#হৃদয়ের_দখিন_দুয়ার
#পর্ব-২৮
ফাহাদ দুদিন ধরে বাসায় আসছে না। কোথায় আছে সেটা ইকরাকে জানায়ও নি। ইকরা যখনই কল করেছে প্রতিবারই সংক্ষিপ্ত কনভার্সেশনে কল শেষ করেছে। আজ বাসায় এলো। বাসায় ঢুকতেই ইকরার প্রশ্নের জেরা শুরু হয়ে গেল।
“তুমি কোথায় ছিলে ফাহাদ? ”
“বাড়িতে গিয়েছিলাম ইকরা।”
“কেন?”
“দরকার ছিলো। ”
“কী দরকার? ”
ফাহাদ ইকরার দিকে তাকালো। একই রকম সুন্দরী, আকর্ষনীয় ইকরা। সেই প্রথম প্রেমে পড়ার মতো। কিন্তু মুগ্ধতার ধরন বদলেছে। যে মুগ্ধতা ছিলো সেটা তিক্ত হতে যাচ্ছে, ফাহাদ চেষ্টা করছে তিক্ততা কমাতে কিন্তু পারছে না। এরকম কৈফিয়ত কেউ ওর কাছে কখনো চায় নি, কেউ না। চোখে চোখ রেখে কোথায় গিয়েছিলে, কেন গিয়েছিলে এই প্রশ্ন করার সাহস এর আগে কেউ দেখায় নি।
“আমার প্রশ্নের জবাব দাও ফাহাদ। কী দরকার ছিলো বাড়িতে। ”
“বাবা, মায়ের কাছে আমার দরকার থাকতে পারে না। ”
“অফকোর্স থাকতে পারে। সেটাই তো জানতে চাচ্ছি যে কী দরকার? তুমি কী তোমার বাবার সঙ্গে প্রোপার্টির ব্যাপারে কথা বলতে গিয়েছিলে?”
“না। ”
“তাহলে? ”
ফাহাদ বসে পড়লো। ও আসলেই অনেক ক্লান্ত। অফিস এখন ও’কে দিয়ে গাধার মতো খাটাচ্ছে। তাদের সিন্ডিকেটে এখন ফাহাদের নাম। যেহেতু ম্যানেজমেন্ট এর কাছে ফাহাদের ইমেজ অলরেডি খারাপ সেহেতু ও’কে সরিয়ে দেয়া সহজ। ও’কে সরিয়ে দিলে বড় বড় প্রজেক্ট গুলো অন্যরা পেতে শুরু করবে।
“ইকরা শোনো, আমি বাবা মায়ের সঙ্গে সহজ সম্পর্ক রাখতে চাই। আমি তাদের বড় সন্তান। তাদের প্রতি দায়িত্ব আমি অবহেলা করতে পারব না। ”
ইকরা তীর্যক হেসে বলল,
“ফাহাদ, তুমি ভুলে গেছ তোমার বোন আমার সঙ্গে ঠিক কী করেছিল?”
“না আমি ভুলে যাই নি। আমি ঝিলিকের সঙ্গে কোনো সম্পর্ক রাখছিও না ইকরা। আর বাবা, মা কেউ ঝিলিক কে শিখিয়ে দেয় নি ওইরকম জঘন্য আচরণ করতে। ”
“আচ্ছা। কিন্তু তারা আমাকে ঘৃনা করেন। বিশেষ করে তোমার বাবা। ”
ফাহাদ হেরো গলায় বলে,
“সেটা সত্যি। কারণ বাবা নাতাশাকে পছন্দ করেন খুব। আমার উপর রাগ থেকে। ”
“ফাহাদ, নাতাশার সঙ্গে তোমার যা কিছু ছিলো সেটা কী আমার জন্য হয়েছে? আমি কিছু করেছি?”
