশা মৃদু হেসে বলল, অর্ণব তোকে ভীষণ ভালোবাসে তাই না?
“বাসে। ভীষণ নাকি অল্প তা জানিনা। ”
“তুই ভালোবাসতে পারছিস তো?”
“এটা কী ব্যক্তিগত প্রশ্ন ছিলো নাকি অন্যকিছু জিজ্ঞেস করার চিন্তা বাদ দিয়ে এটা জিজ্ঞেস করেছ?”
নাতাশা হেসে ফেলল। বলল,
“ঠিকই ধরেছিস। মেয়েলী কৌতূহল খুব খারাপ। ”
“তুমি ইশরাকের ব্যাপারে কিছু জিজ্ঞেস করতে চাইলে করতে পারো। আমি জবাব দেব। তোমার জানার অধিকার আছে। ”
“না, আমি জানতে চাই না। তবে ইশরাকের ব্যাপারে তুই যে ডিসিশন নিছিস সেটা একদম ঠিক নিয়েছিস। ”
“কেন? তুমিতো সবসময় বলতে ইশরাক খুব ভালো ছেলে। ”
“আমি আজও বলব ইশরাক খুব ভালো ছেলে। কিন্তু একটা মানুষ সবার সঙ্গে একরকম হয় না। সবার সঙ্গে সমান বোধ, নীতি যে বজায় রাখে তাকে ভালো মানুষে বিশেষায়িত করা যায়। ”
“অনেক গভীর কথাবার্তা! বাবা কে বলবে তুমি এতো গভীর কথাবার্তা জানো। ”
নাতাশা হাসলো। সুপ্রীতি এই প্রসঙ্গ এড়িয়ে গেল না। অবলীলায় ইশরাকের কথা বলতে লাগলো। নাতাশা অবাক হয়, কতো মানুষ দেখেছে সম্পর্ক ভেঙে গেলে কিভাবে ভেঙেচুরে একাকার হয়ে যায়। ওদের সাথে পড়তো তানিয়া। ক্লাস এইট থেকে প্রেম ছিলো খালাতো ভাইয়ের সঙ্গে। চার বছরের সম্পর্ক ভেঙে ছেলেটা মায়ের পছন্দের মেয়েকে বিয়ে করলো। তানিয়ার দিকে তাকানো যায় না। মেয়েটা হাসে না ঠিকমতো। বিয়ে হয়ে গেল ওই অবস্থায়। একদিন ওরা দেখতে গেল, নাতাশাকে আড়ালে ডেকে বলল, আমার কিছু ভালো লাগে না নাতাশা। বারবার তার কথা মনে পড়ে। একেকবার মনে হয় মরে গিয়ে সবাইকে শাস্তি দেই। তানিয়ার সঙ্গে অনেকদিন যোগাযোগ হয় না। রংপুরের কোনো একটা জায়গায় থাকে। ফেসবুকে পর্যন্ত নেই। নাতাশার আগে মনে হতো সুপ্রীতি তানিয়া হবে না তো। না হোক অমন। সুপ্রীতি বাস্তববাদী মেয়ে, আবেগ কে প্রশ্রয় না দেয়ার দু:সাহস ওর আছে। ও তানিয়া না হোক।
***
সুপ্রীতি নাতাশাকে নিয়ে বেরোলো। প্রকৃতিকেও কল করে ডাকলো। নাতাশাকে একটা ফ্রিজ কিনে দিলো, সঙ্গে আরও কিছু প্রয়োজনীয় জিনিস। নাতাশা কপট রাগ দেখিয়ে বলল,
“কেন তুই এতো খরচ করছিস বল তো?”
“এমনিই ভালো লাগছে। বোনের জন্য করছি বাইরের কারোর জন্য না। ”
“খুব বাড়াবাড়ি করছিস তুই।”
“করলাম নাহয়। শোনো সপ্তাহ খানেক এর মধ্যে বাবা টাকা দিবে। এক বছরের টাকা পুরোটাই….