“না।”
“তাহলে আমি কেন তাদের ঘৃনা ফেস করব? ”
ফাহাদ ক্লান্ত গলায় বলল,
“তুমি তোমার মতো থাকবে ইকরা। আমি কখনো ফোর্স করব না। কিন্তু বাবা, মা আর মেয়ের সঙ্গে এইটুকু রিলেশন মেইনটেইন করব আমি। প্লিজ ইকরা। ”
ইকরা কঠিন গলায় বলল,
“না ফাহাদ। কোনোভাবেই না, যতক্ষণ পর্যন্ত তোমার বাবা মা আমার কাছে ক্ষমা না চাইবেন ততক্ষণ পর্যন্ত তুমি তাদের কাছে যাবে না, তাদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখবে না। ইটস নট মাই রিকোয়েস্ট ফাহাদ। ”
ফাহাদ কথা বাড়ালো না। অফিসের রশিদ ভাইয়ের একটা কথা মনে পড়ে গেল হঠাৎ ই। রশিদ ভাই হাসতে হাসতে বলেছিল, ফাহাদ মিয়া তুমি খুব শিগগিরই বিরিয়ানি আর ভাতের তফাৎ বুঝবা। ভাত এমন জিনিস যেটা চাইলে তুমি বিরিয়ানি বানাইতে পারবে। ভাজাভুজি করে ফ্রায়েড রাইস বানাতে পারবা, আবার পানি দিয়া পান্তাও বানাতে পারবা। কিন্তু বিরিয়ানি সবসময় বিরিয়ানিই থাকবে। হজম না হইলে বদহজম ঠিকই হবে। একসময় দেখবা রুচিও নষ্ট হবে। তখন দৌড়ায়ে ভাতের কাছেই আসা লাগবে।
***
নাতাশা প্রকৃতির বন্ধুদের খাবার পাঠাতে শুরু করলো। প্রথম সপ্তাহে আট জন নিতো। এখন চৌদ্দজন নেয়। প্রতি বক্সে এভারেজে ওর ত্রিশ টাকা করে লাভ থাকে। এই কাজটায়ও ভীষণ আনন্দ পাচ্ছে। নির্ভেজাল জীবন বেশকিছুদিন উপভোগ করলেও হতাশা যেন পিছু ছাড়ছিল না। শ্বশুরবাড়িতে রাঁধতে রাঁধতে একটা অভ্যাস হয়ে গেছিলো। সেই অভ্যাস একা থাকতে গিয়ে হারিয়েছে বটে। তবুও মাঝেমধ্যে মনে হতো রেঁধে খাইয়েও ও আনন্দ পেত ভালোই। পালকের দাদু বলতো মাছের টক টা তোমার হাতে খুব ভালো হয় গো মা। দাদী অবশ্য সামনে প্রশংসা করতেন না। খুশি আসার আগে কল করে বলতো, ভাবী চিকেনের মিষ্টি কোরমা কোরো পোলাওয়ের সঙ্গে। বাবুরা ওটা ভালো খায়। ঝিলিকের এটাসেটা বায়নাও ছিলো।
নাতাশা এই সবকিছু ভুলতে চায়, কতটা সময় পেরিয়ে গেছে তবুও সব ভুলতে পারে নি। এখন মনে হয় পারবে। সারাদিন এতো ব্যস্ত থাকে যে পুরোনো স্মৃতি ঘুমানোর সময় মাথায় আসে না। শুয়ে পড়লেই চোখ ভেঙে ঘুম চলে আসে।
নাতাশা ঠিক করলো ফাহাদের কাছ থেকে বাকী দুই লাখ টাকা আর নিবে না। ফাহাদ ঝিলিকের সঙ্গে ঝামেলার সময় কল করে রাগারাগি করেছিল আর বলেছিল আর কোনো টাকা ও দিবে না। এখন পালকের সঙ্গে দেখা করার একটা নাটক করছে। ওই দুই লাখও দিতে চায়। নাতাশা সিদ্ধান্ত নিয়েছে ওই দুই লাখ টাকা মেয়ের নাম করে ও নিবে না। দরকার নেই মেয়ের এরকম বাপের। বাপ, মা দুজনের দায়িত্বই ও পালন করবে।
***
ইশরাক আলতো করে ধরে আছে ঝিলিক কে। ঝিলিকের খোপায় একটা লাল গোলাপ গুজে রাখা। পরনের শাড়িটা গোলাপি রঙের। মাথার উপর বিশাল নীল আকাশ, সামনে সমুদ্র। দাঁড়িয়ে আছে বালির উপর। ফটোগ্রাফার ছবি তুলছে একের পর এক। ঝিলিক কে খুব খুশি লাগছে। ইশরাকেরও ভালো লাগছে, ঝিলিক কে খুশি হতে দেখে অনেক ভালো লাগছে।
“আজ সারারাত আমরা সমুদ্রের কাছে থাকি?”
ইশরাক আনমনে জবাব দিলো,
“হু। ”
“হু না সত্যি সত্যি থাকব। ”
“আচ্ছা। ”
ঝিলিক হঠাৎ অন্যরকম গলায় বলল,
“আমি ভেবেছিলাম তুমি আমার জীবনে সবসময় অপূর্ণ স্বপ্ন হয়েই থেকে যাবে। কিন্তু সুন্দর স্বপ্নের মতন এসে ধরা দিলে। স্বপ্ন ভাঙার ভয় আমি করি। আমি চাই এই মুহুর্ত গুলো ভালো কাটুক, আনন্দে কাটুক। দু’হাত ভরে মুঠোবন্দি করে রাখতে চাই এই মূল্যবান সময় কে। ”
ইশরাক হাসে। মনে মনে বলে,
“বোধহয় তুই আমাকে একদিন ঠিকই পাগলের মতো ভালোবাসিয়ে ছাড়বে। ”
****
“এতো স্ট্রেস কেন নিচ্ছো মা? প্রথমবার মা হচ্ছো, যত পারো আনন্দে থাকো। একদম স্ট্রেস নিও না। ”
অর্ণব দের ফ্যামিলি ডক্টর। বয়স পঞ্চাশের উপর। সুপ্রীতি অন্য ডাক্তারের আন্ডারে আছে। হঠাৎ অসুস্থ হয়ে যাওয়ায় ওনাকে ডাকা হয়েছে। অর্ণব আজ অফিসে গিয়েছিল। খবর পেয়ে ছুটে এসেছে। সুপ্রীতিকে অসুস্থ দেখে উদ্বীগ্ন হবার চেয়ে রাগ হলো বেশী। বিকেলে সুপ্রীতির বাবা, মা, প্রকৃতি এলো। স্বপ্না এবার এসেও বললেন,
“আর কোনো কথা শুনছি না। চল এখান থেকে। ”
সুপ্রীতি ক্লান্ত গলায় বলল,
“যাব না মা। প্লিজ ফোর্স কোরো না। ”
“তোর ইচ্ছেমতো সব হবে না। এখন তোকে বাচ্চা দিতে কে বলেছিল? শরীর ফিট না, বাচ্চা নিয়ে বসে আছিস। ”
অর্ণব আজ স্বপ্নাকে কিছু বলল না৷ মেয়ের শরীর খারাপ দেখে এটুকু অশান্ত হওয়া মায়ের সাজে। অর্ণব সুপ্রীতিকে বলল,
“সত্যিই কী এতো স্ট্রেস নেয়ার দরকার আছে তোমার? ”
“সরি অর্ণব। ”
“সুপ্রীতি আমি শুধু বেবির কথা ভাবছি না। আমি তোমার কথাও ভাবছি। ”
সুপ্রীতি অর্ণবের বুকে মাথা রাখলো। ভেতরটা তোলপাড় হয়ে যাচ্ছে ওর। অর্ণব কে হারানোর তীব্র ভয় ওর ভেতরে। এমন ভালো ও কাউকে বাসে নি। ইশরাক কে ছাড়া একটা জীবন হাসিখুশি ভাবে কাটিয়ে দেয়ার কথা ভাবতে পেরেছিল। সময়ে সব সাধন হবে এটা মেনে নিয়েছিল। কিন্তু অর্ণব কে হারানোর ভয় এতোটা হাহাকার করা যে ভাবলেই নি:শ্বাস, প্রশ্বাস সব বন্ধ হয়ে যায়।
চলবে…..