নাতাশা থামিয়ে দিয়ে বলল,
“এই জিনিস করিস না। তোর মা’কে তো চিনিস… কথা শুনিয়ে পঁচিয়ে মেরে ফেলবে। ”
“ওটা যতবার তোমার সাথে তার দেখা হবে এমনিই শুনিয়ে দিবে। এখন যে টাকাটা বাবা তোমাকে দিচ্ছেন সেটা তুমি ফেরত দিয়ে দিও তোমার সময়মতো। আমি চাই তুমি একটা দিনও টানাটানি না করে চলো। পালক কে নিয়ে ভালো থাকো। টাকা পয়সার টানাটানি থাকলে মানসিক শান্তি থাকে না,এটুকু গ্রহণ করো। এমনিতেই কম অশান্তিতে নেই তুমি। ”
নাতাশা আর কিছু বলতে পারলো না। ভালোলাগা কিংবা খারাপ লাগায় মন টা আদ্র হলো।
****
সুপ্রীতির আজ ফিরতে রাত হলো। অর্ণব ওর জন্য অপেক্ষা করে ছিলো। সুপ্রীতি বলল,
“সরি অর্ণব, আমি আপুদের সঙ্গে খেয়ে এসেছি। ”
অর্ণব স্বাভাবিক গলায় বলল,
“ইটস ওকে। ডোন্ট ফিল সরি। ”
“তোমার খাবার টা গরম করে দেই। ”
“না প্লিজ। আমাকে ঘরের কিছু দাও। ভাত, ডিম ভাজা হলেও হবে। ”
সুপ্রীতি নাতাশার জন্য রান্না করা খাবার থেকে অর্ণবের জন্যও রেখে দিয়েছিল। সেটা গরম করে দিলো। ও পাশে বসে প্লেটে খাবার তুলে দিচ্ছে। অর্ণব খেতে খেতে প্রশ্ন করলো,
“তোমার মায়ের সঙ্গে কথা হয় নি শিগগির?”
“সেদিনের পর থেকে না। আমিও ফোন করি নি, সেও না।”
“সত্যি! আমি এতোটা এক্সপেক্ট করিনি কিন্তু। ”
“কী?”
“উনি আমার কথা এভাবে শুনবেন। আমি ভেবেছিলাম সপ্তাহ খানেক গেলে উনি নিজেই কল করবেন। এট লিস্ট সরি ফিল করে একটা কল করবেন। তোমাকে একবার সরি বললেই, আমি ওই বাসায় নিয়ে যেতাম। ”
সুপ্রীতি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, থাক বাদ দাও।
“সুপ্রীতি তোমার বন্ধুদের কথা তো কখনো আমাকে বলো নি। বিয়েতেও কাউকে দেখলাম না। তুমি কী ইউনিভার্সিটিতেও একটু চুজি ছিলে?”
সুপ্রীতি এই বিষয় টা এড়িয়ে যেতে চাইলো। ওদের আট নয়জনের একটা গ্যাং ছিলো। একসাথে ট্যুরে যেত। সেই ট্যুরে মাঝেমধ্যে ইশরাকও অংশগ্রহন করতো। একসময় দেখা গেল ওর বন্ধুরা ইশরাকের বেশী বন্ধু হয়ে গেল ওর চেয়ে।
সুপ্রীতি নিজেই বন্ধুদের এড়িয়ে গেছে। সে কারণে বিয়েতেও ডাকে নি।
“ছিলো দুই একজন। বিয়েতে ডেকেছিলাম আসে নি। বাই দ্য ওয়ে, হঠাৎ এই টপিকে জিজ্ঞেস করলে?”
অর্ণব খেতে খেতে বলল, এক মিনিট।
ফোন বের করে হোয়াটসঅ্যাপ বের করে একটা ছবি দেখালো। খাগড়াছড়ি ট্যুরের ছবি। দুই বছর আগের। ওরা তেরো জন ছিলো। ইশরাকও আছে। যে ছবিটা দেখা যাচ্ছে সেটায় সুপ্রীতি হাসিমুখে বসে আছে। ওর কাঁধে হাত রেখে বসা ইশরাক।
অর্ণব খুব স্বাভাবিক গলায় বলল,
“আননোওন নাম্বার থেকে এসেছে। আদার কোনো টেক্সটও নেই। কি বুঝাতে চাইলো সেটাই বুঝলাম না।”
সুপ্রীতির শিরদাঁড়ায় ঠান্ডা স্রোত বয়ে গেল।
***
ঝিলিক বাড়ি আসার দুদিন পর ফাহাদ ও’কে কল করে জানালো যে পরের সপ্তাহে ও আর ইকরা বিয়ে করবে। বেশী আয়োজন করবে না ওরা থাকবে কিনা সেজন্য কল করেছে। ঝিলিক ফাহাদের কল কেটে দিলো। ফাহাদের বাবাও জানালেন যে এই ছেলের কাছে তার আর কোনো চাওয়া নেই। সে মরে গেলেও যেন না আসে।
নিজেদের কিছু বন্ধু, শুভাকাঙ্ক্ষীদের নিয়ে ইকরা আর ফাহাদ বিয়ে করে ফেলল। ওদের কাছে এমনিতেও এছাড়া আর কোনো অপশন নেই। বিশেষ করে ইকরার।
চলবে….
সাবিকুন নাহার নিপা